লাল মেঝে, কালো বর্ডার

অনমিত্র রায়

এই লেখাটা অনেক বছর ধরে আমার মধ্যে ছিল। ঘুমিয়ে ছিল। শ্রুতি গোস্বামীর ‘আমাদের বাড়ি’ সিরিজের চারটে লেখা পর পর পড়ে আচমকা ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। ধন্যবাদ, শ্রুতি।

আমার একটা একক শৈশব ছিল। পাড়ায় কোনো কোনোদিন বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তেমন অন্তরঙ্গতা ছিল না। বাবা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর, মা কাছাকাছি কোনো কাজে বেরোলে আমাকে পাশের বাড়িতে ঠাম্মা, কাকু, কাকিমাদের কাছে রেখে যেত। ওঁরা আমাকে যারপরনাই ভালোবাসতেন, আর আমিও ওঁদের কাছে দিব্যি থাকতাম।

বাড়িটা একটু অন্ধকার অন্ধকার মতো, সামনে একটা কুয়োসমেত বেশ বড়ো একটা উঠোন। সেই উঠোনে ছিল একটা কাঠচাঁপা গাছ। বেশির ভাগ সময়টাই গাছের তলাটা ঝরা ফুলে ভরে থাকত। আর একটা অদ্ভুত, ঘোর লাগা মিষ্টি গন্ধে জায়গাটা ম ম করত।

তবে বিশাল বড়ো বাড়িটার আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণের ছিল দোতলার ঘরটা। কারণ ওই ঘরের মেঝেটা ছিল টকটকে লাল। শুধু তাই নয়, সেই লাল মেঝের চার ধারে ছিল চওড়া, কালো বর্ডার। সেই প্রথম আমার লাল মেঝের প্রতি প্রেম।

এর পর বেশ কিছু পুরোনো দিনের বাড়িতে ‘লাল মেঝে কালো বর্ডার’-এর সুখ উপভোগ করেছি। মনের এক কোণে একটা ছোট্ট ‘চাওয়া’ জন্ম নিয়েছে। পাহাড়চুড়োয় স্বপ্ন ও সুখের কুটো দিয়ে বাড়ি না হয় না-ই হল, যে বাড়িতে আছি সেখানেই অন্তত একটা ঘরও যদি লাল মেঝের ছোঁয়া পেত, বেশ হত!

অবশেষে একদিন স্বপ্নপূরণের সুযোগ এল। বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ হবে। তেমন কিছুই না, শোয়ার ঘরটা রান্নাঘর হয়ে যাবে, আর এক চিলতে সরু বারান্দাটা পেরিয়ে বাড়ির পুব দিকের অংশে পাশাপাশি দুটো ঘর; একটা মা-বাবার, একটা আমার।

তিন সদস্যের পরিবারে দুজনের ঝোঁক ছিল মোজেইক বা টাইলের দিকে, আর আমি নাছোড়বান্দা ‘লাল মেঝে, কালো বর্ডার’।

‘ওরে শোন, তোর স্বপ্নে যে লাল-কালো, সেই মিস্তিরি আজ আর নেই। সেই রংও নেই।’

‘তা হোক, তবু।’

শেষমেষ লাল-কালোরই জয় হয়। প্রথমে হয় মা-বাবা আর আমার ঘরদুটো। সিমেন্টের ওপর ঘন লাল রংটা পড়তে শুরু করতেই আমার অস্তিত্বে শুরু হয় উত্তেজনা। কালো বর্ডার সমেত পুরো ঘর সম্পূর্ণ হওয়ার পর সেদিক থেকে আর কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না। বার বার মনে হতে থাকে বালিশ নিয়ে এসে মেঝেতেই শুয়ে পড়ি।

দিন যায়। মিস্তিরিদের দেওয়া পরামর্শমতো জলে অল্প কেরোসিন দিয়ে রোজ মোছা হতে থাকে লাল মেঝে। একদিন হঠাৎই চোখে পড়ে লাল মেঝের সারা গায়ে কালো কালো ছোপ। কেন? কী করে হল? প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যায়, উত্তর মেলে না।

একটা মন খারাপ নিরুচ্চারে দানা বাঁধতে থাকে। এর পর আসে বারান্দার মেঝের পালা। একদিন ভোরে বাবা বড়োরাস্তার মোড়ে বটতলা থেকে দুজন মিস্তিরিকে নিয়ে আসে। তাঁদের সহকর্মীরা কাজের ফরমাশ পেয়ে চলে গেছেন, কেবল তাঁরা দুজনই রয়ে গেছেন।

তাঁরা এসে জিনিসপত্তর গুছিয়ে কাজ শুরু করলেন। আর আমার শুরু হল এক উদগ্রীব অপেক্ষা। সন্ধে পেরিয়ে (বিশেষ জোরালো আলোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিল) রাতের দিকে যখন বর্ডার ছাড়া  সেই লাল মেঝে জন্ম নিল, তার দিক থেকে আর চোখ ফেরাতে পারি না।

দিন যায়। নানাভাবে বারান্দার লাল মেঝে মোছা হতে থাকে। দিনে দিনে তার রূপ খুলতে থাকে। এক চিলতে সরু বারান্দাটার একটা ধার ঘেঁষে সার দিয়ে জলের ড্রাম, বালতি। ড্রামের শেষ প্রান্ত আর পাশের দেওয়ালের মাঝে চলাচলের জন্য ফাঁক খুব বেশি নয়। তবু।

তবু স্বপ্নে ও জাগরণে মন মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, ‘যাই, একটু হেঁটে আসি।’

One Response

  1. Sushanta Dutta May 18, 2017

Leave a Reply to Sushanta Dutta Cancel reply