শ্যাম সুন্দর মুখোপাধ্যায়
প্রাক কথন : এই কাহিনী যে সময়কার তখন শিশুদের শৈশব ছিল ।সমাজ সংসার ও অভিভাবকেরা শিশুদের মূল্যবোধ শিক্ষায় উৎসাহ দিতেন । কাহিনীর সময় কাল – বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক ।
ছোটখোকার গল্প ১
শিশুটির বয়স সবে পাঁচ পেরিয়েছে ।অনেক দিন আগের কথা । ষাটের দশকের গোড়ার দিক ।ওর ডাকনাম ছোটখোকা ।বড়খোকা একজন আছে,সে ওর দাদা ।সে স্কুলে যায় । ক্লাস ফোরে পড়ে ।আজ ছোটখোকার খুব মজা ।ওর মাসি এসেছে ।মাসি মায়ের থেকে ছোট , তাই মাকে দিদি বলে । বছরে একবার মাসি ওদের মফস্বলের বাড়িতে আসে ।দূর্গা পূজার পরে পরেই । ছোটখোকারা কোথাও যায় না ।বাবার সময় হয় না । মা কোথাও একা একা যেতে পারে না । মা বলে, মাসি একা একা সব জায়গায় যেতে পারে ।
মাসির ছেলে জয় ছোটখোকার থেকে একটু বড়। জয়রা বালিগঞ্জে থাকে । জয় এবার স্কুলে ঢুকেছে, ক্লাস ওয়ান। জয়ের কাছে কোলকাতার কথা, স্কুলের কথা একমনে শুনছিল ছোটখোকা। একসময় তার মনে পড়ল দাদা স্কুলে গেছে, এখন ক্যারম খেলা যায়। একটু আগে ওরা সকালের জলখাবার খেয়েছে। দুপুরে স্নান করতে খেতে অনেক দেরি। দাদা বাড়ি থাকলে ও ক্যারমে হাত দিতে পারে না, ধুন্ধুমার লেগে যায় ।
দুই ভাই ধরাধরি করে ভারি ক্যারম বোর্ড মাটিতে পাতল। জয় স্ট্রাইকার হাতে নিয়ে পাকা খেলোয়াড়ের ভান করে কয়েকটা রিটার্ন মারল খালি বোর্ডে। দুজনেই আসল খেলা জানে না। তারা তালগাছ খেলবে। বোর্ডের মাঝখানে সবকটা গুটি উপর উপর সাজিয়ে তালগাছ বানানো হবে। তার পর খেলে খেলে যে যত গুটি ফেলতে পারে তার ততো পয়েন্ট। কালো গুটি দশ পয়েন্ট, সাদা গুটি কুড়ি আর রেড পঞ্চাশ।
সব খেলার মত ক্যারম খেলার নিয়ম কানুন আছে এবং সেটা মেনেই খেলতে হয়। ছোটখোকা অতশত জানে না। সে মাঝে মাঝেই বেস লাইনের বাইরে স্ট্রাইকার বসিয়ে গুটি মারছিল। এ নিয়ে লেগে গেল ঝগড়া। ঝগড়া কেউ না মেটালে সাধারণত থামে না। তর্কাতর্কি বাড়তে বাড়তে গালাগালি ।
- তোর সঙ্গে খেলব না তুই একটা চোর।
- তুই একটা গাধা।
- তুই বাঁদর, তুই উল্লুক।
- তুই খানকির ছেলে।
জয় এ গালি কোনও দিন শোনেনি কারও কাছে। তার কাছে এ শব্দ একেবারে নতুন। এর প্রত্যুত্তর কি দেওয়া যায় সে ভেবে পেল না। সে খেলা ফেলে তার মাকে গিয়ে নালিশ করল।
মা ও মাসি হৈ হৈ করে ছুটে এল। মাসি ছোটখোকার কানটা পেঁচিয়ে ধরে বললেন – বল, এ রকম খারাপ কথা কার কাছ থেকে শিখেছিস?
- হারানের কাছ থেকে ।
মাসি মার দিকে ঘুরে বললেন – হারান কে রে দিদি?
- আমাদের বাগানের পেছন দিকে একঘর ঘরামি থাকে। ওদের ছেলে। ওর সমবয়সি।
- একদম মিশতে দিবি না ওদের সঙ্গে। ছোটলোকদের মত কথা শিখবে।
মাসি এবার ছোট খোকাকে চোখ পাকিয়ে বললেন – হারানের সঙ্গে আবার যদি মিশিস আর কোনও দিন তোদের বাড়ি আসব না। মনে থাকবে?
ছোটখোকা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল ।
ছোটখোকা বুঝল সে অত্যন্ত খারাপ কথা বলে ফেলেছে। আর, হারানরা ছোটলোক। হারানের সঙ্গে মা আর খেলতে দেবে না।
দুপুরে খাওয়ার সময়, মাটিতে দুটো আসন পাতা পাশাপাশি। জয় আর ছোট খোকা খেতে বসেছে। ভাত আর ডিমের ঝোল। মাসি থালার ভাতের উপর ডিমের বাটি দুটো উপুড় করে দু থালার ভাত মেখে দিলেন। ডিম আলু সব থালার এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। দুজনেরই একটা করে গোটা ডিম। ডিমটা লাল করে ভাজা। ছোট খোকার মা যেরকম সাদা সাদা ডিম করে সে রকম নয়। দুই ভাই খাওয়া শুরু করল।
ছোটখোকা ডিমটা থালার একপাশে জমিয়ে রেখেছে। সব শেষে খাবে। চেটে চেটে থালা পরিস্কার করে ফেলেছে।
মাসি জিজ্ঞাসা করল – কিরে ডিমটা কেমন হয়েছে?
ছোটখোকা চোখ বড় বড় করে বলল – ভালো।
- কেমন ভালো?
- ছোটলোকদের মত।
মাসি বুঝতে পারছে না দেখে ছোটখোকা তার নিজের ভাষায় যা বলল তার মর্মার্থ হল – এরকম লাল করে ভাজা ডিম সে হারাণদের বাড়িতে একদিন খেয়েছে।
মাসি রাগ করলেন না। উল্টে হেসে উঠলেন।
মাকে বললেন – দিদি তোর ছেলেটা হাঁদা আছে, সামলে রাখিস। নাহলে গোল্লায় যাবে।
ছোট খোকার গল্প – ২
ছোট খোকা এখন স্কুলে যায়, ক্লাস থ্রি-এ পড়ে। একদিন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে সে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। পথে পড়ে একটি পাঁচিল ঘেরা একতলা বাড়ি। পাঁচিলের পাশে ভিতর দিকে এক পেয়ারা গাছ। পাকা–ডাঁসা ফল ধরে আছে। পাঁচিল বেয়ে উঠলে ফল পাড়া সহজ ব্যাপার। উৎসাহী কর্মনিপুণ বন্ধু কজন চটপট গাছে উঠে পড়ল। গৃহস্থ টের পাওয়ার আগেই পেয়ারা পেড়ে রাস্তায় নেমে এল। দে ছুট। অকুস্থল থেকে ছুটে পালাল সবাই। ছোট খোকা ভাগে পেল দুটি পেয়ারা। তার পিঠে স্কুল ব্যাগ, দুহাতে দুটো পেয়ারা। একহাতেরটা খাচ্ছে, অন্য হাতেরটা অক্ষত। দিন খারাপ ছিল, বাড়ি ঢুকতেই উঠোনে মায়ের মুখোমুখি। দুই হাত পিছনে চলে গেল পিছমোড়া ভঙ্গিতে।
- হাতে কী দেখাও!
দু হাত সামনে চলে এল। একহাতে ধরা আধখাওয়া অন্য হাতে গোটাটা।
- কোথায় পেলে পেয়ারা, কে দিল ?
দোষ কবুল হল, পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সমেত ।
- ওদের বাড়িতে গিয়ে সব বল। তারপর ওরা যদি পেয়ারা খেতে দেয় তবে খাবে।
বালক তখনই দৌড়োয় মায়ের আদেশ পালন করতে ।
- স্কুলব্যাগ রেখে যাও।
পেয়ারার মালিকের বাড়ি বেশি দূর নয়। অতি কষ্টে পাঁচিলের ভারি গেট খোলে বালক। গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এলেন এক ভদ্রমহিলা।
তিনি গৌরবর্ণা, মধ্যবয়সী, মোটাসোটা। মুখমন্ডল গোলাকার, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, মাতৃস্নহে ভরা মুখ। স্নেহপূর্ণ নরম গলায় জানতে চাইলেন বালকটি কী বলতে চায়। অপরাধবোধ, মায়ের কাছে ধরাপড়া তারপর দোষ স্বীকার করতে আসা। বালকের মন উৎকণ্ঠায় ভরে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই সে দোষ স্বীকার করার চেষ্টা করছে আর ছোট ছোট দুহাত সামনে বাড়িয়ে বামাল প্রদর্শন করছে। একহাতে আধখাওয়া অন্য হাতে গোটাটা।
কিছু বুঝতে না পেরে ভদ্রমহিলা বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। এবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। গৌরবর্ণ, লম্বা ভারিক্কি চেহারা, ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত। যেন বাংলা সিনেমার ছবি বিশ্বাস। বালকের আবেগ এখন অনেক প্রশমিত হয়েছে। সে দু হাত বাড়িয়ে পেয়ারা দেখাল, এক হাতে আধখাওয়া আর এক হাতে গোটা।
- এই পেয়ারা দুটো আমি আপনাদের গাছ থেকে চুরি করেছি। এগুলো নিয়ে নিন। আমায় ছেড়ে দিন। আমি আর কোন দিন পেয়ারা চুরি করব না।
গম্ভীর গলার আওয়াজ বেরল – অ ।
বালক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক বালকের পিঠে হাত রাখলেন। শান্ত স্বরে বললেন – ভেতরে এস।
বালক এক প্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে নীচু টেবিল ঘিরে কুশন দেওয়া বেতের চেয়ার। অঙ্গুলি নির্দেশ মেনে বালক কোন রকমে চেয়ারে বসে। কুশন দেওয়া বেতের চেয়ারে বালকের পক্ষে বসা কঠিন। ব্যালান্স সামলাতে হাত দুটো টেবিলে রাখে।
- চেয়ারে ঢুকে ভাল করে বস। যেটা খাচ্ছিলে ওটা খাও।
বালক বুঝতে পারে পরিস্থিতি সহজ হচ্ছে। গোটা পেয়ারাটা টেবিলে রেখে আধখাওয়াটা খেতে শুরু করে।
একের পর এক প্রশ্ন আসছে উল্টো দিক থেকে। কী নাম, কোন ক্লাসে পড়? কোন ইস্কুলে? বাড়ী কোথায়? বাড়ীতে কে কে আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
বালক পেয়ারা খেতে খেতে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়।
প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জেরা সারলেন। বসার ঘর থেকে ভিতর বাড়িতে গেলেন। একলা হতেই সুযোগ পেয়ে বালক মুখ তুলে ঘরের চারপাশ দেখে নিল।
আবার প্রৌঢ়ের প্রবেশ। বালকের মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন।
ঘরে ঢোকে গৃহকর্ত্রী, হাতে ব্রাউন কাগজের ঠোঙা। ঠোঙাটা টেবিলের উপর রাখলেন, ঠক করে আওয়াজ হল। গৃহকর্তা এবার টেবিলের আস্ত পেয়ারাটা ঠোঙায় ভরে বালকের হাতে দিলেন।
- এটা নাও, এবার বাড়ি যাও। সোজা বাড়ি চলে যাবে।
বালক সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। বাড়ির বাইরে এসে ঠোঙা খুলে ভিতরে উঁকি মারে। এক দৌড়ে বাড়ি।
- মা, দেখ আমায় কতগুলো পেয়ারা ……. ।