হায়দ্রাবাদ নট আউট

বেদদ্যুতি চক্রবর্তী

কতদিন আগের কথা ! ১৩৭০ কোটি বছর !! হায়দ্রাবাদ – কোলকাতা- মগরা- ভিয়েতনাম- রোম- প্যারিস- ইউরেনাস- নেপচুন- সিরিয়াস- বেটেলগিউস- সপ্তর্ষিমন্ডল- কালপুরুষ- অ্যান্ড্রোমিডা- ব্ল্যাকহোল- ব্রহ্মান্ড — সব একাকার হয়ে ছিল একটা ডিমের মধ্যে। কসমিক এগ। মহাডিম্ব। সেটাই ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল। আজ থেকে ১৩৭০ কোটি বছর আগে। সৃষ্টির আপন নিয়মে তৈরি হল সৌরজগৎ। তারমধ্যে পুটকি পৃথিবী। পৃথিবীর মধ্যে বিন্দুবৎ হায়দ্রাবাদ।
হায়দ্রাবাদের ঐ পাথরগুলোর বয়স ২৫০ কোটি বছর ! ঐ যে পর পর পাথরগুলো, ইয়াব্বড়-বড় পাথরের চাঁই আরেকটা পাথরের ওপর কোনরকমে সংক্ষিপ্ত সংযোগে দাঁড়িয়ে আছে ! মনে হবে এই পড়ে গেল বুঝি ! অথচ না। দিব্যি ওরা আছে, কোটি কোটি বছর ধরে। কত প্রাণ-প্রজাতির আসা-যাওয়া। ডাইনোসরের হম্বি-তম্বি। ঝড়-জল-বৃষ্টি, রাত-দিন-বারোমাস।  নীরব সাক্ষী সবকিছুর।
হায়দ্রাবাদ, হায়দ্রাবাদ হল তো হালে ! মোটে ৪২৫ বছর আগে। ছোট-বড়ো অবলা পাথরগুলোর আড়ালে কখন যে ভাগমতী আর কুলি কুতুব শাহের মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল তা আজও ঐ পাথরেই জীবন্ত। রাজা কুলি ভাগমতীকে বিয়ে করে, ভাগমতীর গ্রামের নাম রেখে দিলেন ভাগ্যনগর। বিশ্বস্ত সহচর মমিন আলিকে জানালেন প্রাণের কথা। ভাগ্যনগরে গড়ে উঠবে মস্ত শহর। প্রাসাদ- মিনার- বাগানবাড়ি। স্বপ্ন মূর্ত হল। ভাগমতীকে কুলি ডেকে নিলেন প্রাসাদে। একান্তে। চারমিনারের ওপর তখন টুকরো চাঁদের ভালোবাসা। ভাগমতি তখন “হায়দার মহল”।

‘হায়দার মহল’, সে তো কুলিরই দেওয়া নাম।
এ ভাবে ভাগ্যনগর যে কখন হায়দার মহলের নামে ‘হায়দ্রাবাদ’ হয়ে গেল তাও ঐ পাথরগুলো জানে। শাহ্ জাহানের মুমতাজ মহল তো অনেক পরে। পাথুরে শহর হায়দ্রাবাদে প্রেমের পরশ লেগেছিল তারও অনেক আগে।

প্রেম, অথচ প্রেম নয়। হায়দ্রাফাদের শেষ রাজা (শেষ নিজাম) মীর ওসমান আলির বৌ-এর সংখ্যা ৪৩ বা ৭২। দুই কৌতুহলীর দুই হিসেব। তাদের ঘরে ছেলে-পুলে, নাতি-নাতনি। নিজামের সাম্রাজ্য। একশো বছর আগে (১৯১৭-১৮), হায়দ্রাবাদেই নিজাম গড়ে তুলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের নামেই তার নাম — ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি। পঠন-পাঠন শুরু হল উর্দুতে। কেন বাবা ! তামিল-তেলেগু-কন্নর কী দোষ করল ? এই কারনেই কয়ক শো ছাত্রের বিদ্রোহে উত্তপ্ত হল বিদ্যাক্ষেত্র। অবশেষে তাদের বহিষ্কার। ব্যাপারটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেনি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। অসীম ভরসায় নাগপুর ইউনিভার্সিটির উপাচার্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কৃত ছাত্রদের অ্যাডমিশন দিলেন। এও যেমন সত্যি, এটাও সত্যি যে ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতেই ‘গীতা’-র প্রথম আরবি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। এখানকার বিজ্ঞান গবেষণার হাত ধরে জগৎ চিনল ঐ ছোট্ট জীবানুটাকে। নাম “স্ট্রেপ্টোমাইসেস ওসমানিয়াসিস”। এই জীবানুকেই এখনকার বিজ্ঞানীরা ধানগাছে ছত্রাকের আক্রমণ রুখতে ব্যবহার করতে চাইছেন।

বিড়লা মন্দিরের পাথরে আরও কত ঘটনার অদৃশ্য খোদাই। এখনকার ঐ মন্দিরস্থল আগেকার নওবত পাহাড়। এখান থেকেই নহবৎ বাজিয়ে নিজামের ‘ফরমান’ (আদেশনামা) পথচলতি নাগরিককে জানান দেওয়া হত।
পাশেই হুসেন সাগর। পাথুরে জায়গাটায় যে জলের বড়ই দরকার। দক্ষ স্থপতি হুসেন শাহের তত্ত্বাবধানে হায়দ্রাবাদ শহর পত্তনের আগেই যে বিরাট জলাধার তৈরি হল, গোলকুন্ডার রাজা ইব্রাহিম তার নাম রাখেন হুসেন সাগর। গুগল ম্যাপে দেখলে তাকে মনে হবে হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তার পাশে ট্যাঙ্ক বান্ড। তার ধার ঘেঁষে চৌত্রিশ মনীষির প্রস্থরমূর্ত্তি সুরক্ষিত, সুশোভিত। ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার পিঙ্গালী ভেঙ্কাইয়াও এখানে উপস্থিত। উল্টোদিকে উড়ছে বিরাট একটা তেরাঙ্গা। কাছাকাছি রইল সালার জং মিউজিয়াম। জীবনে বিয়েই করলেন না একসময়ের নিজামের ঐ প্রধানমন্ত্রী। বছর দুয়েক ওসমান আলির প্রধানমন্ত্রিত্ব করলেও নিজামের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেন নি। প্রধানমন্ত্রীর পদ খুইয়ে বিষাদরোগে আক্রান্ত হলেন। বিদেশী চিকিৎসকের পরামর্শে জীবনের স্বাদ খুঁজে পেতে চাইলেন অ্যান্টিক সংগ্রহে। এক জীবনে ৪৩,০০০ অ্যান্টিকের সংগ্রাহক (বইয়ের হিসেব বাদ), বিশ্বে বিরল।

প্রধানমন্ত্রী – পাইগা – জায়গীরদার – নিজাম। সবারই অঢেল ধনরত্ন। ১৯৩৭ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তির মর্যাদা পেয়েছিলেন নিজাম। এখন যে শিরোপা বিল গেটসের মাথায়। ২০ গ্রামের (প্রায়) ‘জ্যাকব ডায়মন্ড’-এর মালিকও ছিলেন এই নিজাম। এখন সেই হীরে নিজামের ১০,০০০ কোটি টাকার রত্নসম্পদের সাথে দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অন্ধকার ঘরে।
ধনরত্ন, অর্থকরী বাড়ানোর নানান উপায় ফেঁদেছিলেন এই নিজামেরা। মীর ওসমান আলিকে প্রজারা দর্শন করতে এলে স্বর্ণমুদ্রা দিতে হত “নজরান” হিসেবে। আর, নিজামের যদি কোনও জিনিস পছন্দ হত, প্রজারা তাকে তা দিয়ে ধন্য হত। মানে, নিজাম তাদের ধন্য হওয়াতেন। এইভাবেই ফলনামা প্যালেস পাইগাদের কাছ থেকে নিজামের আয়ত্তে এল। নিজাম এসমান আলি সেই প্রাসাদকে ব্যবহার করতেন গেস্ট হাউস হিসেবে। এমনই কিপটে ছিলেন, অতিথিদের চায়ের সাথে একটার বদলে দু’টো বিস্কুট দিতেন কুন্ঠাভরে। তালাচাবি মারা আলমারি থেকে বিস্কুটের কৌটো বার করে। আর খেতেন চারমিনার সিগারেট। চারমিনার নামটার ব্যবহার করার অনুমতি দেবার জন্যে, ঐ সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে মোটা টাকাও পেতেন নিজাম।

সেই চারমিনার ! হায়দ্রাবাদের সাথে অচ্ছেদ্য, অভিন্ন।
প্লেগ মহামারির আকার নিয়েছিল একবার। বহুলোক মরল। প্রকৃতির নিয়মে প্লেগ যখন বিদায় নিল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নগরবাসী। মহানন্দে কুলি কুতুব শাহ গড়ে তুললেন চারমিনার। সাত কিলোমিটার দূরের গোলকুন্ডার শীর্ষের সাথে তিনিই নাকি সুড়ঙ্গ কাটিয়েছিলেন। এখনও গোলকুন্ডার ওপরে উঠলে, পাথর দিয়ে বন্ধ করা সেই সুড়ঙ্গর মুখ দেখা যায়। কিন্তু পাথর দিয়ে কি ইতিহাসকে বন্ধ করা যায় ?
তারামতি , প্রেমমতি, তানা শা, আওরঙ্গজেব, হায়াত বক্সী, ইব্রাহিম, জাহাঙ্গীর, ভাগিরথীকে নিয়ে গোলকুন্ডার পাথরগুলোর যে এখনও অনেক গল্প বলা বাকি !
হায়দ্রাবাদ শহরটার নামকরণের ৪২৫ ফছর পেরিয়ে গেল। এখনও সেটা ভীষনভাবেই হায়দ্রাবাদ। ইতিহাসের গায়ে বর্তমানের চাদর মুড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলেছে শহরটা। চলতে থাকুক। নিজেকে আরও সুন্দর করে। এস, আমরাও বাড়াই হাত।

3 Replies to “হায়দ্রাবাদ নট আউট”

  1. আমাদের পাড়ার আশেপাশে, আনাচে-কানাচে এত বিচিত্র আর রোমাঞ্চকর ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে !

  2. কত অজানারে জানাইলে তুমি…..
    বেদা দা খুব ভালো হয়েছে লেখাটা।

    শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *