ভালোদাদু ও মেছোভূত

নীতা মণ্ডল

টিন্টোকে ডাকতে গিয়েছে গোগোল। ভালোদাদু গল্প বলবে। তবে টিন্টোকে বাদ দিয়ে বলবেন না।

‘কী যে হবে!’ তিতলি গভীর চিন্তায় পড়েছে। ও দেখেছে টিন্টো আজ স্কুল থেকে ফেরার সময় আন্টির হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। ওর আর টিন্টোর স্কুল বাস প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছয়। আজ টিন্টোরটা আগে এসেছিল । তিতলি ওকে জিজ্ঞেস করবে কি, আয়ামাসি তখন হাত ধরে হিড়হিড় করে টানছে আর বক বক করছে, ‘তাড়াতাড়ি চল, জামাকাপড় ছাড়তে হবে। খাবার গরম করে দেব। কার্টুন দেখতে দেখতে খেতে তো এক ঘন্টা লাগিয়ে দেবে! ঘুম না পাড়ালে তোমার মা এসে আমাকে মুখ করবে…’

গোগোল ফিরে এসেছে। হাফাতে হাফাতে বলছে, ‘টিন্টোকে আজ আন্টি আসতে দেবে না গো ভালোদাদু। স্কুলে হোঁচট খেয়ে পায়ে লাগিয়েছে।’

‘তাহলে আমরা কি গল্প শুনতে পাব না ভালোদাদু?’ কথা বলার তালে তালে তিতলির বেণীজোড়া দুললেও দুঃখে ঠোঁটদুটো ফুলে ওঠল।

‘ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে টিন্টোর পায়ে লেগেছে। আমার একটুও সিমপ্যাথি নেই। ওর জন্যেই আজ আমাদের গল্প শোনা হল না। যত নষ্টের গোড়া।’ মাটিতে পা ঠুকতে ঠুকতে বলে ঋভু।

মুখে চুক চুক শব্দ করে ভালোদাদু বললেন, ‘ছিঃ ছিঃ দাদুভাই। ‘নষ্টের গোড়া!’এমন কথা শিখলে কোথায়? আর বন্ধুর জন্যে কেউ বলে এরকম?’

মা তো সব সময় আমাকে বলে, ‘যত নষ্টের গোড়া।’

‘আচ্ছা দাঁড়াও…’ বলেই ভালোদাদু থেমে গেলেন। একটু পর বললেন, ‘আসলে এরকম রাগ কারা করে জান? যারা সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সমস্যা তো জীবনে থাকবেই। আর দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান আছে। শুধু মাথাটা ঠাণ্ডা করে সমস্যা নিয়ে ভাবলেই পেয়ে যাবে সমাধান। কক্ষনও এরকম উত্তেজিত হবে না। মনে থাকবে? তোমার মাকেও বলে দেব। এখন ভাব, আজকের ব্যাপারটার কিভাবে সমাধান করা যায়!’

তিতলি অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তুমিই করে দাও না গো ভালোদাদু। তুমি সব পারো। সেবারে কী সুন্দর গল্প বলে আমাদের বুঝিয়ে দিলে, ভূত বলে কিছু হয় না। এখন রাতে টয়লেট যাবার সময় আমি আর মাকে ডাকি না। মা, বাবা কত্ত হ্যাপি…।’

ভালোদাদু তিতলির গাল টিপে দিয়ে গোগলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তো নিজের চোখেই দেখে এলে, টিন্টো দাদুভাইয়ের কি খুব লেগেছে? কী করছিল ও?’

‘সোফায় বসে বসে আন্টির কাছে বায়না করছিল আর পায়ের কাছে একটা রেড কালারের বলে কিক মারছিল। আমিও দুটো মেরেছি। আন্টি আমাকে বলল, আজকে যাও। যত বদবুদ্ধি ওর। পায়ে লেগেছে বলে সব কাজ করে দিতে হবে আর উনি ফুটবল খেলবেন!’ গোগোল টিন্টোর মায়ের বলা ভঙ্গীকে নকল করে বলল।

শুনে ভালোদাদু হো হো করে হেসে উঠলেন।

ঋভু বলল, ‘দাদুভাই তুমি হাসছ? তুমি যে বললে…’

‘আচ্ছা যে পায়ে লেগেছে সে পায়েই কিক মারছে তো? বুঝেছি তোমাদের আন্টি কেন রাগ করেছে। চল চল, গিয়ে একবার মা আর ছেলেকে দেখে আসি।’

গোগোল বলল, ‘বুঝেছি তুমি আন্টিকে পানিশমেন্ট দেবে, যেমন ঋভুর মাকে দাও।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ দাদু। ইউ আর দ্য বেষ্ট দাদু ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’ বলে দাদুর বাঁ হাতের আঙ্গুল ধরল ঋভু। ‘এখন আমরা টিন্টোদের বাড়িতে বসেই গল্প শুনব। কেউ বাদ যাবে না।

ভালোদাদুকে দেখেই টিন্টো তিন লাফে উঠোন পেরিয়ে গেটে এসে পৌঁছল। পেছন পেছন ডান হাত উঁচিয়ে তেড়ে এসেছে টিন্টোর মা। শুধু থাপ্পড়টা পড়ার অপেক্ষা। সামনে ভালোদাদুকে দেখেই স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে নেমে এসেছে হাতখানা। তবে মুখে কথা নেই।

‘এত অপ্রস্তুত হবার কিছু নেই। আমি সব জানি। আমি ঋভুর দাদু।’ বলে ভালোদাদু হাত জোর করে নমস্কার করলেন।

টিন্টোর মা ভালোদাদুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘আমি টিন্টোর মা, সুজাতা। আপনার কথা অনেক শুনেছি। দেখুন না কেমন দুষ্টু বুদ্ধি ছেলের। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি এল। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছি। ছেলের মুখ শুকনো। বলে, ‘আজ হোমওয়ার্ক করতে পারব না। পায়ে খুব ব্যথা। খেতে পারছি না। প্লিজ মা, তুমি খাইয়ে দাও।’ এদিকে খাওয়া শেষ হতেই ওনার আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে। কোথা থেকে ধুলো ভর্তি ফুটবলটা বের করে ওই ব্যথা লাগা পায়েই খেলছে। অথচ আমাকে ছুঁয়ে দেখতে দেবে না কতটা লেগেছে। তাই ওর শাস্তি, আজ পার্কে যাওয়া চলবে না।’

ভালোদাদু টিন্টোর ঝাঁকড়া চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে ওর মাকে বললেন, ‘আহা, খুব লেগেছে গো। চল তো আমি একটু ড্রেসিং করে দিই। এমন ড্রেসিং করব, কাল যদি টিন্টো নিজের হাতে না খায়, তুমি আমাকে শাস্তি দিও।’

গোগোল বলল, ‘তুমি ডাক্তারিও জান ভালোদাদু?’

তিতলি বলল, ‘না ম্যাজিক। ম্যাজিক করে সব কিছু ঠিক করে দেয় ভালোদাদু।’

একটু পরেই টিন্টোদের বসার ঘরের মেঝেয় বসে ভালোদাদু ওর ডান পা’টা কোলে তুলে নিলেন। ডেটল জলে পরিষ্কার করে একটা ব্যান্ডেড লাগিয়ে দিলেন।

টিন্টোর মা ট্রেতে করে দু-তিন রকম বিস্কুট আর দু কাপ চা এনে বলল, ‘মেসোমশাই হাত ধুয়ে নিন। দেখুন না দুষ্টুটার জন্যে আপনার কত…’

ভালোদাদু খুশি খুশি মুখে বললেন, ‘আরে সুজাতার হাতে চা! আমি তো ভেবেছিলাম পরমান্ন গ্রহন করব।’

গোগোল বলল, ‘আমি জানি পরমান্ন মানে পায়েস। দিম্মা বলেছে।’

‘কিন্তু সুজাতার পায়েসের গল্পটা জানো কি?’

‘না তো! আজকে ওটাই বল না ভালোদাদু।’ তিতলি বলল।

‘আজ টিন্টোদাদুভাই যা শুনতে চাইবে সেই গল্পই বলা হবে।’

টিন্টো বলল, ‘তোমার সেই বন্ধু শিবুর গল্প বল। যে খুব সাহসী ছিল।’

ভালোদাদু চায়ের কাপে বড় করে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বাহ এমন চা না হলে কি গল্প জমে! সেবারে তোমরা শুনেছিলে গেছোভূতের গল্প এবার তাহলে হয়ে যাক মেছোভূত।’

সুজাতাও কৌতূহলী চোখে বসে পড়েছে বাচ্চাদের মাঝখানে। কান খাড়া করে আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে।

ভালোদাদু শুরু করেছেন।

(২)

আমাদের বয়স তখন কত হবে এই পনের ষোল। তখন বোর্ডিঙে থাকি। আমার রুমমেট ছিল শিবশঙ্কর আর রমেন। ঘটনাটা অবশ্য শিবশঙ্কর মানে, শিবুদের গ্রামের। সেবারে গরমের সময় শিবুর কাকা এলেন বোর্ডিঙে। ইশকুলের মাইনেপত্র দেবেন আর দুদিনের জন্যে শিবুকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। আসল কথাটা হল ওদের বাগানে আম পেকেছে, কাঁঠাল পেকেছে। একটা বড় পুকুরও মারা হয়েছে। কদিন ধরে বাড়িতে অঢেল মাছ। শিবু না খেতে পাওয়ায় শিবুর মা, ঠাকুমা কিছুতেই সে মাছ মুখে তুলছেন না। এদিকে শিবু বেঁকে বসেছে, আমাকে না নিয়ে বাড়ি যাবে না। কাকা ভদ্রলোক পড়লেন ঝামেলায়। শেষে হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে লিখিত দরখাস্ত দিতে অনুমতি মিলল।

কাকার কাছে একটা সাইকেল ছিল। সেখানা ঠেলে ঠেলে উনি আমাদের সঙ্গেই হাঁটছিলেন। শেষে আমাদের জোরাজুরিতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলেন। বাকি দশ কিলোমিটার আমরা দুইবন্ধু মাঠ, ঘাট, গাছপালা, গ্রাম দেখতে দেখতে, গল্প করতে করতে হেঁটে চললাম। কখনও জমির আলে আলে হাঁটি। কখনও দুপাশে জমির মাঝখানের সরু আঁকাবাঁকা মেটে রাস্তা বেয়ে। একটা সময় শিবু দেখাল দূরে বড় বড় গাছে ঘেরা গ্রামটা ওদের। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘ছায়া সুনিবিড়’। এগিয়ে যেতে যেতে পথে পড়ল একটা বিশাল দীঘি। তবে দীঘির টলটলে ঝলমলে রূপ নেই।

শিবু বলল, ‘এই পুকুরটার নাম শম্ভুসায়র। এই পুকুরের মাছ খাওয়ার জন্যেই আমাদের এই অভিযান। এটার চার আনা ভাগ আমার দাদুর। ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ পাওয়া যায় ভাগে। এবারে তো আবার সব মাছ তুলে নেওয়া হল। আজ তো গাবিয়েছে রে।’

‘গাবানো কী ভালোদাদু?’ কোরাসে প্রশ্ন করল ভালোদাদুর নাতিনাতনিরা।

পুকুর গাবানো মানে হচ্ছে যেটুকু জল তলানিতে পড়ে থাকে তাকে উলোটপালোট করে ছোট ছোট মাছ ধরা। পুকুর গাবালে যে কেউ এসে মাছ ধরতে পারে, তাতে কারোর ভাগ থাক বা না থাক।  ওই কাদা জলের মধ্যে পুঁটি, মৌরলা, চ্যাং, ল্যাটা, বেলে, মাগুর, পাঁকাল এরকম ছোট ছোট মাছ ধরা পড়ে। তাছাড়া ছোট ছোট কাঁকড়া, গেঁড়িগুগলিও ওঠে। শিবু বলল, ‘পুকুর কাটা হয়ে যাক। তোকে বর্ষার পর একবার নিয়ে আসব। দেখবি কেমন কাকের চোখের মত জল টলটল করে। জমিয়ে সাঁতার কাটব তখন।’

আরও কিছুদূর হাঁটার পরে এল ওদের গ্রামের শ্মশান। আমাদের গ্রামাঞ্চলে শ্মশান বলতে, গ্রামের শেষে একটুকরো জমি। কেউ মারা গেলে তাঁর দেহ এনে রাখা হত সেখানে। বাঁশ কেটে ওখানেই তৈরি করা হত খাট। তারপর মুখাগ্নি করিয়ে নিয়ে যাওয়া হত উদ্ধারণপুরে গঙ্গার ঘাটে। সে অনেকটা দূর। যাদের সামর্থ্য নেই তাঁরা লাঘাটার ঘাটেই সৎকার করত।

দেখলাম শ্মশানটার একদিকে রাস্তা আর অন্যদিকে একটা ছোট ডোবা। ডোবার চারিদিকে বাঁশের জঙ্গল, কয়েকটা নিম গাছ আর কিছু বেড়াকলমির ঝোপ। অন্যদিকে শ্মশান আর হাঁটা পথের মাঝে ঝুড়ি নামিয়ে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একখানা বট গাছ।

শ্মশান পেরিয়ে আরও দুচারটে জমির পর গ্রাম শুরু হল। শুরুতেই গোয়ালপাড়া। বাড়ির লাগোয়া বড় বড় গরুর চালা। হাম্বা হাম্বা রব। নাদুসনুদুস ছেলেরা খালি গায়ে খেলে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই একটা ঘর থেকে তুমুল হট্টগোল ভেসে এল। তাই শুনে শিবু আমাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল সেই বাড়িতে।

ঘরে ঢুকে দেখি একজন বিধবা মহিলা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন। উঠোন ভর্তি মানুষ। তারা সবাই কিছু না কিছু বলছে। কিন্তু কে কাকে কী বলছে বুঝে ওঠা দায়। সেই ভিড়ের উদ্দেশে এক ভদ্রলোক চিৎকার করছেন, ‘সব মজা দেখতে এসেছে। কারুর পৌষমাস আর কারুর সর্বনাশ।’

দাওয়ায় বসে আমাদের বয়সী একটি ছেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে শুণ্যের দিকে। আমরা ঢুকতেই এক লহমায় সব চিৎকার থেমে গেল। ভদ্রলোক বললেন, ‘শিবুবাবু আপনি এরকম অসময়ে?’

‘কী হয়েছে তাই জানতেই তো এলাম।’ শিবু উত্তর দিল।

যা জানা গেল তা সংক্ষেপে এই রকম।  এক কোণায় বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছেলেটির নাম সুবোধ। শিবুর সঙ্গে প্রাইমারী ইশকুলে পড়ত। তাকে ঘিরেই যত ঘটনা। ওকে গতকাল রাতে মেছোভূতে ধরেছিল। নিমাই ওঝা সকালে দেখে গিয়েছে। সব লক্ষণ বিচার করে সে বলেছে, এ নারাণ চাটুজ্জে ছাড়া কেউ নয়। চাটুজ্জের মাছে ভারী লোভ ছিল। ছ’মাস পেরিয়ে গেল উনি পরলোকে গিয়েছেন কিন্তু আজও ছেলেরা গয়ায় পিন্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করল না। তাছাড়া শম্ভুসায়রের মাছের প্রতি তাঁর কম লোভ ছিল? কোনও যজমান চাটুজ্জের বাড়িতে মাছ না পাঠিয়ে কোনদিন খায় নি। কিন্তু লোভ যাবে কোথায়! বিশাল ফর্দ মিলিয়ে জিনিসপত্র এনে কালকের মধ্যেই ভূত ছাড়াবে নিমাই ওঝা এই পর্যন্ত ঠিক হয়েছে।

‘শোন কাকা, শোন। নিমাই ওঝাকে বল একদিন অপেক্ষা করতে।’ তারপর আমাকে দেখিয়ে বিজ্ঞের মত করে সুবোধের বাবাকে শিবু অনুরোধ করল, ‘একে দেখ, এও কিন্তু খুব বড় ওঝা। যেমন তেমন না, একবারে ম্যাট্রিক পাস করা শিক্ষিত ওঝা। একবার ধরলেই ভূত কোন দিকে যাবে রাস্তা খুঁজে না পেয়ে সোজা উপরে।’ আঙ্গুল উঁচিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করে শিবু।

আমি তো শুনে হতভম্ব। সত্যি কথা বলতে কি শিবুর মত অত বড় বুকের পাটাও তো নেই আমার। আমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে চোখ টিপে ইশারা করল। তারপর আমরা দুজনে এগিয়ে গেলাম সুবোধের দিকে। সুবোধের কাঁধ ধরে নাড়িয়ে দিয়ে শিবু বলল, ‘কী হয়েছিল একটু খুলে বলতে  হবে আমাকে।’

‘কী করে বলবে বাবা। কালকে মাছের সঙ্গে ওর বাক্যিও কেড়ে নিয়েছে মুখপোড়া ভূত।’ ঘরের এককোণে ঘোমটা ঢাকা একজন স্ত্রীলোক বলে উঠলেন। পরে বুঝলাম উনি সুবোধের মা।

শিবু বলল, ‘বলবে। ততক্ষণে ঘরটা একটু খালি করুন।’

সবাইকে অনুরোধ করে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় সুবোধের বাবা। তারপর পাঁচিলের আগলটা ভেতর থেকে টেনে দেয়। ঘরে আমরা দুজন ছাড়া সুবোধের বাবা, মা আর ঠাকুমা। শিবু আমার ডান হাতটা তুলে সুবোধের মাথায় ছোঁয়াতেই কী হল, আমি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ার ভান করলাম। অমনি সুবোধের মুখ খুলে গেল।

‘শম্ভুসায়রের মাছ নিয়ে কাল কুটুম বাড়িতে বাড়িতে দিয়ে আসছিলাম। দিদিদের বাড়িতে দিয়ে এসে, খয়েরবুনিতে ছোটপিসিদের বাড়ি যাবার কথা। বেরোচ্ছি তখন সন্ধ্যে লাগব লাগব। বটগাছের কাছে আসতে আসতে আঁধার হয়ে গেল। তবুও সাহস করে এগিয়ে গেলাম। গাছের উপর থেকে কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে। শনশন করে বাতাস দিতে লাগল। কানের কাছে ফিসফিস করে বললে, ‘সবাঁই খেঁলি রে, খাঁলি আঁমাকে বাঁদ্দিলি।’ আমি নিঃশ্বাস চেপে রামনাম করছি। আর বুঝতে পারছি আমার হাতের খালুই ধরে কে টানছে। আমি মাছফাছ ফেলে দিয়ে ছুটে পালিয়ে এলাম গো।’ কথা শেষ হতেই সুবোধের অস্বভাবিক দৃষ্টিটা আবার ফিরে এল।

‘তারপর থেকেই ছেলের কী ভয় বাবা! খায় না, দায় না। চোখ বেরিয়ে আসছে। আজ সকালেই পীরতলার মৌলবিসাহেব এসে একবার ঝেড়ে দিয়ে গিয়েছেন। তারপর ওই নিমাই ওঝাও দেখে গেল। কিন্তু কেউ বুলি ফোটাতে পারে নি। এই তোমার আশিব্বাদ পেয়েই কথা কটা বলল।’ বলতে বলতে সুবোধের ঠাকুমার গলা বুজে এল।

শিবু প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘সুবোধ, আমার বন্ধু বলছে তুমি কাল যেরকম সময়ে গিয়েছিলে, আজ ঠিক ওই সময় ওইখানে তোমাকে মাছ নিয়ে যেতে হবে।’

শুনেই সুবোধ গোঙাতে শুরু করল। চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

শিবু একটুও না ঘাবড়ে সুবোধের বাবাকে বলল, ‘কাকা তুমি গেলেও হবে। কোনও ভয় নেই। সুবোধ জায়গাটা দেখিয়ে দিলে ভাল হত। না দেখালেও ক্ষতি নেই। দেখ রাতের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

(৩)

সুবোধদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে না গিয়ে আবার শিবু আমাকে নিয়ে গেল শ্মশানে।

শিবুর মত আমিও খুঁটিয়ে দেখছিলাম চারিপাশ। আর পাঁচটা গ্রামের মতই একফালি জমিতে মৃতদেহকে শেষ বিদায় জানানোর আয়োজন। পরিবেশটা নিজগুণেই থমথমে, নির্জন। বাঁশবন ঘেঁসে কয়েকটা কালিঝুলি মাখা মাটির হাঁড়ি পড়ে আছে। পড়ে আছে কয়েক গুছি কুঁচির কাঠি, কিছু আধপোড়া পাটকাঠি, কয়েকটা ছেঁড়া মাদুর আর কাঁথা।

শিবু হঠাৎ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘ইয়েস, পেয়েছি।’

আমি বললাম, ‘কী?’

উত্তর না দিয়ে বলল, ‘চল বাড়ি যাই, প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। জমিয়ে খেতে হবে।’

সন্ধ্যে লাগার ঠিক আগে আগেই সুবোধের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দিলাম আমরা। সুবোধের বাবার হাতে ধরা মাছের খালুই, তাতে একটা শোলমাছ। বট গাছের কাছাকাছি এসে শিবু বলল, ‘কাকা তুমি এগোও। আমরা গেলে তিনি আসবেন না।’

শিবুর বাবা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল। আমরা শর্ত দিয়েছি আলো জ্বালা চলবে না। যদিও আমাদের জামার তলায় তিন ব্যাটারির টর্চ লুকোনো আছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। একটানা ঝি ঝি ডাকার শব্দ উঠে আসছে বাঁশবন থেকে। এছাড়া বাতাসের একটা শণশণ আওয়াজ। খশ খশ শব্দ হচ্ছে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে । পায়ের পাতার নীচে শুকনো পাতাগুলো মড়মড় শব্দে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমরা আসলে থেমে যাই নি ঠিক সুবোধের বাবার পেছনেই ছিলাম।

হঠাৎ সুবোধের বাবা চিৎকার করে উঠল। সে এক বিকট চিৎকার, নিজের কানে না শুনলে ঠিক বোঝানো যাবে না। কী বলছে কিছুই বোঝা যায় না। ঠিক এমন সময় জ্বলে উঠল আমাদের হাতের টর্চদুটো। দৌড়ে যেতেই দেখি ভদ্রলোক উবু হয়ে পড়ে আছেন।

‘ভয় পাবেন না। কী হল বলুন।’ আমি গম্ভীর গলায় বললাম।

ভদ্রলোক বললেন, ‘ঠিক যেমন কাল সুবোধের সঙ্গে হয়েছিল। প্রথমে আমার মাথায় হাত দিল। তারপর খালুই ধরে টানাটানি…’

শিবুর হো হো হাসির শব্দে শ্মশানের নীরবতা ভেঙে খান খান। হাতের টর্চখানা উপর দিকে জ্বালিয়ে বলল, ‘দেখুন কাকা, ওই যে বটের ডাল ঝুঁকে আছে। ওখানা আপনার মাথায় ঠেকেছিল। দিনের বেলা দেখতে পাই বলে আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আর এই যে বেড়াকলমির আধভাঙা ডালগুলো বেরিয়ে আছে এখানেই আটকে গিয়েছিল আপনার খালুই। যখন আপনার মনে হয়েছে কেউ ওটা ধরে টানছে।’ এদিকে ওদিক টর্চ ঘোরাতেই বেড়াকলমির ঝোপে মাছের খালুই আবিষ্কার হল।

‘এবার বুঝতে পারছেন, কাল ঠিক এই ডালটার তলা দিয়েই গিয়েছিল আপনার সুবোধ। আর বাকিটা ওর দুর্বল মনের কল্পনা। এখনও যদি আপনারা ভূত, প্রেত, কুসংস্কারে মানেন তাহলে কী করা  যায়!’

সুবোধের বাবা লজ্জা পেল। আমরা ফিরে আসতেই দেখি সুবোধদের ঘরে গোটা পাড়া ভেঙে পড়েছে। শিবু যেরকম করে সুবোধের বাবাকে বুঝিয়েছিল, আমি পুরোটা বোঝালাম ওই জনতাকে। তখন সবার কী উত্তেজনা! হ্যারিকেন হাতে দল বেঁধে চলে গেল শ্মশানের দিকে। সরেজমিনে দেখে আসবে। দেখি পেছন পেছন সুবোধও চলেছে। ওর চোখে ভয়ের দৃষ্টি উধাও।

‘ভালোদাদু, তোমার বন্ধু কী ভালো গো! সে নিজেই সব করে তোমাকে হিরো বানিয়ে দিল!’ টিন্টো বলল।

ভালো দাদু হা হা করে হাসলেন।

সুজাতা বলল, ‘যাই আর এক কাপ চা করে আনি।’

‘চা খেতে খেতে সুজাতার পায়েসের গল্পটা বলবে তো দাদু?’ তিতলি বলে উঠল।

‘কিন্তু তার আগে দেখি তো কে বলতে পারে সরেজমিনে কথাটার মানে কি?’ ভালোদাদু একে একে ওদের প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকালেন।

Illustration by Spandan Mondal

2 Comments

  1. Sushanta Dutta May 11, 2017
  2. Subhendu Bikash Chowdhury May 14, 2017

Leave a Reply