মনীষা রায়
বিধান চৌধুরী সারা জীবন পরিশ্রম করে টাকা পয়সা অনেক করেছেন। এমন কী জামসেদপুরের স্টিল কোম্পানির চিফ কেমিস্টের পদ থেকে বিশ্রাম নেবার পরও আবার নানা জায়গায় কন্সাল্টিং-এর কাজ করেছেন। স্ত্রী সুজাতার আপত্তি সত্বেও ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে সল্টলেকে একটা ছোট দোতলা বাড়ি কিনে উঠে এলেন তাঁর সত্তর হবার আগেই। আত্মীয় পরিজন চিরকাল বিধান চৌধুরীকে যথেষ্ট প্রগ্রেসিভ এবং আধুনিক বলে জানেন। নতুন বাড়িতে তাঁর পছন্দ মতো আধুনিক ডিজাইনের ফার্নিচার এল। সুজাতা এত বছরের আসবাব পত্র, পুরোনো ছবি, লেপ-তোষক, জামা-কাপড়, এমনকি শাশুড়ির আমলের হাতের কাজ করা বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকনা এসব বিলিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। পুরোনো রংচটা লোহার ট্রাঙ্কটা ভর্তি করে যখন বাড়ির ঝি সব নিয়ে গেল তখন বুকের ভেতরে একটা ঠান্ডা কষ্ট চেপে ধরেছিল।তাঁদের একমাত্র সন্তান কৌশিক যখন আমেরিকা গিয়েছিল তখনও কিন্তু সুজাতা এভাবে কষ্ট পাননি; জানতেন ঐ বিচ্ছেদটা স্বাভাবিক এবং হয়তো সাময়িক।
সুজাতা জানতেন স্বামীকে এসব কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেবেন, নয়ত ব্যঙ্গ করে কিছু একটা বলবেন। তাতে কষ্ট আরও বাড়বে। এভাবে এত বছরের সংসার ভেঙ্গে সমস্ত ইতিহাস উপড়ে চলে আসাটা অলক্ষুণে বলে মনে হয়ছিল। চল্লিশ বছর আগে যখন চৌধুরী পরিবারে নতুন বৌ হয়ে এসেছিলেন, তখন শাশুড়ি বলেছিলেন, “ তুমিই এখন এবাড়ির কর্ত্রী, আমরা চলে গেলে এ সংসারের পুরোপুরি দায়িত্ব তোমার”। একমাত্র ছেলের বৌ হয়ে সুজাতা সে দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করেছেন।কিন্তু আজ এই বার্ধক্যের সূচনায় সেই প্রতিশ্রুতি ভাংতে হল। হয়ত এই বিরাট পরিবর্তন তাঁর বিবাহিত জীবনান্তের ঘোষণা। কথাটা মাথায় আসা মাত্র সুজাতা সেটা মনের অতলে ঠেলে দিয়েছিলেন। যদিও এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে স্বামীর হৃদয়ের আনাচে-কানাচে কতটা প্রবেশাধিকার পেয়েছেন সেটা এখন জানেন না।
একদিন বিকেলে পুরোনো বাড়ির শোবার ঘরে বসে চা খেতে খেতে স্ত্রীর মুখ ভার দেখে বিধান চৌধুরী হেসে বলেছিলেন, “দ্যাখো, বয়স তোমার আমার কারোরই কমছে না।এই সময় যদি একটু আরাম করে থাকতে না পারি তাহলে এত পয়সা কড়ি রোজগার করে কী লাভ। ঠাকুরদাদার তৈরি বাড়ি যতই শক্তপোক্ত হোক, অ্যামিনিটিস এক্কেবারে নিল। চেষ্টা করলেও সেসব নতুন করে বানানো সম্ভব নয়। তুমিই না বলেছিলে ছেলে-বৌ দেশে বেড়াতে এলে ওদের খুব অসুবিধে হয়। বাথটাব না হলেও একটা আলাদা শাওয়ার স্টল থাকলে বাথরুমগুলো শুকনো রাখা সম্ভব। ফ্লাশটা বছরে ন’মাস কাজ করে না। জয়েসের কাছে রীতিমত অপ্রস্তুত হতে হয়”।
“তা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এতদিনের পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে দেবে? এই বাড়ির ইট কাঠে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কত স্মৃতি জমে আছে। তোমার মনে কষ্ট হয় না? তাছাড়া কৌশিক আর জয়েস আসে তো সেই দু বছরে তিন বছরে একবার।ছেলেপুলে হলে আসা আরও কমে যাবে, দেখো”। “আঃ হা, এর ভেতর আবার সেন্টিমেন্টাল হবার কী দরকার ! তোমার ঐ এক দোষ, হুট করে মন টন টেনে এনে একটা জট পাকিয়ে তোল। চেঞ্জ, — বুঝলে, চেঞ্জ ছাড়া জীবনে নতুন কিছু ঘটতে পারে না। সেই মান্ধাতার আমলে পড়ে থাকলে পৃথিবী এগোবে কী করে ?” তারপর আরও কত কী বলে গিয়েছিলেন বিধান চৌধুরী, যার অনেক কথাই সুজাতার বোধগম্য হয়নি; হয়তো বোঝার চেষ্টাও তেমন করেন নি। সুজাতা কাজ আর অনুভূতি দিয়ে পৃথিবীটা দেখার ও বোঝার চেষ্টা করতেন। বিশ্লেষণ করা তাঁর স্বভাব নয়। তাই পুরোনো জীবন ছেড়ে আসার শোক ভুলতে চেষ্টা করলেন নতুন বাড়ির হাজার কাজে। হয়তো অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলেই এক মাসের মধ্যে বিছানায় পড়লেন। প্রথমে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, তারপ্র নানা উপসর্গ। সলটলেকের হাস্পাতালের বড় বড় ডাক্তাররা অনেক চিকিতসা করেও কিছু করতে পারলেন না।নতুন বাড়িতে উঠে আসার আড়াই মাসের গোড়াতেই মাত্র চৌষট্টি বছর বয়সে সুজাতা তাঁর স্বামীর শখের কেনা নতুন বাড়ি থেকে শুধু নয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিধান চৌধুরী শোকে ভেঙ্গে পড়লেন।
খবর পেয়ে আমেরিকা থেকে ছেলে ছুটে এল। শ্রাদ্ধের পর বাবাকে অনেক পীড়াপীড়ি করল ওর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে ক’মাস থাকতে। জায়গা বদল, হাওয়া বদলে মনটা শান্ত হবে। উত্তরে বিধান চৌধুরী কেবল বললেন, “এখন নয়। তোর মার খুব শখ ছিল হরিদ্বারে যাবেন তীর্থ করতে। ভাবছি সেখানে কিছুদিন কাটাব। তারপর দেখা যাবে। কৌশিক চলে যাবার পর দিন বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেলেন হরিদ্বার। সেখানে এক মঠে কাটালেন ন’মাস। ফিরে এসে আবার যথারীতি পুরোনো জীবনে ফিরে গেলেন – শনিবার গলফ, রবিবার ক্যালকাটা ক্লাবে দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে স্কচ সহযোগে তাস খেলা এবং বাকি সপ্তাহ নিজের বাড়িতে বসে বই, কাগজ-পত্র ঘাঁটা। সপ্তাহে একদিন ছেলের সঙ্গে ই-মেল মারফৎ চিঠির আদান-প্রদান হয়, মাঝে মাঝে ছেলের বৌয়ের নামটাও জুড়ে দেন সম্বোধনে। মাস ছয়েক পর একদিন জয়েসের একটা ই-মেল এল শ্বশুরকে আমন্ত্রন জানিয়ে।‘আপনি আগে আসতে চাননি, এখনতো হল প্রায় দু’বছর, এবার আসবেন কি ? এলে কৌশিক ও আমি খুব খুশি হবো।ই-মেলটা পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন এবারে যাবেন।
একটা সুটকেসে চাকুরি জীবনে কেনা দামি তিনখানা স্যুটের সঙ্গে সুজাতার কয়েকটি গয়না ভরে নিলেন। জয়েসকে তার মৃত শাশুড়ির উপহার হিসেবে দেবেন; ব্যবহার করাটা ওদের ইচ্ছের অপর। সুজাতা এক মাত্র ছেলের বৌয়ের জন্যেই গয়নাগুলো রেখে গেছে।বাড়ির কাজের মহিলাকে দু-মাসের মাইনে সহ তিন মাসের ছুটি দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে প্রতিবেশীদের বললেন, তিন মাস পশ্চিম গোলার্ধে কাটাতে যাচ্ছেন।‘দেখে আসি আমেরিকার মাহাত্ম্য’। বলে হাসলেন। বন্ধুবান্ধবরা খুশি হল যে স্ত্রী-বিয়োগের পর বিধান চৌধুরী আবার তার নিজস্ব ফর্মে ফিরে এসেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির সান হোসে শহরে কৌশিক আর তার বৌ জয়েসের কাছে এক মাস বিশ্রামে কেটে গেল বিধান চৌধুরীর।ইতিমধ্যে উইকেন্ডে ছেলে-বৌ গাড়ি করে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান দেখিয়েছে। গোল্ডেন গেট, নাপা ভ্যালির ওয়াইন কান্ট্রি, ম্যুর এবং রেডউড ফরেস্ট, ইত্যাদি। কোনও কোনও শনিবার কৌশিক আর জয়েসের বন্ধুবান্ধবরা আসে ককটেল বা ডিনারে। এরা সব কম বয়সি ছেলেমেয়ে; বেশিক্ষণ আড্ডা দিতে গেলেই মতভেদ দেখা দেয়। ভদ্রতার খাতিরে বিধান চৌধুরী তখন চুপ করে যান। সারাটা দিন একা কাটে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নানারকম সাপ্তাহিক কাগজ পত্র ঘেঁটে, টেলিভিশন দেখে সময় কাটতে চায় না।ঠিক করলেন ছেলেকে বলবেন যদি কোনও গলফ ক্লাবে যোগ দেওয়া যায়।নয়তো টিকিট বদলে আর এক মাসের ভেতর ফিরে যাবার কথা ভাববেন।
এক সকালে ব্রেকফাস্টের পর রোজকার রুটিন শেষ করে, বেলা এগারোটা নাগাদ দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস আদ্যোপ্রান্ত পড়া হয়ে গেলে বিধান চৌধুরী রান্নাঘরে গেলেন চা বানাতে।এদেশে আসার পর দিনই জয়েস শ্বশুরকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে চা কফি বানাতে হয়। কখনও ভাবেননি এই বয়সে নিজের হাতে চা করে খেতে হবে।
জলের কেটলিটা ইলেক্ট্রিক স্টোভে বসাবার সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজার বেল বেজে উঠল।একটু চমকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখেন এক আমেরিকান মহিলা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন – হাতে একটা প্লেটে চকলেট-কেক। মহিলা বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বল্লেন, ‘আমি মার্গারেট উইলসন, পাশের বাড়িতে থাকি। আপনি যখন এলেন তখন আমি ছুটিতে ছিলাম, তাই দেখা হয়নি। জয়েসকে আমি কথা দিয়েছিলাম মাঝে মধ্যে এসে আপনাকে দেখব। হিয়ার আ য়্যাম’। মার্গারেট উইলসন বিধান চৌধুরীর পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন এবং কাউন্টারের ওপর কেকটা রেখে আবার বললেন, ‘আশা করি আপনি চকোলেট-কেক পছন্দ করেন। আমি নিজে তৈরি করেছি’। যেন কোন এক স্বপ্ন বলে কোথা থেকে এক সোনালি চুলের সুন্দরী তাঁর সামনে আবির্ভূত। মধ্যবয়স্কা হলেও মারগারেটের অবয়বে যুবতির প্রাণোচ্ছ্বলতা। ভর দুপুরে একা একজন সুন্দরী বিদেশী মহিলার সঙ্গে গল্প করার অভিজ্ঞতা নেই বিধান চৌধুরীর। এতক্ষণে তাঁর সম্বিত ফিরে এল। তাড়াতাড়ি নিজের পরিচয় দিয়ে মহিলার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং খাবার টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসতে দিলেন। ইতিমধ্যে কেটলির জল ফুটে একটা তীক্ষ্ণ হুইসেলের আওয়াজ শুরু হল। মার্গারেট তৎক্ষণাৎ স্টোভের সুইচটা অফ করে চায়ের সরঞ্জাম বার করে দুজনের জন্য চা বানাল এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক কথাও বলল।
পনের বছর আগে মার্গারেট তার স্বামীকে হারিয়েছে একটা এক্সিডেন্টে। তারপর থেকে অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। পঞ্চাশ বছর বয়সে তাকে আবার চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। এক কোম্পানিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কাজ করেছে এবং মাত্র তিন বছর হল রিটায়ার করেছে। একটি মাত্র সন্তান লেখা পড়া শেষ করে মিনিয়াপোলিসে গেছে এক হাইস্কুলে পড়াতে। ছেলেকে নিয়ে মায়ের খুব গর্ব, কারণ সে আদর্শবাদী – মাইনে সামান্য হওয়া সত্ত্বেও সে স্কুলের শিক্ষক হয়েছে। প্রায় দু-ঘন্টা অনেক গল্প করল মার্গারেট । এত অল্প সময়ের আলাপে যে একজন মহিলা একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে এতটা স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারে, বিধান চৌধুরী ভাবতেই পারেন না।
বেলা দেড়টা নাগাদ যখন মার্গারেট উঠল তখন তাঁর কেবল মনে হচ্ছিল যদি কোনও অজুহাতে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখা যেত মহিলাকে। তখন লাঞ্চের সময়, খাবার নেমন্তন্ন না করে কাউকে আটকে রাখা অভদ্রতা। তাছাড়া এই কয়েক ঘন্টার আলাপের পর একজন মহিলাকে খেতে বলাটা এখানকার সমাজেও হয়তো ঠিক নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ওকে খাওয়াবেনই বা কী। ওঁর নিজের জন্য ফ্রিজে মাত্র একটা স্যান্ডুইচ তৈরি করা আছে। কৌশিক রোজ সকালে সেটা বানিয়ে রেখে যায়।
অজুহাতের দরকার হল না। সেদিনের পর থেকে মার্গারেট প্রায় প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে দরজায় টোকা দিতে লাগল। কোনও দিন দুজনে হাঁটতে যান একটু দূরে একটা পার্ক অব্দি, কখনও বা ও ড্রাইভ করে নিয়ে যায় শহরের অন্য প্রান্তে পাবলিক লাইব্রেরিতে। ফেরার পথে স্টারবাক্সে কফি খেয়ে বাড়ি ফেরেন। কখনও বা বিধান চৌধুরী মার্গারেট আমন্ত্রণ জানান ওর সঙ্গে বসে স্কচ খাবার জন্য। পেছনের ডেকে বসে দুজন স্কচের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কথা বলেন। বিধান চৌধুরীর কোনও ধারণা ছিল না যে তাঁর এত কথা বলার ছিল। আরও অবাক হন এই ভেবে যে এদেশে প্রতিবেশীরা কেউ মাথা ঘামায় না কে কার সঙ্গে মিশছে, এই নিয়ে। এই স্বাধীনতার মাদকতা যে তাঁকে এক মহিলার সঙ্গে স্কচ পান করার বাইরে আরও কিছু বলা বা করার সাহস জোগাতে পারে সেটা বুঝতে পেরে এই প্রবীন মানুষটি একটু ভয়ও পেলেন। অবশ্য ছেলে-বৌকে মার্গারেটের সঙ্গে তাঁর আউটিং সম্বন্ধে ডিটেল কিছু বলেন না।
এক রবিবার সবাই যখন ব্রেকফাস্ট করছে তখন বিধান চৌধুরী জয়েসকে ও বললেন,’চল না সবাই মিলে আজ বাইরে কোথাও খেতে যাই। আমি খাওয়াবো’। তারপর চায়ের কাপে কয়েকবার চুমুক দিয়ে যোগ করলেন, ‘আচ্ছা তোমার নেবার মার্গারেটকেও ইনক্লুড করলে কেমন হয়। সেদিন আমার নাম করে এত ভাল একটা কেক এনেছিলেন। মানুষটা মনে হয় বেশ ভাল। মাঝে মধ্যে বিকেলবেলা আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসেন – মানে আমি যখন বাগানে জল টল দিতে যাই তখন বেরিয়ে এসে গল্প করেন’।
‘নিশ্চই। লেটস ডু দ্যাট। আই শ্যাল কল হার রাইট নাও।গুড আইডিয়া’। জয়েস সেই রাত্রে বিছানায় কৌশিককে বলেছিল যে তাঁর বাবা আসলে সত্যি কথাটা চেপে গেছেন। কারণ মার্গারেট জয়ে্সকে ইতিমধ্যে বলেছে যে ওর শ্বশুর এবং সে প্রায় প্রতিদিন দেখা করে। কৌশিক এই খবরে খুব একটা খুশি হতে পারল না, যদিও জয়েস হেসে ওকে ঠাট্টা করল, ‘হোয়াট আর ইউ ওয়ারিড অ্যাবাউট ? এটা তো খুব ভাল কথা। লেট দ্য ওল্ড ম্যান হ্যাভ সাম ফান। দে আর বোথ ফ্রি টু ডু সো’।
‘ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড’- বলে কৌশিক অন্য পাশে ফিরে শুয়েছিল। অবশ্য জয়েসের কথাটা তাঁর মাথায় রয়ে গেল।লক্ষ্য করল বাবা যেন আগের তুলনায় একটু বেশি উৎফুল্ল। কথায় কথায় অ্যামেরিকার প্রশংসা, যা আগে করতেন না।
দেখতে দেখতে দু-মাস কেটে গেল। বিধান চৌধুরীর ভিসা যদিও ছ’মাসের জন্য, কিন্তু উনি প্রথম থেকেই বলে রেখেছেন যে তিন মাসের ওপর একটা দিনও তাঁর থাকা সম্ভব নয়। একদিন খাবার টেবিলে কৌশিক বলল, ‘বাবা, তোমার তো দেশে ফেরার দিন প্রায় এসে গেল। আমি ভাবছি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে তোমাকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নটা দেখিয়ে আনবো। জয়েস এই মুহূর্তে ছুটি পাবে না। যাবে?’
‘আরে তাড়া কিসের?’ বিধান চৌধুরী ইংরেজিতে বললেন।‘আমার ভিসা তো রয়েছে ছ’মাসের জন্য। ভেবে দেখলাম একবার যখন এসেছি, নাহয় পুরো সময়টাই কাটিয়ে যাই। তোমরা এত করে বলছো, তাই আগের প্ল্যানটা বদলালাম। আর ইউ হ্যাপি নাও?’ বলে বিধান চৌধুরী হাসি মুখে জয়েসের দিকে তাকালেন।
‘অফকোর্স। উই আর অল ডিলাইটেড’। জয়েস তাড়াতাড়ি কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল। মনে মনে ভাবল, কারণটা সে ভাল করেই জানে। সে রাত্রে আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা হল।জয়েস সাজেস্ট করল মার্গারেটকে ওদের সঙ্গে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যাবার আমন্ত্রণ জানাতে। কৌশিক রেগে মেগে বলে উঠল, ‘আর ইউ আউট অব ইওর মাইন্ড? তুমি এখন তোমার শ্বশুরের বিয়ের ঘটকালি করবে মনে হচ্ছে!’ এই নিয়ে দুজনের বেশ কথা কাটাকাটি হল। জয়েস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কৌশিক কেন তাঁর বাবার সুখে সুখী নয়। তাঁর আপত্তির আসল কারণটা কৌশিক নিজেই জানে না, জয়েসকে কী করে বোঝাবে! তবু চেষ্টা করল।‘মা চলে গেছেন মাত্র দু’বছর হয়েছে।বাবা কী করে এত তাড়াতাড়ি মাকে ভুলে গেলেন?’ তাঁর যুক্তিটা যে একজন অ্যামেরিকানের কাছে অকাট্য নয় সেটা বুঝে আর কথা বাড়াল না।
চার মাস পর একদিন বিধান চৌধুরী ছেলেকে বললেন যে কোলকাতা থেকে তাঁর প্রতিবেশীর চিঠি এসেছে। ওঁর বাড়িতে নাকি চোর ঢোকার চেষ্টা করেছে কয়েকবার। তাই ওঁর দেশে ফেরা দরকার। সেই সঙ্গে আরেকটি কথা বললেন যা কৌশিক একেবারেই আশা করেনি।বললেন, ‘সেদিন কথায় কথায় তোদের নেবার মার্গারেট বলছিল ওর বহুদিনের ইচ্ছে ইন্ডিয়া দেখার। আমাকে এই নিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছে, ও যদি আমার সঙ্গে যায় তাহলে আমি হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারি। প্রথমবার যাচ্ছে কিনা। ওর ছেলেও আমাকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছে। তাই মার্গারেটকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। মাস খানেক থেকে ফিরে আসবে। আমি জানি তুমি আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ চিন্তিত। তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই’। এই বলে তিনি নিজের শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
দু’সপ্তাহ পর কৌশিক ও জয়েস, বিধান চৌধুরী এবং মারগারেটকে সানফ্রান্সিস্কো এয়ারপোর্টে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে তুলে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন কৌশিক স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল,’হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক? আর দে ইন লাভ?’
‘হাও ডু আই নো? হি ইজ ইওর ফাদার’।