রবীন্দ্রনাথ এবং সুভাষ চন্দ্র

কল্পনা রায়

হ্যাঁ, সে প্রায় অনেকদিন হল, প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গেই মনে হয় আজ বুঝি উত্তর আসছেই আসছে। প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় দিন অতিবাহিত হয়, রাত কেটে যায়। ভোর হয়, আবার আরেকটি দিনের প্রতীক্ষা শুরু হল।
রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে একজন বিরাট মাপের মানুষ। দেশে বিদেশে সকলেই তার নাম জানে। আবার এও সকলের জানা আছে যে তার কাছে চিঠি লিখলে দু-লাইন হলেও উত্তর ঠিকই পাওয়া যায়। সুভাষের সাথে তাঁর তেমন হয়ত ঘনিষ্ঠতা নেই, তা বলে উত্তর দেবেন না, তাও কি হয় ? বিশেষতঃ সুভাষ যে একখানা দীর্ঘ চিথি লিখেছিলেন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে, সে চিঠি কি এতটাই গুরুত্বহীন হয়ে পৌঁছবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে?
১৯৩৩ সন ব্রিটিশ সরকার সুভাষকে ইউরোপের স্বাস্থ্যনিবাসে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ইউরোপে এসে চিকিৎসকদের চিকিতসায়, পরামর্শে সুভাষ অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন । নষ্ট স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবু ডাক্তারের নির্দেশে তাকে আরও বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। কিন্তু কেবলই শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে, দিন কাটাবার মানুষ তো সুভাষ নন। অতএব তিনি লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। দেখতে দেখতে কয়েক পাতা লেখা হয়ে গেল।
লন্ডানের একজন প্রকাশক নাম তার Wishart & Company, ঠিকানা – ৯, জন স্ট্রিট, এডেলফিতে তার বাসস্থান – সেই প্রকাশক বাতাসে বাতাসে তার খবর পেল, সুভাষচন্দ্র লিখছেন কিছু। পাতার পর পাতা লিখে শেষ করে ফেলছেন। সে দৌড়ে এসে লেখার জন্য বায়না করল। অগ্রিম টাকাও দিয়েছে। সুভাষ বসু সেই টাকা নিয়ে নব প্রেরনায় নব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নব উৎসাহে লিখতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। তারপর দেখতে দেখতে অনেক পাতা লেখা হয়ে গিয়ে সে এক বিরাট বইয়ের আকার নিয়েছে। বইটির নামও স্থির হয়ে গেছে। ‘The Indian Struggle’। পুস্তকের গোড়ায় Historical Background’ নামে একটি অধ্যায় রয়েছে। তারপর ‘Laming Events’ নামে আরেকটি অধ্যায়।
সুভাষ বসুর দৃঢ় প্রতীতি, পুস্তকের খুবই আদর হবে। আর এ বিশ্বাস কেবল মাত্র সুভাষের নয়, প্রকাশকের আরও বেশি। প্রকাশক রয়্যালটির টাকা আগেই ধরিয়ে দিয়েছে। সুভাষ চন্দ্র আশা রাখেন এই বই ইংল্যান্ড আমেরিকায় অনেক বিক্রি হবে। বই এখন প্রকাশিত হয়নি অথচ এরই মধ্যে এই বই-এর ফারসী এবং জার্মান অনুবাদের কথাও অনেকে ভাবছেন।
সবকিছুই প্রস্তুত। এখন বইটির একটি সুন্দর ‘সূচনা ’ চাই। অর্থাৎ যাকে বলে Foreword।এই ‘Foreword’-এর ব্যাপারেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন সুভাষ চন্দ্র।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত পনেরো দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে চিঠির উত্তর এল। এক বন্ধু লোক অবশ্য আগ বাড়িয়ে এসে বললেন, ‘কি এমন দেরী করেছেন রবীন্দ্রনাথ। পনেরো দিনের মাথায় ইন্ডিয়া থেকে উত্তর এসে গেল’। সুভাষ চন্দ্র বোঝালেন নিজেকে, ‘হয়তবা হবে’। আসলে প্রতীক্ষার সময় দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়। কলেজ জীবনে পাঠ্যবস্থায় বৈষ্ণব পদাবলী কি পড়েননি সুভাষ বসু! সেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রেমকথা। শ্রীরাধার প্রতীক্ষায় “সময়, এক মিনিট” কি ভীষণ বিলম্বিত লয়ে এক যুগে পৌঁছে যায়।

যাক, শেষ পর্যন্ত যে প্রতীক্ষার অন্ত হল, এটাই বড় কথা। চিঠিটি বের করতে করতে উত্তেজনায় কাঁপছিলেন সুভাষ চন্দ্র। চিঠিটি খুলতে খুলতে আনন্দে, আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠছিলেন। আর যখন চিঠিটি বের করে চোখের সামনে ধরলেন, তখন তার মুখ গম্ভীর রক্তিম হয়ে উঠলো। তার প্রচন্ড উৎসাহ যখন টগবগ করে ফুটছে, তখন ঐ চিঠি যেন এক বালতি ঠান্ডা জল হয়ে ঝপাৎ করে তার উপর পড়ে তাকে, তাঁর আনন্দ-উৎসাহকে একেবারে নিভিয়ে দিল।
সুভাষ চন্দ্র লিখেছিলেন দীর্ঘ একটি চিঠি, আর তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন একপাতার ছোট্ট চিঠি। সুভাষচন্দ্র বসু যে অনুরোধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্রনাথ সে অনুরোধ রাখেন নি। ফিরিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সোজাসুজি লিখেছেন, “Bernard Shaw কে আমি ভালোমতই জানি। তোমার বইয়ের পূর্বভাষন লেখবার জন্য তাকে অনুরোধ করতে আমি সাহস করিনে। করলেও ফল হবে না এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তোমার পান্ডুলিপিখানির এক কপি তুমি নিজেই তার কাছে পাঠিয়ে দেখতে পার। এতদিনে সংবাদপত্র যোগে নিশ্চয়ই তিনি তোমার পরিচয় পেয়েছেন”।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সুভাষ আনমনা হয়ে বসে থাকলেন। তিনি রবি ঠাকুরকে H G Wells এবং Bernard Shaw দুজনের কথাই লিখেছিলেন। তার বইয়ের ‘সূচনা’ লেখবার জন্য তিনি এই দুজনকেই মনোনীত করেছিলেন। রবি ঠাকুর H G Wells-এর কথা কিছু লেখেন নি।
সুভাষ বসু মাপের মানুষটি কোন ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে যান না। তিনি রবীন্দ্রনাথকে সোজাসুজি লিখেছিলেন যে, বইয়ের ‘সূচনা’ লেখবার জন্যে ‘Romain Rolland’-র কথা তার মনে হয়েছিল। আর ইতিমধ্যে এদেশে আসবার পর তার সঙ্গে সুভাষের ভালই পরিচয় হয়েছে। কিন্তু তার পুস্তকের ‘সূচনা’ লেখবার জন্য তিনি মোটেই তাকে উপযুক্ত মনে করেন না। কারণ রোমা রঁল্যা প্রচন্ড ‘গাঁধীভক্ত’। আর কেবল ভক্তই বলা যায় না, একেবারে অন্ধ ভক্ত। সুভাষ নিজে গান্ধিজীর অনুসৃত নীতিকে সর্বত ভাবে সমর্থন করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে সোজাসুজি এও লিখেছেন সুভাষচন্দ্র যে, যে কারণে তিনি রম্যা রঁল্যাকে সূচনা লেখবার উপযুক্ত মনে করেননি, সেই একই কারণে তিনি রবিন্দ্রনাথকেও তার বইয়ের সূচনা লেখবার উপযুক্ত মনে করেন না। কারণ রবীন্দ্রনাথ কেবল ভক্তমাত্র নয়, তিনিও গান্ধিজীর অন্ধভক্ত। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে এই রকমই বোধ হয়।
সুভাষ অতো মানুষের মন বুঝে কথা বলতে পারেন না। তোয়াজ টোয়াজ করতে পারেন না। তিনি সরাসরি লিখে দিলেন যে, Bernard Shaw আর H G Wells — দুজনে নিশ্চয়ই গান্ধিজী সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষন করেন, কিন্তু অন্ধ ভক্ত কেউই নন।
সুভাষ বসু রবীন্দ্রনাথের চিঠির উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। সুভাষের অতো বড় চিঠি রবীন্দ্রনাথ কেবল ছুঁইয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁকে যে গান্ধিজীর অন্ধভক্ত বলা হয়েছে, এতে গভীর উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং ঘটা করে ঐ কয়েক ছত্রের উত্তর দিয়েছেন। সুভাষ বসু চিঠিটিকে চোখের সামনে মেলে ধরলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মহাত্মা গান্ধী অতি অল্পকালের মধ্যে সমস্ত ভারতবর্ষের মনকে একযুগ থেকে আরেক যুগে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কেবল একদল রাষ্ট্রনৈতিকের নয়, সমস্ত জনসাধারনের মনকে তিনি বিচলিত করতে পেরেছেন। আজ পর্যন্ত আর কেউ তা করে উঠতে পারেনি। মহাত্মাজীর চরিত্রের এই প্রবল নৈতিক শক্তিকে, ভক্তি যদি না করতে পারি, তাহলে সেটিকেই বলব অন্ধতা। অথচ তার সঙ্গে আমার স্বভাবের, বুদ্ধির ও সংকল্পের বৈপরীত্য অত্যন্ত প্রবল। মনের দিকে, ব্যবহারের দিকে তিনি আর আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর জীব। কোন কোন বিষয়ে তিনি দেশের ক্ষতি করেছেন। কিন্তু দেশের নির্জীব চিত্তে হঠাৎই যে বল এনে দিয়েছেন, একদিন সেটা সমস্ত ক্ষতিকে উত্তীর্ণ করে টিকে থাকবে। আমরা কেউই সমস্ত দেশকে এই প্রাণশক্তি দিইনি”।
চুপচাপ অনেক্ষণ বসে রইলেন সুভাষ। মনে পড়ছে তার, এইখানে আসবার আগে, রবীন্দ্রনাথের সাথে সে দেখা করেছিল। উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একখানা পরিচয়পত্র জোগাড় করা। রবিন্দ্রনাথ সেই পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছিলেন।
গান্ধিজীর কাছেও গিয়েছিলেন। গান্ধিজী প্রথমে বললেন,” পরিচয়পত্র লিখে দেবেন।“ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দেননি। অচেনা মানুষ, অচেনা জায়গা। একটা পরিচয় পত্র থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। তখন মন খারাপ হয়েছিল বটে। কিন্তু তাতে কি আর অসুবিধে হয়েছে। সুভাষ নিজে গিয়ে সকলের সাথে পরিচয় করলেন। এমন কি রোম্যা রঁল্যার বাড়িতে তো একাই গেলেন।
চিঠি হাতে নিয়ে সুভাষ ভাবলেন, “দরকার নেই কারোকে”। অভিমান ভরা হৃদয়ে ভাবলেন, নিজের বইয়ের সূচনা তিনি নিজেই লিখবেন। কাউকে প্রয়োজন নেই তার। সুভাষ নিজেই নিজের পরিচয় হয়ে উঠবেন। লিখতে ইচ্ছে হল তার, লিখলেন। আর অমনি প্রকাশক তার রয়্যালটির টাকা হাতে ধরিয়ে দিল। এ যে রাজকীয় যোগাযোগ! ‘Foreword’-এর জন্য এই বই থেমে থাকবে না। নিশ্চয়ই না।
এতসব ভাবলেন সু্ভাষ। কিন্তু শেষপর্যন্ত যে দেশ থেকে এমন একটি দুঃসংবাদ আসবে, তা কি জানতেন ?
পিতা, জানকীনাথ বসু, প্রবল দেহপীড়ায় আক্রান্ত। সুভাষ বসু বিমান যোগে ভারতবর্ষে রওয়ানা হলেন। করাচি বিমান বন্দরে অবতরণ করে সুভাষ খবর পেলেন, পিতা পরলোক গমন করেছেন। পিতৃশোকে মুহ্যমান সুভাষ। এরই মধ্যে ঘটলো আরেক দুর্ঘটনা । পুলিশ তার জিনিষপত্র তল্লাশি করে ‘Indian Struggle’ বইটির টাইপড কপি বাজেয়াপ্ত করল।
কলকাতায় পৌঁছতে সুভাষ খবর পেলেন, তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশের এই কঠোর দমননীতির প্রতিবাদ দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক ব্যক্তি এই দমননীতির প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এইসব ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আছেন ভারতবর্ষের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের Bernard Shaw আর H G Wells।
এই ঘটনায়, এতো অল্প সময়ে সুভাষ এই তিনজনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন, এতটাই কাছাকাছি যে এই মূহুর্তে সুভাষ এদেরকে দিয়ে ‘সূচনা’ অনায়াসে লিখিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সুভাষ আর ঐ পথে হাঁটলেন না।
সুভাষ মনস্থির করে নিয়েছেন, নিজের বইয়ের ভূমিকা তিনি নিজেই লিখবেন।
পিতার পারলৌকিক কাজ শেষ হল। সুভাষ শর্তাধীনে গৃহবন্দী রয়েছেন ওদের এলগিন রোডের বাড়িতে।
তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেছেন। লিখছেন আর গুনগুন করে সুর ভাঁজছেন। কখনো উচ্চস্বরে গেয়ে উঠছেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে”। এই গানের কি প্রচন্ড শক্তি। নির্জীব প্রাণতন্ত্রীতে যেন বিদ্যুত-তরঙ্গ জাগে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয় প্রাণ। নির্ভীক করে মননকে। আত্মপ্রত্যয়ী সুভাষ লিখে যাচ্ছেন তাঁর বই Indian Struggle-এর সূচনা, Foreword, Preface কিংবা ভূমিকা। An Indian movement from the standpoint of Indian Nationalist… সুভাষ চন্দ্র লিখছেন আর মাঝে মাঝে টেবিলে আঙ্গুলের শব্দ করে সঙ্গত করছেন।
সুভাষ চন্দ্র হাসছেন। মুচকি হাসি। আচ্ছা বোকা বনবে ব্রিটিশ। যতই উঠে-পড়ে লাগো, বই – Indian Struggle – প্রকাশ পাবেই। কারণ মূল কপিটি এখনও প্রকাশকের জিম্মায়ই রয়েছে।

One Response

  1. Chandan Kumar Chaudhuri September 27, 2017