লেখকের অন্তর্ধান

শ্যাম সুন্দর মুখোপাধ্যায়

শিবনাথ নন্দী গত তিনমাস হল নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন না। ড্রাইভার রেখেছেন। রোজ পত্রিকা অফিস যাওয়া-আসা, এদিক ওদিক যাওয়া, সবই ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে যায়। কখনও কখনও তাঁর খুব গাড়ি চালাতে ইচ্ছে করে, কারণ এত দিনের অভ্যাস। কিছুদিন আগে মৃদু হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই। সাবধানে থাকতে হবে, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া আর রেগুলার চেক-আপ বজায় রাখলেই যথেষ্ট। শিবনাথ গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন।

এখনকার নাম করা বাংলা সাহিত্যিকদের তালিকায় শিবনাথ নন্দীর নাম  আসবেই। তিনি জনপ্রিয় হন গল্পকার হিসাবে, তবে ওনার উপন্যাসও আছে অনেকগুলি। টিভিতে আলোচনা অনুষ্ঠানে এখন কবি-সাহিত্যিকদের ডাকা হয়, সেই সুবাদে রাস্তা ঘাটে অনেকেই শিবনাথকে চিনতে পারেন। অন্যান্য অনেক সাহিত্যিকের মতোই শিবনাথ নন্দী এক পত্রিকা অফিসে চাকরি করেন।

অফিসে ঢুকতেই দেখা হল রমেনের সঙ্গে । রমেন মজুমদার হলেন পত্রিকা গ্রুপের যে পাক্ষিক বেরোয়, তার সহ-সম্পাদক । পাক্ষিকের লেখা বাছাই থেকে সমস্ত সম্পাদনার কাজ রমেন করে ।দেখা হতেই রমেন বলল, “আপনার ঘরে যান ,আমি এক্ষুনি আসছি আপনার কাছে”। হার্ট অ্যাটাকের আগে শিবনাথ চেইন স্মোকার ছিলেন। এখন ধুমপান ছেড়ে দিয়েছেন। এই অফিসে সিনিয়র সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের নিজের ঘরে বসে ধুমপানের অলিখিত ছাড় আছে। এখনও কেউ সিগারেট অফার করলে শিবনাথ না বলেন না। রমেন প্যাকেট বাড়িয়ে দিতে তিনি সিগারেট নিলেন ।

  • শিবনাথ দা, আপনি পাক্ষিকের জন্য তিনখানা গল্প দিয়েছিলেন। এগুলো এই মাস থেকে দু মাস অন্তর অন্তর ছাপা হবে।
  • তিনটে গল্পের চেক একসঙ্গে এ মাসে, দিয়ে দিও।

রমেন সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ল। হাতে ধরা কাগজের রোলটা শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে বলল

– দেখুন তো এই তিনটে গল্প আপনার লেখা কিনা।

কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখলেন ওগুলো তাঁরই গল্পের প্রিন্ট আউট।শিবনাথ এখন আর হাতে লেখেন না, ল্যাপটপে লিখে পেনড্রাইভে কপি করে লেখা জমা দেন। গল্প তিনটের প্রথম দু লাইন করে পড়ে উনি বুঝতে পারলেন এগুলো সেই তিনটে গল্প যার কথা এক্ষুনি রমেন বলল। মাত্র দু দিন আগে রমেনকে দিয়েছেন ।

তাই তিনি অবাক গলায় বললেন

– রমেন তুমি কি বলছ, বুঝতে পারছি না।

  • গল্পের লেখকের নাম কি লিখেছেন, দেখুন।

শিবনাথ অবাক হলেন। তিনটে গল্পেই তিনি লেখকের নাম লিখেছেন – বটুকেশ্বর দত্ত।

রমেন বলল

– দাদা, আপনি নামটা কেটে নিজের নাম লিখুন ও সই করে কাগজগুলো দিন।

কাগজপত্র নিয়ে রমেন উঠে গেল ।

শিবনাথের বিমূঢ় ভাব এখনও কাটে নি। নামটা কি করে ভুল লিখলেন। প্লট যখন মাথায় আসে তখন গল্পের শুরু ও শেষটা ভেবে রাখেন। তারপর লিখতে লিখতে কাহিনী তার নিজস্ব পথে এগোয়। প্রায় শেষের কাছাকাছি এসে নাম খুঁজে পান। আর তখনই গল্পের মাথায় গল্পের নাম ও লেখকের নাম বসান।

আজ শুক্রবার, গত বুধবার তিনটি গল্প এক সাথে তিনি রমেনের কাছে জমা করেন। গল্প লেখা শুরু করেছিলেন গত রবিবার সকাল থেকে, তিনটি গল্প শেষ হয় মঙ্গলবার রাতে।

তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ছে, রবিবার সকালে মুখ ধুয়ে চা পান করে, লেখার টেবিলে বসে যান। এরপর তাঁর স্ত্রীর ডাকে ডাইনিং টেবিলে যান প্রাতরাশের জন্য, ফিরে আবার লিখতে বসেন। গল্প শেষ হয় মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে। এইভাবে তিনটি গল্পের লেখার ঘটনাক্রম তিনি পরিষ্কার মনে করতে পারলেন ।

কিছুদিন আগে লেখা গল্প হলেও, গল্প ও গল্প বানাবার পু্ঙ্খানপুঙ্খ শিবনাথের মনে থাকে। যেমন কিভাবে প্লটটা মাথায় এসেছিল, লেখার সময় কি কি পরিবর্তন করেছিলেন। অনেক সময় দু-তিন প্যারা লিখেও মুছে দিতে হয়, অপ্রয়োজনীয় বোধ হলে। কিন্ত এই তিনটি গল্পের ক্ষেত্রে এইসব কিছুই তিনি মনে করতে পারলেন না। এক বিন্দুও না।

বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে সব ঘটনা বললেন ।শিবনাথের স্ত্রী বললেন, “তোমার কিছু হয়নি, ক্রমাগত লেখার চাপ অনেকদিন চলছে। মাসখানেক লেখাপত্র বন্ধ রাখ। চল একমাস দিল্লী যাই, ওখান থেকে উত্তরাখন্ড ঘুরে আসা যাবে”। দিল্লীতে শিবনাথের ভায়রাভাই থাকেন, অনেক বার যেতে বলেছেন।

একমাস দিল্লী উত্তরাখন্ড ঘুরে আসার পর, শিবনাথ আজ অফিসে যোগ দিয়েছে। রমেন দরজা ফাঁক করে উঁকি মারতেই শিবনাথ তাকে ডেকে ঘরে বসাল। একথা, সেকথার পর রমেন যেন কিন্তু কিন্তু করেই বলল, “শিবনাথ দা, আপনার তিনটে গল্পের বাকি দুটো পাক্ষিকে প্রকাশ করা হবে না”।

এরকম তো কখনও হয়নি, বিস্মিত শিবনাথ বলল

– কেন ?

  • সম্পাদক বারণ করেছেন। আর কিছু আমি বলতে পারব না, আপনি সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।

শিবনাথ ঠিক করলেন, তাঁর লেখা প্রকাশ হল না কেন তার কারণ সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করবেন। তিনি চা আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, চা খেয়েই সম্পাদকের ঘরে যাবেন। তাঁর কোথাও যেতে হল না, সম্পাদক নিজেই হাজির ।

বিনা ভূমিকায় শিবনাথ জিজ্ঞাসা করল

  • শুনলাম, আমার গল্প দুটো আপনি হোল্ড করে দিয়েছেন ।

সম্পাদক উত্তর না দিয়ে বললেন

  • আমার ঘরে চলুন সব বলছি।

সম্পাদকের ঘরে এসে শিবনাথ একই প্রশ্ন উত্থাপন করল।

সম্পাদক শুধু বললেন

  • একটু দাঁড়ান।

তার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন ও তাঁর ঘরে রাখা ক্যাবিনেট থেকে একটি ফাইল বার করে টেবিলে রাখলেন। ফাইল থেক এক গোছা ক্লিপ দিয়ে আঁটা কাগজ বার করলেন, শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

  • এ গুলো পড়ুন।

শিবনাথ দেখলেন, সেগুলো কারও হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, হুবহু তাঁর তিনটি গল্পের প্রথমটির যেটি গত দেড় মাস আগে পাক্ষিকে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের নাম ‘বটুকেশ্বর দত্ত’ দেখে শিবনাথ চমকে উঠলেন।

  • এটা তো পাক্ষিকে প্রকাশিত রচনা থেকে কেউ হাতে লিখেছে ।
  • আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম ।

সম্পাদক আরেক গোছা কাগজ শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে বললেন

  • এটা পড়ে দেখুন।

শিবনাথ দেখলেন সেটাও হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এবং গল্পটি হুবহু তাঁর দ্বিতীয় গল্প। লেখকের নাম বটুকেশ্বর দত্ত।

সম্পাদক বললেন, “গতকাল বটুকেশ্বরের স্ত্রী আমার কাছে এসেছিলেন। ওনার স্বামীর লেখা দশটি গল্পের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে। অভিযোগ করেন বটুকেশ্বরের গল্প আমরা আপনার নাম দিয়ে ছাপিয়েছি। বটুকেশ্বর গত বছর মারা যান। উনি শখের লেখক ছিলেন। এখনও অবধি ওনার কোন লেখা, কোন নামী পত্রিকায় ছাপা হয়নি। আমি ভদ্রমহিলার কাছ থেকে লেখাগুলো এই বলে চেয়ে রাখি যে, কোন লেখা মনোনীত হলে তা আমরা পত্রিকায় ছাপব। আরও একটি কথা হল বটুকেশ্বর দত্ত লেখকের ছদ্মনাম।

একটু থেমে সম্পাদক বললেন, “এই অবস্থায় আপনার গল্প দুটো আটকে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না” ।

শিবনাথ চুপচাপ কথাগুলো শুনলেন, একটিও কথা না বলে কক্ষ ত্যাগ করলেন।

 

***

 

অজিত ঘোষাল অকৃতদার। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বয়স সাতান্ন পুরো হল। অজিত সুদর্শন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারি। এখনও তার বয়সজনিত রোগগুলো যেমন – ব্লাড প্রেসার, সুগার, কোলেষ্টরল ইত্যাদি কোন কিছুই ধরেনি। অজিত পেশায় চাকুরে, একটি ছোট প্রাইভেট ফার্মে অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। অজিত ও তার দিদি লেকটাউন অঞ্চলে এক দুকামরার ফ্ল্যাটে থাকে। অজিত ও দিদি পিঠোপিঠি ভাইবোন। দিদিও বিয়ে করেন নি। তিনি পেশায় স্কুল টিচার।

অজিতের একটি বর্ণময় অতীত আছে। স্কুল জীবন থেকেই সে বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর, পাকাপাকি ভাবে পার্টির পূর্ণ সময়ের কর্মী হয়, তাত্বিক নেতা হিসাবে ভাল নাম করে। তার রাজনৈতিক জীবন ভালোই কাটছিল। মধ্য আশির দশকে পার্টি তাকে পৌরসভার কাউন্সেলর হিসাবে মনোনয়ন দেয়। তখন অজিতকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কর্মকান্ড ও লড়াইয়ে নামতে হয়। কাউন্সেলর থাকার সময়ে তার তাত্বিক ধ্যান ধারণার সঙ্গে পার্টির সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার নীতি, প্রক্রিয়ার মধ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অজিত নিজেকে কৌশলী রাজনীতিক হিসাবে পরিবর্তিত করতে ব্যর্থ হয়। সে অকালে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করে।

রাজনৈতিক জীবনে তার অনেক সাংবাদিক বন্ধু ছিল। আজ আর কারও সাথে যোগাযোগ নেই, একজন ছাড়া। সে হল সৌমিত্র মজুমদার। মাসে একদিন বা দু’দিন অজিতের বাড়ি তাদের দু’জনের পান ভোজনের আড্ডা বসে সন্ধ্যাবেলা। আজ সন্ধ্যাবেলা সেই আড্ডা হওয়ার কথা।

সৌমিত্র অনেক তাড়াতাড়ি এসে গেছে। শীতের বেলা, যদিও অন্ধকার নেমে এসেছে, ঘড়িতে সময় মাত্র সাড়ে ছটা। অজিত দ্রুত হাতে হুইস্কির বোতল, গ্লাস ও খাবার দাবার ছোটো টি-টেবিলে সাজিয়ে ফেলল।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে সৌমিত্র বলল, “অজিত দা, সাহিত্যিক শিবনাথ নন্দী আজ দুপুরে মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল সত্তর বছর। এটা ধরুন দু’হাজার ষোলো, মানে প্রায় দশ বছর আগে দু’হাজার ছয় সালে, সাহিত্য জগৎ থেকে উনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর উনি কোলকাতা ছেড়ে কোথায় যে চলে যান কেউ জানত না। মিডিয়া তার খবর জানার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন খবর পায় নি। বেমালুম নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।

  • তুমি খবর পেলে কি করে ?
  • হরিদ্বারের একটি ছোট নার্সিংহোম থেকে ই-মেলে পত্রিকা অফিসে খবর এসেছে। উনি শেষ ইচ্ছা জানিয়ে ছিলেন যে তাঁর মৃত্যু সংবাদ যেন আমাদের পত্রিকায় জানানো হয়। উনি সারা জীবন এই পত্রিকায় কাজ করেছেন। দিল্লী থেকে আমাদের সংবাদ টিম হরিদ্বার পৌঁছে গেছে। কালকের কাগজে খবর ছাপা হবে।

অজিত উদাস হয়ে যেন কি ভাবছে। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষন করে সৌমিত্র বলল, “জানেন তো অজিত দা, শিবনাথ নন্দী গত দেড় বছর কোলন ক্যানসারে ভুগছিলেন”।

অজিত বলল, ‘জানি’।

অভিজ্ঞ সাংবাদিকের কান কথাটা এড়ালো না। সৌমিত্র চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল – “জানি বললেন, আপনি জানতেন শিবনাথ নন্দী কোথায় ছিলেন? আমাকে বলেন নি”!

দুজনের গ্লাসই খালি হয়ে গেছে। অজিত দুই গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন, অনুপাত করে সোডা মেশালেন। সৌমিত্র সাহায্য করতে দুটো করে বরফ কিউব দুই গ্লাসে দিল।

গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে অজিত বলল, “শিবনাথ বাবু ওনার কথাটা গোপন রাখতে বলেছিলেন। এখন উনি আর নেই, তোমাকে সব বলতে পারি”।

সৌমিত্র উত্তেজনায় এতক্ষণ হাতে, ভরা গ্লাস ধরে রেখেছিল, চুমুক দিতে পারেনি। সে একচুমুক পানীয় গলাঃধকরণ করে বলল, “বলুন অজিতদা, সব খুলে বলবেন”।

অজিত বলতে লাগল, “আমার সঙ্গে শিবনাথের দেখা হয় গত বছর উত্তরাখন্ডের কংখলে। তোমরা, অর্থাৎ যারা আমার পরিচিত, সকলেই জানে নভেম্বর মাসটা আমি কংখলের আশ্রমে থাকি। একা যাই, ওখানে গেলে আশ্রমের একটা ঘর আমার জন্য দেয়। আশ্রমের আধ্যাত্মিক পরিবেশে থাকা, সাত্ত্বিক আহার ও হিমালয়ে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে কিছুদিন নিজেকে বিলিয়ে দিই। সেই উদ্দেশ্যে গত বছরও কংখল গেলাম। সকালবেলায় আশ্রমে পৌঁছলাম। অপেক্ষা করতে হল। নটায় অফিস খুললে জানতে পারলাম কোনও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না। কিছু ঘর সারানো হচ্ছে, আর বাকিগুলোর বুকিং হয়ে আছে। অফিসের কথা বিশ্বাস না করে, প্রতীক বাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। মনে আশা ছিল উনি ঠিক কোন ব্যবস্থা করে দেবেন। ওনার হাতেই আশ্রমের পুরো তদারকি, ওনার কথাতে সব কাজ হয়। প্রতীকবাবু রিটায়ার্ড মানুষ, ঘর সংসার সব ছেড়ে আশ্রমবাসী হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থার অতি উচ্চ পদে ছিলেন।

প্রতীকবাবুকে ওনার ঘরে পাওয়া গেল। স্নান আহ্নিক সেরে মন্দিরে যাওয়ার জন্য রেডি। সব শুনে আমাকে বললেন, “তুমি আমার ঘরে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি মন্দির ঘুরে আসছি”। তার পর আমরা চা, জল-খাবার খেয়ে বেরোব, তোমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

পথে যেতে যেতে প্রতীক বললেন, “তোমাকে এখন আনন্দ বাবার কাছে নিয়ে যাব। উনি আমার মতো সংসার ছেড়ে বিবাগী জীবন যাপন করছেন। ওনার নিজের ছোট বাড়ি আছে। একটু আগে ফোনে কথা বললাম, অনুরোধ রেখেছেন। তুমি থাকতে পারবে ওখানে। কোন রকম ভাড়া দেওয়া বা পয়সা কড়ির কথা ওনার সঙ্গে ভুলেও উত্থাপন করবে না। মনে রাখবে উনি উচ্চ কোটির মানুষ, আমার তোমার মত সাধারণ নন। তুমি রাত্রে ওখানে শোবে আর সারাদিন আশ্রমে থাকবে”।

কথা বলতে বলতে প্রতীক একটি বাড়ির সামনে থামল। কাঠা ছয়েক জমির উপর ছোট বাংলো প্যটার্নের বাড়ি। বাড়ির সামনে সুন্দর বাগান, ফুল আর পাতা বাহার গাছ। বাড়ি ও বাগান উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। গেট খুলে ঢুকতেই দেখা গেল, বাগানে এক ব্যক্তি গার্ডেন চেয়ারে বসে আছেন। আমরা দুজন কাছে যেতেই তিনি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। প্রতীক বাবুর দেখাদেখি আমিও তাঁকে পা ছুঁয়ে প্রনাম করলাম। দীর্ঘকায় সৌম্য দর্শন পুরুষ, মুখমন্ডল ধবধবে সাদা গোঁফ দাড়িতে ঢাকা, লম্বা সাদা চুল কাঁধ ছুঁয়েছে। উন্নত নাসা, দীঘল চোখ, মুখমন্ডলে ছড়িয়ে আছে সাধু সুলভ প্রশান্তি। দর্শন মাত্র মনে ভক্তি আসে। পরনে সাদা ধুতি, সাধুদের মত ফেরতা দিয়ে পরা, ঊর্ধাঙ্গে সাদা ফতুয়া।

আনন্দ বাবা বাড়ির দিকে মুখ করে বললেন, “লক্ষণ দুটো চেয়ার দাও এখানে”। আমরা বসলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, এবার প্রতীক বাবুর দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে মৃদু হাসলেন। আমার নাম, কোথায় থাকি, কি কাজ করি ইত্যাদি কয়টি মামুলী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। আবার ডাকলেন লক্ষণকে। আনন্দ বাবা বললেন, “লক্ষনের সঙ্গে যাও, ও তোমাদের ঘর দেখিয়ে দেবে”।

সুন্দর সুসজ্জিত বড় ঘর, লাগোয়া বাথরুম। প্রতীক বাবু ঘর দেখে রসিকতা করে বললেন, “অজিত এখানে টিভি থাকলে তো এটা ফোর ষ্টার অ্যাকমোডেশন হয়ে যেত”।

লক্ষণের কাছ থেকে জানা গেল, এই বাড়িতে এই রকম বড় ঘর তিনটি। একটি ঘর ওনার পূজার ও কাজের ঘর, আরেকটি শোয়ার জন্য। একটি ছোট ঘর আছে সেটা স্টোর রুম, সেখানে লক্ষণ রাত্রে শোয়। আমার থাকার ঘরটি গেষ্ট রুম।

আরেকটা কথা লক্ষণ বলল, “ঘরে তালা লাগাবেন না ।আমি সব সময় এখানে থাকি”।

বেশ কাটছিল দিনগুলো। সারাদিন আশ্রমে কাটাই আর রাত্রে আনন্দ বাবার নিবাসে শুতে যাই। কোন কোন দিন বেরোনোর সময় দেখি আনন্দ বাবা বাগানে বসে আছেন, আমি হাত জোড় করে নমস্কার করি আর উনি হাত তুলে আশীর্বাদ করেন।

পানীয় গ্লাসের তলানীতে ঠেকেছে, দু’জনেই লম্বা চুমুকে গ্লাস খালি করল। এবার গ্লাস ভরল সৌমিত্র।

অজিত আবার বলতে শুরু করল, “সন্ধ্যারতি ও ভোগের পর আশ্রমে রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। আমি রাত নটার আগেই নিবাসে ফিরে আসতাম। সেদিন একটু আগেই ফিরে ছিলাম, আর দুদিন বাদে এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে কোলকাতা ফিরতে হবে। ঘরে ফিরে জিনিষপত্র অল্পস্বল্প গুছিয়ে রাখছিলাম। খোলা দরজায় লক্ষণ এসে দাঁড়াল, বলল “মহারাজ আপনাকে ডাকছেন”।

লক্ষণের পিছন পিছন এসে একটি ঘরে ঢুকলাম। ঘরটি বেশ বড় আকারের, প্রায় ফাঁকা। আসবাব বলতে আছে লেখার টেবিল চেয়ার, দুটো সোফা, চায়ের টেবিল আর একটি প্রমান সাইজের স্টিল আলমারি। ঘরের এক দেওয়াল ঘেঁষে সুন্দর ঠাকুরের সিংহাসন, বাবার পূজার জায়গা।

আনন্দ বাবা সোফায় বসে ছিলেন, তাঁর মুখোমুখি সোফায় আমাকে ডেকে বসালেন। ইঙ্গিতে লক্ষণকে ঘর ছেড়ে যেতে বললেন। আমি আর বাবা একলা বসে আছ, বাবা আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। অস্ব্স্তি হচ্ছে, একবার ভাবলাম অস্বস্তি কাটাতে উঠে গিয়ে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করি অথবা আমিই মুখ খুলি, কেন ডেকেছেন জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু যেন সম্মোহিত হয়ে বসে আছি, কিছুই করতে পারলাম না।

মুখ খুললেন আনন্দ বাবা, “তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি একটি উইল বানাচ্ছি তাতে তোমাকে উইটনেস থাকতে হবে”।

একটু ভেবে নিয়ে আমি বললাম, “বাবা, আমি তো আপনাকে চিনি না, মানে সেই রকম ভাবে চিনি না। আপনি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন তো”।

আনন্দ বাবা বললেন, “সে তো ঠিক কথা। আমারই উচিত ছিল প্রস্তাবটা দেওয়ার আগে নিজের পরিচয় দেওয়া। আমার নাম শিবনাথ নন্দী। পূর্বাশ্রমে আমি লেখক বলে পরিচিত ছিলাম”।

আমার তখন যে অবস্থা, তা মুখে বলা অতীব কঠিন। উনি শুধু বিখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক নন, আমার প্রিয় সাহিত্যিক, আমাদের লেকটাউনের বাসিন্দা। সবচেয়ে বড় কথা ওঁর স্ত্রী ছিলেন আমার দূর-সম্পর্কের দিদি। নিজের কোন ভাই ছিল না বলে আমাকে ভাই-ফোঁটা দিতেন। এক সময় প্রায়ই ওনার বাড়ি যেতাম।

  • আপনি আমাকে চিনতে পেরে ছিলেন।
  • খুব, নীতার ভাই তো। আগে আমাদের বাড়ি কত আসতে। একবার কমিশনার হয়ে ছিল পৌরসভার। তা এখন কি খবর তোমার?
  • রাজনীতি অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি, এখন চাকরি করে পেট চালাই।

মনের মধ্য যে প্রশ্নটা তোলপাড় করছে তাকে প্রকাশ করা যাচ্ছে না, মনের সংযম ও সহবৎ তাকে আটকে রেখেছে। সকল বাধা দূর করে বলে বসলাম, “আপনার লেখা অনেক দিন পাই না কোথাও”।

  • আমি লেখা ছেড়ে দিয়েছি দু’হাজার ছয় সাল থেকে।
  • কেন লেখা ছাড়লেন হঠাৎ।

আনন্দ বাবা কোন উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “সাড়ে নটা বাজতে চলল, আমাকে শুতে যেতে হবে”।

যেদিন থেকে এখানে এসেছি সেদিন থেকে প্রতিদিন লক্ষণ ঠিক সকাল সাতটায় এক কাপ চা আর দুটি বিস্কুট আমাকে দিয়ে যায়। আজ চা, বিস্কুট দিয়ে সে বলল, “আজকে রাতের খাওয়া আপনি মহারাজের সঙ্গে খাবেন”। আটটার মধ্যে চলে আসবেন।

একটি ছোট ডাইনিং টেবিলে বারান্দায় আমরা দুজন খেতে বসেছি। ভাত, ডাল, ভাজা আর আলু পটলের তরকারি। আনন্দ বাবার খাবার অন্য রকম। একটি বড় জাম বাটিতে খিচুড়ি বা ডালিয়া গোছের কিছু খাদ্য দ্রব্য, উনি চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাচ্ছিলেন।

খাওয়ার পরে আমরা আবার ওনার কাজের ঘরে বসলাম। উনি বললেন, “আমি আত্মগোপন করে আছি, আমার আসল পরিচয় প্রতীক ছাড়া আর কেউ জানে না”। এখন তুমি জানলে। তুমি এই তথ্য আমার জীবিত অবস্থায় কাউকে জানাবে না। আমি বললাম, “আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন”।

উনি বলে চললেন, “আজ আমি যে ঘটনা বলছি, সেটা আগে কেউ কোন দিন শোনেনি। অবিশ্বাস্য ঘটনা। হয় তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে, নয় আমাকে চোর মনে করবে”।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, হতবাক হয়ে ওনার কথা শুনে যাচ্ছি।

আনন্দ বাবা বলে চলেছেন “দু’হাজার ছয় সালে, পুজোর পর আমি পত্রিকায় তিনটি গল্প দিই। তার একটি ছাপা হওয়ার পর পত্রিকা অফিসে এক ভদ্রমহিলা সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে বলেন, গল্পটি তাঁর মৃত স্বামীর লেখা এবং সেটা আমার লেখা বলে চালানো হয়েছে। ভদ্রমহিলা প্রমাণ হিসাবে তাঁর স্বামীর হাতে লেখা পান্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার তার মধ্য দুটি গল্প ছিল যে দুটি ছাপার জন্য জমা দেওয়া ছিল এবং পাক্ষিকে তখনও প্রকাশিত হয়নি। তারা হবহু এক ছিল, মায় দাড়ি কমা শুদ্ধু। কিন্তু আমার থেকে বেশি কেউ জানতো না যে, ওই গল্প তিনটির প্রতিটি শব্দ আমার সৃষ্টি। সম্পাদক মহাশয় ডেকে যখন এই অভিযোগ করলেন, যখন আমাকে পান্ডুলিপি গুলি দেখালেন, তখন আমি একটা কথাও ওনাকে বলতে পারিনি। অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসলাম। স্ত্রীকে মানে তোমার নীতাদিকে সব খুলে বললাম। কি করে এই ঘটনা ঘটল তার কোনও উত্তর আমরা কেউ খুঁজে পেলাম না।

পরদিন রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকা অফিসে, চিঠিতে অনুরোধ জানালাম আমার যা কিছু বকেয়া আছে তা যেন আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। সেই দিনই ফ্লাইটে আমরা দুজন দিল্লী হয়ে চলে আসলাম হরিদ্বারে। কিছুদিন পর কংখলের এই বাড়িটা কেনা হল। একমাত্র ছেলে, তুমিতো জানো আমেরিকাবাসী, সে জানল, বাবা মা সংসার ছেড়ে বিবাগী জীবন যাপন করছে। তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়, কিন্তু তাকে দেখা করতে বারণ করা আছে।

আনন্দ বাবা প্রশ্ন করলেন – তুমি অতীন্দ্রিয় ঘটনা বিশ্বাস কর?

আমি বললাম – বিশ্বাস করার মত জীবনে কিছু ঘটেনি, তাই বিশ্বাস নেই।

আনন্দ বাবা বললেন – ঠিক কথা বলেছ।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে উনি বলতে শুরু করলেন।“হরিদ্বারে আসার মাসখানেক পরের ঘটনা। আমরা তখন যোশীমঠে এক আশ্রমে থাকি। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে নানা ব্যস্ততায় কাটে, কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় মানসিক যন্ত্রনা, বিনিদ্র রজনী প্রায় মধ্য রাত অবধি। রাতের খাওয়া খেয়ে বিছানা নিয়েছি। আধো নিদ্রায় আচ্ছন্ন, ….কোন সুদূর থেকে ডাক আসছে …শিবনাথ, শিবনাথ। মশারির পাশে আমার পায়ের দিকে আবছা মনুষ্য অবয়ব যেন দেখতে পেলাম। মুখ দেখে চেনার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে মুখ চেনার মত প্রকট হচ্ছে না। সারা শরীর মনে স্তম্ভন, জিজ্ঞেস করতে চাই ‘কে আপনি’, গলা থেকে স্বর বেরোয় না। শিবনাথ, আমি অনিন্দ্য, তোমার স্কুলের বন্ধু, বাজারের মোড়ে আমাদের বইয়ের দোকান ছিল। মনে আছে স্কুলের ম্যাগাজিনে তোমার আর আমার গল্প বেরোত। আমি লিখলেই তোমাকে পড়াতাম। তুমি বলতে আমি একদিন নাম করা লেখক হব। শিবনাথ, আমি অনেক লিখেছি কিন্তু নাম করা লেখক হতে পারিনি। শিবনাথ তোমার হৃদয় অনেক বড়। আমায় ক্ষমা করো। তোমার এ অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি তোমার মন কে দখল করে গল্প তিনটি লিখিয়েছি। আমার স্ত্রীকে দোষ দেব না। উনি আমার সব গল্প লেখা হলে পড়তেন। আমাকে না জানিয়ে বিখ্যাত পত্রিকায় পাঠাতেন। মাস যায়, বছর যায়, অপেক্ষা করতেন। যদি একটিও কোন নামী পত্রিকায় বেরোয়, যদি আমি স্বীকৃতি পাই। শিবনাথ আমি খুব অন্যায় কাজ করেছি। আজ আমি তোমাদের জগতে নেই। তুমি আবার লেখা শুরু কর।

শরীর মনে সাড় ফিরে আসছে, মনুষ্য অবয়ব মিলিয়ে গেছে। বিছানা ছেড়ে ঘড়ি দেখলাম – রাত সাড়ে তিনটে।

আনন্দ বাবা এতদূর বলে চুপ করে রইলেন। আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে বসে আছি।

  • এ কথা শুধু আমার স্ত্রী জানতেন। উনি আর ইহ জগতে নেই। দু’বছর হল আমায় একলা করে দিয়ে গেছেন। এখন আমি ছাড়া তুমিই এক মাত্র এ কথা জানলে। আমার মৃত্যুর আগে একথা প্রকাশ কোর না।
  • কিন্তু এ কথা আমাকে বললেন কেন?
  • নিজেকে ভারমুক্ত করার জন্য।

ঘড়িতে রাত নটা কুড়ি বাজে। উনি বললেন, “কাল দশটার সময় উকিল উইলের কাগজ পত্র নিয়ে আসবে”। তুমি থেকো, প্রতীকও আসবে।

উইলে আনন্দ বাবা ওনার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তাঁর অবর্তমানে কোলকাতার এক মিশনকে দান করেছিলেন।

আশ্রমে যাওয়ার পথে প্রতীক বাবু জানিয়ে ছিলেন যে, আনন্দ বাবার কোলন ক্যানসারের শেষ স্টেজ চলছে, আর হয়তো মাস ছয়েক বাঁচবেন।

অজিত বলল, “এই হল শিবনাথ নন্দীর পুরো কাহিনি। সৌমিত্র তুমি ঘটনাটা লিখে কালকের কাগজে ছাপিয়ে দাও”।

সৌমিত্র বলল, “আমি লিখতে পারি কিন্তু এডিটর ছাপবে না”।

 

Leave a Reply