বাঙাল থেকে বাঙালি

সুদর্শনা ধর

bangalbangali

 

সংলাপ ১

ক: ওটা কুমড়া নয় রে, বল কুমড়ো!

খ : আইচ্ছা! কুমড়ো!

ক: কুমড়ো, তাড়াহুড়ো, তানপুরো, পড়াশুনো…এই ভাবে বলবি, কেমন?

খ : আইচ্ছা। আমাকে ওই মুড়োর উপর রাখা মুজোটা এনে দেবে?

ক: আরে আরে, ওটা মোড়ার ওপর মোজা …আ…আ..

খ: কেন? তুমি যে বললে আকার না বলতে?

 

সংলাপ ২

ক: ভাইগ্য না, বলবে ভাগ্য। জইগ্য না, বলবে যজ্ঞ।

খ: আইচ্ছা ।

(দু দিন পর অফিস ফেরত খ)

খ: আইচ্ছা, বাংলা এ 22 কে কি বলে?

ক: কেন? বাইশ!

খ: কেন বাইশ হবে? ভাগ্য, যজ্ঞ এগুলোতে ইকার না থাকলে, ইটাতে কেন থাকবে?

ক: কি বলে এসেছ অফিসে?

খ: আমি তো বললাম বাস, তেস..সবাই এমন করে তাকিয়েছিল যে ভাবলাম বাড়ী এসে তুমাকে জিজ্ঞাসা  করি।

“আমি বাংলায় গান গাই“ প্রতুল মুখোপাধ্যায়র সেই আবেগভরা গান অনেক বাঙালির মনকেই নাড়া দেয়। কিন্তু ধরুন, আমি বাঙালি কিন্তু “বাংলা“ বলিনা। না না, আমি প্রবাসী বাঙালি না। কিন্তু তাও “বাংলা” বলতে বললে আমার ঘাম ছুটে যায়! কি অদ্ভুত, তাই না? মানে আসলে আমি বাঙালিই, কিন্তু আমি যে বাংলা বলি সে বাংলা এ বাংলা নয়। পরীক্ষার ফর্ম, চাকরির সি ভি, পাসপোর্ট, ইত্যাদিতে অবশ্যই লিখি যে আমার মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু আমার মা-বাবা কেউই বাংলা বলেন না। হেঁয়ালী করছি না, আসলে আমি হচ্ছি বাঙাল। আকার ইকার একটু এদিক ওদিক হয়ে গেছে আরকি, হেঁ হেঁ।

অহমিয়া বা অসম এর লোকেরা যখন পঞ্চাশের দশকে আসামে “বঙাল খেদাও” আন্দোলন করেছিল, তখন ওরা বোধয় ভেবেছিল যে ওরা বাঙালিদেরকেই খেদাচ্ছে বা তাড়াচ্ছে। ওরা ঠিক ঠাহর করতে পারেনি যে, বাঙালিরাও এই দলটাকে বাঙালি বলেনা। এই বাঙালরা আলু পোস্তর মর্ম বোঝেনা, পান্তাভাত, কলাই ডাল, সর্ষেবাটাকে খানিক অচেনা বোধ করে, বারোমেসে ষষ্ঠী করেনা, বিয়ের কনেকে পিঁড়িতে তোলেনা, বাসর জাগেনা, ইত্যাদি। কিন্তু এরাও অতি আবেগপূর্ণ ভাবে নিজেদের কে বাঙালি বলে!

মুশকিল হল এই যে এদের মধ্যে অনেকেই দেশভাগের সময় প্রাণে বাঁচতে এপারে চলে এসেছিল। সঙ্গে অল্প টাকাকড়ি আর কাপড়-চোপড়। ঘরবাড়ি, ক্ষেত-পুকুর, ইস্কুল-কলেজ, বন্ধু-বান্ধব সবই পড়ে রইল। রইল শুধু নাম, ভাষা, রান্না আর সামাজিক রীতি নীতির স্মৃতিকে আঁকড়ে থাকার প্রবল ইচ্ছা। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ এই বাঙালদের নিয়ে ভরে উঠলো। এরা অনেকেই নতুন করে ঘরবাড়ি করল। যারা পারল না, না খেতে পেয়ে মরেই গেল, তাদের কথা আমরা অবশ্য জানিনা। কিন্তু সে যাকগে।

এই বাঙালরা পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা, ইত্যাদি করে নিজেদের সমৃদ্ধি আবার ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতে ব্যাপারটা নির্বিঘ্নেই চলছিল, কিন্তু মুশকিল হল যেইনা পশ্চিমবঙ্গে পা পড়ল।

“আচ্ছা আপনারা কি অহমিয়া ভাষা বলছেন?”

“সে কী? আপনারা বাঙালি? তাহলে ভাষাটা এত আলাদা কেন?”

“হি হি! ওটার নাম মকা না, মৌরলা মাছ!” “আরে তেলচুরা আবার কি রে? বল আরশোলা! ঝ্যাং আবার কী? বল ঝাঁঝ! সর্তা আবার কি? বল জাঁতি। বাশপাতা না কাজরী। বুগুইল না থোড়।”

পদে পদে শোধরানো। পদে পদে শোনা যে তুমি ভুল আর আমি ঠিক। যতই “বাংলা” বলার চেষ্টা করে, উঁহু, কিছুতেই হয়না!

হঠাৎ একটা বেমক্কা গল্প মনে পড়ে গেল। সেই যেবার রবীন্দ্রসঙ্গীত এর উপর বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠে গেল, সবাই মনের সুখে এলোপাথাড়ি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, সেবার টিভিতে দেখলাম নচিকেতা গীটার  ঝমঝমিয়ে গাইছে “ঝর ঝর বরিষে বারি ধারা”। দু লাইন গেয়েই বলল, “উঁহু, ওদের মত হচ্ছে না”, বলেই মিচকি হেসে বাকি গানটা গেয়ে গেল।

সে যাই হোক, বাঙালদের বাংলা ঠিক বাঙালিদের বাংলার মত কিছুতেই আর হলনা। বাঙালিদের মুচকি হাসি, কটাক্ষ, আর জোক ও বৃদ্ধি পেল এবং সেগুলো খানিক অভ্যাস ও হয়ে উঠলো। না হয়ে যে উপায় নেই, এ কপিরাইট তো আর কোনদিন উঠবে না ।

দেশ স্বাধীন হবার পর, সিনেমা জগতে হই হই করে এলেন, ভানু বন্দোপাধ্যায় আর গানের জগতে শোনা গেল নির্মলেন্দু চৌধুরীকে। এরা খোলাখুলি বাঙাল ভাষা – এ ক্ষেত্রে, ঢাকাইয়া এবং সিলেটিতে প্রান খুলে পারফর্ম করলেন আর তাই দেখে শুনে বাঙালিরাও প্রীত এবং মুগ্ধ। বাঙালরা তখন যারপরনাই খুশি। হেঁ হেঁ, বলেছিলাম না? আমরাও দেখিয়ে দিতে পারি।

কিন্তু এই নাম যশ অনেকটাই তাৎক্ষনিক হয়েই রয়ে গেল। এবং বাঙালরা অনেকটাই কৌতুক আর কোঁদলের সঙ্গে স্টিরিওটাইপড হয়ে রইল। যথা – বাঙাল কে হাইকোর্ট দেখাচ্ছ? ওই দেখ দেখ, কেমন বাঙালদের মত হাঁটছে।

একদল বাঙাল তো এই ঝামেলা এড়াতে কলকাতা ছেড়ে চলে গেল, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই যেখানে বাঙালির বাংলা বলতে হয়না। সেখানে হিন্দি, ইংরাজি বা লোকাল ভাষা বললেই চলে আর নিজেকে সগর্বে বাঙালি  বলা যায়।

দোষ কারো নয় গো মা। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে হিন্দি ও ইংরিজি পড়ে, কারণ বাংলা খুব কম ইস্কুলেই পড়ানো হয়। শিলং, আগরতলা, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলায়ে বাংলা পড়ানো হয় বটে, কিন্তু সেটা বইয়ের ভাষা, চলতি বাংলা নয়। ঠিক যেমন আমরা বইয়ের ইংরিজি স্কুল এ শিখি, কিন্তু সেই বিদ্যে নিয়ে চলতি বা কলোকুয়াল ইংরিজি বলতে গেলে, লোকে শুনে হেসেই খুন হবে। অতএব যাঁরা কাছাড়, করিমগঞ্জ, শিলং, ত্রিপুরার স্কুলে পাঠ্যবই এর বাংলা শিখলেন এবং অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র আওড়ে গেলেন, তাঁদের কিন্তু বাংলা সাহিত্য পড়া হল, কিন্তু বাঙালি হওয়া হলনা। ঠিক যেমন আমরা প্রচুর শেক্সপীয়ের, কীট্স, ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েও ইংরেজ হতে পারলাম না।

কিন্তু তাই বলে চেষ্টা ছাড়া যায়? সূর্যমুখী ফুলের যেমন সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিন কাটে,বাঙালদেরও অনেকটা সময় কেটে যায় বাঙালি হবার চেষ্টায়। ছেলেমেয়েকে ওই ভাষায় কথা বলতে শেখানো চলবেনা, এই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। তাতে সুবিধে হচ্ছে, সেকেন্ড জেনারেশন অতি সহজেই কলকেতার কেতা-কায়দা রপ্ত করে ফেললেই ব্যাস কেল্লা ফতেহ! আর মিচকি হাসির খোঁচা খেতে হবেনা। অনেকটা আমেরিকাতে যাঁরা সেটল করেন, তাঁদের ছেলেমেয়েদের আমেরিকান অ্যাকসেন্ট শেখার মত।

ক্রমেই মঙ্গলাচরণ হয়ে গেল আশীর্ব্বাদ, বাসি বিয়ে চুপিচুপি সেরে ফেলা হলো, চতুর্থ মঙ্গল হয়ে উঠলো বউ ভাত। যে দেশে মেয়েদের শিক্ষাকে খুব প্রাধান্য দেওয়া হত, বাল্যবিবাহ বা পণ প্রথার প্রচলন ছিলনা, সেই দেশের লোকই এখন ভিনদেশের ভীড়ে মিশে যাবার তাগিদে তড়িঘড়ি মেয়েদের বিয়ে দেবার আয়োজন করতে লাগলো। জুটলো এসে এলাহী তত্বের রীতিও। জামাই ষষ্ঠীর দিনে যেখানে বাড়ির সকল সন্তান সন্ততিকে সমান ভাবে আশীর্ব্বাদ করা হত, সেখানে শুধু জামাই বাবাজীবনের প্রাধান্য বেড়ে চলল |

না না, আবার বলি, দোষ ধরাটা উদ্দ্যেশ্য নয়। এই পরিবর্তনের একটা বড় কারণ, লিপির অভাব। লিপির অভাবে যদিও গান ও পদ্যের মত মৌখিক সাহিত্য রচনা হয়েছে, লিখিত সাহিত্য হওয়া সম্ভব হয়নি। সিলেটিতে ক আর খ; প আর ফ; চ আর ছ; দ আর ধ এর মাঝামাঝি কিছু উচ্চারণ আছে, যা বাংলা হরফ ব্যক্ত করতে পারেনা।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় নিশ্চয়ই বাঙাল বাঙালির এক হয়ে ওঠার বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তখন দলে বিভেদ নয়, ঐক্য বাড়ানোই উদ্দ্যেশ্য ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর, এর এক অন্য প্রতিক্রিয়া হল, আর এই লঘু আঞ্চলিক ভাষা আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা বড়ই শক্ত হয়ে উঠলো। এই নথিকরণের যুগে কি মৌখিক সাহিত্য নিয়ে টিকে থাকা যায়?

তবে একেবারে টেকে না, তা বলা যায়না। মৌখিক সাহিত্যের একটা গুণ হল, এ সাহিত্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক নয়, কারো একার মগজে বা কাগজে তার নিবাস নয়, এই সাহিত্য সমষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকে। লেখার যেখানে সুযোগ নেই সেখানে মগজাস্ত্রই ভরসা। অর্থাৎ, লোকের মুখে মুখে ফেরা। তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরন হল গান।

২০০০ সাল নাগাদ এক বাংলা গানের দল তৈরি হল, নাম দোহার। শিলচর নিবাসী কালিকাপ্রসাদ আর রাজীব, কলকাতা শহরে নিয়ে এলো ঝুলি ভর্তি বিভিন্ন স্বাদের প্রান্তিক বাংলা ভাষার গান। সারি গান, ছাদপেটার গান, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বরাক উপত্যকার গান, চা বাগানের কুলিদের গান, আরও কত কী। ওদের গান বড় সহজ ভাবেই ক্রমে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো আর ওদের মিঠে সুর, ক্ষণিকের জন্যে হলেও, দিল বিভেদগুলো ভুলিয়ে, ফিরিয়ে দিল আহত সম্মান।

তবে ঠিক যেমন আমাকে এই লেখাটা কলকাতার বাংলায় লিখতে হচ্ছে, সবার কাছে সমান ভাবে বোধগম্য হবার জন্যে, দোহারকেও কলকাতার বাংলায় কথা কইতে হয়, সবাইকে তাদের গান শোনানোর জন্যে। অন্য উপায় এখনো বের হয়নি যে!

ছোট-ছোট নাম-না-জানা নদী যেগুলো গ্রাম-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়, তার প্রত্যেকেরই প্রকৃতি আলাদা। গ্রামের লোক সেখানে নাইতে যায়, গরু বাছুর সেখানে জল খেয়ে তৃপ্ত হয়। সবার সেই চেনা স্বাদ গন্ধই প্রাণবায়ু। নদীর ধারে গড়ে ওঠে বসতি, মাঠ-ঘাট। অজানা, অচেনা, অল্প-চেনা, গভীর-চেনা বাংলা ভাষার ঝুলিও ঠিক তেমনি। এই ছোট নদীগুলো যদি বয়েই যেতে পারতো, কোনোদিন যদি মোহনায় মিশতে না হত, তাহলে ভারি মজার দেশ হত, তাই না?

 

Illustration by  Aditi Chakraborty

5 Comments

  1. Manjuri October 2, 2016
  2. Ajoy October 3, 2016
  3. Debashis Basu October 22, 2016
  4. Chandan Kumar Chaudhuri November 2, 2016
  5. Bengali only October 8, 2017

Leave a Reply to Bengali only Cancel reply