অনমিত্র রায়
‘রুমাল’-এর কথায় প্রথমেই মনে পড়ে সুকুমার রায়। মনে পড়ে হ য ব র ল। সেই বেড়াল, রুমাল ইত্যাদি। মনে পড়ে কিশলয়, লেজের কাহিনি। সেই যে সেই হরিণ, যে তার লেজকে রুমালের মতো নেড়েচেড়ে তার ছানাদের পথ দেখাত!
ঠিক কোন ক্লাস বা বয়স থেকে স্বতন্ত্র রুমাল ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম, প্যান্টের বাঁ-পকেটে তার স্থান হয়েছিল সেসব মনে থাকার কথাও নয়, মনে নেইও। তবে কিন্ডারগার্টেনে টিফিন খাওয়ার সময় টিফিন বাক্সর তলায় একটা রুমাল পেতে নিতে হত, সেকথা বেশ মনে আছে।
সে-রুমালের একটা বিশেষ নাম ছিল বা আছে। তোয়ালে-রুমাল।
বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটা মজার রুমাল-জীবন তৈরি হল। কারণে-অকারণে পকেট থেকে রুমাল বের করে অদৃশ্য ঘাম মোছা বা মুখ মোছার মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চ, যেন হঠাৎ বড়ো হওয়া। কিন্ডারগার্টেনের ঘেরাটোপে রুমাল অতি আবশ্যক একটা বস্তু। একেবারে চলতি ভাষায় বললে বলতে হয়, রুমাল শৈশবের একটা অন্যতম জরুরি প্রপ। কারণ সেই যে, স্কুলবাড়ির সামনের মাঠে ক্লাসের বাকি তিরিশজন বন্ধুর সঙ্গে গোল হয়ে বসে ‘রুমাল-চোর’ আর পিঠে অকাল ভাদ্রের তাল!
বয়েস বদলায়, রুমালও তার ভূমিকা বদলায়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে রাত্তির থেকে নাক সড়সড়। তাই সাতদিন-চব্বিশ ঘন্টা, পকেটে বা হাতে রুমাল।
এদিকে রুমালেরও যে শ্রেণী আছে, ভাগ আছে। মা যে রুমাল নিয়ে যায় ভুল করে কোনোদিন সেই রুমাল নিয়ে স্কুলে গেলে সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকা। বন্ধুরা একবার দেখে ফেললে বলবে ‘লেডিস’ রুমাল নিয়ে এসেছে। বড় হয়ে রুমালের আরও একটা দিক চোখে পড়েছে। পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে দেখতে চোখে পড়েছে, নায়িকা নায়ককে একটা রুমাল উপহার দিচ্ছে, যে রুমালের এক কোণে তার নিজের হাতে সেলাই করা রঙিন ফুল, লতাপাতা অথবা তার নামের প্রথম অক্ষর। কিংবা, রাস্তায় বা মাঠের ঘাসে পড়ে থাকা রুমাল কুড়িয়ে পেয়ে, নায়ক চলেছে তার প্রেমের সন্ধানে।
এই যে এক দীর্ঘ রুমাল-জীবন, এই রুমাল-জীবনে ছোটো থেকে বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি একটা বোধ জেগে ওঠে রুমালের আবশ্যকতা সম্পর্কে। কখনো কখনো মাকে দেখেছি, স্কুল যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে শুধু রুমাল নিতে ভুলে গেছে বলে।সামান্য একটা রুমাল বই আর কিছু তো নয়! অথচ সেই নিরীহ রুমালকেই একটু সরু ভাঁজ করে শার্টের কলার আর ঘাড়ের মধ্যে রেখে রাস্তায় বেরোনোর জো নেই। বড়োরা কেউ দেখে ফেললেই—‘কি ব্যাপার, ডানা গজিয়েছে মনে হচ্ছে? যতসব লাফাঙ্গা, লোফারদের মতো হাবভাব! এক চড়ে. . .’
নিমেষে রুমাল আবার ঘাড় থেকে পকেটে।
লোকাল ট্রেনে যে হকার দাদা অন্য আরও অনেক জিনিসের সঙ্গে রুমালও বিক্রি করেন তাঁর রুমালগুলো আকারে আলাদা, বিশেষ। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো তারা ঠিক রুমাল নয়, হয়তো-বা ‘রুমাল’ নামের আড়ালে গামছার পরিমার্জিত, ক্ষুদ্র সংস্করণ।
এই প্রবল মোবাইল, ট্যাব-এর যুগেও রুমাল ভুলে রাস্তায় বেরোলে কখনো কখনো মনটা খাঁ খাঁ করে বই কী । মনে হয় কী যেন থাকার কথা ছিল, কী যেন নেই!
Illustration by Aditi Chakraborty
Khub bhalo laglo pore, tissue paper ajker rumaler ek sanskaran