দেবাশীষ বসু
যাকে খুঁজে পেলাম সে শিলং এর লাবানে, পাহাড়ের কোলে ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ী। বাড়ীর একধারে বেশ কিছু সিঁড়ি নেমে, বয়ে যাওয়া জলধারার ওপরে একটা ছোট্ট সাঁকো। সেই সাঁকো পেরিয়ে বড় রাস্তা। আর রাস্তার ওপারে পাহাড়ের ওপর পাইন গাছের সারি। বাড়ীর অন্য ধার দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হরিসভা মন্দিরের পাশ দিয়ে লাবান বাজার যাবার পথ।
এই কথাগুলো আজকের নয়। তখনকার কথা যখন আমার বয়স ছিল ১২ কি ১৩। অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর আগে। আমি পড়তাম দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে, আর আমার বাবা মা থাকতেন শিলং-এর এই সুন্দর বাড়ীটার এক অংশে। সেখানে আমি যেতাম প্রতি বছর গরমের আর শীতের ছুটিতে। এই বাড়ীটার স্মৃতি কেন যে আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল জানিনা। মনে পড়ত পাইন গাছের সারি আর তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলের স্রোতের আওয়াজ। আর ভাবতাম কবে আবার যাবো শিলং-এর বাড়ীতে।
দেওঘরে থাকাকালীন হঠাৎ এক দিন জানতে পারলাম যে বাবা চাকরিসূত্রে শিলং ছেড়ে কোলকাতা চলে যাবেন। তাই স্কুলের ছুটিতে আমার আর শিলং যাওয়া হবে না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বাড়ীর ছবিটা মনে রয়ে গেল স্বপ্নের মত। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল,কিন্তু একবারের জন্যেও আমার আর শিলং যাওয়া হলনা। এত বছর পরেও বাড়ীটা কি এখনও আছে? কে জানে?
অবশেষে শিলং যাবার পরিকল্পনা হল আমাদের। স্ত্রী মন্দিরা, বড়ছেলে শতজিত এবং ওর স্ত্রী মীনাক্ষীকে নিয়ে। যেদিন যাবার পরিকল্পনা হল, সেদিন আমার মনে হল যদি সেই বাড়ীটা আজও অটুট থাকে,আমি সেটা খুঁজে বার করবই আর সেই থেকে মনে একটা উত্তেজনাও সৃষ্টি হল।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, শিলং-এর কাছে বড়াপানি বিমান-বন্দর হয়ে পৌঁছলাম শিলং-এ। শিলং-এ পৌঁছেই বয়সটাকে কমিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম ১৯৬৬/৬৭ সালে। চোখটা বন্ধ করতে মনে হল, ছোট ছেলেটা সিঁড়ি ভেঙ্গে ওই সুন্দর বাড়ীটার দিকে যাচ্ছে। তাই চোখ খুলে ঠিক করে ফেললাম আগামীকাল শিলং-এ বেড়াতে বেড়িয়ে প্রথম কাজ হবে ওই বাড়ীটা খুঁজে বার করা।
পরদিন হোটেল থেকে রওনা হয়ে গাড়ীর ড্রাইভারকে বললাম আমাদের লাবানে নিয়ে যেতে। লাবানের কোথায় যাব জানতে চাইলে বললাম হরিসভা মন্দিরের কাছে। ড্রাইভার এই মন্দিরের নাম শোনেনি। লাবানের একটা জমজমাট রাস্তার কাছে নিয়ে গাড়ী দাঁড় করাল। আমরা গাড়ী থেকে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম হরিসভা মন্দির। এক দোকানের মালিক আমার প্রশ্ন শুনে হরিসভা মন্দির যাবার হাঁটা পথ দেখিয়ে দিল। আমরা সেই রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম হরিসভার মন্দির।
ভীষণ ভাল লাগল মন্দিরের সামনে দাড়িয়ে। যদিও মন্দিরের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত হলাম যে এটাই সেই মন্দির যেটা আমি শেষবার দেখেছি ৫০ বছর আগে। এবার বাড়ী খুঁজে
বার করার পালা। মন্দিরের ভেতরে কয়েকজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। বাড়ীর যিনি মালিক তাঁর নাম করে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীটার হদিস দিতে পারেন কিনা। বাড়ীটার বর্ণনা দিলাম। বাড়ীতে পৌঁছতে যে সিঁড়ি ভাঙতেই হয় তাও বললাম। কিন্তু কেউই সঠিক হদিস দিতে পারলেন না। আমি এই বাড়ীতে ৫০ বছর আগে থেকেছি শুনে একজন ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি বাড়ীটা কেন খুঁজছি। সঠিক উত্তর দিতে পারলাম না। ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে মন্দিরের সামনের রাস্তায় চলে এলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। পাব কি খুঁজে সেই বাড়ী?
মন্দিরের মুখোমুখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখটা বন্ধ করে একমনে ভাববার চেষ্টা করলাম সেই রাস্তাটা যেটা ধরে ৫০ বছর আগে ছোট ছেলেটা অনায়াসে মন্দির থেকে বাড়ী পৌঁছে যেত। হঠাৎ মনে পড়ল বাড়ী থেকে মন্দিরের পাশ দিয়ে গেলে মন্দিরটা হাতের বাঁ দিকে পড়ত। তাহলে কি আমরা ঠিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আর আমাদের যেতে হবে বাঁ দিকে? চলতে শুরু করলাম আর মনে হতে লাগল সরু পাহাড়ী রাস্তাগুলো ভীষণ চেনা লাগছে। আরও মনে হল যেন আমরা আর বাড়ী থেকে বেশি দূরে নেই।
ঠিক এই সময় রাস্তার পাশের বাড়ীতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম সেই একই কথা যা করেছিলাম মন্দিরের ভদ্রলোকদের।
ভদ্রলোক কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। নামটা শুনে বললেন যে তিনি আমার বাবাকে মনে করতে পেরেছেন। ভীষণ আবাক লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীটা কি এখনও আছে? উনি আমাকে আর একটু কাছে ডেকে নিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে আঙুল দেখিয়ে বললেন “দেখতে পাচ্ছেন ওই সিঁড়িগুলো? সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেই ওই বাড়ীতে পৌছে যাবেন”। হেঁটে গিয়ে দাড়ালাম সিঁড়িগুলোর সামনে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে খুঁজে পেলাম বাড়ীটাকে। মনে
একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। বাড়ীটা ঠিক সেই রকমই আছে যেমনটা ছিল আমার স্মৃতিতে। এমনটা যে দেখব সত্যি ভাবিনি। বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মনে পড়তে লাগল সেই ছোটবেলার দিনগুলো। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে কত যে আনন্দ হয়…..
মন্দিরা পাশে দাড়িয়ে বোধহয় আমার মনের অস্থিরতার আঁচ পেয়েছিল, বলল “যাবেনা বাড়ীটাতে”?
বেল বাজাতে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, তাকে একটু অস্বস্তির সঙ্গে বললাম “এই বাড়ীতে অনেক বছর আগে আমরা ভাড়া থাকতাম। অনেক স্মৃতি আছে এই বাড়ীটাকে ঘিরে, তাই বাড়ীটা আবার দেখতে এসেছি”। ভারী অবাক হলেন তিনি। ভেতরে আসতে বললেন। অনেক কথা হল। বুঝলাম উনি
সেই পরিবারেরই লোক। তথনকার দিনে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে দাদু ,দিদা আর নেই।আর যারা আমার পরিচিত ছিলেন তারা কেউ আর এই বাড়ীতে থাকেন না। বাড়ীর ভিতরটা ঘুরে দেখলাম। যে দিকটায় আমরা থাকতাম সেই দিকটাতেও গেলাম। হুবহু একই রকম আছে। দেখতে দেখতে ঘরের সামনের উঠোনে এসে দাড়ালাম। এই উঠোনে পিঠে রোদ লাগিয়ে বসে শীতকালে শুকতারা পড়তাম। সেখানে আমার একটা ছবি তুলতে বললাম মন্দিরাকে।
প্রায় কিছুই বদলায়নি এই বাড়ীটাতে ৫০ বছরে। এত মনে পড়ছিল ছোটবেলাটা যে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম যে আমি আজ চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে। সার্থক হল এই বাড়ীটা খুঁজে বার করার চেষ্টা।
বাড়ীর বাইরে এসে দেখলাম বাড়ীর চারপাশে আর কিছুই আগের মত নেই। নেই সেই পাইন গাছের সারি, না আছে বয়ে যাওয়া জলের ধারা। আছে উঁচু উঁচু বাড়ী, দোকান আর মানুষ এবং গাড়ীঘোড়ার ভীড়।
ফেরার সময়ে মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল, কারণ বাড়ীটা ঠিক সেইরকমই সুন্দর আছে আর
একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় বুঝতে পেরেছিল একদিন আমি ওকে খুঁজতে আসব আর আমাকে
দেখে ওরও নিশ্চয়ই খুব ভাল লেগেছে যে ছেলেটা এর মধ্যে কত বড় হয়ে গেছে।
হারিয়ে গেছে ছোট্ট ঝরণাখানি
হারিয়ে গেছে পাইন গাছের সারি
তবুও স্মৃতি জড়িয়ে নিয়ে গায়ে
জেগে আছে আমার বসতবাড়ি
“খুঁজে পেলাম তারে … “-তে শেষের কবিতাটা খুব ভাল লাগল। মন ছুঁয়ে গেল। এটা কি পিয়ালীর সংযোজন ?
Yes, Piyalir Khub bhalo sangjojan