দস্যি মেয়েদের গল্প

নীতা মণ্ডল

(১)
‘আই লাভ ইউ বাতাবি’…
নধর চকচকে বাতাবির গায়ে কালো রঙের আঁচড় দেখে মাথায় আগুন জ্বলে গেল লতিকার। আগামীকাল গুরুবার। সন্ধ্যেবেলা লক্ষীপুজো। সকালে স্নানের পরেই পাড়ার কথা। বেড়া ঘেঁসে বেশ আড়ালেই ছিল বাতাবিটা। তাতে কি! মেয়েগুলো কম ধিঙ্গী!
‘হে ঠাকুর, এর শাস্তি যেন ওই দস্যি, বজ্জাত মেয়েগুলো পায়।’ মনে মনে নিবেদন করেই ধিক্কার দিয়ে উঠল লতিকা, ‘অসভ্য, গেছোমেয়ে যত্তসব! বাপ, মা, দিদিমনিরা এই শিক্ষে দেয়! চুরিবিদ্যা! ছিঃ ছিঃ ছিঃ…’
মেয়েরা সব ক্লাসে। চারিদিকে পড়ানোর একটানা মৃদু গুঞ্জন। লতিকার চিৎকারে পরিবেশটাই কর্কশ হয়ে উঠল। শিক্ষিকারা নিমেষের জন্যে থামলেন। বেরিয়ে এলেন প্রধান শিক্ষিকা সুনয়না সেন। সেভেন-সির পেছনের বেঞ্চে বসা স্বাতী সুস্মিতার খাতায় লিখল, ‘আজ ওটা খেয়েই বাড়ি ফিরব।’
‘চুরি করবি?’ অনন্যা লিখল।
‘চোর বলল, শুনলি? ইশকুলের জিনিস মানে আমাদেরই জিনিস।’ লিখল স্বাতী।
(২)
লতিকা একটি বালিকা বিদ্যালয়ের পিয়ন। গার্ড মঙ্গলের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে মেয়েদের কাছে ও লতিকাবৌদি। বিদ্যালয়ের একপ্রান্তে ওদের স্বামী স্ত্রীর আস্তানা। ওর ধারণা এখানকার কাঁঠাল, নারকেল, বাতাবি, করমচায় ওর একচেটিয়া অধিকার।
টিফিনের সময় কাঁঠালতলায় টেবিল পেতে কেক, লম্বু, মদন কটকটি বিক্রি করছে লতিকাবৌদি। সুস্মিতা, অনন্যা আর স্বাতী পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। ইশকুলের মাঠ জুড়ে সাদা টপ আর সবুজ স্কার্টের মেলা বসলেও এদিকটা ফাঁকা। সুস্মিতার পায়ে লেগে একঝাঁক সাইকেল উল্টে গেল। সেগুলো তুলে দাঁড় করানো হতেই স্বাতীর স্কার্ট আটকাল বেড়ায়। সেটা ছাড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে নিল বাতাবিটা। অনন্যাকে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার দৌড়। স্টার্ট।’
‘কোথায়!’ অনন্যা জিজ্ঞেস করতেই খেয়াল হল, বাতাবিটা পাড়ার পর কি করবে ঠিক করা হয় নি।
স্বাতী বলল, ‘স্টাফ কোয়ার্টারের দিকটায় এসময় কেউ থাকে না। এক্ষুনি ঘণ্টা পড়বে। ভাবার সময় নেই অনন্যা, তুই না ২০০ মিটার রানে চ্যাম্পিয়ান!’
বাতাবিটা যথা সম্ভব লুকিয়ে অনন্যা দৌড়েছিল। কোয়ার্টার চত্বর শুনশান। ইউক্যালিপটাস গাছের সামনে সবে থেমেছে। হাঁফ ছাড়ার আগেই একটা গলার স্বরে ওদের হাড় হিম হয়ে গেল। ‘কে রে ওখানে?’
অঙ্কের দিদিমনি বেদবিভা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্রীদের কাছে ত্রাস। কখনও ওনাকে হাসতে দেখা যায় না। সব সময় রাগে মুখ থমথমে। অনেকটা বয়েস হলেও অবিবাহিতা। সে নিয়েও মেয়েদের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। প্রথম কোয়ার্টারটাই যে ওনার তা মনেই ছিল না।
উল্টোদিকে দৌড়নোর আগেই বেরিয়ে এসেছেন, ‘তোরা? এখানে? ওটা কি?’
উত্তর নেই। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির সম্ভবনায় ওরা বিহ্বল। হঠাৎ বেদবিভাদির স্নেহ মিশ্রিত কন্ঠস্বর, ‘ভেতরে যা। ওদিকটায় রান্না ঘর। বটি আছে, নুন আছে। খেয়ে সব জায়গায় রেখে দিবি।’
ওরা মুখ তুলে দেখল, বেদবিভাদি মুচকি হেসে ক্লাসের দিকে চলে গেলেন!
(৩)
ঝাপসা হয়ে আসা একটা ছবি মিস বেদবিভার চোখের সামনে দুলছে। শাস্তি হয়েছে তিনজনের। মাঠ ভর্তি মেয়েদের সামনে বেদবিভা, দেবযানী আর শ্যামলী কান ধরে দাঁড়িয়ে। অনামিকাদি ধিক্কার দিচ্ছেন, ‘আমি ভাবতে পারছি না। তোমরা টিফিন চুরি করেছ? পরীক্ষায় এত নম্বর পাও অথচ …!’
টিফিন চুরি নয়, নাক উঁচু সুমিত্রাকে শিক্ষা দেওয়াই ছিল সেদিনের উদ্দেশ্য। সৎমায়ের অবহেলায় বড় হওয়া মলিনার টিফিন বলে কিছু থাকত না। সুমিত্রারা তাই নিয়ে উপহাস করত। তাই নিজেদের মত করে শাস্তি দিতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল বেদবিভারা।
লতিকার তখনকার চিৎকারের মানে বোঝা গেল। ভাষাগুলো আজও পাল্টায় নি। বেদবিভাও ‘ধিঙ্গী’, ‘গেছো মেয়ে’ বিশেষণে ভূষিত হয়েছে ইশকুলে। কলেজের খেতাব ‘টমবয়’। তারপর সারাজীবন একঘরে। ওই ডানপিটে মেয়ে তিনজন যেন সেই বেদবিভা, দেবযানী আর শ্যামলী। চোখের কোণে বাষ্প জমছে বেদবিভার। সামনের ক্লাসরুমে কলরব করছে মেয়েরা। ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছে ভেতরটা। ওনাকে দেখেই এক লহমায় মেয়েরা থেমে গেল। মিস বেদবিভা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গম্ভীর গলায় ডাকলেন, ‘রোলনম্বর ওয়ান…’

Illustration by Soma Ukeel

One Reply to “দস্যি মেয়েদের গল্প”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *