(০৩৩)২৬৪৩-৪৩২১

অনমিত্র রায়

তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। কয়েক বছর আগে আমাদের মায়া কাটিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন। তিনি (০৩৩) ২৬৪৩-৪৩২১।

ঠিক কবে তিনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে তাঁর আরামের জন্য একটা স্থায়ী কোণের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। তিনি ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠলেন। সময়ে অসময়ে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়ে আমাদের মাতিয়ে রাখলেন (০৩৩)২৬৪৩-৪৩২১।

অনেকের হিংসে হত। অনেকে জানতে চাইত ৪৩২১ কে আমাদের বাড়ির সদস্য করার জন্য আমরা কী কী করেছি। আমরা বার বার হাসিমুখে একই উত্তর দিয়েছি। তেমন কিছুই আমরা করিনি, ৪৩২১-এর বাপের বাড়িতে গিয়ে নিমন্ত্রণপত্রটা কেবল দিয়ে এসেছি।

মাঝে মাঝেই ৪৩২১-এর মধ্যে দিয়ে আমরা শুনতে পেতাম এক নারীকণ্ঠ, ‘বুবুন আছে?’ প্রথম প্রথম আমরা খুব অবাক হতাম। বার বার কেন বুবুনেরই খোঁজ পড়ে! আমাদের তিনজনের সংসার। আমার বাবা শ্রীঅনিমেষ রায় বা বাবলু, আমার মা গায়ত্রী রায় বা টুটুন আর আমি অনমিত্র রায় বা পাপ্পু, খুব ভালোবেসে পাপু। এর মধ্যে কোথাও বুবুন নেই। কোনোদিন ছিল না। তবু। তবু বুবুনের খোঁজ পড়ে। এক উত্তর দিতে দিতে আমাদের রাগ হয়ে গেলে আমরা বলতাম, ‘বুবুন বাড়ি নেই।’ যেন ‘অবনী বাড়ি আছ?’-র ছায়া। সকাল ছ-টাতেও নেই, বেলা দশটাতেও নেই, দুপুর দুটোতেও নেই, এমনকী রাত দশটাতেও বুবুন বাড়ি নেই। সেই বুবুনের কোনো বাড়ি নেই। একদিন বুবুনের খোঁজ নেওয়া বন্ধ হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, বুবুনকে কি পাওয়া গেল?

একদিন হঠাৎ ৪৩২১-এর কোনো সাড়া নেই। সকাল থেকে। তাঁর বাপের বাড়িতে খবর দেওয়া হল। বাপের বাড়ির মানুষরা এলেন দু-তিন দিন পর। একসঙ্গে চারজন। উৎকণ্ঠিত। তাঁদের স্নেহের স্পর্শে ৪৩২১ আবার জেগে উঠলেন। এর পরে বেশ কয়েকবার এভাবে ঘুম ও জাগরণে জীবন কাটল ৪৩২১-এর। একদিন তাঁর গায়ের রং বদলে গেল। স্বরও যেন একটু স্তিমিত। আগের মতো উপস্থিতি জানান দেওয়ার ক্ষমতা যেন আর নেই।

দিন যায়। ৪৩২১ একটু একটু করে বুড়ো হতে থাকেন। তাঁর বাপের বাড়ির মানুষজন একটু ঘন ঘনই তাঁর খোঁজ নিতে থাকেন। একদিন তাঁরা এসে দেখেন ৪৩২১ আর এ জগতে নেই। তাঁরা তাঁকে নিয়ে যেতে চান। আর কোনো উপায় নেই দেখে আমরাও চোখের জলে ৪৩২১ কে বিদায় জানাই।
তার পর কালের নিয়মে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। ৪৩২১-এর কথা আজও মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। বিশেষ করে, যখন আমি আমার কাজের টেবিলে মনোযোগী আর পাশের ঘরে খাটের ওপর শুয়ে থাকা চলভাষ ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তখন মনে হয়, আজ যদি ৪৩২১ থাকত তাহলে হয়তো ওপারের মানুষটিকে হতাশ হতে হত না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *