অনির্বাণ চক্রবর্তী
আমাদের এই প্রাণী জগতে কত রকমেরই না জীব আছে।স্থল, জল আকাশ সর্বত্র বিভিন্ন রকমের জীবের
সমাহার। এমন কী সমুদ্রের একদম তলদেশে যেখানে সূর্যের আলো কখনো পৌঁছায় না, সেখানেও বিচিত্র
সব জীব বাস করে।
তোমরা শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবে, সেই চির অন্ধকারের দেশে জায়ান্ট টিউবওয়ার্ম বলে একরকমের প্রাণী
থাকে যারা শুধু সমুদ্রের তলার অর্ধজাগ্রত আগ্নেয়গিরি বা ইংরিজিতে যাকে বলে ‘হাইড্রো থার্মাল
ভেন্ট’ এর আশেপাশে থাকে। তাদের কথা তোমাদের পরে শোনাব।
এখন শোনো এই সব বিচিত্র জীবেরা কি খেয়ে বেঁচে থাকে।শুনলে মনে হবে এরা যেন শুধু ভোজনের
অন্তহীন খোঁজেই থাকে।প্রমাণ সাইজের খাবার দেখলে কারো হুঁশ থাকে না, হামলে পড়ে সব। খাবার নিজ
আয়তনের চেয়ে বড় হলেও চিন্তা নেই; হয় চিবিয়ে হাড় গোড় গুঁড়িয়ে দেবে নয়ত ঘপাত করে গিলে
ফেলবে।সে যেভাবেই খাক, দুটিই সমান ভয়ংকর।
আর্জেন্টিনায় প্যাকম্যান ফ্রগ নামে এক ধরনের বড় ব্যাঙ পাওয়া যায় যা আর্জেন্টাইন হর্নড ফ্রগ নামেও
পরিচিত। যার বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় শিংওয়ালা ব্যাঙ।ছোট-খাটো পোকামাকড়, ইঁদুর, গিরগিটি
যা পায় তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমনকি নিজের চেয়ে বড় কোনো প্রাণীতেও আপত্তি নেই।বেজায় পেটুক
ব্যাঙ।ব্রাজিল এবং উরুগুয়েতেও এরা থাকে।
যদি নিজের ওজনের অনুপাতের খাওয়া কে আমরা মাপকাঠি হিসেবে ধরি, তাহলে শুঁয়োপোকার জুড়ি
মেলা ভার। পেটুক বা খাদক হিসেবে শুঁয়োপোকা এক ও অদ্বিতীয়। একটি শুঁয়োপোকার ওজন
২০ দিনেরও কম সময়ে ১০ হাজার গুণ বাড়ে! গাছের লতাপাতা, ছাল বাকল এসবই খায় সারাদিন
ধরে। তবে এই শুঁয়োপোকাই যখন প্রজাপতি হয় তখন মুগ্ধ হয়ে তারিফ করেই যাই।
খুদে প্রাণীর কথা যখন এসেই গেলো তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো পাখি হামিংবার্ডই বা বাদ থাকে
কেন? সাইজে ওরা এইটুকুন হলে কি হবে? খাদক হিসেবে ওরা কিন্তু ভয়ংকর। প্রতি ১০ মিনিট পর
পর খাবার চাই ওদের। একটি হামিংবার্ড দিনে গড়ে কতটুকু খাবার খায় জানো? তার শরীরের
ওজনের দুই তৃতীয়াংশ পরিমাণ। অবশ্য একটি হামিংবার্ডের হৃদপিন্ড মিনিটে ১২০০ বার বাজে,
আর ২০০ বার পাখা ঝাপ্টায়। ফলে ক্যালোরিও অনেক খরচা হয় বটে। কত? তা প্রায়
১৪০০০ ক্যালোরি, একটা ম্যারাথন দৌড়ের সমান।
এবার আসি আফ্রিকার ড্রাইভার অ্যান্টের কথায়।তোমরা ভাবছ সামান্য পিঁপড়ে আর কত খাবে?
কিন্তু ক্ষুদ্র হলে কী হবে ওই রকম বুদ্ধিমান ও হিংস্র প্রাণী খুব কমই আছে। এদের একটি ঝাঁকে
গড়ে ২কোটি করে পিঁপড়ে থাকে।ভুল করেও ওই ঝাঁকের সামনে পড়লে প্রাণ হাতে পালিয়ে বাঁচাই
বুদ্ধিমানের কাজ। গরুটা ছাগলটা তো বটেই, বাগে পেলে মানুষও খেয়ে নিতে পারে।ঘন্টা দুয়েকের
মধ্যে একটা গরু খেয়ে শেষ এরা হামেশাই করে থাকে।
মাটি আর আকাশের পেটুকদের কথা তো শুনলে। এবার চলো একটু জলের নিচে ডুব দিয়ে
আসা যাক। সেখানে টাইগার শার্ক বলে এক হাঙর রয়েছে।হাঙর নাম তার সার্থক। বাস্তবিকই
ওরা হাঙরের মতই খায়। দুনিয়ার বাঘা বাঘা খাদকের দল ওদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারবে না।
ভগবান ওদের বানিয়েছেন সেই রকম ভাবেই।আটচল্লিশটা করাতের মত দাঁত যেকোন
প্রাণীর দুঃস্বপ্ন।
জলে বাসকারী আরেক পেটুকরাজ হলো নীলতিমি। নীলতিমির পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ প্রাণী।একটি নীলতিমি
গড়ে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার কেজির বেশি খাবার খেয়ে থাকে। খাবারের তালিকায় সবচেয়ে বেশি
থাকে ক্রিল বলে এক ধরনের খুদে সামুদ্রিক চিংড়ি মাছ।
রক্তচোষা নিশাচর প্রাণী বা ভ্যাম্পায়ার গল্প-উপন্যাসে দাপিয়ে বেড়ালেও আসল রক্তচোষা হলো ‘ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’। এরা একধরনের বাদুড়। এরা প্রতিদিন বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে নিজ ওজনের বেশি পরিমাণ
রক্ত পান করে।তবে অবশ্যই ওরা কাউকে ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দেয় না।
‘তাসমানিয়ান ডেভিল’ বলে অস্ট্রেলিয়ায় ধরনের স্তন্যপায়ী মাংসাশী প্রাণী রয়েছে।ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
এদের পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র প্রাণীদের তলিকায় তিন নম্বরে রেখেছে।এরা সাধারণত মৃত প্রাণী পছন্দ করে।
মাত্র আধ ঘণ্টায় প্রাণীটি নিজ ওজনের ৪০ শতাংশ খাবার সাবাড় করতে পারে!
কি ভয়ংকর!
এই প্রাণী জগতে এত খাদক আছে যে বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু আমি বলি মানুষের মত
বড় খাদক আর নেই। বস্তুত মানুষ যা সামনে পায় তাই সাবড়ে দেয়। কি না খাই আমরা?
মাছ, মাংস, শাক, শবজি, পোকামাকড়, সাপ, থেকে হাঙরের পখনার স্যুপ, সবই খায় মানুষ। তবে এরই
মধ্যে বাঙালীদের পেটুক হিসেবে একটু বেশিই নাম। ইলিশ, চিংড়ি, কচি পাঁঠার ঝোল আর রসগোল্লা
বাঙলীর চিরন্তন।
জিভে জল চলে এল, তাই না?
সুকুমার রায়ও বলে গেছেন,
“খাই খাই করো কেন, এস বোস আহারে
খাওয়ার আজব খাওয়া ভোজ কয় যাহারে”।
তথ্য সূত্র: অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট।
খাদ্য আর খাদকের এক জমজমাট রঙ্গমঞ্চ এই দুনিয়া।
এত জাতের খাদকের মধ্যে বোধহয় মানুষই একমাত্র পেটুক, যার দৃষ্টিক্ষিদে আছে !