শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী
১
– শুনা হ্যায়, আপ পহেলি বার ঠেকেদারি করনে আয়ে হ্যায়। ঠেকেদার কা মতলব জানতে হ্যায় আপ?
– জি, ওহি…ঠেকেদারি মতলব…গাঁও সে কুছ লেবার লেকে আয়া হঁু। উও লোগ পহেলে খেতি কা কাম করতা থা, অভি ফেক্টিরি বনানে কা কাম করেগা।
– আপকো লাগতা হ্যাঁয় কেয়া, ফ্যাক্টরি বানানে কা কাম ইতনা আসান হ্যায়? কোই ভি কর লেগা?
– স্যার, উও লোগ তো আন-ইস্কিল্ড লেবার হ্যায়। আনপড়, গাওয়ার হ্যায়, পর কংক্রিট ডালনে কা কাম কর লেগা। ম্যায় মানতা হঁু, উও লোগ আপকা শাটারিং উটারিং ইয়া সরিয়া কা কাম নেহি কর পায়েগা। উসকে লিয়ে তো টেরনিং কা জরুরৎ হোগা। লেকিন স্যার আপ দেখ লিজিয়ে গা, হামারে লেবার গ্যাং বহুৎ তাগতদার অউর মেহনতি হ্যায়। ইসি লিয়ে ভরদ্বারাজন সাব আপকে পাস ভেজা।
ব্যাপারটা এতক্ষণে স্পষ্ট হয় কার্ত্তিক ঘোষের কাছে। ভরদ্বারাজন হলেন এই প্রোজেক্টের ডেপুটি প্রোজেক্ট ম্যানেজার। তাঁর প্রধান কাজ সব সাইটে লেবার বণ্টন করা। বয়স্ক মানুষ। বেশি চাপ নিতে পারেন না। অন্য সব কাজে এত অপারদর্শিতা দেখিয়েছেন যে তাঁর প্রধান কাজ বলে যা বলা হল, কালক্রমে সেটিই তাঁর একমাত্র কাজ। সাইটে একটা চুটকি চালু হয়েছে সম্প্রতি, প্রোজেক্ট ম্যানেজার অর্থাৎ বোস সাহেবের দুই ডেপুটিকে নিয়ে। সেটা হল – বিশ্বকর্মার দুই চ্যালা, নিষ্কর্মা আর দুষ্কর্মা। প্রথমোক্ত ডেপুটি ওই প্রথম গোত্রের। এই অসামান্য বিশ্লেষণী শক্তি – বিন্দুতে সিন্ধুকে ধরবার ক্ষমতা স্টোরের দাসবাবু ছাড়া আর কারুর নেই।
কার্ত্তিক ঘোষ বললেন, ‘তব তো আপ সব কুছ সমঝ হি চুকে হ্যায়, বাকী ভি আপ ভরদ্বারাজন সাব সে হি সমঝ লিজিয়ে’।
সতীন্দর শর্মাকে মোলায়েম হাসতে হয়। বুঝতে পারে বেশী বিদ্যা জাহির করাটা ভুল হয়েছে। বলে, ‘নেহি নেহি স্যার, আপ হি সে তো সব কুছ শিখনা হ্যায়। ম্যায় তো পহেলি বার আয়া কন্সট্রাকশন সাইট মে কাম করনে কে লিয়ে। বাতাইয়ে না ক্যায়সে হোতা হ্যায় ই সব মেজারমেন্ট আউর পেমেন্ট বাগারা…স্যার চলিয়ে না, উধার বৈঠতে হ্যায়, ম্যায় চায়ে মাঙ্গাতা হঁু’।
চায়ে চুমুক দিয়ে কার্ত্তিক ঘোষ বললেন, ‘আভি আপ নে যো পুছা, ওহি হ্যায় সবসে কাম কি বাত। কাম তো আপ কর লেঙ্গে, লেকিন প্যায়সা ক্যায়সে মিলেগা, কিতনা মিলেগা, ইয়ে সব সমঝ লেনা বহুত জরুরী হ্যায়’।
অতঃপর কার্ত্তিক ঘোষ সব কিছু বুঝিয়ে দেন। কিছু কাজ হয় মেজারমেন্ট বেসিস এ, কিছু কাজ সাপ্লাই বেসিস এ। কংক্রিট ঢালাই, মাটি কাটা, মাটি ভরা এসবের মেজারমেন্ট হয় কিউবিক মিটারে। লেংথ, ব্রেড্থ, হাইট গুণ করলে ভল্যুম হয়, একথা নিশ্চয় ঠিকেদারের অজানা নয়, বিশেষত যখন তিনি দাবি করছেন নিজেকে ম্যাথেমে্টিক্স অনার্স পাশ বলে। বাকী যে সব কাজ সরাসরি মেজারমেন্ট করার অসুবিধে আছে যেমন হাউসকিপিং বা ঝাড়ু লাগানো, এদিকের মাল ওদিকে শিফটিং করা, সেগুলো সাপ্লাই বেসিস এ করানো হয়, মানে কতজন লেবার কতক্ষণ কাজ করলো, সেই হিসেবে পেমেন্ট হয়। এই যে, কতজন লেবার কতক্ষণ কাজ করলো এবং কীই বা করলো – এই ব্যাপারটা মাত্র তিনজন জানতে পারেন, সাইট ইঞ্জিনীয়ার, ঠিকেদার এবং স্বয়ং ভগবান। মাসের শেষে যখন বিল পাশ হবে, তখন প্রোজেক্ট ম্যানেজার, বিলিং এবং অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট একটু হল্লাগুল্লা করতে পারে, সে দেখা যাবে’খন। মেজারমেন্টের কাজে কোন ঝুট ঝামেলা নেই, ড্রয়িং থেকে সরাসরি হিসেব করে কোয়ান্টিটি বেরিয়ে আসে। সব আইটেমের ফিক্সড রেট আছে, সেই হিসেবে পেমেন্ট হয়ে যাবে।
সতীন্দর বলে, ‘সাব, আপনে তো বহুত আচ্ছাসে সমঝা দিয়া সব কুছ’।
– আউর কুছ পুছনা হ্যায়? ……আরে দেখিয়ে ম্যায় আপকা নাম হি নেহি পুছা। কাঁহা সে আয়ে আপ? মেরা নাম তো আপ কো মালূম হি হোগা।
– জি… মেরা নাম সতীন্দর শর্মা, হাম বিহার সে আয়ে হ্যায়।
– উও তো আপকা বাতোঁ সে হি সমঝ গয়া, বিহার মে কাঁহা?
– জেহানাবাদ জিলা।
– ‘জেহানাবাদ মে কিধর?’, কার্ত্তিক ঘোষ কিঞ্চিৎ ভৌগোলিক গভীরে যেতে চান।
– আরওয়াল কে পাস।
– ইয়ে আরওয়াল বাড়ওয়াল নেহি শুনা কভি।
সতীন্দর কিছুক্ষণ ইতিহাস হাতড়ায়। আরওয়ালের গৌরবময় অতীত কিছু সামনে আসে না। শেষে বলে ফেলে, ‘সাব, উও এইট্টি সিক্স মে হত্যাকান্ড্ হুয়া থা না…পুলিশ ফায়ারিং মে মারে গয়ে থে গরীব কিষাণ লোগ……দুসরা জালিয়ানওয়ালাবাগ….’
কার্ত্তিক ঘোষের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলা করে, বলেন, ‘আরে, তুমহারা উধার তো হর জায়গা মে হত্যাকাণ্ডঅ হোতা হ্যায়’।
সত্যিই লজ্জিত হয় সতীন্দর। বলে, ‘হামারা উধার কা গরিবি, জাতপাত, পলিটিক্স, বেরোজগারি, গুন্ডাগর্দি … আপলোগ সোচ ভি নেহি সকতে সাব…। পিছলে সাল হি তো বাথানি টোলা মে…’
কার্ত্তিক ঘোষ থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘উও সব হিস্ট্রি উস্ট্রি ছোড়িয়ে, অব ঠেকেদার কা আসলি মতলব শুনিয়ে। ঠ সে ঠগ, ক সে কমিনা, দ সে দারুবাজ, র সে রাণ্ডীবাজ’।
শেষ শব্দটি বলার সময় কার্ত্তিক ঘোষের ডান চোখ ছোট হয়ে আসে। একবার চোখ বুলিয়ে নেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সতীন্দরের ফিমেল লেবার দলে।
প্রায় পঁচিশ তিরিশ জনের দল। চার জন মাত্র পুরুষ, বাকিরা সবাই মহিলা। এইসব দলের পুরুষরা মিক্সার মেশিন চালায়, রাজমিস্ত্রির কাজ করে, কেউ রাজমিস্ত্রির হেল্পার। বাকী সব কাজ যেমন, গিট্টী, বালি, সিমেন্ট বয়ে এনে মিক্সার মেশিনে ঢালা, মিক্সারে মশালা মাখা হয়ে গেলে অন্যদিক থেকে সেই কংক্রিট তশলায় (গামলা) ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ঢালাই এর জায়গায় ফেলা এসব কাজ মহিলারাই করে থাকে। বড় ঢালাই হলে, কংক্রিট সরাসরি ব্যাচিং প্ল্যান্ট থেকেই আসে।
কার্ত্তিক ঘোষ অর্থপূর্ণ হেসে বলেন, ‘উস ডেফিনেশন কা হিসাবসে আপ তো ঠেকেদার হি নেহি লাগতে’।
সতীন্দরের বলতে ইচ্ছে করছিল যে আপনি একদিন খুব বড় ঠিকেদার হবেন। এমন সময় ভরদ্বারাজন সাব হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেয়া গোস বাবু, আপ আবি তক ইনকো কাম পে নেই লাগায়া? সুবে সে বৈটে হ্যায় ইয়ে লোগ’।
কার্ত্তিক ঘোষ বললেন, ‘সাব, আভি তো আয়ে ইয়ে লোগ। পুছিয়ে ঠেকেদার কো, ম্যায় সুভেসে কিতনা বিজি হঁু। পিসাব করনে কা ভি টাইম নেহি মিলা’।
ভরদ্বারাজন সাব প্রায়োরিটি ঠিক করে দেন। বলেন, ‘নেয়ি নেয়ি …পহলে পিসাব করো’। বলে দ্রুতই সিন থেকে অন্তর্হিত হন।
২
অর্কদের অফিসটি তেমন কোন সম্ভ্রম-জাগানো বিল্ডিং নয়, অফিস বলতে যেমন বোঝায়। নিছকই ইটের গাঁথনি আর টিনের চালের তৈরি অস্থায়ী অফিস, যাকে সাইট অফিস বলা হয়। প্রোজেক্ট শেষ হলে, অফিসটিও ভেঙে ফেলা হবে। জায়গাটি রাজস্থানের ব্যাওয়ার শহর থেকে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে। অনেক উঁচু-নিচু, কাঁচা-পাকা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় এই রাবড়িওয়াস গ্রামে। এখানেই চলছে একটি সিমেন্ট কারখানার নির্মাণ কাজ। আর সেই সূত্রেই অর্ক এবং তার দুই বন্ধুর আগমন এই পাহাড়ি রাজস্থানি গ্রামে।
অর্কদের চাকরি পাবারও একটা ইতিহাস আছে। তখন ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল সেমেস্টার পরীক্ষা হয়ে গেছে। কয়েকটা কোম্পানির তখনও ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে আসা বাকি আছে। অর্ক, সপ্তর্ষি আর হারাধান হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। যে-সব কোম্পানির নামের শেষে কন আছে (কন্সট্রাকসনের কন), খুঁজে খুঁজে তাদের অফিসে হানা দিচ্ছে। পারলে ইস্কনেও চলে যায় – এমন অবস্থা। এমন সময় অর্করা খবর পেল, তাদের অন্য তিন বন্ধু যারা রাজস্থান গিয়েছিল, ওই প্রোজেক্টের কাজে, তারা ফিরে এসেছে। সেখানে টিকে থাকা নাকি সহজ নয়। এই সুযোগে কিংবা দুর্যোগে, অর্ক আর সপ্তর্ষি পৌঁছে গেল ওই কোম্পানির এন এস রোড স্থিত সদর দফতরে। সেখানে জনৈক চক্রবর্তী সাহেব ওদের দুজনকে বসিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার নির্যাস এইরকম – প্রথমতঃ, এমন আতুপুতু হলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করা যায় না। দ্বিতীয়তঃ, তিনি আর কোন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছেলেকে সাইটে পাঠাবেন না, কারণ তাঁর অভিজ্ঞতায় যাদবপুরের ছেলেরা একেবারেই কষ্টসহিষ্ণু নয়। তৃতীয়তঃ, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাঁকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে তিনিও যাদবপুরের প্রাক্তনী। কিন্তু তাঁর সময়ে, হাতে-কলমে কাজ শেখার এক অদম্য ইচ্ছে তাঁর এবং অন্য সহকর্মীদের ছিল। তিনি তো নিজের হাতে ভাইব্রেটরও (কংক্রিট থেকে হাওয়া বের করে, পোক্ত করার যন্ত্র) চালিয়েছেন। রাতে ঘূম আসত না। নাইট ডিউটি না থাকলেও হঠাৎ হঠাৎ সাইটে চলে যেতেন – মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতেন কিভাবে ড্রয়িং এর অ্যামোনিয়া প্রিন্ট আস্তে আস্তে মাঝরাত্তিরে কল্পনা থেকে বাস্তব হয়ে উঠছে।
অর্ক মাঝখানে একবার মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল, ‘না স্যার, মানে এইভাবে যাদবপুর বলে একেবারে জেনারেলাইজ করে দেওয়াটা কি ঠিক হবে স্যার? আমাদের একবার সুযোগ দিন, আমরা কথা দিচ্ছি, প্রোজেক্ট শেষ করে তবেই ফিরব’।
কিন্তু চক্রবর্তী সাহেবকে অত সহজে গলানো গেল না। বললেন, ‘না ভাই, আমি ক্যাটাগোরাইজ করে ফেলেছি, আর যাদবপুর নয়’।
অফিস থেকে বেরিয়ে সপ্তর্ষি বলল, ‘যাঃ শালা, এটাও কেঁচে গেল। একবার হারাধন কে ধরতে হবে, ও ব্যাটা একা একা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওর কাছে নিশ্চয় কিছু খবর আছে’। দুই বন্ধু হতাশ হয়ে যাদবপুরের বাস ধরল। তারপর দুঃখ ভুলতে সেলিমপুরের ফুটপাথের দোকান থেকে পেট পুরে পরোটা আর কাবুলি ছোলার তরকারি খেয়ে হোস্টেলে ফিরে লম্বা ঘুম।
দিন তিনেক পরে, হারাধন খবর দিল, ‘আমাদের তিনজনকে কাল একবার চক্রবর্তী সাহেব যেতে বলেছেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নেওয়ার জন্য’। যাকে বলে একেবারে বিনামেঘে পুষ্পবৃষ্টি!
তিনদিন পরে অর্ক, সপ্তর্ষি ও হারাধন হাওড়া থেকে চড়ে বসল তুফান এক্সপ্রেসের স্লিপার ক্লাসে। গন্তব্য দিল্লি। ট্রেনে অনেক অবাঙ্গালী যাত্রী। তিনজনে কান খাড়া করে রইল। যেতে যেতেই যতটা সম্ভব হিন্দি শিখে ফেলতে হবে। হিন্দি সিনেমার কল্যাণে হিন্দি বুঝতে পারলেও হিন্দি বলায় তেমন সড়গড় নয় তিনজনেই। ট্রেন ঢিক ঢিক করে চলতে লাগল। মাথার উপর ফ্যানও ঘুরছে ঢিমেতালে। তিনটে ফ্যানের মধ্যে একটা খুলে নিয়ে গেছে লোকে। একজন বললেন টু ফ্যান থেকেই তুফান নামটা এসেছে! তাই হবে নিশ্চয়, তাছাড়া তো তুফান এক্সপ্রেসের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
দিল্লি থেকে রাতের বাসে চড়ে তিনজনে ব্যাওয়ার এসে পৌঁছল পরদিন সকালে। রাতের অন্ধকারে যাত্রাপথ ভাল করে দেখা হয় নি। মাঝে একবার এক ধাবায় বাস দাঁড়িয়েছিল রাতের খাওয়ার জন্য। ওরা এতই কাহিল ছিল, বাস থেকে নামে নি। শুধু ঘুম চোখে দেখেছিল – বড় বড় উনুনে তন্দুরি রুটি বানানো হচ্ছে, ইতস্তত ছড়ানো দড়ির খাটিয়া, বাল্বের ম্রিয়মাণ আলো, গরগরে মশালাদার তরকারি নিয়ে ধাবা কর্মচারীদের ছোটাছুটি। হাইওয়ের দুধারে যে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের স্তূপ ছিল, ভোর হতে বোঝা গেল, সেগুলো আসলে পাহাড়ের শ্রেণী – আরাবল্লি পর্বতমালার অংশ। সকালে এরকমই দুই পাহাড়ের মাঝখানে দেখা গেল এক অবিস্মরণীয় সূর্যোদয়!
ব্যাওয়ার শহরটি আজমীর থেকে আরও পশ্চিমে যোধপুর যাওয়ার পথে পড়ে, প্রায় ঘণ্টা খানেকের জার্নি। ওদের থাকার ব্যবস্থা হল আদর্শনগরে কোম্পানির মেসে। কাছাকাছি আরও একটি মেস ছিল। তাছাড়া যারা পরিবার নিয়ে থাকতেন তাদেরও অনেকেই আদর্শনগরেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকাল সাতটায় একটি জীপগাড়ি আদর্শনগর থেকে ওখানকার সকলকে নিয়ে সাইটে রওনা হত। অন্য একটি জীপগাড়িতে, প্রোজেক্ট ম্যানেজার ও আরও কিছু স্টাফ, যারা শহরের অন্য প্রান্তে থাকতেন, তারা সাইটে যেতেন।
প্রথমদিন সাইটে পৌঁছে ওরা দেখল, সে-এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। নানা আকার-প্রকারের বিল্ডিং – লাইম-স্টোন ক্রাশার, কোল মিল, সিমেন্ট মিল, সিমেন্ট সাইলো ইত্যাদি। কোনটা মাটির তলা থেকে সবে উঠতে শুরু করেছে, কোনটা তিন-চারতলা অব্দি পৌঁছেছে, কিছু বিল্ডিং আরও উঁচু। কোথাও চল্লিশ ফুট গভীর বড় পুকুরের মত মাটি কাটা হয়েছে, তো কোথাও চারশ ফুট লম্বা কনভেয়ার বেল্টের সারিসারি পিলার।
অর্কর ডিউটি পড়ল লাইম-স্টোন ক্রাশারে, সপ্তর্ষির সিমেন্ট মিল আর সিমেন্ট সাইলো তে, হারাধনের লাইম-স্টোন স্ট্যাক-পাইল এ। সাইটে আরও অনেক কোম্পানি আলাদা আলাদা কাজে যুক্ত। সাইটের একপাশে লেবার কলোনি – লোহার রড, জি আই শিট, ভাঙা ইট, ত্রিপল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি সারি সারি ঘুপচি ঝুপড়ি – প্রায় সুকুমার রায়ের ‘বুড়ীর বাড়ি’র মতোই। তিনজনে সাইটে ঘুরতে ঘুরতে আরও দেখতে পেল – দুটো ক্যান্টিন। সেখানে জিলিপি, শিঙাড়া, দইবড়া, পুরী, গুলগুলা পাওয়া যাচ্ছে। গুলগুলা হল টেনিস বলের সাইজের একটি খাদ্যবস্তু, বোধ হয় ময়দা আর গুড় দিয়ে তৈরি।
সাইটে গিয়েই ওরা বুঝতে পারল, ওরা ‘লাইনে’ এসে গেছে, লাইন অর্থাৎ কন্সট্রাকসন লাইন। এই লাইনটা যে অন্যান্য লাইন থেকে একেবারেই আলাদা, সে-কথাটা রাজমিস্ত্রি, ঠিকাদার, মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান থেকে শুরু করে প্রোজেক্ট ম্যানেজার পর্যন্ত সকলেই নানা ভাবে, নানা ভাষায় বোঝাতে লাগলো। জানতে পারল নির্মাণ শিল্পের অ আ ক খ। কাজকে বলে প্রোজেক্ট, যারা কাজ দেয় তারা ক্লায়েন্ট, যারা নকশা বানায় তারা কন্সালট্যান্ট, আর যারা কাজ করে তারা কনট্রাক্টর। বোঝা গেল, অর্করা যেহেতু কনট্রাক্টর কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছে, ক্লায়েন্ট ও কন্সালট্যান্ট এর কাছ থেকে নিয়মিত গালি খাওয়াই তাদের বিধিলিপি। কলেজে ওদের রাস্তা, বাড়ি, ব্রিজ ডিজাইন করা শিখিয়েছিল, কিন্তু পাগলা ক্লায়েন্ট তাড়া করলে কী করতে হবে, সে-কথা কোন ‘নোটবুকে’ লেখেনি।
৩
কার্ত্তিক ঘোষের সঙ্গে ঠিক জমল না সতীন্দরের। ভদ্রলোক এত খুল্লামখুল্লা সব কিছু বলেন, সতীন্দরের মনে হয়, সে বুঝি বিহারের কোন সরকারী দপ্তরে বসে আছে। তাছাড়া, লছমির দিকে খুব বাজে ভাবে তাকান। তাই সতীন্দর এখন ভার্মা সাহেবের সাইটে কাজ নিয়েছে। সেখানেই আলাপ হল অর্কর সঙ্গে। মাঝে মাঝে গল্প-স্বল্প হয়। ভার্মা সাব – অর্কর বস, একটু রেগেও যান। অর্ক কে বলেন, ‘বাবু, আপ ইঞ্জিনীয়র হো, কলেজ সে নয়ে নয়ে নিকলে হো, থোড়া ডিস্ট্যান্স মেনটেন করো ঠেকেদার সে। ইতনা মৎ সমঝো উনকা দুখ-দর্দ’।
অর্ক সতীন্দরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার সঙ্গে লছমির সম্পর্কঅ কেয়া হ্যায়?’
তারপর দশ মিনিট লক্ষ্মীর পাঁচালী শোনার পর অর্ক মোটামুটি যা বুঝতে পারল, সেই একই প্রেমের গল্প ঃ উঁচু জাত-নিচু জাত, ধনী-গরিবের সেই চিরন্তন দ্বন্দ্বমূলক প্রেমবাদ। সতীন্দর ভূমিহার আর লছমিরা দলিত, অচ্ছুৎ। ভূমিহীন কিষাণ। ভূমিহারদেরই আখ, ভূট্টা, গেঁহু ক্ষেতে কাজ করে দিন চলে লছমি এবং ওদের মত দলিত পরিবারের। গ্রামের এক প্রান্তে থাকে দুসাধ, পাসি, ধোবি, চামার, মাল্লা এইসব নিচু জাতের লোকেরা। আজাদির পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। ওদের জীবন বদলাল না বিশেষ। তবে আজকাল ওরাও একজোট হচ্ছে। ওদের মোকাবিলা করার জন্য বিহারে এখন ভূমিহার আর রাজপুতরা মিলে রণবীর সেনা বলে প্রাইভেট সেনাদল বানিয়েছে। আরও আছে নানারকম সেনাদল। শোনা যায় পুলিশ, প্রশাসন, নেতাদের প্রছন্ন মদত আছে। আর্মির হাত থেকেই বেআইনি অস্ত্র চলে আসে। প্রশিক্ষণও দেয় নাকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মীরা। জমির দখল নেওয়া, কিষাণ মজদুরদের ন্যায্য মজুরী না দেওয়া, নকশাল/ দলিত নিকেশ করা, একটা ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা এসবই হল ওদের প্রধান কাজ। ওদের গ্রামেও যে কোন সময় বড় হাঙ্গামা হয়ে যেতে পারে। এই পরিবেশে যদি সতীন্দর আর লছমি বিয়ে করতে চায়, তাহলে দুজনেই যে খুন হয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তাই সতীন্দর পালাতে চায়। সে ঠিকেদারি করবে, সারা ভারতের কন্সট্রাকসন সাইটে সাইটে ঘুরবে। লছমি থাকবে বাড়িতে, তাকে সে সাইটে কাজ করতে দেবে না। বঙ্গালে চলে যাবে। শুনেছে, বঙ্গালে নাকি জাত টাত নিয়ে অত কেউ মাথা ঘামায় না। পালিয়ে যাবে কোন ছোট গ্রামে, সেখানে কেউ কোনদিন ওদের খোঁজ পাবে না। ছোট মাটির বাড়িতে থাকবে – এক সকুন কি জিন্দেগি জিতে চায়।
অর্ক সব শুনে বলল, ‘আপনি তো দেখতা হ্যায় একেবারে দৈত্য কূল মে প্রহ্লাদ’।
– কেয়া, কেয়া বোলা আপনে?
– বাদ মে বুঝাউঙ্গা, আগে হিন্দিটা ঠিকসে শিখনা পড়েগা।
প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন ঘটনা ঘটে ওদের জীবনে। মেসে ফিরে রাতে শুয়ে শুয়ে গল্প হয় তিনজনে। আজ বাপি মণ্ডল ধরেছিল সপ্তর্ষিকে। বাপি হল এক ঠিকেদার, মালদা থেকে লেবার এনেছে। মালদা থেকে আরও একজন ঠিকেদার এসেছে, নুরুল ইসলাম। বাপির সঙ্গে সবসময় একটা ট্রিপ্লিকেট বুক থাকে, তাতে মেজারমেন্ট আর সাপ্লাই লেবারের হিসেব লেখা থাকে। বাপি এসে সপ্তর্ষিকে বলছিল, ‘আপনি তিরিশ জনের সাপ্লাই লেখে দ্যান, হাফ ডে। আপনার সাইটে ঝাড়ু লাগিয়েছে, সাফাই করেছে, মাল মেটিরিয়াল স্ট্যাক করেছে’।
সপ্তর্ষি বলল, ‘সে তো এক-দেড়ঘন্টার কাজ ছিল, তারপরে তো আপনার লেবাররা অন্য সাইটে ঢালাই করতে চলে গেছে। আর লেবার আমি গুনেছিলাম, বুড়ো-বাচ্চা সব মিলিয়ে আঠার জন ছিল’।
বাপি সুর করে বলতে লাগলো, ‘লেবারের আসতে যাতে সময় লাগে না? আপনি গিণতি করে দেখেছেন সব? কত লেবার পানি পিতে গেছিল, কতজনায় পিসাব করতে গেছিল, আপনি তার হিসাব রেখেছেন?’
সপ্তর্ষি বলল, ‘কেন? এখানে আসার সময় কি সিনেমা হলের ইন্টারভ্যাল হয়েছিল যে সবাইকে একসঙ্গে মুততে যেতে হল?’
– তাহলে আপনি তিরিশ জনের হাফ-ডে সাপ্লাই লিখবেন না?
– না। আমার হিসেবে যা হয়েছে তাই লিখব।
– হামি যদি এখন আপনাকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে ঢালাই করে দিই, কেউ আপনাকে বাঁচাতে আসবে?
– হামিও যদি আপনার পাছায় লাথি মেরে সাইট থেকে বের করে দিই, কোন বাপ আপনাকে বাঁচাতে আসবে?
– মুখ সামলে কথা কইবেন। বাপ তুলবেন না। আমি কার্ত্তিক ঘোষকে রিপোর্ট করব।
– করগে যা শালা। আমাকে কার্ত্তিক ঘোষ দেখাচ্ছে……রাগে গজগজ করতে করতে বাপি মণ্ডল চলে যায়।
সাইটের অন্যদিকে কাজ করছে নুরুল ইসলামের দল। ভারি অমায়িক মানুষ। আগে তাদের অনেক জমিজমা, আমবাগান ছিল, গঙ্গার ভাঙনে সব গেছে জলের তলায়। এখন পার্ট টাইম ঠিকেদারি করে। মাটি কাটার কাজে তার লেবাররা বিশেষ দক্ষ। ভোর থেকে এসে কাজে লেগে পড়ে। গায়ে ফুলশার্ট অথবা গেঞ্জি, লুঙ্গি হাঁটুর উপরে গোটান। সঙ্গে বড় বড় ঝোড়া আর কোদাল। ঝোড়ার ভেতরের দিকে সিমেন্ট ব্যাগ পাতা, যাতে মাটি বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারে। অন্য ঠিকেদারের লেবাররা যখন সাইটে পৌঁছয়, ওদের ততক্ষণে ঘণ্টা তিনেক কাজ হয়ে গেছে। তারপর ওরা নাস্তা করতে যায় লেবার কলোনিতে। মাটি কাটায় পাল্লা দিতে হয় যন্ত্রের সঙ্গে। এক সর্দারজি বসে আছেন বিশাল এক্সক্যাভেটর মেশিনের কেবিনে। সর্দারজিও বিশাল। দাড়িগোঁফের ফাঁকে ঈশ্বরের মত রহস্যময় হাসি। একবার দেখেন মালদা গ্যাং কে। পরক্ষণেই মেশিনের ধাতব হাত-নখ ঢুকিয়ে দেন মাটির গভীরে। এক মুঠো মাটি নিয়ে মেশিন ঘুরে যায় টিপারের দিকে, সেখানে মুঠো আলগা করে মাটি ঢেলে দেন তিনি। কয়েক মুঠো মাটিতেই টিপার ভরে যায়, তারপর মাটি নিয়ে রওনা হয়, সাইটেরই অন্য জায়গায় স্তূপ করে রাখে। মালদা গ্যাং ও দেখে সর্দারজি কে। কী অবলীলায় সর্বত্র বিচরণ করছে ওই যন্ত্র-খনক। খর্বকায় মানুষগুলি মাথায় মাটিভর্তি ঝোড়া নিয়ে আরও খর্ব, নুব্জ হয়ে যায়। নদী নিয়েছে জমি বাড়িঘর, যন্ত্র বুঝি বা কেড়ে নেয় পেটের ভাত। প্রাণপণে মাটি কাটে মালদা গ্যাং!
সাইটের সামনেই এক অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট কাঁটা গাছ, পাথর, কোনদিকে বালির আস্তরণ অনেকটা ঢাল জুড়ে। ছাগল, ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। একটা মাইনিং কোম্পানি ড্রিলিং করছে পাহাড়ের উপরে। ওই পাহাড়ের পেটের ভিতরেই আছে লাইমস্টোন বা চুনাপাথর – সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল। লাইমস্টোন প্রথমে এসে জমা হবে ক্রাশারে, সেখান থেকেই পরে, পুরো সিমেন্ট প্ল্যান্ট জুড়ে নানা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে সিমেন্ট তৈরি হবে এবং শেষে সিমেন্ট সাইলোতে জমা হবে। তারপর সেখান থেকে প্যাকিং করে ফ্যাক্টরির বাইরে বেরিয়ে যাবে।
৪
আমি যত দূরেই যাই
আমার সঙ্গে যায়
ঢেউয়ের মালা গাঁথা
এক নদীর নাম –
আমি যত দূরেই যাই।
আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোন
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
আমি যত দূরেই যাই।
লিখেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আজ এই শীতের রাতে, রাজস্থানের ব্যাওয়ার জেলায় রাবড়িওয়াস গ্রামে নির্মীয়মাণ সিমেন্ট কারখানার প্রান্তরে, পঙক্তি ক’টি হানা দিল অর্কর মাথায়। সিমেন্ট সাইলোর কাজ চলছে। সাইলো হল সিলিন্ডারের আকৃতির একটি কংক্রিট স্ট্রাকচার। এখানে দিন রাত একটানা ঢালাই চলতে থাকে যতক্ষণ না সাইলো নির্ধারিত উচ্চতা অবধি পৌঁছয়। এই স্ট্রাকচারে এক বিশেষ পদ্ধতির শাটারিং ব্যবহার করা হয়। শাটারিং খোলার দরকার হয় না, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় তা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে, ঢালাই ও চলতে থাকে। সাইলোর যদি ভাষা থাকতো, পাশের বড় সাইলোকে বলতে পারত, ‘দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’।
মাটি থেকে প্রায় দেড়শ ফুট উঁচু সাইলোর ডেকে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক। গভীর রাত। হু হু করে হাওয়া বইছে। সোয়েটার, জ্যাকেট, টুপি, গ্লাভস পরেও ঠাণ্ডাকে কাবু করা যাচ্ছে না। উঁচুতে থাকার ফলে হাওয়ার বেগও প্রবল। ঢালাই চলছে। নীচে থেকে মেশিনে করে কংক্রিট উপরে উঠে আসছে। লেবাররা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঢেলে চলেছে সেই কংক্রিট। জেনারেটর, মিক্সার, ভাইব্রেটরের যান্ত্রিক শব্দ। তারই মাঝে কিছু দৃশ্যের জন্ম হয়। ধান কাটা হয়ে গেছে। শূন্য মাঠ। মাঠে পড়ে থাকা ধানের শিষ কুড়িয়ে নিচ্ছে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা। লুকোচুরি খেলছে মেঠো ইঁদুর। ধান বিক্রি করে যে-কটি টাকা পাওয়া যাবে, তাই দিয়ে মকর সংক্রান্তির মেলায় কিনে নেওয়া যাবে কিছু স্বপ্নে-দেখা খেলনাপাতি। ক্ষেতের মাঝখানে ছেড়ে রাখা ধানের শেষ আঁটিটি পূজো করা হল সর্ষে ফুল দিয়ে, তারপর কাস্তে দিয়ে কাটা হল। মাথায় করে তাই নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে চলেছে একটি বালক। সঙ্গে শাঁখের শব্দ, পেতলের গাড়ু থেকে জলের ধারা। পেছন ফিরে তাকাতে নেই। সেই ধানের আঁটিটিই পরে রাখা হবে খামারের মাঝখানে। সেখানেই খামার-লক্ষ্মী পূজো হবে মকর সংক্রান্তিতে। উঠোন জুড়ে আলপনার কারুকার্য। ফুল, লতাপাতা, কুলো, ধামা, লাঙল, মই, প্যাঁচা, লক্ষ্মীর পা। সন্ধ্যে থেকেই শেয়াল কিংবা প্যাঁচার ডাকের জন্য প্রহর গোণা। প্রতিটি ডাকের সঙ্গে শঙ্খধ্বনি, জলের ধারা, খামার প্রদক্ষিণ। ছোট্ট খালের জলে তুসু বিসর্জন। গানের লড়াই – আমাদের তুসু…..তোদের তুসু……। পুলি পিঠে, খেজুর গুড়, চালের গুঁড়ি ও ফলের কুচি দেওয়া মকর। খেজুর রসের অপার্থিব ভোর।
কত কীই তো জানা গেল এই কয়েক মাসের প্রবাস জীবনে! বড় কাঁচি দিয়ে কেটে উপরে দই ঢেলে শিঙাড়া পরিবেশন, গুড়ের চা, উটের গাড়ি, কাঁটা না বেছেই উটের কাঁটাগাছ খাওয়া, টিন্ডের তরকারি (অর্কদের পছন্দ না হলেও, উটকে পরমানন্দে কাঁচা টিন্ডে খেতে দেখা গেছে), খাটো ধুতি আর মাথায় পাগড়ি পরা রাজস্থানি পুরুষ, আগলালম্বিত ঘোমটা দেওয়া রাজস্থানি মহিলা, ‘রাজকীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়’ থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি দপ্তরের রাজকীয়তা, রাজস্থানি বিয়ের ‘সংগীত’ অনুষ্ঠান আর বাঙালিদের বাংলা ভুলে যাওয়া। ওদের বিলিং ইঞ্জিনিয়ার দাসদা একবার ট্রেনে আগুন লাগার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার ‘আগ’ ‘আগ’ করছিলেন। আগ থেকে আগে বঢ়তে তাঁর যথেষ্ট সময় লেগেছিল, দু-চারবার হোঁচট খেয়ে শেষ পর্যন্ত আগুনে পৌঁছেছিলেন। দুপুরের খাবার আসত ব্যাওয়ারের মেস থেকে, সেই সময় সবাই গিয়ে সাইট অফিসে জড়ো হোত। মঙ্গলব্রত মুখার্জি ছিল প্রায়-পার্মানেন্ট মেস ম্যানেজার। ডিম খাইয়ে খাইয়ে সবার মঙ্গল করাই বোধ হয় তার জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল – মেনু জিজ্ঞেস করলেই বলত, ডবল ডিমের আন্ডা কারি। এই সব ঘটনাপ্রবাহের ভেতরেও, অর্কর অবচেতনে কোথাও রয়ে গেল – নিকোনো উঠোন, সারি সারি লক্ষ্মীর পা!
সেদিন সতীন্দর সাইটে এল রাগে গরগর করতে করতে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
সতীন্দর বলল, ‘ম্যায় আভি যা কে বোস সাব কো কমপ্লেন করুঙ্গা। ক্যায়া চল রাহা হ্যায় ইয়ে লেবার কলোনিমে?’
অর্ক জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যায়া হুয়া?’
জানা গেল, কাল রাতে লেবার কলোনিতে মদের আসর বসেছিল। সেটা অবশ্য নতুন ঘটনা কিছু নয়, এরকম দারুপার্টি মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে। কয়েকজন ঠিকেদার, প্ল্যান্ট অপারেটর, হেল্পার, মেকানিক, ইলেক্ট্রিসিয়ান, ফোরম্যান, সুপারভাইজার সবাই মিলে মদ মাংস সহযোগে আড্ডা চলে। এক-আধজন, নাইট শিফটের ইঞ্জিনিয়ারও জুটে যায় কখনও সখনও। কালও সেই রকম পার্টি চলছিল। তারপরই হঠাৎ মাঝরাতে লছমিদের ঝুপড়ির টিনের দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা পড়তে থাকে। দরজা খুলে কয়েকজন মহিলা বাইরে এলে, মাতালরা তাদের হাত ধরে টানাটানি করতে শুরু করে। সেইসময় মহিলাদের চিৎকারে, কলোনির অনেকেই বাইরে বেরিয়ে আসে। দুপক্ষের হাতাহাতি শুরু হয়। কিল-চড়-ঘুসিতে আহতও হয় অনেকে। এরই মধ্যে যাদের নেশা কম হয়েছিল, তারা সবাইকে শান্ত করে ঝুপড়িতে ফেরত পাঠায়। বলে দেয়, এসব কথা যেন বোস সাহেবের কানে না পোঁছায়। সতীন্দরকেও এক ঠিকেদার বলেছে, ‘ইয়ে সব বাত লেকর আপ যেয়াদা হল্লা মত করো। সাইট মে অ্যায়সা হোতা হ্যায়। আপ পহেলি বার ঠেকেদারি করনে আয়ে হো, আপকো যেয়াদা মালুম নেহি হ্যায়। হাম আপস মে ব্যায়ঠকে মামলা সুল্টা লেঙ্গে। আপ বোস সাব কো কমপ্লেন মত করনা’।
এসব যে নিছক পরামর্শ নয়, আসলে হুমকি – বলার ধরণ দেখে তা পরিস্কার বুঝতে পারে সতীন্দর। তবে সেও ভুমিহার, এত সহজে ওদের ছেড়ে দেবে না। আজ সতীন্দরের দল কাজে আসেনি। যতক্ষণ না এই ঘটনার বিচার হয়, ততক্ষণ ওরা কেউ কাজে আসবে না। লছমি আর তার সঙ্গের কয়েকজন তো ওই ঘটনার পর সারারাত ঘুমোয়নি, একটানা কেঁদেই চলেছে। এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সতীন্দর অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কোন ফল হয় নি।
ঘটনার সময় সতীন্দর লেবার কলোনিতে ছিল না। ঠিকেদাররা প্রায় সবাই সাইটের বাইরে, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ‘রাস’ নামে এক জায়গায় আলাদা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। সেটাও প্রায় গ্রাম, তবে কয়েকটা মুদিখানার দোকান আছে, সব্জি বাজার বসে, ওষুধের দোকান আছে, অংরেজি শরাবের দোকান আছে – ব্র্যাকেটে লেখা ‘ভাও মে ভারি কমি’। সতীন্দর ঠিক করল এবার থেকে সে একটা মুন্সি রাখবে, লেবার কন্ট্রোল করার জন্য, যে সবসময় লেবারদের সঙ্গে থাকবে। ফিমেল লেবারদের একা ছেড়ে দেওয়াটা নিরাপদ নয়। তবে সবার আগে বোস সাবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বোস সাহেব মন দিয়ে শুনলেন সতীন্দরের কথা। ঘটনার সময় যারা ছিল তাদের প্রত্যেককে ডেকে পাঠিয়ে তাদের বক্তব্য শুনলেন। বোস সাহেবের চোখ কান সব সময় খোলা থাকে। অল্প সময়েই বুঝতে পারলেন কারা জড়িত এই ঘটনায়। ডাকলেন সেই ঠিকেদার, অপারেটর, হেল্পার, মেকানিকদের। তারপর সতীন্দরের সামনেই তুমুল গালিগালাজ করলেন সবকটাকে। প্রায় মারতে বাকি রাখলেন। পরিস্কার বলে দিলেন, এটাই লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর এরকম ঘটলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সাইটের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। পুলিশ কেস হয়ে যাবে। সবাইকে দিয়ে সতীন্দরের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ালেন।
সতীন্দর মোটামুটি খুশী হয়েছিল বিচার প্রক্রিয়ায়। কিন্তু লছমি এবং আরও চার-পাঁচ জন মহিলা আর থাকতে চাইল না সাইটে। অগত্যা সতীন্দর ওদের সঙ্গে একজন লোক দিয়ে ওদের বিহারে পাঠিয়ে দিল। কিছুদিন পরে সে নিজে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।
সতীন্দর মনমরা হয়ে ঘোরে সাইটে। অর্ককে বলে, ‘গরীব লোগো কা কোই ইজ্জৎ নেহি হোতা। গরীব হোনা পাপ হ্যায়, আওরত হোনা পাপ হ্যায়, আউর গরীব আওরত – উয়ো ভি নীচা জাতকা, উসকা তো মর যানা হি আচ্ছা হ্যায়’।
ডিসেম্বরের সকাল। ভগবান শুনেছিলেন সতীন্দরের প্রার্থনা! কাল রাতে খুন হয়ে গেছে লছমি পাসওয়ান। লক্ষ্মণপুর বাথে গ্রাম। মুখে কাপড়-বাঁধা লোকেরা এসেছিলো নদী পেরিয়ে। হাতে তরোয়াল, রাইফেল, ভোজালি। ঠাণ্ডা শীতের রাতে ঘুমোচ্ছিল সবাই। পুরুষরা বেশীর ভাগই বাড়ির বাইরে। ন্যূনতম প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারে নি অসহায় মহিলা আর শিশুর দল। সবচেয়ে ছোটটি এক বছরের বাচ্চা। ওদের খতম করো। ওরা সব বড় হয়ে নকশাল হবে। মেয়েদের খতম করো, ওরা কেবলই নকশালদের জন্ম দেয়। ওই তো লুকিয়ে আছে চালের বস্তার আড়ালে। টেনে বের করে আনো, আগে ধর্ষণ করো, তারপরে খুন। গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দাও জন্মপথ। সফল অপারেশন শেষ করে বুক ফুলিয়ে চলে যায় সেনাদল। পড়ে থাকে জীবনের সংক্ষিপ্ত আয়োজন – বাঁশ আর টিনের চালের ছোট কুঁড়েঘর, পলেস্তারা-হীন দেওয়াল, দড়ির খাটিয়া, ছেঁড়া কাঁথা, হাঁড়ি-কলসি, পাতকুয়ো, গরুর জাবনা খাওয়ার পাত্র।
পরদিন শোণ নদের তীরে গণচিতায় জ্বলে প্রভা, মনমতিয়া, লছমিদের শরীর। পোড়ে লছমির পা। পোড়ে নিকোনো উঠোনের স্বপ্নও!