টীনটোরেটোর ছবি

সায়ন্তন ভট্টাচার্য

গতবছর, নভেম্বরের কুড়ি। উত্তর ইতালির কাস্তেলেভেচ্চিও মিউজিয়ামে সন্ধ্যে নেমে আসছে, সাথে হালকা হাওয়া। গার্ডদের শিফট বদলের সময় আচমকাই গোটা মিউজিয়াম কেঁপে উঠল। তিনজন মুখোশধারী আর্মড রবার একে একে এগারটা ছবি চুরি করে পুলিশের নাকের সামনে দিয়ে পালাচ্ছে, সবাই দেখছে ফ্রেমের বর্ডার বরাবর চাকু চালিয়ে নিখুঁত হাতে তিনজন ক্রিমিনাল কেটে নিচ্ছে একের পর এক মাস্টারপিস যাদের মধ্যে, না, টীনটোরেটোর যীশু নেই, রয়েছে তাঁর আঁকা দুর্মূল্য কিছু মেল পোর্ট্রেট আর পিটার পল রুবেন্সের ১৬২০’র ওয়র্কশপ থেকে কালেক্টেড সামান্য কয়েকটা কাজ। ছবিগুলো এমন কিছু ফেমাস নয়, পরের দিন প্রেস কনফারেন্স থেকে জানা গেল এগারোটা পেইন্টিঙের সব মিলিয়ে দাম ছিল মোটে পনেরো মিলিয়ন ইউরো।

এবার সংখ্যার একটা মজা আছে, আমরা যতক্ষণ না সেটার প্রকৃত ভ্যালু বুঝতে পারি, অঙ্কের হিসেব বিশেষ মাথায় ঢোকেনা…পনেরো মিলিয়ন ইউরো হল একশো নয় কোটি, আটত্রিশ লক্ষ, একাত্তর হাজার দুশো চার টাকা। মানে একজন মধ্যবিত্ত ভারতীয় চাকুরিজীবী’র অ্যানুয়াল ইনকাম ৬ লাখ অ্যারাউন্ড ধরলে বিশ’এ নভেম্বর, ২০১৫ তে তিনজন মুখোশধারী লুম্পেন এসে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে প্রায় চল্লিশজন মধ্যবিত্ত মানুষের গোটাজীবনের আয় লুট করে পালিয়ে গেছিল। তবে অন্যান্য আর্ট থেফটের কাছে এই ঘটনা বাচ্চা, পৃথিবীর ইতিহাসে পেইন্টিং চুরির যে কত রোমহর্ষক ঘটনা আর তাদের ঘিরে টাকার ছড়াছড়ি রয়েছে তার হিসেব নেই।

আকাশ কালো করা বিকেল, সমুদ্রে ওঠা ভয়ানক ঝড়ে নৌকোটা এই ওল্টালো বলে! যাত্রীদের সবার নাজেহাল অবস্থা, কেউ বমি করে ফেলছে তো কেউ হাউমাউ করে কাঁদছে, কেউ পাল আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে…শান্ত কেবল একজন- যীশু, তিনি উদাস মুখে বললেন, “হোয়াই আর ইয়ে ফিয়ারফুল? ও ইয়ে অফ লিটল ফেইথ?” ছবিটার নাম ‘দ্য স্টর্ম অন দ্য সি অফ গালিলি’, ১৬৩৩ এ রেমব্রান্টের আঁকা একমাত্র সি ল্যান্ডস্কেপ যেটা ১৯৯০ সাল অবধি ম্যাসাচুসেটস’এর ইসাবেলা স্টেওয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়াম আলো করে রাখত। তারপর? হাওয়া!

ঠিক একই ভাবে সন্ধ্যের শিথিল হয়ে আসা গার্ডদের শিফটকে কাজে লাগিয়ে নকল পুলিশের বেশধারী দু- তিনজন ছিনতাইকারী ৯০ সালের ১৮ই মার্চ তিনটে রেমব্র্যান্ট, একটা ভামেয়ার, পাঁচটা দেগা, একটা মোনে মিলিয়ে মোট ১৩টা পেইন্টিং চুরি করেছিল যার মোট প্রাইস ৫০০ মিলিয়ন ডলার। হিসেবটা আরেকটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক? ৫০০ মিলিয়ন ডলার হল ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে তিন হাজার তিনশো সাতচল্লিশ কোটি ছত্রিশ লক্ষ টাকা। হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ ২০১৫ তে গ্রীসের যে দ্বীপটি কিনেছিলেন তার দাম পড়েছিল ৪.২ মিলিয়ন ইউরো, হিসেব করে দেখলাম সেদিনের লুট করা শিল্পগুলি বেচলে এই রকম ১১০ টা দ্বীপ কেনা যাবে!

পরের অ্যাটাকটা হল ১৯৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর, মধ্যরাত্রে যখন গোটা পৃথিবী মিলেনিয়াম সেলিব্রেট করছে। রাত দেড়টা নাগাদ অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামের ছাদে বেড়ালের মত সাইলেন্ট পদক্ষেপে উঠে এল এক ক্রিমিনাল মাস্টারমাইন্ড, তার হাতে সময়ের অভাব নেই, গার্ডরাও পার্টির নেশায় মত্ত। সেই তস্কর চূড়ামণি ছাতের গ্লাস সিলিং থেকে একটা চৌকো স্ল্যাব কেটে আলাদা করে, সেই ফুটো থেকে মিউজিয়মের ভেতরে স্মোক বম্ব ছেড়ে ফায়ার অ্যালার্ম অ্যাক্টিভেট করে দেয় কারণ ফায়ার রেগুলেশন অনুসারে মিউজিয়ামের ভেতরে আগুন লাগলে প্রহরীদের প্রবেশ নিশিদ্ধ। তারপর? মিশন ইম্পসিবল স্টাইলে রোপ ল্যাডার ঝুলিয়ে ভেতরে ঢোকা এবং ৩ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সেজ্যানের বিশ্বখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ চুরি। বেশি না, চব্বিশ কোটি বাহান্ন লক্ষ চার হাজার ষোলো টাকা। মানে ওই আট ন’টা ল্যাম্বর্ঘিনি অ্যাভেন্তাদর কেনা যাবে মোটে!

এসব হল জাস্ট কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা, আর্ট লস্ট রেজিস্টারের ডেটাবেস অনুসারে গোটা বিশ্বে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৪ লক্ষ পেইন্টিং চুরি হয়েছে এবং কেসদের মধ্যে সলভড হয়েছে জাস্ট ১৮%। ভ্যান গঘ, মোনে, দাভিঞ্চি, গোয়া, রেমব্রান্ট- কে নেই সেই লিস্টে! কিন্তু তখনই এলো আসল প্রশ্ন। কেউ কেন একটা ওয়র্ল্ড ফেমাস পেইন্টিং চুরি করবে? কাজটা যতই ভ্যালুয়েবল হোক, আপনি তো কোনো দোকানে গিয়ে বলতে পারবেন না, “দাদা মোনালিসাটা বেচব ভাবছি, বেশি বার্গেন করবেন না- ওই ষাইট কোটি ধরুন, কাল পে করে দিয়েন!” তবে? কালেকশন বাড়ানোর জন্যে?

আপনি কল্পনা করতে পারেন একজন বিলিওনেয়ার আর্ট এন্থুসিয়াস্ট নিজের রেপুটেশন, সেফটির কথা না ভেবে রোপ ল্যাডার নিয়ে ঝুলে ঝুলে এসব লেজেন্ডারি আর্ট হাইস্ট করছে? না মশাই, ওসব ওশানস ইলেভনে হয়, রিয়েল লাইফে হয়না। রিসার্চ করে পাওয়া গেল এক ভয়ানক তথ্য- এইসব প্রাইসলেস পেইন্টিং আসলে মাফিয়ারাজ্যে গোল্ড লোনের মত কাজ করে, লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট। মানে ভেবে দেখুন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে শুরু করে এফ বি আই হয়ে দুনিয়ার বাঘা বাঘা পুলিশ এজেন্সীরা মাথায় হাত দিলে হতাশ সরকারের আর কী করার থাকে? রিওয়ার্ড ঘোষণা।

তাছাড়া একে লেজেন্ডারি কাজ তায় স্টোলেন- ফলে বিক্রীর অযোগ্য হয়েও পেইন্টিঙগুলোর মার্কেট ভ্যালু রাজারহাটের ফ্ল্যাটের মত সময়ের সাথে সাথে বাড়তেই থাকে। অর্থাৎ নিখুঁত প্ল্যানে চুরি করা পিকাসোর কিউবিজমকে কোনো বড়লোক বাড়ির দেওয়ালে সাঁটানো পাওয়ার চেয়ে কোনো ইতালিয়ান কিংপিনের সিক্রেট ডার্করুমে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকতে পাওয়ার চান্স অনেক বেশি…

আমরা তবে কী বুঝলাম? পেইন্টিং জিনিসটাকে আপনি সিরিয়াসলি নাই নিতে পারেন, অ্যাবস্ট্রাক্ট দেখে বলতেই পারেন সীমাহীন আঁতলেমো, ফ্রিদা কাহ্লো’র সেলফ পোর্ট্রেট দেখে মনে হতেই পারে এর চেয়ে প্রিজমা বেটার, দালি’র ‘প্রিন্টেম্পস নেক্রোফিলিক’ দেখে ভাবতেই পারেন এমন ছবি আপনার ছোটো বোন আঁকে। কিন্তু মনে রাখবেন, একটা পেইন্টিং কেবল কাপড়ের ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি নয়, এক একটা এরা’র রিপ্রেজেন্টেশন, হিস্টোরিকাল খাজানা যাদের একখানি পিস আমাদের কারো কাছে থাকলেও পরবর্তী তিন পুরুষ স্রেফ বিছানায় শুয়ে দিদি নং ওয়ান দেখে কাটিয়ে দিতে পারত…কখনো ভাবেন এগুলোর কথা?

ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। তারপর রং, তুলি নিয়ে বসে যান। কে জানে একদিন আপনার আঁকাও মিউজিয়াম আলো করে থাকবে সুদূর ভবিষ্যতে।

Leave a Reply