পুপু-শ্যাডো ‘ছিবো’তে

গার্গী রায় চৌধুরী

ঘুমের ঘোরে শ্যাডো শুনল বাবা কোথাও একটা বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছেন। মাও বলছেন ‘চলো ঘুরে আসি। অনেকদিন যাই না কোথাও’। এর আগেও মা বাবার সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে ও আর পুপু। বুকের মধ্যে আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো। স্বপ্নে দেখল একটা পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে চলেছে ও আর পুপু। পাহাড়ের গায়ের জঙ্গল থেকে একটা বন মুরগি বেরোনো মাত্র যেই ও ভউ করে ছুটে গেছে, পিছন পিছন ছুটেছে পুপু। কিন্তু ওরা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না মুরগি টাকে। এরমধ্যে পুপুর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল শ্যাডোর। ওর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে পুপু ডাকছে, ‘শ্যাডো ওঠ খেলতে যাবি না? বিকেল হয়ে গেছে’। শ্যাডো গড়াগড়ি খেয়ে লেজ নেড়ে বোঝাল পুপুর কথা ও খুব বুঝেছে।
খেলতে খেলতে বেড়াতে যাবার কথা আর মনে ছিল না শ্যাডোর। রাত্রে ডিনারের সময় মা পুপুকে বললেন পুপু আমরা পরশু কালিম্পং এর খুব কাছে একটা ছোট্ট গ্রামে যাব, গ্রামের নাম ছিবো। পুপুর সামার ভাকেসান শুরু হয়েছে সবেমাত্র, এর মধ্যেই এত ভাল খবর টা যে আসবে তা একেবারে ভাবতেই পারেনি পুপু। শ্যাডো বসে ছিল ডাইনিং টেবিলের পাশে, ওর মনে পরে গেল আর ভউউউউউউ করে বলতে চাইল সেকথা। আনন্দ ওর হচ্ছে কিন্তু সঙ্গে একটা দুশ্চিন্তাও আছে, মা বাবা যদি ওকে না নিয়ে যান? যদি রেখে যান দাদা-দিদার কাছে? গত পুজোয় যখন লাদাখ গিয়েছিল ওরা তখন শ্যাডো কে রেখে গিয়েছিল দাদার বাড়িতে। পুপু খুব কান্না কাটি করেছিল আর বায়নাও করেছিল শ্যাডো কে নেওয়ার জন্য কিন্তু বাবার সেই এক কথা শ্যাডো কে ওখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। কেন নেওয়া যাবে না সেটা পুপু শ্যাডো কেউই বুঝতে পারেনি। কিন্তু পুপু কে ছাড়া পূজো টা পুরো মাটি হয়েছিল শ্যাডোর। পুপু ও বেরিয়ে এসে বলেছিল ও নাকি একটু ও এঞ্জয় করেনি শ্যাডো কে ছাড়া। কিন্তু মা বাবা সেকথা বুঝলে তো? এবার কি হবে কে জানে? ভাবতে ভাবতে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শ্যাডো। তাকিয়ে দেখল পুপু চেয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখটা গম্ভীর মানে শ্যাডো যা ভাবছে পুপুও তাই ভাবছে। বাবা টেবিলে এসে বসতেই পুপু জিজ্ঞেস করল, ‘এবারে শ্যাডো যাবে তো? ও না গেলে কিন্তু আমি যাব না কিছুতেই’। শ্যাডো দেখল বাবা মিটি মিটি হাসছেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ শ্যাডো যাবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে’। কথাটা শোনা মাত্র শ্যাডো আর সামলাতে পারল না নিজেকে। ভউউউউউউউ বলে ছুট্টে গিয়ে বাবার কোলে উঠতে গেল আর ওর ধাক্কা লেগে কাঁচের গ্লাস টা টেবিল থেকে মাটিতে পরে ভেঙ্গে গেল। এক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ব্যাপার তা ঘটে গেল। শ্যাডো বুঝতেও পারল না কি করে কি হল। ও তো বাবা কে আদর করতে গেছিল। মা তখন রান্না ঘরে। পুপু শ্যাডো বাবা সবাই জানে এর পর কি হবে, মা ভীষণ রেগে গিয়ে বকবেন সবাই কে। তাই বাবা আর পুপু তাড়াতাড়ি করে ভাঙ্গা কাচের টুকরো গুলো সরিয়ে ফেলতে লাগলো। আর শ্যাডো সোজা গিয়ে ঢুকে পড়ল সোফার তলায়। মা রেগে গেলে এই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হয় শ্যাডোর।
দেখতে দেখতে একটা দিন কেটে গেল, আজ ওদের বেরোনো, মা বাবার সঙ্গে পুপু যাবে ফ্লাইটের চেয়ারে বসে আর শ্যাডো কে যেতে হবে মালপত্রে ঠাসা ফ্লাইটের পেটের মধ্যে একটা খাঁচার ভিতর। অসহ্য লাগছে শ্যাডোর, কান্না পাচ্ছে খুব। পুপু বাবা মা সবাই ওর কষ্ট বুঝতে পেরে সকাল থেকে ওকে আদর করছে আর বোঝাচ্ছে, মাত্র এক ঘণ্টার ব্যাপার, একটু কষ্ট করতে হবে। শ্যাডোও জানে এক ঘণ্টার কষ্টের পর শুধু মজা আর মজা। ওর ভয় করে মা বাবা পুপু কে ছেড়ে থাকতে। আগের বার ফ্লাইটে উঠবার আগে এয়ার লাইনের দুটো ছেলে টিজ করেছিলো ওকে, কান টানছিল, চড় মারছিল অকারণ। এই সব ছেলেপুলেদের কামড়ে দিলে তবে শায়েস্তা হয়। কিন্তু মার মুখটা মনে পড়লে আর কোন দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হয়না শ্যাডোর। মা বকবেন, বাবাও অপদস্ত হবেন এসব ভেবে চুপ করে ও সহ্য করেছিল ছেলে দুটোর বদমায়েশি। এবার কি হবে কে জানে। এয়ারপোর্টে পৌঁছেই তো ওকে আলাদা হয়ে যেতে হবে মা বাবা আর পুপুর কাছ থেকে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল ওর। পুপুর কাছে ছুটে গিয়ে ও পুপুর হাত টা চেটে আদর করে দিল একটু।
বাগডোগরা এয়ার পোর্টে পৌঁছে মা বাবা পুপুর সঙ্গে দেখা হতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল শ্যাডো। যেন কতদিন দেখেনি ওদের। বাবা এক প্যাকেট কাজু বিস্কিট কিনে শ্যাডো কে খাওয়ালেন তারপর গাড়ি করে ওরা রওনা হোল ছিবোর দিকে। পৌঁছল যখন তখন বেলা দুটো টো বেজে গেছে। কালিম্পং আট মাইল পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেছে ছিবো যাওয়ার রাস্তা। দূরত্ব চার কিলোমিটার মাত্র। পাইন বনের মধ্যে দিয়ে গেছে এই পাথুরে রাস্তা, পিচ পড়েছিল কোনসময় কিন্তু তা ভেঙ্গে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পাথর। রঙিন পাহাড়ি ফুল আর নানা রকমের ফার্ন পথের দুদিক জুড়ে। পাথুরে রাস্তা তাই চার কিলোমিটার যেতে সময় লাগলো প্রায় আধ ঘণ্টা। পাহাড়ের মাথায় গাড়ি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল যেখানে তার পরে আর রাস্তা নেই। সামনে ভরত কালিকটির ছোট্ট দোকান, ওটাই ল্যান্ডমার্ক বাবা বললেন। রিসর্টে ফোন করতে তারা লোক পাঠাল, সে এসে মালপত্র নিল আর ওর পিছন পিছন চলল বাবা মা পুপু আর শ্যাডো। পাথর দিয়ে বাঁধাই করা সুন্দর রাস্তা। সামনে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কানচঞ্জঙ্ঘা, সূর্যের রঙ তার সারা গায়ে তখনও লেগে আছে। রিসর্টের লোক এসে ওদের কটেজের দরজা খুলে দিল।
কটেজের ঘর থেকে বেরোলেই খোলা বারান্দা, কাঠের রেলিং দেওয়া, সামনে তাকালে উন্মুক্ত আকাশ, বনভূমি, আর পাহাড়। পুপু আর শ্যাডো মহানন্দে হুটপাটি লাগিয়ে দিল বারান্দাতেই। কিন্তু সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। খেলতে খেলতে শ্যাডো দেখল দূর থেকে ওদের কটেজের দিকে দৌড়ে আসছে একটা পেল্লাই কুকুর। ভয়ে শ্যাডোর গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না, মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীরের ভিতর অব্দি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল ওর। পুপু তখন খেলায় ব্যস্ত এমনকি শ্যাডো যে খেলছে না সেটাও ও লক্ষ্য করেনি। লক্ষ্য করল যখন তখন কুকুর টা ওদের কটেজের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় পা রেখেছে। শ্যাডো অবাক হয়ে দেখল পুপু ভয় পেলনা একটুও। বরং কুকুরটাকে ব্রুনো বলে ডাকতেই ও পুপুর গায়ে উঠে পুপুকে আদর করতে লাগলো। পুপু শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে বলল ‘শ্যাডো ওর নাম ব্রুনো, ও এখানেই থাকে, মাল বয়ে আনল যে কাকু টা সে বলেছিল। আর ব্রুনো, ও হচ্ছে শ্যাডো, আমার বোন’। পুপু ব্রুনো কে আদর করছিলো দেখে একটু অভিমান হয়েছিল শ্যাডোর, কিন্তু এখন আর তা নেই, শ্যাডো জানে ও মানুষ নয়, কুকুর। কিন্তু পুপু যখন ওকে নিজের বোন বলে পরিচয় দেয় তখন ওর ভীষণ আনন্দ হয়। ব্রুনো এগিয়ে এসে আদর করল শ্যাডোকে। ব্যাস বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুপুরে খাবার ঘরে খেতে গিয়ে ওরা দেখল পর্দার আড়াল থেকে একে একে বেরিয়ে এলো আরও তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে। রিসোর্টের মালিক সুজানের ছেলে ও ভাইপো,ভাইঝি ওরা। পুপু নিজে থেকে সবার সঙ্গে আলাপ করল, আর পকেট থেকে চকলেট বার করে ওদের হাতে দিল। ওদের সবার মুখ গুলো হাসি হাসি হয়ে গেল, সবাই হ্যান্ডসেক করল পুপু আর শ্যাডোর সঙ্গে। ওদের নাম জসুয়া, নিকোলাস, রুথ আর আয়ুশ। আয়ুশ আর পুপু একই বয়সী। ক্লাস সিক্সে পড়ে। বাকীরা ক্লাস ওয়ান টু। সঙ্গে আছে ব্রুনো, তার দুবছর বয়েস, মানে শ্যাডোর চেয়ে সে একবছরের ছোট। সবার মনে খুব আনন্দ । ছুটির দিনগুলো দারুন কাটবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না কারো।
(২)
মহাআনন্দে দুদিন কেটে গেল ওদের সকলের। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো। বড়রা মেতে রইলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তিস্তা কে নিয়ে। প্রকৃতি এখানে আরও বেশি উন্মুক্ত ও রমনীয়। অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। দেখে দেখে আশ মেটে না।
এদিকে পুপুদের নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে নানা রকম পাখি চেনাচ্ছে আয়ুশ। নিকোলাস শেখাচ্ছে কি করে পাহাড়ি ঝোরার মধ্যে থেকে কাঁকড়া ধরতে হয়। বড়দের অলক্ষ্যে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা ছোট বড় অ্যাডভেঞ্চার। পুপু ও শ্যাডো মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওদের দ্রুত ওঠা নামা দেখে। স্পাইদারম্যানের চেয়ে ওরা কোন অংশে কম নয়, পুপুর মনে হয়। আয়ুশ পুপু কে বলেছে একটা আশ্চর্য জায়গায় নিয়ে যাবে, সেই জায়গা টা নাকি এই অঞ্চলের সব চাইতে সুন্দর জায়গা। সেখান থেকে আকাশ টা খুব কাছে আর আকাশে পর পর সাজানো আছে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া, পায়ের নীচে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। আয়ুশ বলেছে সেই জায়গাটা নাকি ও ছাড়া আর কেউ জানে না। বড়রাও না। সেখানে ও নিয়ে যাবে পুপু কে। ব্রুনো আর শ্যাডো কে নেওয়া যেতে পারে। রুথ কে নেবে না মোটেই, কারণ ও খুব ভিতু আর বড্ড কাঁদে। নিকোলাস আর জাসুয়া কেও নেবে না বলল কারণ ওরা ছোট। আয়ুশ বলল ‘আগলা সাল সে নিকোলাস কো লেগা’। কারণ নিকোলাস ছোট বটে তবে এখনি সে বেশ সাহসী। বড় দের চোখ এড়িয়ে ঝোড়া থেকে আয়ুশের সঙ্গে কাঁকড়া ধরেছিল নিকোলাস আবার সেগুলো সবার চোখ বাঁচিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলো চৌবাচ্চার মধ্যে । বড় বড় কাঁকড়া গুলো ধরতে খুব ই বেগ পেতে হয়েছিল ওদের। দড়ি দিয়ে দাঁড়া গুলো বেঁধে আগুনে ঝলসে ওদের খাওয়া হবে এমনই প্ল্যান ছিল সবার। রাতে হবে বন ফায়ার, সেখানেই পোড়ানো হবে ওদের এমনই কথা ছিল। আর পরের দিন দুপুরের খাওয়ার পর যখন বিশ্রাম নেবেন বড়রা তখন আয়ুশ পুপুকে নিয়ে যাবে সেই অপূর্ব জায়গা টায়, আবার ওরা ফিরে আসবে সন্ধ্যার সময়, ওখানে যেতে হলে হাঁটতে হবে দু ঘণ্টা এমনই বলেছিল আয়ুশ। পুপুর রাতে ঘুম আসছিল না উত্তেজনায়। রাত পোহালেই সেই অ্যাডভেঞ্চার। মা বাবা কে না বলে যেতে হবে তাই একটু ভয় ও করছিলো পুপুর, কিন্তু এই সুযোগ ও হারাতে চায় না কোন মতেই। পরশু দিনই ফিরে যেতে হবে কলকাতায়। মাত্র একটা দিন সময় আছে হাতে।
(৩)
রাত দশটা বেজে যাওয়ার পরও যখন পুপু শ্যাডো আয়ুশ আর ব্রুনোর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না তখন মা ভেঙ্গে পড়লেন একেবারে। বাবা ফোন করছেন এখানে ওখানে। আয়ুশের সব বন্ধুদের বাড়িতেও খোঁজা হয়ে গেছে। কোত্থাও পাওয়া যায়নি ওদের। এদিকে জাসুয়া আর নিকোলাস ও জানে না কোথায় গেছে ওরা। বড়দের ধমক খেয়ে রুথ এই দুদিনের কাঁকড়া ধরা, পাখির পিছনে জঙ্গলে ছোটা ইত্যাদি অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলে দিয়েছে। খুব করে মার খেতে হয়েছে নিকোলাস আর জাসুয়া কে। ওই সব ঝোড়া তে নাকি বিষাক্ত সাপ থাকে, তাদের কামড়ে নাকি মারা যেতে পারত ওরা। নিকোলাস অনেক বার ঝোড়াতে সাপ দেখেছে, কিন্তু ওদের তাড়া দিতেই ওরা সরে যায়, কোনদিন ফোঁস পর্যন্ত করেনি। আর কামড়াতে এলে কাঁকড়া ধরার মতো করে ওদেরও ধরে ফেলত নিকোলাস। এ এমন কি ব্যাপার যার জন্য মার খেতে হয়। বুঝতে পারে না ওরা। আর আয়ুশ ওদের হিরো। সব চেয়ে উঁচু থেকে ওই লাফ দিতে পারে, সবচেয়ে বড় কাঁকড়া ওই ধরতে পারে। তাই নিকোলাস আর জাসুয়া নিশ্চিন্তে থাকে, আয়ুশ ঠিক চলে আসবে, আবার গেস্ট নিয়ে গেছে। ‘কুছ নেহি হোগা উসকো’। চারদিক খোঁজা খুঁজির পর রাত দশটায় কালিম্পং পুলিশের দ্বারস্থ হন পুপুর বাবা, আয়ুশের মামা নির্মলও যান সঙ্গে। পুপুদের ছবি বর্ণনা ইত্যাদি পুলিশকে দিয়ে ওঁরা ফিরে চলে আসেন রিসোর্টে।
(৪)
ভোর চারটে নাগাদ একটা ফোন আসে থানা থেকে। ‘আপনারা এখুনি একবার থানায় আসুন। আইডেণ্টিফাই করতে হবে’। পুপুর বাবা মিস্টার সেনের হাত থেকে ফোন পড়ে যায়, কি আইডেণ্টিফাই করতে ডাকছেন ওরা। পুপুরা ঠিক আছে তো। নির্মলকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ছোটেন থানার দিকে। উদ্ভ্রান্তের মতো ওরা থানায় পৌঁছে দেখেন এক কোণে একটি বেঞ্চির উপর বসে আছে পুপু আর আয়ুশ, পাশে শ্যাডো আর ব্রুনো। ওদের সারা গায়ে কাদা মাখা, বোঝা যাচ্ছে ভেজা জামা কাপড় গায়েই শুকিয়েছে। পুপু বাবা কে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, ‘সরি বাবা। আর কোনদিন হবে না এরকম’। আয়ুশ দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। ওর মামা নির্মল বকাবকি শুরু করতে যাবেন এমন সময় বড়বাবু এসে সামনে দাঁড়ান। ‘স্যার, উই আর প্রাউড ওব দিস কিডস। ওরা আজ দুজন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। মোটর সাইকেলে যাচ্ছিলেন এক দম্পতি। পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে খাদে পড়ে যান তারা। সন্ধ্যে নেমে আসে, বাচ্চা দুটো অন্ধকারে খাদে নেমে ওদের তুলে আনে। গাড়ি থামিয়ে পৌঁছে দেয় হসপিটালে। ওরা বেঁচে গেছে। বাচ্চা দের আর কুকুর দুটোকে হসপিটাল থেকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে গেছে থানায়’। বাবা বলেন, ‘কিন্তু ওরা বড় মানুষ দুজনকে তুলল কি করে খাদ থেকে’? ‘স্যার সুবুদ্ধি, আর সাহস থাকলে সবই হয়’। বড়বাবু পুপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। এবার পুপু বলল, ‘আমি আর শ্যাডো বসে পাহারা দিচ্ছিলাম ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী কে। ওদের জ্ঞান ছিল না। একজনের তো খুব রক্ত বেরোচ্ছিল। আয়ুশ আর ব্রুনো অনেক হেঁটে গ্রাম থেকে লোক ডেকে এনে তুলেছে ওদের’। ‘লেকিন তুমলোগ শামকো উতনা দূর ঊস রাস্তে পে গয়ে কৈসে’? নির্মল প্রশ্ন করে। পুপু কিছু বলার আগেই আয়ুশ বলে ওঠে, ‘ঘুমতে ঘুমতে রাস্তা ভুল করকে চলে গয়ে থে’। পুপু অবাক হয়ে তাকায় আয়ুশের দিকে, কেন রাস্তা ভুল করে গেছে এই মিথ্যেটা বলল আয়ুশ? আয়ুশ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন পড়ে ফেলল ওর প্রশ্ন। রিসোর্টে ফিরবার সময় বড় দের কান বাঁচিয়ে আয়ুশ বলেছিল বড় দের ও বলতে চায়না ওই সুন্দর জায়গাটার কথা। বড়রা জানলেই ওখানে ভিড় করবে সব ট্যুরিস্ট আর রেগে গিয়ে দূরে সরে যাবে আকাশ, পাহাড় আর তিস্তা। আয়ুশ শুধু ওর প্রিয় বন্ধুদেরই নিয়ে যাবে ওখানে।
কালিম্পং থেকে ছিবোর রিসোর্টে পৌঁছে ওরা দেখল সারা মহল্লা জড়ো হয়েছে মালা হাতে ওদের স্বাগত জানাতে। দুটো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে পুপু, শ্যাডো, আয়ুশ আর ব্রুনো তখন সুপার হিরো। পুপু দেখল শ্যাডোর দুচোখ চকচক করছে আনন্দে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *