উড়োচিঠি তোমাকে।।

ডঃ পারমিতা পূর্ণেন্দু পালিত

পুজোর লেখালেখি বা পড়ার অভ্যেস নিতান্তই পুরোনো আমার। লেখার সূত্রপাত পুজোর ছুটির পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াল পত্রিকায় উত্তরণ ঘটেছিল কাঁচা বয়সেই ।কচি হাতের লেখার মস্ত গুণ, আনকোরা স্বপ্ন বোঝাই থাকে অনেক।আর পড়ার অভ্যেস বাবা জেঠুর সূত্রে পাওয়া।মেজজেঠু দিব্যেন্দু পালিত প্রথিতযশা সাহিত্যিক হওয়ার সুবাদে “সাহিত্য” শব্দটি খুব ছোটবেলাতেই মগজে ঠাঁই পেয়েছিল।পুজো মানে চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন বাবার হাত ধরে জেঠুর বাড়ি একবার ঢুঁ মেরে আসা। অবশ্যম্ভাবী জেঠুর কোনো সদ্যপ্রকাশিত বই-এর প্রথম পাতায় স্নেহমিশ্রিত দু’কলম লিখে উপহার দিতেন। বড় উতসাহের সাথে স্কুলে দেখানোর মত একটা জিনিষ পাওয়া হত। আবছা আবছা শুনতাম লেখকেরা কত আগে থেকে পুজোর লেখার প্রস্তুতি শুরু করেন।
তা আমার এখন তাড়া খেয়ে কলম চলছে গড়গড়িয়ে ।আকাশের মুখ ভার। বারান্দার ফরাসি বাতায়ন (French window)দিয়ে দেখলুম, দিশি মৌসুমী ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে পেটমোটা ছাই রঙের মেঘবাবু টিকে। মুখ বেকিয়ে বললে আমায়, “তুমি বরষামঙ্গল লেখ হে, এখন তাই প্রাসঙ্গিক”। আমি আর তাকে বল্লেম না, গতকালের ঝকঝকে নীলে হাশিখুশি সাদা মেঘের পানসিটি ফিস্ফিসিয়ে বলে গেছে, “দেরী হল বটে, চিন্তা করিস না, আমি আসছিই, মা আসছেন যে”।
“মা আসছেন” বড় প্রিয় শব্দ বাঙ্গালীর। এই মা কে? জগদজননি দেশমাতৃকা নন, বড় আপন, আটপৌরে শাড়ি পড়া, সাঁঝবেলায় ধুনোর গন্ধ মাখা, পিদিম জ্বালা, বুকের কাছে ধুকপুকুনির মত জেগে থাকা মা আমাদের। তাইতো পুজো মানে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের থেকে অষ্টমীর অঞ্জলির অপার্থিব সকালে লাল পেড়ের খসখসানি আর পাশের বাড়ির উঠোন কুড়োনো এক গোছা শিউলি ফুল দেখে মা লুকিয়ে মুচকি হাসেন।
পুজো মানে আমার কাছে ইস্কুলের শারদীয়া উৎসব, নাটকের, আলেখ্যর স্ক্রিপ্ট লেখা। আলসে দুপুরে পূজা বার্ষিকী। প্রথম আলোর প্রসাদ খুঁজে পাওয়ার মত গীতবিতানের শরত ঋতুর গান গুলি কণ্ঠস্থ করা। “তোমার ছুটি নীলাকাশে”; শুধু নীল আকাশ নয়, অকালবোধনের কালটির বিশেষত্ব এই যে, সবটুকু জুড়ে পূর্ণতার প্রসাদ। বৃষ্টি ভেজার পর গাছগুলি সতেজ, দীঘির জলে নীলাকাশের প্রতিবিম্ব, কাশের বনে অপু-দুর্গা।
আমার ছেলেবেলার পুজোয় এসবের মাঝে ছিল “পুজোর চিঠি”। চিঠি আসত প্রবাসী বাবার কাছ থেকে। আমার এবং বোনের দুটি আলাদা চিঠি, মুক্তোর মত গোটা অক্ষরে নিচে লেখা থাকত, “ইতি, তোমাদের বাবা”। চিঠি এসেছে, ট্রাঙ্কলের প্রতীক্ষার অবসান, এবার বাবা আসবে। আমাদের পুজোর ঘণ্টা বাজল বলে। আর ছিল চিঠি লেখার ধুম, বিজয়ার পরে, শ্রীচরণেষু বানানটিতে হোঁচট খাইনি কোনোদিনও। পুজোর মধ্যে এসে পৌঁছতো তুতো ভাইবোনদের কার্ড, মা পাশে বসিয়ে লেখাতেন চিঠি। আজ চিঠি কই? সবই তো মেলে, তবু মেলে না কিছুই। সেই যে পুজোর ছুটিতে ইস্কুলের বন্ধুদের একখানি উড়োচিঠি, কোন অন্তরজালে তার আনন্দটুকু ধরতে পারিনা আজ। বাঙ্গালীর চিঠিপত্রের ইতিহাসে সেই যে, “দিলে তুমি সোনা মোড়া ফাউন্টেন পেন”, বলে পুজোর চিঠিটি লিখলেন রবিঠাকুর, আজও তার মেদুরতা অম্লান।
পুজোর মধ্যে লিখতেই হবে দু চার পাতা। না হলে যেন পুজোটা ঠিক পূর্ণ হয়না আমার। এখন এই সুদুর প্রবাসে বসে, তিরিশটা আস্ত শরত পার হয়ে গেলেও পুজোর লেখার আনন্দটা মাটি হয়নি একটুও।
তারই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে একটুকরো বেমানান দুশ্চিন্তা। এই মুঠোফোনের যুগে, আর কতদিন, এবং কীভাবে এই ছোট্টো ভালোলাগার অকৃত্রিম আবেগটুকু তুলে দিতে পারব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে? যে কচি মানুষ টা এখন তার দ্বিপ্রাহরিক খেলার ফাঁকে আমার ডায়েরির পাতার নীলচে হরফের মাঝে সরসরিয়ে চলা কলমটিকে দেখে অবাক বিস্ময়ে হেসে উঠছে, পারব তো এইটুকু ঐতিহ্য তুলে দিতে আমার আত্মজের হাতে?
কেমন যেন সময়টা বদলে যাচ্ছে মাত্র। পুজোর আগের অকাল বরিষণের মতই মন জুড়ে শুধু অজস্র প্রশ্নচিহ্ন আর না পাওয়ার ক্ষোভ নিয়ে বিদঘুটে নীল তিমির বুকে মিথ্যে আশ্রয় খোজা মরণ খেলায় মেতে ওঠা ছানাগুলোকে যদি ছোঁ মেরে উড়িয়ে আনতে পারতো মা নিকষ আঁধার থেকে, যদি মা দুগ্গার ত্রিশুলের এক খোঁচায় সমস্ত দুঃখবোধ মিলিয়ে যেত, তবে বোধহয় সত্যি দানবদলনী হতেন মা।
এবার পুজোয় লেখা জুড়ে তাই অকালে নিভে যাওয়া তেষট্টিটা সন্ধ্যেপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে চাই। এবার পুজোয় তাই, যে খবরগুলো না পড়তে পারলে খুশি হতেম, তাদের একটা কাগুজে প্লেন বানিয়ে ছুঁড়ে দিলাম শরত মেঘে। জানলার বাইরের, পরিসর কমে আসা নীলাভ আকাশ্টাকে ধরে রাখতে চাইছে, তাকে লিখে দিলেম আজ, ভাল থেকো বন্ধু। আমার পুজোর উড়োচিঠিরা এখনও স্বপ্ন দেখার সাহস করে যে! এখনও তাদের মনের চোরকুঠুরির দরজা খুলে মুক্তি দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করি, মা নিষাদ!

3 Comments

  1. Sushanta Dutta October 11, 2017
  2. xyz October 12, 2017
  3. Dr Prithwindra Mukherjee March 6, 2018

Leave a Reply