অপরূপা খাজ্জিয়ার

সোমা উকিল

 

উফ্ প্রায় ৯- ১০ মাস হয়ে গেল একেবারে  হায়দ্রাবাদে বন্দী । সেই থোড়-বড়ি-খারা র মতো অফিস আর সংসার । উপরি পাওনা হল মেয়ের জুনিয়র কলেজের অহেতুক সিরিয়াসনেস । যাহোক, জানা গেল ইলেভেনের পরীক্ষার পর এক হপ্তা প্যারলে বেরোতে দেবে নাকি । আহা এই সুযোগ !

তাড়াতাড়ি প্ল্যান করে হিমালয় এ কোন নির্জন কোণা খুঁজতে হবে আগে । আজকাল অবশ্য গুগলের শক্তিশালী সার্চ এঞ্জিনে  খোঁজার গতি প্রায় মনের গতির সমান হয়ে গেছে । এবার লটারি –  ভূটান নাকি হিমাচল প্রদেশ । শেষে অবশ্য হিমাচলই জিতল । খাজ্জিয়ার উপত্যকা ও জিয়া গ্রাম, দুটিই চম্বা ও কাংরা ভ্যালী র দুই অপরূপা কন্যা । খাজ্জিয়ার এর বেশ নাম ডাক বেশ আগে থেকেই আছে উত্তর ভারতীয়দের কাছে সুইত্জারল্যান্ড অফ হিমাচল বলে কথা ! তবে জিয়া সেরকম সুখ্যাতি এখনো অর্জন করেনি ।

প্রস্তুতি অনেক, টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, তবে তার উত্তেজনা ও উদ্দীপনা দুটি ই খুব উপভোগ্য । ঠিক হল হায়দ্রাবাদ থেকে সকালে  দিল্লি, সারাদিন দিল্লিতে ঘোরাঘুরি, রাতে ট্রেনে চেপে পাঠান কোট , ভোরে পাঠান কোট থেকে ডালহৌসি হয়ে খাজ্জিয়ার ।

যেমন প্ল্যান, তেমন মেয়ের পরীক্ষা শেষের পরদিন ই সকালে বেরিয়ে পড়া । দিল্লী পৌঁছাতে প্রায় দুপুর । দিল্লীর মেট্রোটা কিন্তু দারুন – পরিকল্পনা, সিস্টেম, ডিসিপ্লিন সবই । নিউ দিল্লী মেট্রো স্টেশনের ক্লোকরুমে সব ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়া গেল । প্রথম চাঁদনী চক, তারপর পারাঠেওয়ালি গলিতে পারোটা খাওয়া ও লাল কেল্লা দেখা । ওই পরোটা গলি তে প্রায় পঞ্চাশ রকম পরোটা পাওয়া যায়, একদম ছাঁকা তেলে ভাজা, সঙ্গে বেশ কয়েক রকম তরকারি, চাটনি । একটু ভয় হলেও [ওই পেট ঠিক ভাবে ব্যাপারটা নেবে কিনা !] বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হোল কিন্তু ।  গলিটার প্রস্থ উত্তর কলকাতার যে কোন কানা গলি কে হার মানায় । দোকানগুলোর সাজ সজ্জা এবং পরিচ্ছন্নতা শিয়ালদা স্টেশনের পাশে উড়াল পুলের নিচে খাবার দোকানের কথা  মনে করায় । কিন্তু তাতে দেশীদের সাথে বিদেশিরাও পাল্লা দিয়ে পরোটা খাচ্ছে । খাওয়া দাওয়া সেরে  দিল্লির চাঁদনি চকে রিক্সা চেপে লাল কেল্লায় পাড়ি দিলাম তিন জন । হাতে অনেক সময়, তাই বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাল কেল্লা দেখা হল, হটাৎ বৃষ্টি আসায় লাইট এন্ড সাউন্ড দেখার ইচ্ছেতে জল ঢালতে হল । কি করা যায় ? ঠিক হোল কনট প্লেসে  যাওয়া  যাক ।  চাঁদনি চকের পর কনট প্লেসের  এ পরিবেশগত তফাতটা ও তো খুব চোখে পড়ার মত তাইনা ? ঘোরাঘুরি করে, ডিনার খেয়ে এবার ট্রেন চাপা । তাই রওনা হলাম রহিলাসারাই এর দিকে, ট্রেনটা ওখান থেকেই । আহ ! সারাদিন ঘুরে ট্রেনে চড়েই দুচোখ সবারই জুড়িয়ে এল ।

ভোর পৌনে পাঁচটা- পাঠান কোট এসে গেছে । মার্চ এর তৃতীয় সপ্তাহ, তাও বেশ ঠাণ্ডা পাঠান কোটে । আগে থেকে কোনও গাড়ি বুকিং করিনি, নেমে যা হোক দেখা যাবে । স্থানীয় একজন পরামর্শ দিলেন যে বাসে করে গেলে সাশ্রয় ও আরাম দুটোই হবে । বাসে উঠে স্থানীয় জীবন যাত্রার এক টা  ছবি নিঃসন্দেহে পাওয়া গেল । পথে দুনহেরা গ্রামে পাউরুটি ও স্থানীয় মাখন দিয়ে দারুন একটা ব্রেকফাস্ট হোল । প্রায় দশটা নাগাদ আমরা ডালহৌসি পৌঁছে গেলাম । অপূর্ব এই শৈল শহর । পুরানো দিনের সুন্দর পাথরের বাড়ি ঘর, পরিচ্ছন্নতা নজর কাড়ে বইকি ।একটু হেঁটে ওপর দিকে গেলে এ ঝকঝকে রুপালি পিরপাঞ্জাল  গিরিশ্রেণীর সৌন্দর্য দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় ।

গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঠিক হোল, ডালহৌসির আশ পাশ ঘুরে খাজ্জিয়ার যাবো । খাজ্জিয়ারে হোটেলের চেক ইন টাইম একটু বেলার দিকে । ট্যাক্সি ও ওখান থেকে সহজে  পেয়ে গেলাম । এদিক ওদিক দেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য  পাঞ্চপুলা ওয়াটার ফলস । ভারি সুন্দর এক জায়গা, প্রকৃতি অনেক যত্ন নিয়ে এমন সুন্দর উপহার আমাদের জন্য সাজিয়েছেন, মন্ত্রমুগ্ধের মত অনেকক্ষণ শুধু তাকে দেখলাম, জলের সুর , পাখির কলতান শোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আর শোনা হোল না । বড় বড় সস্তা সাউন্ড বক্স লাগিয়ে তাতে চলেছে গান নামক চ্যাঁচামেচি ।  বড় কষ্ট হোল দেখে যে কিছু মানুষ শুধু ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে কি ভাবে এই সৌন্দর্যকে শুধু যে নষ্ট করছে তা নয়, সাথে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেও অনিশ্চয়তার মুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে ।

পাঞ্চপুলা ছেড়ে এগিয়ে চললাম খাজ্জিয়ারের দিকে। পথে বিস্তীর্ণ এলাকায় আলুর ক্ষেত, সবই ধাপ চাষ । বিস্তীর্ণ চম্বা উপত্যকা, ঘন সবুজ পাহাড়ের ঢল , মেঘ সূর্যের খেলা, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, সব আমাদের তিন জনের দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি একদম ভুলিয়ে দিল । প্রায় পৌঁছে গেলাম খাজ্জিয়ার , দূর থেকে দেখা যাচ্ছে , আঁচ পাচ্ছি সেই সৌন্দর্যের।  বাঁ পাশে হোটেল দেওদার আর ডানদিকে সেই খাজ্জিয়ার ভ্যালী, অপরূপা খাজ্জিয়ার ! সত্যি তো, আমি কিছু সুইত্জারল্যান্ডের ছবি দেখেছি ,যাবার সুযোগ হয়নি, কিন্তু ভীষণ মিল তো সেই সব ছবির সাথে ! বাঃ , যতদূর চোখ যায়, শুধু মুগ্ধ হবার পালা । ঘন পাইনে ঘেরা উজ্জ্বল সবুজ সেই বিস্তীর্ণ উপত্যকা, মাঝে ছোট অগভীর লেক, তার এক ধারে উজ্জ্বল লাল, নীল রঙ এর চাল দেওয়া ইংলিশ  কটেজ, কিছু ঘোড়া সওয়ারি নিয়ে চলেছে।

Soma

হোটেলের চেক ইন পর্ব সেরে ঘরে ঢুকে খুবই আনন্দ পেলাম। কথা রেখেছে, যেমনটা চেয়েছি তেমনটাই তো দিয়েছে, দেয়াল জোড়া কাচের জানালা দিয়ে যে ভ্যালির বিরাট অংশ দেখা যায় ! ফ্রেশ হয়ে হিমাচলি রান্না দিয়ে দুপুরের খাবার সেরেই ভাবলাম, আর দেরি না বেরিয়ে পড়া যাক এমন সুন্দরের কোলে এক মুহূর্ত নষ্ট করা নয়, প্রাণভরে নিতে হবে এর আস্বাদন । কোথা থেকে যেন কালো মেঘ ছেয়ে ফেলল, দারুণ ঠাণ্ডা হাওয়া আর দু এক ফোঁটা গায়ে বিঁধল । আরে জল নয়, ছোটো ছোটো শোলার বলের মত বৃষ্টি । দৌড়ে চলে আসতে হল হোটেলে আর এই প্রথম আমি দেখলাম সেই বরফ বৃষ্টি । নাহ এত ঠাণ্ডায় জল আর পড়ে না , শুধু বরফ । ঢেকে গেল খাজ্জিয়ার বরফে । আর সবুজ নয়, এবার সাদা পাইনগুলো ছাড়া সব সাদা আর থোকা থোকা মেঘ উড়ে গেল সেই ঘন পাইন এর থেকে । এইসব ফ্রেমগুলো জীবনের অ্যালবামে চিরস্থায়ী।

পরের দিন সকালটা সোনাঝরা এক সকাল । ঝকঝকে নীল আকাশ , নিখুঁত সবুজের বাহার  চারিদিকে । আর কি ঘরে থাকা যায় ? বেরিয়ে পরলাম , চলে গেলাম ওই অন্য প্রান্তটায় । এবার আর একবার অবাক হবার পালা , ওই যে পিরপাঞ্জাল এর পুরো রেঞ্জটা দেখা যায় এই প্রান্ত থেকে । এখান থেকে অল্প দূরে এক পয়েন্ট থেকে মনিমহেশ কৈলাসও দেখা যায় ! প্রতি কোনায় যে কতকিছু দেখার ও আনন্দ পাবার ! কিছুটা বেলা বাড়লে ভাবলাম কালাটোপ এর রিসার্ভ ফরেস্টে ঘুরে আসা যাক । পথে মনিমাহেশ কৈলাস এর পয়েন্ট থেকে তাঁকেও দেখে নেব । সত্যি অপূর্ব দর্শন পেয়েছি মনিমাহেশ এর । কালাটোপতো আরও ঠাণ্ডা ! পায়ে হাঁটা ১২ কিলোমিটার পথ চলে গেছে খাজ্জিয়ারের সেই ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ।

আমরা উৎসাহ ভরে  পা দিলাম সেই পথে । কিছুটা তো এগোই । কিন্তু খানিকটা  গিয়ে আর পারা গেল না, বেশ অনেকটা করে কাঁচা পথ ঢেকে আছে বরফে । যে জায়গায় বরফ গলেছে, সে জায়গা ভীষণ পিছল । পড়লে পাশের খাদে । তাই আবার ফিরে আসা , বেলা ও পড়ে এসেছিলো । চারিদিকে সুন্দর কিছু পয়েন্ট আছে, ঘুরে দেখলাম, পড়ন্ত রোদের তাপ এই ঠাণ্ডায় উপভোগ করলাম ! আমাদের যিনি গাড়িতে করে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন, সেই সুদর্শনজী ফিরিয়ে নিয়ে এলেন আমাদের সেই অপরূপা খাজ্জিয়ারে!

এইচ পি টি ডি সি র ম্যানেজার মানুষটিও ভারি মজাদার । সকালে ব্রেকফাস্ট এ গল্প করতে করতে বললেন “চম্বা ঘুরে আসুন, আমার বাড়ি ওখানে । দেখুন কি সুন্দর !” ঠিক আছে, বেরিয়ে পড়লাম চম্বায় । কত  পুরনো শহর ! সুন্দর মিউজিয়াম, সত্যনারায়ণ মন্দির, অনেক ওপরে চামুণ্ডা মন্দির , বেশ ঘোরা হল এই জেলা শহর । এবার ফিরে আসা খাজ্জিয়ারে, শেষ সন্ধে । ভারি সুন্দর রুপোলি থালার মত দোল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে , তার উজ্জ্বল আলোতে পিরপাঞ্জাল এর আর এক রূপের সাক্ষী হলাম । মনে হল যা দেখলাম, তাদের মধ্যে খাজ্জিয়ারই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ! পরের দিন যাবো জিয়া । সে গল্প না হয় আর একদিন করা যাবে ।

 

অলংকরণ :  সোমা উকিল

Leave a Reply