গার্গী রায় চৌধুরী
আজ সকালটা অনেক অন্যরকম, অন্তত পুপুর তাই মনে হল। ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই, স্কুলে যাবার তাড়া নেই। যেন বিশ্বাস হতে চায় না গতকালই আনুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সে এবার ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠবে। পরীক্ষা ভালই হয়েছে। আজ শুক্রবার, কাল সে মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে সাগর দ্বীপে। সঙ্গে কাকাই, কাম্মা আর পুটুশও যাচ্ছে। পুটুশ পুপুর খুড়তুতো বোন, সে ক্লাস টু এ পড়ে। পুপুর ছায়া সঙ্গী। আর পুপু যা যা করে তারও সেই সেই কাজ করা চাই। পুপুও এঞ্জয় করে তার কান্ড কারখানা, দরকার পড়লে শাসন করে কিন্তু পুটুশকে ছাড়া তারও চলে না।
সেদিনটা হুস করে কেটে গেল গোছগাছ করতে করতে। পুপু সবার আগে প্যাক করে নিল তার ফেলুদার বই তারপর মাকে গোছাতে সাহায্য করলো সারাদিন। রাতে মা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বললেন পুপুকে, কারণ পরের দিন খুব ভোরে উঠে যেতে হবে। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতে চাইছিল না পুপুর, চোখের সামনে যেন সাগর দ্বীপ। সে শুনেছে অনেক নদী এসে মিলেছে যেখানে সেটাই সাগর দ্বীপ। এর চারিদিক শুধু জল আর জল। আজ দুপুরে একবার ম্যপ খুলে জায়গাটা দেখেও নিয়েছে পুপু। ছোট্ট একটা বিন্দু। চারিদিকে জল, তার ভাবনা মানুষ সেখানে থাকে কি করে? জলে পড়ে যায় না? মনের মধ্যে এসব নানা কথা নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সময়ের নিয়মে ভোর হয়, গাড়ি এসে যায়, পুপুদের যাত্রাও শুরু হয়ে যায়। গাড়ি শহর কলকাতা ছাড়িয়ে ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। পুপু আর পুটুশ দুজনে বসেছে পাশাপাশি। পুটুশ পুপুর হাতটা ধরেই আছে সে গাড়িতে উঠে বসা থেকে। নানা রকম প্রশ্ন করে চলেছে পুপুকে,
“দিভাই আমরা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছি, না রে?”
পুপু হেসে বলে, “ না রে বোকা, সাগর দ্বীপে”।
পুটুশ পুপুর কাছে সবুজ দ্বীপের রাজার গল্প শুনেছে, তাই তার খালি মনে হচ্ছে তারা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছে। সে মানতে চায় না, বলে,
“জেঠু বলেছেন আমায়, আমরা সবুজ দ্বীপেই যাচ্ছি”।
বাবা হেসে উঠলেন ,
“কেন হবে না সবুজ দ্বীপ, যেখানে যাচ্ছি সেখানেও তো শুধু সবুজ আর সবুজ”।
পুপুরও মনে ধরে কথাটা। সঙ্গে একটা রোমাঞ্চও হয়। ২-৩ ঘণ্টা যাওয়ার পর তারা এসে দাঁড়ায় একটা বিশাল নদীর সামনে। তার একুল ওকুল দেখা যায় না। পুপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে, এত্ত বড় নদী সে আগে কখনো দেখেনি। তারপর লঞ্চে করে সেই নদী পার হয়ে সাগর দ্বীপে যখন তারা পৌছল ঘড়ির কাঁটা তখন ১টা ছুঁয়েছে। বাবা কাকাইকে বললেন,
“বুঝলি বাবুই, কলকাতা থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টা লাগলো”।
এখন মার্চ মাস, সূর্যের তেজ বেশ বেশী। কিন্তু হাওয়াও খুব। রোদের তেজ আর গরম গায়ে লাগে না। লঞ্চ ঘাটে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল পুপুদের গেস্ট হাউসে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা উঠে বসলো গাড়িতে। গাড়ি ছুটল সবুজ দ্বীপ দিয়ে। পুপুরা আজ আর কাল এখানে থেকে আবার পরশুই ফিরে যাবে কলকাতায়। বাবা, কাকাই, মা, সবার অফিস আছে, তাই বেশিদিন থাকা হবে না। বাবা বললেন,
“এখন গেস্ট হাউসে গিয়ে স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে হবে সবাই কে, পুপু, পুটুশ তোমরাও দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেবে না হলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে”।
পুপু- পুটুশ কারও এই কথাটা পছন্দ হল না, একটুও ক্লান্ত লাগছে না তাদের। কিন্তু বাবা বলেছেন, শুনতেই হবে।
সেই বিকেলটা সাগরের পারে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিল ওরা। পুপুরা পা ভেজালো জলে। গেস্ট হাউসটা প্রায় সাগরের পারেই বলা যায়, তাই গাড়িতে না উঠে হেঁটে হেঁটেই ঘুরে বেড়ালো ওরা। ঠিক হল কাল যাওয়া হবে এখানকার খুব বিখ্যাত এক মন্দিরে। এই দ্বীপে এসে সেখানে না গেলে, ঘুরতে আসাই নাকি বৃথা।
পরদিন সকালে স্নান সেরে সবাই গেল মন্দিরে। মন্দির দেখে তো পুপু তাজ্জব। বিশাল বড় তো বটেই, কত দর্শনার্থীর ভিড় সেখানে। মন্দিরের একপাশে আবার গেস্ট হাউসও আছে, দর্শনার্থীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। যদিও একটি ঘরও খালি নেই। বাবা বললেন,
“যেন একটা ইনডাস্ট্রি চলছে”।
এমন সময় একজন সন্ন্যাসী এসে তাদের পুজোর প্রসাদ দিয়ে গেলেন। মা কাম্মাকে বললেন, “অনেক বড় মন্দির, ভালো করে সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখি চল”।
বাবা আর কাকাই গেলেন, মন্দিরের বাইরের আশপাশ দেখতে, মা , কাম্মা, পুপু আর পুটুশ ঘুরে বেড়াতে লাগলো মন্দির চত্বরে। মা পুপুকে মন্দিরের গায়ে আঁকা দেবদেবীর মূর্তি চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, তাদের নিয়ে কথিত গল্প বলছিলেন, পুটুশ ঘুরছিল কাম্মার সাথে। হঠাৎ পুপু দেখল কাম্মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে তাদের দিকে আসছেন, এসে মা কে বললেন,
“দিদি পুটুশ কে দেখতে পাচ্ছি না”।
কাম্মার মুখ লাল, চোখে জল এসে গেছে। মা বললেন,
“কখন থেকে দেখতে পাচ্ছিস না?”
কাম্মা বললেন,
“আমার সঙ্গেই তো ছিল, এই এখুনি লক্ষ্য করলাম নেই, তারপর আসেপাশেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না”।
মা কাম্মা কে সঙ্গে নিয়ে মন্দির চত্বর খুঁজতে লাগলেন আর পুপুকে মন্দিরের পিছন দিকটা দেখিয়ে বললেন ,
“পুপু তুই ওই দিকটা একবার দেখে আয় তো”?
পুপু, মার কথা মতো সেই দিকে গিয়ে পুটুশ কে দেখতে পেল না, কিন্তু এপাশ অপাশ করার পর দেখলো দালানের এক পাশ ঘেষে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে, তার মনে হল পুটুশ ওখানে পড়ে যায়নি তো? পুপু আসতে আসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। গিয়ে দেখল ওটাও একটা ঠাকুর ঘর, সাদা পাথর দিয়ে বাঁধানো, খুব পরিষ্কার। বোঝাই যাচ্ছে এখানে লোক বেশী আসে না। ঘরটা এল-সেপের, পুপুর আর এগুতে সাহস হল না, সে পটুশের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। কয়েকবার ডাকার পর সে যখন ফিরে আসবে ভাবছে তখন দেখল এক সৌম্য কান্তি সন্ন্যাসীর হাত ধরে তার বোন এগিয়ে আসছে ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে। পুটুশের দু হাতে সন্দেশ। পুপুর ধড়ে প্রান এলো। সন্ন্যাসী বললেন,
ভয় নেই, ওকে আমি মন্দির ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম। প্রসাদ দিয়েছি, দাঁড়াও তোমাকেও দিচ্ছি”।
পুপুর দাঁড়ানোর সময় নেই, সে জানে মা-কাম্মা এতক্ষনে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে হয়ত বাবাদেরও খবর দিয়েছেন। সে সন্ন্যাসী ঠাকুর কে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,
“না এখন না, পরে এসে প্রসাদ নিয়ে যাব। মা আমাদের খুঁজছেন”।
সন্ন্যাসী হেসে বললেন, “আচ্ছা যাও”।
পুপু তার বোনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলল মা-বাবা দের সন্ধানে। মা-কাম্মা যথারীতি বাবা- কাকাই কে খবর পাঠিয়েছেন। তাঁরাও এসে গেছেন। পুপু গিয়ে সব কথা বলল তাঁদের, তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। কাকাই বললেন,
“ বললাম না, কিচ্ছু হবে না, এখানে এত লোক, এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান”।
কাম্মা পুটুশ কে একটু বকলেন একা একা না বলে যাওয়ার জন্য। পুটুশের মুখ কাঁদো কাঁদো, তার হাতের সন্দেশ হাতেই পড়ে রইল। বাবা বললেন,
“বেলা বেড়ে গেছে, চলো গেস্ট হাউসে ফিরে যাই”।
গেস্ট হাউসে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়ার শেষে হঠাৎ জ্বর এসে গেল পুটুশের। সে বেচারা ধমক খেয়ে একটু মন মরা হয়েই ছিল, ঠিক করে খেলোও না। তারপর এই জ্বর। দুপুর তিনটে নাগাদ দেখা গেল জ্বর বেড়ে ১০২ ডিগ্রি হয়েছে। বাবা বললেন,
“চলো আমরা আজই কলকাতায় ফিরে যাই”।
গাড়ি তো সঙ্গে ছিলই, পুপুরা সবাই বেড়িয়ে পড়ল কলকাতার দিকে।
কলকাতায় এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে পুটুশের জ্বর কমলো কিন্তু সেই মনমরা ভাব কমলো না। দুই বোনেরই পরীক্ষা শেষ, স্কুল ছুটি, তাই মা পুপুকে দুদিনের জন্য কাকাই এর বাড়ী থাকতে পাঠিয়ে দিলেন। পুটুশ খুব খুশি দিদিকে পেয়ে, দুজনে একসঙ্গে সারাক্ষন। দুপুরে পুটুশ জোর করে কাম্মাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিল দিভাই এর সাথে সিক্রেট শেয়ার করবে বলে। পুপু জানে এটা পুটুশের ছেলেমানুষী। সে পুপুর সঙ্গে একদম একা সময় কাটাবে বলে কাম্মাকে অন্য ঘরে যেতে বলছে। বিছানায় শুয়ে পুপুর গলা জড়িয়ে পুটুশ চুপ করে শুয়ে রইল, পুপু বলল,
“বলো তোমার সিক্রেট কি?”
বলে পুপু বোনের মুখটা তুলে ধরতেই দেখল, পুটুশের চোখে জল। পুপু উঠে বসে ওকে কোলে বসাল, বলল, “কি হয়েছে সোনা”?
পুটুশ বলল, “এটা রিয়েল স্টোরি দিভাই, তুমি কাউকে বোলো না, তাহলে তুমি, মা বাবা, জেঠু, জেম্মা সবাই আকাশের তারা হয়ে যাবে”।
পুপু বোঝে কোনও গোলমাল আছে, সে জোর দিয়ে পুটুশকে বোঝায় কারও কিচ্ছু হবে না। পুটুশ বলে সাগর দ্বীপের মন্দিরে সেই সিঁড়ির তলার কথা, সেখানে ওই সন্ন্যাসী পুটুশকে নিয়ে গিয়ে তার শরীরের গোপন জায়গায় হাত দিয়েছেন, পুটুশকে ভয় দেখিয়েছেন, বলেছেন, একথা কাউকে জানালে উনি ঠাকুর কে বলে তাদের আকাশের তারা করে দেবেন। পুটুশ বলে চলে,
“দিভাই সন্ন্যাসী আমার সিক্রেট প্লেসে হাত দিয়েছেন। আমার খুব ব্যথা লেগেছে”।
পুপু বড় হয়েছে, সে জানে এই কাজ কত বড় অন্যায়, মা বার বার তাকে বলে দিয়েছেন শরীরের সিক্রেট প্লেসে কেউ হাত দিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা কে বলতে হয়, যাতে ওই দুষ্টু লোকটি শাস্তি পায় আর অন্য কারও সাথে ওই একই কাজ করতে সাহস না পায়। পুটুশ ছোট, তাকে হয়তো কাম্মা এসব কথা কখনো বলেননি। তাই বেচারা জানেই না। পুপু চোখে জল এসে গেল, দুঃখে নয় রাগে। তার মনে হতে লাগলো লোকটার এত বড় সাহস যে সে বাবা-মা , কাকা-কাম্মা, পুপু সবার প্রেজেন্সকে উপেক্ষা করে ছোট্ট পুটুশের গায়ে হাত দিল, আর তারা কেউ কিচ্ছু করতে পারল না। লোকটা এখনও ওখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আরও কত বাচ্চার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছে কে জানে? পুপু বুঝতে পারে এই লোকটিকে শাস্তি না দিলে পুটুশের চোখের দিকে তাকাতে পারবে না সে। সে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুই কি বোকা পুটুশ, তুই তো জানিস লোকটা দুষ্টু লোক, ভালো লোক কি সিক্রেট প্লেসে হাত দিয়ে ব্যথা দেয়? আর দুষ্টু লোক দের কথা কি কখনো ভগবান শোনেন? ও তোকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে। তুই তখনই বললে আমরা সঙ্গে সঙ্গে লোক টাকে ধরতে পারতাম। যাক গে, এখনও ধরব লোক টাকে আর শাস্তিও পেতে হবে ওকে আমার ছোট্ট বোন টাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য”।
পটুশ বলে, “তুমি সত্যি বলছো দিভাই? তোমরা কেউ আকাশের তারা হয়ে যাবে না তো?”
পুপু বলে, “দূর বোকা, তোর দিভাই কি তোকে কখনো মিথ্যে বলে?”
পুটুশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
সন্ধ্যেবেলা সবাই অফিস থেকে ফিরলে পুপু, মা-বাবা, কাকা-কাম্মা কে একজায়গায় বসিয়ে গোটা ঘটনাটা বলে। বাবা বলেন,
“যেহেতু ঘটনার সময় লোকটিকে ধরা যায়নি তাই এখন তাকে দিয়ে স্বীকার করানো যাবে না”।
পুপু বলে, “আমি লোকটিকে চিনি, আমি যদি ওর কাছে যাই, ও আমার সঙ্গেও একই রকম কাজ করার চেষ্টা করতে পারে, তোমরা পুলিশ নিয়ে আশেপাশে থাকবে, আর ঠিক সময়ে লোকটিকে ধরবে”।
বাবা বললেন, “সাবাশ, এই তো চাই, ভীষণ ভালো আইডিয়া”।
কাকা আর মা একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন, কিন্তু বাবা যখন বললেন, “কোনও রিস্ক নেই, আমরা তো থাকব ওখানে”, তখন ওরা রাজি হলেন।
এরপর বাবা তার এক বন্ধু মারফত সাগর দ্বীপের লোকাল থানায় যোগাযোগ করলেন, ঠিক হল পরের দিন বাবা, কাকাই, পুপু যাবে সাগর দ্বীপে, তবে এবার আর বেড়াতে নয়, একজন অপরাধীকে শাস্তি দিতে।
পাঁচ ঘণ্টার পথ যেন কাটতে চায় না। নদী পার করে সাগর দ্বীপে পৌঁছতে পুপুরা দেখল একজন পুলিশ অফিসার ও চারজন পুলিশ কাকু সিভিল ড্রেসে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। সবাই মিলে যাওয়া হল মন্দিরে, মন্দিরের বাইরে একটু দূরে গাড়ি রেখে সবাই হেঁটে গেলেন মন্দিরের মধ্যে। গাড়িতে আসতে আসতে পুলিশের মুখে পুপু শুনেছে খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে, অপরাধী টের পেয়ে গেলে পালিয়ে যাবে, তখন তাকে ধরা মুশকিল, তারপর পুপুকে আইডেন্টিফাই করতে হবে অপরাধী , পুলিশ তো জানেই না কে সেই লোক। তাছাড়া লোকটি মন্দিরের পুরোহিত, তাই কোনও প্রমাণ ছাড়া তাকে ধরাও সম্ভব হবে না। পুপু বুঝতে পারল ব্যাপারটা সহজ নয়, বুদ্ধি করে লোকটিকে ধরিয়ে দিতে হবে তাকেই।
মন্দিরে ঢুকে পুলিশ অফিসার, একজন পুলিশ ও বাবা গেলেন হেড সন্ন্যাসীদের ঘরে তাদের সঙ্গে কথা বলতে। পুপু একা মন্দির চত্বরে উঠে মন্দির দেখার ভান করে খুঁজতে লাগলো সন্ন্যাসীটিকে, কাকাই আর অন্য দুজন সাধারন পোশাকের পুলিশ দূর থেকে নজরে রাখতে লাগলো পুপুর উপর। পুপুর বুকের মধ্যের ধুক পুক আওয়াজ টা তখন দ্রাম দ্রাম করে বাজছে, সে লক্ষ্য করলো তার হাত পাও কাঁপছে। মুখটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে মন্দিরের এঘর ওঘর ঘুরতে লাগলো, তার ভয় হতে লাগলো যদি সে লোকটিকে খুঁজে না পায় তাহলে পুটুশের অপরাধীকে আর ধরা যাবে না। সে ভালো লোকদের মধ্যে মিশে থেকে মানুষের ক্ষতি করে বেড়াবে। এসব ভাবতে ভাবতে পুপু দেখল আরতি হচ্ছে আর লোকটি, হ্যাঁ সেই লোকটিই আরতির সঙ্গে কাঁশর ঘণ্টা বাজাচ্ছে। পুপুর মন শান্ত হল। অনেক লোক দাঁড়িয়ে আরতি দেখছে, পুপুও তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, এমন জায়গায় দাঁড়াল যাতে লোকটি তাকে স্পষ্ট দেখতে পায়। তারপর সুযোগ বুঝে ঘাড় ঘুড়িয়ে কাকাইকে ইশারা করে লোকটিকে চিনিয়ে দিল। আরতি চলাকালীনই লোকটির সঙ্গে চোখাচোখি হল পুপুর। সে মৃদু হাসল লোকটিকে দেখে, লোকটিও হাসল। তারপর আরতি শেষ হলে পুপুর কাছে এসে বলল,
“কি দুদিন আসনি যে তোমরা?”
পুপু বলল, “সাগরের দিকে ছিলাম তাই আসা হয়নি”।
লোকটি বলল, “কতদিন আছো”?
পুপু বলল, “কালই চলে যাব”।
সন্ন্যাসী বেশী লোকটি বলল, “বোন কোথায়?”
পুপু বলল, “ও মায়েদের দের সাথে বাইরে আছে”।
লোকটি পুপুর চিবুকে হাত রেখে বলল,”তুমি প্রসাদ নেবে?”
পুপু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, আর লোকটি এসো, বলে পুপুকে নিয়ে চলল ওই সিঁড়ির নিচের ঘরের দিকে। পুপু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল, সে জানে তার কোন ক্ষতি হবে না ফেলুদা তার সহায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে লোকটির সাথে ঘরের ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল পুপু, এল শেপের আড়ালে গিয়েই লোক টি পুপু কে কাছে টেনে নিল, পুপু চিৎকার করে উঠল “কাকাই…”
কোনও আওয়াজ এলো না ওপাশ থেকে, লোকটি বলল,
“তোমার কাকাই তো এখানে নেই, আমি আছি শুধু, কোনও ভয় নেই,”
বলে লোকটি পুপুর সিক্রেট প্লেসে হাত দিতে গেল। আর ঠিক তখনি, কাকাই আর দুজন পুলিশ এসে লোকটিকে চেপে ধরল আর ধুমাদুম করে রদ্দা কষাতে লাগলো তার ঘাড়ে। এরপর লোকটিকে বাইরে বের করে আনা হল, গ্রেপ্তার করা হল সবার সামনে। পুলিশ অফিসার কাকু পুপুকে স্যালুট করলেন, তারপর অনেক আদর করলেন। বাবা আর কাকাই তো পুপুর সাহসে মুগ্ধ, গর্বিত। পুপু শুধু ভক্তিভরে মনে মনে তার ইষ্টদেবতা ফেলুদাকে প্রণাম করতে লাগলো।
Illustration by Aditi Chakraborty