সোহিনী বসু
সংগীতকে যদি বলি স্বর ও লয়ের মাধ্যমে সুন্দরের নির্মিতি, নৃত্যকে তাহলে বলা যায় ছন্দ ও দেহভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে সুন্দরের প্রকাশ । নৃত্যকলা একটি স্বতন্ত্র ভাষা যার উদ্ভাসন মুদ্রা এবং দেহভঙ্গিতে । এটিকে আমরা বলি মার্গ বা শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা । আর এক ধরনের নৃত্যে দেখা যায় ভাব এবং লৌকিক অনুভূতির প্রাধান্য, যাকে আমরা সাধারণভাবে লোকনৃত্য নামে জানি ।
এই দিক থেকে ভারতীয় লোকনৃত্যের সঙ্গে উজবেক লোকনৃত্যের আত্মীয়তা অনেকের কাছে আশ্চর্য মনে হতে পারে । তবে এটুকু যদি মনে রাখি যে, তাসখন্ড সমরখন্দ ইত্যাদি মধ্য-এশীয় অঞ্চল একদা ইন্দো-ইরানীয় সংস্কৃতির প্রবাহের অন্তর্গত ছিল তাহলে এই সাদৃশ্য হয়তো তেমন বিস্ময়কর নাও মনে হতে পারে । ১৯১৭ সালের পূর্বে এই অঞ্চলের নৃত্যে যদি পাদুকা ব্যবহারের রেওয়াজ না থেকে থাকে তাহলে এই সাদৃশ্য তখন হয়তো আরো নিকট ছিল । সোবিয়েত ব্যবস্থার প্রভাবে নর্তক-নর্তকীদের মধ্যে জুতো পরে নাচার রেওয়াজ হয়েছে এ অনুমান অন্যায় হবে না । এই কথা মনে হচ্ছিল এ. বি. ইউ., তেলেঙ্গনা সরকার ও দূরদর্শন আয়োজিত নৃত্য উৎসবে তাসখন্ডের বাহর এনসেম্বলের লোকনৃত্য দেখতে দেখতে *।
এদের লোকনৃত্যের অধিকাংশ সামাজিক বিষয় অবলম্বনে রচিত । পুরাতন বিষয়বস্তু অনেক কিছু বর্জিত হয়ে নৃত্য রচনাগুলি আধুনিক অনুভবের প্রকাশবাহন হয়ে উঠেছে । এইখানে আমাদের লোকনৃত্যের সঙ্গে এদের নৃত্যের পার্থক্য । আমাদের নৃত্যে এখনো ধর্মীয় বা কৌলিক আচারের প্রভুত্ব । ফলে দেবদেবী এবং সনাতন লৌকিক ধ্যান-ধারণার প্রভাবই বেশি । ওদের নৃত্যে হর্ষ এবং জীবনতৃষ্ণাই মূল সুর । অবশ্য আমাদের কর্মভিত্তিক নৃত্যগুলিতে এর কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায় ।
উজবেক নৃত্যের ছন্দ রচনায় চতুর্মাত্রিক সম তালের একাধিপত্য দেখা গেল । আমাদের কাহারবার সঙ্গেঁ কোনো পার্থক্য নেই । অবশ্য দু একবার পরিবর্তন হিসেবে অতিদ্রুত দাদরার তালফেরতা শোনা গেছে । অতএব পদচালনা দিক থেকে আমাদের সঙ্গে খুব বেমিল নেই । পা ফেলার কায়দাও অনেকটা আমাদের মত, পার্থক্য শুধু জুতো পরে নাচাতে আর ঘুঙুরের অব্যবহারে । এই আশ্চর্য সাদৃশ্য চোখে পড়ার মত ।
কিন্তু আসল পার্থক্য ধরা পড়ল মেজাজ এবং রচনায় । গানে যেমন আমাদের কানু ছাড়া গীত নেই, নৃত্যেও তেমনি । এরা দেখলাম মধ্যযুগীয় বিষয় পরিহার করে আধুনিক সামাজিক এবং ব্যক্তিক বক্তব্য এবং সৌন্দর্যপ্রকাশে তাদের লৌকিক নৃত্যকলাকে সংযুক্ত করতে পেরেছেন । আবেগের মধ্যে বিরহ ও বিষাদের অনুপস্থিতি সর্বপ্রথমে উল্লেখ করতে হয় ।আমাদের নৃত্যে নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ এবং হতাশার মাধ্যমে যে দুঃখবাদের রাজত্ব দেখা যায় এদের নৃত্যে তার চিহ্ন মাত্র নেই । এদের নৃত্যের বাণী আনন্দময় কিন্তু সে আনন্দের কথা, সুখের বিষয়, নিছক প্রচারধর্মী নয়–তার মধ্যে সুন্দরের আলোকপাতও বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে ।
উজবেকিস্তানে এখন ইউরোপীয় প্রভাব যথেষ্ট । যেমন ধরা যাক ওদের নামটি – বাহর । কথাটি আমাদের বিখ্যাত রাগ বাহারের সগোত্র। বাহার মানে বসন্ত। বাহর মানেও নাকি তাই। ফার্শি বাহার, সংস্কৃত বাসর এবং উজবেক বাহরের উৎস হয়তো এক। ভারতীয় উজবেক কন্যাদের ফুল উপহার দেওয়ার নাচে ওরাই যখন আবার ঘাগরা আর ওড়না পরে নাচতে এল তখন কথাটার আরো স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল। এবারে একমাত্র বৈসাদৃশ্য জুতো পরে নাচ।
এঁরা যন্ত্র নিয়েছিলেন অ্যাকর্ডিয়ন, দুটি জাতীয় যন্ত্রের আদিম সংস্করণ – একটি ব্যাস বাঁশি, একটি টেনর বাঁশি এবং একটি ডফ্ জাতীয় ট্যাম্বুরিন। কাউন্টার পয়েন্টের ব্যবহার বেশী নেই কিন্তু সুন্দর হারমনি সংযোগ করা হয়েছে। তালকে এরা প্রাধান্য দেননি – না বাদ্যে, না নৃত্যে। প্রাধান্য দিয়েছেন ছন্দকে।
এঁদের নৃত্যে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ফর্মের চেয়ে ভাবের প্রাধান্য। সম্মেলক কম্পোজিশন এত সাবলীল যে তা শিক্ষণীয় । স্টেজকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা যথেষ্ট মঞ্চাভিজ্ঞতার পরিচায়ক। এঁদের তালিম যে এত পাকা তা এঁদের নৈপুণ্য থেকে মালুম হয়। কোনো পদক্ষেপেই অপেশাদারিত্বের চিহ্ন দেখা যায় নি । সমস্তটা মিলে একটা আনন্দরস বিতরণ যা হায়দ্রাবাদের বিদেশীরাও সহর্ষে গ্রহণ করে আস্বাদন করেছেন।
*দৃষ্ট নৃত্য প্রদর্শন : শিল্পকলা ভেদিকা, হায়দ্রাবাদ, জানুয়ারি ২০১৭
উজবেক নৃত্যশৈলী আর ভারতের হরেক লোকনৃত্যের যে কোথাও মিলজুল রয়েছে, সেটা জানলে রোমাঞ্চিত হতে হয়।
নৃত্যকলার নানান বৈচিত্রের মধ্যেও হয়ত কোথাও একটা মূল যোগসূত্র রয়ে গেছে।