খুনী

নির্মাল্য সেনগুপ্ত

আমার প্রাক্তণ প্রেমিকার মা আমাকে দেখলেই রেগে যেতেন। বলতেন, এই ছেলেটার মধ্যে একটা ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল ছাপ আছে। চোয়াল দেখেই বোঝা যায় অপরাধী। প্রাক্তণ প্রেমিকার বাবা বলতেন, ও চাইলেই খুন করে ফেলতে পারে কাউকে।

তাঁরা ভুল বলতেননা। আমি সেই জন্মানোর কিছুদিন পর থেকেই পরিবারের দুজন সদস্যকে খুন করার কথা ভেবে চলেছি। একজন আমার বাবা, অন্যজন দাদু।

 

বোধ হওয়ার পর থেকেই ওই শশ্রুগুম্ফধারী ভদ্রলোককে আমার মোটেই পোষায়নি। হাতে পায়ে প্রচণ্ড শক্ত, মায়ের সাথে ঝগড়া করে, প্রচণ্ড জোরে চেঁচায়, একগাদা ভাত খায় আর ঘুমের সময় নাক ডাকে। মাঝে মাঝে আমাকে কাঁধের উপর তুলে রাস্তায় ঘুরতে বেরোলে মন্দ লাগতনা যদিও, কিন্তু সেই একমাত্র ভাললাগার বিষয়টাতেও প্রায়ই ফাঁকি দিত লোকটা। এই লোকটি কেন আমার বাড়িতে থাকছে এবং কেন আমার আর আমার মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে আমি বুঝতামইনা। কিন্তু প্রতিবাদ করার মত ক্ষমতা তখনও আসেনি গলায়, অগত্যা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা।
এরপর যেই আমার বয়স আরেকটু বাড়ল, আমি বুঝতে পারলাম আই ওয়াজ ড্যাম রাইট। লোকটা প্রচণ্ড খারাপ। আমার উপর অত্যাচার প্রথম শুরু হল সেটা সন ১৯৯৩। ভোর ছটায় ঘুম থেকে তুলে একটা বাড়িতে নিয়ে গেল যেখানে আমার মতই আরও প্রচুর ভিক্টিম এবং এই লোকটার মতনই অনেকগুলো খারাপ লোক অত্যাচার করছে। সেকি কষ্টকর! গাদাগাদা বই এনে পড়াচ্ছে, না পারলে মারধোর করছে। কয়েকটা মায়ের মতন নরম জিনিস ছিল, ভেবেছিলাম এরা আমার ক্যাম্পের হবে। ও হরি, এগুলোও সঙ্গদোষে নষ্ট হয়েছে দেখি! এরাও একই কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এতেই শেষ নেই! সেখান থেকে বিকেলবেলা ফেরার পর রাত হতেই ওই ভদ্রলোক আবার একপ্রস্থ অত্যাচার শুরু করে দিল। ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমি আবার কাঁদি টাদিনা। ভ্রূকুঞ্চিত করে সহ্য করি সব। দেখি কত নীচে নামতে পারে।
আমি প্রথমে যেই বাড়িতে থাকতাম, তার পিছনে ছিল একটা খাল। নোংরা জলে ভর্তি, অজস্র পোকা মাকড়। এই লোকটা আমাকে প্রচুরবার তখন থ্রেট দিয়েছে পড়াশুনা না করলে আর যা যা করতে বারণ করা হয়েছে সেগুলো করলে ওই খালে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আমি পাত্তা দিইনি। এরপর যখন নতুন আরেকটা বাড়িতে আসলাম, দেখি ঘরের পিছনদিকেই একটা মরে যাওয়া পুকুর। প্রচুর গাছপালা আর জঙ্গলে ভরা। বিভিন্ন রঙের পাখি এসে বসে থাকে গাছের ডালে।অজস্র বিষধর সাপ কিলবিল করে ঘুরে বেড়ায়, কচুরীপানার উপর মেঘের ছায়া পড়ে, আর একদম মধ্যিখানে কিছুটা জল এখনও থেকে গেছে। সন্ধ্যের সময় লাল রঙের সূর্য্যের অবয়ব সেই জলে প্রতিফলিত হলে অবিকল ডিমের পোচের মত দেখায়।

 

এই সব প্রাকৃতিক সৌর্ন্দর্য্যে মজে গিয়ে যেই আমি বড় হয়ে কবি টবি হওয়া যায় কিনা ভাবছি, অমনি ওই ভদ্রলোক এলেন এবং ফতোয়া জারি করলেন যে খালটা ক্যানসেল হয়েছিল বেশ কিছুটা দূর বলে। পুকুরটা ঘরের পিছনেই। একটা দরজা খোলার অপেক্ষা। কিছু করেছি কী সেখানে ফেলে দেবে আমায় এবং এবার তিনি পুরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যেন জীবনে আর কিছু কাজ নেই, আমাকে পুকুর, খাল ইত্যাদিতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া।

 

এত দূর অবধি ঠিক ছিল, বাড়াবাড়িটা হল সেদিন।
আমি দোতলার একটা ছেলেকে কোনও এক লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিতে মারধোর করেছি। অতি সামান্য ব্যাপার, ইগনোর করাই যেত। কিন্তু তিনি মানলেননা। দরজাটা খুলে আমাকে হাফ বাইরে ছুঁড়ে শেষ মূহুর্তে টেনে নিয়ে এসে বললেন, “এবারের মতন ছেড়ে দিলাম। আর যদি কখনও দেখেছি…” আমার ততক্ষণে আত্মারাম রণতুঙ্গা হয়ে গেছে।
কিন্তু আরও দু তিন বার সেম জিনিস করার পর আমি বুঝলাম, নাহ্‌, এ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। কিছু একটা স্টেপ নিতেই হবে।

তখনই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক করে ফেললাম, আর দেরী নয়, লোকটাকে আমায় খুন করতে হবে, যেমন করেই হোক। নইলে আমার প্রাণ সংশয় হতে পারে। কোনদিন হাত থেকে স্লিপ করে গেলেই তো আমার হয়ে গেল। বরং একই পদ্ধতি আমি অ্যাপ্লাই করি। বাবাকেই ফেলে দিই ওখানে।

 

সেদিন শনিবার। ভদ্রলোক কোত্থেকে যেন চড়ে এসে ফিরেছে। আমি পাথরের মত মুখ করে গেলাম সামনে। বললাম, “একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, ওইখানে। দেখবে চল।”
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? পুকুরে? কেন গেছিলি ওখানে? দেব ফেলে হ্যাঁ? দেব?”
আমি হাত দেখিয়ে বললাম, “না, আগে দেখ জিনিসটা। তারপর ডিসিশন নিও।”
আমার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর ওকে ভাবাল। বলল, “চল দেখি…”
আমি দরজার কাছে গেলাম। বুক দুরুদুরু করছে। ঠাকুর, আমি পারব তো? আমায় সফল কোরো ঠাকুর। না পারলে যে আমি শেষ। প্রতিশোধ নিতে ওই ষণ্ডা ভদ্রলোক এক মূহুর্তও অপেক্ষা করবেনা।

 

দরজাটা খুলে মাঝের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, “ওই দ্যাখো? দেখতে পারছ?”

 

সে উঁকি মেরে প্রাণপণ দেখার চেষ্টা করছে কোথায় কী? আমি আস্তে করে পিছিয়ে এলাম। তার গায়ে যত জোর আছে তা দিয়ে দিলাম এক ধাক্কা।
সেদিনই বুঝে গেছিলাম ভগবান নেই। লোকটা এক চুলও নড়লনা। বরং ঘুরে বলল “এই কোথায় কী? আর তুই আমার পিছনে কী করছিস হ্যাঁ?”
কিছুক্ষণ পরই তার টনক নড়ল। ছবির মত বুঝে গেল কী হতে চলেছে। “ওহ তুই আমাকে ফেলে দিতে চাইছিলি? কী সর্বনাশ!” বলে আমায় কোলে তুলে নিল।
আমি জানি আমি নেই আর। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। আমার জীবনের ভ্যালিডিটি এইটুকুই ছিল। এবার বিদায় নেওয়ার পালা।
কিন্তু লোকটা আমায় ফেললনা। অবাক করে সেই প্রথমবার আমার গালে দুটো চুমু খেয়ে আদর করে মাকে ডাকতে শুরু করল, “এই দ্যাখো তোমার ছেলে আমায় ফেলে দিতে চাইছে পুকুরে…” এই বলে খুব হাসতে থাকল আর আদর করতে থাকল। সে হাসছে। মা হাসছে। আমার চোয়াল শক্ত হওয়া শুরু সেদিন থেকেই। এর থেকে ফেলে দিলে বোধহয় ভাল ছিল। এই অপমান জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।
তবে লোকটাকে আমার অল্প অল্প ভাল লাগতে শুরু করেছিল তার পর থেকেই। এরকমই হয় বোধহয়। খুনের ভিক্টিম কোনওভাবে বেঁচে গেলে তাঁর প্রতি একটা মায়া পড়ে যায়। কিছুদিন পর একদিন আমার কোনও একটা ‘করতে নেই’ এমন কাজে লোকটা রেগে গেল আবার। কিন্তু সেদিন আমাকে পুকুরে ফেলতে চাইলনা। বলল, “তুই এমন করিস তো, যা আমিই চলে যাচ্ছি পুকুরে। আর আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই।” এই বলে দরজার দিকে এগোল। সেই প্রথম আমার দৃঢ়, ঠাণ্ডা মুখ, শক্ত চোয়াল, পাথরের মত দৃষ্টি এবং কুঞ্চিত ভ্রু হঠাৎ বদলে গেল এক নিমেষে।
আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার পেটে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বললাম, “না তুমি যাবেনা… অ্যাঁআঁআঁআআ…বাবাআআআ… আমি আর করবনা এরকম… যাবেনাআআআআ…”
আমার খুনেপণা বন্ধ হয়ে গেছিল সেই সময়। কিন্তু কথায় আছে না? যে যার জন্য জন্মায় তাকে তাই করতে হয়? আমার দ্বিতীয় ভিক্টিমের আগমন তখনই ঘটল। আমার দাদু বা ঠাকুর্দা!


প্রথম প্রথম এই পক্ককেশধারীকে আমার বেশ ভাল লাগত। এ যে অমন জল্লাদের বাপ ধারণাই হয়নি। বরং এর যে আরেকখানা ছেলে আছে সেটা পুরো মাই ডিয়ার লোক। দেখলেই কিছু না কিছু কিনে দিচ্ছে বা খাওয়াচ্ছে, গল্প শোনাচ্ছে, ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে, সিনেমা দেখাচ্ছে, পুরো ফাটাফাটি।

কিন্তু যেই আমি আরেকটু বড় হলাম, এই বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের রঙ দেখানো শুরু করল। বাবা তাঁকে বলল, “আমার দ্বারা এমন বিচ্ছু সামলানো সম্ভব হচ্ছেনা। একফোঁটা পড়াশুনা করেনা, একটাও কথা শোনেনা, তুমি দ্যাখো যদি পারো, নয়ত এ উচ্ছন্নে যাবে।”
ব্যাস বুঝলাম তারপর, এ শালা রক্তের দোষ। আর এ আরও বেশি অত্যাচারী। কংস, শকুনি, অশ্বথামা তাবড় তাবড় ভিলেইনকে এ এক থাপ্পড়ে সোজা করে দিতে পারে। কে বলবে এত বয়স হয়েছে। রোজ আসছে, গাদা অঙ্ক করাচ্ছে, ধপাধপ মেরে শুইয়ে দিচ্ছে। শেষে এক টাকা হাতে দিয়ে ‘লজেন্স খেও’ বলে চলে যাচ্ছে। প্রথমে রাগে ভেবেছিলাম টাকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিই। তারপর ভাবলাম নাহ্‌, এতটা লস ধর্মে আটকাবে। লজেন্সটা খেয়েই নিলাম।
সে যাই হোক, এমন চলতেই থাকছে। আর বাড়ির ভদ্রলোক তো আর বদলে যায়নি পুরো। সে না হয় আমি ক্ষমাঘেন্না করে দিয়েছি মায়ায় পড়ে, পুকুরে আর ফ্যালে ট্যালেনা, কিন্তু সেও হাতের সুখ করে নেয় মাঝে মাঝেই। আর দিন কে দিন মা’টাও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে এদের সাথে মিশে। সবাই মিলে এমন আমার পিছনে পড়েছে কেন বুঝতেই পারছিনা। প্রাণ অতিষ্ট করে তুলেছে! তখনই ঠিক করলাম এদের একটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তবে বাকি দুটো ভয় পেয়ে থামবে।
মনে মনে বললাম, “দাদু, দিন গোনা শুরু কর। তোমার মৃত্যু আমার হাতেই হবে…”
প্রথমেই আমার ‘হাতের পাঁচ’ পুকুর দিয়ে ট্রাই করলাম। একই পদ্ধতি। বাবা না হয় শক্তিশালী, দাদু তো নয়। লাঠি নিয়ে হাঁটে। মাঝে মাঝেই ‘গেছি গেছি’ করে কঁকিয়ে ওঠে। আর আমিও বড় হয়েছি। ব্যস, শুধু নিয়ে যাও দরজায়। তারপর এক ধাক্কা…
কিন্তু যতটা সোজা হবে ভেবেছিলাম, হলনা। লোকটা প্রচণ্ড ধূর্ত। অমন কঠিন কঠিন অঙ্ক কষে ফেলা দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল। সে প্রথমেই নাকচ করে দিল, পুকুরে কিছু দেখার থেকে। বলল “না, না, আমি যেতে পারবনা, ওসব বাদ দাও, এখানে বস, ঐকিক নিয়মটা শেখাই।”
এরপর আমি অন্য পথ ভাবলাম। মা বলত, ‘উকুনের ওষুধ খুব বিষাক্ত। পেটে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। আমি ঠিক করলাম দাদুকে সেটা জলে গুলে খাইয়ে দেব। এবার তো আর বাঁচতে পারবেনা…”

লোকটা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছিল। যা ধূর্ত লোক! বুঝতেই পারে। সে চালু করল ঘুষ দেওয়া। আমার সাথে পরিচয় করালো গল্পের বই এর।

 

অবাক হয়ে গেলাম আমি! ছাপার অক্ষরে কঠিন কঠিন অঙ্ক, ইতিহাস ছাড়া যে এমন মজার জিনিস থাকতে পারে কল্পনাই করতে পারিনি! সেখানে প্রচুর খুনী, গোয়েন্দা, চোর, ডাকাত, পুলিশ সব কিলবিল করছে। পুরো মজে গেলাম সেই নেশায়। আর ঠিক করলাম, নাহ্‌, এ বাঁচুক, প্রচুর দিন বাঁচুক, যেন কোনওদিন না মরে। আর দিয়ে যাক আমাকে এমন সমস্ত সম্পদ। আমি অঙ্ক করব, মা বাবার কথা শুনব, কাউকে পিটাবোনা, শুধু এই রস থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত করা না হয়…
তারপর? তারপর আর কী… আমার আর কাউকে খুন করা হলনা। এখন খুন করার মত লোক প্রচুর। কিন্তু তাঁদের দেখে আমার চোয়াল শক্ত হলেই আমি বই এর তাক থেকে পেড়ে আনি একটা গল্পের বই। ব্যস, সব ঠিক হয়ে যায়।
আমার কথা কিন্তু খণ্ডায়নি। আমার ম্যাজিক বুড়ো গত বছর আমার হাতেই মারা গেছে। অনেকবার বললাম, “দাদু যেওনা, কে দেবে আমায় গল্পের বই বল? যেওনা প্লিজ। কে করাবে আমাকে অঙ্ক?” শুনলইনা কথা।
সবাইকে চলে যেতে হয়। আমার বাড়ির ওই অত্যাচারী, শশ্রুগুম্ফধারী, ষণ্ডা ভদ্রলোকও আস্তে আস্তে নরম হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। চুল পাকছে, টেনশন করা শুরু করেছে, প্রেশার হচ্ছে। আমি অপেক্ষায় আছি সেদিনের, যেদিন আরেকটা প্রজন্ম চোয়াল শক্ত করে প্ল্যান করবে তাকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার, আর মাহেন্দ্রক্ষণে নিজেই দরজায় দাঁড়িয়ে তার পেটে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বলবে “নাআআআআ যাবেনাআআআআআআআ…”

Illustration by Debjyoti Mahapatra

 

2 Replies to “খুনী”

  1. ভারী সুন্দর লেখা। চালিয়ে যান।

    শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *