উত্তরাধিকার এবং ভিখারি

অমিতাভ পাড়ুই

ভগবান বুদ্ধকে স্বামীজী যে কি চোখে দেখতেন তা বলে বোঝানো যাবে না। বুদ্ধর নাম উচ্চারণ করা মাত্রই তিনি যেন কেমন হয়ে যেতেন। বোঝা যেত হৃদয়ের গভীরে এক প্রকাণ্ড তরঙ্গ উঠেছে। ভীষণ অন্তরঙ্গভাবে তিনি বুদ্ধের জীবনী শ্রোতাদের সামনে মেলে ধরতেন। স্বামীজীর বলা এমনই একটি ঘটনা– যা তিনি তাঁর লেকচারে  শ্রোতাদের শোনাতেন।

বোধিলাভের পর বুদ্ধ পিতৃরাজ্যে একবার ফিরে এসেছিলেন। বৃদ্ধ পিতার আনন্দ আর ধরে না! রাজপুত্র ফিরছেন শোনামাত্রই তিনি রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন – রাজধানীকে পত্রে, পুস্পে, তোরণে, বর্ণের বিচিত্র বাহারে সুসজ্জিত কর। সকলের মধ্যেই উচ্ছাস আর আগ্রহ, প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশা – কতদিন পর রাজকুমার দেশে ফিরছেন!

স্বামীজীর বলা এই ঘটনাটিকে অনুসরণ করে নীচের কবিতাটি রচিত…

 

উত্তরাধিকার

 

সাজো সাজো রব রাজার প্রাসাদে

আজি বহুকাল পর

মহা-আনন্দে মাতিয়াছে সব

কুমার ফিরিছে ঘর।

প্রাসাদ অলিন্দে অস্থির যশোধরা

সন্তান সাথে প্রিয় প্রতিক্ষারতা।

কতকাল পর ফিরিছে কুমার

বুঝি অবসান দীর্ঘ আশার।

 

আবেগ না মানে বাঁধন যে হায়

হেরিয়া স্বামীরে যশোধরা কয় –

হে পুত্র মোর ‘ঐ আসে পিতা, যাও ছুটে যাও,

প্রাপ্য তোমার লও মেগে লও।‘

অপার বিস্ময়ে বালক কহিল –

‘কে আমার পিতা, বলো মোরে বলো,

আমি শুধু দেখি প্রাসাদ পানে চলে

সহায় সম্বলহীন ভিখারি দলে দলে।‘

যশোধরা কয় – ‘ওরে বাছা মোর,

ভাল করে দেখ – পুরভাগে ওর

উজ্জ্বল জ্যোতি মৃগেন্দ্র সম

পিতা তোমারই, দেবতা মম।

রাজপুত্র তিনি কি বিচিত্র সাজ!

ভিখারির বেশে এ যে মহারাজ!’

 

শুনিয়া সে কথা পুত্র রাহুল

সেই দিক পানে ধায়

নতজানু হয়ে দুহাত বাড়ায়ে

পিতা মুখপানে চায়।

সম্মুখে তাঁর শিশুপুত্র সেই!

ত্যাজিয়া যাহারে, ছাড়িয়া রাজপ্রাসাদ

এ খোলা আকাশ হইয়াছে

তাঁর আপন গৃহের ছাদ।

 

রাজার প্রাসাদে রাখিয়া প্রমাণ

পুত্রের হাতে বুদ্ধ ভগবান

নিজ ঝোলা হতে টানি

করিলেন দান গৈরিক বস্ত্রখানি।

 

অঞ্জলিপুটে হল অর্পণ

যা তাঁহার বড় আপনার ধন

“সব ধর্ম মাঝে ত্যাগ ধর্ম সার”

পিতৃ সম্পদে পুত্রের অধিকার।

 

কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী, ইংরেজি ৯ই নভেম্বর, ১৮৮৪ সাল। শীতের প্রারম্ভ। ঠাকুরের জামার প্রয়োজন হইয়াছিল, মাস্টারকে আনিতে বলিয়াছিলেন। তিনি লংক্লথের জামা ছাড়া একটি জিনের জামা আনিয়াছিলেন; কিন্তু ঠাকুর জিনের জামা আনিতে বলেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – তুমি বরং একটা নিয়ে যাও। তুমি পরবে। তাতে দোষ নাই। আচ্ছা, তোমায় কি রকম জামার কথা বলেছিলাম?

মাস্টার – আজ্ঞা, আপনি সাদাসিধে জামার কথা বলেছিলেন, জিনের জামা আনিতে বলেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তবে জিনেরটাই ফিরিয়ে নিয়ে যাও।

বিজয় – আজ্ঞা, তা বই কি! যা দরকার কাজেই নিতে হয়। একজনের ত দিতেই হবে। মানুষ ছাড়া আর কে দেবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেবার সেই ইশ্বর !

এই বলে ঠাকুর নীচের গল্পটি বলেছিলেন  —

“একজন ফকির আকবর শাহর কাছে কিছু টাকা আনতে গিছলো।   বাদশাহ তখন নামাজ পড়ছে আর বলছে, হে খোদা! আমায় ধন দাও, দৌলত দাও। ফকির তখন চলে যাবার উপক্রম করলে। …“

ঠাকুরের এই গল্পটি অনুসরণ করে নীচের কবিতাটি রচিত…

 

ভিখারি

বাদশাহ বীর – উন্নত শীর সম্রাট আকবর

পড়িছেন নামাজ একদা প্রভাতে বসি।

জীর্ণ শরীর – বৃদ্ধ ফকির

ভিক্ষার তরে জোড় হাত করে

নীরবে দাঁড়াল আসি।

 

কহে সম্রাট আল্লার প্রতি –

দয়া কর মোরে, করি এ মিনতি

মোর পানে প্রভু চাও

ধন দৌলত আরও বেশী করে মোরে দাও।

 

শুনিয়া সেকথা বৃদ্ধ ফকির

সহসা করিল স্থির

সে স্থান হতে – দ্রুত রাজপথে

তখনই হইল বাহির।

অবাক তাহাতে বাদশাহ বীর

ফকিরে ডাকিয়া কয়

ভিক্ষা না লও – কেন চলে যাও!

জানো মোর পরিচয়?

 

নত করি শীর – কহিল ফকির

মাগিব ভিক্ষা – ভিখারির কাছে!

তাই কি কখনও হয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *