আমি, রাধা

চন্দনা খান

কিছু সময় তো তুমি আমায় দিয়েছিলে।
সেই সব ক্ষণ, সেই আমার অনন্ত জীবন।
আগে পরে, ধোঁয়াশা – কুয়াশার মতো ঝাপসা।
এমনই তো বেঁচে থাকা, উদ্বেগ, উদ্বেলিত হৃদয়
কখনো আনন্দের ঢেউয়ের শিখরে
কখনো বা টলোটলো বেদনায় সাগরের গর্ভই আশ্রয়।
আমি কি জানিনি ?
আমি কি বুঝিনি ?
এক অলৌকিক সময়ের মধ্যে দিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি
এই ব্রজধাম, এই গোপিনীরা, রাখালবালক
তোমার দুরন্ত বাঁশী টান দেয় রক্তের শিরায় শিরায়
কুলশীল? যে অভিধানে আছে, সেইখানেই থাক।
সংসার? যমুনার জল বয়ে আনার জন্য যার প্রয়োজন।
যখন ডাক দিল তোমার স্বর্গনিন্দিত বা স্বর্গনন্দিত ভালবাসা
গৃহবধূ গেল ভেসে, জন্ম নিলো চিরকালের দয়িতা।
তোমার নীল অবয়ব আমার নীল গরল
সেই পানে মদিরার মতো নেশা
তুমিহীন জীবন ছেড়ে মৃত্যুর শান্তি।

একদিন তুমি চলে গেলে বৃহৎ, বৃহত্তর জীবনের দিকে
সমাজে, সংসারে, রাজনীতি, রণাঙ্গনে
তোমার কত কত কর্তব্য
শঙ্খরবে করে আহ্বান।
তখন কেই বা রাধা, গ্রাম্যরমণী এক।
সখীদের সাথে কলহে, কৌতুকে কাটিয়ে দেবে কাল।
তোমরা চলে গেলে দূরে রাধাদের কি হয়?
মনহীন দেহ ফিরে আসে সংসারের আঙ্গিনায়।
জীবন চলতে থাকে যমুনার নীল জল অশ্রুজলে ঘন নীল।
কদমফুল বালকের পায়ে পায়ে ক্রীড়ার সামগ্রী।
সখীদের নতমুখ, তুমি যে ছিলে তাহাদেরও সখা।
সখা? শুনেছি তুমি পরে হয়েছিলে দ্রৌপদীরও প্রিয়সখা
তার পরিত্রাণদাতা, বিবস্ত্র হওয়ার লাজ থেকে।
চাওনি যুদ্ধ তুমি কোনদিন, তবু অর্জুনকে ঠেলে দিলে রণাঙ্গনে
তুমি তো জানতে ধরাধাম মায়ার প্রতীক।
মায়া? হে প্রিয়, তোমার আমার নেই রামধনু সময়
সেও মায়া?
বলো না, বলো না, রিক্ত করো না আমাকে।
সময়ের দুধটুকু থেকে ক্ষীরসম্ভার
উপহার দাও আমায়।
স্মৃতি নয়, ওই তো বাস্তব।
আনমনা পথে চলি কলসী কাঁখে
দূর হতে তোমার কীর্তিকাহিনী কানে ভেসে আসে।
জানি তুমি অজেয়, তবু ভয় হয়
ইতিহাস গড়বে, তাই ধর্মযুদ্ধের জন্য কাটিয়ে দিলে সারাটা জীবন।
রুক্মিনী, সত্যভামা, তারাও কি করে অভিমান?
রাধার গল্প কি শুনেছে তারা?
কোনও বিরল বিরতিতে, স্বপ্ন-স্মৃতি কি জানা দেয় তবে?
নীল যমুনার তীরে, কদম্বের মূলে
কোন এক সামান্যা রমণীর আকুতি
অশ্রু আখিঁ, পূজা-সমর্পণ
কবির কাব্য, আর প্রেমিকের গান
শেষে অমরত্বে জড়ালো, আমাকে তোমাকেই।

One Reply to “আমি, রাধা”

  1. চন্দনাদির কবিতার বৈশিষ্টই হচ্ছে একেকটা অংশ পাঠকের মনে গেঁথে যায়।

    “তোমার কত কত কর্তব্য
    শঙ্খরবে করে আহ্বান।
    তখন কেই বা রাধা, গ্রাম্যরমণী এক।
    সখীদের সাথে কলহে, কৌতুকে কাটিয়ে দেবে কাল।
    তোমরা চলে গেলে দূরে রাধাদের কি হয়?
    মনহীন দেহ ফিরে আসে সংসারের আঙ্গিনায়।…”

    কিংবা
    “রুক্মিনী, সত্যভামা, তারাও কি করে অভিমান?
    রাধার গল্প কি শুনেছে তারা?…”
    বা
    “কবির কাব্য, আর প্রেমিকের গান
    শেষে অমরত্বে জড়ালো, আমাকে তোমাকেই।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *