মন-আয়না

চন্দনা খান

শেষ দেখা হয়ে ছিল বছর পাঁচেক আগে ।কলকাতার কলেজের এক কমন বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। কাজে বা অকাজে সমৃদ্ধা তখন কলকাতাতেই ছিল। সেটা ছিল নভেম্বরের হালকা শীতের সময়, সমৃদ্ধার কাছে যে সময়ের কোনও ঘড়ি নেই । সে সময় তর্ তর্ করে বয়ে চলুক বা এক বিন্দুতে স্থিরই থাকুক, সমৃদ্ধা কিছু আসে যায় না। এসব ক্ষেত্রে সমৃদ্ধা সত্যিই এক কবি মানুষ ।
তার ষষ্ঠ কবিতার বই বেরোবে পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক প্রেসে দিন দুয়েক পরে। পাঁচ বছর আগে শেষ দেখা রোশনীকে ফোন করেছিল সে। নেমন্তন্ন করার জন্য ।
রোশনী বলল: ” জানিস তো, তোর সঙ্গে এতদিন পরে ফোনে কথা হলেও আমি প্রায়ই মনে মনে তোর সঙ্গে কথা বলি। তুই আমার সঙ্গেই থাকিস।”
কৌতুহলে সমৃদ্ধা জিগ্গেস করেছিল – ” কি কথা?”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এসেছিল। রোশনির সেই বিখ্যাত হাসি। -” বললে নিতে পারবি তো?”
সমৃদ্ধার বুকের মধ্যে আশংকা আর বিস্ময়ের কাটাকাটি। কি এমন কথা বলে রোশনী তা সে নিতে পারবেনা? মুখে বললো “জীবনের এত বছর পেরিয়ে, এত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে না পারার কিছু নেই। দেখা হলে বলিস।” ওপাশে আবার হাসি ও সেই সাথে “বা-ই-ঈ” বলে ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ।

রোশনী, রোশনী। তোর বুকের কোনখানে কোন আঘাত বা আঘাতেরা স্তরে স্তরে জমে রইল? সেই কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে, তুই, আমি আর চন্দ্রিমা আমরা তিনজনই ছিলাম অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ইউনিভার্সিটি শেষ করে তোর সাথে প্রত্যক্ষ ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত। অফ ক্লাসে কলেজের পিছনে ঝিলের ধারে বসে আমরা ঝিলটাকে সমুদ্র ভেবেছি, যার এপারে আপেক্ষা করে আছে অনাবিষ্কৃত সব মহাদেশ। আছে আমাদেরই আবিষ্কারের প্রতীক্ষায়।
ওই সময়ই ওদের তিনজনের মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠেছিল ভ্রমণের লিপ্সা। নতুন নতুন জায়গা দেখা। কিন্তু সেই সময়ে সত্তরের প্রথম দিকে, ওদের সেই বয়সে, সীমিত রেস্ত নিয়ে কতদূরই বা যাওয়া যায়? সব সময় তিনজনের একসাথে যাওয়া হতো না।
রোশনী আর সমৃদ্ধার বাড়ির বন্ধন ছিল কম।
সমৃদ্ধা কি রোশনীকে যাকে বলে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করে নিয়েছিল? সে যেন রোশনীর গলা শুনতে পায়। সমৃদ্ধা সাথে ওর মনে মনে কথা বলা।

সমৃদ্ধা তুই বুঝি ভেবেছিলি আমি ঘুমিয়ে পড়েছি?
হঠাৎ আমরা ঠিক করলাম তিনদিনের ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে যাব। সেটা অক্টোবর মাস। পুজোর পর পর । তুই বললি ফাল্গুনীকে সঙ্গে নিয়ে যাই, একটা ছেলে থাকলে সুবিধা হয়।আমার আপত্তি ছিল না। তবে তোর কেমন বন্ধু সেটা পরে বুঝেছি। দার্জিলিং এ তখন তুলকালাম ভীড়, কোন হোটেলে জায়গা নেই, অবশেষে একটা হোটেলে একটাই ঘর পাওয়া গেল। উপায় নেই, ডবল বেডে তিনজন পাশাপাশি শুলাম। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি যে তুই ও ফাল্গুনী নিবিড় ভাবে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছিস। আমিও ঘুমের ভাণ করে পড়ে রইলাম। টয়লেটে যাওয়ার একটু দরকার ছিল, কিন্তু ওই পরিস্হিতিতে ওঠার সাহস দেখালাম না।

সমৃদ্ধা মনশ্চক্ষুতে দেখতে পায় সেই রাতটা। ফাল্গুনীর সাথে তখন তার সম্পর্ক দানা বাঁধছে।

আর?

বি.এ পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে আছি। কোথায় যাব, কোথায় থাকব ভাবছি! তুই-ই হুজুগ তুললি যে চল বাঁকুড়া জেলার টালডাংরায় যাই। আমাদের অবিচ্ছেদ্য তৃতীয় বন্ধু চন্দ্রিমাও রাজী।বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, তাই তার ক্ষেত্রে বাড়ির নিয়ম কানুন একটু কড়া।কিন্তু এবার মা আর মামার অনুমতি পত্র মিলেছে।

তুই বলেছিলি টালডাংরা একটা অদ্ভুত সুন্দর শালবন ঘেরা সাঁওতাল গ্রাম। সেই গ্রাম ঘেঁষেই বি.ডি.ও অফিস। বিরাট মাঠকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে আছে ব্লকের অফিস আর কোয়ার্টার । তোর পিসতুতো দাদা সুরঞ্জনদা সেই বি.ডি.ও অফিসে কাজ করেন। উনি নাকি তোকে বন্ধুদের নিয়ে আসতে বলেছেন। অতএব –
শীতের এক প্রায় সন্ধ্যায় আমরা বাঁকুড়া স্টেশনে নেমেছিলাম। সুরঞ্জনদা তোকে জানিয়েছিলেন যে বাঁকুড়া থেকে টালডাংরা বাসে আসতে লাগবে দুঘন্টা, কিন্তু দিনের শেষের বাস কিন্তু ছেড়ে যাবে বিকেল পাঁচটায়।স্টেশনের গায়েই বাস স্টেশন। আমরা বিকাল চারটেয় নামার বদলে ট্রেন লেট হওয়াতে নামলাম পাঁচটায় আর চোখের সামনে দিয়ে টালডাংড়া যাওয়ার ধ্যারধ্যারে বাসটা বেরিয়ে গেল। পরের বাস পরদিন সকাল ছটায়।রাতে থাকবো কোথায়? চন্দ্রিমা বললো, “হোটেলে রাতে থাকবো না।যত সব বাজে লোক থাকে। তার চেয়ে চল পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করি।” তুই বললি, “রিপোর্ট করে কি হবে? পুলিশ স্টেশনের সেলে আমাদের এক রাতের জন্য পুরে দিতে বলবো? পুলিশরাই কি হোটেলের খারাপ লোকেদের থেকে কম খারাপ?” আমি বললাম “তোদের এগুলো সব অবাস্তব কথা। আমরা রাতটা ওয়েটিং রুমেই থেকে যাব।দিব্যি দুখানা আরামকেদারা আছে ভিতরে। আমরা পালা করেই ঘুমোবো।” সেদিন আমাদের জীবনের প্রথম অ্যাডভ্যেঞ্চার।
– রোশনী আমি জানি এরপর তুই কি বলবি। আমি সেই গ্লানিতে এখনও ভুগছি। সুরঞ্জনদার বাড়ীতে তখন পিসিমা ছিলেন, আমাদের ভালই অভ্যর্থনা হল। সুরঞ্জনদা ভাল ছবি আঁকেন। বিশেষ করে পোট্রেট। তুই আবদার করলি তোর একটা পোট্রেট এঁকে দেবার জন্য। লাঞ্চের পর ঘন্টা দুয়েক পোট্রেট এঁকে সুরঞ্জনদা ক্লান্ত। আমরা দুপুরে একটু বিশ্রামের পর শালজঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগিয়েছি। আমি ও চন্দ্রিমা। তোকে বেড়োনোর মুহুর্তে সুরঞ্জনদা আটকেছেন। “রোশনী মাথাটা খুব ধরে গেছে এক নাগাড়ে মনোনিবেশের পরে। একটু টিপে দিবি?” তোর দ্বিধাগ্রস্ত মুখ, আমার তোকে ছাড়িয়ে আনা উচিত ছিল। পারিনি। বুঝতে পারছিলাম যে একজন অনাত্মীয় যুবতীকে দিয়ে এই কাজ করানো ওনার অন্যায়। বুঝলাম উনি সুযোগ নিচ্ছেন। আমি বলেছিলাম যে আমরা কাছাকাছিই হাঁটাচলা করছি। তোর জন্য অপেক্ষা করব।
আধঘন্টা পরে তুই আস্তে আস্তে আমাদের দিকে হেঁটে আসছিলি। চন্দ্রিমা বললো “রোশনীর কোথায় যেন একটা হীনমান্যতার ভাব।আমরা দুজনেই ওর চেয়ে পড়াশোনায় ভালো, সেটা আমি জানি। আমি তো কতদিন আমাদের পাঠ্য কোন নাটক বা কবিতা ওকে সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছি।” রোশনী, তুই নিশ্চই সেদিন আমার দাদার সাথে তোকে ওই ভাবে একা ফেলে আসার জন্য আমাকে মনে মনে দোষারোপ করছিলি।
পাঁচ বছর পরের এই দেখায় আমি যুগপৎ কৌতুহলী ও আশংকিত ছিলাম।একটু আড়াল পেলে জানতে চাইলাম – “তুই আমার সাথে মনে মনে কি কথা বলিস? আমি নিতে পারবো।”
– “সেকি!  তুই ওনলি তুই ই নিতে পারবি।” আবার সেই নদীর জল বয়ে যাওয়ার মতো হাসি।
– “আরে, আমি তো বলেছিলাম, লিখতে পারবি তো? তোর সাথে আমার কথা বলার মধ্যে আমার আনন্দিত যৌবন আছে, আমার রোজকার জীবনযাপন আছে, মনে মনে তোকে যে উঁচু আসনে বসিয়েছি তার প্রতি নিবেদন আছে। – বসে একদিন ডিটেলস্এ বললে লিখতে পারবি তো?”

One Reply to “মন-আয়না”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *