হৃদমাঝারে

পিয়ালী চক্রবর্ত্তী

 

অনেকদিন বাদে খুললাম ফেসবুক । এদিক সেদিক দেখতে দেখতে কি মনে হল, ক্লিক করলাম মেমরিতে । আজ  থেকে ঠিক একবছর আগে, আমার আগের অফিসের এক কলিগ আমার টাইমলাইনে লিখেছে ‘কিরে তোর কি খবর ? ফোনে পাচ্ছিনা, অফিসে আসছিস না, কি ব্যাপার ?’ গত দুদিন ধরে ভুলে থাকতে চাইছিলাম, আজ একেবারে হুড়মুড়িয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল ঠিক একবছর আগের দিনটা ।

নভেম্বর মাস, হালকা একটা ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে । দুপুরের রোদে একটা আমেজ, খেয়ে দেয়ে চিলেকোঠার ঘরে শুয়ে রোদ পোহাতে বেশ লাগে । আমি শুয়ে আছি চিলেকোঠার ঘরে, কোনক্রমে দু-চার গাল ভাত খেয়ে উঠে এসেছি । দুপুরের রোদে আমার একটুও আরাম লাগছে না । আমার বুকের মধ্যে,গলার কাছে চাপ চাপ কষ্ট।আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা,কিছুতেই না। মা,বাবা বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে আমার ? আমি উত্তর দিইনি । কাল থেকে আমি কোন ফোন ধরিনি, মেসেজ, হোয়াটসআপ, ফেসবুক কিচ্ছু চেক করিনি । আজ দুদিন অফিস যাইনি, সারাদিন শুয়ে আছি চিলেকোঠার ঘরে । রাত করে নেমে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ছি । আজও সন্ধ্যে অব্দি শুয়ে ছিলাম, দেখি অফিস থেকে ফিরে দাদা উঠে এল আমার কাছে।

–           কি হয়েছে রে তোর ? এভাবে শুয়ে আছিস কেন ? কারুর সাথে কথা বলছিস না, মা, বাবা প্রচন্ড দুশ্চিন্তা করছে ।

আমি উঠে বসলাম, নাঃ আর একা একা যন্ত্রণা নেওয়া যাচ্ছে না । দাদাকে সব খুলে বলতেই হবে ।

–           আমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদা

–           কেন রে ? আমাকে তো বল

পরিস্কার দেখতে পেলাম সেই দিনটা, মাস তিনেক আগের কথা,আমার বন্ধু স্বাগতা একটা রাজনৈতিক পোস্ট দিয়েছিল ফেসবুকে, আমি আমার মতামত জানিয়েছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পোস্টকে চ্যালেঞ্জ করে লিখল একটি ছেলে, তার নাম,  ছবি প্রথম দেখলাম, রূপম সরকার । ব্যাস সারাদিন ঝগড়া । সে যা বলে আমি তার উল্টোটা,  প্রায় ফেসবুকীয় হাতাহাতির যোগাড় । কাজকর্ম মাথায় উঠল, শেষে একটা টিম মিটিং বাঁচাল আমায় । মাথা ঠান্ডা হল একটু । পরেরদিন সকালে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, সেই রূপম সকারের, ইনবক্সে একটা ছোট্ট মেসেজও দিয়েছে ‘কাল সারাদিন ঝগড়া করেছি, তাই আজ বন্ধুত্ব করতে চাই’। কি মনে হল হ্যাঁ করে দিলাম। তবে স্বাগতার কাছে একটু জেনেও নিলাম, ‘এই রূপমকে তুই চিনিস’? স্বাগতা তখুনি মেসেজ করল, ‘হ্যাঁ,হ্যাঁ ওই পাগলটাতো আমার কোম্পানীতেই চাকরি করে, পুনেতেই থাকে, ভাল ছেলে’। তারপর কোন না কোনভাবে ফেসবুকে কথা হতেই থাকত, আস্তে আস্তে ইনবক্সে গল্প, একদিন ফোন নম্বর আদান প্রদান, তারপর সারাদিন হোয়াটসআপ । খুব তাড়াতাড়ি পট পরিবর্তন, মনের মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করে গেল রূপমের জন্য । একটু অবাক হই, আমি আবার এসব করতে পারি নাকি ? মানে কাউকে কোনদিন না দেখেই তার প্রেমে পড়ছি ? এর মধ্যে একদিন ফোনে কথাও বলে ফেললাম,কোন বিশেষ কথা না, নেহাতই আড্ডা । ভাবছি আর অবাক হচ্ছি, আমি একটি নেহাতই সাদামাটা মানুষ, ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ার মত কিছুই নই । আমার উনত্রিশ বছর বয়েস, এখনও বিয়ে হয়নি, মনে যদিও যথেষ্ট ইচ্ছে আছে । আমার বাড়ির লোকের এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা, আমরা যৌথ পরিবারে থাকি, জেঠু আর জেঠিমার সঙ্গে । জেঠু রক্ষণশীল ব্রাম্হন, নিজের দুই মেয়েকে ২৪ বছরের মধ্যে ভাল ঘর, একই জাতের মধ্যে ঠিকুজি কুষ্ঠি মিলিয়ে বিয়ে দিয়েছে । কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমাকে পাত্রস্থ করে উঠতে পারলনা এখনও । আমি পড়াশুনায় খারাপ ছিলাম না, সায়েন্স নিয়ে পড়ে, জয়েন্টে একটু পিছনের দিকে র‍্যাঙ্ক করে, প্রাইভেট কলেজ থেকে বি.টেক করে এঞ্জিনিয়র হলাম, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি পেলাম । এই পুরো সফরে উল্লেখ করার মত কিছু নেই, আমিও আর পাঁচজনের মত কলেজ কেটে সিনেমা দেখেছি, ক্যান্টিনে আড্ডা মেরেছি, একটা দুটো ছেলেকে ভাল লেগেছে, বলতে পারিনি, চেয়েছি তাদেরও আমাকে ভালো লাগুক, সেটা হয়নি যথারীতি। চাকরি পাবার পর থেকেই বাড়িতে পাত্র খোঁজার হিড়িক, আমি অবশ্য তাতে খুব একটা বাধা দিইনি । জেঠুতো উঠেপড়ে লেগেছে সেই থেকে । এখনও পাত্রপক্ষ চাইলে আমার কুষ্ঠি পাঠান হয় তাদের বাড়িতে । তাতেও আমি কোনদিন আপত্তি করিনি । কারুর আমার কুষ্ঠি পছন্দ হয়নি, কারুর আমাকে, আবার আমাদেরও কাউকে পছন্দ হয়নি এমনও হয়েছে । মোদ্দা কথা, বিয়ে আমার কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না । তাই নিয়ে যে আমি বিশেষ উতলা ছিলাম তাও নয়, বন্ধুদের বিয়ের ছবি দেখে, নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ইচ্ছেটা চাড়া দিত । আর ওই হ্যাঁ বিয়ে যদি করতেই হয়, তাহলে সময়টা এসে গেছে, এটাই যা । এইরকম সময়ে হুট করে রূপমের সাথে অনলাইন আলাপ । আস্তে আস্তে বুঝলাম ছেলেটাকে আমার ভাল লাগছে । একটু বেশি ভাল লাগছে। অন্যপক্ষের অবস্থাও অনেকটা একই । এখন আমরা একটু মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা করছি। একদিন সাধ হল স্কাইপে দেখব, রাতের বেলা দরজা বন্ধ হবার পর স্কাইপ চালু হল, প্রথম তো দুজন দুজনকে দেখে হেসেই গেলাম । তারপর গল্প আর ফুরোয় না । রূপম বলল ও ক্রিস্টমাসে আসবে কলকাতা, দেখা হবে তখন । চলছিল বেশ, আগের সপ্তাহে রূপমের ফেসবুক, হোয়াটসআপে একটু কম আনাগোনা,বলল শরীরটা ভাল নেই । ফোন করলাম, গলা ভারি, বেশ জ্বর, অফিসে যায়নি, ডাক্তার দেখাতে যাবে । তারপর দিন দুয়েক জ্বর কিছুতেই কমছে না, ব্লাড টেস্টেও কিছু ধরা পড়ছে না, বুধবার আবার ফোন করলাম, ওর এক বন্ধু ফোন ধরে বলল ওকে হস্পিটালে নিয়ে যাচ্ছে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা । ভীষণ টেনশন হচ্ছে, বুধবার রাত অব্দিও অবস্থা একই, বৃহস্পতিবার সকালে অভ্যাসবশত ফেসবুকটা খুললাম, রূপমের টাইমলাইনে কে একটা লিখেছে ‘কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না তুই আর নেই, যেখানেই থাকিস ভাল থাকিস’, মানে ? বলতে না বলতেই আর একটা পোস্ট ‘আর আই পি’। কি লিখছে এরা ? এরা কি পাগল হয়ে গেছে ? উদ্ভ্রান্তের মত স্বাগতাকে ফোন করলাম, ‘স্বাগতা কি হয়েছে রূপমের ?’ স্বাগতা কান্নাটাকে গিলতে গিলতে বলল ‘রূপমকে বাঁচান গেলনা রে, কিচ্ছু ধরা গেল না, কাল মাঝরাতেই…’

কোনমতে বললাম দাদাকে, দেখি দাদাও কেমন থম মেরে গেল । আমার মাথায় একটা হাত রাখতেই,আমি দাদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম, পাগলের মত ।

দাদা বাড়িতে বলেছে সকলকে, কিন্তু বাড়িতে একটা অশান্তি শুরু হয়েছে, জেঠু নাকি তার এক অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কথা দিয়ে ফেলেছে যে তিনি তার ভাইপোর জন্য মেয়ে দেখতে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন । আসলে আমি যে এমন কিছু করে ফেলতে পারি, এতো কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি, জেঠু বলেছে এটা ক্যান্সেল করা সম্ভবই নয়, যদিও জেঠুর নাকি আমার প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি আছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে বললাম, ‘মা প্লিজ আমি এক্ষুণি পারবনা, আমায় একটু সময় দাও’। মা বলল ‘আমি, বাবা দুজনেই জেঠুকে বলেছি, এখন সম্ভব নয় । পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেছি, জেঠু পাশে এসে বসল, গম্ভীর গলায় শুরু করল ‘আমি জানি তোমার মন ভাল নেই, কিন্তু কি করবে বল, জীবন তো থেমে থাকবে না, একটু মন শক্ত কর’, করুণ গলায় বললাম ‘আমি এক্ষুণি পাত্রপক্ষের সামনে বসতে পারব না জেঠু, আমায় একটু সময় দাও’। জেঠু মুখটাকে শক্ত করে বলল ‘কি নাম ছিল ছেলেটার?’ বললাম ‘ রূপম সরকার’, জেঠুর গলা থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল ‘সরকার’। এই প্রথম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম জেঠুর দিকে, দাদা তাড়াতাড়ি সামলে নিল, ‘যে মানুষটা নেই, তার সম্পর্কে আর জেনে কি হবে জেঠু’। মনটা তেতো হয়ে গেল ।  কিন্তু এখানেই শেষ নয় সবটা, দাদা বলল যে জেঠু নাকি নিজে থেকে ছেলের বাড়িকে বারণ করতে পারবে না, বাবা দায়িত্বটা নিতে চেয়েছিল, জেঠু সেটাও হতে দেবে না, কি নাকি প্রেস্টিজের ব্যাপার আছে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে যে ছেলের সাথে দেখা করে আমাকে সব বিস্তারিত বলতে হবে । কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে, তারপর বললাম ‘আচ্ছা বলে দেব’। আমার আর জেঠুর সাথে লড়ার শক্তি নেই । ঠিক কবে ছিল ?

অফিসে প্রাণপণ কাজের চেষ্টা করছি, কি একটা ঘোরের মধ্যে বারবার রূপমের ফেসবুক প্রোফাইল খুলে ফেলছি, দেখে যাচ্ছি ওর ছবিগুলো, মোবাইল খুলে পড়ছি আমাদের চ্যাট । বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে সব । কোনমতে কাজ শেষ করে উঠলাম, কাছাকাছি সিসিডিতে আসবে ছেলেটা, ফোনে কথা বলে নিয়েছি, নীলাদ্রি, তাকে এখন বলতে হবে আমার গল্প । বলতে হবে আমি এখন বিয়ে করতে পারবনা । ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থাকে, ভাল চাকরি করে, জেঠু আস্ফালন করে মরবে, ‘ভাল ছেলেটা হাতছাড়া হয়ে গেল’, হয়ত বলে দেবে বাবাকে, ‘তোমার মেয়ের পাত্র খোঁজার দায়িত্ব আমি আর নেব না’। বেঁচে যাব আমি তাহলে, ভগবান এই সুযোগ । সিসিডিতে পৌঁছে আবার ফোন লাগালাম,ভিতরে বসা নীল টি-শার্টের ছেলেটা ফোনটা নিয়ে হাত নাড়াল । চশমা পরা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সুপুরুষ ছেলেটা একগাল হেসে বলল ‘হাই আমি নীলাদ্রি, বসুন প্লিজ’। তারপর কিছুক্ষণ টুকটাক আলাপচারিতা, কফির অর্ডার, কফিতে চুমুক দিয়ে আমি সোজা পৌঁছলাম আসল টপিকে । বললাম ‘আপনাকে কিছু কথা বলার আছে আমার’। বাকিটা বলে ফেললাম গড়গড় করে, গলার কাছে কান্নাটা আসছিল, কিন্তু অচেনা একটা ছেলের সামনে ? না, থাক । কথা শেষ হতে দেখি, ছেলেটা কেমন গুম মেরে গেল, তারপর মুখ তুলে বলল, ‘জানিনা ঠিক আপনাকে কি বলব ? ভাল থাকবেন, আর এসব নিয়ে ভাববেন না, আমি বাড়িতে সব বুঝিয়ে বলব’।

দেখতে দেখতে ছটা মাস কেটে গেল । কবে যেন বাংলার স্যার বলেছিলেন, মানুষের জীবনে সময়ের সাথে সাথে কষ্ট যদি বেড়েই চলত তাহলে মানুষ বাঁচত না । হ্যাঁ,কষ্টটা থাকে, শুধু একটা প্রলেপ পড়ে তাতে, একটু একটু করে সয়ে যায় । তাও ভাবি ভাগ্যিস সামনাসামনি দেখা হয়নি, সেটা হলে কি করতাম ? পাগল হয়ে যেতাম তো । একদিন উইকেন্ডে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখে, মলে ঘুরছি, চারদিকে লোক গিজগিজ করছে, একটা জটলা কাটিয়ে এগোতে যাব, আরেকটু হলেই ধাক্কা খেতাম একজনের সাথে । সরি বলতে গিয়ে তাকিয়েছি, আরে নীলাদ্রি না? সেও একগাল হেসে বলল

–           আরে তুমি? কেমন আছ?

(বুঝলাম এ বেশি আপনি টাপনির ধার ধারে না, আমিও তাই, বললাম)

–           ভাল

–           সব ঠিকঠাক?

–           একদম

–           বিয়ে করলে?

–           আরে ধুর,মেয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে পাগল করে দিচ্ছে, বিরক্তিকর । বললাম একটা ব্রেক দাও, সামনের মাসে অফিস থেকে যাচ্ছি ইউ এস । তিন মাসের জন্য । এসে আবার ভাবা যাবে ।

–           বাঃ ভাল

–           ওকে আজ একটু তাড়া আছে, আসি কেমন?

–           ওকে বাই

বাড়িতে ফিরে ফেসবুক ঘাঁটছিলাম, কি মনে হল নীলাদ্রির প্রোফাইল খুঁজে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম । পাঠিয়েই মনে হল, এটা কি হল ? আজ জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে করেছ কিনা, বাড়িতে এসেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট । কি ভাববে ছেলেটা ? আমি কষ্ট টষ্ট সব ভুলে আবার বিয়েতে রাজি ? ছি,ছি । যাগকে, মরুকগে, যা ভাববে ভাবুক, ইচ্ছে হয়েছে পাঠিয়েছি, বেশ করেছি । পরদিন দেখলাম রিকোয়েস্ট এক্সেপ্টেড । আবার অফিস, কাজ, জীবন, বেশ মাসখানেক পর কি একটা ফেসবুকীয় পোস্টে নীলাদ্রির সাথে কথা হয়ে গেল । তারপর দেখি চ্যাটে পিং

–           কি ম্যাডাম শরীর ভাল?

–           হ্যাঁ, তুমি আমেরিকা পৌঁছেছ?

–           একদম

–           কোথায় আছ?

–           মিনিয়াপোলিস

–           ভাল

হাবিজাবি আরও কিছুক্ষণ কথা হবার পর জানলাম ও আর আমি একই টেকনোলজিতে কাজ করি । আমার অফিসে বেশ একটা গ্যাঁড়াকল প্রোজেক্ট চলছে, মাঝে মাঝেই ফেঁসে যাচ্ছি, বলতেই বলল ‘হ্যাঁ আমার সাথে আলোচনা করতেই পার, অবশ্য আমার যদি ফান্ডাতে কুলোয়’। একটা কাজ কর আমার হোয়াটস আপ নাম্বারটা নিয়ে নাও, চ্যাটে আমি সবসময় থাকিনা, আর তোমার আমার যা টাইম ডিফারেন্স’। নিয়ে নিলাম, অতঃপর কোডিং, ডিকোডিং, বাগ হ্যানত্যান চলতেই লাগল, দেখলাম ছেলেটার ফান্ডা বেশ ভালই, আমার কাজে লাগছে বেশ । যাক কোডিং বেঁচে থাক, ছেলেটার মনে  বিয়ে প্রসঙ্গে কোন সন্দেহ নেই বলেই মনে হয়  আমি নিশ্চিন্ত হলাম ।

চলছিল ভালই, আমার সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ, উইকএন্ডে অফিস করছি। একটা দরকারে পিং করলাম নীলাদ্রিকে, বাজে লাগছিল, ওদের ওখানে সবে উইকেন্ড শুরু হয়েছে,আজ  শুক্রবার । রিপ্লাই এল, কথা চলছে, হঠাত শনিবার সন্ধ্যে থেকে হোয়াটস আপে কোন রিপ্লাই নেই । ভাবলাম বেড়িয়েছে হয়ত, শনি গেল, রবি গেল, সোমবার বিকেল অব্দিও না হোয়াটস আপ, না ফেসবুক, জিমেইল চ্যাট, কোত্থাও নেই । এখনও ফেরেনি ? বুকের মধ্যে একটা হালকা ধড়ফড়ানি, কি হল ? কথা বলছে না কেন ? আবার ভাবছি, ধুর ওর তো হাজারটা কাজ থাকতে পারে, উত্তর দিতেই হবে এমন কোন ব্যাপার তো নেই । মঙ্গলবার থেকে ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করল, বারবার ওর টাইমলাইন চেক করছি, কোন খারাপ কিছু নয় তো ? মিনিয়াপোলিসে কোন বড় দুর্ঘটনার খবর আছে নেটে ? নাঃ নেই তো । সেদিন আমার জন্মদিন, সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, আমি ঠিক করে আনন্দ করতে পারছি না, কিছু কি হল ? বাড়িতে পায়েস করেছে মা, খাচ্ছি মানে গিলছি, বারবার টাইমলাইনে দেখছি নীলাদ্রির, এতটা সময় কেটে গেল ।

রাত তখন পৌণে বারোটা, আর পনের মিনিট পরে আমার জন্মদিন শেষ, ফোন বেজে উঠল, বাইরের নাম্বার, তুললাম

–           হ্যালো

–           নীলাদ্রি বলছি, আরে আজ দেখলাম তোমার বার্থডে, আরে আমি এমন ফেঁসে গেছিলাম, তোমার হোয়াটস আপে পিং দেখলাম, সরি, হ্যাপি বার্থডে

–           নীলাদ্রি তুমি কোথায় ছিলে ? কেন তিনদিন তোমার কোন খবর নেই ? জান…

আমি কথা বলতে পারছিনা, কান্নায় আমার কথা আটকে যাচ্ছে, ওদিক থেকে আওয়াজ এল

– আরে বোল না, শনিবার হঠাত প্ল্যান করে কয়েকজন গেছিলাম কাছাকাছি একটা হিলস্টেশনে । আরে পৌঁছনর পর সে কি বৃষ্টি, ল্যান্ডস্লাইড হয়ে, গাড়ি আটকে, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই, যাতা ব্যাপার, তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই ফিরলাম । হ্যালো, হ্যালো…একি তুমি কাঁদছ?

আমি কিছু বলতেই পারছিনা, আমি কি, কেমন বোকা, কেঁদেই চলেছি, ওদিক চুপ, কিছুক্ষণ পর আবার নিলাদ্রির গলা

–           রিয়া

আমি এমন গাধা, আরে এবার নিজেকে সামলে নিয়ে যাহোক কিছু বল, তা না আবার কেঁদে ফেললাম জোরে

–           তুমিতো ভারি ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে দেখছি, দাঁড়াও আসছি পুজোতে কলকাতায়, তোমার একটা ব্যবস্থা করতে হবে

পুজো কেটে গিয়ে আবার নভেম্বর, নীলাদ্রির ঘরণী হয়ে এসেছি ব্যাঙ্গালোর, কাল এসেছি, বিয়ে, হানিমুনের পাট চুকিয়ে । নীলাদ্রি অফিস গেছে, আমি ফেসবুক খুললাম, বেশ কয়েকদিনের ব্যস্ততায় খোলাই হয়নি।

এদিক সেদিক দেখতে দেখতে কি মনে হল,ক্লিক করলাম মেমরিতে……………

One Reply to “হৃদমাঝারে”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *