জানালা

শমিতা চক্রবর্তী

সকালের আলোটা মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই মৌ এর হাল্‌কা ঘুমটা ভেঙে গেল ।  ঘুমের সাথে সম্পর্কটা ওর আজকাল একদম ভালো না, মাঝে মাঝে পথ ভোলা পথিকের মত আসে ঠিকই, তবে অধিকাংশ দিনই জোর করে ধরে আনতে হয় ।  আজকাল সবসময় ওষুধেও ভালো কাজ হয় না।  অথচ কিছুদিন আগেও ঘুম ছিল ওর আলাদিনের জিনি ।  সারাদিনের  অক্লান্ত পরিশ্রমের পর চোখের পাতা এক করলেই আবির্ভাব হত সে । আজ্ঞার অপেক্ষা করত না, নিজেই নিয়ে যেত এক এক সম্পূর্ণ অজানা জগতে ।  কিন্তু আস্তে আস্তে অন্য অনেক কিছুর মত সেই চরম বিশ্বস্ত জিনিও আর ওর বশে নেই।  শুধু ঘরের পূবের জানালাটার সাথে ওর সম্পর্কটা এখনও অত্যন্ত মধুর ।

ঢাকুরিয়া ষ্টেশন লেনের ছোট্ট একটি বাড়ির দোতলার কোনে মৌ এর ঘর । বাড়িটা দাদুর আমলে তৈরী ।  তখন এই ঘরটায় ঠাকুমা দাদু থাকতেন, তারপর মৌ এর দখলে ।  ঘরের তিনটে জানালার দুটো উত্তর দিকে, একটা পূবে ।  পূবদিকটা বেশ খোলামেলা ।  বাড়ির পাশেই রাস্তা আর তারপরই বড় একটা খেলার মাঠ – প্রোমোটারের আশীর্বাদের অপেক্ষায় দিন গুণছে । উত্তর দিকে একটা বহুতল তৈরী হবার পর থেকে পূবের জানালাটাই এখন ঘরের প্রাণ, মৌ এর নিঃসঙ্গ জীবনের নির্বাক সঙ্গী । ছোটবেলা থেকে  এই জানালাটার পাশে বসে পড়াশুনো করা ওর অভ্যেস ।  বাবা-মার সাথে কত গল্প, গান, আলোচনা, বিতর্কের নীরব শ্রোতা ছিল এই জানালাটা ।  আজ সেই মা-বাবা, এমনকি অনেক সাধনায় তৈরী ওর গানের গলাও ওর সাথে নেই । কিন্তু থেকে গেছে এই অবলা জানালাটা।  বিনা বাক্যব্যয়ে বয়ে চলেছে সুখ-দুঃখের বোঝা ।

কয়েক মাস আগে হাসপাতালে রুগী দেখা শেষ করে গাড়ীর দিকে যেতে যেতে হঠাৎ হাতের ফোনটা কেঁপে উঠল মৌ এর । মধুমিতা – অনেকদিন কথা হয় নি মধুমিতার সাথে ।  অথচ স্কুলে পড়তে অসম্ভব বন্ধুত্ব ছিল  দুজনের। কর্মজীবনের ব্যস্ততা অনেকটা  আগাছার মত, অদ্ভুত ক্ষমতায় নিঃশব্দে সময়ের বেড়াজালের ভেতর ঢুকে কি ভাবে নিজের আধিপত্য ছড়িয়ে ফেলে ।  ফোন তুলতেই মধুমিতার আদেশ সোজা ওর বাড়ি যেতে হবে । স্কুলের কয়েকজন বন্ধু একসাথে হয়েছে, মৌকে ছাড়া আসর জমছে না ।  আড্ডার আকর্ষণে  ক্লান্ত শরীরটাকে জোর করে টেনে নিয়ে নিউ আলিপুরে গেল মৌ ।  ও ছাড়া সবাই এখন সংসারী । একটু অস্বস্তি হয় আজকাল এইসব আড্ডায় আসতে, কিন্তু আবার ভীষণ ভালোও লাগে।  নানা গল্পের মাঝে হঠাৎ ইন্দ্রাণী বলে ওঠে সোমার দাদার কথা ।  কেন, কি প্রসঙ্গ – তা আর শোনে নি মৌ,  ‘সোমার দাদা’ কথাটাই যথেষ্ট ছিল ওর সংযত, তরুণী মনটাকে তোলপাড় করে দিতে ।  ১৬ বছর বয়সের এক নির্বাক প্রেমের স্মৃতির তরঙ্গ আছড়ে পরতে থাকে ওর মনে – আলোড়িত হয়ে ওঠে ওর সারা শরীর।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে সেই পূবের জানালাটার পাশে বসে পড়ত মৌ । ঠিক ভোড় ছ’টার সময় সোমার দাদা শুভ্র যেত কলেজে , ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে । শুভ্র মৌ-এর থেকে এক বছরের বড়, তখন  11 এ পড়ত ।  নিজের অজান্তেই চোখ দুটো  জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে চলে যেত রাস্তায় আর মিলিত হত অন্য দুটি আকাঙ্খিত চোখের সাথে ।  নিষ্পলক সেই দৃষ্টি বয়ে নিয়ে যেত দুজনের অন্তরের আবেগ ও অনুভূতি, পৌছে দিত হৃদয়ের না বলা বাণী।  কিন্তু ওইটুকুই – তবে ঐ নির্বাক কয়েকটি মুহূর্তের জন্য রোজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো মৌ – শুভ্রকে দেখতে না পেলে সারাদিন উদাস হয়ে থাকত ও – পিপাসিত আঁখি খুঁজে বেড়াত তৃষ্ণার জল ।  খুব জানতে ইচ্ছে হত শুভ্ররও একই অনুভূতি হয় কিনা ।  এইভাবে কেটে যায় প্রায় দুবছর ।  তারপর শুভ্র চলে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে খড়গপুরে ।  খবরটা  মৌ পেয়েছিল সোমার কাছে । খুব আশা করেছিল শুভ্র যাবার আগে ওকে কিছু বলে যাবে ।  কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয় নি মৌ এর ।

এরপর মৌ যায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়তে, নিজেদের জীবন প্রতিষ্ঠার সাধনায় হারিয়ে যায় কৈশোরের সেই নির্বাক প্রেম ।  প্রায় সাত-আট বছর পর MD শেষ করে কলকাতায় ফিরে এসে যোগ দেয় এক নামী বেসরকারী হাসপাতালে ।  ওর বাবা ততদিনে অসময়ে চলে গিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে, সেই শোকে মা নিয়েছেন বিছানা ।  পেশার চাহিদা আর মায়ের অসুস্থতার বন্ধনে আবদ্ধ মৌ জীবনযুদ্ধে হারিয়ে ফেলে নিজেকে । অন্য অনেক কিছুর মতই ভুলে যায় সেই ছেলেমানুষিও । একদিন হাসপাতালের কাজের ফাঁকে এক সহকর্মীর সাথে ব্যাঙ্কে গিয়েছিল ও । লাইনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে ভীষণ পরিচিত এক মুখ, আরও পরিচিত তার দৃষ্টি । সম্মোহনী সেই দৃষ্টির আকর্ষণ থেকে দুজনের কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি নিজেদের, বহুদিন পর আবার নিষ্পলকে নীরব কথোপকতনে হারিয়ে যায় দুটি বিস্মিত প্রাণ ।  ডঃ ব্যানার্জীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ নামিয়ে counter র দিকে এগিয়ে যায় মৌ ।  সেই ওর শুভ্রর সাথে শেষ দেখা।

আজ এতদিন পর দুষ্টু রোদটা শুধু ঘুমই ভাঙ্গায় নি, আবার সাথে করে নিয়ে এসেছে সেইসব মিষ্টি স্মৃতিগুলো ।  মধুমিতার বাড়িতে ইন্দ্রাণীর মুখে শুভ্রর কথা শুনে কিছুদিন নিজেকে অনেক কষ্ট করে সংযত করেছিল  মৌ।  কিন্তু এক সপ্তাহ আগে ওর দুরন্ত জীবনটা হঠাৎ থম্‌কে দাঁড়িয়ে পরায় আজকাল আর কোন কিছুতেই প্রভাবিত হয় না ও।  তবু আজ ওর কি হল ! শুয়ে শুয়ে সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আচম্‌কা শুভ্রকে দেখার প্রবল উন্মাদনা অনুভব করল মৌ ।  চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃষ্টি – ওর নীরব প্রেমের একমাত্র অবলম্বন।  কি অদ্ভুত এক অনুভূতি ! সেই উন্মাদনার তাণ্ডব আর অনুভূতির আবেশের কাছে হেরে গেল ওর সংযত অপ্রমত্ত মন – কি মূল্য আছে এই সংযমের ? না হলে ও নিজেও তো সেদিন ব্যাঙ্কে কথা বলতে পারত শুভ্রর সাথে বা মধুমিতার বাড়িতে ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞেস করতে পারত ওর কথা ! উত্তেজনায় চঞ্চল মৌ হাত বাড়িয়ে ফোনটা টেনে নিল – মধুমিতা নিশ্চয়ই জানে শুভ্র এখন কোথায় থাকে ! জীবনের এই শেষ বেলায় মৌ শুধু একবার ওকে দেখতে চায়, ওর চোখে চোখ রাখতে চায় ।  শরীর আচ্ছন্ন হয়ে এল মৌ এর, কোনরকমে পূবের জানালাটার পাশে আস্তে আস্তে বসল ও। অস্পষ্ট দৃষ্টি জানালা দিয়ে গেল রাস্তায় – আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা ! গত সপ্তাহেই মৌ জানতে পেরেছে যে ওর Laryngeal Cancer এখন একদম শেষ পর্যায়ে ।

আজও ওদের সেই নির্বাক প্রেমের একজনই সাক্ষী – পূবের জানালাটা।

Leave a Reply