সৌরাংশু সিংহ
আজকাল আমি বড়ই উদাসীন হয়ে যাচ্ছি । কোনো কিছুতেই উৎসাহ পাই না বিশেষ । আসলে আসে পাশে সব সময় ভাল কিছু হলে ভালোর জন্য আকাঙ্ক্ষাটা বোধহয় কমে যায় । সেই যেবার সুভাষ এসে আমায় প্রোপোজ করে, আমি তখন হেসে নির্লিপ্তের মতো বলেছিলাম, “তাহলে আমায় কি করতে হবে ? ভালো বাসতে হবে ? আচ্ছা, ঠিক আছে ! বাসলাম না হয় ”।
এভাবেই দেখতে দেখতে বছর চারেক কেটে গেছে । আমি বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে একটা ল ফার্মে ঢুকেছি । ভালই তো । সোনার টুকরো ছেলে সুভাষের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বাবা মা আপত্তি করেন নি, মন্দ কি ? কিন্তু তাও সব কিছুতে উৎসাহের কেন যে অভাব ? বাবা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে গেছেন, “মান্তু তুই খুশী তো ?” হেসে তাকিয়েছি, বাবা আমার মুখের দিকে খুব গভীর ভাবে দেখে, আলতো হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেছেন ।
বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি, অবশ্য ভালোবাসাটা রেসিপ্রোকাল বলেই বোধ হয় । মা আবার দাদা অন্ত প্রাণ, সব কিছুতেই ‘বাবি, বাবি আর বাবি ।’ ‘বাবি এই, বাবি সেই’, দাদাটাও এটা রেলিস করে, একের নম্বরের স্বার্থপর। কিন্তু কাকে বলছি ? আমিই বা কম কিসে ?
আসলে মানুষ হিসাবে সুভাষের জুড়ি নেই, সফল, অমায়িক, সুন্দর ভদ্র, কোনো নেশা নেই । কিন্তু কেন জানি না মনে হয় ম্যাদামারা… মানে আমি যা বলব তাই যদি শুনবে তাহলে আর পুরুষ হলো কোথা থেকে, কিন্তু সেফটি ফার্ষ্ট । অবশ্য সুভাষ দারুণ সিভালরাস । আমার খুব যত্ন টত্ন করে । বিয়ের পরে মনে হয় ভালই রাখবে । তবে সুভাষকে সবাই পছন্দ করে আমার বাড়িতে, দাদা ছাড়া । অবশ্য দাদার তো আমার কিছুই পছন্দ নয় ।
গত চার দিন ধরে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে আজ বেশ একটা থমথমে পরিবেশ হয়ে আছে । আজ ফার্মের থেকে ছুটি নিয়েছি, শরীরটা ভালো ছিল না, আগের দিন জ্বর হয়েছিল, এটাই কারণ । আসলে জাস্ট ভালো লাগে নি যেতে… এরকম আমার অনেক বার হয়ে থাক, মা বলে মুড সুইং, বাবা বলে এমনটা তো হতেই পারে, দাদাটা পাত্তা দেয় না বলে ঢং…
যাকগে বসে বসে একটা ফাইল দেখছি, নীচে হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে জানলা দিয়ে দেখলাম বাবাকে পাঁজাকোলা করে তুলে একটা লম্বা চওড়া ছেলে গেট ঠেলে ঢুকছে… ছুটে গেলাম নীচে ! কি হল বাবার ?
– কি হয়েছে বাবা ?
– কিছু না রে মান্তু একটু পড়ে গেছিলাম পা পিছলে… বাজারে অনেকটা কাদা হয়েছে…
মা হাঁউমাউ জুড়ে দিল, দাদাকে ডেকে পাঠালো, সে রাজপুত্তুর তখনো ঘুমচ্ছিল নাইট করে এসে । চোখ কচলাতে কচলাতে নীচে এসেই প্রথমে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “গায়ে একটা ঠিক ঠাক জামা দিয়ে আয় । কি হয়েছে?”
আমার তখন জ্ঞান শোনার অবস্থা নেই তাও স্লিভলেস নাইটিটা একটু উপরের দিকে তুলে নিয়ে বললাম, “দেখতে পাচ্ছিস না ? বাবা পড়ে গেছিল বাজারে !”
বাবাকে ততক্ষণে ছেলেটি সোফার উপর শুইয়ে দিয়েছে। আরো জনা ছয়েক লোক ড্রয়িং রুমে ভিড় করে আছে। বাবা হাত তুলে কিছু বলতে গেছিল, মা দাবড়ে উঠলো, “তুমি চুপ করে থাক তো! বুড়ো বয়সে আমার যত ঝামেলা । বাবি এখনি ডাক্তার কাকুকে খবর দে” ।
ছেলেটি বলে উঠল, “ডাক্তার দেখে তো বিশেষ লাভ হবে না, গোড়ালির হাড়টায় মনে হয় হাল্কা চিড় ধরেছে, আমি অলরেডি এম্বুলেন্সে খবর দিয়েছি, এসেই পড়বে । একটা হাফ প্লাসটার করাতে হবে, আর দিন দশেকের রেস্ট”। বাবা বলতে যাচ্ছিল কিছু, কিন্তু ছেলেটি বাবার দিকে কপট রাগ করে বলল, “ মেসোমশাই, আপনি শুয়ে থাকুন । যেমনটা বলেছি তেমনটা না করলে এই বয়সে আর সামলাতে পারবেন না কিন্তু…”
বাবা চুপ করে গেল, কিন্তু দাদা তেরিয়া হয়ে বলতে গেল, “তুমি কে হে ? ডাক্তার নাকি ?”
ছেলেটি মিষ্টি করে হেসে বলল, “হাতুড়ে বলতে পারেন। আমি স্পোর্টস মেডিসিন নিয়ে কাজ করি, গোদা বাংলায় ফিজিওথেরাপিস্ট। আপনারা আপনাদের ডাক্তার দেখাতে পারেন, তবে সিওর যে অন্য কিছু বলবে না” ছেলেটার একটা মিষ্টি অথচ ওভারওয়েল্মিং পার্সোনালিটি রয়েছে । নাহলে দাদাকে চুপ করিয়ে দিতে পারে ? তাও আমি চেষ্টা করলাম, দাদা থমকে গেল, আর আমি এই ফাঁকে নজর করলাম ছেলেটি বেশ সুপুরুষ, লম্বা, চওড়া কাঁধ, ঝাঁকড়া অবাধ্য চুল, । “কিন্তু স্পেশালিষ্ট দেখানোর দরকার তো আছে? নাকি? আপনি বললেন আর আমরা মেনে নেব?”
ছেলেটি চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো, কি গভীর চোখ! ধক করে যেন কি একটা গলার কাছে আটকে গেল । মিষ্টি করে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি খবর দিয়ে দিয়েছি তো ! ফর্টিসের এম্বুলেন্স এসেই যাবে । ডক্টর তুষার রায়কে ফোন করে দিয়েছি, নাম করা অর্থোপেডিক । উনি আছেন এখন এমার্জেন্সিতে । আপনারা চিন্তা করবেন না ।” আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম ।
এম্বুলেন্সটা এল তক্ষনি, বাবাকে নিয়ে যেতে । ছেলেটি দাদাকে নিয়ে গেল সঙ্গে । যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের আর আসতে হবে না, দাদা তো আসছেনই, আমি আছি, ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসবেন । বাই দ্য ওয়ে, আমি আকাশ, গলির মোড়ের মেসটায় থাকি, আপনি বোধ হয় ঝিলিক ? নাম শুনেছি আপনার… চিন্তা করবেন না ।” বলে একটু হেসে চলে গেল । দাদা ততক্ষণে টি শার্ট গলিয়ে নিয়েছে, আমাকে বলল, “মাকে দেখিস, আমি চলে আসছি এখনি বাবাকে নিয়ে, দাঁড়াও আকাশ ।” আমি বোধহয় কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। কে আকাশ ? কেন সে আমার নাম শুনেছে? তার পর মনেও রেখেছে ? দেখে নাকি আমাকে ? আমি কেন আকাশকে দেখি নি ? এতটাই কি উদাসীন হয়ে পরেছি আমি ?
দু হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে ক্রস করে ঢাকলাম যতটা সম্ভব । ওরা চলে গেল, আমি গেটের দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ…হঠাৎ আমার খুব লজ্জা পেল, নাইটিটা কি খুব রিভিলিং ?
ঘন্টা খানেক পরে ফিরে এল বাবাকে নিয়ে দাদা একা । ইতিমধ্যে সুভাষ এসে গেছে অফিস থেকে, খবর শুনে । এসেই শুরু করে দিয়েছে শ্বাশুড়ীকে পটানো, “আমাকে খবর দিলে এই সেই ওই তাই…”বাবা দাদার কাঁধে ভর দিয়ে ঢুকল । পায়ে প্লাস্টার । কানে যাচ্ছিল না কিছুই। “ভাগ্যে আকাশটা ছিল…” দাদাও দেখি খুব গদ গদ। সুভাষ এগিয়ে গেল বাবার দিকে, “কি যে করেন না বাবা, এই বুড়ো বয়সে এসব করতে যান! বাজার করার কি লোকের অভাব হয়েছে ? আমি আছি কি করতে ?” মা অমনি হবু জামাইকে আগলাতে শুরু করে দিলেন ।
দাদা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে খুব প্রশ্রয় মাখানো দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠল, “আকাশ এল না । বলেছে বিকেলে আসবে দেখতে বাবাকে!” আমার গালটা অজান্তেই লাল হয়ে উঠলো । বুকটা ধুকধুক করে উঠলো । আকাশ আসবে ? আকাশ আসবে আবার ? সামলে নিয়ে সুভাষকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি সন্ধ্যায় একবার ঘুরে যাবে ? আমি আজ অনেক দিন পরে মাছের কচুরী বানাবো…” তারপর হতভম্ব মুখগুলোর সামনে দিয়েই আমি উঠে চলে গেলাম উপরে, লজ্জা লাগছিল খুব…