Aheli Sarkar
———-
Aheli Sarkar
গার্গী রায় চৌধুরী
আজ সকালটা অনেক অন্যরকম, অন্তত পুপুর তাই মনে হল। ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই, স্কুলে যাবার তাড়া নেই। যেন বিশ্বাস হতে চায় না গতকালই আনুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সে এবার ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠবে। পরীক্ষা ভালই হয়েছে। আজ শুক্রবার, কাল সে মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে সাগর দ্বীপে। সঙ্গে কাকাই, কাম্মা আর পুটুশও যাচ্ছে। পুটুশ পুপুর খুড়তুতো বোন, সে ক্লাস টু এ পড়ে। পুপুর ছায়া সঙ্গী। আর পুপু যা যা করে তারও সেই সেই কাজ করা চাই। পুপুও এঞ্জয় করে তার কান্ড কারখানা, দরকার পড়লে শাসন করে কিন্তু পুটুশকে ছাড়া তারও চলে না।
সেদিনটা হুস করে কেটে গেল গোছগাছ করতে করতে। পুপু সবার আগে প্যাক করে নিল তার ফেলুদার বই তারপর মাকে গোছাতে সাহায্য করলো সারাদিন। রাতে মা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বললেন পুপুকে, কারণ পরের দিন খুব ভোরে উঠে যেতে হবে। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতে চাইছিল না পুপুর, চোখের সামনে যেন সাগর দ্বীপ। সে শুনেছে অনেক নদী এসে মিলেছে যেখানে সেটাই সাগর দ্বীপ। এর চারিদিক শুধু জল আর জল। আজ দুপুরে একবার ম্যপ খুলে জায়গাটা দেখেও নিয়েছে পুপু। ছোট্ট একটা বিন্দু। চারিদিকে জল, তার ভাবনা মানুষ সেখানে থাকে কি করে? জলে পড়ে যায় না? মনের মধ্যে এসব নানা কথা নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সময়ের নিয়মে ভোর হয়, গাড়ি এসে যায়, পুপুদের যাত্রাও শুরু হয়ে যায়। গাড়ি শহর কলকাতা ছাড়িয়ে ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। পুপু আর পুটুশ দুজনে বসেছে পাশাপাশি। পুটুশ পুপুর হাতটা ধরেই আছে সে গাড়িতে উঠে বসা থেকে। নানা রকম প্রশ্ন করে চলেছে পুপুকে,
“দিভাই আমরা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছি, না রে?”
পুপু হেসে বলে, “ না রে বোকা, সাগর দ্বীপে”।
পুটুশ পুপুর কাছে সবুজ দ্বীপের রাজার গল্প শুনেছে, তাই তার খালি মনে হচ্ছে তারা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছে। সে মানতে চায় না, বলে,
“জেঠু বলেছেন আমায়, আমরা সবুজ দ্বীপেই যাচ্ছি”।
বাবা হেসে উঠলেন ,
“কেন হবে না সবুজ দ্বীপ, যেখানে যাচ্ছি সেখানেও তো শুধু সবুজ আর সবুজ”।
পুপুরও মনে ধরে কথাটা। সঙ্গে একটা রোমাঞ্চও হয়। ২-৩ ঘণ্টা যাওয়ার পর তারা এসে দাঁড়ায় একটা বিশাল নদীর সামনে। তার একুল ওকুল দেখা যায় না। পুপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে, এত্ত বড় নদী সে আগে কখনো দেখেনি। তারপর লঞ্চে করে সেই নদী পার হয়ে সাগর দ্বীপে যখন তারা পৌছল ঘড়ির কাঁটা তখন ১টা ছুঁয়েছে। বাবা কাকাইকে বললেন,
“বুঝলি বাবুই, কলকাতা থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টা লাগলো”।
এখন মার্চ মাস, সূর্যের তেজ বেশ বেশী। কিন্তু হাওয়াও খুব। রোদের তেজ আর গরম গায়ে লাগে না। লঞ্চ ঘাটে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল পুপুদের গেস্ট হাউসে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা উঠে বসলো গাড়িতে। গাড়ি ছুটল সবুজ দ্বীপ দিয়ে। পুপুরা আজ আর কাল এখানে থেকে আবার পরশুই ফিরে যাবে কলকাতায়। বাবা, কাকাই, মা, সবার অফিস আছে, তাই বেশিদিন থাকা হবে না। বাবা বললেন,
“এখন গেস্ট হাউসে গিয়ে স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে হবে সবাই কে, পুপু, পুটুশ তোমরাও দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেবে না হলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে”।
পুপু- পুটুশ কারও এই কথাটা পছন্দ হল না, একটুও ক্লান্ত লাগছে না তাদের। কিন্তু বাবা বলেছেন, শুনতেই হবে।
সেই বিকেলটা সাগরের পারে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিল ওরা। পুপুরা পা ভেজালো জলে। গেস্ট হাউসটা প্রায় সাগরের পারেই বলা যায়, তাই গাড়িতে না উঠে হেঁটে হেঁটেই ঘুরে বেড়ালো ওরা। ঠিক হল কাল যাওয়া হবে এখানকার খুব বিখ্যাত এক মন্দিরে। এই দ্বীপে এসে সেখানে না গেলে, ঘুরতে আসাই নাকি বৃথা।
পরদিন সকালে স্নান সেরে সবাই গেল মন্দিরে। মন্দির দেখে তো পুপু তাজ্জব। বিশাল বড় তো বটেই, কত দর্শনার্থীর ভিড় সেখানে। মন্দিরের একপাশে আবার গেস্ট হাউসও আছে, দর্শনার্থীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। যদিও একটি ঘরও খালি নেই। বাবা বললেন,
“যেন একটা ইনডাস্ট্রি চলছে”।
এমন সময় একজন সন্ন্যাসী এসে তাদের পুজোর প্রসাদ দিয়ে গেলেন। মা কাম্মাকে বললেন, “অনেক বড় মন্দির, ভালো করে সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখি চল”।
বাবা আর কাকাই গেলেন, মন্দিরের বাইরের আশপাশ দেখতে, মা , কাম্মা, পুপু আর পুটুশ ঘুরে বেড়াতে লাগলো মন্দির চত্বরে। মা পুপুকে মন্দিরের গায়ে আঁকা দেবদেবীর মূর্তি চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, তাদের নিয়ে কথিত গল্প বলছিলেন, পুটুশ ঘুরছিল কাম্মার সাথে। হঠাৎ পুপু দেখল কাম্মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে তাদের দিকে আসছেন, এসে মা কে বললেন,
“দিদি পুটুশ কে দেখতে পাচ্ছি না”।
কাম্মার মুখ লাল, চোখে জল এসে গেছে। মা বললেন,
“কখন থেকে দেখতে পাচ্ছিস না?”
কাম্মা বললেন,
“আমার সঙ্গেই তো ছিল, এই এখুনি লক্ষ্য করলাম নেই, তারপর আসেপাশেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না”।
মা কাম্মা কে সঙ্গে নিয়ে মন্দির চত্বর খুঁজতে লাগলেন আর পুপুকে মন্দিরের পিছন দিকটা দেখিয়ে বললেন ,
“পুপু তুই ওই দিকটা একবার দেখে আয় তো”?
পুপু, মার কথা মতো সেই দিকে গিয়ে পুটুশ কে দেখতে পেল না, কিন্তু এপাশ অপাশ করার পর দেখলো দালানের এক পাশ ঘেষে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে, তার মনে হল পুটুশ ওখানে পড়ে যায়নি তো? পুপু আসতে আসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। গিয়ে দেখল ওটাও একটা ঠাকুর ঘর, সাদা পাথর দিয়ে বাঁধানো, খুব পরিষ্কার। বোঝাই যাচ্ছে এখানে লোক বেশী আসে না। ঘরটা এল-সেপের, পুপুর আর এগুতে সাহস হল না, সে পটুশের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। কয়েকবার ডাকার পর সে যখন ফিরে আসবে ভাবছে তখন দেখল এক সৌম্য কান্তি সন্ন্যাসীর হাত ধরে তার বোন এগিয়ে আসছে ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে। পুটুশের দু হাতে সন্দেশ। পুপুর ধড়ে প্রান এলো। সন্ন্যাসী বললেন,
ভয় নেই, ওকে আমি মন্দির ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম। প্রসাদ দিয়েছি, দাঁড়াও তোমাকেও দিচ্ছি”।
পুপুর দাঁড়ানোর সময় নেই, সে জানে মা-কাম্মা এতক্ষনে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে হয়ত বাবাদেরও খবর দিয়েছেন। সে সন্ন্যাসী ঠাকুর কে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,
“না এখন না, পরে এসে প্রসাদ নিয়ে যাব। মা আমাদের খুঁজছেন”।
সন্ন্যাসী হেসে বললেন, “আচ্ছা যাও”।
পুপু তার বোনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলল মা-বাবা দের সন্ধানে। মা-কাম্মা যথারীতি বাবা- কাকাই কে খবর পাঠিয়েছেন। তাঁরাও এসে গেছেন। পুপু গিয়ে সব কথা বলল তাঁদের, তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। কাকাই বললেন,
“ বললাম না, কিচ্ছু হবে না, এখানে এত লোক, এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান”।
কাম্মা পুটুশ কে একটু বকলেন একা একা না বলে যাওয়ার জন্য। পুটুশের মুখ কাঁদো কাঁদো, তার হাতের সন্দেশ হাতেই পড়ে রইল। বাবা বললেন,
“বেলা বেড়ে গেছে, চলো গেস্ট হাউসে ফিরে যাই”।
গেস্ট হাউসে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়ার শেষে হঠাৎ জ্বর এসে গেল পুটুশের। সে বেচারা ধমক খেয়ে একটু মন মরা হয়েই ছিল, ঠিক করে খেলোও না। তারপর এই জ্বর। দুপুর তিনটে নাগাদ দেখা গেল জ্বর বেড়ে ১০২ ডিগ্রি হয়েছে। বাবা বললেন,
“চলো আমরা আজই কলকাতায় ফিরে যাই”।
গাড়ি তো সঙ্গে ছিলই, পুপুরা সবাই বেড়িয়ে পড়ল কলকাতার দিকে।
কলকাতায় এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে পুটুশের জ্বর কমলো কিন্তু সেই মনমরা ভাব কমলো না। দুই বোনেরই পরীক্ষা শেষ, স্কুল ছুটি, তাই মা পুপুকে দুদিনের জন্য কাকাই এর বাড়ী থাকতে পাঠিয়ে দিলেন। পুটুশ খুব খুশি দিদিকে পেয়ে, দুজনে একসঙ্গে সারাক্ষন। দুপুরে পুটুশ জোর করে কাম্মাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিল দিভাই এর সাথে সিক্রেট শেয়ার করবে বলে। পুপু জানে এটা পুটুশের ছেলেমানুষী। সে পুপুর সঙ্গে একদম একা সময় কাটাবে বলে কাম্মাকে অন্য ঘরে যেতে বলছে। বিছানায় শুয়ে পুপুর গলা জড়িয়ে পুটুশ চুপ করে শুয়ে রইল, পুপু বলল,
“বলো তোমার সিক্রেট কি?”
বলে পুপু বোনের মুখটা তুলে ধরতেই দেখল, পুটুশের চোখে জল। পুপু উঠে বসে ওকে কোলে বসাল, বলল, “কি হয়েছে সোনা”?
পুটুশ বলল, “এটা রিয়েল স্টোরি দিভাই, তুমি কাউকে বোলো না, তাহলে তুমি, মা বাবা, জেঠু, জেম্মা সবাই আকাশের তারা হয়ে যাবে”।
পুপু বোঝে কোনও গোলমাল আছে, সে জোর দিয়ে পুটুশকে বোঝায় কারও কিচ্ছু হবে না। পুটুশ বলে সাগর দ্বীপের মন্দিরে সেই সিঁড়ির তলার কথা, সেখানে ওই সন্ন্যাসী পুটুশকে নিয়ে গিয়ে তার শরীরের গোপন জায়গায় হাত দিয়েছেন, পুটুশকে ভয় দেখিয়েছেন, বলেছেন, একথা কাউকে জানালে উনি ঠাকুর কে বলে তাদের আকাশের তারা করে দেবেন। পুটুশ বলে চলে,
“দিভাই সন্ন্যাসী আমার সিক্রেট প্লেসে হাত দিয়েছেন। আমার খুব ব্যথা লেগেছে”।
পুপু বড় হয়েছে, সে জানে এই কাজ কত বড় অন্যায়, মা বার বার তাকে বলে দিয়েছেন শরীরের সিক্রেট প্লেসে কেউ হাত দিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা কে বলতে হয়, যাতে ওই দুষ্টু লোকটি শাস্তি পায় আর অন্য কারও সাথে ওই একই কাজ করতে সাহস না পায়। পুটুশ ছোট, তাকে হয়তো কাম্মা এসব কথা কখনো বলেননি। তাই বেচারা জানেই না। পুপু চোখে জল এসে গেল, দুঃখে নয় রাগে। তার মনে হতে লাগলো লোকটার এত বড় সাহস যে সে বাবা-মা , কাকা-কাম্মা, পুপু সবার প্রেজেন্সকে উপেক্ষা করে ছোট্ট পুটুশের গায়ে হাত দিল, আর তারা কেউ কিচ্ছু করতে পারল না। লোকটা এখনও ওখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আরও কত বাচ্চার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছে কে জানে? পুপু বুঝতে পারে এই লোকটিকে শাস্তি না দিলে পুটুশের চোখের দিকে তাকাতে পারবে না সে। সে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুই কি বোকা পুটুশ, তুই তো জানিস লোকটা দুষ্টু লোক, ভালো লোক কি সিক্রেট প্লেসে হাত দিয়ে ব্যথা দেয়? আর দুষ্টু লোক দের কথা কি কখনো ভগবান শোনেন? ও তোকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে। তুই তখনই বললে আমরা সঙ্গে সঙ্গে লোক টাকে ধরতে পারতাম। যাক গে, এখনও ধরব লোক টাকে আর শাস্তিও পেতে হবে ওকে আমার ছোট্ট বোন টাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য”।
পটুশ বলে, “তুমি সত্যি বলছো দিভাই? তোমরা কেউ আকাশের তারা হয়ে যাবে না তো?”
পুপু বলে, “দূর বোকা, তোর দিভাই কি তোকে কখনো মিথ্যে বলে?”
পুটুশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
সন্ধ্যেবেলা সবাই অফিস থেকে ফিরলে পুপু, মা-বাবা, কাকা-কাম্মা কে একজায়গায় বসিয়ে গোটা ঘটনাটা বলে। বাবা বলেন,
“যেহেতু ঘটনার সময় লোকটিকে ধরা যায়নি তাই এখন তাকে দিয়ে স্বীকার করানো যাবে না”।
পুপু বলে, “আমি লোকটিকে চিনি, আমি যদি ওর কাছে যাই, ও আমার সঙ্গেও একই রকম কাজ করার চেষ্টা করতে পারে, তোমরা পুলিশ নিয়ে আশেপাশে থাকবে, আর ঠিক সময়ে লোকটিকে ধরবে”।
বাবা বললেন, “সাবাশ, এই তো চাই, ভীষণ ভালো আইডিয়া”।
কাকা আর মা একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন, কিন্তু বাবা যখন বললেন, “কোনও রিস্ক নেই, আমরা তো থাকব ওখানে”, তখন ওরা রাজি হলেন।
এরপর বাবা তার এক বন্ধু মারফত সাগর দ্বীপের লোকাল থানায় যোগাযোগ করলেন, ঠিক হল পরের দিন বাবা, কাকাই, পুপু যাবে সাগর দ্বীপে, তবে এবার আর বেড়াতে নয়, একজন অপরাধীকে শাস্তি দিতে।
পাঁচ ঘণ্টার পথ যেন কাটতে চায় না। নদী পার করে সাগর দ্বীপে পৌঁছতে পুপুরা দেখল একজন পুলিশ অফিসার ও চারজন পুলিশ কাকু সিভিল ড্রেসে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। সবাই মিলে যাওয়া হল মন্দিরে, মন্দিরের বাইরে একটু দূরে গাড়ি রেখে সবাই হেঁটে গেলেন মন্দিরের মধ্যে। গাড়িতে আসতে আসতে পুলিশের মুখে পুপু শুনেছে খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে, অপরাধী টের পেয়ে গেলে পালিয়ে যাবে, তখন তাকে ধরা মুশকিল, তারপর পুপুকে আইডেন্টিফাই করতে হবে অপরাধী , পুলিশ তো জানেই না কে সেই লোক। তাছাড়া লোকটি মন্দিরের পুরোহিত, তাই কোনও প্রমাণ ছাড়া তাকে ধরাও সম্ভব হবে না। পুপু বুঝতে পারল ব্যাপারটা সহজ নয়, বুদ্ধি করে লোকটিকে ধরিয়ে দিতে হবে তাকেই।
মন্দিরে ঢুকে পুলিশ অফিসার, একজন পুলিশ ও বাবা গেলেন হেড সন্ন্যাসীদের ঘরে তাদের সঙ্গে কথা বলতে। পুপু একা মন্দির চত্বরে উঠে মন্দির দেখার ভান করে খুঁজতে লাগলো সন্ন্যাসীটিকে, কাকাই আর অন্য দুজন সাধারন পোশাকের পুলিশ দূর থেকে নজরে রাখতে লাগলো পুপুর উপর। পুপুর বুকের মধ্যের ধুক পুক আওয়াজ টা তখন দ্রাম দ্রাম করে বাজছে, সে লক্ষ্য করলো তার হাত পাও কাঁপছে। মুখটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে মন্দিরের এঘর ওঘর ঘুরতে লাগলো, তার ভয় হতে লাগলো যদি সে লোকটিকে খুঁজে না পায় তাহলে পুটুশের অপরাধীকে আর ধরা যাবে না। সে ভালো লোকদের মধ্যে মিশে থেকে মানুষের ক্ষতি করে বেড়াবে। এসব ভাবতে ভাবতে পুপু দেখল আরতি হচ্ছে আর লোকটি, হ্যাঁ সেই লোকটিই আরতির সঙ্গে কাঁশর ঘণ্টা বাজাচ্ছে। পুপুর মন শান্ত হল। অনেক লোক দাঁড়িয়ে আরতি দেখছে, পুপুও তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, এমন জায়গায় দাঁড়াল যাতে লোকটি তাকে স্পষ্ট দেখতে পায়। তারপর সুযোগ বুঝে ঘাড় ঘুড়িয়ে কাকাইকে ইশারা করে লোকটিকে চিনিয়ে দিল। আরতি চলাকালীনই লোকটির সঙ্গে চোখাচোখি হল পুপুর। সে মৃদু হাসল লোকটিকে দেখে, লোকটিও হাসল। তারপর আরতি শেষ হলে পুপুর কাছে এসে বলল,
“কি দুদিন আসনি যে তোমরা?”
পুপু বলল, “সাগরের দিকে ছিলাম তাই আসা হয়নি”।
লোকটি বলল, “কতদিন আছো”?
পুপু বলল, “কালই চলে যাব”।
সন্ন্যাসী বেশী লোকটি বলল, “বোন কোথায়?”
পুপু বলল, “ও মায়েদের দের সাথে বাইরে আছে”।
লোকটি পুপুর চিবুকে হাত রেখে বলল,”তুমি প্রসাদ নেবে?”
পুপু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, আর লোকটি এসো, বলে পুপুকে নিয়ে চলল ওই সিঁড়ির নিচের ঘরের দিকে। পুপু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল, সে জানে তার কোন ক্ষতি হবে না ফেলুদা তার সহায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে লোকটির সাথে ঘরের ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল পুপু, এল শেপের আড়ালে গিয়েই লোক টি পুপু কে কাছে টেনে নিল, পুপু চিৎকার করে উঠল “কাকাই…”
কোনও আওয়াজ এলো না ওপাশ থেকে, লোকটি বলল,
“তোমার কাকাই তো এখানে নেই, আমি আছি শুধু, কোনও ভয় নেই,”
বলে লোকটি পুপুর সিক্রেট প্লেসে হাত দিতে গেল। আর ঠিক তখনি, কাকাই আর দুজন পুলিশ এসে লোকটিকে চেপে ধরল আর ধুমাদুম করে রদ্দা কষাতে লাগলো তার ঘাড়ে। এরপর লোকটিকে বাইরে বের করে আনা হল, গ্রেপ্তার করা হল সবার সামনে। পুলিশ অফিসার কাকু পুপুকে স্যালুট করলেন, তারপর অনেক আদর করলেন। বাবা আর কাকাই তো পুপুর সাহসে মুগ্ধ, গর্বিত। পুপু শুধু ভক্তিভরে মনে মনে তার ইষ্টদেবতা ফেলুদাকে প্রণাম করতে লাগলো।
Illustration by Aditi Chakraborty
Prateek Dhar
Robert Rodney went to church on Sundays. He had a perfect Caucasian accent; was very polite, had none but two enemies, David and Daniel. He was a well-built, muscular boy. He got ‘A’s in every test, was respectful to his parents and teachers, and very good in tennis. He wanted to be a bio-engineer when he grew up and looked like Ronald Weasley from the movies.
You would think he is the perfect boy, would you not?
WRONG.
His parents tried to cover up the fact that he still continued to wet the bed even when he was twelve. Every night.
Only one dude knew about his unusual habit. He was Mitchell. Mitchell was the most awesome dude that ever lived. He always wore a blue Aviator jacket, cool shades, and never left home without his smartphone. He was of a short stature, very athletic, and a gamer like Robert.
One fine day, Robert and Mitchell were texting.
Robert: Hey yo, what’s up?
Mitchell: Dude, nothing.
Robert: Did you murder anyone yet?
Mitchell: What?
Mitchell: I am not your friend any more!
Robert: But why not?
Mitchell: You think I am a murderer?? I think I should tell David and Daniel about your habit.
Robert: NO! I SWEAR THAT WAS AUTOCORRECT. I SWEAR I MEANT TO WRITE SOMETHING ELSE.
Mitchell: Oh! was it autocorrect? Sorry….
Robert: I hate you.
Mitchell: I will text them saying it was a lie…
Mitchell: Wait, you hate me? I hate you too!
Don’t you feel awesome and happy right now after reading that text? Does it not remind you of cherries in the spring? Don’t you…
Fine, enough sarcasm for a day.
Robert kept on texting Mitchell that he did not mean what he said, but Mitchell did not budge. He knew Daniel Andrew and David Clarkson were the biggest gossipers of the school. His perfect reputation was going to be ruined because of his ex-best friend.
He screamed at the top of his lungs
“I HATE MY LIFE”
(Echo phenomenon occurs).
His parents rushed to his room. “What is wrong with you?” They asked. After maybe, like 7 seconds of persuasion Robert confessed the entire tale .
He said: ”Mom, Dad. I have always respected you. Mitchell Jeffrey, my best friend, has told Daniel Andrew and David Clarkson about my ’embarrassing habit’ due to a serious miscommunication. Will you help me?”
Mrs Rodney asked “What is Mitchell’s Number?”
“22661279”, replied Robert .
(Mrs. Rodney dialled the number.)
Mrs Rodney: “Hello, who is this?”
Mitchell: “The Jeffrey Residence.”
Mrs Rodney: “May I speak to Mitchell?”
Mitchell : “Yes. This is Mitchell. Who is this?”
Mrs Rodney: “Ok, this is Robert’s mother and how dare you do such a thing to him!”
Mitchell: “It was not intended…”
Mrs Rodney: “Come to my house this instant!”
Mitchell: Sure. “I will be there in 3 mins.”
(Call disconnected).
Mrs Rodney muttered some curses towards the Jeffreys. Meanwhile, Mitchell could not believe his ex-best friend was a complaint box (he was already a bed-wetter).This would seriously reduce his popularity ratings.
DING-DONG!
Mrs Rodney opened the door.
Mitchell: “Hello, Mrs. Rodney, Mr. Rodney, Robert.”
Mrs Rodney (coldly): “Hello.”
Mitchell: “I have got homework to do today. I do not have time. I will make a deal. Do you want to hear it, Robert Rodney?”
Robert: “I sure do.”
Mitchell: “If you do not wet your bed for a week continuously, I will go and tell David and Daniel that I was simply joking. Finally, we will conduct a test on you. David, Daniel, you and I will have a sleepover. We will watch a horror film. I will not stop David and Daniel from teasing you if you wet the bed.”
(Mitchell left the house.)
Mr Rodney said: “Son, you should accept Mitchell’s challenge.”
Mrs Rodney agreed “I think so too. We will make you go to the bathroom before sleeping and make you watch more horror fims.”
Robert asked “Why are you betraying me?”
Mr. Rodney replied “You need to be brave, braver than what you are now.”
A week later it was the time for the sleepover.
The film chosen was ‘Evil Dead’. It had been one of his training films. While everyone else was shivering over the horror scenes, Robert, like a tough man was making jokes on how terrible the acting was.
Midnight; it was finally time for lights out.
Robert’s bed was dry the next morning.
Mitchell congratulated him and asked him if they could be best friends again.
Robert replied: “Yes!!”
He asked David and Daniel if they would now consider not teasing him.
They replied “No. It does not make up for good gossip.”
Robert Rodney was sure there was a law against murdering people in a sleepover. So he asked Mitchell to cool it .
When Robert went home he reported to Mr Rodney about his success.
Mr Rodney was delighted and gave Robert 5000 bucks to spend.
Robert gave 2000 bucks to Mitchell.
They went to the nearby weapon store.
Robert bought an MSMC gun and a bulletproof jacket while Mitchell bought a Remington 870 MS. (They obviously wore fake beards that made them look like adults and printed the licences at home).
The next day Robert and Mitchell walked into school with their weapons.. Whoever insulted Robert was in the coffin within an hour.
TRULY, ROBERT RODNEY HAD TRANSFORMED.
পিয়ালী চক্রবর্ত্তী
‘দিয়ে জ্বলতে হ্যায়, লোগ মিলতে হ্যায়, বড়ি মুশকিলসে মগর দুনিয়ামে দোস্ত মিলতে হ্যায়’
রবিবারের সকাল আটটায় এফ.এম চিত্কার করে চলেছে, ঘুমের এইসি কি ত্যায়সি, আমার শাশুড়িকে কিছুই বলা যাবে না, এই যদি গানটা ‘আনারকলি ডিস্কো চলি’ হত, রেডিওর গলা নিজেই টিপে দিতেন, কিন্তু এই গান যে সেই সত্তরের, রাজেশ খান্না, এই কদিন আগে টিভিতে যার অন্তিম সংস্কার দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। আহারে. যাকগে, আড়মোড়া ভেঙ্গে ভাবলাম, দোস্ত কেন, পয়সা-কড়ি, সুখ-শান্তি, এমনকি এই ছুটির দিনে ঘুমটুকুই কত মুশকিলে মেলে।
‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’, আজ নাকি ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’, তাই সেন্টিমেন্টে এত ঝাঁকুনি সকাল সকাল। তাই বল, আমার বরের মোবাইলে সক্কাল সক্কাল ঝাঁকুনি, লন্ডন থেকে এসেছে অনুব্রত, বরের বন্ধু, তা ফ্রেন্ডশিপ ডে’র ইস শুভ অফসর মে, সে নাকি গুটিকয় বন্ধু, বন্ধুপত্নী আর তাদের ট্যাঁ-ভ্যাঁদের লাঞ্চে ডেকেছে. শুনে শাশুরিও খুশি হয়ে বললেন, “ও তা তোরা যা, আমি তবে দিদির বাড়ি যাই”। অনুব্রতকে দেখার আনন্দে নাকি কে জানে, বর আমার জলখাবারে মুড়িমাখা খেতে রাজি হলো, ছেলেও হলো। লাঞ্চ বানানোর তাড়া নেই, বেরোতে দেরী আছে, আমি আলমারি খুললাম খোশ মেজাজে, অনুব্রত যে আমার কত উপকার করলো, সে কি নিজেও জানে?
আজ হঠাত কলেজ জীবনের একটা শাড়ি পরার শখ হলো, এর সাথে বেশ মানাবে পোড়ামাটির কানের দুল আর হার, আছে পাশের ড্রয়ারে, পুরনো কিছু বই-খাতার সাথে। পুরনো গয়না. ড্রয়ার খুলতেই পুরনো গন্ধ, ভীষণ বিপজ্জনক। সব কাজ ভুলিয়ে দেয়,এফ.এমের মত সেন্টিমেন্টে প্রবল ঝাঁকুনি দেয়,দুঃখ হয় একগাদা,আমি এই ড্রয়ারটা তাই খুব দরকার না পড়লে খুলি না। আজ কি যেন এক ঘোরের মধ্যে খুললাম ড্রয়ারটা,পুরনো গয়নাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতেই পাশে সেইসব পুরনো ডায়েরি,স্কুলজীবনে ডায়েরি লিখতে শুরু করেছিলাম,বিয়ের পর ছেড়ে দিয়েছি।
আমি মনে করি ডায়েরি লেখা ভালো না, সেই পুরনো গন্ধটার মত বিপজ্জনক,যা আর ফিরে পাওয়া যাবেনা,সেগুলোকে কালি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে হয়না। ডায়েরি মানুষকে পিছন দিকে টানে, ভুলতে চাওয়া সাল,তারিখ,দিন কিছুতেই ভুলতে দেয়না। এই যেমন আবার ঘোরের মধ্যে আমি হাতে তুলে নিলাম,স্কুলজীবনের ডায়েরি, ‘আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি’।
আজ স্কুলে প্রথম দিন শাড়ি পরে গেলাম। প্রথমে কেমন বাজে লাগছিল, জোরে জোরে হাঁটা যায়না। খালি মনে হয় এই বুঝি শাড়ি খুলে গেল. শাড়ি পরে ঘর থেকে বেরোতেই বাড়িশুদ্ধু লোক হ্যা হ্যা করে হাসলো। রিকুদাদা বলেছে আমায় নাকি বিচ্ছিরি লাগছে , ও নিজে যেন কত সুন্দর। জেঠিমা বলেছে, ‘রিঙ্কু তুই খুব সুন্দর লাগছিস, আমার ছেলেটা পাজি, ওর কথা শুনবিনা’। আমি নাইন’এ’ সেকশনে রয়েছি, সোমরিতা এবার ‘বি’ তে। বাঁচা গেল, এক নম্বরের হিংসুটে একটা। ইস, সবাইকে কি আলাদা লাগছে স্কুলে। সায়নি কে একদম পুতুল পুতুল লাগছে, মধুরিমাকেও, শ্রাবন্তী মুখ গোমড়া করে আছে,ওর বয়েজ কাট চুলের সাথে নাকি একটুও মানাচ্ছে না শাড়ি। আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি। শর্র্মিষ্ঠা আবার চোখে কাজল পরেছে, সব সময় স্টাইল। দীপশ্রী ফার্র্স্ট বেঞ্চে আমার জন্য জায়গা রেখেছিল, রোজ রাখবে বলেছে। আমি আজ একটা মিথ্যে কথা বলে এসেছি মাকে। বলেছি অভিজিত স্যার আজ তাড়াতাড়ি ইংলিশ টিউশন পড়াবে তাই স্কুল থেকে আমরা সোজা টিউশনে যাব। আমি বাড়ি গিয়ে চেঞ্জ করে টিউশনে যাই, কিন্তু,আজ,আজ প্রথম দিন শাড়ি পরেছি না, সুতীর্থ আগের দিন বলেছে আজ স্কুল ড্রেসেই আসতে, আমায় দেখবে। দীপশ্রী জানে, তাই আমি স্কুলের পর দীপশ্রীর বাড়ি গেলাম. ওর বাবা-মা চাকরি করে, ঐসময় কেউ থাকবে না। ওখান থেকে আমি আর দীপশ্রী একসাথে পড়তে গেলাম।
সুতীর্থ যথারীতি দেরিতে এলো,তাও ভালো আজ আমার উল্টোদিকের বেঞ্চটা খালি ছিল। এমনভাব করলো যেন আমায় দেখতে পায়নি,আমি জানি আড়ে আড়ে দেখেছে। টেবিলের তলা দিয়ে দু-তিনবার পায়ের ঠোকাঠুকি হলো, চাইল না। ইস একবারও আমায় সামনাসামনি দেখল না।
সন্দীপ, অয়ন, দীপশ্রী, সুতীর্থ, আমি, কৃষ্ণেন্দু, এতজনে একসাথে বেরোলাম। কেমন লাগছে আমাকে? জিজ্ঞেস করতেই পারছিনা. এইবার আমার রাস্তা চেঞ্জ হবে. মোড়ের মাথায় আমাদের শেষবারের আড্ডা, অয়নটা, এক নম্বরের ক্যাবলাকান্ত, আমায় দেখে বলল ‘তোকে কেমন লেডি লেডি লাগছে, ভালো লাগছে না’। বেশ হয়েছে, মনে মনে বললাম ‘কে শুনতে চেয়েছে তোর কাছে?’
সন্দীপ কাল ওদের পাশের বাড়ির মেয়েটাকে লাভ লেটার দেবে, সেটা পড়ে শোনাচ্ছিল, সকলে ওকে ঘিরে ধরল, সেই ফাঁকে আমি সুতীর্থকে একটু টেনে এনে জিজ্ঞেস করলাম. কেমন লাগছে বললি না তো?
ওদের চিঠি পড়া শেষ, সবাই বাড়ির দিকে হাঁটা দিল, সুতীর্থও, আমার কান মাথা গরম হয়ে গেছে, যেন আগুন বেরোচ্ছে, কেমন লজ্জা করছে, ইস সুতীর্থটা খুব বদমাশ. সবসময় এমন বলে. বাড়িতে এসে আজ দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরে চেয়ারের এদিক ওদিক টপকেছি, কেমন করে দেখেছে সুতীর্থ আমাকে?
এখন আমি আমার বরের বন্ধু অনুব্রতর ওপর যতটাই খুশি সে ততটাই রেগে যাবে আমাদের ওপর, কারণ এ ডায়েরি পুরোটা পড়তে বসলে, আজ আর লাঞ্চে যাওয়ার টাইম হবে না. কয়েকটা পাতা ছেড়ে দিলাম।
আজ সকালে বায়োলজি টিউশনটা খুব বাজে গেল. আমরা কয়েকজন যারা মাধ্যমিকে অ্যাডিশনাল বায়োলজি নিয়েছি, তাদের সবাইকে গৌরবদা মানুষের জননতন্ত্র পড়াতে শুরু করলেন। ছি, এইগুলো ছেলে আর মেয়েদের আলাদা করে ক্লাস নেওয়া উচিত। ঋতুচক্র মানে মেন্সট্রুয়েশন সাইকেল মানে, কিসব বলে যাচ্ছিল গৌরবদা আর অনিন্দ্যর মত অসভ্য ছেলে আর হয়না, ও ঠিক এই জায়গাটাই বুঝতে পারছিল না। বার বার ‘গৌরবদা আর একবার বলবে?’ সুতীর্থ, অয়ন আর সন্দীপ মুখ চিপে হেসেই যাচ্ছে. আমি আর দীপশ্রী খাতা থেকে মুখ তুলতেই পারছিলাম না। সুতীর্থ কদিন আগে আমার কাছ থেকে এই ব্যাপারটা আবার ভালোভাবে জেনেছে. ও নিশ্চই সন্দীপ আর অয়নকে বলেছে।
টিফিনের সময় সুজাতা আমাদের কয়েকজনকে বলল সব। ওর দিদি ওকে বলেছে ‘সহবাস’ মানে কি? খুবই বাজে ব্যাপার। যদিও আমার ডায়েরি কেউ পড়বে না, তবুও আমি এখানে লিখতে পারছি না।
আমার ছেলে এফ.এমটা চালিয়েছে আবার. গান হচ্ছে ‘পুরানী জিন্স, অর গিটার’ আমি এতক্ষণ আলমারির সামনে মেঝেতে বসেই পড়ছিলাম, আরাম করে ব্যালকনিতে এসে বসলাম. আজ হয়েছে আমার লাঞ্চে যাওয়া।
বেলাদির খুব বাজে স্বভাব। পড়া ধরে নিজেই গরগর করে উত্তর দিতে থাকেন। আরে পড়া ধরছে তো নাকি? আজ মৌমিতাকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের জলবায়ু বলতে বলে নিজেই বলে যাচ্ছে. মৌমিতা এক ধমক দিয়েছে, ‘আঃ আপনি বলতে দেন না কেন বলুন তো? চুপ করুন না আমি বলছি তো।’ এরপর বেলাদির মুখটা যা হয়েছিল না, হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাচ্ছিলাম। তার ওপর কনিকাদি আজ আগে আগে যাচ্ছিলেন. আমি পিছন পিছন যেত যেতে দীপশ্রীকে বলছিলাম ‘ওই দেখ শাখাঁলু’, আর হাসছিলাম। কনিকাদি হঠাত পিছন ফিরে বললেন, ‘এই কে রে শাখাঁলু’? আমরা তো কেউ না কেউ না বলে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দার উঠতে লাগলাম, আধা সিঁড়ি উঠে যখন কনিকাদি আর আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, দীপশ্রীটা এত পাজি, আস্তে করে বলে কিনা ‘জানো না তুমি তো’, আর আমাদের কি হাসি।
কনিকাদির মুখটা মনে পরে গেল,শাখাঁলু,নামটা ভালই দিয়েছিলাম। না রেখে দি ডায়েরিটা, ধীরে ধীরে পাতা ওল্টাচ্ছি, একটা পাতায় চোখ আটকে গেল
সুতীর্থ আজকাল আমায় খুব অ্যাভয়েড করছে। আমি কি খুব সাদামাটা, বাংলা মিডিয়ামে সরকারী স্কুলে পড়ি বলে? আর ওই নতুন মেয়েটা ‘অর্র্চিতা’ ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, চুলে স্টেপস কাটা, ভুরু প্লাক করা, হাতে পায়ে ওয়াক্সিং করা, তাইতে এত ভালো লেগে গেল সুতীর্থর? দুদিন আসতে পারিনি বলে আজ খাতা চাইলাম, বলল ‘তুই অয়ন বা সন্দীপের থেকে নে না, আমার কাছ থেকে অর্র্চিতা নেবে’। গা জ্বলে যায় শুনলে। মানছি ইংলিশে ও অনেক ভালো। আমি কি খারাপ, শুধু ফটফট করে বলতে পারিনা বলে? আজ সত্যি সত্যি অভিজিত স্যার তাড়াতাড়ি পড়িয়েছে, তাই স্কুল থেকে সোজা পড়তে গেলাম, আজ সুতীর্থর উল্টো দিকে বসেছিলাম, আজ বেঞ্চ টপকেছি। সুতীর্থ কেমন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে. আমার খুব কান্না পাচ্ছে। বাড়ি এসে দেখি কারেন্ট নেই আর মা, বাবা, জেঠু, জেঠিমা কেউ নেই। সবাই পিসির বাড়ি গেছে কি দরকারে। রিকুদাদা একা। রিকুদাদার ঘরে আমার ঢুকতে ইচ্ছা করেনা। কদিন আগে ওর বালিশের তলায় একটা খুব নোংরা মলাটের বই দেখেছি। ইস এইসব পড়ে আজকাল রিকুদাদা? আমাকে জিজ্ঞেস করছিল হ্যারিকেন জ্বেলে দেবে কিনা, আমি বললাম ‘না ছাদে যাচ্ছি’। মনটা খারাপ ছিল, কিছুক্ষণ বাদে দেখি রিকুদাদা উঠে এলো ছাদে।
রিকুদাদা হাত দিয়ে আমার কোমরটা জড়িয়ে ধরেছে, শক লাগার মত চমকে উঠলাম, ঠিক ব্লাউজের আর শাড়ির মাঝের ওখানে রিকুদাদার হাত, আঙ্গুলগুলো কোমরের ওপর সরগম বাজাচ্ছে। আমার গা ঘিন ঘিন করছে, বমি পাচ্ছে, এক ধাক্কায় হাতটা সরিয়ে দিলাম।
কি জানি একটা অদ্ভুত জোর এসেছিল গলায়,’না’ বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল, রিকুদাদা কেমন ছিটকে চলে গেল নিচে। আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আচ্ছা কয়েকবছর আগেও তো রিকুদাদাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতাম, আজ হঠাত গা ঘিনঘিন করলো কেন?
এইজন্য ডায়েরি লিখতে নেই আর পড়তে নেই। কিছুতেই ভুলতে দেয়না সেই সাল, তারিখ, দিনগুলো…
অর্র্চিতা এখন অন্য ব্যাচে পরে, সেই কারণে নানা অজুহাত দেখিয়ে সুতীর্থ ব্যাচ চেঞ্জ করেছে, নতুন ব্যাচের জন্য কেমিস্ট্রি পড়াও চেঞ্জ করেছে. মাধ্যমিক দেবার পর থেকে সুতীর্থ আমায় আর চিনতেই পারেনা। আমরা এখন কো-এড স্কুলে পড়ি, একসাথে । সায়েন্সে, কিন্তু ও যেন কেমন হয়ে গেল। দীপশ্রীর নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে, জয়দীপ। ও আজকাল ওকে নিয়েই ব্যস্ত। মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত, আমি নাকি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি খুব। আজ আমার বাংলা খাতাটা টেবিলের ওপর পড়েছিল, মা দেখছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। খাতার পিছনে লেখা ছিল সু + অনি, মা আমার দিকে তাকালো, কিছু বলল না। আজ বিকেলে গেলাম দীপশ্রীকে ডাকতে, গ্রুপ স্টাডিজ করব বলে ওকে আমি ডেকে নিয়ে আসি, আসলে ও জয়দীপের সাথে দেখা করে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি একটু দূরে, একা একা। আমি এইসময় খুব খুব মিস করি সুতীর্থকে।
সুতীর্থ আমার সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে, আমি পারছিনা, সত্যি পারছিনা। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না। ও আমার। অর্চিতা ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতেই পারেনা। যে করে হোক ওর সাথে কথা বলতে হবে। দীপশ্রী আর আমি মিলে প্ল্যান করেছি যে দীপশ্রীর জন্মদিনে এবার শুধু অয়নকে আমরা খাওয়াতে নিয়ে যাব। সুতীর্থর ব্যাপারটা জানতে হবে, অয়ন জানে সবকিছু, শুনেছি ও নাকি সুতীর্থ, অর্চিতার মধ্যে চিঠি চালাচালি করে।
অয়নটা সত্যি ক্যাবলা, দীপশ্রী যেই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলল, “তুই তো আমাদের একমাত্র ভাল বন্ধু, আর তো কেউ বিশেষ কথা বলেনা, তাই ভাবলাম শুধু তোকেই নেমন্তন্ন করি”। ব্যস গদগদ হয়ে গেল একেবারে। মোগলাই খাওয়াতে খাওয়াতে শুনলাম পুরো ব্যাপারটা। অর্চিতা আর সুতীর্থ সাঙ্ঘাতিক প্রেম করছে। অর্চিতার বাবা খুব স্ট্রিক্ট, কিন্তু অয়নকে চেনেন আর নাকি খুব ভালবাসেন। অয়ন ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। ওদের বাড়ি অয়ন প্রায়ই যায়। তাই সুতীর্থ চিঠিপত্তর সব অয়নের হাত দিয়েই পাঠায়। অয়ন খুব গর্ব করে বলল যে ও ছাড়া নাকি এই অ্যাফেয়ারটা হতেই পারত না। আমার শুনতে শুনতে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
আচ্ছা এমন হতে পারেনা? সুতীর্থ খুব বিপদে পড়ল, আমি ওকে বাঁচালাম, ও আমার হয়ে গেল। নাহলে অর্চিতা ওকে ছেড়ে দিল, ও বুঝতে পারল, এ পৃথিবীতে একা আমিই ওকে ভালবাসি। ও আমার কাছে ফিরে এল। না একবার, একবার অন্তত ওর সাথে কথা বলতে হবে। ওকে কি একটা চিঠি লিখব?
আজ মায়ের ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা চুরি গেছে। বাবা বলছে “তুমি হারিয়ে ফেলেছ”। মা মানছে না, বলছে বিকেল অব্দি নাকি ওটা মায়ের পার্সেই ছিল। সন্ধ্যেবেলা থেকে পাচ্ছে না। আমার পরিস্কার মনে পড়ছে, আমি যখন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকছিলাম, রিকুদাদা তখন আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঘরে কেউ ছিলনা। মা জিজ্ঞেস করল
উফ, নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। মা আমায় এরম বলল কেন? কিন্তু রিকুদাদা বাজে সত্যি বাজে ছেলে, আমি একদিন প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব। আজ ভাল করে পড়েছি, না না ভাল রেজাল্ট করতেই হবে।
আজ সন্ধ্যেবেলা আবার কারেন্ট অফ হয়ে গেছিল, বাড়িতে কেউ নেই রিকুদাদা ছাড়া। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছিল। কিন্তু না, শয়তানটা এঘরে আসেনি। আজ সুতীর্থকে চিঠি লিখেছি। একবার অন্তত দেখা করার জন্য। কাল দীপশ্রী দিয়ে দেবে স্কুলে। ইস চিঠিটাকে টেবিলের ওপর রেখে বাথরুমে চলে গেছিলাম, এসে দেখলাম রিকুদাদা ঘরের মধ্যে, বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল।
রিকুদাদা নিজের ঘরে চলে গেল। চিঠিটা তো ঠিক জায়গাতেই আছে, ভাঁজ করা। শয়তানটা পড়েনি তো?
সুতীর্থ আমায় ডেকেছিল ওর বাড়িতে। আইডিয়াটা আমি লিখেছিলাম, আজ বায়োলজি প্রাক্টিক্যাল বাঙ্ক করে যদি দুপুরের দিকে কোন বাহানা করে আমি ওর বাড়িতে পৌঁছে যাই। ওর বাড়িতে ওইসময় কেউ থাকেনা। ও হ্যাঁ বলেছে দীপশ্রীকে। একচোট ঝগড়া হয়ে গেল দীপশ্রীর সাথে। দীপশ্রীটা কেন জানিনা আমায় বারণ করছিল এভাবে ওর বাড়িতে যেতে। আরে কে দেখতে যাচ্ছে? কিন্তু আমাকে তো একবার জানতে হবে, জানতেই হবে। মুখের ওপর বলে দিল “যাচ্ছিস যা, কিন্তু কোন প্রব্লেমে পড়লে আমার কাছে কাঁদতে আসবি না”। মানে ও কি মনে করে আমায়? আমি বাজে মেয়ে? নিজে ধোওয়া তুলসিপাতা? অন্ধকারে জয়দীপের সাথে অ্যাপো মারার সময় কিসব হয়, আমি জানি না, না?
আজ সুতীর্থ স্কুলেই আসেনি। মানে আমার জন্য ও অপেক্ষা করছে সারাদিন।
আমি হনহন করে হাঁটা দিলাম ওর বাড়ি, বুকের ভিতর লাব-ডাব শব্দটা শুনতে পাচ্ছি, প্রত্যেকটা। কলিং বেল বাজালাম, দরজা খুলল। খালি গা সুতীর্থ দাঁড়িয়ে আছে।
ওর পিছন পিছন ওর ঘরে ঢুকলাম, চড়া সিগারেটের গন্ধ ঘরময়।
সুতীর্থর চোখ দুটোতে কেমন যেন নোংরা নোংরা একটা চাউনি। আমার ভয় করতে লাগল। হ্যাঁ আমি ওকে ভালবাসি, কিন্তু তা বলে শুধু একটা দুপুর এঞ্জয় করতে এসেছি? মানে? হঠাত ও বলল
সুতীর্থ এগিয়ে আসছে আমার দিকে, খালি গা, আমার কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠল, বমি পাচ্ছে, এক ঝটকায় ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
সুতীর্থকে কিচ্ছু বলতে না দিয়ে বেরিয়ে এলাম। হনহন করে এগোচ্ছিলাম, একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি, মা আর রিকুদাদা দাঁড়িয়ে। আমার পা দুটো মাটির সাথে আটকে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ।
মার দুচোখে আগুন জ্বলছে,“বাড়ি চল”, মার এমন গলা কক্ষনও শুনিনি আগে।
কে একটা আলতো করে কাঁধে হাত দিল, কে? বলে চমকে উঠেছি
আমার ছেলে ফোকলা দাঁতে হেসে উঠল,“এমা ভয় পেয়েছে, বাবা বলল তুমি চানে যাবেনা? কখন রেডি হবে?”
কলেজ লাইফের শাড়িটাই পরলাম, মাটির গয়নাগুলও,আরও একটা দুটো ডায়েরি ঘাঁটলে এই শাড়ি-গয়নার কাহিনীগুলো খুঁজে পাব। কি বোকা ছিলাম না? কি ভীষন বোকা।
অথচ আজ এইসব দিনে ফিরে যেতে কি ভীষণ ইচ্ছে করে, কই এত অবিশ্বাস, এত আশাভঙ্গের গল্পের পরেও, রাস্তা-ঘাটে, পুরোন পাড়ায়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে, এইসব পুরনো মুখের খোঁজ করে যাই। কই রাগ হয় না তো, বরং মণি-মুক্তোর মত এইসব মুহুর্তগুল ঝরে পড়ে, খুব খুব হাসি, প্রাণ খুলে।
গাড়িতে বসে আবার এফ.এমটা চালিয়ে দিলাম, গান হচ্ছে
‘হঠাত রাস্তায় অফিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে
বন্ধু কি খবর বল?
কতদিন দেখা হয়নি’।
নির্মাল্য সেনগুপ্ত
১)
খুব আনাড়ির হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিলে ফোকাস ইন করার সময় যেমন ব্লারড ইমেজ পাওয়া যায় তেমনভাবে খোলা দরজার আলোটা দেখতে পেলেন অরুণবাবু। আর মিনিট তিনেক। তারপর সব জল্পনার অবসান। অদূরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষ্যে। ভয় এবং চাপা উৎকণ্ঠার মধ্যে সিঁড়ির হাতল ধরে এগোলেন তিনি। এইবার, এইবার সমস্ত রহস্যের উন্মোচন ঘটবে। নয় তিনি মানব সভ্যতার ধারাকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে চলে যাবেন, নয়ত তাঁর আর অস্তিত্বই থাকবেনা। ভীতির পরিমাণ কম নয়, কিন্তু প্রত্যেক অতিমানবদেরকেই উন্নতির স্বার্থে এমন কাজ করতে হয়েছে যাতে মৃত্যুভয় প্রবল ছিল। দাঁতে দাঁত চিপলেন অরুণবাবু। ‘প্রায় অন্ধকার’ সিঁড়ি থেকে তিনি আলোর গভীরে প্রবেশ করলেন।
ঊনত্রিশ দিন আগের কথা…
অরুণবাবুর বয়স মেরেকেটে বাহান্ন হবে। অল্প বয়স থেকে ‘কম মায়না কাম খাটুনি বেশি’র চাকরী এবং অবিবাহিত হওয়ার জন্য অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে বার্ধক্যের ছাপ বেশ কিছু বছর আগেই চলে এসেছে। রাজবল্লভ পাড়ার বাসিন্দা অরুণলাল মহালনবীশের সঙ্গে বাকি বাসিন্দাদের যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। অরুণবাবু একটি জীবনবীমা কোম্পানির এজেন্ট। ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে থাকেন। যা মাইনে পান তাতে একজনেরই চালাতে বেশ বেগ পেতে হয়। তাই শখ আহ্লাদ, আমোদ, বছরে একবার ঘুরতে যাওয়া, সপ্তাহান্তে মদ্যপান, পাড়ার মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানে মাসিক খাতা ইত্যাদি প্রায় সমস্ত বাঙালীদের স্বাভাবিক বিষয়গুলো থেকে তিনি বঞ্চিত। তাতে তাঁর দুঃখ করার মতন বিলাসীতাও নেই। তিনি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সস্তার রেজর দিয়ে দাড়ি কামিয়ে অফিসে যান। যাতায়াতে লোকাল ট্রেনে কমলা লেবু বা ঝাল বাদাম কিনে খান। ভেন্ডারে উঠে বাকি অফিস যাত্রীদের তাস খেলা দেখে প্রাণপণে শেখার চেষ্টা করেন। সারাদিন এর ওর বাড়ি প্রিমিয়ামের টাকা তুলতে বা নতুন ক্লায়েন্টদের ‘জীবনবিমা যে কতটা প্রয়োজন’ বোঝাতে সময় কেটে যায়। বাড়ি ফিরে এসে স্নান করে রাতের খাবার খেয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন।
সেদিন সকালবেলা ঘরে অফিস যাওয়ার সময় অরুণবাবু ফ্ল্যাটের মেইন গেটে তালা লাগাচ্ছিলেন। একটি দম্পতি রিকশায় চেপে পাশের ফ্ল্যাটে এসে দাঁড়াল। ছেলেটির বয়স সাতাশ আটাশ। মেয়েটি ছাব্বিশের ঘরে হবে। সেদিকে তাকিয়ে অরুণবাবুর মন অল্প বিষণ্ণ হয়ে গেল। আর কিছু না হোক, একজন সহধর্মিণীর অভাব সবসময় টের পান তিনি। মাখো মাখো প্রেমের প্রয়োজন ছিলনা, অন্তত মুখ ঝামটা দেওয়ার জন্যও যদি কেউ থাকত, রান্নাটা নিজেকে করতে হতনা, সকালের শার্টটা ঘুম থেকে উঠে ইস্ত্রী করা পাওয়া যেত, ঘুমোনোর আগে কারও কপালে চুমু খেয়ে আদর করতে করতে ঘুমনো যেত একটু।
এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তালার ফুটোয় চাবিটা সেট হচ্ছিলনা ঠিক করে। এমন সময় ডাক শুনে তাঁর সম্বিত ফিরল।
“দাদা শুনছেন?”
অরুণবাবু দেখলেন, সদ্য রিকশায় আগত দম্পতির ছেলেটি তাকে ডাকছে।
“অ্যাঁ?”
“বলছি যে, আপনি কি পুরনো বাসিন্দা? খাওয়ার জলের ব্যবস্থা কি করে করা যেতে পারে বলতে পারেন? আমার ওয়াটার পিউরিফায়ারটা কেনা হয়নি।”
“সামনের পরেশের দোকানে মিনারেল ওয়াটারের জারিকেন ভাড়া পাওয়া যায়। পঁয়তাল্লিশ টাকা দাম। একশ টাকা জমা রাখে। নতুন আপনারা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি থাকব। ও আমার বান্ধবী রনিতা। আমার নাম সুমিত, সুমিত বিশ্বাস।”
ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। অরুণবাবু সেটি ধরে অল্প ঝাঁকালেন।
এরপর প্রায় কুড়ি মিনিট দুজনের মধ্যে কথা হল। অরুণবাবুর ছেলেটিকে বেশ ভাল লাগল। প্রতিবেশী হিসেবে খাসা। এমনিতে তাঁর আজ অবধি কোনও প্রতিবেশীর সঙ্গে সখ্যতা হয়নি।
দুদিন পরে অরুণবাবু সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরছিলেন। কাজের চাপ কম থাকায় তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছিল। বাড়িতে ঢোকার সময় সুমিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে এক গাল হাসি দিয়ে বলল, “কী দাদা? এক বোতল বিয়ার হবে নাকি? একদম ঠাণ্ডা…”
অরুণবাবুর চমক লাগল মনে। কোনওদিন এসব ছুঁয়ে দ্যাখেননি। তাঁর বাবা জীবিতদশায় বলতেন, “ওসব বিষ রে অরু। ছুঁয়েছিস কী জ্বলে মরে গেছিস”। কিন্তু অফিসে নিত্য তাঁর কলিগদের মদ্যপানের গল্প শোনেন। আজ হঠাৎ তাঁর মনে অদম্য ইচ্ছে জাগল।
“চল, হয়ে যাক। আমি কিন্তু খাইনা একদমই।”
সুমিতের বেডরুমের খাটের এক কোণায় বসে দ্বিতীয় বোতলের শেষ ফেনা ফেনা অংশটুকু গলায় চালান করে দেওয়ার পর অরুণবাবুর মনে হল বমি হবে, হবেই। তাঁর মনে বহুদিনের জমা আবেগ যেন কণ্ঠনলী দিয়ে ঠেলে বেরোতে চাইছে। তিনি সুমিতকে জড়িয়ে ধরলেন দু হাত দিয়ে।
“ভাল লাগেনা ভাই, কিচ্ছু ভাল লাগেনা। কী আছে বল আমার জীবনে? এই অফিস আর বাড়ি। কিচ্ছু পাইনি আমি। টোটাল ফেলিওর। আমি মরিনা কেন…”
সুমিতেরও চোখ ভিজে আসছিল। সেও দু বোতল খেয়েছে। এমনিতে সে মাতাল হয়না, কিন্তু কেউ এমন ভেউ ভেউ করে কাঁদলে কার না কষ্ট হয়! সে অরুণবাবুর পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, “আরে দাদা, কাঁদবেননা, ভাবুন তো কত লোক রাস্তায় শোয়? তাদের কত কষ্ট?”
এমনভাবেই দুর্দান্ত একটা বন্ধুত্ব তৈরী হল দুজন অসমবয়সী মানুষের মধ্যে। অরুণবাবু জানলেন, সুমিত একজন কেমিস্ট। একটা ফার্মেসীতে চাকরী করে। তার বান্ধবী রনিতা তার অফিস কলিগ। সে পাগলের মত ভালবাসে তাকে। সে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিন্তু রনিতা আর কটাদিন অপেক্ষা করতে চায়। এছাড়া সুমিতের শখ আহ্লাদ সবকিছু হল পুরাণ বা মাইথোলজি। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ড-ওডিসি, বাইবেল সবকিছু তার ঠোঁটস্থ। বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনী জোগাড় করে পড়াই তার সখ। সুমিতের কাছেই তিনি জেনেছেন গ্রীক দেবী অ্যাফ্রোডাইটি আসলে সমুদ্রের ফেনা থেকে জন্ম নেন। ঘটোৎকচের ছেলে বার্বারিকের মৃত্যু কেমনভাবে হয়। শিখণ্ডীর আগের জন্মের নাম অম্বা, যে ভীষ্মর উপর প্রতিশোধ নিতে উভলিঙ্গ হয়ে জন্ম নেয় আবার ইত্যাদি। সুমিত ভীষণ হাসিখুশি এবং সবসময় উজ্জীবিত একটি ছেলে। অফিস আর পুরাণ বাদে যার জীবনের আর একটিই লক্ষ্য, রনিতাকে বিয়ে করা।
এভাবেই চলে গেল দুটো সপ্তাহ। সুমিত আর রনিতার সঙ্গে রেস্টুর্যান্টে খেয়ে এলেন একদিন। কিছু টাকা তাঁর পকেট দিয়েও খসল, কিন্তু তাঁর একঘেয়ে জীবনে যেন এই ছেলে মেয়ে দুটি নতুন হাওয়া নিয়ে এসেছিল হঠাৎ। রনিতা রবিবার সুমিতের সাথে দেখা করতে এলে তাঁর ডাক পড়বেই।
একদিন সপ্তাহান্তে সুমিতের বাড়ি বসে বিয়ার খাচ্ছিলেন দুজনে। আজ সুমিত দুপুর থেকেই একটু চুপচাপ। কারণ জিজ্ঞেস করাতে সুমিত বলল, “ সকালে রনিতার কলেজ জীবনের এক বন্ধুর সাথে আলাপ হল। সেও কেমিস্ট। বিদেশ থেকে পাশ করে এসেছে। অনেকক্ষণ গল্প হল।”
“বাহ, কিন্তু কিছু হয়েছে কি?”
“সে অদ্ভুত একটা গল্প শোনালো আমায়।”
“তাই? কী?”
“আপনি এলিক্সার কাকে বলে জানেন?”
“আমি পলিসি বেচার পদ্ধতির বাইরে খুব কম জিনিসই জানি হে। এই তোমার থেকেই শিখছি আজকাল। সেটা কী বস্তু?”
সুমিত একটু নড়েচড়ে বসে বিয়ারের বোতলে একটা ঢোক মেরে বলল, “ইস্ট এশিয়ান মাইথোলজি অনুযায়ী মুন র্যাবিট এক ধরণের মিষ্টি তরল পানীয় বানায়, যাকে বলে দ্য এলিক্সার অফ লাইফ’ অর্থাৎ হিন্দু পুরাণ মতে যাকে বলা হয় অমৃত। এখন চীনা, জাপানি ছাড়াও ইজিপশিয়ান পুরাণ মতে দেবতা ‘থথ’ যার দেহ মানুষের এবং মাথাটা ইবিসের, সে এক ধরণের তরল পান করত, যার ফলে সে অসীম শক্তি ধারণ করত। কিন্তু পরে থথ হয়ে ওঠে মানসিক রোগী। যাই হোক, রনিতার এই বন্ধু অশোক ইজিপ্টে পিরামিডের কেমিক্যাল সল্যুশন নিয়ে কাজ করতে গেছিল। সেখানে সে নাগ হামাদি লাইব্রেরীতে একজন পুরাতত্ত্ববিদের সাহায্যে একটি প্যাপিরাস কোডিস থেকে এই এলিক্সারের ফর্মুলা পায়। সেটা নিয়েই আজ বলছিল সে।”
এত তত্ত্ব মাথায় রাখতে পারছিলেননা অরুণবাবু। এমনিতেই এক বোতল বিয়ার শেষের দিকে। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে দিয়েছে। তিনি বললেন, “তা এই নিয়ে তুমি এত চিন্তিত কেন?”
সুমিত বলল, “শুধু এলিক্সার নয়, ডার্ক এলিক্সার নামের আরেকটি জিনিসের সন্ধান পেয়েছে অশোক। যা এর আগে কোনওদিন কোথাও জানা যায়নি। এর ইনগ্রিডিয়েন্টটা সে আমাকে বলল। আমি ভাবছিলাম যদি…”
“কী?”
“যদি আমার ল্যাবে সেটা বানিয়ে দেখি। সে এসব জানলেও বিশ্বাস করেনা কিছু হতে পারে। সে শুধু কৌতুহলে জেনেছে। আমি ভাবছি যদি চেষ্টা করে দেখা যায়…”
“কর কর… তোমার অনেক নাম হোক…” অরুণবাবু খালি বোতলটা রেখে আরেকটা বিয়ারের ভর্তি বোতল হাতে তুলে কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, ‘উল্লাস…’
২)
এরপর দিন পাঁচেক সুমিতের দেখা পাওয়া গেলনা। এরপর একদিন রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরলেন অরুণবাবু। মেইন গেটের দিকে এগোতে দেখলেন সুমিত দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এত রাতে?”
“একত্রিশটা জিনিস লেগেছে মোট। অ্যাসিটামিনোফেন, অ্যামিনপাইরিন, অ্যান্টিপাইরিন, ক্যাফেইন…”
“থামো থামো। কী বলছ?”
“ডার্ক এলিক্সার রেডি দাদা। আমি অলরেডি নিয়ে নিয়েছি কিছুটা। আস্তে আস্তে বল পাচ্ছি। দশ দিন টানা নিতে হবে। তারপর…”
অরুণবাবু চমকে গেলেন। এমন কী সত্যি হয়? তাঁর জিনিসটা একবার দেখার ইচ্ছে হল খুব।
“একবার দেখা যাবে ব্যাপারটা?”
সুমিত দুপাশ একবার দেখে নিয়ে বলল, “আজ রাতে না হয় আমার ঘরে থেকে যাবেন। চলুন…”
মিনিট ছয়েকের মধ্যে সুমিতের ঘরে পৌঁছলেন তিনি। সুমিত একটা নীল রঙের ঘঁষা কাঁচের বোতল নিয়ে এল।
“দাদা, রনিতা যেন না জানে…”
অরুণবাবু মাথা নাড়লেন। খুব ঘন তরলটা। কি হতে পারে উনি ব্যবহার করলে?
সুমিত যেন অরুণবাবুর মনের কথা শুনে ফেলে বলল, “আপনার চাই?”
অরুণবাবু থতমত খেয়ে তাকালেন সুমিতের দিকে। “মানে… আমি তো জানিনা… কী থেকে কী হবে…”
“আমি কিন্তু দাদা এটা দুজনের জন্য তৈরী করেছি…”
অরুণবাবু প্রমাদ গুনলেন। সত্যিই কি এমন কোনও গুণ আছে এটায়? সারা জীবন লাঞ্ছনা আর গঞ্জনার জীবন কাটিয়েছেন। প্রথমে বাবার ধ্যাতানি, তারপর স্কুল কলেজে বন্ধুবান্ধবের ইয়ার্কি, অফিসে বস-কলিগের ব্যঙ্গ, একাকীত্বময় জীবন, কতদিন এসব সহ্য করবেন তিনি? আর কতদিন?
সুমিতের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় অরুণবাবু বললেন, “এটা কিভাবে খাব? এমনি? না জল দিয়ে?”
সুমিতের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটল। সে একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ নিয়ে এল। এরপর অরুণবাবুর পাঞ্জাবীর হাতাটা গুটিয়ে শিরায় সূঁচ ফুটাল। অরুণবাবু ইষৎ কেঁপে উঠলেন। মাথাটা অল্প ঝিমঝিম করে উঠল, যেমন বিয়ার খেলে হয়। মুখের ভিতরটা তেতো লাগল হঠাৎ খুব।
সুমিত একটা ছোট বোতল আর এক বান্ডিল ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ এনে অরুণবাবুর হাতে দিয়ে বলল, “রোজ সকালে খাওয়ার পর। এবার ভাগ্য। দেখা যাক কী হয়…”
কিছুক্ষণ গল্প করার পর অরুণবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন সোফায়।
এরপর কেটে গেল তিনদিন। কিছুই আলাদা টের পাননি তিনি। কিছুই হবেনা শুধু শুধু সুঁচে বিদ্ধ করা নিজেকে। সুমিতের উপর দুর্বলতা তাই নইলে এসব করতেননা তিনি। তার উপর বেশ মাথা ঝিমঝিম করে। বসের সামনে দুবার তুতলে গেছেন আগেরদিন। অরুণবাবু ঠিক করেছেন আর দিন তিনেক দেখবেন, তারপর আর নয়। বোতল আর সিরিঞ্জটা ফেলে দেবেন।
গতকাল সুমিত এসেছিল। ওর উচ্ছাস ভাবটা কম যেন। রনিতার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। মন মেজাজ ভাল নেই। সে এলিক্সার সেবন করছে কিনা আর জিজ্ঞেস করলেননা। বেচারার মনটা খারাপ বেশ। তাঁর প্রেমিকা বা স্ত্রী না হওয়ায় এই জ্বালা থেকে মুক্ত তিনি।
টিফিন খাওয়ার সময় শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল বেশ। জিনিসটা নেওয়ার পর থেকেই সারাদিন কেমন ক্লান্ত ভাব লাগে। কিছু ক্ষতি হচ্ছেনা তো? রোগা হচ্ছেন কী? অরুণবাবুর মনে পড়ল তাঁর বাবা বলতেন, শরীরে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে কিনা তা জানবার প্রাথমিক উপায় হল ওজন চেক করা।
অফিসের নিচেই ওষুধের দোকান। অরুণবাবু নেমে এসে সামনের দোকানটায় ঢুকলেন। ডিজিটাল মেশিন। দু টাকা ফেলতে ওজন ফুটে উঠল স্ক্রীনে।
মেশিনটা খারাপ। অরুণবাবু দেখলেন ওজন দেখাচ্ছে চব্বিশ পয়েন্ট পাঁচ। দু টাকা গচ্ছা গেল। বিরক্তিসূচক আওয়াজ বের করে, দোকানীর দিকে একটা অল্প কড়া নজর দিয়ে এগিয়ে গেলেন।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে আরেকটা দোকান। এখানেও একই রকম মেশিন। দুটাকা হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন মেশিনে। টাকা ফেলার তিন সেকেন্ড পর ওজন দেখাল। পঁচিশ পয়েন্ট দুই।
অরুণবাবু বুঝলেন খুব বেশি গরম না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ তিনি দরদর করে ঘামতে শুরু করেছেন।
“দাদা মেশিনটা ঠিক আছে?”
দোকানি একটা অবজ্ঞাময় অভিব্যক্তি দেখিয়ে বলল, “আগের মাসের কেনা। এটাই মার্কেটে লেটেস্ট। হাতিরও এগজ্যাক্ট ওজন দেয় দাদা…”
অরুণবাবু নামলেন। পকেট হাঁতড়িয়ে দেখলেন আরও চারটে দু টাকা খুচরো আছে। একটু দূরে আরেকটা দোকান। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওজন এল চব্বিশ পয়েন্ট সাত।
এতগুলো মেশিন খারাপ হতে পারেনা। কি হয়েছে তাঁর!! অরুণবাবু হন্তদন্ত হয়ে ফিরলেন অফিসে। ডেস্ক স্টাফ নিখিলের সামনে এসে বললেন, “দ্যাখো তো নিখিল, আমাকে কী খুব রোগা লাগছে?”
নিখিল একবার তাঁকে আপাদমস্তক দেখে বলল, “কই না তো। বরং একটু মুটিয়েছেন মনে হচ্ছে।”
বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলেন অরুণবাবু। এটা কী হচ্ছে! তিন চার মাস আগে একবার মেট্রোতে ওজন করেছিলেন। বাষট্টি কেজি দেখিয়েছিল। সেখান থেকে পঁচিশে নামে কী করে! তাঁর তো মরে যাওয়ার কথা! তবে কী ওই এলিক্সারের জন্য…
অরুণবাবুর মনে হল তাঁর নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। কাজকর্মও বেশ তাড়াতাড়ি করে ফেলতে পারছেন। তৎপরতা বেড়েছে। শুধু মাথা ঝিমঝিম।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সেদিন রাতে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। হঠাৎ করে একটা কুকুর এসে পড়ল সামনে। আচমকা এসে যাওয়ায় আঁৎকে উঠে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে ফেললেন।
পা যখন মাটি ছুঁল, অরুণবাবু আবিষ্কার করলেন লাফ দেওয়ার আগে এবং পরের জায়গাটার মধ্যে দূরত্ব প্রায় পাঁচ মিটার!
এ কি হচ্ছে! অরুণবাবুর খুব ভয় লাগল। এ সব তো অস্বাভাবিক ব্যাপার। কোনওদিন স্কুল কলেজে লং জাম্পে নাম দেননি তিনি। তাঁর চেহারা বরাবরই ভারীর দিকে। এ সব কী তাহলে এলিক্সারের জন্য?
হঠাৎ খুব ফুর্তি জাগল তাঁর মনে। বেশ কিছুটা ছুটে এসে তিনি লাফ দিলেন।
যখন জমিতে নামলেন, অরুণবাবু বুঝলেন প্রায় ১০ মিটার তিনি শূন্যে ছিলেন।
এরপর অরুণবাবু প্রায় আধ ঘণ্টা লাফিয়ে বেড়ালেন সারা পাড়া।
৩)
পরের দিন খুব সকালে সুমিত এল অরুণবাবুর বাড়িতে। তিনি দেখলেন, সুমিতের দু চোখের নীচে লম্বা কালো ছোপ পড়েছে। হঠাৎ সে অরুণবাবুকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করল।
“আমার কিচ্ছু ভাল লাগছেনা দাদা। রোজ ঝগড়া হচ্ছে রনিতার সাথে। ওই ওষুধটাও কিচ্ছু কাজ করলনা। আমি এভাবে বেঁচে থেকে কী করব বলুন? আমার জীবনে কী একটু শান্তি থাকবেনা?”
অরুণবাবুর এখন এই কান্নাকাটি ভাল লাগছিলনা। তিনি ঠিক করেছেন আজ একটু বেশি পরিমাণে এলিক্সারটা ইনিপুট করবেন। তবু তিনি সুমিতকে সান্ত্বনা দিতে পিঠ চাপড়ে বললেন, “আরে একি? এভাবে ভেঙে পড়ছ কেন? এত ভাল চাকরি কর তুমি। এত হাসিখুশি ছেলে। এমন করতে আছে? ঠিক কাজ করবে। ঝগড়াও হবেনা। রনিতাও এত ভাল মেয়ে। খুব ভাল থাকবে তোমরা…”
সুমিত চোখের জল মুছে বলল, “আপনি কিছু বুঝলেন? কাজ হল কিছু?”
অরুণবাবু ভাবলেন কিছুক্ষণ। এখনই বলা ঠিক হবেনা সুমিতকে। ওঁর কাজ করেছে শুনলে সুমিত আরও ভেঙে পড়তে পারে। সবার ভাগ্য তো আর এক হয়না।
“নাহ্, কিছুই হয়নি। তবে আরো তো ছদিন বাকি। এখনই হতাশ হোওনা। আচ্ছা সুমিত, আজ অফিসে একটু কাজের চাপ আছে। স্নানে যেতে হবে। তাই…”
সুমিত চলে গেল। অরুণবাবু ডার্ক এলিক্সারের বোতলটা হাতে নিলেন। আজ একটু বেশি করে…
সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে অরুণবাবু চলে গেলেন পাড়ার মাঠে। দশ বারটা কুকুরের চেঁচামেচি পার করে তিনি এসে দাঁড়ালেন এক প্রান্তে। নিস্তব্ধ অন্ধকার মাঠ। কারও আসার সুযোগ নেই এখন।
কিছুটা দৌড়ে এসে লাফ দিলেন তিনি। দেওয়ার সাথে সাথে হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে গেল তাঁর নিজে থেকে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর যখন মাটিতে নামলেন, অরুণবাবু বুঝলেন, আর কিছু নয়, গত পাঁচ মিনিট তিনি উড়ে বেড়িয়েছেন সারা মাঠ। হয়তো এই যুগের তিনি প্রথম মানুষ যে পাখির মত উড়ল এতক্ষণ।
রাত তিনটের সময় বাড়ির সামনে ল্যান্ড করলেন তিনি। বলাই বাহুল্য মাঠ থেকে বাড়ির রাস্তাটা তিনি হেঁটে আসেননি।
তিনদিন পর রবিবার এল। সুমিতের খোঁজ নিতে তার বাড়ি গেলেন অরুণবাবু। কলিং বেল টেপার দু মিনিট পর দরজা খুলল।
চমকে গেলেন অরুণবাবু। সুমিতকে চেনা যাচ্ছেনা প্রায়! সারা শরীর যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গায়ে কালো কালো ছোপ। গাল দুটো ভেঙে যেন একে অপরকে ছুঁতে চাইছে। মাথার চুলের ঘনত্বও কম। চোখ দুটো কোটরের ভিতর ঢুকে গেছে পুরো। বোঝা যাচ্ছে সুমিত কাঁদছিল এতক্ষণ।
“একি অবস্থা হয়েছে তোমার? শরীরের কী হাল বানিয়েছ? এমন করছ কেন তুমি?”
অনেকদিন গরমের পর যেমন হঠাৎ বর্ষা আসে, সেভাবে অঝোরধারে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ল সুমিত। অরুণবাবু কিছুতেই সামলাতে পারছিলেননা। সে কী বলছে এক বর্ণও বোঝা যাচ্ছেনা। রনিতার নামটা শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কিছুক্ষণ পর তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফিরে এলেন সুমিতবাবু। হাসিখুশি ছেলেটা পুরো ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু এসব এখন তাঁর ভাবার সময় নয়। গতকাল প্রায় এক ঘণ্টা ওড়ার পর তিনি মাটিতে নেমেছেন। কিন্তু এখনও এই উড়ন্ত ব্যাপারটা তাঁর কন্ট্রোলে আসেনি। আর বাকি দুদিন। তারপর ডার্ক এলিক্সার শেষ হয়ে যাবে। তিনি চাননা ওটা শেষ হওয়ার পর তাঁর এই ক্ষমতা চলে যাক। তাই নিত্য প্র্যাকটিস চালাচ্ছেন। মানব সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন হতে চান তিনি।
দশ নম্বর দিন। খুব আনাড়ির হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিলে ফোকাস ইন করার সময় যেমন ব্লারড ইমেজ পাওয়া যায় তেমনভাবে খোলা দরজার আলোটা দেখতে পেলেন অরুণবাবু। আর মিনিট তিনেক। তারপর সব জল্পনার অবসান। অদূরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষ্যে। ভয় এবং চাপা উৎকণ্ঠার মধ্যে সিঁড়ির হাতল ধরে এগোলেন তিনি। এইবার, এইবার সমস্ত রহস্যের উন্মোচন ঘটবে। ছাদের দরজার দিকে এগোলেন অরুণবাবু। এলিক্সার শেষ। আজ তিনি ঝাঁপ দেবেন ছ তলার ছাদ থেকে এবং উড়ে বেড়াবেন নিজের ইচ্ছেমত। কেউ আটকাতে পারবেনা তাকে আর। বুকের ভিতর নিশ্বাস প্রশ্বাস পাগলের মত চলাফেরা করছে। মৃত্যুভয় আছে, কিন্তু সমস্ত বৈজ্ঞানিকই জীবনের মায়া তুচ্ছ করে এক্সপেরিমেন্ট করেছে চিরকাল। অদূরে গান বাজছে ‘আমার বেলা যে যায়, সাঁঝবেলাতে…’ পাঁচিলের উপর এক পা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অরুণবাবু। নীচে একটা পানা পুকুর। সেখানে একটা বক কুঁচো মাছ ধরে উড়ে গেল আকাশে। অরুণবাবু ঠিক করলেন তিনি ওই বকটাকে পিছু করবেন।
পাশের দিকে তাকালেন তিনি। ঠিক তক্ষুনি পাশের ছাদ থেকে পাঁচিলের উপর একটি শীর্নকায়, প্রায় মাথায় টাক পড়ে যাওয়া সাতাশ আটাশ বছরের ছেলে পাঁচিলের উপর উঠে এসে দাঁড়াল। দুজনে তাকাল একে অপরের দিকে। সুমিত চায়না আর এই জীবন রাখতে। গত কাল চাকরি চলে গেছে তার। রনিতার সাথে সম্পর্কও শেষ করে দিয়েছে সে, রনিতার প্রচুর কাকুতি মনতি সত্ত্বেও।
দুজন অসমবয়সী মানুষ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল একে অপরের দিকে। তারপর প্রায় একই সাথে ঝাঁপ মারল।
৪)
সাব ইন্সপেক্টর তথাগত মজুমদারের কাছে ফোনটা এল বেলা বারটার সময়। এমনিই পঁচিশে বৈশাখের জন্য সারা এলাকাময় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল। বাইরে রোদের তেজও কম নয়। এই সময় ফোন এল, কাছেই একটা বহুতল ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে একজন আত্মহত্যা করেছে। মাথা ফেটে চৌচির, মাল্টিপল বোন ফ্যাকচার। শিড়দাঁড়াটা ভেঙে বুক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে। সেই দেখে লোকে বেমালুম ভির্মি খাচ্ছে। এক্ষুনি স্পটে গিয়ে ভীড় সামলাতে হবে অ্যাম্বুলেন্স আসা অবধি। একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠলেন তথাগতবাবু। মানুষ যে কেন আত্মহত্যা করে…
সাতদিন পরের কথা…
গোয়েন্দা দপ্তরের অভীক ব্যানার্জী ঢুকল আই.জি বিকাশ স্যানালের কেবিনে। এই ছেলেটার প্রতি অগাধ বিশ্বাস বিকাশ সান্যালের। কঠিন থেকে কঠিনতর কেস দুদিনে সমাধান করে দেয় অভীক। তাই আজকেও পজেটিভ কোনও উত্তর চাইছিলেন তিনি।
“কেস অলমোস্ট সলভড স্যার…”
“অ্যাজ ইউজুয়াল অভীক। দ্য ডিপার্টমেন্ট ইজ প্রাউড অফ ইউ। তুমি যেটা সন্দেহ করছিলে সেটাই?”
“হ্যাঁ স্যার। ক্লিন কেস অফ লাভ ট্রায়াঙ্গল। রনিতা নামের মেয়েটি চাইছিল সুমিতের সাথে সম্পর্কটা না রাখতে। এদিকে সুমিত জোর দিচ্ছিল বিয়ের জন্য। এমন অবস্থায় রনিতার প্রেম হয় সায়াকাট্রিস্ট ডক্টর অশোক ভট্টাচার্য্যর সাথে। অশোকও রনিতার প্রেমে পাগল হয়ে যায়। অশোক শোনে সুমিতের অদম্য কৌতূহল মাইথোলজিতে। তখন সে প্ল্যান করে যেমন করে হোক সুমিতকে কিছু করে সরিয়ে দিতে হবে রনিতার জীবন থেকে। সে রনিতার বন্ধু সেজে দেখা করে সুমিতের সাথে এবং কোনও গল্পের মাধ্যমে সুমিতকে রেসিপি দেয় ডি.এম.টি এবং হেরোইন এর এক কম্বিনেশনের। সে জানত সুমিত কেমিস্ট। তার এর ইনগ্রিডিয়েন্ট জোগাড় করতে অসুবিধে হবেনা। হাইলি ডিপ্রেসিভ স্কিজোফ্রেনিয়ার সৃষ্টি করে এই ড্রাগ সেবন। সে এই গল্পটা এমনভাবেই ফাঁদে যাতে একটা ভাল পরিমাণ ওষুধ সুমিত ব্যবহার করে প্রতিদিন। প্রায় ২৫ গ্রাম মাদক পাওয়া গেছে সুমিতের দেহে। এর থেকে পজেটিভ স্কিজোফ্রেনিয়া হওয়ারও একটা মাইল্ড চান্স থাকে কিন্তু তা এক লাখে একটা। তার প্ল্যান অনুযায়ীই সে এই মাদক সেবন করে এবং মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। তবে স্যার এক্ষেত্রে অশোকবাবুর এগেইন্সটে কদ্দুর অ্যাকশন নেওয়া যাবে বলতে পারছিনা। ম্যাক্স টু ম্যাক্স লাইসেন্স ক্যানসেল করানো যেতে পারে। কিন্তু এরা হাই প্রোফাইল লোক, ভাল উকিল লাগিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে অনায়াসে…”
বিকাশ সান্যাল কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থাকলেন। তারপর বললেন, “হুমম, আর ওই ভদ্রলোক? সুমিতের পাশের বাড়ির অরুণবাবু? তিনি নিখোঁজ হলেন কেন সুমিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পর?”
অভীক ব্যানার্জী একটু মাথা চুলকে ইতস্তত করে বলল, “এই জায়গাটাই আনসলভড স্যার। ওই ভদ্রলোকও একই ড্রাগ নিচ্ছিলেন সুমিতের সাথেই। ওর বাড়িতেও সিরিঞ্জ এবং কন্টেইনার পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি যে কোথায় গেলেন! আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। এনার মাথারও প্রবলেম দেখা দিয়েছিল। ওর অফিসের এক কলিগ নিখিল দাসকে অদ্ভুত গল্প শোনাচ্ছিলেন ইদানীং…”
“কী গল্প?”
“কিসব উনি নাকি উড়তে পারেন। মানব সভ্যতার কল্যাণে সে বিদ্যা লাগাবেন। এই সব পাগলের বুক্নি।”
“কিন্তু তিনি নিরুদ্দেশ হলেন কেন? খোঁজ নাও। হয়ত কেসটা এতটা সোজা না যতটা তুমি ভাবছ।”
অভীক মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিকাশ সান্যাল ভাবতে শুরু করছিলেন অরুণবাবুর নিরুদ্দেশের কারণ। তবে কী আরও জটিল কোনও বিষয়? লাভ ট্রায়াঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে কিছু? উড়তে পারার বিদ্যাটার রহস্যটা কি???
যদিও কিচ্ছুক্ষণ পরেই একটা ফোন তাঁর চিন্তার অবসান ঘটাল। বিকাশ সান্যাল জানতে জানতে পারলেন, সুমিতের ফ্ল্যাটের সামনের পানা পুকুর থেকে একটা লাশ উদ্ধার হয়েছে এক্ষুনি। ফুলে ফেঁপে একসা কাণ্ড। পাড়ার লোকেরা লাশ সনাক্ত করেছে। অরুণলাল মহালনবীশ, যার উড়ান শেষ হয়েছিল পুকুরের জলের নীচে…
Madhab Chattopadhyay
My father was born at a village named Hetampur in the district of Birbhum in West Bengal. Later on, he migrated to a place near Delhi called Hathras, where his father was working as a headmaster in a local school. Being brought-up in a Hindi-speaking environment, my father learnt the language very well. His vocabulary in Hindi was highly appreciated even by those whose mother tongue was Hindi. It was the medium of education for him and he answered the test papers of various subjects (history, geography) in Hindi during his Matriculation Examination.
When he moved to Kolkata after getting employment, he got a house constructed at Chandernagore in Hooghly district of West Bengal, where my maternal grandfathers and maternal uncles resided through generations. It was a French colony during the British rule in India. Hence a lot of encouragement was provided to learn French. It was not surprising therefore that some eminent French scholars who hailed from that small town, got established in highly honourable academic positions in various parts of France and India. High academic standards were also maintained in the teaching of other languages like Bengali, English and Sanskrit. But Hindi was an out-of-the way language there. My father had no problem in speaking Bengali. However, the admixture of various Hindi words in his vocabulary like ‘tu’ (you) or ‘kom-se-kom’ (at least) drew the attention of rickshaw-pullers, shopkeepers and others with whom he interacted. Aware of his weakness in Bengali, he tried to compensate it by introducing idioms from time to time. But since his childhood was not spent in a Bengali-speaking environment, he was not well versed with the exact connotations of all the idiomatic expressions in Bengali and his attempt to improve his expression most often landed him in embarrassing situations. Let me highlight an example here.
The marriage of my sister was finalised in March 1975 with a professor. During the hectic search for a match for her, my parents made earnest requests to many people to look for a suitable bachelor. One evening, a gentleman visited our house with the details of a prospective bridegroom. My father first thanked him and then informed him that he had already finalised my sister’s marriage. “It is indeed a very good news” said the visitor “Now I have a look for a match for my daughter”. My father wanted to encourage him by saying that he was a capable person and hence he had nothing to worry over the issue. But instead of saying it in plain Bengali, he chose to emphasize his point with an idiom by saying “Why are you worrying? After all, you are a ghughu”. The word in italics literally means dove (the bird) but figuratively means a cunning and shrewd person. My father, to the best of his belief and knowledge had thought he had “glorified” the visitor with this expression. Hence he was highly surprised to note that instead of being grateful for the “appreciation“, the gentleman was taken aback and looked stunned. He left in a short while after exchanging some pleasantries. The moment he stepped out of our house, my mother started admonishing my father for his faux pas. He was trying to defend himself by elaborating what he wanted to mean. But when my mother explained to him the actual meaning of the word, his feelings of shame and guilt knew no bounds. This incident led to a drastic cut down in the use of idioms in his future conversations.
শ্যাম সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিবনাথ নন্দী গত তিনমাস হল নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন না। ড্রাইভার রেখেছেন। রোজ পত্রিকা অফিস যাওয়া-আসা, এদিক ওদিক যাওয়া, সবই ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে যায়। কখনও কখনও তাঁর খুব গাড়ি চালাতে ইচ্ছে করে, কারণ এত দিনের অভ্যাস। কিছুদিন আগে মৃদু হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই। সাবধানে থাকতে হবে, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া আর রেগুলার চেক-আপ বজায় রাখলেই যথেষ্ট। শিবনাথ গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন।
এখনকার নাম করা বাংলা সাহিত্যিকদের তালিকায় শিবনাথ নন্দীর নাম আসবেই। তিনি জনপ্রিয় হন গল্পকার হিসাবে, তবে ওনার উপন্যাসও আছে অনেকগুলি। টিভিতে আলোচনা অনুষ্ঠানে এখন কবি-সাহিত্যিকদের ডাকা হয়, সেই সুবাদে রাস্তা ঘাটে অনেকেই শিবনাথকে চিনতে পারেন। অন্যান্য অনেক সাহিত্যিকের মতোই শিবনাথ নন্দী এক পত্রিকা অফিসে চাকরি করেন।
অফিসে ঢুকতেই দেখা হল রমেনের সঙ্গে । রমেন মজুমদার হলেন পত্রিকা গ্রুপের যে পাক্ষিক বেরোয়, তার সহ-সম্পাদক । পাক্ষিকের লেখা বাছাই থেকে সমস্ত সম্পাদনার কাজ রমেন করে ।দেখা হতেই রমেন বলল, “আপনার ঘরে যান ,আমি এক্ষুনি আসছি আপনার কাছে”। হার্ট অ্যাটাকের আগে শিবনাথ চেইন স্মোকার ছিলেন। এখন ধুমপান ছেড়ে দিয়েছেন। এই অফিসে সিনিয়র সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের নিজের ঘরে বসে ধুমপানের অলিখিত ছাড় আছে। এখনও কেউ সিগারেট অফার করলে শিবনাথ না বলেন না। রমেন প্যাকেট বাড়িয়ে দিতে তিনি সিগারেট নিলেন ।
রমেন সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ল। হাতে ধরা কাগজের রোলটা শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে বলল
– দেখুন তো এই তিনটে গল্প আপনার লেখা কিনা।
কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখলেন ওগুলো তাঁরই গল্পের প্রিন্ট আউট।শিবনাথ এখন আর হাতে লেখেন না, ল্যাপটপে লিখে পেনড্রাইভে কপি করে লেখা জমা দেন। গল্প তিনটের প্রথম দু লাইন করে পড়ে উনি বুঝতে পারলেন এগুলো সেই তিনটে গল্প যার কথা এক্ষুনি রমেন বলল। মাত্র দু দিন আগে রমেনকে দিয়েছেন ।
তাই তিনি অবাক গলায় বললেন
– রমেন তুমি কি বলছ, বুঝতে পারছি না।
শিবনাথ অবাক হলেন। তিনটে গল্পেই তিনি লেখকের নাম লিখেছেন – বটুকেশ্বর দত্ত।
রমেন বলল
– দাদা, আপনি নামটা কেটে নিজের নাম লিখুন ও সই করে কাগজগুলো দিন।
কাগজপত্র নিয়ে রমেন উঠে গেল ।
শিবনাথের বিমূঢ় ভাব এখনও কাটে নি। নামটা কি করে ভুল লিখলেন। প্লট যখন মাথায় আসে তখন গল্পের শুরু ও শেষটা ভেবে রাখেন। তারপর লিখতে লিখতে কাহিনী তার নিজস্ব পথে এগোয়। প্রায় শেষের কাছাকাছি এসে নাম খুঁজে পান। আর তখনই গল্পের মাথায় গল্পের নাম ও লেখকের নাম বসান।
আজ শুক্রবার, গত বুধবার তিনটি গল্প এক সাথে তিনি রমেনের কাছে জমা করেন। গল্প লেখা শুরু করেছিলেন গত রবিবার সকাল থেকে, তিনটি গল্প শেষ হয় মঙ্গলবার রাতে।
তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ছে, রবিবার সকালে মুখ ধুয়ে চা পান করে, লেখার টেবিলে বসে যান। এরপর তাঁর স্ত্রীর ডাকে ডাইনিং টেবিলে যান প্রাতরাশের জন্য, ফিরে আবার লিখতে বসেন। গল্প শেষ হয় মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে। এইভাবে তিনটি গল্পের লেখার ঘটনাক্রম তিনি পরিষ্কার মনে করতে পারলেন ।
কিছুদিন আগে লেখা গল্প হলেও, গল্প ও গল্প বানাবার পু্ঙ্খানপুঙ্খ শিবনাথের মনে থাকে। যেমন কিভাবে প্লটটা মাথায় এসেছিল, লেখার সময় কি কি পরিবর্তন করেছিলেন। অনেক সময় দু-তিন প্যারা লিখেও মুছে দিতে হয়, অপ্রয়োজনীয় বোধ হলে। কিন্ত এই তিনটি গল্পের ক্ষেত্রে এইসব কিছুই তিনি মনে করতে পারলেন না। এক বিন্দুও না।
বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে সব ঘটনা বললেন ।শিবনাথের স্ত্রী বললেন, “তোমার কিছু হয়নি, ক্রমাগত লেখার চাপ অনেকদিন চলছে। মাসখানেক লেখাপত্র বন্ধ রাখ। চল একমাস দিল্লী যাই, ওখান থেকে উত্তরাখন্ড ঘুরে আসা যাবে”। দিল্লীতে শিবনাথের ভায়রাভাই থাকেন, অনেক বার যেতে বলেছেন।
একমাস দিল্লী উত্তরাখন্ড ঘুরে আসার পর, শিবনাথ আজ অফিসে যোগ দিয়েছে। রমেন দরজা ফাঁক করে উঁকি মারতেই শিবনাথ তাকে ডেকে ঘরে বসাল। একথা, সেকথার পর রমেন যেন কিন্তু কিন্তু করেই বলল, “শিবনাথ দা, আপনার তিনটে গল্পের বাকি দুটো পাক্ষিকে প্রকাশ করা হবে না”।
এরকম তো কখনও হয়নি, বিস্মিত শিবনাথ বলল
– কেন ?
শিবনাথ ঠিক করলেন, তাঁর লেখা প্রকাশ হল না কেন তার কারণ সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করবেন। তিনি চা আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, চা খেয়েই সম্পাদকের ঘরে যাবেন। তাঁর কোথাও যেতে হল না, সম্পাদক নিজেই হাজির ।
বিনা ভূমিকায় শিবনাথ জিজ্ঞাসা করল
সম্পাদক উত্তর না দিয়ে বললেন
সম্পাদকের ঘরে এসে শিবনাথ একই প্রশ্ন উত্থাপন করল।
সম্পাদক শুধু বললেন
তার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন ও তাঁর ঘরে রাখা ক্যাবিনেট থেকে একটি ফাইল বার করে টেবিলে রাখলেন। ফাইল থেক এক গোছা ক্লিপ দিয়ে আঁটা কাগজ বার করলেন, শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
শিবনাথ দেখলেন, সেগুলো কারও হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, হুবহু তাঁর তিনটি গল্পের প্রথমটির যেটি গত দেড় মাস আগে পাক্ষিকে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের নাম ‘বটুকেশ্বর দত্ত’ দেখে শিবনাথ চমকে উঠলেন।
সম্পাদক আরেক গোছা কাগজ শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে বললেন
শিবনাথ দেখলেন সেটাও হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এবং গল্পটি হুবহু তাঁর দ্বিতীয় গল্প। লেখকের নাম বটুকেশ্বর দত্ত।
সম্পাদক বললেন, “গতকাল বটুকেশ্বরের স্ত্রী আমার কাছে এসেছিলেন। ওনার স্বামীর লেখা দশটি গল্পের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে। অভিযোগ করেন বটুকেশ্বরের গল্প আমরা আপনার নাম দিয়ে ছাপিয়েছি। বটুকেশ্বর গত বছর মারা যান। উনি শখের লেখক ছিলেন। এখনও অবধি ওনার কোন লেখা, কোন নামী পত্রিকায় ছাপা হয়নি। আমি ভদ্রমহিলার কাছ থেকে লেখাগুলো এই বলে চেয়ে রাখি যে, কোন লেখা মনোনীত হলে তা আমরা পত্রিকায় ছাপব। আরও একটি কথা হল বটুকেশ্বর দত্ত লেখকের ছদ্মনাম।
একটু থেমে সম্পাদক বললেন, “এই অবস্থায় আপনার গল্প দুটো আটকে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না” ।
শিবনাথ চুপচাপ কথাগুলো শুনলেন, একটিও কথা না বলে কক্ষ ত্যাগ করলেন।
***
অজিত ঘোষাল অকৃতদার। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বয়স সাতান্ন পুরো হল। অজিত সুদর্শন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারি। এখনও তার বয়সজনিত রোগগুলো যেমন – ব্লাড প্রেসার, সুগার, কোলেষ্টরল ইত্যাদি কোন কিছুই ধরেনি। অজিত পেশায় চাকুরে, একটি ছোট প্রাইভেট ফার্মে অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। অজিত ও তার দিদি লেকটাউন অঞ্চলে এক দুকামরার ফ্ল্যাটে থাকে। অজিত ও দিদি পিঠোপিঠি ভাইবোন। দিদিও বিয়ে করেন নি। তিনি পেশায় স্কুল টিচার।
অজিতের একটি বর্ণময় অতীত আছে। স্কুল জীবন থেকেই সে বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর, পাকাপাকি ভাবে পার্টির পূর্ণ সময়ের কর্মী হয়, তাত্বিক নেতা হিসাবে ভাল নাম করে। তার রাজনৈতিক জীবন ভালোই কাটছিল। মধ্য আশির দশকে পার্টি তাকে পৌরসভার কাউন্সেলর হিসাবে মনোনয়ন দেয়। তখন অজিতকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কর্মকান্ড ও লড়াইয়ে নামতে হয়। কাউন্সেলর থাকার সময়ে তার তাত্বিক ধ্যান ধারণার সঙ্গে পার্টির সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার নীতি, প্রক্রিয়ার মধ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অজিত নিজেকে কৌশলী রাজনীতিক হিসাবে পরিবর্তিত করতে ব্যর্থ হয়। সে অকালে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করে।
রাজনৈতিক জীবনে তার অনেক সাংবাদিক বন্ধু ছিল। আজ আর কারও সাথে যোগাযোগ নেই, একজন ছাড়া। সে হল সৌমিত্র মজুমদার। মাসে একদিন বা দু’দিন অজিতের বাড়ি তাদের দু’জনের পান ভোজনের আড্ডা বসে সন্ধ্যাবেলা। আজ সন্ধ্যাবেলা সেই আড্ডা হওয়ার কথা।
সৌমিত্র অনেক তাড়াতাড়ি এসে গেছে। শীতের বেলা, যদিও অন্ধকার নেমে এসেছে, ঘড়িতে সময় মাত্র সাড়ে ছটা। অজিত দ্রুত হাতে হুইস্কির বোতল, গ্লাস ও খাবার দাবার ছোটো টি-টেবিলে সাজিয়ে ফেলল।
গ্লাসে চুমুক দিয়ে সৌমিত্র বলল, “অজিত দা, সাহিত্যিক শিবনাথ নন্দী আজ দুপুরে মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল সত্তর বছর। এটা ধরুন দু’হাজার ষোলো, মানে প্রায় দশ বছর আগে দু’হাজার ছয় সালে, সাহিত্য জগৎ থেকে উনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর উনি কোলকাতা ছেড়ে কোথায় যে চলে যান কেউ জানত না। মিডিয়া তার খবর জানার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন খবর পায় নি। বেমালুম নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।
অজিত উদাস হয়ে যেন কি ভাবছে। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষন করে সৌমিত্র বলল, “জানেন তো অজিত দা, শিবনাথ নন্দী গত দেড় বছর কোলন ক্যানসারে ভুগছিলেন”।
অজিত বলল, ‘জানি’।
অভিজ্ঞ সাংবাদিকের কান কথাটা এড়ালো না। সৌমিত্র চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল – “জানি বললেন, আপনি জানতেন শিবনাথ নন্দী কোথায় ছিলেন? আমাকে বলেন নি”!
দুজনের গ্লাসই খালি হয়ে গেছে। অজিত দুই গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন, অনুপাত করে সোডা মেশালেন। সৌমিত্র সাহায্য করতে দুটো করে বরফ কিউব দুই গ্লাসে দিল।
গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে অজিত বলল, “শিবনাথ বাবু ওনার কথাটা গোপন রাখতে বলেছিলেন। এখন উনি আর নেই, তোমাকে সব বলতে পারি”।
সৌমিত্র উত্তেজনায় এতক্ষণ হাতে, ভরা গ্লাস ধরে রেখেছিল, চুমুক দিতে পারেনি। সে একচুমুক পানীয় গলাঃধকরণ করে বলল, “বলুন অজিতদা, সব খুলে বলবেন”।
অজিত বলতে লাগল, “আমার সঙ্গে শিবনাথের দেখা হয় গত বছর উত্তরাখন্ডের কংখলে। তোমরা, অর্থাৎ যারা আমার পরিচিত, সকলেই জানে নভেম্বর মাসটা আমি কংখলের আশ্রমে থাকি। একা যাই, ওখানে গেলে আশ্রমের একটা ঘর আমার জন্য দেয়। আশ্রমের আধ্যাত্মিক পরিবেশে থাকা, সাত্ত্বিক আহার ও হিমালয়ে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে কিছুদিন নিজেকে বিলিয়ে দিই। সেই উদ্দেশ্যে গত বছরও কংখল গেলাম। সকালবেলায় আশ্রমে পৌঁছলাম। অপেক্ষা করতে হল। নটায় অফিস খুললে জানতে পারলাম কোনও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না। কিছু ঘর সারানো হচ্ছে, আর বাকিগুলোর বুকিং হয়ে আছে। অফিসের কথা বিশ্বাস না করে, প্রতীক বাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। মনে আশা ছিল উনি ঠিক কোন ব্যবস্থা করে দেবেন। ওনার হাতেই আশ্রমের পুরো তদারকি, ওনার কথাতে সব কাজ হয়। প্রতীকবাবু রিটায়ার্ড মানুষ, ঘর সংসার সব ছেড়ে আশ্রমবাসী হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থার অতি উচ্চ পদে ছিলেন।
প্রতীকবাবুকে ওনার ঘরে পাওয়া গেল। স্নান আহ্নিক সেরে মন্দিরে যাওয়ার জন্য রেডি। সব শুনে আমাকে বললেন, “তুমি আমার ঘরে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি মন্দির ঘুরে আসছি”। তার পর আমরা চা, জল-খাবার খেয়ে বেরোব, তোমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
পথে যেতে যেতে প্রতীক বললেন, “তোমাকে এখন আনন্দ বাবার কাছে নিয়ে যাব। উনি আমার মতো সংসার ছেড়ে বিবাগী জীবন যাপন করছেন। ওনার নিজের ছোট বাড়ি আছে। একটু আগে ফোনে কথা বললাম, অনুরোধ রেখেছেন। তুমি থাকতে পারবে ওখানে। কোন রকম ভাড়া দেওয়া বা পয়সা কড়ির কথা ওনার সঙ্গে ভুলেও উত্থাপন করবে না। মনে রাখবে উনি উচ্চ কোটির মানুষ, আমার তোমার মত সাধারণ নন। তুমি রাত্রে ওখানে শোবে আর সারাদিন আশ্রমে থাকবে”।
কথা বলতে বলতে প্রতীক একটি বাড়ির সামনে থামল। কাঠা ছয়েক জমির উপর ছোট বাংলো প্যটার্নের বাড়ি। বাড়ির সামনে সুন্দর বাগান, ফুল আর পাতা বাহার গাছ। বাড়ি ও বাগান উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। গেট খুলে ঢুকতেই দেখা গেল, বাগানে এক ব্যক্তি গার্ডেন চেয়ারে বসে আছেন। আমরা দুজন কাছে যেতেই তিনি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। প্রতীক বাবুর দেখাদেখি আমিও তাঁকে পা ছুঁয়ে প্রনাম করলাম। দীর্ঘকায় সৌম্য দর্শন পুরুষ, মুখমন্ডল ধবধবে সাদা গোঁফ দাড়িতে ঢাকা, লম্বা সাদা চুল কাঁধ ছুঁয়েছে। উন্নত নাসা, দীঘল চোখ, মুখমন্ডলে ছড়িয়ে আছে সাধু সুলভ প্রশান্তি। দর্শন মাত্র মনে ভক্তি আসে। পরনে সাদা ধুতি, সাধুদের মত ফেরতা দিয়ে পরা, ঊর্ধাঙ্গে সাদা ফতুয়া।
আনন্দ বাবা বাড়ির দিকে মুখ করে বললেন, “লক্ষণ দুটো চেয়ার দাও এখানে”। আমরা বসলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, এবার প্রতীক বাবুর দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে মৃদু হাসলেন। আমার নাম, কোথায় থাকি, কি কাজ করি ইত্যাদি কয়টি মামুলী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। আবার ডাকলেন লক্ষণকে। আনন্দ বাবা বললেন, “লক্ষনের সঙ্গে যাও, ও তোমাদের ঘর দেখিয়ে দেবে”।
সুন্দর সুসজ্জিত বড় ঘর, লাগোয়া বাথরুম। প্রতীক বাবু ঘর দেখে রসিকতা করে বললেন, “অজিত এখানে টিভি থাকলে তো এটা ফোর ষ্টার অ্যাকমোডেশন হয়ে যেত”।
লক্ষণের কাছ থেকে জানা গেল, এই বাড়িতে এই রকম বড় ঘর তিনটি। একটি ঘর ওনার পূজার ও কাজের ঘর, আরেকটি শোয়ার জন্য। একটি ছোট ঘর আছে সেটা স্টোর রুম, সেখানে লক্ষণ রাত্রে শোয়। আমার থাকার ঘরটি গেষ্ট রুম।
আরেকটা কথা লক্ষণ বলল, “ঘরে তালা লাগাবেন না ।আমি সব সময় এখানে থাকি”।
বেশ কাটছিল দিনগুলো। সারাদিন আশ্রমে কাটাই আর রাত্রে আনন্দ বাবার নিবাসে শুতে যাই। কোন কোন দিন বেরোনোর সময় দেখি আনন্দ বাবা বাগানে বসে আছেন, আমি হাত জোড় করে নমস্কার করি আর উনি হাত তুলে আশীর্বাদ করেন।
পানীয় গ্লাসের তলানীতে ঠেকেছে, দু’জনেই লম্বা চুমুকে গ্লাস খালি করল। এবার গ্লাস ভরল সৌমিত্র।
অজিত আবার বলতে শুরু করল, “সন্ধ্যারতি ও ভোগের পর আশ্রমে রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। আমি রাত নটার আগেই নিবাসে ফিরে আসতাম। সেদিন একটু আগেই ফিরে ছিলাম, আর দুদিন বাদে এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে কোলকাতা ফিরতে হবে। ঘরে ফিরে জিনিষপত্র অল্পস্বল্প গুছিয়ে রাখছিলাম। খোলা দরজায় লক্ষণ এসে দাঁড়াল, বলল “মহারাজ আপনাকে ডাকছেন”।
লক্ষণের পিছন পিছন এসে একটি ঘরে ঢুকলাম। ঘরটি বেশ বড় আকারের, প্রায় ফাঁকা। আসবাব বলতে আছে লেখার টেবিল চেয়ার, দুটো সোফা, চায়ের টেবিল আর একটি প্রমান সাইজের স্টিল আলমারি। ঘরের এক দেওয়াল ঘেঁষে সুন্দর ঠাকুরের সিংহাসন, বাবার পূজার জায়গা।
আনন্দ বাবা সোফায় বসে ছিলেন, তাঁর মুখোমুখি সোফায় আমাকে ডেকে বসালেন। ইঙ্গিতে লক্ষণকে ঘর ছেড়ে যেতে বললেন। আমি আর বাবা একলা বসে আছ, বাবা আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। অস্ব্স্তি হচ্ছে, একবার ভাবলাম অস্বস্তি কাটাতে উঠে গিয়ে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করি অথবা আমিই মুখ খুলি, কেন ডেকেছেন জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু যেন সম্মোহিত হয়ে বসে আছি, কিছুই করতে পারলাম না।
মুখ খুললেন আনন্দ বাবা, “তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি একটি উইল বানাচ্ছি তাতে তোমাকে উইটনেস থাকতে হবে”।
একটু ভেবে নিয়ে আমি বললাম, “বাবা, আমি তো আপনাকে চিনি না, মানে সেই রকম ভাবে চিনি না। আপনি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন তো”।
আনন্দ বাবা বললেন, “সে তো ঠিক কথা। আমারই উচিত ছিল প্রস্তাবটা দেওয়ার আগে নিজের পরিচয় দেওয়া। আমার নাম শিবনাথ নন্দী। পূর্বাশ্রমে আমি লেখক বলে পরিচিত ছিলাম”।
আমার তখন যে অবস্থা, তা মুখে বলা অতীব কঠিন। উনি শুধু বিখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক নন, আমার প্রিয় সাহিত্যিক, আমাদের লেকটাউনের বাসিন্দা। সবচেয়ে বড় কথা ওঁর স্ত্রী ছিলেন আমার দূর-সম্পর্কের দিদি। নিজের কোন ভাই ছিল না বলে আমাকে ভাই-ফোঁটা দিতেন। এক সময় প্রায়ই ওনার বাড়ি যেতাম।
মনের মধ্য যে প্রশ্নটা তোলপাড় করছে তাকে প্রকাশ করা যাচ্ছে না, মনের সংযম ও সহবৎ তাকে আটকে রেখেছে। সকল বাধা দূর করে বলে বসলাম, “আপনার লেখা অনেক দিন পাই না কোথাও”।
আনন্দ বাবা কোন উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “সাড়ে নটা বাজতে চলল, আমাকে শুতে যেতে হবে”।
যেদিন থেকে এখানে এসেছি সেদিন থেকে প্রতিদিন লক্ষণ ঠিক সকাল সাতটায় এক কাপ চা আর দুটি বিস্কুট আমাকে দিয়ে যায়। আজ চা, বিস্কুট দিয়ে সে বলল, “আজকে রাতের খাওয়া আপনি মহারাজের সঙ্গে খাবেন”। আটটার মধ্যে চলে আসবেন।
একটি ছোট ডাইনিং টেবিলে বারান্দায় আমরা দুজন খেতে বসেছি। ভাত, ডাল, ভাজা আর আলু পটলের তরকারি। আনন্দ বাবার খাবার অন্য রকম। একটি বড় জাম বাটিতে খিচুড়ি বা ডালিয়া গোছের কিছু খাদ্য দ্রব্য, উনি চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাচ্ছিলেন।
খাওয়ার পরে আমরা আবার ওনার কাজের ঘরে বসলাম। উনি বললেন, “আমি আত্মগোপন করে আছি, আমার আসল পরিচয় প্রতীক ছাড়া আর কেউ জানে না”। এখন তুমি জানলে। তুমি এই তথ্য আমার জীবিত অবস্থায় কাউকে জানাবে না। আমি বললাম, “আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন”।
উনি বলে চললেন, “আজ আমি যে ঘটনা বলছি, সেটা আগে কেউ কোন দিন শোনেনি। অবিশ্বাস্য ঘটনা। হয় তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে, নয় আমাকে চোর মনে করবে”।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, হতবাক হয়ে ওনার কথা শুনে যাচ্ছি।
আনন্দ বাবা বলে চলেছেন “দু’হাজার ছয় সালে, পুজোর পর আমি পত্রিকায় তিনটি গল্প দিই। তার একটি ছাপা হওয়ার পর পত্রিকা অফিসে এক ভদ্রমহিলা সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে বলেন, গল্পটি তাঁর মৃত স্বামীর লেখা এবং সেটা আমার লেখা বলে চালানো হয়েছে। ভদ্রমহিলা প্রমাণ হিসাবে তাঁর স্বামীর হাতে লেখা পান্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার তার মধ্য দুটি গল্প ছিল যে দুটি ছাপার জন্য জমা দেওয়া ছিল এবং পাক্ষিকে তখনও প্রকাশিত হয়নি। তারা হবহু এক ছিল, মায় দাড়ি কমা শুদ্ধু। কিন্তু আমার থেকে বেশি কেউ জানতো না যে, ওই গল্প তিনটির প্রতিটি শব্দ আমার সৃষ্টি। সম্পাদক মহাশয় ডেকে যখন এই অভিযোগ করলেন, যখন আমাকে পান্ডুলিপি গুলি দেখালেন, তখন আমি একটা কথাও ওনাকে বলতে পারিনি। অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসলাম। স্ত্রীকে মানে তোমার নীতাদিকে সব খুলে বললাম। কি করে এই ঘটনা ঘটল তার কোনও উত্তর আমরা কেউ খুঁজে পেলাম না।
পরদিন রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকা অফিসে, চিঠিতে অনুরোধ জানালাম আমার যা কিছু বকেয়া আছে তা যেন আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। সেই দিনই ফ্লাইটে আমরা দুজন দিল্লী হয়ে চলে আসলাম হরিদ্বারে। কিছুদিন পর কংখলের এই বাড়িটা কেনা হল। একমাত্র ছেলে, তুমিতো জানো আমেরিকাবাসী, সে জানল, বাবা মা সংসার ছেড়ে বিবাগী জীবন যাপন করছে। তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়, কিন্তু তাকে দেখা করতে বারণ করা আছে।
আনন্দ বাবা প্রশ্ন করলেন – তুমি অতীন্দ্রিয় ঘটনা বিশ্বাস কর?
আমি বললাম – বিশ্বাস করার মত জীবনে কিছু ঘটেনি, তাই বিশ্বাস নেই।
আনন্দ বাবা বললেন – ঠিক কথা বলেছ।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে উনি বলতে শুরু করলেন।“হরিদ্বারে আসার মাসখানেক পরের ঘটনা। আমরা তখন যোশীমঠে এক আশ্রমে থাকি। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে নানা ব্যস্ততায় কাটে, কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় মানসিক যন্ত্রনা, বিনিদ্র রজনী প্রায় মধ্য রাত অবধি। রাতের খাওয়া খেয়ে বিছানা নিয়েছি। আধো নিদ্রায় আচ্ছন্ন, ….কোন সুদূর থেকে ডাক আসছে …শিবনাথ, শিবনাথ। মশারির পাশে আমার পায়ের দিকে আবছা মনুষ্য অবয়ব যেন দেখতে পেলাম। মুখ দেখে চেনার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে মুখ চেনার মত প্রকট হচ্ছে না। সারা শরীর মনে স্তম্ভন, জিজ্ঞেস করতে চাই ‘কে আপনি’, গলা থেকে স্বর বেরোয় না। শিবনাথ, আমি অনিন্দ্য, তোমার স্কুলের বন্ধু, বাজারের মোড়ে আমাদের বইয়ের দোকান ছিল। মনে আছে স্কুলের ম্যাগাজিনে তোমার আর আমার গল্প বেরোত। আমি লিখলেই তোমাকে পড়াতাম। তুমি বলতে আমি একদিন নাম করা লেখক হব। শিবনাথ, আমি অনেক লিখেছি কিন্তু নাম করা লেখক হতে পারিনি। শিবনাথ তোমার হৃদয় অনেক বড়। আমায় ক্ষমা করো। তোমার এ অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি তোমার মন কে দখল করে গল্প তিনটি লিখিয়েছি। আমার স্ত্রীকে দোষ দেব না। উনি আমার সব গল্প লেখা হলে পড়তেন। আমাকে না জানিয়ে বিখ্যাত পত্রিকায় পাঠাতেন। মাস যায়, বছর যায়, অপেক্ষা করতেন। যদি একটিও কোন নামী পত্রিকায় বেরোয়, যদি আমি স্বীকৃতি পাই। শিবনাথ আমি খুব অন্যায় কাজ করেছি। আজ আমি তোমাদের জগতে নেই। তুমি আবার লেখা শুরু কর।
শরীর মনে সাড় ফিরে আসছে, মনুষ্য অবয়ব মিলিয়ে গেছে। বিছানা ছেড়ে ঘড়ি দেখলাম – রাত সাড়ে তিনটে।
আনন্দ বাবা এতদূর বলে চুপ করে রইলেন। আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে বসে আছি।
ঘড়িতে রাত নটা কুড়ি বাজে। উনি বললেন, “কাল দশটার সময় উকিল উইলের কাগজ পত্র নিয়ে আসবে”। তুমি থেকো, প্রতীকও আসবে।
উইলে আনন্দ বাবা ওনার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তাঁর অবর্তমানে কোলকাতার এক মিশনকে দান করেছিলেন।
আশ্রমে যাওয়ার পথে প্রতীক বাবু জানিয়ে ছিলেন যে, আনন্দ বাবার কোলন ক্যানসারের শেষ স্টেজ চলছে, আর হয়তো মাস ছয়েক বাঁচবেন।
অজিত বলল, “এই হল শিবনাথ নন্দীর পুরো কাহিনি। সৌমিত্র তুমি ঘটনাটা লিখে কালকের কাগজে ছাপিয়ে দাও”।
সৌমিত্র বলল, “আমি লিখতে পারি কিন্তু এডিটর ছাপবে না”।
Arunlekha Sengupta
Buddy crawled fast and steady through the corridor and reached his ‘unsun. To us the gait might have seemed funny, but the residents of K1 around Buddy all crawled in the same way. The once marbled floor was now unrecognizable after a century or so of encroachment by humanity. The throng of survivors had muddied and sullied the once hallowed halls of what was now known as K1. Buddy gathered all the belongings that he had on this grey planet and tried to go to sleep. The ‘unsun was a prized crawlspace and he knew he was lucky to still have it after his ‘ma and ‘ba had jumped the air. He tried to sleep despite the noise around him. The little harrys and emmas were crawling all over K1 like little ants. Food gathering ants. Moss and mushroom grew in the underground and the harrys and emmas fought amongst each other to take the food prize back to their ‘mas and ‘bas. Their old families in all the nooks and crannies in K1 waited for their harrys and emmas. Each family fought each other for space and survival.
Buddy tried to sleep despite the noise around him. There was an uneasy feeling in his stomach and heart. He had been noticing lately that the little harrys and emmas were little no more. They had been growing taller and stronger. When they crawled they looked like a gang of wild animals that his ‘ma used to tell him stories about. Suddenly Buddy realized that there was a silence around him. The complete dearth of sound was more fearsome than the previous animal-like din. Buddy tossed and turned for some time and then just gave up on sleep for the night. Buddy decided to go and see what the harrys and emmas were up to.
Buddy crawled out of the space and hurried forward on his hands and knees. He crawled out and peeped into every nook and every cranny and crawlspace but there was no sign of a harry or an emma. Buddy went to the next level in search of them.
Every level of K1 had a different clan of survivors and usually no one went where they didn’t belong. There had been a strict law from the time of the ‘shroom in the sky, which changed to a laxer social rule after the war of levels.
Buddy wasn’t used to crawling up the stairs, but he thought to himself, if the harrys and emmas could do it, so could he. Unused to stairs, Buddy made a slow work of it. By the time he reached level 2, there was no light anywhere. All Buddy could hear around him was a few low growls and a strange slurping noise. The noise was so inhuman that even a post-apocalyptic man like Buddy had shivers up and down his spine. There was an eerie silver light a little far away. Buddy slowly crept to the silver light and a crawlspace that smelt like death and decay. And of madness.
Buddy reached the silver light and slowed down. From close by the silver light was bright. Too bright for the ground level Buddy. He squinted and waited as his eyes adjusted. By the time he could see again, he saw a tableau of monstrosity in front of him. At first Buddy couldn’t understand what he was looking at. There was a ‘ma on the floor and red was oozing out of her chest and stomach. At the stomach, all the harrys and emmas were feasting. There was slurping and chomping and scratching noises. And there was giggling. The smell of death was strong here. The smell of madness and hysteria was even stronger.
Buddy hid behind the blue, rotted ‘nekin and looked at the horror movie in front of him in terror. He looked back at the face of the ‘ma. She was not yet dead. She was living and those little monsters were feeding on her and growing bigger and stronger than the rest. They were eating her as she lived. The ‘ma was looking straight at Buddy now. Buddy wanted to reach out to her and help her, but he was stuck to his spot. The ‘ma was moving her lips, but no word came out of her mouth. She mouthed words to Buddy and he tried to understand what she was saying, but the levels had different languages and this ‘ma was clearly from the ‘udcot upstairs. Buddy shook his head and started to cry. His insides gave out at last and yellow water leaked out of him. He tried to back out of his corner but the ‘nekin behind him gave out and fell down. The sound alerted the monsters.
Buddy rushed out from his hidden place and crept out. He tried to hurry down the stairs, but it was even more difficult to go down than climb up. The biggest harry was now behind him. Harrys and emmas were used to this and had no problem going up and down the stairs. They were starting a chant now. Buddy had a lead of a few moments and he went back to the ‘unsun. Once in, he realized that he was now trapped. And now this beloved ‘unsun will not save him. He went back to the image of the ‘ma the harrys and emmas had preyed on and something struck him. He wanted to wait and think but he felt it in his bones that the the mob was stirring and they were calling for his life’s red.
Buddy tried to clear his mind and jumped out of the ‘unsun. The survival instincts of his ancestors that had saved humanity all those years ago kicked in. Buddy crawled out at break-neck speed. He glanced back once and saw that the pack of cannibalistic harrys and emmas were just about 20 feet away. They were large in numbers. All around them the ‘mas and ‘bas looked on. Some were sad and scared, but most had given up. Their progeny had found a way to grow stronger and if that meant giving up their own lives, then that was how it was going to be.
Buddy sped towards the exit. The unmentionable, untouchable exit door was now right in front of him. He turned back once more. The shiny white mob was now just a few feet away, but some of them faltered now that Buddy was so close to the door that kept them safe in the K1 and away from the toxic waste that was the rest of the grey planet.
Buddy held on to the latch and tried to stand. The crowd stopped. Scared. Amazed. No one had stood straight in the last couple of centuries.
Buddy pulled himself up and with wobbly thighs and calves, he stood. Buddy now looked at them from above. The mob around him stared, pale and speechless. Buddy felt a strange relief in his back and spine. And something glowed from within. Suddenly he knew what he had to do. Suddenly he understood what the dying ‘ma had been trying to say to him. She had looked different, Buddy realized. She looked burned by the Sun.
Buddy pulled the hatch and opened the door as the crowd screamed ‘Nooooooo’, the only word they all knew across all the levels.
***
There was a big new tree amidst the grassy plains. The leaves shined emerald and a big silvery glow emanated from someone sitting at the foot of the tree. A crowd was gathered around the tree. Their faces were peaceful and happy. It looked like they were meditating.
The newcomer sat next to a tall boy.
“Who is that man?” He asked the boy called Harry.
“He is our savior. He saved us from ourselves. He opened our eyes to a new, better world.” Harry said.
The newcomer looked at the glowing man in front of him. A peaceful smile adorned his face.
Harry turned to the newcomer once again.
“We think his name is Budda”.
Illustration by Aditi Chakraborty