ইশকিয়া

সোমা ঘোষ (চক্রবর্তী)

ইটালির কথা ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভাবছি। ঐতিহাসিক শহর রোমের বর্ণনা দিয়ে নাকি রোমান্টিক বর্ণালী জল-শহর ভেনিসের গন্ডোলা রাইডের অভিজ্ঞতা দিয়ে। নাকি রেস্তোঁরার সেই মিষ্টি হাসির মেয়ে অ্যান-এর আখ্যান শোনাব, যে রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে আলাপ করে অতি যত্ন সহকারে নিজের রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে বীফ লাজানিয়া খাইয়েছিল। তারপর থেকে দুবেলা আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত অপেক্ষায়, কখন পার করব ওর পথ? সেই যে গ্রীক গডের মত সুন্দর সুঠাম এবং ততটাই সুন্দর মনের মানুষ ড্রাইভার রোনালদিনো’? তার কথা বলব? যার কাছে ইংরাজি ‘ডিফিকাল্ট’ শব্দের প্রতিশব্দ স্ট্রং? নাকি বলব, দীর্ঘ দেড় হাজার বছর ছাইএর নীচে চাপা পড়ে থাকা তিন হাজার বছরের পুরনো শহর পম্পেই এর মৃত্যু মূহুর্তে থমকে থাকার ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার কথা! ক্যাপ্রি নামের সেই গভীর নীল দ্বীপটা? যার সীমানা জুড়ে অদ্ভুত সাদাটে পাথুরে পাহাড়ের সারি, যার পায়ের কাছে গিয়েই হঠাতকরে সমুদ্রটা আরও স্বচ্ছ আরও অভাবনীয় অবাস্তব সবজে নীল হয়ে উঠল! একেবারে হলিউডি রূপকথা ছায়াছবির সমুদ্রের মত মায়াবীসুন্দর!  আমাদের বোট একের পর এক প্রাকৃতিক আর্ক ফুঁড়ে ফুঁড়ে সবাইকে যেন অন্য গ্রহের এক স্বপ্নজগতে নিয়ে চলেছিল!

ম্যাঞ্চেষ্টার এয়ারপোর্ট আমাদের বাড়ির লাগোয়া বললে অত্যুক্তি হয়না। তবু উড়ানের দুঘন্টা আগে পৌঁছে গেছিলাম। কস্টা’য় কফিসহ ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে যথাসময়ে প্লেনে চাপলাম দুই পুত্র এবং বরকে বগলদাবা করে।

আমাদের সেদিনের যাত্রার অন্তিম গন্তব্য ছিল নেপলস। দক্ষিণ ইটালির ছোট্ট একটা শহর। জেনেছিলাম নেপেলস শহর রোম থেকে তীব্রগতি (৩০০কিমি/ঘন্টা) ট্রেনে মাত্র দেড় ঘন্টার পথ। এই শহর কে কেন্দ্র করে আমরা বাকি শহরগুল ঘুরব এমনি প্ল্যান। পাঁচদিন পর নেপলস ছেড়ে শেষ দুটো দিন ভেনিসে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। আমরা ইন্টাররেল পাস কিনে নিয়েছিলাম দ্রুতগতিতে ইটালির শহরগুলয় যাতায়াতের জন্যে। ইন্টাররেল পাস যথেষ্ট দামি হলেও অনেকগুলো শহর কভার করতে গেলে আলাদা করে টিকিট কেনা অনেক বেশী খরচসাপেক্ষ হয়ে যায়, তাই আখেরে সাশ্রয়। যাইহোক,আমাদের মনে হয়েছিল আমরা বিকেল ৪ টের দিকে হোটেল ঢুকে যেতে পারলে পাঁচটার দিকে পম্পেই রওনা দেব। তাহলে পরদিন এ্যামালফি কোস্ট, সরেন্টো, পোসিটানিও এই কোস্টাল পয়েন্টগুল দেখা যাবে। কিন্তু বিধি বাম। আজ সেই গপ্পটাই নাহয় করা যাক।

প্লেনে উইন্ডোসাইড সীটটা ছোটোজন দখল করল,কারণ এই আড়াই ঘন্টার যাত্রাপথে সিনেমার ব্যাবস্থা নেই। ওর সাথে কিছুটা বায়নাক্কা করে যখন দেখলাম লাভ হলনা উপরন্তু লোকজন কিঞ্চিত বিস্মিত দৃষ্টি দিচ্ছে এই আধ-দামড়া মহিলার হাব ভাব দেখে,অগত্যা মাঝের সীটে বসলাম। বেশ রোদ ঝলমলে আকাশে ফুরফুরে মুডে চলেছি,পার হয়েছে ঘন্টা দেড়েক,এমন সময় পাইলট এনাউন্স করল- ‘আমরা এখন আল্পসের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পরে ডান দিকে মাউন্ট ব্ল্যাঙ্ক (মঁ ব্লঁ,আল্পস এর উচ্চতম শৃঙ্গ) দেখা যাবে। পারলে তখন ছেলেকে মেরে ধরেই সরাই। তবু লোকসমক্ষে,‘বেবি, প্লীজ সুইচ আওয়ার সীটস’। বিশ্বওঁচা বেবি বললে,‘নো আই উইল সী দ মাউন্টেইন’। দাঁত কিড়মিড়ানি চেপে মুখে হাসি বজায় রেখেই বললাম,‘বাট আই হ্যাভ টু টেক সাম পিকচার্স ফর ইওর ‘শো এন্ড টেল’এট স্কুল,বেবি!’তার উত্তর,‘মা, হু টেইক ইওর পিকচারস  অফটেন, হুহ? গিভ মি দা ক্যামেরা।‘জনান্তিকে বলে রাখি,আমার ফোটোশুট এর একমাত্র সহায় সম্বল এই ছোটো পুত্র। বড় পুত্র বা বরকে একটার বেশী দুটো ছবি তুলতে বললে,পারে তো দা কাটারি নিয়ে তেড়ে আসে। অগত্যা চেপে বসে গেলাম মুখ ব্যাজার করে।

কিন্তু ছেলে যখন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে বল্ল, ‘মা, লুক আউটসাইড’… আমি তার গায়ের ওপর দিয়েই হুমড়ি খেয়ে জানলার দিকে চেয়ে দেখি-  যতদুর চোখ যায় তুষার ঢাকা শৃঙ্গের সারি।  জানিনা প্লেনের উচ্চতা ৪০০০ ফুট থেকে কিছু নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল কিনা, কিন্তু তুষারাবৃত চড়াই আর ঘন আঁধার উতরাই ঢেউএর বিস্তার নিয়ে ভারি স্পষ্ট ভাবে পাহারগুল ঝিমঝিমে নীল আকাশের গায়ে মিলিয়ে যাচ্ছে,দেখছিলাম। অন্তত বিশ পঁচিশ মিনিট জানালায় ওই উৎকট ভঙ্গিমায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বড় ছেলে পেছনের জানলা থেকে বেশ অস্বস্তিমাখা স্বরে বলল,‘এবার তো বস।‘তখনও কালো পাহাড়ের পেছনে রূপোলী পাহাড়েরা সরে সরে যাচ্ছে অতি ধীরে। আশাতিরিক্ত প্রাপ্তিতে মন ভরপুর হয়ে গেল!

বাক্সপ্যাঁট্রা পেয়ে যাবার পর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে রোম এয়ারপোর্ট ছাড়তে ছাড়তে বেজে গেল আড়াইটে প্রায়। রোমা টার্মিনি,রোমের মেইন রেলওয়ে স্টেশনে এসে ইন্টাররেল পাস কেনার পালা। ভেবেছিলাম সে কাজ হবে- ‘টাকা দাও আর হাতে নাও’টাইপ। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম,দেশের ন্যাশলাইজড ব্যাঙ্কগুলোর মত হাতে ধরিয়ে দিল নাম্বার লেখা একটা স্লিপ। যেখানে কিউতে ত্রিশ জনের পরে ডাক। আর এক একজনের মিনিট দশেক করে সময় লাগছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম,ওদিন পম্পেই দেখার প্ল্যান তো মায়ের ভোগে গেল! যাকগে যাক, নেপলস শহরটাই ঘুরে দেখা যাবে। তবে হোটেলে পৌঁছতে হবে সাতটার মধ্যে। থুড়ি হোটেল নয়,রিসর্ট। যেখানে সন্ধ্যে সাতটার পর রিসেপশন বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের চাবি দেবার আর কেউ থাকবেনা দেরী হলে।

তা যাইহোক,টিকিট কিনেটিনে ট্রেনে চেপে বসে তো দিল একেবারে ঝিঙ্কাচিকা। যেমনি ট্রেনের রংরূপ (একেবারে ফুলটু ঝক্কাস),তেমনি দুপাশের ঘন সবুজ পাহাড় রূপের পসরা নিয়ে তীব্র বেগে পেছনে ছুটে যেতে যেতে কখনও দূরে যাচ্ছে কখনও কাছে সরে আসছে। কোথাও চোখে পড়ছিল সবুজ পাহাড়ের পেছনে বরফ ঢাকা পাহাড়ের ঝিলমিলে রেখা। তার ফাঁকে ফাঁকে আঙুরের অর্চারড অথবা হলুদ ক্ষেত কিংবা জলপাই বাগান কে যেন গুঁজে দিয়ে গেছে।

তাপমাত্রা ১৭/১৯ ডিগ্রীর মধ্যে বলে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা হল ক্লান্তি এসে জুড়ে বসতে অবসর পায়না। ভাবছি সাড়ে ছ’টার মধ্যে নেপেলস পৌঁছে যাব,তাহলে হোটেলে সাতটার মধ্যে অবশ্যই ঢুকে যাব। কারণ বলা হয়েছিল ঘন্টা দেড়েকে রোম পৌঁছোন যাবে হোটেল থেকে। তাই চিন্তা না করে ট্রেন যাত্রাটা আপাতত উপভোগ করা যাক।

সব ভালর শেষ আছে। আমাদের যাত্রাপথের একটা ঘন্টা উবে গেল কোথা দিয়ে। মনে এই আনন্দ নিয়ে নাবলাম যে আগামী চারটে দিন এই পথে যাতায়াত জারি থাকবে।

দেখে মনে হল না নেপেলস ছোটো শহর,বিশাল স্টেশন,স্টেশনস্ত দোকানপাট সব ধোপদুরস্ত- এলাহি ব্যাপার। আবার বাক্সপ্যাঁট্রা বর ছেলেপুলে সমেত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। লাইনে দাঁড়াতে বেশ জলদিই আমাদের টার্ন এল। ড্রাইভারকে দেখানো হল আমাদের আবাসের ঠিকানা। ড্রাইভার বলল ২০ মিনিট ড্রাইভের পর ফেরী। আমরা বললাম,ফেরী চাইনা আমরা পুরো পথটাই ট্যাক্সিতে যাব। উত্তরে ড্রাইভার বললে, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ উইংস!’ উত্তর শুনে আমি আর বর চোখ চাওয়াচাওই করলাম। বলে কি …  ব্যাটারা মোটেই ইংরিজি বোঝেনা ভুল ভাল বকছে। ওকে ফেলে এগিয়ে চল্লাম অন্য ট্যাক্সির উদ্যেশ্যে। সেই ড্রাইভার তুলনামুলক ভাল,কিছুটা ভরসাযোগ্য ইংরিজি বলে। বলল, ‘দ্যাট উদ বি ভেরি স্ত্রং’। আগেই বলেছি এঁর কাছে স্ট্রং মানে ডিফিকাল্ট। পরবর্তীতে আমাদের সারথীর ভুমিকা যথার্থ ভাবে পালন করেছে এই হ্যান্ডসাম ইতালীয় যুবক।

ওর কথাবার্তা শুনে যা বোঝা গেল,এই রিসর্টটি একটি দ্বীপে অবস্থিত। যেখানে হাই স্পীড ফেরীতে পৌঁছতে লাগবে দেড় ঘন্টা। তাও নির্ভর করবে সমুদ্রের আবহাওয়ার ওপর।

এবং লাস্ট ফেরী ছাড়বে ৭টায়,ফেরী ঘাট পৌঁছতে লাগবে ২০ মিনিট। তারপর টিকিট কাটার কিছুটা সময়,শেষ ফেরী পাওয়া প্রায় অসম্ভব। চমক ভাঙ্গার আগেই গাড়িতে বসে লাগাও তাড়া,‘হারি আপ প্লীজ। ফেরী ঘাটে নেমে বর ছুটল টিকিট কিনতে- আমরা লাগেজ নিয়ে ল্যাজে গোবোরে হয়ে অসহায় ভাবে ছুটোছুটি করে বোঝার চেষ্টা করছি গোটা সাতেক জেটির মধ্যে ঠিক কোনটাতে আমাদের ফেরী বাঁধা।

যাইহোক অবশেষে ফেরীতেও বসা হল এবং যথা সময়ে ভেঁপু বাজিয়ে যাত্রাও শুরু হল। লাগেজ টাগেজ রেখে প্রায় ফাঁকা ফেরীতে গুছিয়ে বসলাম। বাইরে তখন দিব্য দিবালোক। মেঘলা আকাশ,সমুদ্র কিছুই আর শিহরণ জাগাচ্ছেনা,এতটাই অবসন্ন বোধ করছি। ইতিমধ্যে ৭টা দশ বেজেছে,তড়িঘড়ি ফোন করা হল রিসর্টে আমাদের বিলম্বের খবর জানাতে। গোটা আষ্টেক কলের পরেও অন্যতরফ নিরুত্তর। ফোন বেজে গেল। সুতরাং রিসর্টে খবর দেওয়া গেলনা।

অজানা নির্জন দ্বীপে,রিসর্ট বন্ধ হয়ে গেলে রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মিলবে কোথায় সেই দুশ্চিন্তায় দিশাহারা লাগছিল। এরমধ্যে লোকজনের সাথে কথা বলে আরও কিছু আশঙ্কাজনক তথ্য পেলাম-  ইশকিয়া নামের রিমোট এই নির্জন দ্বীপে খুব অল্প লোকের বাস। তিন ঘন্টা পর পর নেপেলস থেকে আসা যাওয়ার ফেরী। সুতরাং ওখানে পৌঁছনোর অর্থ বাকী দুনিয়া ভুলে ইশাকিয়ার ইশকেই মজে থাকা।

হিলটন হলিডে টাইমশেয়ার কেনা আমাদের। ওরাই নেপলসে আমাদের হোটেল বুক করেছে। তা যে আদৌ নেপলস এ নয়, একটা নির্জন দ্বীপে সেই তথ্য আমাদের একেবারেই আজানা। উপরন্তু ওদের ইনফর্মেশন অনুযায়ী আমাদের হোটেল থেকে রোমের দূরত্ব মাত্র দেড় ঘন্টা।

তবে? কি হবে আমাদের বাকি প্ল্যানের? এই যে এত টাকা দিয়ে কাটা হল আট দিনের ইন্টার রেল পাস? তার সাথে রোম শহরের বেশ কিছু মিউজিয়াম, কলোসিয়াম ইত্যাদি দেখার জন্যে কেনা হল অমনিয়া পাস? এত এত প্ল্যান সব স-অ-ব জলে গেল? বেড়াতে আসার সবটুকু মজাই কেমন ব্লটিং পেপারে তরলের মত কেউ কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ শুষে নিয়েছে মনে হল।

মন খারাপ নিয়ে চারটে প্রাণী তখন ভাবছি কোনোমনে থাকার একটা ঘর যেন জুটে যায়। কারণ রাতে নেপলস ফেরার কোনও সুযোগ আর নেই। কিন্তু কপালের লিখন আরও খারাপ।

আধ ঘন্টা পার হতেই হঠাত সমুদ্র উঠল ফুঁসে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল সামনের জলরাশি। বোটটা খ্যাপা ষাঁড়ের মত উথাল পাতাল দুলতে লাগল। আমরা মোটেই ডিঙি নৌকো টাইপের ছোট খাটো কিছুতে যাচ্ছিলামনা। দুটো ফ্লোর মিলে তিনশো সীট আছে এতোটাই বড় এই নৌকো। এবং সজ্জায় রীতিমত আধুনিক।

এই উঠে যায় কত্ব উঁচুতে আবার ধপাস করে পড়ে। গোটা শরীরে কি অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত এক দুলুনি, মনে হচ্ছিল পেটের ভেতর থেকে সব পাকিয়ে নিয়ে বের করে আনবে। আমি আর ছোটো ছানা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নিত্য যাত্রীরা অব্দি বেশ শঙ্কিত বোঝা যাচ্ছিল। আর আমি তো ভীতুর ডিম। ভাবলাম,এই ছিল কপালে? এভাবে সলিল সমাধি?

যাইহোক সব ভালোর যেমন শেষ আছে,খারাপেরও আছে। এই ভয়ংকর দুলে দুলে ওঠা-পড়াও এক সময় শেষ হল। আমাদের বোট তীরে এসে ভিড়ল। সেই জেটিতে আমাদের বোটের গুটিকয় যাত্রী ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না। বেড়িয়ে দেখলাম দুসীটের ছোটো ছোটো কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে,যারা যাত্রী নিয়ে ফেরীঘাট বেবাক খালি করে কেবল আমাদের রেখে চলে গেল। আমরা বাদে বাকি যাত্রীরা কুলিয়ে গেল এমনি মাপে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। অনুমান করলাম এই গাড়িদের ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়েছে।

দু একজন ড্রাইভারকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা দেখাতে কিছুই না বলে নিজেদের যাত্রী নিয়ে চলে গেল। একজন ড্রাইভার শুধু বললে,‘আই উইল সেন্ড আ ট্যাক্সি ফর ইউ’। একটু ভাবুন কি অসহায় ভাবে একটা নির্জন দ্বীপে আমরা চারজন। প্রাণে বাঁচলাম বটে কিন্তু চুড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা একটা সেকেন্ড অপেক্ষা করে চলেছি ট্যাক্সির আশায়। অদূরে গোটা তিনেক ঝাঁপ বন্ধকরা দোকান। বৃষ্টি থেমে গেছে বটে,তবে ঠান্ডাটা জমিয়ে পড়েছে। সামার জ্যাকেট আর কাজ করছেনা।

কিন্তু ট্যাক্সি এল অবশেষে। এবং ড্রাইভার ঠিকানা দেখে বলল পাহাড়ি রাস্তায় চল্লিশ মিনিটের পথ। আর তখন কিছুই ভাবছিনা,আমাদের একটা ছাদ চাই শুধু। আরও একটু অপেক্ষা নাহয় করলাম। ছোটোটা ট্যাক্সিতে আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পাকদন্ডী বেয়ে আমরা উঠে যেতে থাকলাম আমাদের হোটেলের দিকে। বিরক্তির সাথে ভাবছি,কারো মাথায় আসে কিকরে এমন জায়গায় হোটেল বানাবার কথা!!

রাস্তাঘাট যদিও একেবারে টিপটপ,যেমন ইউরোপের যেকোনো জায়গায় হয়। বেশ কিছু বাড়িঘর দোকানপাট,পথে লোকজন,ছোট্ট ক্যাফে চোখে পড়তে মনে হল, যাক একেবারে গোবিন্দপুর নয়। ঘর পেলে একটু খাবারও জুটে যেতে পারে। ততক্ষণে খিদেটা চাগাড় দিতে শুরু করেছে।

এতক্ষণে আমরা গল্পের ক্লাইম্যাক্সে এসে পৌঁছেছি।  রিসর্টের সামনে নামলাম। একটা খাড়া ঢালু রাস্তা বেয়ে গাড়িটা দাঁড়াল একটা আধো অন্ধকার হট সুইমিং পুলের পাশে।  রিসেপশন লেখা জায়গায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দরজা লকড। তিনটে খাড়া পায়ে চলার পথ ওপরে উঠে গেছে,সেদিকেই বিল্ডিং মনে হচ্ছে। আলো এত কম যে পুরো জায়গাটাকেই আন্দাজে ধরে নেওয়ার চেষ্টা। এসব দেশে আলো নেভানোর রীতি নেই। বড় বড় দোকান কাঁচের দরজার ভিতরে আলোকিত হয়ে রাত কাটায়। আথচ এই বেয়াক্কেলে রিসর্টের রিসেপশন অন্ধকার।  বর বেচারা ফোনের পর ফোন করছে আর রিং টোন ওই অন্ধকার রিসেপশন থেকে আমাদের কানেই ফিরত আসছে। এ কেমন আধো অন্ধকার ভুতুড়ে এক জায়গায় এসে উঠলাম আমরা! জনমনিষ্যির নামনিশান নেই। ভয়ে শীতে গা ছম ছম করছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যখন গাড়ি ঘোরাচ্ছে ছুটে গিয়ে জানতে চাইলাম,কি করব? সে ইটালিয়ান ভাষায় কিছু একটা বলে চলে গেল। ইচ্ছে করছিলাম ডাক ছেড়ে ভ্যাঁ করে কাঁদি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় একেই বলে! আমরা স্থাণু হয়ে ওখানে আটকে গেছি। পরে কি হবে কিছুই জানিনা। কিছু সময় এভাবে কেটে গেল!

হঠাত শোনা গেল নারী পুরুষের কন্ঠস্বর ওপর থেকে নেমে আসছে। প্রায় ‘ইউরেকা’ বলে বর দৌড়ে গিয়ে পাকরাও করলে কন্ঠস্বরের মালিক মালকিন দের। তিন আমেরিকান বৃদ্ধ বৃদ্ধা রেস্টোরান্টে খেয়ে ফেরত আসছে। বললে, ‘ ম্যানেজার চলে গেছে সাতটায়, নো সার্ভিস আফটার সেভেন, তবে রেস্টোরান্টে স্টাফ আছে হয়তো তোমাদের সাহায্য করতে পারে।’

এই বলে তারা নিজেদের রুমের দিকে চলে গেল। বড়পুত্র সবে  দিকে হাঁটা দিয়েছে রেস্টোর‍্যান্ট- পানে,দেখা গেল ওপর থেকে হুডপরা একজন নেমে আসছে।

যাক,কাজের শেষে এর কাছে চাবি দিয়ে গেছে আমাদের ম্যানেজার। ট্যাক্সির আওয়াজ পেয়ে খবর নিতে এসেছে আমরা এসেছি কিনা।

অবশেষে আমরা রুমে পৌঁছলাম।  তখন রাত প্রায় দশটা। কিছুক্ষণের মধ্যে বড়পুত্র আর বর মিলে গরম গরম অমৃতসমান পিত্জা নিয়ে এল। পিত্জার ডো মাখা থেকে শুরু করে সবটাই ওদের চোখের সামনে। পিত্জা তৈরী হবার ফাঁকে বর এক্সপিডিয়াকে ফোন করে পরদিন থেকে চার রাতের জন্যে নেপেলসে হোটেল বুক করে ফেলল। ইশকিয়া গোল্লায় যাও এমন একটা ভাব।

এরকম ফ্রেশ পিত্জা আগে পরে আর কোনওদিন খাইনি। কি যে সুবাস! ইটালিয়ান রেড ওয়াইন সহযোগে তাকে গলঃধকরণ করে একটা দুধসাদা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম! আঃ শান্তি।

পরদিন ঘুম ভেঙে পর্দা সরিয়ে দেখি অদ্ভুত সুন্দর কালচে সবুজ পাহাড় খুব কাছেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার পায়ের কাছে জলপাই বন। ছুটে ব্যালকনি গেলাম- সদ্য ঘুমভাঙা অপূর্ব শান্ত নীল সমুদ্র নীল আকাশের সাথে আদুরে দুষ্টুমি করার ফাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল,আমায় ছেড়ে চলে যাবি? ভোর সকালের ঢুলু ঢুলু সুন্দর এরকম একটা রিসর্ট কে রাতে এমন ভুতুড়ে লাগছিল কেন কে জানে? রাতে যতক্ষণ না ঘুম এসেছে হিল্টনের তো আয়িসি কি ত্যাইসি করে গেছি স্বামী স্ত্রীতে। আর এখন? ইশকিয়া ছেড়ে যেতেই মন কেমন করছে! এক নজরেই হামলিয়ে ইশক হয়ে গেল ইশকিয়ার সাথে।

5 Comments

  1. Sেanjoy kr dutta May 10, 2017
  2. Sanjoy kr dutta May 10, 2017
  3. Subir Bose May 11, 2017
  4. Sarada May 11, 2017
  5. Asoke Datta May 12, 2017

Leave a Reply