মুর্শিদ ধন হে

সুদর্শনা ধর

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে নিয়ে লিখতে বসে মনে হল আমি নিতান্তই ওঁর গুনমগ্ধ শ্রোতা বই তো কিছু নই, আমার আর ওঁর যোগসূত্র ওইটুকুই। তবে তাই নাহয় হল। কালিকা রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে“ উদ্ধৃত করতে শুনেছি। তাই শিল্পীর সৃষ্টির ওপর শ্রোতার অধিকার দাবি করেই আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ লিখতে বসেছি।

মনে করতে পারিনা শেষ কবে এক গায়ক,বাদক,শিল্পী,লেখক,চিত্রকর এর অকাল প্রয়ানে জনমানসে এই রকম জোয়ার উঠেছিলো। আশ্চর্য এক বেদনা,যেন এক আপনজনকে হারালাম। এ আমার একার কথা নয়,বহু মানুষ বললেন,”ও যে এত আপন ছিল আগে তো এ ভাবে বুঝিনি”? সবার চোখের কোণে জল। না,কেউ আত্মীয়,পরিজন,বন্ধু-বান্ধব এর কথা বলছে না,অচেনা শ্রোতার দল কদিন ধরে আপন মনের গভীর ক্ষত নিয়ে কি করবে বুঝে পেলনা। কত লেখা,কত ছবি,কত গান,শোক মিছিল, শোকসভা হল,কিন্তু কিছুতেই তাকে আর ফিরে পাওয়া হলনা।

২০০০ সালের কোন একটা সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ক্যাসেটের দোকানে পেলাম একটা মজার মনোগ্রাহী প্রচ্ছদে বাংলা গানের দল দোহার এর গানের ক্যাসেট। গানের সারিতে দেখি, ছাতপেটার গান,সারি গান,মুর্শিদি,ভাটিয়ালি,কারবালার গান,চা বাগানের গান। দেখে শুনে মনে কৌতূহল হল। এ কি রকম দল?এ কি রকম গান?ক্যাসেটের ভেতর সুন্দর বাংলায় মুখবন্ধ লেখা। এই দল বরাক উপত্যকা থেকে গান খুঁজে এনেছে আর সেই গানেরই দোহার দিচ্ছে।

পড়ে ভারি মজা লাগল যে এরা বলছেনা এরা নিজেরা গান রচনা করেছে বা সুর দিয়েছে,বরং পরিষ্কার ভাষায় বলছে অন্যের গান খুঁজে পেতে এনে গাইছি। সেই সময়টা এমনি ছিল যখন আশেপাশে প্রচুর ব্যান্ড নিজের গান গাইছে আর একক গায়কেরা নিজের গান গলায় গিটার ঝুলিয়ে গাইছেন। তখন সেটাই রীতি। এরা বলছে আমরা অন্যের গান গাইছি,গরিবের গান,শ্রমিকের গান,প্রান্তিকবর্গের গান। অতি উৎসাহে বাড়ি এনে চালালাম গান।

প্রথম গানটা ছিল,কালিকাপ্রসাদ এর লেখা ভনিতা,দোহারের বন্দনা। চমৎকৃত হয়ে গেছিলাম বললে বাড়িয়ে বলা হয়না। পথের পাঁচালির মিঠে বাঁশি দিয়ে শুরু আর তারপর অসাধারণ কথায় বাঁধা একটি গানরূপি ভনিতা। সেখানে শুনলাম দোহার বন্দনা করছে,কি ভাবে,কাকে?

“দোহারে বন্দে সবারে বন্দে

আসর বন্দে,শ্রোতা বন্দে,বন্দে গানের দেশ

খুঁজে প্রানের দেশ আহা মরি বেশ”

“বন্দে মহাজন আর বন্দে বন্ধু সুজন”

আর

“বন্দে ফতিমা, বন্দে সরস্বতী মা”।

এই সব গাইছে আর প্রায় যেন কীর্তন এর হরধ্বনির মত রব তুলেছে।

কি কাণ্ড! এমন কথা আর এমন গান তো বাপের জন্মে শুনিনি! এরা কারা?

পরিষ্কার,পরিশীলিত পরিবেশনা। যন্ত্র সবই দেশী,গান সবই যেমনই মেঠো তেমনই মিঠে। কোথাও অযথা যন্ত্র বা বাদ্যের ব্যবহার নেই। এএক্কেবারে যাকে বলে নিটোল পরিবেশনা। শুনলে মনে হয় আহা কি শুনলাম!মনে হল পেলে জিজ্ঞেস করি,কোথায়ে ছিলে গো তোমরা?

লোকসঙ্গীতের সব থেকে বড় গুণ তার সহজ পরিবেশন। গান আর বাজনার সহজ মিলমিশ তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে। গানের সুরে বিশেষ বৈচিত্র্য না থাকলেও সহজবোধ্য সুর আর অনাবিল ছন্দ না থাকলেই নয়। মাটির গান যেখান থেকে উঠে এসেছে সেখানে আর যাই থাকুক রকমারি দামি বাদ্যযন্ত্রের আড়ম্বর থাকা অসম্ভব বললেই চলে। পেটে নেই ভাত,তা না হয় আজ মরমী দু কলি গান বেঁধেই পেট ভরাই!

সেই গান কি যে সে গান? তার কথার ভাব শহরের মানুষের মনেও দোলা দেয়। সহজ সুর,গভীর কথা  আর শরীরের সমস্ত শক্তি ও আবেগ নিংড়ে নেওয়া গায়কী। এই লোকগানের টান অতি আন্তরিক।

শহরে বেশিদিন নাগরিক জীবন যাপনের এক বিষম বেদনা হল জটিলতা। তার বিভিন্ন রূপ দৈনন্দিন কাজে-অকাজে ব্যক্ত হয়। গানই বা বাদ যাবে কেন?যে যত ভাল গান জানে,যার গানের জ্ঞান যত বেশী,সে ক্রমেই গান কে আরও জটিল করে তুলবে,এ আর আশ্চর্য কি?যারা ট্রেনে বাসে গান গেয়ে ভিক্ষে করে,তাদের গান চড়া সুর হলেও,মিঠে লাগে। কিন্তু সে গান শহুরে মানুষের ছোট ড্রয়িং রুম বা মাইক ফিটিং গলার মাপে বেমানান লাগে। কেতা কায়দায়ে ঢ্যারা। পড়াশোনা শিখে অমন চাষা ভুষোদের মত গাইলে চলেনা। তাই না?

এই রকমে একটা জায়গায়ে কালিকা দিলেন আঘাত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যর ছাত্র,ভালো ঘরের ছেলে কোথায় রবীন্দ্রগান বা মার্গ সঙ্গীত এর পথ ধরবে,তা নয়,গেরামের গান ধরল। যেখানে বুদ্ধিজীবির কথার ধারই মাপকাঠি,সেখানে কিনা অন্যের মেঠো গান? হাতের কাছে ইলেক্ট্রনিক বাজনার কোন অভাব নেই,পরতের পর পরত মিলিয়ে মিশিয়ে গান তৈরির সব সরঞ্জাম মজুত,সেখানে সরল রেখার মত গান?

আর শুধু কি গান? কালিকার গানের সঙ্গে থাকতো  গানের ইতিহাস ও সামাজিক ব্যাখ্যা। এইখানে কাজে লাগত ওঁর তথাকথিত পড়াশোনা। যে কোনও গান গাইবার আগে সেই গানের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিস্তারিত ভাবে শ্রোতাকে ব্যাখ্যা করা, এতটা ক’জন করে আর ক’জনই বা করতে পারে? গভীর জিজ্ঞাসা মনে নিয়ে এই শিল্পী-গবেষক অনুসধন্ধান করতেন। গানের কথা, সুর, এবং আঞ্চলিক সঠিক উচ্চারণ কে সম্পূর্ণ সম্মান জনক ভাবে তুলে ধরার মধ্যে মনন, চিন্তা ও মুনশিয়ানা প্রচুর। কালিকার প্রতিটি কাজ ও কথা যেন লোকগান কে উদ্যেশ্য করেই বার বার বলত “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।“

সোহাগ চাঁদ বদনি ধনি গানটি কলকাতায় সোহাগ বলেই উচ্চারণ করা হত। এমনকি নির্মলেন্দু চৌধুরীও পরিষ্কার সোহাগ বলেই উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কালিকা সেই জায়গাটুকুও ত্যাগ করতে রাজি না। “সুহাগ” চাঁদ বদনি ধনি শুনলাম পরিষ্কার তাঁর কাছেই। নির্দ্বিধায়,সহজ ভাবে আঞ্চলিক উচ্চারণ যে কতটা মুক্তির,কতটা আনন্দদায়ী, এটা শুধু মাত্র অনুভবের,ব্যাখার নয়।

একই রকম ভাবে “দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সুনা”বলে তাঁর দলের রাজিবকে অ্যালবাম রেকর্ড করতে শুনেছে বহু লোক। আমার শুনে ভারি মজা লেগেছিল। আমরা যারা অসম থেকে কলকাতায় এসে প্রাণপণ আঞ্চলিক ভাষার আভাস ভোলানোর চেষ্টা করছি,সেখানে ওরা এসে দিব্যি আঞ্চলিক উচ্চারণে দাপটের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে!মনে জোর পেলাম,লজ্জা কাটিয়ে উঠলাম। আমিও তখন ছোট খাটো অনুষ্ঠানে ওদের গান গুলো ওদের মত করেই গাইতে লাগলাম। কালিকার সঙ্গে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হত। শুনে খুশি হয়েছিলেন যে আমি ওদের গান গেয়ে বেড়াই।

এই বার আসি দোহারের কথায়। দোহার ছিল গানের দল। ব্যান্ড নয়। ব্যান্ড কথাটার একটা পরিধি বা সীমা আছে,কিন্তু দল মাত্রেই বড় আকার এবং ক্রমবর্ধমান। কালিকা কোনোদিন তাঁর কাকার বিশাল ভান্ডার কে নিজের নামে বেঁধে রাখেনি। গান গেয়ে,গাইয়ে,শুনিয়ে,বুঝিয়ে,শিখিয়ে দেওয়ার নামই হল দোহার। অ্যালবাম থেকে,শো থেকে,লেখালেখি থেকে ক্রমে সারেগামাপা এবং সিনেমাতে সঙ্গীত পরিচালক হওয়া,সব কিছুই দোহারের লোকগানের মূল আদর্শকে ধরে রেখে কাজ করে যাওয়া। এক সময় এমন আকার ধরল,যেন একটা গানের আন্দোলন শুরু হল!লোকগান কে “কুল” বা “হেপ” করে তোলা। ট্যাটু গায়ে,জিন্‌স পরা ছেলে মেয়ে লোকগান শুনছেও,গাইছেও!এক অভূতপূর্ব সময় এসে পড়েছিল গানের জগতে। সবাই দোহার কে চেনে। ঘরে ঘরে ওদের গান,ওদের চর্চা। কালিকার গানের ব্যাখ্যা,অজানা তথ্য সবাই হাঁ করে শুনছে।

বাউল গান বা লোকগানের অভাব ছিলনা। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল এমনটাও ঠিক বলা যায়না। কেন্দুলির মেলাতে বাউলরা এখনো আসেন। গ্রামে গঞ্জে,ট্রেনে বাসে,গ্রামের বিয়ে বাড়িতে,চা বাগানের কুলিদের সান্ধ্য জমায়েতে,সাঁওতালদের আড্ডায় গান জমে ওঠে। এখনো।

কিন্তু সে মরমী গান শুনতে গেলে তাঁদের কাছে যেতে হয়,ভাব জমাতে হয়,থাকতে হয়। সেই যেমন সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক ছবিতে উৎপল দত্তকে দেখা গেছিল। খানিক না মিশলে ওরা ওদের তত্ত্বকথা মন খুলে বলবে কেন?

এই এত পথ হেঁটে গিয়ে গান শোনাটাই সহজ করলেন কালিকা।  নিজে যোগাড় করে সাজিয়ে গুছিয়ে শহরে নিয়ে এলেন এই অজানা,অল্প চেনা গান। নিয়ে এল গানের তথ্য যা জানার ইচ্ছে থাকলেও শহুরে মানুষের জানা হয়ে ওঠেনি। লেখালেখিও বিশেষ হয়নি। হলেও বা সেটা এতটাই শুষ্ক যে সেটা মরমে গিয়ে পৌছয়নি। গানের সম্পর্কে যতই লেখা হোক,আসল নথিতো গান নিজেই।

এই লোকগানকে আজকের মত করে বুঝে,সমসাময়িক আলোচ্য বিষয়কে ঘিরে গান চয়ন করা এবং চড়া সুর ও নরম সুরের সুন্দর মিশ্রন পরিবেশনা করার জন্যে লাগে তুখোড় মেধা আর গান শোনানোর চরম আকাঙ্খা!এই এত কিছু কার ঝুলি তে আছে?কার ঝুলি তে ছিল?

একটা গানের কথা বলি। গৌরি এল, দেখে যা লো…। এই গানে একটা মিষ্টি কথা বারবার আছে “কি ঠাকুর দেখলাম চাচা!কি দুগগি দেখলাম চাচি!” বেশি ভাবার ও দরকার নেই। সবাই জানে,চাচা চাচি কোন সম্প্রদায়ের লোকের সম্বোধন। তারা দুর্গা ঠাকুর দেখতে এসেছে,আর আদর করে দুর্গা কে দুগগি বলছে!যেন বাড়ির আদরের ছোট্ট মেয়ে। কি সুন্দর একটা দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠল!আজকের এই মৌলবাদী আবহাওয়ায় এই গান কি সুন্দর ভাবে গ্রামের একটা সজীব দৃশ্য তুলে ধরে!কে আজ সাহস করে এই গান গাইবে?কে গাইবে ওদের সেই অসাধারণ কারবালার গান?

সবাই কেন কাঁদছে ওর জন্যে?ও যে শুধু গান গাইত না গো,ও যে অনেক প্রান্তিক বর্গের মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। ও যে নিরঞ্জনদার সারিন্দাকে দেশ বিদেশের সম্মান এনে দিয়েছিল। তুলিকা গঙ্গাধরের গান যে ও পৃথিবীকে শুনিয়েছিল। আদিতির কীর্তনে সকলকে কাঁদিয়েছিল!

যাক,কাজ অসম্পূর্ণ রেখে গেল। মানুষের মনে দোলা দিয়ে টুক করে কেটে পড়া মোটে ভালো কাজ না। ওরই গাওয়া বাউল আব্দুল করিমের গান ধরে কালিকার উদ্দ্যেশে বলি “ভক্তের অধীন হও চিরদিন, থাকো ভক্তের অন্তরে..”।

7 Replies to “মুর্শিদ ধন হে”

  1. লেখা টা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম । অনেক অনুভূতি মনকে ছুঁয়ে গেল ।

    ঋতুপর্ণের অকাল প্রয়াণে একই রকম শূন্যতা অনুভব করেছি।

    অপূরণীয় অনুদান ..

  2. খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা। টুক করে কেটে পড়া টা মেনে নেয়া যায় না। এই রকম আরো একজনের দেখা এই জীবনে পাব বলে মনে হয় না।

  3. Lot of us will continue drawing inspiration from great souls like him and only hope they come back again and again… Hoyto ba manush noy, hoyto shankhachil ba salik er beshe.

  4. দারুণ লেখা। অনেক কিছু জানতে পারলাম।

  5. ঁকালীকা প্রসাদের সম্বন্ধে অনেকে অনেক কিছুই বলেছেন অথবা লিখেছেন ।আজ এই লেখা পড়ে এক আলাদা অনুভূতি হলো,কেন হলো সঠিক বলতে পারবনা। লেখার মাঝে মাঝে যেন একধরনের ব্যথা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল, যেটা আমি সবসময়ই অনুভব করি যখন কালীকা প্রসাদের কথা মনেপড়ে। কালীকা প্রসাদের সাথে মুখোমুখি কথাবার্তা বলার সুযোগ হয়েছিল দুই বার,তাই আজও মনে হয় উনি জীবিত আছেন ,হয়তো আবার দেখা হবে কোনোদিন । অসাধারণ ব্যক্তিত্তের মানুষ ছিলেন তিনি .. …. অনেক কিছু বলার আছে,কিন্তু প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাচ্ছি , তাই বলছি যে লেখাটি অসাধারণ এবং তাৎপর্যপুর্ণ লেখা ॥

  6. সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে বলাই বাহূল্য এই লেখাটা লিখতে না হলেই বেশি খুশি হতাম।

  7. খুব মর্ম স্পর্শী লেখা।
    কালিকা গানের জগতকে এক ‘নতুন ধারা’ দেখিয়ে গেল, তা আবারও অনুভব করলাম এই লেখা পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *