সুশান্ত দত্ত
বয়স এগারো। নাম প্রবীন। ডাক নাম টুকাই। সুন্দর ফুটফুটে কিশোর মুখখানা দেখলে ভালো লেগে যায়। এই বয়সটায় বিবেকটা থাকে টলটলে। টুকাইয়ের মনেও তেমন ধুলো-বালি লাগেনি।
টুকাইরা থাকে রূপচকে। মা, বাবা আর টুকাই।
বাদশাহী সড়ক ধরে কোলকাতা-বর্ধমান-কৈচর। তারপর বাঁহাতি রাস্তা। ন্যারোগেজ লাইন পেরিয়ে চার-পাঁচ কিলোমিটার গেলেই বাঁয়ে ঢালু রাস্তাটা গড়িয়ে গেছে শীতলদিঘির দিকে। শীতলদিঘির ওপারে ছোট্ট টিলা। মাঝে রূপচক।
ঐ টিলার ওপর থেকে গোটা রূপচক দারুণ দেখায়।
কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, ছাতিম, কাঠচাঁপা, শিমূল – অনেক গাছের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে শীতলদিঘিকে বাঁয়ে রেখে
মিনিট দশেক হাঁটলে টুকাইদের ফুটবল খেলার মাঠ। এখনও এই মাঠের নাম তেপান্তর।
টুকাই যখন আরও ছোট ছিল, এই মাঠটা তখন ছিল আরও বড় । এখন রূপচকে বসতি বেড়েছে। মাঠও ছোট হয়েছে।
তবে নাম রয়ে গেছে সেই তেপান্তর।
খেলার মাঠের দক্ষিণে, সমীরদার চায়ের দোকান আর রহিমদের বাড়ির মাঝ দিয়ে খানিক এগোলে টুকাইদের স্কুল।
রহিম-টুকাইরা এই রাস্তা দিয়েই শর্টকাটে স্কুলে যায়।
সেদিন স্কুল থেকে টুকাই বাড়ি ফিরছে। পিছন থেকে কে যেন ডাকল,” অ্যা–ই টুকা–ই !”। সে ঘুরে দেখল, রহিম।
স্কুলে টুকাই হ’ল প্রবীন। খেলার মাঠে সেই প্রবীনই আবার টুকাই। প্রবীন আর রহিম হরি-হর আত্মা।
“তোকে স্কুলে কত খুঁজলাম !”, রহিম হাঁফাচ্ছে। তার হাতে পিজবোর্ডের তৈরি ছোট্ট একটা এরোপ্লেন। অনেক
পরিশ্রম আর বিস্তর মাথা খাটিয়ে সেটা বানিয়েছে। সহপাঠিদের এই যন্ত্রটার কারিকুরি দেখিয়ে বেশ প্রসংশাও কুড়িয়েছে । অনেকজনের মাঝখানে রহিম যখন তার যন্ত্রটিকে প্রদর্শন করছিল, তখন তার দুটো চোখ প্রবীনকে খুঁজে ফিরছিলো।
মুকুল আর বিমলের মাঝ দিয়ে তার দৃষ্টি গেল উত্তরের জানলা পেড়িয়ে পিছনের জংলা-জমিতে। দেখল প্রবীন স্কুলের দারোয়ান মোহনদার সাথে কথা বলছে আর এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছে। মিনিট দশেক পরে সে বাইরে এসে দেখে প্রবীন নেই।
এতক্ষনে, আধ-রাস্তায় এসে, রহিম এরোপ্লেনটা একান্তে প্রবীনকে দেখানোর সু্যোগ পেয়েছে। চোখে মুখে উৎসাহ। এক ঝলক হেসে বলল, “টুকাই, দেখতো কেমন বানিয়েছি। এটা উড়তেও পারে।“ বলে ওপর দিকে ছুঁড়ে দিল। উড়োজাহাজ দিব্যি ঘুরতে ঘুরতে ওপরে উঠল। আবার ঘুরতে ঘুরতে নেমে এল। টুকাই হাত তালি দিয়ে উঠল। বন্ধুর সাফল্যের সেও যেন অংশীদার। বন্ধুর কৃতিত্বের সেও ভাগিদার। বলল, “এটা আগের এরোপ্লেনটার থেকেও ভাল হয়েছে !”
রহিম একগাল হেসে এরোপ্লেনটা এগিয়ে ধরল,”নে, এটা তোর জন্যে তৈরি করেছি। তুই মামাবাড়িতে গিয়ে
ভালোদাদুকে দেখাবি।“
দুজনে স্কুলের উত্তরদিকের গাছ-গাছালির ছায়ায় সরু পায়ে-হাঁটা পথ দিয়ে ফিরছিল।
টুকাই খেলনার এরোপ্লেনটা হাতে নিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখতে থাকল। পিজবোর্ডের ডানায় ঘাসের কুচি লেগে।
মাঝের নীলরঙা পেটটাও ঝোপের ঘষা খেয়ে সবুজাভ।
টুকাইয়ের চোখের ভাষা জানালো, সে খুশি। রহিমের চোখ দুটো উত্তর দিল, সেও খুশি। বলল, “ কাল নবাবহাটে যাচ্ছি। চাচার কাছে। ছুটির পরে দেখা হবে।“
স্কুলে গরমের ছুটি পড়ল। বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে জ্যৈষ্ঠের শেষ পর্যন্ত। লম্বা ছুটি।
টুকাই থেকে থেকেই এরোপ্লেনটা একটু উড়িয়ে দেখতে লাগল। মনটা খুশি খুশি। গরমের ছুটিতে সে যাচ্ছে মামাবাড়ি। কোলকাতায়।
রহিমদের বাড়ির রাস্তা ছেড়ে টুকাই ডানদিকে নাগেদের আমবাগানের সরু রাস্তাটা ধরল। আম-কাঁঠাল-পেয়ারা-নিম গাছের অলিগলি দিয়ে হাঁটছে আর নতুন পাওয়া খেলনা-এরোপ্লেন ওড়াচ্ছে।
মেঘ জমছিল অনেক্ষন ধরেই। আকাশ কখন যেন কালো হয়ে এসেছে, সে খেয়ালই করেনি। গাছের ফাঁক দিয়ে একটু ঝোড়ো হাওয়া বইছে। ঝোড়ো হাওয়ায় রহিমের উড়োজাহাজ আরও ওপরে গিয়ে ঘুরপাক খেয়ে নামছে। আর তাই দেখে টুকাইয়ের উৎসাহ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
এমনই খেলতে খেলতে সে একবার একটু জোরেই ওপরে ছুঁড়ল তার খেলনা-এরোপ্লেনটাকে। যন্ত্রটা দিব্যি অনেকটা উঠে গেল। তারপর – কি মতি হল — বাঁয়ে মোড় নিয়ে সটান একটা আমগাছের মগডালে গিয়ে আটকে রইল। দু-চারটে ঢিল ছুঁড়েও কিছু করা গেল না। মামাবাড়ি গিয়ে দাদুকে রহিমের কারিগরী দেখানো হবে না ভেবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল টুকাইয়ের।
ভালোদাদু একসময় ছিলেন বায়ুসেনায়। কয়েক দশক আগে তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে শত্রুপক্ষের বোমারু বিমানকে। পাঞ্জা লড়তে হয়েছে সমানে সমানে। আকাশের দখলে যেমন আছে গতির উত্তেজনা তেমনই আছে দুর্গতি। দেশের অনেক ভাইদের হারিয়ে, মায়ের কোল শূন্য করে পূর্ব পাকিস্তান হল বাংলাদেশ।
বিদ্যুতের ঝলকানি আর বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই টুকাইয়ের খেয়াল হল এবার পা চালাতে হবে।
ধুলো উড়িয়ে আর পলাশের রঙ ছড়িয়ে দিয়ে ঝড় উঠলো। কালবৈশাখী। এই বয়সেও টুকাই জানে যে, বৃষ্টির জেদ আর তেজ — ভীষণ অনিশ্চিত । রূপচক হঠাৎই দামাল হয়ে উঠল। টুকাই স্কুলের ব্যাগ পিঠে বাড়ি ছুটল।
শুধু নাগেদের আমবাগানে একটা গাছের মগডালে আটকে রইল রহিমের তৈরি খেলনা-এরোপ্লেন।
———————————-
টুকাই তার মায়ের সাথে মামাবাড়ি এসেছে তা’ এক সপ্তাহ হল। বাবা আসেনি। বাবা – শেখর লাহিড়ী – সরকারি
ইঞ্জিনিয়ার। বর্ধমান জেলার আনাচে-কানাচে অনেক সরকারি হাইওয়ে বানানোর প্রোজেক্ট চলছে।
রূপচকে এখন তার অনেক কাজ। সরকারি মহল আর কন্ট্রাক্টরদের মাঝে ভারসাম্য ধরে রাখা। খসড়া বানান।
রাস্তাঘাট বানানোর ঠিকঠিক রসদ যোগার করা। শেখরের ফুরসৎ নেই। শিখা একাই চলে এসেছে টুকাইকে নিয়ে।
টুকাইদের মামাবাড়ি উত্তর কলকাতার ছিদাম মুদি লেনে। বাড়ির সামনের লাল রোয়াকে ভোরবেলায় কাকেরা
আড্ডা দেয়। আর বেলা ন’টার পরে বুড়োরা। দুপুরে রাস্তার কটা মস্তানগোছের কুকুর গুটিশুটি মেরে দিবানিদ্রা দেয়।
সন্ধের পর আবার বুড়োরা এসে বসে।
ভালোদাদুও এই দলেরই একজন সদশ্য। তবে টুকাইবাবু ছুটিতে এলে “গল্প দাদুর আসর” জমে তেতলার ছাদে।
মাদুর পেতে। কখনো সাপ-লুডো খেলা হয়। কখনো মেমারি গেম।
সেদিন মেমারি গেম খেলছে টুকাই, ভালোদাদু আর টুকাইয়ের মামাতো দিদি – বুলটিদি।
বুলটিদি একটা পাখির নাম বলল, “ডোডো”।
টুকাই বড়ো বড়ো চোখ করে জিজ্ঞেস করল, “ডোডো আবার কি ?”
দাদু একটু হেসে টুকাইয়ের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, “ডেড অ্যাজ এ ডোডো ! কি বুঝলে, টুকাইবাবু ? এই বোকা পাখিদের জাতিটাই এক সময় ভ্যানিস হয়ে গেল। সভ্যতার অভিশাপ ! অনেকদিন আগে ডোডোরা ছিল। আজ নেই।“
টুকাই জানাল,”ডাইনসরেরাও নেই।“
দাদু বলল, “ওদের অতো খাবার যোগান দেবে কে ?”
ছুটিতে এসে দাদুর কাছে টুকাই অনেক গল্প শুনতে পায়। যুদ্ধের গল্প। এরোপ্লেনের গল্প। সে দাদুকে বলেছে,”আমি
বড় হয়ে পাইলট হবো।“
দাদু-নাতি-নাতনির আরেকটা মজার সম্পর্ক আছে। সেটা হল মামা-মামী আর মাকে না জানিয়ে তিনজনে মিলে কচুরি খাওয়া। সে একরকম চুরি করে কচুরি !
দাদু ছোটবেলায় আইস্ক্রিম কিনে দিত। কেক-লজেন্স-বিস্কুট কিনে দিত। মা বারণ করত। বকাবকি করত। তবুও দাদু চুপিচুপি নিয়ে এসে দিত।
সম্পর্কের সমীকরন বদলে যায় সময়ের সাথে। কালের স্রোতে। সেদিন মা আর মামী গেছে স্টার থিয়েটারে।
টুকাই আর বুল্টি সেই সুযোগে দাদুর জন্যে গদাইয়ের দোকান থেকে কচুরি কিনে আনল। বুল্টি আবার দাদুর জন্যে একটা ললিপপও নিয়ে এল। সেটা হাতে পেয়ে দাদুর সে কী হাসি ! দাদু-নাতনির ছোট্ট খুনসুটি । এই মুহূর্তগুলোতে না-বলা অনেক মজা। তিনজনেই তখন এক বয়সের হয়ে যায়। জীবনের ঝাঁপিতে আরেকটু মজা জমা হয়। লুকিয়ে কচুরি খাওয়ার স্বাদই আলাদা। এমন মজার সম্পর্ক যার আছে সেই বোঝে। যার নেই, সেও বোঝে।
তবে ধরা যে পড়ে না তা নয়। এই তো গত পরশু টুকাইরা দাদুর জন্যে ‘সাউ’-এর আলুর চপ নিয়ে ছাদে উঠছে। বিটনুনের গন্ধটা মায়ের নাকে ঠিকই গেল। কিন্তু মা না-দেখার ভান করে রান্না ঘরের দিকে গেল।
আলুর চপে কামড়টা দিয়ে দাদু যেই গল্পটা শুরু করতে যাচ্ছে, মা এসে হাজির !
“বাবা, ডাক্তারকাকু পই পই করে বলেছে দোকানের এইসব ভাজাভুজি খাবে না। কে কার কথা শোনে !”, বলতে বলতে মা টুকাইয়ের হাত থেকে চপের ঠোঙাটা নিয়ে নিলো।
একটু পরে মামীও এসে হাজির ! “তোমাদের ছুটির হোম ওয়ার্ক তো দেখছি শিকেয় উঠেছে। ফুলদি, এদেরকে পড়তে বসাও। মাথার ব্যায়াম না করলে এইসব মাথার ব্যামো গজিয়ে ওঠে”।
ঠোঙাটা আবার হাত বদল হল। মামী সবাইকে একটা একটা চপ পরিবেশন করে শেষেরটা মায়ের সাথে ভাগ করে নিল।
দাদু মুচকি হেসে চপে একটা কামড় বসিয়ে বলল, “ইয়ে হুই না বাত। টুকাইবাবু, যাও হোম ওয়ার্ক কর গিয়ে। ছুটি যে
ফুরিয়ে এল”।
আর এক সপ্তায় ছুটি শেষ। টুকাইয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
————————————–
এদিকে শেখরের নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। বর্ষা আসার আগেই কাজ সারতে হবে। কাজের বাইরে তার যেন কোন
অস্তিত্বই নেই। রূপচক এখন ভীষনভাবে করমব্যস্ত । পুরোনো জি টি রোডের মোড়ে নবাব হাট। সেখান থেকে শুরু নতুন রাস্তার কাজ।
শেখর অলীক স্বপ্ন দেখে। রাস্তা হবে। বাস চলবে। রূপচক হবে “সব পেয়েছির দেশ”।
শেখরের এক সাকরেদ আছে – রাজেশ। রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালা। সে দালালি করে। আর ঠিকাদারদের সামলায়।
রাজেশকে যেন ভগবান দালাল করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। পরের দ্রব্য পরের কাছেই বেচে তার থেকে দুপয়সা লাভ করে তার সংসার চলে। পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে অন্যের। শুধু দালালিটুকু তার নিজের।
মানুষের সঙ্গে যার সামাজিক বন্ধন নেই, শুধুই টাকার বন্ধন, সে মুক্ত। রাজেশও মুক্ত।
সে শেখরকে বলে,” পোকেটে প্যায়সা তো মনটা রহিস, শেখারবাবু। শুদ্ধু সিচুয়াসানের সোঙ্গে খাপ খাইয়ে লিতে হোবে।“
শেখর জানে এ লাইনে খাজনা কম, বাজনদারদের ভিড় বেশী। কেউ ভালবাসে রুটি দিতে। কেউ আবার কেড়ে নিতে। রাজেশ বাস্তবটা বোঝে ভাল। শেখর তাই ওর ওপর খুব নির্ভর করে থাকে। সমাজের আদিম মানুষগুলোর কাছ থেকে রাজেশ শেখরকে আগলে রাখে। জীবন থেকে শিখতে রাজেশের কোন বইয়ের দরকার হয়নি।
প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল রাস্তা তৈরি হচ্ছে। নবাহাট থেকে রূপচক হয়ে রাস্তা চলে যাবে কৈচর। সেখানে গিয়ে মিশবে হাইওয়েতে।
সেদিন শনিবার। টুকাই আর শিখা কোলকাতা থেকে ফিরবে।
শেখর আর রাজেশ টিলার ওদিকের কাজে তদারকি করে শীতলদিঘির পাশ দিয়ে ফিরছিল। রাজেশের আবার হাত ভেঙ্গেছে। মোবাইল ফোনে বকবক করতে করতে স্কুটার চালাচ্ছিল। তাতেই চিত্তির ! পেটের ওপর প্লাস্টার করা হাতটা ঝুলছে।
দিঘির ধারে শিমূল গাছটা দেখিয়ে রাজেশ বলে উঠল,”হোই গাছটা এখন দিন গুনছে। ‘সিতাল’ ঔর ভি ছোটা হোবে।“
শেখর অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বৈশাখের ঝিম দুপুরে শীতলদিঘিকে উদাসীন দেখাচ্ছে। সে এ-দিক ও-দিক তাকালো।
বালির সঙ্গে মাটি মিশে আছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষ কাজ করছে। খুব আস্তে আস্তে তারা হাঁটছে। আবার
কেউ কেউ একেবারে পাথরের মতো এক জায়েগায় দাঁড়িয়ে। মানুষগুলোর গায়ে ময়লা, ছেঁড়া জামা । বছরের পর বছর রোদে, জলে মরচে পড়ে গেছে সারা শরীর। চোখে শূন্য দৃষ্টি। কোনও চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। স্রেফ যন্ত্রের মত কাজ
করে যাওয়া। “সব পেয়েছির দেশের” কারিগর এরা।
রোডরোলারের ঘড়ঘড় আওয়াজ। বুলডোজার। এই যন্ত্রগুলোয় শক্তি আছে। হৃদয় নেই। কিন্তু তাদেরও ক্লান্তি আছে।
শেখরের ইচ্ছে হল কথা বলে গিয়ে। উত্তর হয়ত দেবে না। কিন্তু শুনবে নিশ্চই।
আশ্চর্য ভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে একটা জায়গা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লুকোচুরি চলছে। শেখরের মনে হল –
আমরা তো কিছুই তৈরি করি না। যা আছে তাই নিয়েই মেলাই-মেশাই-কাটি-ছাঁটি। নিজের মতো করে নিই। তাতেই গলদঘর্ম! প্রকৃতি সত্যিই যদি কোনদিন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে ?
শেখরের ঘোর কাটল রাজেশের ডাকে, “ শেখারবাবু, রাইস্তা ঠিক হ্যায় তো ? উস তরফ লেবেলিং বাকি আছে”।
শেখর মুখের ঘাম মুছে জানাল,”রাজেশ, ওদিকটা তুমি দেখ। আজ একটু টায়ার্ড লাগছে। আমি চললাম স্টেশনে।
ফ্যামিলি আসছে”।
শেখর রওনা দিল নবাব হাটের দিকে।
———————————–
স্টেশন থেকে বাবার সাথে ফেরার পথে টুকাইয়ের জমে থাকা গল্প, প্রশ্ন — সব একসাথে চলতে থাকল।
ডাইনে ঘুরে বাঁয়ে তাকাতেই বালি চোখে পড়ল। ভুসভুসে বালির ঢিপিতে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। রুক্ষ শুকনো বালি-মাটি চারিপাশে। দিঘির জল গেছে কমে। গাছগুলো, বাড়িগুলোর ওপরে ধুলোর চাদর। তাদের রূপচক বদলে গেছে।
টুকাই বাবাকে বলল, “বাবা, তোমরা যাও। আমি আমবাগান হয়ে আসছি”। এই বলে রহিমের বাড়ির পাশের গলি দিয়ে
ছুট লাগাল।
আকাশে কিছু উদাস মেঘের আনা-গোনা। রোদ নামছে নীল আকাশের ধার দিয়ে। সাবধানে। নাগেদের আমবাগানে
ক্লান্ত পাখিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে।
টুকাই দেখতে পেলো একাদশীর ভাঙা চাঁদ গাছের ফাঁকে আটকে রয়েছে। হঠাতই তার বুকের ধুকপুকুনি গেল বেড়ে ।
রহিমের এরোপ্লেন ! কোথায় গেল ? এই গাছটার ঠিক ঐ ডালেই প্লেনটা আটকে ছিল ! গাছের নিচে এদিক-ওদিক
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে বাগানের দক্ষিণদিকের একটা ঝোপের ফাঁকে তার হদিস পাওয়া গেল।
নীল ডানাটা ধরে টুকাই আস্ত এরোপ্লেনটা বের করে আনলো। ডানদিকের ডানাটা একটু জখম হয়েছে বটে। তবে
সেটা ঠিক করা যাবে। যন্ত্রটা ফিরে পাওয়ার আনন্দটা সেভাবে পেলনা টুকাই।
একই সঙ্গে টুকাই, মানে প্রবীনের মধ্যে দুটো চিন্তার টানাপোড়েন চলছিল।
এক, দাদুকে প্লেনটা দেখাতে পারলে ভালো হত। মামী একদিন মাকে বলছিলো ডাক্তারদাদু সামনের মাসে দাদুকে হাসপাতালে ভর্তি করবে।
দুই, রূপচকে ফিরে সে দেখল – তেপান্তরে আইস্ক্রিমওয়ালা নেই । বেলুনওয়ালাও নেই। সমীরদার দোকানটাও নেই। একটু একটু করে রাস্তা এগিয়ে চলেছে রূপচককে দুভাগ করে দিয়ে।
তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে মোহনদার কথাগুলো, “ স্কুলের উত্তর দিয়ে বড় রাস্তা হবে। বড়বাবু বলছিল — রূপচকের সবুজ আরও ছোট হয়ে যাবে। গাছ কমবে। কিছু কাক আর পাখি উদ্বাস্তু হবে। উত্তরে কোথায় যেন বরফ গলবে। দ্বীপ ডুববে। গরম পড়বে।“
এবারের গরমের ছুটি টুকাইকে ধাক্কা মেরে অনেকটা বড় করে দিল।
দূর দিগন্তে নানা রঙের ক্যানভাস। চারপাশ নিঝুম। আমবাগানে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল।
অবন ঠাকুরের গল্প সম্পর্কে পন্ডিতেরা বলতেন যে তিনি ছবি লিখতেন৷
আর তোমার গল্প পড়লে আমার মনে হয় তুমি যেন গল্পটা বলছ৷
অামাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশবের গল্প শুনলাম তোমার লেখায়৷ লেখার মুন্সীয়ানা কিছুক্ষনের জন্য পাঠকে নিয়ে যায় তার ছেলেবেলার জগতে৷
তবে ঈশান কোণে সিঁদুরে মেঘের একটা অশনি সংকেতও আছে মনে হল৷
Cost of Development…..
সমস্যাটা বড় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ফেলেছে..