ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী
হায়দ্রাবাদের সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির মাধব চট্টোপাধ্যায়ের নাম বিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত।
আর হায়দ্রাবাদের বাঙালিদের আসরে ওনার নাম মুখে মুখে ফেরে বললে যে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না সে বিষয়ে আমি একেবারে সুনিশ্চিত। উনি একাধারে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, পত্রিকা সম্পাদক এবং তার থেকেও যেটা বড় কথা সেটা হল মাধবদা হচ্ছেন নিবেদিত প্রাণ আপাদমস্তক ভদ্রলোক এক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাঁর বিজ্ঞানপিপাষু মন দৈনন্দিন জাগতিক সমস্ত রকম কর্মকান্ডের কার্যকারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়। সেই অনুসন্ধান দ্বারা প্রাপ্ত ফল তিনি যে স্বার্থপরের মতন শুধু নিজের জ্ঞান ভান্ডারেই সঞ্চয় করে রাখেন তা মোটেই নয় বরং তিনি আমাদের মতন আমজনতার দরবারে এমন সহজ সরল ভাবে পরিবেশন করেন যাতে তা আমাদের মস্তিষ্কে সহজপাচ্য হয়।
বহু মহাজ্ঞানী মহাজন আছেন যাঁরা কঠিন বিষয়গুলোর কাঠিন্যতাকেই বজায় রাখতে চান পাছে আমজনতার কাছে তাঁদের নিজেদের মেকি ওজনদার ইমেজটা নষ্ট না হয়ে যায়। এনারা নিজেদেরকে এক ভিন্ন গ্রহের প্রাণী হিসেবে উপস্থাপিত করতে চান। বাকিসব জীবকে ক্ষমা ঘেন্নার দৃষ্টিতে দেখতে ভালবাসেন তাঁরা।
এইখানেই মাধবদা সবার থেকে আলাদা আর এটাই ওনার কৃতিত্ব।
বিজ্ঞানকে তিনি বিজ্ঞানীদের দেওয়ানীখাসের ইন্টেলেকচুয়াল দরবার থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে সাধারন মানুষের দেওয়ানীআম দরবারে হাজির করাতে চান। এর ফলে যে সাধারন মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চা আরো বাড়বে সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। এতে যে আখেরে বিজ্ঞানেরই লাভ সেটা বলাই বাহুল্য। মাধব চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কেই বা সেটা ভাল বুঝবে!
এই মাধবদার সাথে আমার কেন জানি না আলাপ পরিচয় হয় অনেক পরে। অবশ্য মাধবদাকে আমি একটু যেন সযত্নে এড়িয়েই চলতাম। মাঝেমধ্যে ছোটখাট সাহিত্য পাঠের আসরে, আলোচনায় দেখা সাক্ষাৎ হত এবং সেখানে আপাত নিরীহ কোন বিষয় নিয়ে ওনার সাথে আলোচনা যে একেবারে হয় নি তা নয় তবে আমি এই বিজ্ঞান তপস্বী মানুষটিকে দূর থেকে একটু সম্ভ্রম সহকারে দেখতেই ভালবাসতাম।তা সেই মাধবদা যখন আমাকে তাঁর প্রকাশিত “বিজ্ঞানচর্চা আর চিকিৎসা নিয়ে নানান ভাবনা” বইটার রিভিউ লিখতে অনুরোধ করলেন তখন আমি অকুল পাথারে পড়লাম বলা যায়।
শুধু অনুরোধ করেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি। একদিন দেখি সুদূর ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহর নিবাসী তাঁর প্রকাশক বইটা আমার হায়দ্রাবাদের বাড়িতে হাজির করিয়ে দিলেন ভারত সরকারের দ্রুতগামী ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে!
আমি যাকে বলে কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ়!!!
বইটা হাতে নিয়ে দিন দুয়েক নাড়াচাড়া করলাম। পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখলাম বিষয়গুলো অত্যন্ত ভারি। বর্তমান কালের এই Whats App আর Facebook মাধ্যমে পঠন পাঠনের যুগে আমি শেষ কবে আমার মস্তিষ্কের ধূসর কণা গুলোকে নড়াচড়া করিয়েছি তা আমার মনে নেই। সবসময় তরল বিষয়ের সংস্পর্শে থাকার ফলে সর্বপ্রথমে ভারি চিন্তা ভাবনা সামলানোর শক্তিকে মস্তিষ্কের সুদূর গহ্বর থেকে উদ্ধার করে মনের মধ্যে হাজির করানোর প্রচেষ্ঠায় কয়েকদিন কেটে গেল। মন বলতে লাগল কি দরকার এইসব কঠিন কর্মকান্ডের উত্তাপে হাত পুড়িয়ে আবার হৃদয়ের শব্দ বলতে থাকে ”বৎস্য, প্রতিফলিত আলোকের আলোতে আলোকিত হবার এই সূবর্ণ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা কর।“
বেশ কয়েকদিন বেডসাইড টেবিলের কোনায় পড়ে থাকার পর অবশেষে অনেক টানাপোড়েনের ঝড় ঝাপটা সামলে একদিন হৃদয়ের শব্দে সাড়া দিয়ে বইটা হাতে তুলে নিলাম।
অতএবচ “শ্রী গণেশ”।
বইটাকে আবার নতুন চোখে দেখলাম। ইকো-গ্রীন রঙের বেস কালারের ওপর অপরেশ পাল কৃত বৈজ্ঞানিক কিছু নকসা সম্বলিত প্রচ্ছদ আর সেই সঙ্গে ঝকঝকে জ্যাকেটসহ “বিজ্ঞানচর্চা আর চিকিৎসা নিয়ে নানান ভাবনা“ বইটির প্রকাশে প্রকাশকের যত্নের তারিফ করতে হয়।
বইটির Epitome-এ অল্প অথচ প্রয়োজনীয় শব্দের মাধ্যমে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং বিজ্ঞান নিয়ে মিথের ওপর কিছু দরকারি কথা খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে বলা হয়েছে।
২/-
(২)
আগরতলার “জ্ঞান বিচিত্রা“ প্রকাশনা সংস্থাটি একটি ব্যতিক্রমী প্রকাশনা গোষ্ঠী। লেখা মনোনীত করার ব্যপারে লেখকের থেকে এনারা লিখিত বিষয়কেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। একদা হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত বইমেলাতে ওনাদের বইয়ের ভান্ডারে বেশ কিছু মনকাড়া প্রকাশন নজরে এসেছিল। ওনাদের প্রকাশিত একটি অন্য ধরনের কবিতা সঙ্কলন আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ আজও আলো করে আছে।
ISBN নম্বরসহ মাধবদার “বিজ্ঞানচর্চা আর চিকিৎসা নিয়ে নানান ভাবনা” বইটি হাতে নিয়ে মনটাতে বেশ একটা তৃপ্তির স্পর্শ পেলাম। বইটির “মুখবন্ধ” নান্দীমুখটি দেখলাম মাধবদার নিজেরই লেখা। জানতে পারলাম স্কুল জীবন থেকেই বিজ্ঞান তাঁকে আকর্ষন করেছে। তারপর তিনি একে একে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সবাইকে যাঁরা তাঁর এই বিজ্ঞানপিপাষু মনকে নানা সময়ে নানা ভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। বুক ভরা কান্না নিয়ে স্মরণ করেছেন তাঁর অকাল প্রয়াত অগ্রজ উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাদাতা ডঃ প্রণব চট্টোপাধ্যায়কে।
সবশেষে আশা প্রকাশ করেছেন, “এই বই পড়ে যদি কারো চিন্তার জগতে সামান্য আলোড়ন ওঠে, ওষুধপত্র সম্বন্ধে সামান্য সচেতনাতা তৈরি হয় তবে সার্থক হবে আমার পরিশ্রম আর (প্রকাশক) দেবানন্দবাবুর উদ্যোগ।“
শতকরা একশ ভাগ বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের একটি আন্তরিক সৎ প্রচেষ্টা।
“বিজ্ঞানচর্চা আর চিকিৎসা নিয়ে নানান ভাবনা” বইটি মাধবদার নানা সময়ে প্রকাশিত মোট সতেরটি প্রবন্ধ সংকলন। এই সতেরোটি প্রবন্ধকে সাধারন ভাবে নিম্নলিখিত তিনটি গোত্রে ভাগ করা যেতে পারে।
(ক) বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ
(১) বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞান
(২) বিজ্ঞানকর্মী ও ধর্ম
(৩) বিজ্ঞানের নামে
(৪) বিজ্ঞানমনস্কতা
(৫) বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নৈতিকতা
(৬) নির্যাতিত বিজ্ঞানী
(৭) বিবর্তনবাদ বনাম ধর্মবিশ্বাস
(খ) রোগ জীবানু এবং ওষুধ বিষয়ক প্রবন্ধ
(১) অ্যান্টিঅক্সিডান্টঃ কিছু তথ্য, কিছু প্রশ্ন
(২) হোমিওপ্যাথি
(৩) বসন্তের টিকা
(৪) কলেরা নিয়ে গবেষণায় দুই বাঙালি বিজ্ঞানীর অবদান
(৫) অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপক ব্যবহার ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবানুদের বাড়বাড়ন্ত
(গ) অন্যান্য প্রবন্ধ
(১) তিন ডাক্তারের কথা
(২) রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান রচনার ভাষা
(৩) পরশুরাম রচনায় বিজ্ঞানমনস্কতা ও দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা
(৪) প্রফুল্লচন্দ্র, চরকা ও রবীন্দ্রনাথ
(৫) বঙ্গাব্দঃ কিছু তথ্য, কিছু বিতর্ক
প্রবন্ধগুলির সমাপ্তিতে প্রবন্ধগুলিতে ব্যবহৃত তথ্যসূত্রের কৃতজ্ঞতা স্বীকৃত থাকলেও লেখকের প্রবন্ধগুলির সময়কালের কোন উল্লেখ নেই। তার ফলে সেই সময়ের দেশীয় বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে বর্তমান কালের তুলনা মূলক মূল্যবান আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। এটা সুধী পাঠক সম্প্রদায়ের কাছে একটা অপ্রাপ্তি বলা যেতেই পারে।
৩/-
(৩)
এইবার প্রবন্ধগুলির বিষয় নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।
সর্বপ্রথমে “অন্যান্য প্রবন্ধ” নিয়ে আলোচনায় আসতে চাই।
“তিন ডাক্তারের কথা”য় যে তিনজন ডাক্তারবাবুর কথা আছে তার মধ্যে ডাঃ মুরারি মোহন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিবারের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের প্রথমদিকে।
সেই সময়ে তিনি আমার এক দিদিমার এক দূরূহ অস্ত্রপ্রচার করেছিলেন। অস্ত্রপ্রচারের সাফল্যে ডাক্তারবাবু আমাদের পরিবারের কাছে ভগবানরূপে পূজিত হতেন। আবার যখন কলেজে পড়তে গেলাম তখন আমার এক সহপাঠীর জ্যাঠামশাই হিসেবে আমার কাছে পরিচিত ছিলেন। আর্তের সেবায় নিয়োজিত প্রাণ এই ডাক্তারবাবু একসময়ে আমাদের কাছে মডেল রোল হিসেবে বিবেচিত হতেন।
ডাঃ চন্দন সেন আর ডাঃ সুশীল পাল মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের বর্তমান কালের criminalization of politics-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। শুধু এই নমস্য ডাক্তারবাবুরাই নন আজকের সমাজের সমস্ত আলোকিত মানুষ যাঁরাই কায়েমি স্বার্থের বিরূদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই চূড়ান্ত হেনস্থার স্বীকার হয়েছেন। সমাজের যাঁরা আইন রক্ষক তাঁরাও সেইসব good Samaritan-দের রক্ষা করতে ব্যর্থ।
তাই আমরা দেখি প্রয়াত মনজুনাথের মা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার নিতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামকে যখন প্রশ্ন করেন যে সৎ কর্মচারীদের নিরাপত্তা দিতে যখন সরকার ব্যর্থ তখন কিসের ভিত্তিতে সরকার তার কর্মচারীদের কাছ থেকে সততা দাবি করতে পারে! তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীরব ছিলেন সেদিন।
মাধববাবু সমাজের এই অসহয়তা অতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই রচনার মাধ্যমে।
“রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান রচনার ভাষা’ প্রবন্ধে লেখক সঠিকই বলেছেন যে আকাশে সূর্য থাকলে অন্য জোতিষ্ক চোখে পড়ে না। রবিঠাকুর রূপী রবির কিরণে তাঁর সমসাময়িক যে সকল মহান ব্যক্তিদের প্রতিভা ম্লান হয়ে গেছিল রামেন্দ্রসুন্দর তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা ভাষা উন্নতিকল্পে তথা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কাণ্ডারি হিসেবে ওনার সঠিক মূল্যায়ন হয় নি বলেই আমার মনে হয়। মাধববাবু’র এই প্রবন্ধ রামেন্দ্রসুন্দরের বহু অজানা অনালোকিত কর্মকান্ডের ওপর আলোকপাত করেছে। এটা পাঠকের কাছে একটা বড় প্রাপ্তি।
“পরশুরাম রচনায় বিজ্ঞানমনস্কতা ও দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা” প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে প্রবন্ধকার পরশুরাম ছদ্মনামের অধিকারি লেখক রাজশেখর বসুর “বিজ্ঞানমনস্কতা ও দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা” এই দুই আপাত বিরোধী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাজশেখর আর পরশুরামের বহু লেখার উল্লেখ করে প্রবন্ধকার আসল মানুষটির সাথে পাঠকদের পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন। এই প্রবন্ধটিতে শতকরা একশভাগ বিজ্ঞানমনষ্ক প্রবন্ধকার যেন তাঁর প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলির “বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য” এই একমুখি বিশ্বাসের জায়গা থেকে একটু সরে গেছেন বলেই আমার মনে হয়।
পরশুরাম তথা রাজশেখর বসু আমার কাছে একটি বিস্ময়। ওনার লেখা গীতা অনুবাদ বইটি আমি হায়দ্রাবাদে “জ্ঞান বিচিত্রা”র ষ্টল থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। মুখবন্ধে গীতা সম্বন্ধে ওনার যে ধারনার কথা উনি ওখানে লিপিবদ্ধ করেছেন তা এক কথায় অসাধারন।
বড় স্বল্প পরিসরে কমবেশি মাত্র হাজার শব্দ প্রয়োগে মাধববাবু রাজশেখর বসু সম্পর্কে যে খন্ডচিত্রটি আঁকার চেষ্টা করেছেন তা সাধারন পাঠককে রাজশেখর বসু সম্বন্ধে আরও গভীর ভাবে চর্চা করতে আগ্রহী করে তুলবে হয়ত তবে সিরিয়াস পাঠক সম্প্রদায়ের প্রবন্ধকারের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা ছিল।
আমরা আশা করতেই পারি ভবিষ্যতে মাধববাবু রাজশেখর বসুকে নিয়ে আরও বড় কাজে হাত দেবেন। কেননা সর্বশেষে “বিজ্ঞানমনষ্কতা আর নাস্তিকতা সমার্থক নয় – রাজশেখর রচনাবলী খুঁটিয়ে পড়লে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়“-প্রবন্ধকারের এই মন্তব্যটি অত্যন্ত দামি।
“প্রফুল্লচন্দ্র, চরকা ও রবীন্দ্রনাথ” পড়ার পর যে কথাটি সর্বপ্রথমে মনে জাগে সেটা হচ্ছে সমসাময়িক এই দুই মহাপুরুষের বিশ্বাসের স্থান দুটি আপাত বিরোধী মনে হলেও দুজনে ছিলেন দুজনের গুণগ্রাহী। মাধববাবু অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে প্রফুল্লচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের difference of opinion-গুলি পাঠক সমীপে হাজির করেছেন সমস্তরকম তথ্যপ্রমাণ দ্বারা।
৪/-
(৪)
এই প্রসঙ্গে প্রবন্ধকারের মন্তব্যটি আমাদের বর্তমান কালের এই অশান্ত সময়ের অসহনশীলতার গোড়ায় আঘাত করবে বলেই আমার মনে হয়। কোন একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কোন একটি বিষয়ের ওপর ব্যক্তিগত মতামত আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে synchronized নাও হতে পারে কিন্তু তবে তা কখনই ব্যক্তিগত শত্রুতার স্তরে অধঃপতিত হওয়া উচিৎ নয়।
অন্যান্য পর্যায়ের “বঙ্গাব্দঃ কিছু তথ্য, কিছু বিতর্ক” রচনাটি আমাকে এক কথায় মুদ্ধ করেছে। হায় রে, সত্যি কত কম জানি আমরা আমাদের এই বাংলা সনের ইতিহাস সম্বন্ধে! শাহেনশা আকবর থেকে গ্রহ, নক্ষত্র, তিথির সব হিসেব নিকেশ এই রচনাটিতে পাওয়া যাবে। মহাজাগতিক ক্ষেত্রের কি পরিমাণ minute details এই সব গণনায় প্রয়োজন হয় তা আমার ব্যক্তিগত ধারণার বাইরে ছিল। সমৃদ্ধ হলাম এই রচনাটি পড়ে।
বুঝতে পারলাম কি কারনে বাঙালির দুর্গাপুজো, মুসলমানদের ইদের পরবের দিন ইত্যাদি এমন অনেক ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান এক এক বছরে এক এক দিন অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেল বাংলা বছরে “মলমাস” ব্যাপারটি ঠিক কি। এছাড়া বাংলা আর ইংরাজি বছরের মধ্যে অঙ্কের আঁত্মীয়তা ঠিক কি সমীকরণের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত করা যায় সেটা জানতে পারে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশেষ উপকৃত হয়েছি। এটা যেন সেই সেন্টিগ্রেডের সঙ্গে ফারেনহাইট – এই দুই তাপমাত্রা মাপক এককের যোগসূত্র।
এই প্রসঙ্গে আমার খুবই সীমীত ধ্যানধারনায় একটি বিষয় উল্লেখ করছি। কোথায় যেন একসময়ে পড়েছিলাম যে লিপইয়ারের মাধ্যমে একটা দিন গোঁজামিল দিয়েও সময়ের হিসেবটাকে সঠিক করা যায় না। কয়েক মিলি সেকেন্ড নাকি ভাগশেষে থেকে যায়। সেই মিলিসেকেন্ড এক্ত্রে মিলিত হয়ে তিনশতাধিক বছর পর নাকি একটি পূর্ণ দিনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাই আমাদের পরিচিত এই ইংরেজি ক্যালেন্ডারে নাকি সেই তিনশ(+) [সঠিক সংখ্যাটি এখন ঠিক মনে পড়ছে না] বছর পর পর একটি করে পূর্ণ দিন যুক্ত হয়।
ঠিক না বেঠিক, সময় সুযোগ করে তা মাধবাবুর কাছ থেকেই জেনে নেব একদিন।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় পর্যায়ে – “রোগ জীবানু এবং ওষুধ বিষয়ক প্রবন্ধ” সকলের আলোচনায়।
অ্যান্টিঅক্সিডান্ট এবং অ্যান্টিবায়োটিক এই দুটি রাসায়নিক পদার্থের রোগ প্রতিষেধক এবং একই সঙ্গে রোগ প্রতিকারক কর্মকাণ্ড নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান একত্রে উল্লসিত এবং চিন্তিত। মাধববাবু স্বল্প পরিসরে এই দুই রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে Dr. Jakyll & Mr. Hyde চরিত্রের সন্ধান পেয়ে আমজনতাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যাতে তারা এই দুইয়ের যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে বিরত থাকে।
কলেরা এবং বসন্ত এই দুটি মারন রোগ আমাদের দেশে বহু জীবনের অবসান ঘটিয়েছে স্বাধীনতা পূর্ব এবং পরবর্তী কালে। দুটি রচনার মাধ্যমে আমরা আলোকিত হলাম এই দুই রোগের অতীত এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। কি অসাধারন অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দিনের পর দিন রাতের পর রাত মানব কল্যাণে সময় ব্যয় করে এই দুই মারণ রোগ থেকে মানব জাতিকে স্বস্তি দিয়েছে। এই রাজসূয় মানব কল্যাণ কর্মকান্ডে দুই বাঙালী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাঃ শম্ভু নাথ দে এবং ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ-এর অবদান আর একবার সর্বসাধারনের নজরে আনার জন্য মাধববাবুকে অশেষ ধন্যবাদ।
এই পর্যায়ের সবচেয়ে বিতর্কিত লেখাটি হল “হোমিওপ্যাথি”।
প্রায় এগার পাতা ব্যাপী (পৃ ৮২ – পৃ ৯২) এই দীর্ঘ রচনাটি হল বইটির দ্বিতীয় সর্ববৃহত রচনা। দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে একমাত্র বঙ্গাব্দ নিয়ে রচনাটিই সর্বাগ্রে অধিষ্টিত আছে। এই রচনাটি “অ্যালোপ্যাথি বনাম হোমিওপ্যাথি” নামক একটি চিরকালীন বিতর্কটিকে তার কবর থেকে উঠিয়ে এনেছে বলা যেতে পারে। এই বিষয়ে আমি কোন ব্যক্তিগত মতামত দিতে চাই না, তবে এই বিতর্কিত বিষয়ে একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের “সম্পাদক সমীপেষু” বিভাগের কয়েকটি চিঠি আমার নজরে আসে। চিঠি’কটির মাধ্যমে পত্রপ্রেরকগন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক পথিক গুহ মহাশয়ের একটি রচনার বিষয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন।
সেই চিঠিগুলোর কয়েকটি লাইন আমি এখানে শুধু তুলে ধরছি মাধববাবুর “হোমিওপ্যাথি” রচনাটির পরিপ্রেক্ষিতে।
৫/-
(৫)
প্রথম চিঠির লেখক শ্রী অশোক কুমার দাস, কলকাতা-১০ থেকে লিখেছেন,
“পথিক গুহ-র বক্তব্য, হোমিওপ্যাথি ঔষধে কোন ঔষধি থাকে না। তাই হোমিওপ্যাথি ঔষধের রোগ সারাবার কোন ক্ষমতা নেই ও এটি অবৈজ্ঞানিক। বক্তব্যের সপক্ষে লেখক উল্লেখ করেছেন ফরাসী গবেষক জাক বুভুনিস্তের মিথ্যে
দাবির কথা। উপেক্ষা করেছেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত লুক মতাঁনিয়ের নিজস্ব গবেষণা লব্ধ ফলাফল – দ্রব্যের লেশ না থাকলেও দ্রবণ কাজ করতে সক্ষম।“
দ্বিতীয় চিঠির লেখক শ্রী রতনলাল বসু কলকাতা-৫১ থেকে লিখেছেন,
“পথিক গুহ বলেছেন তাঁর ফতোয়ার ভিত্তি রুশ বিজ্ঞান আকাদেমির একটি ঘোষণা, যাতে বলা হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ না থাকায় কোন হোমিওপ্যাথিক ওষুধে কী রোগ সারে লেখা যাবে না।
হোমিওপ্যাথি তত্ত্ব অনুসারেও কিন্তু সেটা লেখা যায় না, কারণ হোমিওপ্যাথিতে রোগভিত্তিক ওষুধ নেই সিম্পট্ম-এর ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচন করতে হয়।“
“সম্পাদক সমীপেষু” বিভাগের পাঁচটি চিঠিতেই বক্তব্য প্রায় একই – হোমিওপ্যাথিকে অচ্ছুত ভাববার কোনো কারন নেই। স্থানাভাবে সব চিঠিগুলোর থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম।
আমার ব্যক্তিগত মতামত এখানে নিস্প্রয়োজন। তবে জনান্তিকে জানিয়ে রাখি যে আমি সপরিবারে পাচন প্রক্রিয়ার গণ্ডগোল অথবা ক্ষুধামান্দ্য অবস্থায় Nuxvom30-তে বিশ্বাসী। এই অবস্থায় যে সকল Allopathic OCD (Over the Counter Drug) আছে তাদের পারলে এড়িয়েই চলি। আর এটা কোন Placebo effect নয় বলেই আমার ধারনা।
এবার আসা যাক বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা গুলোর আলোচনায়।
এই সমস্ত রচনাগুলোয় খুব যত্ন সহকারে বিজ্ঞানের জয়ধ্বজা তুলে ধরা হয়েছে মানব কল্যাণের উন্নতি কল্পে। অবৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড মানব জীবনে কি পরিমাণ ক্ষতি সাধন করতে পারে তার বেশ কিছু উদাহারণ আমরা এই পর্যায়ের সাতটি রচনার মাধ্যমে জানতে পারি। মারণ রোগ সম্পর্কে সাধারন মানুষের সততার সুযোগ নিয়ে কত অসাধু মানুষ যে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে চলেছে তার কিছুটা ধারণা আমরা করতে পারি এই পর্যায়ের রচনা গুলোর মধ্যে থেকে।
সংস্কার আর কুসংস্কার এই সুক্ষ প্রান্তরেখার এপার আর ওপারের ধ্যান-ধারণা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে বিজ্ঞানই যে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে সেটা লেখক এই রচনাগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বহু উদাহরনের মাধ্যমে। লেখক নিজে বিজ্ঞানী আর তিনি নিখুঁত বিজ্ঞান চর্চায় বিশ্বাস করেন। আর করেন বলেই জ্ঞান আহরণ আর বিতরণে তাঁর কোন ফাঁকি নেই। জ্ঞানের অসামান্য আলোক আর সেই আলোকে আরও নতুন আলোর সন্ধান তাঁর নিরলস প্রচেষ্ঠা অতি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
এই পর্যায়ের রচনাগুলোতে অপর্যাপ্ত তথ্যের ভান্ডার আছে তবে অতিরিক্ত আবেগ নেই। এই বইয়ের পাতা ওল্টালে সাধারন পাঠক এমন একজন বিজ্ঞান মনস্ক ঋজু ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে যিনি সমাজের অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার গোড়ায় গলদটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চলেছেন। মাধববাবুর এই রচনাগুলো পড়া থাকলে বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত ও অনালোকিত অন্ধকার জগতের প্রকৃতি ও তার ব্যবসা ভিত্তিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব বোঝার কাজটি সহজ হয় এবং অবশ্যই পাঠকের বিচার বুদ্ধিতে শান পড়ে।
তবে এই ধরনের বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনায় যে কথাটি বারবার উঠে আসে সেটা এই প্রসঙ্গে একটু আলোচনা না করে নিলে বোধহয় এই রিভিউটি আলুনি থেকে যেতে পারে ভেবে উল্লেখ করতে চাই। বিজ্ঞানের সর্বপ্রকার জয়যাত্রাকে কূর্নিশ জানিয়েও যে প্রশ্নটা সাধারন ম্যাঙ্গোম্যানদের মনে আসে সেটা হল যে মানব সভ্যতা যে খালি বৈজ্ঞানিক মুগুর ভাঁজার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে এটা মোটেই আশা করা যায় না। বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিতে না পারলে সবটাই কি অবৈজ্ঞানিক? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে নেই।
যে হাইপথেসিসের ভিত্তিতে বিজ্ঞান পৃথিবীকে সর্ব প্রথমে সমতল এবং পরে গোলাকৃতি বলেছিল তা যদি চিরকালীন হিসেবে গণ্য হত তাহলে বিজ্ঞানেরই সমূহ ক্ষতি হয়ে যেত। শেষমেস বিজ্ঞানীরাই পৃথিবীকে নাসপাতি সদৃশ বলে মান্যতা দিয়েছেন।
বহু যুগ ধরে যে সকল ধ্যান ধারনা বিশ্বাস আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাকে এক কথায় কুসংস্কার আর অবৈজ্ঞানিক বলে দেগে দিলে কিন্তু বিজ্ঞানই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই আমার ধারনা।
৬/-
(৬)
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে ভারতবর্ষের জ্যোতিষ শাস্ত্রে প্রথম থেকেই কিন্তু অর্ধাকৃতি গ্রহের উল্লেখ আছে। পশ্চিমী অ্যাস্ট্রোনমি কিন্তু সেই বিষয়ে ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রকে চিরকাল হীন দৃষ্টিতেই দেখে এসে আজ তারা স্বীকার করে নিয়েছে যে তাদের আবিস্কৃত Pluto গ্রহটি আসলে একটি হাফ প্ল্যানেট।
এই প্রকার আমাদের বহু সামাজিক সংস্কার যা আজকের বিচারে কুসংস্কার বলে মনে হয় তা যদি সেই সময়ের সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক অবস্থানের বিচারে বিচার করা যায় তবেই তার আসল মূল্যায়ন সম্ভব বলেই আমার ব্যক্তিগত মতামত।
বিজ্ঞান সতত সচল। আজ যেটা কল্পনা, কাল সেটা বাস্তব। বৈজ্ঞানিক আর অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা নিয়ে স্বাস্থ্যকর বিতর্ক চলুক। তবে সেই বিতর্কে চাই সকল বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের সহযোগিতা। আজ যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের কাছে নেই কাল যে তার সত্য উদ্ঘাটিত হবে না তার কোন কারন নেই। আর সেই অনাবিস্কৃত দিন পর্যন্ত তা সকল যে অবৈজ্ঞানিক – এই একমুখি চিন্তা ধারাই বিজ্ঞানকে যাতে One eyed deer-এ পরিণত করতে না পারে তার দায়িত্ব কিন্তু মাধব চট্টোপাধ্যায়ের মত মননশীল বিজ্ঞান মনস্ক মানুষদের ওপরেই ন্যস্ত থাকবে।