অভিসার

সুস্মিতা সরকার
(প্রাক্তনী, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ)


জয়শ্রী যখন স্নান করে বের হল, গোটা ঘরটা চন্দনের গন্ধে ভরে উঠল। গন্ধটা ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ লেপ্টে থাকবে, জানে জয়শ্রী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে ধবধবে সাদা সিল্কের শাড়ি পরতে পরতে আপনমনে গুনগুন করছে, ‘বহু মনরথে সাজু অভিসারে…’।

শাড়িটায় পাড় নেই। তবে লম্বাহাতার উজ্জ্বল ময়ূরকণ্ঠী রঙের ব্লাউজের সঙ্গে এক অসামান্য কনট্রাস্ট তৈরি হয়েছে। ওর ছিপছিপে মেদহীন চেহারাটা চাবুকের মত দেখাচ্ছে। একটু ময়শ্চরাইজার নিয়ে হাল্কা হাতে ঘষতে ঘষতে ভাবল, চুলটা খোলা রাখবে নাকি একটা হাতখোঁপা করে নেবে! ময়শ্চরাইজার মাখা শেষ করে অল্প পাউডার। এবার আই লাইনারের টান। ভাবল, সারাদিনের জন্য যাওয়া, তাই সরু লাইনই থাক। জয়শ্রী জানে ওর চোখ দুটো কতটা বাগ্ময়, কতটা আকর্ষণীয়! তার উপর হাল্কা কাজল আর লাইনারের টান দিলে তা কতখানি ধারাল হয়ে ওঠে সেটা বুঝেই টানল রেখা। কাজল লাগিয়ে আয়নায় নিজের চোখদুটো দেখে সেই কিশোরীবেলার মতই মুগ্ধ হল। ইচ্ছে হল বারে বারে দেখে নিজেকে।

হঠাৎই ঠোঁটের কোণায় একটা দুষ্টুমি মাখানো মুচকি হাসি খেলে গেল। যেন কিছু একটা ষড়যন্ত্র করেই তুলে নিল লিপস্টিকের বাক্সটা। মন দিল ঠোঁটের রঙ বাছায়। এটা ওর অনেকদিনের শখ। কত রঙ যে ওর সংগ্রহে আছে তা বলার নয়। বেগুনি ঘেঁষা হাল্কা গোলাপি, গাঢ় গোলাপি, পিচ, কমলা, কফি রং; কি নেই! আজকে কি কমলাই লাগাবে? চেরি রঙটাও তো বেশ মানায়! অবশ্য টকটকে লালটা লাগালেও মন্দ হয় না! একটা একটা করে রং হাতে নেয় আর এক একটা ভাবনা খেলে জয়শ্রীর মাথার মধ্যে। তার ছাপ পড়ে ওর চোখের ঝিলিকে আর ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখায়। শেষমেশ লাল আর পিচ এই রঙদুটোই পছন্দ হল। সাদা শাড়ির সঙ্গে ঠোঁটের রঙটা উজ্জ্বল হলে বেশি মানায়। লিপ লাইনার দিয়ে নিপুণ হাতে ঠোঁট এঁকে নিল প্রথমে। তারপর লাল আর পিচ পর পর মিশিয়ে দিল। ‘নট ব্যাড!’, আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পাস নম্বর দিল নিজেকে। এবার উঁচু করে বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে আঁচড়াতে আঁচড়াতে টের পেল নিজের মনের চোরা শিরশিরানি। খোলা রাখবে ভেবেও কি মনে করে একটা চিমটি ক্লিপ দিয়ে আটকে নিল চুলে। কানে লাল পাথর দেওয়া রুপালি রঙের বড়বড় ঝোলা দুল। লিপস্টিকের মতই কাঁচের চুড়িও প্রতিও ওর তীব্র আকর্ষণ। বাঁ হাত ভর্তি রংবেরঙের কাঁচের চুড়ি গলিয়ে ডান হাতে পরে নিল গাঢ় নীল ডায়ালের রুপালি ব্যান্ডের ঘড়ি । কানের পিছনে, গলায়, বুকের খাঁজে আর হাতে ফুলেল সুগন্ধির ছোঁয়া। ব্যাস, জয়শ্রীর সাজ শেষ। হ্যাঁ, গলাটা খালিই রইল। সেই স্কুলবেলার এক গুণমুগ্ধ বালক প্রেম নিবেদন করে বলেছিল, ওর নাকি মরাল গ্রীবা। ছেলেটাকে ভুলে গেলেও কথাটা মনে গেঁথে আছে। আর সেই গ্রীবায় আছে একটা লাল তিল। গলাটাকে সাজালে ওই তিলটার অমর্যাদা করা হয়।

আজ জয়শ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় পুনর্মিলন উৎসবে যাচ্ছে। প্রতিবছরই এই দিনটা এক বিশেষ দিন। নাচ, গান, নাটক, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। এই একটা দিনে সিনিয়ার, জুনিয়ার, স্যার, ম্যাডামেরা সবাই দারুণ উৎসবের মুডে থাকে। অনেক পুরনো, বিখ্যাত প্রাক্তনীও এই দিনটিতে তাদের ছাত্রজীবনে ফিরে যায়। তবে দিনটা এবছরে জয়শ্রীর কাছে অন্য কারণে বিশেষ। পাস করে বেড়িয়ে যাওয়ার পর এটাই ওর প্রথম বছর। তাছাড়া ইন্দ্রদার সঙ্গে পাক্কা এক বছর পর দেখা হবে। কথাটা ভেবেই বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার মত একটা অনুভূতি হল। কানের লতিগুলো জ্বালা করে উঠল। এবারেও কি কিছু বলবে না ইন্দ্রদা?

সাড়ে দশটা নাগাদ গান্ধীভবনের সামনে পৌঁছে দেখল, ভিড় জমে নি মোটেই। রেজিস্ট্রেসন কাউন্টারে দুজন চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছে। কেউ এলে মন দিয়ে নামের লিস্ট মিলিয়ে টাকা নিয়ে কিট এগিয়ে দিচ্ছে। সই করতে গিয়ে জয়শ্রী দেখল ওর নামের বেশ কিছুটা আগে ইন্দ্রনীল রায়ের নাম। মানে, ইন্দ্রদা এসে গিয়েছে। বুকের ভিতর আবার সেই হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার অনুভূতি। কি মনে করে ফাঁকা গান্ধীভবনের ভিতরেই ঢুকল ও। আর ঢুকেই ইন্দ্রর সঙ্গে মুখোমুখি! অপেক্ষা অধীর হলেও ঠিক এতটাও আশা করে নি জয়শ্রী।

‘আরে করেছিস কী? তোর দিকেই তো তাকিয়ে থাকতে হবে আজ সারাদিন!’ কোমরে হাত দিয়ে জয়শ্রীর সামনে দাঁড়িয়ে একটু পিছনে হেলে নিরীক্ষণ করার ভঙ্গীতে বলল ইন্দ্র।

‘তাই নাকি?’ নিরীহ মুখে বললেও অন্য কথা বলল জয়শ্রীর মন, ‘হুঁ হুঁ, সেটাই তো চাই শ্রীমান ইন্দ্রনীল রায়! তুমি শুধু আমাকে দেখবে বলেই তো আজ এত সাজলাম!’

‘কেন, তুই জানিস না?’শুনেই জয়শ্রীর ঘোর কাটল।

চমকটা নিমেষে লুকিয়ে নিয়ে বলল, ‘কেউ তো বলে নি! কি করে জানব?’

‘বলার কী আছে? ছেলেদের চোখের দিকে তাকা, তাহলেই বুঝতে পারবি।’

‘মুখ ফুটে তুমি বললেই যখন, তার তো একটা দাম দিতেই হয়। এক কাজ কর তুমি, আমার দিকেই তাকিয়ে থেকো আজ সারাদিন।’

‘ইস, মামার বাড়ি! আর আমি যে এতগুলো টাকা দিলাম! নাচা, গানা না দেখলে আর এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের ঝারি না মারলে উসুল হবে?’

‘তা অবশ্য ঠিক কথা।’ আয়ত চোখদুটোয় একটা মারকাটারি কটাক্ষ হেনে জয়শ্রী বলল, ‘ওই যে ঢুকছে তোমার সুন্দরী প্রমীলাবাহিনী। আমি চললাম, তুমি ঝারি মার। কেমন?’ পাশ কাটিয়ে এগোনোর উপক্রম করতেই দুহাত দিয়ে ওর পথ আটকালো ইন্দ্র।

‘এই, তুই রাগ করলি! ব্যাপার কী রে? সেন্টু?’

‘তুমি অন্য মেয়েদের দেখলে আমি কেন সেন্টু খাব? তুমি কি আমার বয়ফ্রেন্ড?’

‘মানে তোর বয়ফ্রেন্ড হলে রাগ করতিস?’ প্রশ্নটা করতে করতে আরেকটু কাছে ঘনিয়ে এল ইন্দ্র।

‘জানি না যাও।’ বলে দ্বিতীয় কটাক্ষটা হানল জয়শ্রী।

‘একটা কথা ভাবছি, বুঝলি।’

‘বলার হলে বলে ফেল কি ভাবছ?’ ইন্দ্রর চোখের দিকে তাকাল জয়শ্রী।

‘আজ থেকে তুই রাগ করিস, আমি যদি অন্য মেয়েদের দেখি। আমি তোকে রাগ করার পূর্ণ অধিকার দিলাম।’

‘মানে?’

‘মানে বুঝতে পার না হাঁদারাম! আসলে আমার খুব ইচ্ছা তোর বয়ফ্রেন্ড হওয়ার।’

‘এই, তুমি আমাকে হাঁদারাম বলছ?’

‘হাঁদা মেয়েকে হাঁদা বলব না? তুই বুঝিস না আমি তোকে ভালোবাসি?’

‘না বললে কী করে বুঝব?’

‘ওই জন্যই তো হাঁদা বললাম রে! বুদ্ধিমান হলে কবেই বুঝে যেতিস। আর বকাস না। চল একটু দক্ষিণাপণে যাই।’ বলে আচমকা জয়শ্রীর হাত ধরে টান দিতেই ও প্রায় ইন্দ্রের বুকের উপর এসে পড়ল।

‘সবাই আসবে আর আমরা এখন দক্ষিনাপণে যাব?’ বোকা বোকা মুখে প্রশ্ন করল। গলায় জোর নেই, একটু দূরে সরে যাওয়ার শক্তিও যেন নেই জয়শ্রীর।

‘যেখানে খুশি যাব। কি মুশকিল, যেতে পারি না! আচ্ছা চল দক্ষিণাপণের সামনে ফুচকা খাওয়াব, তারপর তারপর আইসক্রিম … ইশ, আমার জিভে জল চলে আসছে। কতদিন ফুচকা খাই নি, ওই খোট্টাদের পানিপুরিতে পোষায় বল?’

জয়শ্রী চুপ করে থাকায় ইন্দ্র আবার বলল, ‘কি হল? তুই রাজি না থাকলে বলে দে বাবা! এসেই দেখেছি সম্প্রীতা বেশ আমার দিকে প্রেম প্রেম চাউনি দিচ্ছে। ওকেই আবার খুঁজে বের করি না’হয়।’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গুনগুনিয়ে গান ধরল ইন্দ্র, “ও কেন এত সুন্দরী হল, অমনি করে ফিরে তাকাল, দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই…।”

জয়শ্রী বাক্যহীনা। গত তিনবছর ধরে যার প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু সে যে হঠাৎ করে এরকম ভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেবে সেটা যেন অপ্রত্যাশিত। অনেকবার অনেকরকম ভাবে কল্পনা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ রকম হালকা চালে, ইয়ার্কি মারার ভঙ্গীতে কেউ প্রেম প্রস্তাব দেয় ওর মাথায় আসে নি। আবার বলে সম্প্রীতাকে খুঁজে বের করবে! মানে? ছুরি চালিয়ে নুন ছিটনো! কি বিপজ্জনক ছেলে রে বাবা! ভাবলেও ভাল লাগায় অবশ হয়ে আসছে জয়শ্রীর দেহ ও মন।

‘খুঁজলেই হল না?’ বলে অস্থির হাতে ও একটা কিল মারল ইন্দ্রর বুকে। ইন্দ্র ওর হাতটা চেপে ধরে চারিদিকে তাকাল। ‘শিগ্রী এই কিল মারার শোধ নিচ্ছি, ওয়েট।’, বলে হাতটা ছেড়ে দিল।

অনুষ্ঠানের আকর্ষণ কোথায় পালিয়ে গেল দুজনের। রাস্তায় পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ায় মধ্যে যে কি আনন্দ! অনেকক্ষণ চুপ করে আছে জয়শ্রী। সেই যে কিল মেরেছিল তারপর থেকেই। ইন্দ্র তাকাল ওর দিকে। খুব নরম স্বরে বলল, ‘এই ভিড় রাস্তায় কেউ আমাদের চেনে না, তাই এই ভিড়েও আমরা একা। ওখানে সবাই চেনে আমাদের। একটু পরেই সব গান গাওয়ার আবদার জুড়ত, তাই আগেভাগেই তোকে নিয়ে কেটে পড়লাম, বুঝলি?’

জয়শ্রী উত্তর দিল না। অন্যসময় এই রাস্তার হাঁটলে, রাস্তার পাশের দোকানগুলো ওর নজর কেড়ে নেয়। আজ অন্য রকম। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে ও। এই একটা দিনের জন্য কতদিনের অপেক্ষা, সেকথা শুধু ওই জানে। অথচ আজ সোজাসুজি কথাটা বলল ইন্দ্র, আর ওর যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না।

‘কিরে, কিছু বলবি না তুই?’ জয়শ্রীর বাঁ হাতখানা নিজের ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ইন্দ্র বলল, ‘তুই কি জানিস, আজ আমি শুধুমাত্র তোর সঙ্গে দেখা করার জন্যই এসেছি? নাহলে দিল্লি থেকে রিইউনিয়নে কেউ আসে? মা পর্যন্ত বলছিল, ‘শুধু রিইউনিয়নের জন্য যাবি? অকারণ ছুটি নষ্ট, টাকা নষ্ট।’ আর দেখ, তুই কিছু বলছিসই না’।

‘কী বলব?’

‘এই যে আমি বললাম, আমি তোর বয়ফ্রেন্ড হতে চাই। তুই বললি না তো, তুইও তাই চাস কিনা?’

‘তুমি জান না?’

‘না বললে কী করে জানব?’ একটু আগেই বলা জয়শ্রীর কথাটা ফেরত দিল ইন্দ্র। মুচকি হাসির সঙ্গে বেশ কিছুটা দুষ্টুমি মিশেছে এখন।

‘তাহলে শোন, হ্যাঁ আমিও চাই।’ ফুটপাথের একপাশে সরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জয়শ্রী। তারপর স্পষ্ট চোখে তাকাল ইন্দ্রর দিকে, ‘সেই প্রথম দিন থেকেই চাই। যেদিন ভাঙ্গা হাত নিয়ে গান্ধীভবেনের সামনে রিক্সা থেকে নামলে সেদিন থেকেই।’

ইন্দ্রের মুখের দুষ্টুমি মেশানো মুচকি হাসিটা আর নেই। তার বদলে একটা শান্তির ছায়া। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জয়শ্রীর খুব ইচ্ছে হল ওর বুকে মাথা রেখে একটু দাঁড়াতে। কতদিন, কতদিন ও এই একটা দিনের স্বপ্ন দেখেছে সে ওই জানে!

‘ওয়েক আপ, ওয়েক আপ, ওয়েক আপ, ওয়েক আপ…’
মোবাইলের অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গতেই মুখখানা বাংলার পাঁচের মত করে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল জয়শ্রী। ভাবল, ‘এমন স্বপ্ন ভেঙে যেতে আছে?’ নিজের হাতের দিকে খানিকক্ষণ এক নিমেষে তাকিয়ে থেকে একটা শ্বাস ফেলল। তারপর আলতো করে হাতটা বুলিয়ে নিল গালে, গলায় আর ঠোঁটে।

ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রী জয়শ্রীর প্রেম নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না কোনদিনই। কলেজে পড়তে এসেও ভাবত এতখানি একটা তুচ্ছ বিষয়কে কি করে ওর বন্ধুরা জীবনমরণ সমস্যা বানিয়ে বসে আছে। শুধু খারাপ ছেলেমেয়েরাই যে পড়াশোনা না করে প্রেম করে সময় নষ্ট করে সে ব্যাপারে ওর কোন সন্দেহ ছিল না। রাস্তাঘাটে হাতে হাত রেখে চলা প্রেমিকযুগল দেখলেই ওর মনে হত একটা থাপ্পড় মেরে পড়তে বসিয়ে দেয়। ও বরাবর এটাই জানত যে পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি পাওয়াই ওর জীবনের আসল লক্ষ্য। পড়াশোনাই ছিল ওর জীবন। আর তাই কাউকে ভালো লাগার অবকাশ ছিল না।

সেই জয়শ্রীও একদিন প্রেমে পড়ল! ততদিনে পড়া শেষ হয়ে আসছে। সেদিন ছিল এরকমই এক পুনর্মিলন উৎসবের দিন। ইউজির শেষ বছর। ও বসেছিল নাম রেজিস্ট্রেসন কাউন্টারে। ঋতম ছিল পাশের চেয়ারে। তখন সকাল সাড়ে দশটা। ধীরে ধীরে একজন দুজন করে হাজির হচ্ছে। হাসাহাসি আর গল্পে জমে উঠছে চত্বর। জয়শ্রী দেখল রিক্সা থেকে একটা সাধারণ দেখতে ছেলে নেমে এল। পরণে মেরুণ পাঞ্জাবি আর হাল্কা নীল জিন্স। এসব কিছুই অবশ্য জয়শ্রীর চোখে পড়ত না, যদি না ছেলেটির একটা হাতে প্লাস্টার করা থাকত। তালিকা থেকে কেবল ওর নামটা কেমন মনে গেঁথে গেল। ওই প্লাস্টারই ইন্দ্রনীল রায়কে আলাদা করে দিল সেদিন।

সেদিন সারাদিনে নানান কাজ বা আড্ডার ফাঁকে কেবল ইন্দ্রনীল রায়কেই দেখল জয়শ্রী। আর শুনল ওর গান। ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’, ‘ও চাঁদ সামলে রাখ জোছনাকে’, ‘আমি তার ঠিকানা রাখি নি’, ইত্যাদি। লাঞ্চের পর মাঠে বসে মান্না দে’র পাগল করা প্রেমের গানগুলো একটা একটা করে গাইছিল ইন্দ্রনীল আর জয়শ্রী একটু একটু করে ডুবছিল। ইন্দ্রনীল কি ওকে খেয়াল করেছিল? জয়শ্রী জানে না। ও শুধু জানে ওর ধ্যানধারণা কেমন ভেসে চলে যাচ্ছে ওর থেকে অনেক দূরে। একটা ছেলেকে দেখে ওর ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে।

তিনবছর আগের সেই দিনটার কথা ভাবলে এখনও কেমন যেন ঘোর লাগে জয়শ্রীর। নাম ছাড়া আর কিছুই জানত না সেদিন। আলাদা করে একটাও কথাও হয় নি ওর সঙ্গে। শুধু সারাদিন একটা নেশার মধ্যে কাটিয়ে একবুক ভালো লাগা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন।

পরের দিন ক্লাসে গিয়ে ঘুরিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছিল। জানতে পেরেছিল ইন্দ্রনীল একজন খুবই সাধারণ ছাত্র তবে অসাধারণ লেখক আর অসামান্য গায়ক। ওর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মাতিয়ে রাখত ও। জয়শ্রীর থেকে তিন বছরের বড়। জয়শ্রী যেবার ঢোকে, ইন্দ্রনীল সেবারেই বেরিয়ে গিয়েছে। এখন দিল্লিতে একটা পত্রিকায় কাজ করে। জয়শ্রী ফেসবুকে খুঁজে খুঁজে বের করেছিল ইন্দ্রনীল রায়কে। সাহস করে নিজের পরিচয় দিয়ে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল। তারপর একটু একটু করে একে অপরকে জানা।

তারপর থেকে প্রতিবছর এই একটা দিনেই ওদের দেখা হত। জয়শ্রী অনেকবার ইঙ্গিত দিয়েছে, কিন্তু নিজে মুখে বলতে পারে নি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকার পর থেকে ইন্দ্রর সঙ্গে চ্যাটে কথা বলার পরিমাণ বেড়েছে। নানা রকম কাজের কথা বলতে বলতে হাজারটা অকাজের কথাও হয়। অকাজের কথাতেই যেন দুজনের আনন্দ বেশি। জয়শ্রীর মনে হয়, ইন্দ্র কিছু বলতে চায়। কিন্তু ওই মনে হওয়াই। কিছুই তো বলে না স্পষ্ট করে। জয়শ্রী অপেক্ষা করে। জানে না কবে আসবে সেই দিন!

অত সাধের স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাওয়ায় একটু দুঃখ হল ওর। তারপর হঠাৎ মনে হল, ‘অনেক দিন তো হল স্বপ্ন দেখছি। আজ বরং নিজেই স্বপ্নটা সত্যি করে ফেলি। ও কিছু না বললে, আমিই বলে দেব।’

‘গুডমর্নিং, তাড়াতাড়ি এস। আমি আসছি…’ মেসেজটা লিখে ইন্দ্রকে পাঠিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে একটা হাই তুলল জয়শ্রী। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে নেমে চঞ্চল পায়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। দুধসাদা মাইসোর সিল্ক আর লম্বাহাতা ময়ূরকন্ঠী রঙের ব্লাউজটা বের করল। শাড়ির ভাঁজেই রাখা ছিল মাইসোর থেকে আনা চন্দন সাবানটা। সেটা ওর পায়ের সামনে পড়ে গেল শব্দ করে। প্যাকেটা খুলে লম্বা শ্বাস নিল। তারপর ঢুকে গেল স্নান ঘরে। স্নানঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে গুঞ্জরিত হচ্ছে,

‘বহু মনরথে সাজু অভিসারে, পেহেলু সুনীল বেশ
কাজর নয়ানে সলাজ বয়ানে কুসুমে সাজানু কেশ…’

-সমাপ্ত-
(গানের পঙক্তিঃ ঋতুপর্ণ ঘোষ)

Leave a Reply