অনু গল্পমালা

শ্যাম সুন্দর মুখোপাধ্যায়

কোলের ছেলে
আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা । সে সময় পরিবারে তিন চার জন বা তারও বেশি ভাইবোন থাকাটা খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল । বড়, মেজ, সেজ, ন, ছোট এইভাবে সন্তানদের ক্রমাঙ্কন করা হত । কোলকাতা ও তার উপকণ্ঠের ভাষায় অনেক সময় সর্বকণিষ্ঠ ছেলেটিকে কোলের ছেলে বলা হত ।
ভাইবোনদের মধ্য সবচেয়ে ছোট হওয়ার জন্য অনেক সময় মা আমার পরিচয় দিতে গেলে বলতেন – এ হল কোলের ছেলে । আর যখনই একথা বলতেন তখনই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন , অবশ্য তখন আমি অনেক ছোট ।
এরপর অনেক বছর কেটে গিয়েছে , কলেজ পাশ করে চাকরি জীবনের দু বছর পার করেছি । বেশ কিছুদিন হল মা কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী । অফিস থেকে ফিরে মায়ের ঘরে গেলাম । ছোট মাসী এসেছেন মাকে দেখতে , অনেক বছর পর । মায়ের বিছানায় মাথার কাছে বসলাম । শয্যাশায়ী মায়ের হাত মাথা অবধি গেল না, পিঠে হাত রেখেই মাসীকে বললেন – এই হল কোলের ছেলে ।
কতদিন পরে কথাটা শুনলাম । চোখে জল এসে গেল ।
**********
ঈশ্বর ও বাস্তব
এই বুড়ো বয়সে পরেশবাবুর আবার আগের মতো টোনাটুনির সংসার । অবসর জীবন চলছে তা প্রায় বছর ছয়েক হল । দুই ছেলে , তারা তাদের রাস্তা যে যার মত দেখে নিয়েছে । বছর গেলে একবার বিজয়ার পেন্নাম ঠুকতে আসে ।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর , মুখটুখ ধুয়ে পরেশবাবু নারায়ণ প্রণাম করেন । দেওয়ালে টাঙানো বহু পুরাণো চতুর্ভূজ নারায়ণের ছবি । ছবির কয়েক জায়গায় পোকায় খেয়েছে । হাত জোড় করে স্তব করেন , প্রণাম মন্ত্র বলেন । শেষে বলেন – নারায়ণ কৃপা কর ।
এরপর তিনি চা খাওয়ার জোগাড়-যন্ত্র শুরু করেন ।
পরেশবাবুর স্ত্রী বেলাদেবী এই সময় বিছানায় জেগে ঘুমান । ওনার তীব্র শ্রবণ শক্তি । শুয়ে শুয়েই শব্দ শুনে শুনে স্বামীর সকল গতিবিধি খেয়াল রাখেন । কখনও বলেন – বেসিনের কলটা কমিয়ে দাও জল ছিটছে । কখনও বা – আজ বিস্কুট নেই , মুড়ি খাও ।
চা বানানো , চা পান ইত্যাদি সারতে সারতেই সাতটা বেজে যায় । এই সময় পরেশবাবুকে আর একটা কাজ করতে হয় ।
ফ্ল্যাটের বেরোবার দরজা খুলে তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামেন । তাঁর ঠিক নীচের ফ্ল্যাটের দরজার পাপোষের দিকে তাকান । উনি খোঁজেন একজোড়া চেনা চটি । ওনাদের কাজের মেয়েটি এই ফ্ল্যাটেও কাজ করে এবং আগে এখানে আসে । চটি দেখতে পেলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন গিন্নিকে সু-সংবাদ দিতে ।
চটি না থাকলে দুর্যোগের আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে তাঁর ।
কী দুর্যোগ ?
সে আরেক কাহিনী । অনুগল্পে অত কথা লেখা যায় না ।
******
পটি
শব্দটি আমি প্রথম শুনি ২০০৫ সালে যখন আমার বয়স ৫০ বছর । আমাদের পুরণো রহড়ার বাড়িতে দেখা হল ভাইঝির সঙ্গে , ওর ছেলে তখন কিন্ডারগার্ডনে পড়ে । নাতির খোঁজ করতেই ভাইঝি বলল – ও পটি করছে ।
– কী করছে ?
– পটি করছে , পটি ।
– মানে ?
– আরে বাবা , পায়খানা করছে । হাগু হাগু, বুঝেছ এবার ।
– হাগু আবার পটি হ’ল কবে ? তোরা তো ছোট বেলায় হাগু ই বলতিস ।তুই শিখলি কোথা থেকে ?
– ইস্কুলের আন্টিরা বলে , বাচ্ছার মায়েরাও বলে ।বনিকেও আমরা সেটাই শিখিয়েছি । ও হাগু পায়খানা এ সব জানে না ।
আমি বললাম – গু হ’ল শুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ , দেবভাষা । গু মানে অন্ধকার ও আবর্জনা , গুরু শব্দ গু থেকে এসেছে । গুরু মানে যিনি মনের অন্ধকার দূর করেন । অজ্ঞানতিমিরন্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া ……. ।
– ও সব জ্ঞানের কথা জানি না । ভদ্রসমাজে এখন গু হাগু এসব কেউ বলে না ।তুমি আবার বনিকে এসব শিখিও না ।তোমার তো বাচ্ছাদের অসভ্য কথা শেখানোর ঝোঁক আছে ।
– না রে না । বনিকে বলতে যাব কেন এসব ।
সম্যক জ্ঞান লাভ করলাম ভাইঝির কাছথেকে – জায়গা বুঝে হাগু , অন্যথায় পটি ।
*******

যাদবপুরের গল্প

তখন আমার ইঞ্জিনিয়ারিং – এ থার্ড ইয়ার চলছে । আর দু বছর পর অর্থাৎ সাতাত্তর সালে পাশ করে বেরোব ।
মেট্রোলজির একটা সেশনাল জমা দেওয়ার ছিল , বেমালুম ভুলে গেছি ।যাদবপুরে মাঠের আড্ডায় জানা গেল লাষ্ট ডেট চলে গেছে ।কি আর করা যায় । অর্ধেক ক্লাস করে বিকালের মধ্যে বাড়ী ফিরে পাতা লেখা, ছবি আঁকা, কভার পেজ করে সেশনাল শেষ হয় মাঝ রাতে । পরদিন সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙে । তাড়াহুড়ো করে স্নান করা , ভাত খাওয়া , কাগজ পত্র ঝোলাব্যাগে পুরে চটি পায়ে গলিয়ে দৌড় ট্র্রেন ধরার জন্য । খড়দা স্টেশন থেকে আটটা বাহান্নর নৈহাটি লোকাল যার কানেক্টিং ট্রেন শিয়ালদা সাউথ থেকে নটা বিয়াল্লিশে । সেশনালটা ব্যাগে পোরার আগে একবার দেখে নিতে গিয়েই চক্ষু চড়ক গাছে । রিপোর্টের সামনের গোটা পাঁচেক পাতায় ডট পেনে ওপর থেকে নীচে লম্বা টানা দাগ । আমার আড়াই বছর বয়সের ভাইপোর কীর্তি । পাতাগুলো হয়তো হারুদার ষ্টোর থেকে কিনে লিখে নেওয়া যাবে । কিন্তু ছবি আঁকতে তো ঘন্টা চারেক লাগবে ।
সেশনাল জমা দিতে হ’বে মধুবাবুর কাছে । মধুসূদন সেনগুপ্ত , আমাদের ক্লাসের অনির্বাণের বাবা । কপাল ঠুকে রিপোর্ট হাতে নিয়ে ওনার চেম্বারের দরজায় ।
– আসব স্যার ।
ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করলেন ।
– মেট্রোলজির সেশনাল জমা দেব ।
ওনার টেবিলের পাশে একটা টেবিল, তার উপর ডাঁই করা আমাদের ব্যাচের রিপোর্ট । উনি সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন ।
– না স্যার , আপনাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে ।
কিছু বলছেন না । জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ।
আগ বাড়িয়ে রিপোর্ট খুলে ওনাকে দেখালাম । উনি পাতা উল্টে উল্টে দেখছেন আর আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন ।
আমি মনে মনে আর্জিটা গুছিয়ে রাখছি , আরও দু দিন সময় চাইব ।
রিপোর্ট দেখে বললেন – কে করেছে ?
– আমার ভাইপো স্যার ।
– বয়স কত ।
– আড়াই বছর ।
– তাহলে ঠিক আছে । ওই খানে রাখ ।
ধড়ে প্রাণ এল । রিপোর্ট জায়গায় রেখে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি । বেরোতে গিয়ে দরজা অবধি গেছি , গম্ভীর গলা শুনলাম ।
– শোন ।
আবার কি বিপদ রে বাবা ।
– বলুন স্যার ।
– জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাক ।
– হ্যাঁ স্যার ।
– আচ্ছা আস ।
এই রকম পিতৃপ্রতিম ব্যাবহার ছিল আমাদের যাদবপুরের শিক্ষকদের ।

Leave a Reply