শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী
১
এই পিংলাশ গাঁ খানাকে নিয়ে ভারী গর্ব আছে হরিশচন্দ্র খাঁনের। অবশ্য সেটা যে ঠিক গর্ব – তা হরিশ খাঁও ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না। তবে যখনই কোন কাজে এক-দু’দিনের জন্য হলেও গাঁয়ের বাইরে যেতে হয়, গাঁয়ে ফেরার জন্য প্রাণটা কেমন আঁকুপাকু করে। গ্রামটির বহিরঙ্গে তেমন কোন ফারাক কিন্তু চোখে পড়ে না – হয়তো তা আছে মুগ্ধ মনের কল্পনায়। গ্রামখানি আশেপাশের অন্য পাঁচটা গ্রামেরই কার্বন কপি যেন। যে সময়ের কথা লিখছি – তখনও বাজারে জেরক্স মেশিন আসে নি, নাহলে জেরক্স কপি বলা যেত হয়তো।
গ্রামের শেষ প্রান্তে হরিশ খাঁর বাড়ি। বাজার ডাঙা অথবা পাকা রাস্তাকে রেফারেন্স পয়েন্ট ধরলে গ্রামের শুরুও বলা যায়, কিন্তু এমনটাই ভেবে এসেছি চিরকাল। শুরু বামুনপাড়া দিয়ে, যা পাশের গ্রাম আগরাপাড়ার সীমানা শেষ হলেই। তারপর হাজরা-ঘোষ-পান-দলুই-বাগদি পাড়া পার হয়ে এলেই হরিশ খাঁর বাড়ি। দু কামরার একতলা মাটির বাড়ী। খড়ের চাল। একটু দূরে রান্নাঘর। কামরা দু’টোর সামনে একফালি দুয়ার, তিনটে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। সামনে গাছগাছালি ঘেরা উঠোন। একপাশে একটি ছোটো ডোবা – সারা বছরের মাছের বন্দোবস্ত হয়ে যায়। ডোবার চারপাশে কলাগাছ। একটু দূরে রাস্তার মোড়ে একটি টিউবওয়েল, হ্যান্ডপাম্পের দরকার হয় না, সবসময় জলের ধারা বইতে থাকে, আর্টেসিয়ান ওয়েল। ছোটবেলায় জানা ছিল এসব হরিশ খাঁর পোষা দুই ভুতের কীর্তিকলাপ। সেই কলের জল কাঁচা নালা দিয়ে বয়ে হরিশ খাঁর ডোবায় জমা হয়, ফলে তার ডোবা কখনো শুকোয় না। এই কলের জলেই গাঁয়ের অর্ধেক লোকের পানীয় জলের সংস্থান হয়। আর একটা টিউবওয়েল আছে, চৌধুরীপাড়ার দিকে। স্নানাদি ডোবা অথবা পুকুরের জলে, রান্নাবান্নাও পুকুরের জলে। অন্যান্য প্রাকৃতিক কাজকর্ম উদার আকাশের নীচে, শিব্রাম চক্রবর্তীর ভাষায় বলতে গেলে ‘উন্মুক্ত প্রকৃতির নীচে নিজেকে বিমুক্ত করার রেওয়াজ আছে’।
বউ (মাগ অথবা পরিবার ও বলা চলে), দুই মেয়ে ও তাদের পরিবার, একটি গাই ও বাছুর, একটি পোষা শালিক পাখি, কয়েকটি ছাগল, বিঘে তিনেক জমি, দুটি পোষা ভুত (তর্কসাপেক্ষ), শিবমন্দিরের চাতালে তরজা গান, বামুনদের ছোট-বাখুলে আকাশবাণী, পিংলাশ গাঁ তার সমগ্রতাসহ – এসব নিয়েই হরিশ খাঁর ছোট অথচ সম্পূর্ণ পৃথিবী।
সেদিন ভোর থেকেই বাগদি পাড়ায় উচ্চৈঃস্বরে ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে। ঝগড়ার কারণ গুরুতর কিছু নয়। একজনের ছাগল অন্যজনের শাকের ক্ষেতের কিছুটা অংশ সাফ করে দিয়েছে। এইসব সামান্য কারণেই এখানে তুলকালাম হয়ে যায়…অল্প লইয়া থাকি তাই মোর…ইত্যাদি।
খেঁদি বাগদি শাড়ীটাকে প্রায় হাঁটু অবধি তুলে, কখনো তিন পা এগোচ্ছে, কখনো দু’ পা পিছোচ্ছে। হাতের মুদ্রায়, মাথা ঝাঁকানোয়, রুক্ষ চুলের উড়ানে সমস্ত শরীর যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বাখান পাড়া (খিস্তি)।
- নিজের ছাগল নিজে সামলে রাখতে পারু নি হারামজাদি? আমার শাগ খেয়ে গেল। ইবার তোর কুন ভাতার এসে আমাকে খাওয়াবে শুনি? আগে দেখতে পেলে খুঁয়াড়ে দিয়ে আসতম। দু’টাকা দিয়ে ছাড়াতে হলে, ঠ্যালা বুঝতিস।
- শুদুমুদু গাল পেড়োনিগো খেঁদিদ্দি, ভাল হবে নি বলে দিচ্চি। তুমি কি দেকেচো আমার ছাগলই তোমার শাগ খেয়েচে?গাঁয়ে কি ছাগলের অভাব আচে?
- ক্যানে মিছা কতা কইচু? উটা তোর ছাগলেরই কাজ। অমন ঝেঁটিয়ে খেতে আর কুনু ছাগল পারবেনি, যেমন তুই তেমন তোর ছাগল। সব সময় নোলা ঝরছে। আমি দেখতে পেলে তো এতখন তোর ছাগল খুঁয়াড়েই থাকত। হারুর মা তো দেখেচে। সে কি মিছা কতা কইবে?
- অ্যাকেই বলে শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। হারুর মার কতা আর বোলো নি। ক্যানে শুদুমুদু আমার মুক খুলাচ্চো?
খেঁদি বাগদি কোনকালেই যুক্তি-তক্কের ধার ধারে না। এবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘ওলো মাগী, বারোভাতারি, তুই উকিলি ফলাচ্চু আমার সঙ্গে? আমি বলেচি যখন তোর ছাগলেই খেয়েচে, তখন তোর ছাগলেই খেয়েচে’।
ভাতার সংক্রান্ত বিশেষণটি ধনার মার মর্মে প্রবেশ করল। ফলতঃ ঝগড়ার অভিমুখ সহসা ছাগল ও শাকের ক্ষেত থেকে ঘুরে গিয়ে ভাতারে পড়ল।ধনার মা বলল, ‘তুমি মুক লাড়চ কুন মুকে, ভাতারখাগি? তমার মুকের জ্বালায় তো ভাতারটা মরল। মুকে তো ভাল কথা কুনুদিন শুনিনি একটা’।
হরিশ খাঁ বাগদি পাড়া ছেড়ে এগিয়ে বামুনপাড়ার পথ ধরল। সকাল সকাল এই ঝগড়াঝাঁটি, চিল্লামিল্লি, হরিশ খাঁর একেবারেই ভাল লাগে না। নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় মানুষ চিরকালের – এইসব গোলযোগ থেকে শতহস্ত দূরে থেকে এসেছে সবসময়। জগতে কত কী জানার আছে – রেডিও তে বলে সব – প্রভাতী, সঙ্গীতাঞ্জলি, খবর, সমীক্ষা, অনুরোধের আসর, চাষবাসের খবর, তরজা গান। তা নয় – সকাল থেকে ছাগল, শাগের ক্ষেত, ভাতার নিয়ে ক্যাচাল।
ঝগড়ার আওয়াজ তখনও ভেসে আসছে।
- ওলাউঠা হবে তোর, হেগে মুতে পড়ে থাকবি। মুকে জল দেওয়ার জন্যিও একটা লোক থাকবে নি।
- তমার কুঠা হবে। মুকে পকা পড়বে। ওই যে অত হাত লেড়ে লেড়ে ঝগড়া করচ, ওই হাত তমার খসে যাবে। মা বাজারচন্ডীর কিরা আমি শুদুমুদু তমার সঙ্গে ঝগড়া করি নি। আমার ছাগলের কুনু দোষ নাই।
ঝগড়া যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎত শেষ হয়ে যায় – পারস্পরিক অভিসম্পাতে, অকাল্যাণ-কামনায়।
বামুনপাড়ায় তিন ঘর বামুন। ছোটবাখুল অর্থাৎ ছোট তরফের বামুনবাড়িতে হরিশ খাঁর নিত্য যাতায়াত, সকাল-সন্ধ্যে দু’বেলা। বাড়ির কর্তামশাই, এই অঞ্চলের নামকরা পণ্ডিত। আশপাশের বিশটা গ্রাম থেকে পণ্ডিতমশাই এর ডাক আসে – পুজো, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন ও অন্য নানাবিধ বৈদিক ক্রিয়াকর্মের জন্য। হরিশ খাঁ শুনেছে – পণ্ডিতমশাই এর নাম পি এম বাগচি পাঁজির পণ্ডিতদের লিস্টিতে আছে – শ্রী লক্ষ্মীনারায়াণ কাব্যতীর্থ। নিজের চোখে দেখেছে, মানুষটাকে সবাই কেমন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। অগুন্তি শিষ্য-সামন্ত, ভক্ত ছড়িয়ে আছে দূরদূরান্তরে। বাড়ির পুজো-পার্বণে তো বটেই, যে কোন সময়ে ভক্তবৃন্দের আনাগোনা লেগেই আছে বাড়িতে। সবার জন্য অবারিত দ্বার, আর আছে গুরুমার হাতের রান্না – অমৃতসমান।
শুধু যে তিনি ঝাঁকরা হাইস্কুলের সংস্কৃত হেডপণ্ডিত তাই নন, ছাত্রছাত্রীদের ব্রতচারী শেখান, ছেলেদের ফুটবল খেলায় রেফারি। বাংলা ভাষাতেও অসামান্য জ্ঞান। বাংলার স্যারেরা কোন সমস্যায় পড়লে পণ্ডিতমশাই এর কাছ থেকেই বুঝে নেন। কথায় কথায় বেদ, পুরাণ, সংস্কৃত স্তোত্র-মন্ত্রের ব্যাখ্যা, গল্পের আকারে বিশ্লেষণ – হরিশ খাঁ হাঁ হয়ে শোনে সব। ভারি ভালো লাগে পণ্ডিতমশাই এর কাছাকাছি থাকতে। কত কি জানা যায়!
- ‘বড় লাতনিটা ভালো আছে তো?’ জিজ্ঞেস করল বামুন-মা।
- ‘না, খুব একটা ভালো নাই। জ্বরটা এখনো নামে নি। কাশিও আছে’। হরিশ খাঁ জানায় বিরস মুখে।
- ডাক্তার দেখালে, না তোমার কবিরাজিই চলছে?
- কবরাজিই চলছিল, কিন্তু মাগ বলল অ্যালাপাথি করাতে। বড় মেইছ্যানাটাও দেখলম মায়ের দলে। কবরাজি করে কি আমি কম অসুক-বিসুক সারিয়েচি? এরা কি বুঝবে তুলসী পাতা, বাকস পাতা (বাসক), থানকুনি পাতার মর্ম? বড় বড় গরুর সান্নিপাতিক পর্যন্ত ঠিক করে ফেললম, আর সামান্য জ্বর!
- কোন ডাক্তার দেখালে?
- কাল হাটবারে ঝাঁকরা গেছলম, দেখালম মদন ডাক্তারকে। তিনদিনের মিকচার দিয়েচে। বলেচে ঠিক হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ বসতে হল কাল। হাটবারের ভিড় মদন ডাক্তারের চেম্বারে।
মদন ডাক্তার সাক্ষাৎ ভগবান এই অঞ্চলের মানুষের কাছে। ছেলে, বুড়ো, মহিলা সবার জন্যই তার কাছে পাওয়া যায় এক অপার্থিব মিক্সচার। কাচের বোতলের গায়ে, কাগজ কেটে লেবেল সাঁটা থাকে, প্রতিদিনের ডোজ বোঝানোর জন্য। কত যে জটিল, দুরারোগ্য রোগ ঠিক করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। জীবনের ঋণ রয়ে যায় এই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সাদামাটা মানুষটির অন্তরের বৈভবের কাছে!
হরিশ খাঁ বলেই চলল, ‘তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার নম্বর এল। একেবারে ঝেঁটিয়ে লোক এসেচে গো পিংলাশ, খলকপুর, আগরাপাড়া, সাতডুবি, কুঁয়াপুর, ভগীরথপুর, রাজগঞ্জ, ধান্যগাছি সব জায়গা থেকে। মানুষের রোগ জ্বালার আর শেষ নাই। সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটখারাপ, মাথাধরা, বুক আটুবাটু, বুক ঢিপঢিপ সব লেগেই আছে’।
ইতিমধ্যে গোবিন্দ মণ্ডল, জলধর হাজরা, প্রফুল্ল ঘোষ এবং আরও কয়েকজন প্রতিবেশী হাজির হয়েছে। কাপে কাপে চা এসে গেল। আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান চলছে। চলছে কিছু বৈষয়িক কথাবার্তাও। চাষের সময় অনুযায়ী সেই সব কথাবার্তাও বদলে যায়। ধানের দর, কোন জমিতে বাত হল, মাজরা পোকা, ধান রোয়া, বীজতলা, কার ঘরে হল বকনা বাছুর, চন্দ্রমুখী না জ্যোতি আলু, ঘনরামপুরে এবার শীতকালে কোন যাত্রা পার্টি আসবে – আলোচনা গড়িয়ে চলে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে।
জলধর হাজরা বলল, ‘হরিশদা, ইবারে একদিন ঘপসা দিগর এর ছোট মেয়াটার দেখাশুনা ফাইলেন করতে হবে। ঘপসা দিগর অনেক দিন ধরেই বলচে’।
বিয়ের সম্বন্ধ ফাইন্যাল করায় বিস্তর অভিজ্ঞতা হরিশ খাঁ ও জলধর হাজরার। হরিশ খাঁ জিজ্ঞেস করল, ‘কুন সম্বন্ধটা, সেই বালা গাঁয়ের?’
- না গো সেই বালার সম্বন্ধটা কেটে গেচে, ইটা এসচে গড়াল থিকে। ছ্যানাটি ভাল, নিজেদের জমি-জায়গা আচে।
- টাকাপয়সার খাঁই কি রকম?
- লগদ কুড়ি হাজার, সাইকেল, রেডিও, সোনার চেন আর টিটম ঘড়ি খুঁজচে।
- টিটম ঘড়ি টা আবার কি জিনিস? আমরা তো চিরকাল এইচ এম টি ঘড়িই শুনে এসেচি।
- আজকালের ছ্যানা-ছোকরাদের ব্যপার সব – এখন ওই লতুন টিটম ঘড়ি বাজারে এসেচে বলচে, টাটা কুম্পানির।
- ই তো ভালই চাহিদা দেকচি, ঘপসা দিগর কি অত দিতে থুতে পারবে? বড়জোর হাজার পাঁচেক টাকা আর রেডিওটা। রেডিওটা ঘরে একটা থাকা ভাল, অনেক কিছু জানতে পারবে। সাইকেল লিয়ে করবেটা কি?
- হরিশদা, রেডিওটা দরাদরি করে শেষ পর্যন্ত না দিলেও চলবে, অত কারো জানার ইচ্ছা নাই, কিন্তু সাইকেল তো দিতেই হবে। আজকাল হাটে, মেলায় দেখোনি, সামনের রডে লতুন বউকে বসিয়ে সব ফাঁট মেরে ঘুরচে।
- তাহলে হাট বার ছাড়া অন্য কুনু দিন দেখে বল, একবারে ফাইলেন করে আসতে হবে।
রবিবার ও বৃহস্পতিবার হাট বসে ঝাঁকরায় নতুন দিঘির পাড়ে। তাই সপ্তাহের ওই দুটি দিন হাটবার নামেই পরিচিত হয়ে গেছে। যেন হাট ছাড়া অন্য কোন নিজস্বতা অথবা গুরুত্ব নেই ওই দুই বারের – যেমন হয়ে যায় ধনার মা, গনার মায়েরা।
হাটবারে হরিশ খাঁ কে হাটে যেতে হয় চাষের আনাজপাতি বিক্রি করতে, ফিরতে ফিরতে বিকেল। তাই হাটবার ছাড়া অন্য দিন – ঘপসা দিগর এর ছোট মেয়াটার সম্বন্ধ ফাইলেন করার জন্য।
সেদিন পণ্ডিতমশাই বলছিলেন দধীচি মুনির গল্প।বৃত্রাসুর নামের অসুর দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাস্ত করে স্বর্গের দখল নিলেন। জগতের সব জল শোষণ করে বৃত্রাসুর নিজের অসুর সেনার কাজে লাগালেন এবং জগতবাসীকে টাইট দিতে লাগলেন। গাঁয়ের কারুর জল, নাপিত বন্ধ করলে কি হয়, তা হরিশ খাঁর ভালই জানা আছে। ইন্দ্র ঠ্যালায় পড়ে শরণাপন্ন হলেন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর। বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন একমাত্র দধীচি মুনির বজ্রসম হাড় থেকে প্রস্তুত অস্ত্রের সাহায্যেই বিনাশ সম্ভব বৃত্রাসুরের। তখন ইন্দ্র ও অন্য দেবগণ দধীচি মুনির কাছে পৌঁছলেন এই অদ্ভুত আব্দার নিয়ে – আপনি মরুন স্যার, আমরা বাঁচি। আরও আশ্চর্য ব্যপার ইন্দ্রদেব এই দধীচি মুনিরই মস্তক ছেদন করেছিলেন একবার, নিজের গদি হারানোর ভয়ে। সে যাত্রা অশ্বিনীকুমারদ্বয় বাঁচিয়েছিলেন দধীচি মুনি কে।যাই হোক, মহৎ প্রাণ তো থাকে সব জায়গায়, সব যুগে। দধীচি মুনি সম্মত হলেন, জগতের কল্যাণে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে। তিনি জানালেন তাঁর অন্তিম ইচ্ছার কথা – তিনি তীর্থভ্রমণে যেতে যান, দেখতে চান জগতের সমস্ত পুণ্যসলিলা স্রোতস্বিনীকে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্যবস্থা করে দিলেন – সমস্ত নদীকে নৈমিষারণ্যে এনে ফেললেন, যাতে তীর্থভ্রমণে অযথা টাই্ম পাস না করে, কাজের কাজটা তাড়াতাড়ি করা যায়। তখন নদী দর্শন সমাপ্ত করে মহামুনি বসলেন গভীর ধ্যানে, মুক্ত করলেন প্রাণের বন্ধন। অতঃপর কামধেনু গাভীর বৎস লেহন করতে লাগল মহামুনি দধীচির শরীর। ধীরে ধীরে প্রকট হোল অস্থিসমূহ। সেই অস্থি দিয়ে প্রস্তুত অস্ত্রের সাহায্যেই ইন্দ্রদেব পরাস্ত করলেন বৃত্রাসুরকে, ফিরে পেলেন স্বর্গরাজ্য। তারপর থেকেই এ ধরায় খ্যাত দধীচির ত্যাগ।
পণ্ডিতমশাই আরও বললেন, ‘আমাদেরও দেশের সীমানায় দিন-রাত পাহারায় আছে যে সব সেনাবাহিনীর জওয়ান, তারাও নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে, দেশের সেবায় নিযুক্ত। দেশের কাজে অদম্য সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরষ্কার হল পরম বীর চক্র, যাতে খোদাই করা থাকে বজ্র-চিহ্ণ, সেই বজ্র যা দেবরাজ ইন্দ্র প্রস্তুত করেছিলেন দধীচি মুনির অস্থি থেকে’।
পণ্ডিতমশাই মাঝে মাঝে খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। হরিশ খাঁর মনে পড়ল অনেক বছর আগে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর এরকমই একটা পুরষ্কার কিছু মিলিটারিকে দিয়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগ পুরষ্কার পাওয়া সেনাই তো মারা গিয়েছিল যুদ্ধে, তাদের পরিবারের লোকেরা নিয়েছিল পুরষ্কার। রেডিওতে খুব যুদ্ধের কথা শোনা যেত সেইসময়। হরিশ খাঁ ভাবে – এই পিংলাশ গাঁয়েরও তো অনেকে লড়াই করেছে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সঙ্গে। তাদের নাম কি কোথাও লেখা আছে? কত লাশ গায়েব হয়ে গেছে নীলকুঠীর গুম ঘরে কে তার খবর রাখে? পণ্ডিতমশায়ের কাছে শুনেছে এই পিংলাশ নামটা নাকি এসেছে পিঙ্গল দের লাশ থেকে। গাঁয়ের লোকেরাও মেরেছিল অনেক পিঙ্গল চোখের অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের।
নীলকুঠীটা এখন একটা পোড়ো বাড়ি, গোটা কয়েক দেওয়ালই অবশিষ্ট আছে। দরজা, জানালা চুরি হয়ে গেছে কবেই। পুরো জায়গাটা জুড়ে, নানা রকম গাছের ঝোপ। অশথ গাছও আছে দু’-একটা। একটু দূরে এক দিঘি, নাম তার কৃষ্ণসায়র। হয়তো কৃষ্ণসায়র এর জলেই হত নীল চাষ। হয়তো কৃষ্ণসায়র এর জলেই একদা মিশেছে গরীব নীল চাষির রক্ত, অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের রক্ত।
সকালের চা-পর্ব শেষ হয়। সবাইকে যেতে হয় চাষের কাজে। পণ্ডিতমশাইও উঠে পড়েন। ভাল করে সারা গায়ে সরষের তেল মেখে চট করে একটা ডুব দিয়ে আসেন পুকুরের জলে। তারপর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকেন – ব্যাকব্রাশ – জীবনের একমাত্র বিলাসিতা। ধুতি পাঞ্জাবি পরে খেতে বসেন। ঝাঁকরা হাইস্কুল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পিংলাশ থেকে। পঞ্চাশো্দ্ধ্ ঋজু শরীরে, এটুকু রাস্তা তিনি হেঁটেই যাতায়াত করেন – যদিও বাস সার্ভিস চালু হয়েছে কয়েক বছর। কিন্তু পণ্ডিতমশাই কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাকে অপছন্দ করে এসেছেন চিরকাল – তা পথিকৃৎ, চন্দ্রাণী (বাসের নাম) কোন্ ছার।
২
দেশের পুজোটা খুব জমিয়ে হয় পিংলাশে, বছরে দু’বার – অঘ্রানে আর ফাল্গুনে। বড় শীতলা, ছোট শীতলা, যোগিনী, বাজারচন্ডী, শ্মশানকালী – এই পাঁচ মন্দিরে পুজো হয়। শ্মশানকালীর পুজো অঘ্রানে হয় না, শুধু ফাল্গুনে। ব্যাপ্তি এবং জৌলুসে আশেপাশের আর কোন গ্রাম এর ধারে কাছে আসতে পারে না। এরমধ্যে বড় শীতলা, ছোট শীতলা এবং বাজারচন্ডীর স্থায়ী মন্দির আছে, নিত্যসেবা হয়। সব মন্দিরেই পাঁঠাবলি হয় পুজোর সময়। যোগিনী মায়ের পুজো হয় গাঁয়ের ঈশান কোণে এক কয়েত গাছের তলায় মাটির অস্থায়ী বেদী তৈরি করে। বেদীটি পুজোর দিনই তৈরি করা হয়। বেদীর মাঝে প্রোথিত করা হয় এক কলাগাছ – তিনিই যোগিনী মাতা। চারপাশে চাষের ক্ষেত।কয়েত গাছের স্নিগ্ধ হাওয়া। দূর থেকে লোকে দেখে, শূন্য মাঠে কিছু উৎসবমুখর মানুষের জটলা।
পুজো শুরু হয়ে যায় সকাল থেকেই। এক পুজো শেষ হলেই সব লোকজন পরের পুজোর থানে হাজির হয়। বড় শীতলা এবং ছোট শীতলার মন্দিরে কলস পুজো হয়, সঙ্গে থাকে মা শীতলার ছবি। দুই শীতলা এবং যোগিনী মার পুজো হবার পর সকলে যায় বাজারচন্ডী মার মন্দিরে। মন্দিরটি যে জায়গায় – তার নাম বাজারডাঙা। এটিই একমাত্র বাজার এখানে। যে গুটিকয় বাস যায় পিংলাশ হয়ে, তাদের স্টপেজ এখানেই। একটি ছোট বটগাছের তলায়, দুটি বাঁশের বেঞ্চ – এই হল বাস-স্টপ। দুটি মুদি দোকান, একটি মণিহারী, দুটি চায়ের দোকান, একটি সারের দোকান, এক-দুটি ছোট পান-গুমটি এই নিয়েই বাজারডাঙার বাজার। বাজারচন্ডীর মন্দিরে যে পাথরের বেদীটিকে পুজো করা হয় মাতৃজ্ঞানে, লোককথা অনুসারে তা আসলে মূল মন্দিরের চুড়ো। মূল মন্দির মাটির তলায়। শোনা যায় কোন রাখাল ছেলে গরু চরাতে এসে ওখানে মূত্রত্যাগ করেছিল। তারপরে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওখানেই গড়ে উঠে মন্দির। আরও গভীরে খনন করে পুরো মন্দিরটি বের করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয় নি।দেশের পুজোর সময় ছাড়াও দুর্গানবমী এবং দোলপূর্ণিমাতে খুব আড়ম্বর সহকারে পুজো হয়। বাজারডাঙা থেকে কিছুটা এগিয়ে, পিংলাশ হাইস্কুল, নীলকুঠী আর কৃষ্ণসায়র পেরিয়ে গেলেই পড়ে এক গোচারণভূমি – গোডাঙা, যা কালক্রমে অপভ্রংশ হয়ে গোড্ডাঙা অথবা গোড্ডাঙর। সেখানেই অস্থায়ী ছাউনিতে হয় শ্মশানকালীর পুজো, গভীর রাত্রে। একশোরও উপর পাঁঠা পড়ে, অর্থাৎ পাঁঠাবলি হয়। পাঁঠাদের ম্যা ম্যা, ভক্তদের মা মা ডাকে চমকিত হয় রাতচরা পাখি।
তিন ব্রাহ্মণ বাড়ীর সকলেই যুক্ত থাকে পুজোর সঙ্গে। বাড়ীর পুরুষরা পুজোর বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত থাকে।বাড়ীর মহিলারা পুজোর ভোগের জন্য বানায় মুড়কি, সুজি, লুচি। গাঁয়ের প্রায় সব বাড়ি থেকেই পূজোর সিধে আসে, আতপ চাল আর কলা, অন্য ফলমূলও দেয় সাধ্যমত। ছোট মত মেলাও বসে – কাঠি আইসক্রিম, শশা কুচি দেওয়া চানাচুর, গ্যাস বেলুন, ডুগডুগি এসব পাওয়া যায়। আর একটা হয় মজার খেলা। এক বালতি জলের মাঝখানে একটা ছোট গ্লাস বসানো থাকে। জলের উপর থেকে একটা দশ পয়সা এমনভাবে ফেলতে হবে যাতে সেটা গিয়ে ওই গ্লাসের মধ্যে পড়ে। পয়সা যতবারই ফেলা হয় সেটা উপর থেকে নিচে নামার সময় জলের মাঝে দুলতে দুলতে ঠিক গ্লাসের বাইরে গিয়েই পড়ে। লক্ষ্মী যে চঞ্চলা – তা এই পরীক্ষার মাধ্যমেই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণ হয়ে যায়।
হরিশ খাঁ পুজোর দিন সকাল থেকেই পরিষ্কার ধুতি ও হাফ হাতা গেঞ্জি পরে ঘুরতে থাকে এক পুজো থেকে অন্য পুজো প্রাঙ্গণে। শোনে পণ্ডিতমশায়ের উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেয় দেশের পুজোর প্রতিটি মুহূর্ত। মনে মনে আওড়ায়, পিংলাশ হাইস্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীতের এক কলি – এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। পিংলাশ গাঁ কে নিয়ে এমন একটা গান – ভাবা যায়! কে লিখেছে কে জানে? আরও একটা গান হরিশ খাঁর খূব মনে ধরেছিল। এক হাটবারে (বৃহস্পতিবার)হাট থেকে ফেরার সময় একবার উঁকি মেরেছিল ঝাঁকরা হাইস্কুলের মাঠে। দেখেছিল পণ্ডিতমশাই ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছেন একটা গান। তারা সব গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, নেচে নেচে, দুলে দুলে গাইছে –
চল কোদাল চালাই,
ভুলে মানের বালাই
ছেড়ে অলস মেজাজ,
হবে শরীর ঝালাই।
যত ব্যাধির বালাই,
বলবে পালাই পালাই
পেটে খিদের জ্বালা,
খাব ক্ষীর আর মালাই…
এটাই তাহলে পণ্ডিতমশায়ের সেই ব্রতচারী গান। আহা কি সুন্দর! কোদাল চালাতে বলছে, ছেলেমেয়েরাও মিছিমিছি কোদাল চালানোর ভঙ্গী করছে। কোদাল চালানোটা তাহলে খারাপ কিছু নয়। খারাপ হবেই বা কি করে, ওই কোদাল চালিয়েই তো আনাজপাতি ফলানো হয়, সেই আনাজ নিজেদের খাওয়া হয়, হাটে বিক্রি হয়। হরিশ খাঁ মনে মনে একবার, হাত বুলিয়ে আদরই করে নেয় কোদালের লোহার চ্যাটালো অংশ আর কাঠের বাঁটটাকে।
- হরিশ খুড়া, যাবে নাকি আজ সন্ধ্যাবেলা? বিচার আছে আজ মুখ্যার বাখুলে।
- কিসের বিচার?
- সে একটা লট কেস আছে, জাঁত দেয়া হবে।
- না না, উসব জাঁত ফাঁত দেয়া আমি দেকতে পারবনি। তোদের কী ভাল লাগে উসব জাঁত দেয়া দেকতে? একটা নিরীহ লোককে সবাই মিলে ঘিরে ধরে, নীচে বাঁশ, উপরে বাঁশ দিয়ে ডলে দিয়ে তোদের কী লাভ হয়?
- নিরীহ বলচ? যখন লট করেছিল তখন মনে ছিল নি? দেশে বিচার ব্যবস্থা বলে তো একটা জিনিস আছে নাকি?
অবৈধ প্রণয় বা লটঘট কে সংক্ষেপে লট বলা হয়। লট করলেই যে সবসময় শাস্তি হবে তেমন কোন কথা নেই, সেটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের উপর। সব লট নয় সমান! এভাবেই এক সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা বা বিচারব্যবস্থা চলে আসছে। নিকটবর্তী থানার ভৌগোলিক দূরত্ব হয়ত বেশী নয়, কিন্তু পুলিশের কাছে অঞ্চলটি আজও দুর্গম। কদাচিৎ দর্শন মেলে পুলিশের। ভাবতে অবাক লাগে কত বছর আগে ব্যবসার জন্য ইংরেজরা সেই দুর্গমতা অতিক্রম করে, হয়ত ঘোড়ায় বা পাল্কিতে চড়ে, পৌঁছে গিয়েছিল এই পিংলাশ গাঁয়ে।
গনা গলাটাকে একটু খাদে নামিয়ে বলে, ‘না গো খুড়া শুদু জাঁত দেয়া লয়, আরও আলোচনা আচে মিটিঙে। জান কি অরা সড় (ষড়যন্ত্র)করচে – দেশের জমিটা হড়প করবে। দেবোত্তর সম্পত্তি – পাঁচ বিঘা জমি, যার আয়ে আমাদের দেশের পুজো, সেটা লিয়ে অরা হজম করতে পারবে? দেশে কি ঠাকুর দ্যাবতা বলে কিছু নাই?’
অরা মানে পাশের গাঁ, ফিসফিসিয়ে তার নামটাও বলে গনা। হরিশ খাঁর ঠিক বিশ্বাস হয় না, এমন কিছু হবে বলে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে এই দেশের পুজো। মা শীতলা, মা কালীর দয়ায় রক্ষে পেয়েছে এই গাঁ, নাহলে কবেই কলেরায় সাবাড় হয়ে যেত। সেই পুজো বন্ধ হয়ে যাবে? না না, দেশের লোক ঠিক আলাপ আলোচনা করে কিছু ব্যবস্থা করবে। পাশের গাঁয়ের লোকেরাও তো আনন্দ করে এই আমাদের দেশের পুজোয়। তারা কি এমনটা করতে পারে?
হরিশ খাঁ বলে চলে, ‘না না, তরাই যা, আমি আর যাবনি মীটিঙে। পুজো কখনো বন্ধ হয়?’ হরিশ খাঁ বলল বটে, তবে মনে একটা খটকা রয়েই গেল, দেশের পুজোর অনিশ্চয়তা নিয়ে।
গোপন খবর এসেছে, আজ রাতেই জমি দখল হবে। সন্ধ্যে থেকেই গনা গোড্ডাঙরের মাঠে একটা বটগাছের মাথায় উঠে বসে আছে। বিতর্কিত জমির কাছাকাছি কোন আলোর রেখা দেখা দিলেই, গনা খবর দেবে গাছের নীচে বসে থাকা ধনাকে। ধনা জানান দেবে পিংলাশের লোকজনকে। তারাও সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকবে। সমস্ত কাজটা করতে হবে অত্যন্ত গোপনে। ওদের তরফের লোকজনও নিশ্চয় নজর রাখছে অন্য কোন গাছ থেকে। গনা, ধনা দুজনের কাছেই তিন সেলের টর্চ, তবে সেটা জ্বালানোর ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। খুব প্রয়োজনে, অল্প সময়ের জন্যই জ্বালিয়েই আবার নিভিয়ে দিতে হবে, নাহলে ওরা বুঝতে পেরে যাবে। সন্ধ্যে থেকে মশা মেরে মেরে ক্লান্তিতে যখন গনা ধনার প্রায় ঘুম আসার জোগাড়, তখন দূরে আলো দেখা গেল, রেখা নয় – একেবারে হ্যাজাক বাতির চড়া আলো। অনেক লোকলস্কর, মিছিলের মত এগিয়ে আসছে জমির দিকে। হাতে কুড়ুল, টাঙ্গি, বর্শা, লাঠি, বাঁশের কঞ্চির মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়ে পতাকা। জমি দখল করে, পতাকা লাগিয়ে সীমানা চিহ্নিত করে তবে ঘরে ফিরবে সব। কেউ বাধা দিলে কি হবে তা সঙ্গের অস্ত্রশস্ত্র থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
মুহূর্তের মধ্যে খবর পৌঁছে গেল পিংলাশের মোড়লদের কাছে। মুখ্যার বাখুলে সবাই অপেক্ষা করছিল এই সংবাদের জন্যই, তেড়েফুঁড়ে লাফিয়ে উঠল সবাই। এ পক্ষেও সবাই প্রস্তত হয়েই ছিল – লুঙ্গি পরে, গায়ে তেল মেখে, কোমরে গামছা। হাতের অস্ত্রশস্ত্র ওদের মতই। যোদ্ধা বাহিনী এগিয়ে চলল জমির দিকে। রক্তে আগুন জ্বলছে। হরিশ খাঁর ক্ষীণ আওয়াজ চাপা পড়ে গেল সমবেত রোষের উল্লাসে – ‘একবার অদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে…’।
দুই দল মুখোমুখি ভুঁইতার মাঠে। গর্জন, প্রতিগর্জনে কেঁপে উঠছে রাতের আকাশ। ফুলে ফুলে উঠছে গলার শিরা, হাতের পেশী।
- এই জমিটা আমাদের। শালা, তরা ঠাকুরের নাম করে অনেকদিন ভোগ করেছু জমিটা। আজ যদি এর দখল না লিয়ে যাই, তাহলে শালা, আমি এক বাপের ব্যাটা লই। অনেক ঢ্যামনামি করেছু শালারা, আজ এর শেষ দেখে ছাড়ব। তোদের দেশের পুজা লিয়ে খুব গুমোর আছে লয়? ওই পুজা এবার বন্ধ করে ছাড়ব। আয় কে আছু বাপের ব্যাটা, এগিয়ে আয়।
দু’ পক্ষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি, গুঁতোগুঁতি, খিস্তি খেঁউড় চলতে থাকে। হঠাৎ ভিড়ের পেছন থেকে হরিশ খাঁ এগিয়ে আসে সামনে। দধীচি মুনি, পরম বীর চক্র, বর্ষার জলে-ডোবা ধানক্ষেত, আল পেরনো সাবধানী কাঁকড়া, অঝোর বর্ষায় তালপাতার পেখা মাথায় হরিশ খাঁ নিজেই, শিবের গাজনের সময় তরজাগান, ভুঁইতার মাঠের ধারে অশথ গাছের তলায় খেঁজুর পাতার ত্যালাই পেতে পণ্ডিত মশায়ের পরীক্ষার খাতা দেখা, সবার উপরে মা শীতলা, যোগিনী, বাজারচন্ডী, শ্মশানকালীর পুজো – এই সব দৃশ্যকল্প কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় হরিশ খাঁর মগজে কে জানে, সে হঠাৎ সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করে উঠে, ‘আমি আছি বাপের ব্যাটা, এই জমি দখল আমি বন্ধ করবই। ঠাকুরের জমি। নরকেও ঠাঁই হবে নি তোদের..’
এই বীরপুঙ্গবকে দেখে, ওদের রাগের থেকে কৌতুক হয় বেশী। বলে, ‘সরে যা সামনে থেকে, প্যাঁকলা বুড়া। রাগের মাথায় কখন কি হয়ে যায়…’ বলতে বলতেই পাশ থেকে হঠাৎই এক টাঙ্গির কোপ এসে পড়ে হরিশ খাঁর মাথায়।
গাঁয়ের মোড়লরা শলাপরামর্শ করে – গঞ্জে লিয়ে গেলে বহুত হ্যাপা। কে পড়বে পুলিশ কেসের চক্করে? ওখানেও কি ডাক্তার বসে আছে এত রাতে চিকিছ্ছের জন্য, তার চেয়ে মদন ডাক্তার কেই খবর দেওয়া হোক। মদন ডাক্তার এসে এটুকুই শুধু জানাতে পারল – সব শেষ, এত রক্তপাতের পর আর মানুষ বাঁচে?
পূর্ণ গ্রাম্য মর্যাদায় হরিশ খাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল কৃষ্ণসায়রের পাড়ে, রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি। তার হৃদয় রয়ে গেল ভুঁইতার মাঠে, কৃষ্ণসায়রের কালো জলে, যোগিনী মার থানে, নীলকুঠীর ক্ষয়িষ্ণু ইটে। কিছুদিন পর একটি সমাধি মন্দির, গাঁয়ের মানুষেরই উদ্যোগে। কয়েক বিঘা জমি, ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিধবা স্ত্রীকে।
সমাধি মন্দিরের মার্বেল ফলকে লেখা রইল –
দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ
হরিশ চন্দ্র খাঁন
দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করলেন হরিশ চন্দ্র খাঁন। হয়ত আরও কিছুদিন বেঁচে থাকবেন লোকমুখে – গালগল্পে। মৃত্যুই বোধহয় তাঁর জীবনের একমাত্র স্মরণীয় কীর্তি। মৃত্যু কি মহিমান্বিত করে কোন আপাত-সাধারণ জীবনকে, নাকি মানুষই প্রয়োজনে মহিমান্বিত করে মৃত্যুকে – এইসব গূঢ় প্রশ্ন ভেসে বেড়ায় গোড্ডাঙরের করুণ বাতাসে। দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত ……দেশই বটে! এই পিংলাশ গাঁ ই ছিল তার দেশ, তার ভারতবর্ষ।