গার্গী রায়চৌধুরী
পুপু এখন রোজ দেরি করে ওঠে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ, স্কুল বন্ধ এখন। অন্য সময় স্কুল খোলা থাকলে পুপুকে উঠে পড়তে হয় ভোর বেলা। যদিও মা এখনও পুপুকে খুব বেশিক্ষণ ঘুমতে দেন না। পুপুর ভোরে ওঠার অভ্যাস নষ্ট হবে বলে। বাবা, মা দুজনেই অফিসে বেরিয়ে যান সকাল ৯টায়। তার আগে মা পুপুকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে, স্নান করিয়ে রেখে যান। পুপু যদিও একা এক এসব করতে পারে, এবার ও ক্লাস সিক্সে উঠবে। হাই স্কুল যাবে। নিজেকে একেবারেই ছোট ভাবে না ও। সাড়ে আটটায় এসে যায় কল্যাণী মাসি। এই মাসির কাছেই সারাদিন থাকে পুপু। মা সন্ধ্যের সময় ফিরে এলে মাসি বাড়ি চলে যায়। অবশ্য পুপু দের বাড়ীতে আরেকজন মেম্বারও আছে। সে পুপুর পোষা কুকুর শ্যাডো। পুপুর চার বছর বয়স থেকে সে রয়েছে এই বাড়ীতে পুপুদের সঙ্গে। পুপু তাকে নিজের বোন মনে করে। মা বাবা যখন থাকেন না বাড়ীতে তখন পুপুকে সেই সঙ্গ দেয়, সারা দুপুর ঘুম আসেনা পুপুর, সেই সময় কি কি করে পুপু আর শ্যাডো দুজনে মিলে সেটা সিক্রেট। সেটা জানে শুধু পুপু আর শ্যাডো।
রোজ সকালে মায়ের সঙ্গে পুপু কে ঘুম থেকে তোলার কাজে লেগে যায় শ্যাডো ও। ‘পুপু ওঠো ওঠো আট টা বাজে। আমার স্নান হয়ে গেছে, এবার তুমি বাথরুমে যাবে’।
মায়ের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে শ্যাডো এসে ওর ভেজা নাক টা ঘসে দেয় পুপুর মুখে। পউ পউ পউ করে হল্লা শুরু করে দেয়। তখন না উঠে আর কোন উপায় থাকে না পুপুর।
পুপুরা থাকে শহরের মধ্যিখানে একটা ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটা বড় হলেও এতে মন ভরেনা পুপুর। তার পছন্দ একটা বাগান ওয়ালা বাড়ি। ঠিক যেমন তাদের পাশের বাড়িটা। কি সুন্দর একটা বাগান আছে বাড়ির পিছন দিকে। সামনে থেকে বোঝার উপায় নেই যে বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ওত বড় একটা বাগান আছে। পুপুরা এই ফ্ল্যাট টাতে এসেছে বছর তিনেক হল কিন্তু ওই বাগান ওয়ালা বাড়ীতে ওরা কেউ কখনও কোন লোকজন দেখেনি। বাড়ির মালিক বিদেশে থাকেন। বাড়ি দেখা শোনা করে একটি লোক ও তার বউ। তারা দুজন ছাড়া বাড়ি তে আর কাউকে দেখা যায় না। মাঝে মাঝে ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পায় পুপু। বোধহয় কেয়ারটেকারদের বাচ্চা। পুপুদের ফ্ল্যাট দোতলায়। পুপুর ঘরের জানলা দিয়ে বাগানটা দেখা যায়। অনেক বড় বড় গাছ আছে সেখানে। সাজানো বাগান নয় মোটেই। একটা অগোছালো ছায়া ছায়া বাগান। বেশ লাগে পুপুর। কত পাখি আসে সেখানে। পুপুর ঘরে তো সারাদিন খেলা করে পুপু আর শ্যাডো। বাগান থেকে পাখির ডাকলেই শ্যাডো কান খাড়া করে, মাথা হেলিয়ে ছুটে যায় জানলার দিকে। একবার বাইরে তাকায় একবার পুপুর দিকে চেয়ে ডাকে পউ পউ। যেন পুপুকে পাখি দেখতে ডাকছে। শ্যাডোর ডাক শুনে কতবার ছুটে গিয়ে পুপু পাখি দেখেছে, হলুদ পাখি ল্যাজঝোলা। কখনও কোন ছোট্ট নীল পাখি। এছাড়া চড়ুই, শালিখ, বুলবুলি তো আছেই। পুপুর খুব ইচ্ছে করে শ্যাডো কে নিয়ে ওই বাগানে খেলা করবে। কিন্তু ওই বাড়ির লোহার গেট সবসময় বন্ধ থাকে। কেয়ারটেকার কথাই বলে না, গোমড়া মুখ তার। তাছাড়া অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে মানা আছে মায়ের। কিন্তু পুপুর দিন রাতের সঙ্গী যে বাগানটা, যেখানকার পাখি, গাছ সবার সঙ্গে ওর চেনা সেখানে যাওয়ার ওর কোন অধিকার নেই। এ কেমন অন্যায়। এসব কথা মা বাবা কে বলতে গেলে তাঁরা শুনবেন না। তাই মনের দুঃখের কথা পুপু শ্যাডো কে বলে। সে বোঝে পুপুর দুঃখ।
একদিন বাবা ডিনার করতে করতে অন্যমনস্ক গলায় মা কে বললেন,
‘ও আচ্ছা শোন, বলতে ভুলে গেছি এই রবিবার আমাদের সবার ডিনারের নেমতন্ন আছে পাশের বাড়ীতে’।
মা বললেন, ‘সেকি, ওখানে তো কেউ থাকেই না’।
বাবা বললেন, ‘বাড়ির মালিক কাল বিদেশ থেকে ফিরেছেন। আজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে দেখা, আমাদের বাড়ি আসছিলেন নেমতন্ন করতে। পাড়ার বেশ কিছু লোকজন বলছেন। আলাপ করতে চান’।
‘পাশের বাগান ওয়ালা বাড়ীতে নেমন্তন্ন বাবা? পুপু উত্তেজনায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে’।
মা, ধমক লাগান, ‘কি হচ্ছে পুপু, পড়ে যাবে যে। এত উচ্ছ্বাসের কি আছে? হ্যাঁ ওই বাড়িতেই নেমন্তন্ন’।
পুপু অতি কষ্টে আনন্দ চেপে রাখে, ওই বাড়ীতে যাওয়ার সুযোগ পাবে সে কোনদিন ভাবতেই পারেনি। আর মা কিনা বলছেন উচ্ছ্বাসের কি আছে। আর বাবাই বা কেমন, এত বড় কথাটা বলতে ভুলেই গেলেন। বড়দের হাব ভাব কেমন যেন অদ্ভুত লাগে পুপুর।
যাইহোক, পুপু প্রশ্ন করে, ‘বাবা আমরা বাগানে যেতে পারব তো’?
বাবা বলেন, ‘তা তো জানি না সোনা। বাড়ির মালিক নেমন্তন্ন করে কোথায় বসে খাওয়াবেন তা তো ওদের ব্যাপার’।
মা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘তোমার কি মাথা খারাপ পুপু? ওরা আমাদের ডিনারে ডেকেছেন, রাতে তুমি যাবে ওই বাগান দেখতে? সাপ, খোপ কি না কি আছে ওখানে। কেউ পরিস্কার করে না’।
পুপু চুপ করে রইল। শ্যাডো পাশ থেকে দুবার ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বোধহয় মার কথা শুনেই।
পুপুর খুব ইচ্ছে শ্যাডো কে নিয়ে ডিনারে যায়। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। সবাই কুকুর ভালবাসেন না। হয়তো বিরক্ত হবেন। পুপুর খুব মনখারাপ করছিল শ্যাডোর জন্য। কি আর করা। পরদিন যথাসময়ে মা বাবার সঙ্গে পাশের বাড়ীতে ডিনার করতে গেল পুপু। পুপুর বয়সী ছেলে মেয়ে এই পাড়ায় নেই, সবাই বড়। পুপুই ছোট একমাত্র। সবাই গল্প করছেন জমিয়ে, খাবার সার্ভ করছে কেয়ারটেকার আর তার বউ। এদের আগে দেখেছে পুপু। বাড়ির মালিক বললেন, ‘এরাই দেখাশুনা করে সব, দুজনে থাকে’। পুপুর খুব কষ্ট হল ওদের বাচ্চাটার জন্য। ওকে তো কেউ কাউন্টই করলো না। পুপু বলে উঠল, ‘আর ওদের বেবি থাকে, সে মাঝে মাঝে কাঁদে। আমি শুনেছি’। পুপুর কথা শুনে ভদ্রলোক পুপুর কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ওদের কোন বেবি নেই তো। তুমি ভুল শুনেছ। হয়তো বিড়ালের ডাক’। এপাড়ার সব বেড়ালদেরই মোটামুটি চেনে পুপু। ওদের নামও দিয়েছে নিজের মনে, স্টেসি, তার বাচ্চা ডোরেমি আর একটা হুলো তার নাম কালু। কিন্তু যে সময় পুপু বাচ্চার কান্না শুনেছে সেটা হুলো দের লাঞ্চ এর সময়। ওরা তখন পুপুদের বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে লাঞ্চ খেতে আসে। তাই কান্নার আওয়াজ বিড়ালের হতে পারে না। পুপু কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মার চোখের দিকে চোখ পরতে চুপ করে গেল। মা চোখ দিয়ে পুপুকে নিষেধ করলেন কথা বলতে। যাইহোক পুপুর তো একবার বাগান দেখার ইচ্ছা। কিন্তু পুপু বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করার ঝুঁকি নিতে পারল না। যদি না বলে দেয়? সবাই যখন গল্পে মশগুল পুপু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে এগুলো। অনেক বড় বাড়ি। গুলিয়ে যাচ্ছিল পথ, তবু পুপু বাগানের রাস্তা খুঁজে বার করে ফেলল। বাগানটা বেশ বড়, অন্ধকার। বেশ গা ছমছম করছিল পুপুর। যদিও একটা আলো টিমটিম করে জ্বলছিল একপাশে। পুপু ওই আলোর দিকে এগিয়ে গেল। আলোটা যেখানে জ্বলছিল সেটা একটা ছোট ঘর, বাগানের একপাশে, গাছে ঢাকা। পুপু উঁকি মেরে দেখল ঘরের মধ্যে ছয়টা পিস বোর্ডের বাক্স রাখা। তার মধ্যে কাপরে মোড়া কি সব যেন রাখা আছে। কাপড় গুলো নড়ছে, কয়েকটা বাক্স থেকে চিঁ চিঁ আওয়াজ ও বেরচ্ছে। ইশ নিশ্চয় এখানে স্টেসিটা বাচ্চা দিয়েছে। পুপু ভাবল। ওর খুব লোভ হল বাচ্চাগুলোকে দেখে। ও এগিয়ে গেল ঘরের মধ্যে। কিন্তু কাপড় সরিয়ে দেখার সুযোগ আর হল না। কে যেন আসছে এদিকে। পুপু চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে সরে গেল অন্ধকারের দিকে। দেখল কেয়ারটেকার এসে ঘরের দরজায় তালা মেরে দিয়ে চলে গেল। ভাগ্যিস ঘরে রয়ে যায়নি পুপু। কেয়ারটেকার চলে যেতেই পুপু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল ডাইনিং হলের দিকে। দেখল খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। মা পুপুকে বললেন, ‘কোথায় ছিলে, তোমাকে খুঁজছিলাম। তাড়াতাড়ি এসো’। পুপু এসে ডিনার করে নিল। ডিনার শেষে খানিক বসার পর একে একে সবাই বাড়ি যেতে লাগলেন। পুপুরাও উঠে পড়ল। বাড়ি যেতে যেতে বাবা মা দুজনেই বাগানবাড়ির ভদ্রলোকের প্রশংসা করছিলেন। ভদ্রলোক অমায়িক ও শিক্ষিত। পাড়ার সবার সঙ্গে কেমন সুন্দর নিজে থেকে আলাপ পরিচয় করলেন। মা বাবা খুব খুশি ভদ্রলোকের ব্যবহারে।
পরদিন রবিবার, মা বাবাও দেরি করে ওঠেন ওইদিন। পুপু তো আরও দেরি করে। সেদিন মা পুপুকে ডাকেননি। পুপু নিজেই ঘড়ি দেখে উঠল, আরে সাড়ে নটা বাজে। নির্ঘাত বকা খেতে হবে। পুপু চোখ ডলতে ডলতে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল মা বাবা বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছেন। দুজনেরই মুখ গম্ভীর। মা বলছেন, ‘কি দেশে বাস করছি আমরা। খবরের কাগজ পড়তে ইচ্ছে করে না। ছিঃ’। বাবাও সায় দিলেন। সামনে কাগজ খোলা ছিল। পুপু মায়ের কাছে গিয়ে দেখল সদ্যোজাত বাচ্চা চুরির খবর কাগজের পাতা জুড়ে। আর ছবি দেখে পুপুর চোখ ছানাবড়া। বাচ্চা গুলো কে যে রকম বাক্সে কাপড় মুড়ে রাখা হয়েছে ঠিক সেই রকম ছটা বাক্স যে ও দেখে এসেছে বাগানের ঘরে। পুপু মা কে বলল সে কথা, মা বাবা আমল দিলেন না। ওরা বললেন কোন কাজের জিনিস রাখা আছে হয়তো। মা তো উল্টে পুপুকে বকলেন বারণ করা সত্ত্বেও বাগানে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পুপুও নাছোড়বান্দা। ততক্ষনে টিভিতেও দেখাচ্ছে সেই খবর। বাক্স বন্দি সদ্যোজাতদের ছবি। পুপু অনেক বলে বাবাকে রাজি করাল বিষয়টা নিয়ে বাবার বন্ধু অলোক কাকুর সঙ্গে কথা বলার জন্য। অলোক কাকু পুলিশ কমিশনার। বাবা ফোনে অলোক কাকুকে বললেন। অলোক কাকু বাবাকে বললেন বাড়িতে এসে পুপুর সঙ্গে কথা বলবেন। মা বাবা দুজনেই পুপুকে বারবার বলতে লাগলেন বানিয়ে কিছু না বলতে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই অলোক কাকু চলে এলেন পুপুদের বাড়ি। গায়ে পুলিশের পোষাক নেই। সাধারন জামা কাপড় পরা। কাকু অনেকক্ষণ ধরে পুপুর সঙ্গে কথা বললেন, খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বললেন, ‘পুপু মা, কোন অভিযোগ ছাড়া আমরা তো কারো বাড়ি সার্চ করতে পারি না। আমাদের অন্য কোন উপায় ভাবতে হবে’। বাবা বললেন, ‘আমরা গিয়ে মালিক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম কিন্তু উনি তো আজ ভোরেই মুম্বাই চলে যাবেন বললেন। কেয়ারটেকার তো কাউকে ঢুকতে দেবে না’। পুপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ও বলল, ‘কাকু আমি যদি শ্যাডো কে ওদের মেন গেটের গ্রিল দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দি তাহলে একবার শ্যাডো কে নিয়ে আসতে আমি ভিতরে যেতে চাইতে পারি। কেয়ারটেকার নিশ্চয়ই তখন আমাকে যেতে দেবে আর আমি সেই ফাঁকে গিয়ে বাক্সে কি আছে দেখে আসব’। আলোক কাকু বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি বুদ্ধি রে তোর মেয়ের। কিন্তু তুই ভয় পাবি না তো? যদি কোন বিপদ হয় আমরা জানব কি করে’। পুপু ছুট্টে খেলার বাক্স থেকে ওর স্পোর্টসে পাওয়া ছোট্ট বাঁশি নিয়ে এলো। ‘এই যে কাকু কোন বিপদ হলেই হুইসেল। আর তোমরা তখন ভিতরে ঢুকে আমাকে আর শ্যাডো কে বাঁচিয়ে নেবে’। মার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল পুপুকে এই বিপদের মধ্যে যেতে দিতে মায়ের মন সায় দিচ্ছে না। আলোক কাকু মাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘পুপুর কিচ্ছু হবে না বৌদি তুমি ভেবো না’। এবার শ্যাডো কে ট্রেনিং দেওয়ার পালা। শ্যাডো পুপুর সব কথা কেমন বোঝে তার বর্ণনা অলোক কাকুকে দিতে থাকলেন বাবা আর পুপু ততোক্ষণে শ্যাডো কে বলে দিল কি করতে হবে তাকে। ‘তোকে গ্রিল গলিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেই তুই ছুটে বাগানের দিকে চলে যাবি বুঝলি? বাগানের পাশের ঘরেই বাক্স রাখা আছে’। শ্যাডো ডাকল পউ পউ, অর্থাৎ সব বুঝেছে ঠিকঠাক। পকেট ডগ ছোট্ট শ্যাডো কে সঙ্গে নিয়ে পুপু চলল পাশের বাড়ির দিকে। বাবা আর আলোক কাকু সঙ্গে চললেন। অলোক কাকু বাবাকে বললেন, ‘আমরা কিন্তু আড়ালে থাকবো। কেয়ারটেকার এতটুকু সন্দেহ যেন না করে’। প্ল্যান মতো ছোট্ট শ্যাডোকে গ্রিল গলিয়ে গেটের ভিতরে পাঠিয়ে দিল পুপু। তারপর বেল বাজিয়ে কেয়ারটেকারকে ডাকল। কেয়ারটেকার দোতলার বারান্দা দিয়ে মুখ বাড়াতেই পুপু বলল, ‘ও কাকু আমার কুকুরটা গ্রিল গলে ভিতরে ঢুকে গেছে আমায় একটু ঢুকতে দাও না, ওকে নিয়ে আসি’। কেয়ারটেকার বিরক্ত মুখে বলল, ‘এখানে কোন কুকুর ঢোকেনি, মালিক নেই দরজা খোলা হবে না’। বলতে বলতে ভিতরে শ্যাডোর চিৎকার শোনা গেল পউ পউ পউ। পুপু বলে উঠল ‘দেখ কাকু চেঁচাচ্ছে, ও কিন্তু খুব কামড়ায় তুমি ধরতে যেয়ো না। কামড়ে দেবে’। কেয়ারটেকার, ‘ওরে বাবা আসছি, তুমি তাড়াতাড়ি এসে নিয়ে যাও বলে চাবি নিয়ে নেমে এসে দরজা খুলে দিল’। পুপু ওকে বলল, ‘তুমি গেটের কাছে দাঁড়াও আমি এখুনি নিয়ে আসছি কুকুরটাকে’। কেয়ারটেকার বলল, ‘না না আমিও তোমার সঙ্গে যাব’, বলে গেটে তালা দিয়ে চলল পুপুর সঙ্গে। পুপু বাগানের দিকে এগিয়ে গেল, কেয়ারটেকারও পিছু নিল। পুপু দেখল বাগানের পাশের ঘরটা খোলা আছে, ও শ্যাডোকে খোঁজার নাম করে ঘরে ঢুকে দেখল সেখানে কোন বাক্স নেই। কাল রাতে যেগুলো ছিল সেগুলো কেউ সরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু কোথায় তাহলে বাক্সগুলো? কেয়ারটেকার কে জিজ্ঞেস করা যাবে না। অথচ পুপুকে খুঁজে বার করতেই হবে। পুপুর মনে হল ওই লোকটা আজ সকালে বাক্স গুলো নিয়ে মুম্বই চলে যায়নি তো? পুপুর নার্ভাস লাগছিল, কিন্তু মন শক্ত রাখতেই হবে। শ্যাডো টাই বা কোথায় গেল? পুপু বাগানের দিকে এগোচ্ছিল এমন সময় ঘরের মধ্যে থেকে শ্যাডোর চিৎকার শোনা গেল। লোকটা বলল, ‘ওই দেখ তোমার কুকুর ঘরে ঢুকেছে’। পুপু তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে ছুটে গেল। ডাইনিং রুমের পাশের একটা ঘর থেকে শ্যাডোর ডাক আসছে। পুপু গিয়ে দেখল সেই ঘরেই রাখা আছে ছটা বাক্স। কিন্তু কেয়ারটেকারের সামনে পুপু কাপড় সরিয়ে দেখবে কি করে বাক্সে কি আছে? পুপু শ্যাডোকে কোলে নিয়ে কেয়ারটেকারকে বলল, ‘কাকু একটু জল খাব’। লোকটা বলল, ‘চলো আমার সঙ্গে এই ঘর থেকে তারপর জল খাবে’। হঠাৎ শ্যাডো পুপুর কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পরে কেয়ারটেকারকে তেড়ে গেল। লোকটা বাবা গো বলে চোখের আড়াল হতেই পুপু কাপড় সরিয়ে দেখল বাক্সের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট একটা বাচ্চা। বেড়ালের নয় মানুষের। কেয়ারটেকার নিমেষে হাজির হল হাতে একটা মস্ত লাঠি নিয়ে। পুপু তাড়াতাড়ি শ্যাডোকে কোলে তুলে নিল, তারপর ছুটে চলল গেটের দিকে। কেয়ারটেকার তখন তার মাতৃভাষা বলতে শুরু করেছে, ‘অউর এর বার ঘুসা তো মার ডালেগা’। তালা খুলে পুপুদের বার করে দিতেই পুপু ছুটে গিয়ে আলোককাকু কে জানাল সব কিছু। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ফোর্স এসে বাড়ি ঘিরে ফেলল। গ্রেপ্তার হল কেয়ারটেকার ও তার বউ। উদ্ধার হল ছটি সদ্য জাত শিশু।
পরে জানা গেল পাশের বাড়ির ওই মালিক লোকটিই এই শিশু চুরি ও পাচারের পাণ্ডা। বিদেশ থেকে ব্যবসা চালান, মুম্বই থেকে ধরা হয়েছে তাকে। ভারতের অন্যান্য শহরেও এই ব্যবসা আছে তার। বছর চারেক আগে পুপুদের পাড়ার বাড়িটি কেনেন তিনি। পাড়ার লোকের চোখে ধুলো দিয়ে ব্যবসা চালাবেন বলে তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নেমতন্ন করে খাইয়েছিলেন।
সব ধরা পরবার পর দুষ্টু লোকটির কলকাতার বাড়িটি সিল করে দিয়েছে পুলিশ। পাড়ার লোকেদের অনুরোধে বাগানটা পাড়ার বাচ্চা দের খেলার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে পাড়ার লোকজনেরা। এই কাণ্ড ধরা পড়ল পুপুর কেরামতিতে। তাই পুপু আর শ্যাডো এখন এ পাড়ার হিরোইন। সাহসিকতার জন্য তাদের পুরস্কৃত করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তবে এসব কিছুর চেয়ে পুপুর আনন্দ হয়েছে ওই বাগানটাতে খেলতে পেরে। সে আর শ্যাডো এখন নিয়ম করে সেখানে গিয়ে খেলা করে। ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হয়না ওদের। খোলা আকাশ আর বাগানের গাছেরা এখন পুপু আর শ্যাডোর সঙ্গী।