মন-আয়না

চন্দনা খান

শেষ দেখা হয়ে ছিল বছর পাঁচেক আগে ।কলকাতার কলেজের এক কমন বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। কাজে বা অকাজে সমৃদ্ধা তখন কলকাতাতেই ছিল। সেটা ছিল নভেম্বরের হালকা শীতের সময়, সমৃদ্ধার কাছে যে সময়ের কোনও ঘড়ি নেই । সে সময় তর্ তর্ করে বয়ে চলুক বা এক বিন্দুতে স্থিরই থাকুক, সমৃদ্ধা কিছু আসে যায় না। এসব ক্ষেত্রে সমৃদ্ধা সত্যিই এক কবি মানুষ ।
তার ষষ্ঠ কবিতার বই বেরোবে পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক প্রেসে দিন দুয়েক পরে। পাঁচ বছর আগে শেষ দেখা রোশনীকে ফোন করেছিল সে। নেমন্তন্ন করার জন্য ।
রোশনী বলল: ” জানিস তো, তোর সঙ্গে এতদিন পরে ফোনে কথা হলেও আমি প্রায়ই মনে মনে তোর সঙ্গে কথা বলি। তুই আমার সঙ্গেই থাকিস।”
কৌতুহলে সমৃদ্ধা জিগ্গেস করেছিল – ” কি কথা?”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এসেছিল। রোশনির সেই বিখ্যাত হাসি। -” বললে নিতে পারবি তো?”
সমৃদ্ধার বুকের মধ্যে আশংকা আর বিস্ময়ের কাটাকাটি। কি এমন কথা বলে রোশনী তা সে নিতে পারবেনা? মুখে বললো “জীবনের এত বছর পেরিয়ে, এত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে না পারার কিছু নেই। দেখা হলে বলিস।” ওপাশে আবার হাসি ও সেই সাথে “বা-ই-ঈ” বলে ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ।

রোশনী, রোশনী। তোর বুকের কোনখানে কোন আঘাত বা আঘাতেরা স্তরে স্তরে জমে রইল? সেই কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে, তুই, আমি আর চন্দ্রিমা আমরা তিনজনই ছিলাম অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ইউনিভার্সিটি শেষ করে তোর সাথে প্রত্যক্ষ ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত। অফ ক্লাসে কলেজের পিছনে ঝিলের ধারে বসে আমরা ঝিলটাকে সমুদ্র ভেবেছি, যার এপারে আপেক্ষা করে আছে অনাবিষ্কৃত সব মহাদেশ। আছে আমাদেরই আবিষ্কারের প্রতীক্ষায়।
ওই সময়ই ওদের তিনজনের মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠেছিল ভ্রমণের লিপ্সা। নতুন নতুন জায়গা দেখা। কিন্তু সেই সময়ে সত্তরের প্রথম দিকে, ওদের সেই বয়সে, সীমিত রেস্ত নিয়ে কতদূরই বা যাওয়া যায়? সব সময় তিনজনের একসাথে যাওয়া হতো না।
রোশনী আর সমৃদ্ধার বাড়ির বন্ধন ছিল কম।
সমৃদ্ধা কি রোশনীকে যাকে বলে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করে নিয়েছিল? সে যেন রোশনীর গলা শুনতে পায়। সমৃদ্ধা সাথে ওর মনে মনে কথা বলা।

সমৃদ্ধা তুই বুঝি ভেবেছিলি আমি ঘুমিয়ে পড়েছি?
হঠাৎ আমরা ঠিক করলাম তিনদিনের ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে যাব। সেটা অক্টোবর মাস। পুজোর পর পর । তুই বললি ফাল্গুনীকে সঙ্গে নিয়ে যাই, একটা ছেলে থাকলে সুবিধা হয়।আমার আপত্তি ছিল না। তবে তোর কেমন বন্ধু সেটা পরে বুঝেছি। দার্জিলিং এ তখন তুলকালাম ভীড়, কোন হোটেলে জায়গা নেই, অবশেষে একটা হোটেলে একটাই ঘর পাওয়া গেল। উপায় নেই, ডবল বেডে তিনজন পাশাপাশি শুলাম। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি যে তুই ও ফাল্গুনী নিবিড় ভাবে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছিস। আমিও ঘুমের ভাণ করে পড়ে রইলাম। টয়লেটে যাওয়ার একটু দরকার ছিল, কিন্তু ওই পরিস্হিতিতে ওঠার সাহস দেখালাম না।

সমৃদ্ধা মনশ্চক্ষুতে দেখতে পায় সেই রাতটা। ফাল্গুনীর সাথে তখন তার সম্পর্ক দানা বাঁধছে।

আর?

বি.এ পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে আছি। কোথায় যাব, কোথায় থাকব ভাবছি! তুই-ই হুজুগ তুললি যে চল বাঁকুড়া জেলার টালডাংরায় যাই। আমাদের অবিচ্ছেদ্য তৃতীয় বন্ধু চন্দ্রিমাও রাজী।বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, তাই তার ক্ষেত্রে বাড়ির নিয়ম কানুন একটু কড়া।কিন্তু এবার মা আর মামার অনুমতি পত্র মিলেছে।

তুই বলেছিলি টালডাংরা একটা অদ্ভুত সুন্দর শালবন ঘেরা সাঁওতাল গ্রাম। সেই গ্রাম ঘেঁষেই বি.ডি.ও অফিস। বিরাট মাঠকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে আছে ব্লকের অফিস আর কোয়ার্টার । তোর পিসতুতো দাদা সুরঞ্জনদা সেই বি.ডি.ও অফিসে কাজ করেন। উনি নাকি তোকে বন্ধুদের নিয়ে আসতে বলেছেন। অতএব –
শীতের এক প্রায় সন্ধ্যায় আমরা বাঁকুড়া স্টেশনে নেমেছিলাম। সুরঞ্জনদা তোকে জানিয়েছিলেন যে বাঁকুড়া থেকে টালডাংরা বাসে আসতে লাগবে দুঘন্টা, কিন্তু দিনের শেষের বাস কিন্তু ছেড়ে যাবে বিকেল পাঁচটায়।স্টেশনের গায়েই বাস স্টেশন। আমরা বিকাল চারটেয় নামার বদলে ট্রেন লেট হওয়াতে নামলাম পাঁচটায় আর চোখের সামনে দিয়ে টালডাংড়া যাওয়ার ধ্যারধ্যারে বাসটা বেরিয়ে গেল। পরের বাস পরদিন সকাল ছটায়।রাতে থাকবো কোথায়? চন্দ্রিমা বললো, “হোটেলে রাতে থাকবো না।যত সব বাজে লোক থাকে। তার চেয়ে চল পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করি।” তুই বললি, “রিপোর্ট করে কি হবে? পুলিশ স্টেশনের সেলে আমাদের এক রাতের জন্য পুরে দিতে বলবো? পুলিশরাই কি হোটেলের খারাপ লোকেদের থেকে কম খারাপ?” আমি বললাম “তোদের এগুলো সব অবাস্তব কথা। আমরা রাতটা ওয়েটিং রুমেই থেকে যাব।দিব্যি দুখানা আরামকেদারা আছে ভিতরে। আমরা পালা করেই ঘুমোবো।” সেদিন আমাদের জীবনের প্রথম অ্যাডভ্যেঞ্চার।
– রোশনী আমি জানি এরপর তুই কি বলবি। আমি সেই গ্লানিতে এখনও ভুগছি। সুরঞ্জনদার বাড়ীতে তখন পিসিমা ছিলেন, আমাদের ভালই অভ্যর্থনা হল। সুরঞ্জনদা ভাল ছবি আঁকেন। বিশেষ করে পোট্রেট। তুই আবদার করলি তোর একটা পোট্রেট এঁকে দেবার জন্য। লাঞ্চের পর ঘন্টা দুয়েক পোট্রেট এঁকে সুরঞ্জনদা ক্লান্ত। আমরা দুপুরে একটু বিশ্রামের পর শালজঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগিয়েছি। আমি ও চন্দ্রিমা। তোকে বেড়োনোর মুহুর্তে সুরঞ্জনদা আটকেছেন। “রোশনী মাথাটা খুব ধরে গেছে এক নাগাড়ে মনোনিবেশের পরে। একটু টিপে দিবি?” তোর দ্বিধাগ্রস্ত মুখ, আমার তোকে ছাড়িয়ে আনা উচিত ছিল। পারিনি। বুঝতে পারছিলাম যে একজন অনাত্মীয় যুবতীকে দিয়ে এই কাজ করানো ওনার অন্যায়। বুঝলাম উনি সুযোগ নিচ্ছেন। আমি বলেছিলাম যে আমরা কাছাকাছিই হাঁটাচলা করছি। তোর জন্য অপেক্ষা করব।
আধঘন্টা পরে তুই আস্তে আস্তে আমাদের দিকে হেঁটে আসছিলি। চন্দ্রিমা বললো “রোশনীর কোথায় যেন একটা হীনমান্যতার ভাব।আমরা দুজনেই ওর চেয়ে পড়াশোনায় ভালো, সেটা আমি জানি। আমি তো কতদিন আমাদের পাঠ্য কোন নাটক বা কবিতা ওকে সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছি।” রোশনী, তুই নিশ্চই সেদিন আমার দাদার সাথে তোকে ওই ভাবে একা ফেলে আসার জন্য আমাকে মনে মনে দোষারোপ করছিলি।
পাঁচ বছর পরের এই দেখায় আমি যুগপৎ কৌতুহলী ও আশংকিত ছিলাম।একটু আড়াল পেলে জানতে চাইলাম – “তুই আমার সাথে মনে মনে কি কথা বলিস? আমি নিতে পারবো।”
– “সেকি!  তুই ওনলি তুই ই নিতে পারবি।” আবার সেই নদীর জল বয়ে যাওয়ার মতো হাসি।
– “আরে, আমি তো বলেছিলাম, লিখতে পারবি তো? তোর সাথে আমার কথা বলার মধ্যে আমার আনন্দিত যৌবন আছে, আমার রোজকার জীবনযাপন আছে, মনে মনে তোকে যে উঁচু আসনে বসিয়েছি তার প্রতি নিবেদন আছে। – বসে একদিন ডিটেলস্এ বললে লিখতে পারবি তো?”

একটি স্বপ্নের বীজ

 কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
 
 তিতলি স্কুল থেকে এসেই দৌড়ে গেল দাদুর ঘরে, দাদু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, দাদুর কপালে হাত রাখল, একবার তাকিয়েই দাদু আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল, মিনতি মাসি এসে তিতলিকে বলল,  “দাদুর শরীর এত খারাপ, তুমি দাদুকে কেন বিরক্ত করো?”
“আমি দাদুকে বিরক্ত করি নি, শুধু দেখতে এসেছি, তুমি আয়ামাসিকে জিজ্ঞেস করো।”
“ঠিক আছে, চলো, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নেবে, বিকেলে আবার গানের দিদিমণি আসবে, একটু না ঘুমালে রাতে পড়তে বসে ঢুলবে, আর তোমার মা আমায় বকবে। তিতলি আয়ামাসির হাত ধরে বলল, “দাদু কবে আমার সাথে আগের মত কথা বলবে?”
 “বলবে সোনা, বলবে,  দাদু আগের মতো হয়ে যাবে।”
  “আর কতদিন লাগবে?  দাদু আমার সাথে গল্প করে না, আমায় পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায় না, আমার খুব কষ্ট হয়।”
 ” চল,চল, এবার চল তো, আর বকবক করতে হবেনা, দাদুর যখন ভালো হওয়ার হবে,” হাত ধরে টান মেরে মিনতি মাসি বলেই চলে, “তিতলি,এক্ষুণি চল, আজ মা ফিরুক,আমি বলব, বৌদি, তিতলি এখন আমার কোন কথা শোনে না, আমি আর ওর দেখাশোনা করতে পারব না ।”
“ব্যাজার মুখে চলল তিতলি মিনতি মাসির সাথে,” মিনতি মাসি, আজ দুপুরে আমি দাদুর কাছে একটু শোব।” 
“একেবারে না,  তোমার মা বারবার বলে, তুমি যেন দাদুকে  বিরক্ত না করো ।” 
“কিচ্ছু করব না, চুপ করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব।” 
“না তিতলি, তুমি তোমাদের ঘরে শোবে, মা বলে গেছে।”
 তিতলি আর কিছু বলল না, বেচারি বুঝল, এ বড় শক্ত ঠাঁই, জোরাজুরি করে লাভ নেই ।  স্নান,খাওয়া সেরে সে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে  যেশাসের কাছে বলতে থাকল,  ” যেশাস দাদুকে তাড়াতাড়ি ভালো করে দাও, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।”  তিতলির মিশনারী স্কুলে সিস্টাররা বলেন, “যেশাসকে মন দিয়ে ডাকলে তিনি তোমার সব কথা শুনবেন, এই সাত বছর বয়স পর্যন্ত তিতলি এমন করে যেশাসকে কখনো ডাকে নি। তিতলির বাবা, মা দুজনেই ডাক্তার—- ডঃ শুভব্রত সেন, সার্জন, ডঃ মৈত্রৈয়ী ব্যানার্জী, গাইনোকলোজিষ্ট, দুজনেই  খুব ব্যস্ত।  ছোট থেকে মিনতি মাসি তিতলির দেখাশোনা করে, তবে দাদু, সোমশঙ্কর সেন তিতলির সবচেয়ে বড় বন্ধু । সোমশঙ্কর রিটায়ার্ড আই.পি.এস, সারা জীবন চুরি, ডাকাতি, খুন ধর্ষণের মত অপরাধ নিয়ে কাজ করলেও তাঁর একটা অন্য রকম মন ছিল, সেই মনটাই সোমশঙ্করকে তিতলির বন্ধু করে তুলেছিল।  তিতলিরও দাদু-অন্ত প্রাণ, অপরাধীদের মনে ভয় জাগানো সোমশঙ্কর যখন নাতনীর সঙ্গে খেলা করতেন, বোঝাই যেত না, তিনি ছিলেন দোর্দন্ডপ্রতাপ পুলিস অফিসার। খাস কলকাতার  থেকে একটু দূরে জমি কিনে সোমশঙ্কর বাড়ি করেন। কলকাতার হৈ, চৈ, দূষণ থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, বাড়িতে অনেক গাছ,  একদিকে ফলের গাছ, একদিকে কেয়ারি করা বাগানে  নানা রঙের ফুলের  বাহার, বারান্দায় পাতাবাহার, অর্কিড, এত রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে তিতলি সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে প্রিয় ফুল সোমশঙ্করের।  তিতলিকে নিয়ে দাদু বাগানে ঘুরে, ঘুরে গাছ চিনিয়েছেন, গাছের পরিচর্যা করতেন, জল দিতেন, শুকনো পাতা বেছে ফেলতেন। মালি-দাদু এলেও তিতলি তাঁর গায়ে গায়ে ঘুরে বেড়াতো, আর ছিল তার হরেক রকম প্রশ্ন । দাদু তিতলিকে শিখিয়েছেন, গাছপালা ছাড়া মানুষ  বাঁচতে পারে না, গাছকে ভালবাসলে সেও তোমায় ভালবাসবে। সেই ছোট্ট তিতলিকে দাদু বলেছিলেন, গাছের প্রাণ আছে, গাছের ব্যথা লাগে, কষ্ট হয়, আনন্দ হয়,  গাছের কাছাকাছি থাকলে তা  অনুভব করা যায় ।এই প্রকৃতি, মহাবিশ্বে মানুষের কি অবস্থান, প্রকৃতির বিরোধিতা করে মানুষ বাঁচতে পারবে না—- এই সবকথা গল্প করে দাদু তিতলিকে কত বার বলেছেন। গরমের রাতের বেলা ছাদে মাদুর পেতে দাদুর পাশে শুয়ে তিতলি চিনেছে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল, শুকতারা, কি সহজে দাদু বুঝিয়েছেন সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, জোয়ার
ভাটার রহস্য,  শুনতে শুনতে তিতলির কেমন ঘোর লেগে যেত। সময় পেলে বাবা, মাম্মামও ছাদের আসরে যোগ দিতেন,  একদম জমজমাট হয়ে উঠত আসর!!  তিতলির ঠাম্মাম চলে যাওয়ার পরে দাদু খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন, তিতলির যাদুকাঠিতে সোমশঙ্করের জীবন আবার ঝলমল করে উঠেছিল।
সোমশঙ্কর যখন বাড়ি তৈরি করেছিলেন, চারপাশে বেশ ফাঁকা ছিল, একটা পাড়া পাড়া  ভাব ছিল, বাড়ির
সামনে একটা খেলার মাঠ ছিল,  ছেলেদের ফুটবল খেলা হতো। ছুটির দিনে কতবার সোমশঙ্কর সেখানে বল পিটিয়েছেন, ওর ছেলে শুভ ডাক্তারি পড়ার ব্যস্ততার মাঝেও ঐ মাঠে গিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলত, শীতকালের সন্ধ্যায় ছেলে, মেয়েরা মিলে খেলা হতো ব্যাডমিন্টন।  সোমশঙ্কর তখন অবসর নিয়েছেন, হঠাৎ
শোনেন ঐ মাঠে ফ্ল্যাট হবে, শুনে তো তিনি অবাক, পাড়ার লোকদের সঙ্গে কথা বলে চেষ্টা করেন আটকাতে, নিজের চাকরির যোগাযোগকে কাজে লাগাতে চান,  অনেক দৌড়াদৌড়ি করেন, কিন্তু দেখেন সেই পুরোনো  খেলা, রাজনীতি আর প্রোমোটারের দুষ্টচক্র, পাড়ার লোকরাও স্থানীয় এম.এল.এর ভয়ে পিছিয়ে যায়, তবুও চেষ্টা করে সোমশঙ্কর মাঠের খানিকটা বাঁচান, প্রোমোটারকে বলে কয়ে সেখানে একটা বাচ্চাদের পার্ক করান, নিজেই খেলার সরঞ্জাম কেনেন, তিতলিকে নিয়ে ঐ পার্কে যাওয়া ছিল তার রোজের রুটিন।
 পার্কের এক কোণে ছিল জোড়া নিমগাছ, তার নীচে একটা বসার বেদি ছিল, সেখানে তিতলি আর দাদু বসে থাকত, দাদু বলতেন, “জানো দিদিভাই, আমার দাদু বলতেন, নিমের হাওয়া শরীরের পক্ষে বড় উপকারী, আমাদের দেশের বাড়িতে চারটে বড় বড় নিমগাছ ছিল, কচি নিমপাতা একটু বেগুন দিয়ে ভেজে খেতে যে কি ভালো, তাই তোমায় খেতে বলি।”
“দাদু, দেশের বাড়ি কি? তোমার তো এটাই বাড়ি।”
 “না সোনা, আমার জন্ম হয়েছিল পূর্ববঙ্গে, যাকে এখন বাংলাদেশ বলে, সেখানে ঢাকার একটা ছোট গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল।”
“তাহলে  এখন এখানে থাকো কেন?”
“থাকতে পারলাম না যে দিদিভাই, বলে দাদু নাতনীর মত করে দেশভাগের ইতিহাস বলেন, এইভাবে অসমবয়সী দুই বন্ধুর এক আশ্চর্য সুন্দর জগৎ গড়ে উঠল।”
 জোড়া নিমগাছের পাশে ছিল একটা বড় কদম ফুলের গাছ, দাদুর মুখে তিতলি শুনত,”বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।” উল্টোদিকে ছিল জাম গাছ, দাদু-নাতনীর চলত জাম খাওয়া, তারপরে জিভ বার করে দেখানো, কার জিভ কত রঙ পাল্টাল, এটা ছিল মজার খেলা।  আশেপাশে আরো কত গাছ ছিল ।
একদিন স্কুল  থেকে ফেরার সময়ে তিতলি দেখল, নিমগাছের কচি কচি পাতা,ডাল সব কেটে মাটিতে ফেলা, গাছের কাছে বেশ অনেক লোক, তাদের সঙ্গে দড়ি, কোদাল আর কত কিছু । সে গাড়ী থামাতে বলল মোহন কাকুকে, জানালা দিয়ে ছোট মুখটা বার করে বলল:”তোমরা কেন গাছ কাটছ গো? ওর ব্যথা লাগছে।”
“আরে খুকি, বাড়ি যাও, গাছের আবার ব্যথা।”
 “লাগে ব্যথা, তোমার চুল ছিঁড়লে তোমার যেমন লাগে, গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছেরও তেমন লাগে, তোমরা ওর ডাল কাটছ, ওর খুব লাগছে,” বলতে বলতে তিতলির চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল।
“যাও, যাও বাড়ি যাও, ডাল না কেটে গাছ কীভাবে কাটব?”
“তোমরা পুরো গাছটা কেটে ফেলবে? উচ্ছ্বসিত কান্না তিতলির ।  মোহন  তিতলিকে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে গেল । বাড়িতে ঢুকেই  তিতলি কাঁদত কাঁদতে দাদুর ঘরে, “দাদু, কটা দুষ্টু লোক নিমগাছ কেটে ফেলছে।
কে কাটছে দিদিভাই?  কি কাটছে?”
আমাদের নিমগাছ, ওর হাওয়া উপকারী, কি হবে দাদু?” 
“চলো, দেখি দিদিভাই” বলে নাতনীর হাত শক্ত করে ধরে সোমশঙ্কর চললেন। “একি,তোমরা এই বড় বড় গাছ কেন কেটে ফেলছ?”
“দাদু, এখান দিয়ে রাস্তা হবে, এই তিনটে গাছ কাটতে হবে।”
” কদম গাছটাও কেটে ফেলবে? তোমরা কি পাগল? এইসব গাছ বড় হতে কত সময় লাগে তোমাদের ধারণা আছে?”
“উফ্ দাদু,  এই দুই ধারে যত গাছ আছে সব কাটতে হবে নয়ত রাস্তা হবে না ।”
“ঐ শিরিষ গাছগুলো  তোমরা কাটার কথা ভাবতে পারলে কি করে?  গাছ মানুষের অতি বড় মিত্র।”
” হঠাৎ স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা  বলল,  আরে,এই বুড়ো এত বকবক করছে কেন? দাদু, উন্নয়ন বোঝেন, উন্নয়ন! উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু পাল্টাতে হবে।
“এ কেমন উন্নয়ন! যার জন্য সভ্যতার ক্ষতি হয়।”
” পুলিস ছিলি বলে রোয়াব দেখাচ্ছিস! যা, যা কটা গাছ বসিয়ে দেব।” বলে  সেই নেতা ধাক্কা মারল সোমশঙ্করকে, তিতলি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, “দাদুকে মারছ কেন?”
পেছন থেকে মোহন এসে সোমশঙ্কর ও তিতলিকে  বাড়ি নিয়ে গেল । বাড়ি গিয়ে সোমশঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়লেন,   বুকে ব্যথা, এত ঘাম হচ্ছিল যে জামা, গেঞ্জি ভিজে গেল । মোহন ফোন করাতে শুভব্রত বাড়ি এসে বাবাকে  দেখে নার্সিং হোমে ভর্তি করে দিলেন। তিতলির কান্না আর থামে না, অনেক কষ্টে মৈত্রৈয়ী তাকে থামিয়ে  খাইয়ে, ঘুম পাড়াল।
বেশ কিছু দিন সোমশঙ্করকে নিয়ে যমে- মানুষে টানাটানি গেল, সি.সি.ইউ থেকে কেবিনে, তারপরে বাড়িতে, বাড়ি এসে কেমন চুপচাপ হয়ে গেলেন সোমশঙ্কর, শুয়ে থাকেন সারাদিন, কথা বলেন না, হঠাৎ যেন বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়ে ফেলেছেন, খাওয়ায় রুচি নেই, শুভব্রত, মৈত্রেয়ী খুব চিন্তায় আছে, তিতলি চেষ্টা করে দাদুর সাথে কথা বলতে, তেমন সাড়া পায় না, তবুও কতবার যে ঘুরে ফিরে আসে দাদুর কাছে ।
একদিন বিকেলে তিতলি খুব উত্তেজিত হয়ে মোহন কাকুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলো, হাতে ছোট ব্যাগ, ফিরে এসে দাদুর কানে কানে কি যেন বলল, সেদিন রাতে সোমশঙ্কর স্যুপ পুরো শেষ করলেন। পরের দিন সকালে তিতলি দাদুর কাছে গেল, ফিরে বলল, “মাম্মাম আজ দাদুকে কচি নিমপাতা, বেগুন ভেজে দিতে বলো,”  মৈত্রেয়ী অবাক হয়ে বলল, “কেন রে?”
“দাদু বলল, খেতে ইচ্ছে করছে। 
“তোকে বললেন?  বাবা তো কথাই বলছেন না। শুভব্রত বলল, “দাও, তিতলি বাবার কথা বোঝে।”
 সেদিন মৈত্রেয়ী ফেরার পরে আয়া বলল, “জানেন বৌদি, আজ নিম-বেগুন ভাজা দিয়ে মেসোমশাই খুব তৃপ্তি করে ভাত খেয়েছেন। তিতলি সোনা সত্যি দাদুর সব কথা বোঝে।”
পরের দিন দাদুর হাত ধরে দুপুরে তিতলি খাওয়ার টেবিলে নিয়ে গেল, আস্তে আস্তে সোমশঙ্কর টেবিলে গিয়ে বসে তিতলির  সঙ্গে চিকেন স্টু দিয়ে ভাত খেলেন। কেউ বুঝতেই পারছে না, কি অলৌকিক শব্দ দাদুর কানে দিল তিতলি যে এরকম পরিবর্তন হল সোমশঙ্করের।   তিতলি বায়না করে কদিন ধরে দুপুরে খানিক ক্ষণ দাদুর কাছে শোয়,আর কত কথা যে কলকলিয়ে বলে যায়, দাদুর মুখে এক প্রশান্তি খেলা করে ।
স্কুল থেকে ফিরে চরম উত্তেজনায় তিতলি ছুটতে ছুটতে গেল দাদুর কাছে, তারপরে  দাদুর হাত শক্ত করে  যেতে যেতে বলল, “দাদু চলো, আমার হাত ধরে চলো, কোন ভয় নেই, আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি ।”আয়ামাসি  বলল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
“একটা জিনিষ দেখাব দাদুকে, ভয় পেও না, আমি ঠিক নিয়ে যাব।” মিনতি খুব রেগে গেল, বলল, “খবরদার, তিতলি
দাদুকে নিয়ে কোথাও যাবে না, পড়ে গেলে সব্বনাশ হবে, আজ বৌদি ফিরলে বলব এই ডাকাত মেয়েকে
নিয়ে আমরা আর পারছি না।”
সোমশঙ্কর হাত তুলে দৃঢ়ভাবে বললেন,”আমি পারব।” আমতা আমতা করে আয়া বলল, “আমি যাই সঙ্গে  মেসোমশাই।”
” না, আমি আর দিদিভাই যাব।” দুজনে হাত ধরে বেরিয়ে গেল। একটু হেঁটে গিয়ে তিতলি দাদুকে দেখাল দুটো চারাগাছ তিরতির করে দুলছে,  সোমশঙ্করের  দু চোখ ভরে জল এলো, তিতলি বলল, “দাদু দেখো, আমি আমের আঁটি, জামের বীজ পুঁতেছিলাম, জল দিয়েছি, কেমন গাছ হয়ে গেল। জানো,  মোহন কাকু  আমায় হেল্প করেছে। মোহনকাকু বলেছে, আমরা এমন অনেক গাছ পুঁতব। স্কুলে বন্ধুদেরও  বলেছি, বীজ পুঁততে, দাদু দুষ্টু লোকগুলো যত গাছ কাটবে, আমরা তত গাছ বাড়াব।” শুভব্রত, মৈত্রেয়ী ফিরে দেখল, বাড়িতে আলো ঝলমল করছে, দাদুর কাছে তিতলি গল্প শুনছে।

কিউই পাঞ্চ / কিউই মোহিতো

মৌমিতা মন্ডল

 

কি কি লাগবে :- 

কিউই ফল – ১টা

পুদিনা পাতা – দুটো ডাল

পাতিলেবু – ১টা

নুন – পরিমাণ মত

চিনি গুঁড়ো – ৪ চামচ

 কোল্ড ড্রিঙ্ক – (যেকোনো সাদা রঙের যেটা নিজের পছন্দ) বা সোডাজল, বরফের টুকরো। সবকিছু পরিমাণ মত নিতে হবে। 

কি ভাবে করবেন :- 

প্রথমে কিউই ফলটা কেটে নিতে হবে ছোটো ছোটো করে।এরপরে পুদিনা পাতা ডাল থেকে পাতা কেটে নিয়ে পরিষ্কার জলে ধুয়ে রাখতে হবে আর একটা ডাল আর পাতা শুদ্ধ রেখে দিতে হবে সাজানোর জন্য।  

এরপরে হামান-দিস্তে নিয়ে তাতে কিউই ফল কুচি ,পুদিনা পাতা  আর  পাতিলেবু  স্লাইস  নিয়ে  থেঁতো করে নিতে হবে। তারপরে ১টা কাঁচের গ্লাশে ওই থেঁতো করা মিশ্রণটা নিতে হবে।  

এরপরে ওই গ্লাশে একে একে একটু নুন ,চিনি গুঁড়ো  দিয়ে  চামচ  দিয়ে  মিশিয়ে  নিতে হবে ।এরপরে  বরফের  টুকরো দিয়ে  তাতে  কোল্ড ড্রিঙ্ক (যেকোনো সাদা রঙের যেটা নিজের পছন্দ) বা সোডাজল  দিতে হবে। তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে কিউই পাঞ্চ বা কিউই মোহিতো।  

এরপরে কিউই ফল রিং করে কেটে গ্লাশে একপাশে লাগিয়ে আর পুদিনা পাতার ডাল দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন কিউই পাঞ্চ বা কিউই মোহিতো। 

আফগানি গ্রেভী কাটলেট

কাকলি দত্ত 

 

উপকরণ – 

  • মাংসের কিমা (চিকেন অথবা মা্টন)—২০০ গ্রাম 
  • পেঁয়াজ কাটা — এক কাপ  
  • লঙ্কা কুঁচি — দুটো  
  • লঙ্কা-আদা-রসুন বাটা – দুই চামচ  
  • জিরেভাজা গুঁড়ো—হাফ চামচ  
  • শুকনো লঙ্কা – দুটো  
  • দুধ – হাফ কাপ  
  • পাউরুটি – দু স্লাইস  
  • টমেট পিউরি – এক কাপ  
  • লেবু – একটা  
  • ডিম – একটা  
  • বিস্কিটের গুঁড়ো – এক কাপ  
  • নুন – আন্দাজ মতো   
  • চিনি—আন্দাজ মতো (গ্রেভির জন্যে)   
  • তেল – এক কাপ (ডিপ ফ্রাইয়ের জন্যে) 

 প্রণালী – 

 প্রথমে দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে রাখতে হবে। মাংসের কিমা জল ঝড়িয়ে নিতে হবে। 

এবার তেলে পেঁয়াজ ভেজে, আদা-রসুন বাটা ও লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে কিমা কষিয়ে নিতে হবে। এতে পরিমান মত নুন দিতে হবে। 

তারপর থালায়ে ঢেলে আন্দাজ মত লঙ্কা কুঁচি, ভাজা জিরে গুঁড়ো ও দুধে ভেজানো পাউরুটি (দুটো) দিয়ে মেখে নিতে হবে। 

এবার কিছুটা পরিমান মত নিয়ে কাটলেটের আকারে গড়ে নিতে হবে। 

এরপর ডিমে (একটা) ডুবিয়ে  বিস্কিটের গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজতে হবে। 

 

অন্য একটা কড়াইতে গাওয়া ঘি (ঝর্ণা ঘি) গরম করে শুকনো লঙ্কা ফোড়ণ দিয়ে পেঁয়াজ (মিহি করে কাটা) ভাজতে হবে। তারপর তাতে আদা বাটা আর টমেটো পিউরি দিতে হবে। সামান্য চিনি, পরিমান মত নুন দিতে হবে। গ্রেভি একটু গাঢ় হলে নামিয়ে নিতে হবে।  

 

 পরিবেশন –  

প্লেটে ভাজা কাটলেট রেখে তার ওপরে এই গ্রেভি খানিকটা দিতে হবে। 

 

সাথে দুটো পাও (একটু তাওয়ায় গরম করে), কাঁচা পেঁয়াজ কুঁচি, শশা কুঁচি, কাসুন্দি দিয়ে পরিবেশন করা। 

 

তৈরি হয়ে গেলো – আফগানি গ্রেভী কাটলেট।