প্রথমা


IMG_20160503_112208সোমালী সরকার

 

সেইদিনটা ছিল আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ।

মেট্রোস্টেশন থেকে বেরিয়েছিলে ,

টুকটুকে লাল শাড়ি পরনে

বৃষ্টির প্রথম ছোঁয়াটা তোমার কপালে ।

এমনভাবে চমকে তাকালে-

আমি তখন রাস্তার এধারে

অনামিকা বলেই ডাকব ভেবেছিলাম ।

 

বহুদিন পর বইমেলায় হঠাৎ দেখা

চিনতে ভুল করিনি তোমায় ।

তোমার সেই গভীর কালো চোখ

আমার বুকে এঁকে দিয়েছিল তোমার নাম

সুনয়না বলেও ডাকব ভেবেছিলাম ।

 

অনেক সাহস করে সেদিন তোমার সামনে দাঁড়াই ।

পরিচয় হল- আরো কিছু সাক্ষাত-

আর পাঁচটা গল্পের মত সুস্মিতা বন্ধু হল ।

প্রেম হল , সংসার হল ।

 

 

একদিন যাকে অনন্যা বলে ভেবেছিলাম,

আজ তার সমস্তটাই জানা ।

তার রাগ-দু: খ-অভিমান সমস্তটা ।

জীবনের উত্থান-পতন

ঘাত প্রতিঘাতের সাক্ষী সে ।

আমার বিজয়িনী- আমার প্রথমা ।

 

অলংকরণ : সোমালী সরকার

ভাল থেকো বৃষ্টি

Debopam3দেবোপম চক্রবর্ত্তী

কত না আকুতি বৃষ্টি তুমি এসো “ আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেবো মেপে…”। কেউ বা আরও সাহসী, আগল খুলে আহ্বান জানায় বৃষ্টিকে,

ছুঁতে দেব/ কথা দিলাম/ সারা শরীর/ একবার নাম/

ঝরতে দেবো/ ক্লান্ত মুখে/ স্বপ্নে কাঁপা/ তপ্ত বুকে/

পৌঁছে দেবো/ গভীর সুখে/ একবার নাম/

প্লিজ বৃষ্টি/ একবার নাম/”

একদিন সে এলবিনা আয়োজনেই, নিরাভরণে, মুখর নুপুর ধ্বনি হয়তো বা শোনা গেল না তবু অবশেষে সে এল দিকে দিকে হোয়াটস্অ্যাপে বন্দীগাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, প্রথম বৃষ্টিস্নাত আনন্দের উল্লাস, মাটির সোঁদা গন্ধ, আরও কত কি । একরাশ হাসি নিয়ে, সবুজের সংকেত নিয়ে, মাঠের কোণে, ঘাটের কোণে ঝরে পড়ল সে আকুল হয়ে । পাগল বৃষ্টি ভাবতে থাকেএই তো, এই তো আমার ভালবাসার, ভাললাগার, ঝরে পড়বার সঙ্গীরা সব ।

তারপর, ভালবাসার গান তাকে উজ্জীবিত করে, ভাললাগার টান তাকে প্রগল্ভ করে । ভাবে ভালবাসায় আবার আপনপর কি? আয় ভাসিয়ে দিই, আয় ভিজিয়ে দিই, আয় একসাথে প্রাণের গানের ছন্দে জাগি । বেচারি বৃষ্টি, ভালবাসার আতিশয্যে বুঝতেই পারেনি এসবই অল্পদিনের বাঁধন, কয়েকমাসেই শুনতে পায়, “ এই হয়েছে এক বৃষ্টি । না হয় একটু ভালই বেসেছিতা বলে আমার বন্ধ নর্দমার নোংরা তুলে জলবন্দী দশা, তা বলে আমার হেঁশেলে এমন বিনা নোটিশে । এবার ক্ষান্ত দাও ভাই । রাস্তায় রাস্তায় খানাখন্দে কিছু মন্দ ছিলাম না । জলে জলাকার এখন পথ চলাই দায় । এবার আমার নতুন বন্ধু শরতের জন্য একটু জায়গা ছাড় তো । যাও অন্য কোথাও যাও”

বেচারি বুঝতেই পারেনি, ওর বুকে ঝরবার মত যত ভালবাসা ছিল, তাকে ধরে রাখবার মতো এমন জায়গা নেই আমাদের খালে বিলে । আমাদের ছাউনিতে তেমন খড় নেই, আমাদের ছেঁড়া ছাতায় তেমন জোর নেই, আমাদের বর্ষাতিতে তেমন আগল নেই, আমাদের জলাশয়ে তেমন গভীরতা নেই বৃষ্টি, তোমাকে অনেকদিন ধরে আপন করবার মত ।

পরের বছর অভিমানী বৃষ্টি হয়তো আরও সংযমী হবে, ভালবাসার আকুলতায় রাশ টানবে হিসেবি মনে, কিংবা মেঘের কোলে কোলে পাড়ি দেবে অন্য দেশে, অন্য কোনও ভালবাসার আবেগ ছুঁতে ।

তবে বৃষ্টি তোমাকে বলে রাখি, মাটির গভীরে তুমি যে জল ভরে দিয়েছতাই দিয়েই আমরা তৃষ্ণা নিবারণ করব আরও অনেকদিন, তোমাকে ভুলে গিয়েও। তোমার জলের স্পর্শে জেগে ওঠা কোনও ছোট্ট সবুজ তোমার কথা মনে করিয়ে দেবে হয়তো বা ।

তুমি তখন অন্য কোথাও, অন্য ফুল ফোটানর আয়োজনে ।

ভাল থেকো বৃষ্টি, থেকো না হয় তোমার মতই বেহিসাবি হয়ে ।

 

অলংকরণ :  অদিতি চক্রবর্ত্তী

ঝিলিক

সৌরাংশু সিংহ

আজকাল আমি বড়ই উদাসীন হয়ে যাচ্ছি । কোনো কিছুতেই উৎসাহ পাই না বিশেষ । আসলে আসে পাশে সব সময় ভাল কিছু হলে ভালোর জন্য আকাঙ্ক্ষাটা বোধহয় কমে যায় । সেই যেবার সুভাষ এসে আমায় প্রোপোজ করে, আমি তখন হেসে নির্লিপ্তের মতো বলেছিলাম, “তাহলে আমায় কি করতে হবে ? ভালো বাসতে হবে ? আচ্ছা, ঠিক আছে ! বাসলাম না হয় ”।

এভাবেই দেখতে দেখতে বছর চারেক কেটে গেছে । আমি বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে একটা ল ফার্মে ঢুকেছি । ভালই তো । সোনার টুকরো ছেলে সুভাষের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বাবা মা আপত্তি করেন নি, মন্দ কি ? কিন্তু তাও সব কিছুতে উৎসাহের কেন যে অভাব ? বাবা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে গেছেন, “মান্তু তুই খুশী তো ?” হেসে তাকিয়েছি, বাবা আমার মুখের দিকে খুব গভীর ভাবে দেখে, আলতো হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেছেন ।

বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি, অবশ্য ভালোবাসাটা রেসিপ্রোকাল বলেই বোধ হয় । মা আবার দাদা অন্ত প্রাণ, সব কিছুতেই ‘বাবি, বাবি আর বাবি ।’ ‘বাবি এই, বাবি সেই’, দাদাটাও এটা রেলিস করে, একের নম্বরের স্বার্থপর। কিন্তু কাকে বলছি ? আমিই বা কম কিসে ?

আসলে মানুষ হিসাবে সুভাষের জুড়ি নেই, সফল, অমায়িক, সুন্দর ভদ্র, কোনো নেশা নেই । কিন্তু কেন জানি না মনে হয় ম্যাদামারা… মানে আমি যা বলব তাই যদি শুনবে তাহলে আর পুরুষ হলো কোথা থেকে, কিন্তু সেফটি ফার্ষ্ট । অবশ্য সুভাষ দারুণ সিভালরাস । আমার খুব যত্ন টত্ন করে । বিয়ের পরে মনে হয় ভালই রাখবে । তবে সুভাষকে সবাই পছন্দ করে আমার বাড়িতে, দাদা ছাড়া । অবশ্য দাদার তো আমার কিছুই পছন্দ নয় ।

গত চার দিন ধরে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে আজ বেশ একটা থমথমে পরিবেশ হয়ে আছে । আজ ফার্মের থেকে ছুটি নিয়েছি, শরীরটা ভালো ছিল না, আগের দিন জ্বর হয়েছিল, এটাই কারণ । আসলে জাস্ট ভালো লাগে নি যেতে… এরকম আমার অনেক বার হয়ে থাক, মা বলে মুড সুইং, বাবা বলে এমনটা তো হতেই পারে, দাদাটা পাত্তা দেয় না বলে ঢং…

যাকগে বসে বসে একটা ফাইল দেখছি, নীচে হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে জানলা দিয়ে দেখলাম বাবাকে পাঁজাকোলা করে তুলে একটা লম্বা চওড়া ছেলে গেট ঠেলে ঢুকছে… ছুটে গেলাম নীচে ! কি হল বাবার ?

– কি হয়েছে বাবা ?

– কিছু না রে মান্তু একটু পড়ে গেছিলাম পা পিছলে… বাজারে অনেকটা কাদা হয়েছে…

মা হাঁউমাউ জুড়ে দিল, দাদাকে ডেকে পাঠালো, সে রাজপুত্তুর তখনো ঘুমচ্ছিল নাইট করে এসে । চোখ কচলাতে কচলাতে নীচে এসেই প্রথমে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “গায়ে একটা ঠিক ঠাক জামা দিয়ে আয় । কি হয়েছে?”

আমার তখন জ্ঞান শোনার অবস্থা নেই তাও স্লিভলেস নাইটিটা একটু উপরের দিকে তুলে নিয়ে বললাম, “দেখতে পাচ্ছিস না ? বাবা পড়ে গেছিল বাজারে !”

বাবাকে ততক্ষণে ছেলেটি সোফার উপর শুইয়ে দিয়েছে। আরো জনা ছয়েক লোক ড্রয়িং রুমে ভিড় করে আছে। বাবা হাত তুলে কিছু বলতে গেছিল, মা দাবড়ে উঠলো, “তুমি চুপ করে থাক তো! বুড়ো বয়সে আমার যত ঝামেলা । বাবি এখনি ডাক্তার কাকুকে খবর দে” ।

ছেলেটি বলে উঠল, “ডাক্তার দেখে তো বিশেষ লাভ হবে না, গোড়ালির হাড়টায় মনে হয় হাল্কা চিড় ধরেছে, আমি অলরেডি এম্বুলেন্সে খবর দিয়েছি, এসেই পড়বে । একটা হাফ প্লাসটার করাতে হবে, আর দিন দশেকের রেস্ট”। বাবা বলতে যাচ্ছিল কিছু, কিন্তু ছেলেটি বাবার দিকে কপট রাগ করে বলল, “ মেসোমশাই, আপনি শুয়ে থাকুন । যেমনটা বলেছি তেমনটা না করলে এই বয়সে আর সামলাতে পারবেন না কিন্তু…”

বাবা চুপ করে গেল, কিন্তু দাদা তেরিয়া হয়ে বলতে গেল, “তুমি কে হে ? ডাক্তার নাকি ?”

ছেলেটি মিষ্টি করে হেসে বলল, “হাতুড়ে বলতে পারেন। আমি স্পোর্টস মেডিসিন নিয়ে কাজ করি, গোদা বাংলায় ফিজিওথেরাপিস্ট। আপনারা আপনাদের ডাক্তার দেখাতে পারেন, তবে সিওর যে অন্য কিছু বলবে না” ছেলেটার একটা মিষ্টি অথচ ওভারওয়েল্মিং পার্সোনালিটি রয়েছে । নাহলে দাদাকে চুপ করিয়ে দিতে পারে ? তাও আমি চেষ্টা করলাম, দাদা থমকে গেল, আর আমি এই ফাঁকে নজর করলাম ছেলেটি বেশ সুপুরুষ, লম্বা, চওড়া কাঁধ, ঝাঁকড়া অবাধ্য চুল, । “কিন্তু স্পেশালিষ্ট দেখানোর দরকার তো আছে? নাকি? আপনি বললেন আর আমরা মেনে নেব?”

ছেলেটি চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো, কি গভীর চোখ! ধক করে যেন কি একটা গলার কাছে আটকে গেল । মিষ্টি করে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি খবর দিয়ে দিয়েছি তো ! ফর্টিসের এম্বুলেন্স এসেই যাবে । ডক্টর তুষার রায়কে ফোন করে দিয়েছি, নাম করা অর্থোপেডিক । উনি আছেন এখন এমার্জেন্সিতে । আপনারা চিন্তা করবেন না ।” আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম ।

এম্বুলেন্সটা এল তক্ষনি, বাবাকে নিয়ে যেতে । ছেলেটি দাদাকে নিয়ে গেল সঙ্গে । যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের আর আসতে হবে না, দাদা তো আসছেনই, আমি আছি, ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসবেন । বাই দ্য ওয়ে, আমি আকাশ, গলির মোড়ের মেসটায় থাকি, আপনি বোধ হয় ঝিলিক ? নাম শুনেছি আপনার… চিন্তা করবেন না ।” বলে একটু হেসে চলে গেল । দাদা ততক্ষণে টি শার্ট গলিয়ে নিয়েছে, আমাকে বলল, “মাকে দেখিস, আমি চলে আসছি এখনি বাবাকে নিয়ে, দাঁড়াও আকাশ ।” আমি বোধহয় কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। কে আকাশ ? কেন সে আমার নাম শুনেছে? তার পর মনেও রেখেছে ? দেখে নাকি আমাকে ? আমি কেন আকাশকে দেখি নি ? এতটাই কি উদাসীন হয়ে পরেছি আমি ?

দু হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে ক্রস করে ঢাকলাম যতটা সম্ভব । ওরা চলে গেল, আমি গেটের দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ…হঠাৎ আমার খুব লজ্জা পেল, নাইটিটা কি খুব রিভিলিং ?

ঘন্টা খানেক পরে ফিরে এল বাবাকে নিয়ে দাদা একা । ইতিমধ্যে সুভাষ এসে গেছে অফিস থেকে, খবর শুনে । এসেই শুরু করে দিয়েছে শ্বাশুড়ীকে পটানো, “আমাকে খবর দিলে এই সেই ওই তাই…”বাবা দাদার কাঁধে ভর দিয়ে ঢুকল । পায়ে প্লাস্টার । কানে যাচ্ছিল না কিছুই। “ভাগ্যে আকাশটা ছিল…” দাদাও দেখি খুব গদ গদ। সুভাষ এগিয়ে গেল বাবার দিকে, “কি যে করেন না বাবা, এই বুড়ো বয়সে এসব করতে যান! বাজার করার কি লোকের অভাব হয়েছে ? আমি আছি কি করতে ?” মা অমনি হবু জামাইকে আগলাতে শুরু করে দিলেন ।

দাদা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে খুব প্রশ্রয় মাখানো দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠল, “আকাশ এল না । বলেছে বিকেলে আসবে দেখতে বাবাকে!” আমার গালটা অজান্তেই লাল হয়ে উঠলো । বুকটা ধুকধুক করে উঠলো । আকাশ আসবে ? আকাশ আসবে আবার ? সামলে নিয়ে সুভাষকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি সন্ধ্যায় একবার ঘুরে যাবে ? আমি আজ অনেক দিন পরে মাছের কচুরী বানাবো…” তারপর হতভম্ব মুখগুলোর সামনে দিয়েই আমি উঠে চলে গেলাম উপরে, লজ্জা লাগছিল খুব…

জানালা

শমিতা চক্রবর্তী

সকালের আলোটা মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই মৌ এর হাল্‌কা ঘুমটা ভেঙে গেল ।  ঘুমের সাথে সম্পর্কটা ওর আজকাল একদম ভালো না, মাঝে মাঝে পথ ভোলা পথিকের মত আসে ঠিকই, তবে অধিকাংশ দিনই জোর করে ধরে আনতে হয় ।  আজকাল সবসময় ওষুধেও ভালো কাজ হয় না।  অথচ কিছুদিন আগেও ঘুম ছিল ওর আলাদিনের জিনি ।  সারাদিনের  অক্লান্ত পরিশ্রমের পর চোখের পাতা এক করলেই আবির্ভাব হত সে । আজ্ঞার অপেক্ষা করত না, নিজেই নিয়ে যেত এক এক সম্পূর্ণ অজানা জগতে ।  কিন্তু আস্তে আস্তে অন্য অনেক কিছুর মত সেই চরম বিশ্বস্ত জিনিও আর ওর বশে নেই।  শুধু ঘরের পূবের জানালাটার সাথে ওর সম্পর্কটা এখনও অত্যন্ত মধুর ।

ঢাকুরিয়া ষ্টেশন লেনের ছোট্ট একটি বাড়ির দোতলার কোনে মৌ এর ঘর । বাড়িটা দাদুর আমলে তৈরী ।  তখন এই ঘরটায় ঠাকুমা দাদু থাকতেন, তারপর মৌ এর দখলে ।  ঘরের তিনটে জানালার দুটো উত্তর দিকে, একটা পূবে ।  পূবদিকটা বেশ খোলামেলা ।  বাড়ির পাশেই রাস্তা আর তারপরই বড় একটা খেলার মাঠ – প্রোমোটারের আশীর্বাদের অপেক্ষায় দিন গুণছে । উত্তর দিকে একটা বহুতল তৈরী হবার পর থেকে পূবের জানালাটাই এখন ঘরের প্রাণ, মৌ এর নিঃসঙ্গ জীবনের নির্বাক সঙ্গী । ছোটবেলা থেকে  এই জানালাটার পাশে বসে পড়াশুনো করা ওর অভ্যেস ।  বাবা-মার সাথে কত গল্প, গান, আলোচনা, বিতর্কের নীরব শ্রোতা ছিল এই জানালাটা ।  আজ সেই মা-বাবা, এমনকি অনেক সাধনায় তৈরী ওর গানের গলাও ওর সাথে নেই । কিন্তু থেকে গেছে এই অবলা জানালাটা।  বিনা বাক্যব্যয়ে বয়ে চলেছে সুখ-দুঃখের বোঝা ।

কয়েক মাস আগে হাসপাতালে রুগী দেখা শেষ করে গাড়ীর দিকে যেতে যেতে হঠাৎ হাতের ফোনটা কেঁপে উঠল মৌ এর । মধুমিতা – অনেকদিন কথা হয় নি মধুমিতার সাথে ।  অথচ স্কুলে পড়তে অসম্ভব বন্ধুত্ব ছিল  দুজনের। কর্মজীবনের ব্যস্ততা অনেকটা  আগাছার মত, অদ্ভুত ক্ষমতায় নিঃশব্দে সময়ের বেড়াজালের ভেতর ঢুকে কি ভাবে নিজের আধিপত্য ছড়িয়ে ফেলে ।  ফোন তুলতেই মধুমিতার আদেশ সোজা ওর বাড়ি যেতে হবে । স্কুলের কয়েকজন বন্ধু একসাথে হয়েছে, মৌকে ছাড়া আসর জমছে না ।  আড্ডার আকর্ষণে  ক্লান্ত শরীরটাকে জোর করে টেনে নিয়ে নিউ আলিপুরে গেল মৌ ।  ও ছাড়া সবাই এখন সংসারী । একটু অস্বস্তি হয় আজকাল এইসব আড্ডায় আসতে, কিন্তু আবার ভীষণ ভালোও লাগে।  নানা গল্পের মাঝে হঠাৎ ইন্দ্রাণী বলে ওঠে সোমার দাদার কথা ।  কেন, কি প্রসঙ্গ – তা আর শোনে নি মৌ,  ‘সোমার দাদা’ কথাটাই যথেষ্ট ছিল ওর সংযত, তরুণী মনটাকে তোলপাড় করে দিতে ।  ১৬ বছর বয়সের এক নির্বাক প্রেমের স্মৃতির তরঙ্গ আছড়ে পরতে থাকে ওর মনে – আলোড়িত হয়ে ওঠে ওর সারা শরীর।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে সেই পূবের জানালাটার পাশে বসে পড়ত মৌ । ঠিক ভোড় ছ’টার সময় সোমার দাদা শুভ্র যেত কলেজে , ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে । শুভ্র মৌ-এর থেকে এক বছরের বড়, তখন  11 এ পড়ত ।  নিজের অজান্তেই চোখ দুটো  জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে চলে যেত রাস্তায় আর মিলিত হত অন্য দুটি আকাঙ্খিত চোখের সাথে ।  নিষ্পলক সেই দৃষ্টি বয়ে নিয়ে যেত দুজনের অন্তরের আবেগ ও অনুভূতি, পৌছে দিত হৃদয়ের না বলা বাণী।  কিন্তু ওইটুকুই – তবে ঐ নির্বাক কয়েকটি মুহূর্তের জন্য রোজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো মৌ – শুভ্রকে দেখতে না পেলে সারাদিন উদাস হয়ে থাকত ও – পিপাসিত আঁখি খুঁজে বেড়াত তৃষ্ণার জল ।  খুব জানতে ইচ্ছে হত শুভ্ররও একই অনুভূতি হয় কিনা ।  এইভাবে কেটে যায় প্রায় দুবছর ।  তারপর শুভ্র চলে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে খড়গপুরে ।  খবরটা  মৌ পেয়েছিল সোমার কাছে । খুব আশা করেছিল শুভ্র যাবার আগে ওকে কিছু বলে যাবে ।  কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয় নি মৌ এর ।

এরপর মৌ যায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়তে, নিজেদের জীবন প্রতিষ্ঠার সাধনায় হারিয়ে যায় কৈশোরের সেই নির্বাক প্রেম ।  প্রায় সাত-আট বছর পর MD শেষ করে কলকাতায় ফিরে এসে যোগ দেয় এক নামী বেসরকারী হাসপাতালে ।  ওর বাবা ততদিনে অসময়ে চলে গিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে, সেই শোকে মা নিয়েছেন বিছানা ।  পেশার চাহিদা আর মায়ের অসুস্থতার বন্ধনে আবদ্ধ মৌ জীবনযুদ্ধে হারিয়ে ফেলে নিজেকে । অন্য অনেক কিছুর মতই ভুলে যায় সেই ছেলেমানুষিও । একদিন হাসপাতালের কাজের ফাঁকে এক সহকর্মীর সাথে ব্যাঙ্কে গিয়েছিল ও । লাইনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে ভীষণ পরিচিত এক মুখ, আরও পরিচিত তার দৃষ্টি । সম্মোহনী সেই দৃষ্টির আকর্ষণ থেকে দুজনের কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি নিজেদের, বহুদিন পর আবার নিষ্পলকে নীরব কথোপকতনে হারিয়ে যায় দুটি বিস্মিত প্রাণ ।  ডঃ ব্যানার্জীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ নামিয়ে counter র দিকে এগিয়ে যায় মৌ ।  সেই ওর শুভ্রর সাথে শেষ দেখা।

আজ এতদিন পর দুষ্টু রোদটা শুধু ঘুমই ভাঙ্গায় নি, আবার সাথে করে নিয়ে এসেছে সেইসব মিষ্টি স্মৃতিগুলো ।  মধুমিতার বাড়িতে ইন্দ্রাণীর মুখে শুভ্রর কথা শুনে কিছুদিন নিজেকে অনেক কষ্ট করে সংযত করেছিল  মৌ।  কিন্তু এক সপ্তাহ আগে ওর দুরন্ত জীবনটা হঠাৎ থম্‌কে দাঁড়িয়ে পরায় আজকাল আর কোন কিছুতেই প্রভাবিত হয় না ও।  তবু আজ ওর কি হল ! শুয়ে শুয়ে সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আচম্‌কা শুভ্রকে দেখার প্রবল উন্মাদনা অনুভব করল মৌ ।  চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃষ্টি – ওর নীরব প্রেমের একমাত্র অবলম্বন।  কি অদ্ভুত এক অনুভূতি ! সেই উন্মাদনার তাণ্ডব আর অনুভূতির আবেশের কাছে হেরে গেল ওর সংযত অপ্রমত্ত মন – কি মূল্য আছে এই সংযমের ? না হলে ও নিজেও তো সেদিন ব্যাঙ্কে কথা বলতে পারত শুভ্রর সাথে বা মধুমিতার বাড়িতে ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞেস করতে পারত ওর কথা ! উত্তেজনায় চঞ্চল মৌ হাত বাড়িয়ে ফোনটা টেনে নিল – মধুমিতা নিশ্চয়ই জানে শুভ্র এখন কোথায় থাকে ! জীবনের এই শেষ বেলায় মৌ শুধু একবার ওকে দেখতে চায়, ওর চোখে চোখ রাখতে চায় ।  শরীর আচ্ছন্ন হয়ে এল মৌ এর, কোনরকমে পূবের জানালাটার পাশে আস্তে আস্তে বসল ও। অস্পষ্ট দৃষ্টি জানালা দিয়ে গেল রাস্তায় – আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা ! গত সপ্তাহেই মৌ জানতে পেরেছে যে ওর Laryngeal Cancer এখন একদম শেষ পর্যায়ে ।

আজও ওদের সেই নির্বাক প্রেমের একজনই সাক্ষী – পূবের জানালাটা।

হৃদমাঝারে

পিয়ালী চক্রবর্ত্তী

 

অনেকদিন বাদে খুললাম ফেসবুক । এদিক সেদিক দেখতে দেখতে কি মনে হল, ক্লিক করলাম মেমরিতে । আজ  থেকে ঠিক একবছর আগে, আমার আগের অফিসের এক কলিগ আমার টাইমলাইনে লিখেছে ‘কিরে তোর কি খবর ? ফোনে পাচ্ছিনা, অফিসে আসছিস না, কি ব্যাপার ?’ গত দুদিন ধরে ভুলে থাকতে চাইছিলাম, আজ একেবারে হুড়মুড়িয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল ঠিক একবছর আগের দিনটা ।

নভেম্বর মাস, হালকা একটা ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে । দুপুরের রোদে একটা আমেজ, খেয়ে দেয়ে চিলেকোঠার ঘরে শুয়ে রোদ পোহাতে বেশ লাগে । আমি শুয়ে আছি চিলেকোঠার ঘরে, কোনক্রমে দু-চার গাল ভাত খেয়ে উঠে এসেছি । দুপুরের রোদে আমার একটুও আরাম লাগছে না । আমার বুকের মধ্যে,গলার কাছে চাপ চাপ কষ্ট।আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা,কিছুতেই না। মা,বাবা বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে আমার ? আমি উত্তর দিইনি । কাল থেকে আমি কোন ফোন ধরিনি, মেসেজ, হোয়াটসআপ, ফেসবুক কিচ্ছু চেক করিনি । আজ দুদিন অফিস যাইনি, সারাদিন শুয়ে আছি চিলেকোঠার ঘরে । রাত করে নেমে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ছি । আজও সন্ধ্যে অব্দি শুয়ে ছিলাম, দেখি অফিস থেকে ফিরে দাদা উঠে এল আমার কাছে।

–           কি হয়েছে রে তোর ? এভাবে শুয়ে আছিস কেন ? কারুর সাথে কথা বলছিস না, মা, বাবা প্রচন্ড দুশ্চিন্তা করছে ।

আমি উঠে বসলাম, নাঃ আর একা একা যন্ত্রণা নেওয়া যাচ্ছে না । দাদাকে সব খুলে বলতেই হবে ।

–           আমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদা

–           কেন রে ? আমাকে তো বল

পরিস্কার দেখতে পেলাম সেই দিনটা, মাস তিনেক আগের কথা,আমার বন্ধু স্বাগতা একটা রাজনৈতিক পোস্ট দিয়েছিল ফেসবুকে, আমি আমার মতামত জানিয়েছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পোস্টকে চ্যালেঞ্জ করে লিখল একটি ছেলে, তার নাম,  ছবি প্রথম দেখলাম, রূপম সরকার । ব্যাস সারাদিন ঝগড়া । সে যা বলে আমি তার উল্টোটা,  প্রায় ফেসবুকীয় হাতাহাতির যোগাড় । কাজকর্ম মাথায় উঠল, শেষে একটা টিম মিটিং বাঁচাল আমায় । মাথা ঠান্ডা হল একটু । পরেরদিন সকালে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, সেই রূপম সকারের, ইনবক্সে একটা ছোট্ট মেসেজও দিয়েছে ‘কাল সারাদিন ঝগড়া করেছি, তাই আজ বন্ধুত্ব করতে চাই’। কি মনে হল হ্যাঁ করে দিলাম। তবে স্বাগতার কাছে একটু জেনেও নিলাম, ‘এই রূপমকে তুই চিনিস’? স্বাগতা তখুনি মেসেজ করল, ‘হ্যাঁ,হ্যাঁ ওই পাগলটাতো আমার কোম্পানীতেই চাকরি করে, পুনেতেই থাকে, ভাল ছেলে’। তারপর কোন না কোনভাবে ফেসবুকে কথা হতেই থাকত, আস্তে আস্তে ইনবক্সে গল্প, একদিন ফোন নম্বর আদান প্রদান, তারপর সারাদিন হোয়াটসআপ । খুব তাড়াতাড়ি পট পরিবর্তন, মনের মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করে গেল রূপমের জন্য । একটু অবাক হই, আমি আবার এসব করতে পারি নাকি ? মানে কাউকে কোনদিন না দেখেই তার প্রেমে পড়ছি ? এর মধ্যে একদিন ফোনে কথাও বলে ফেললাম,কোন বিশেষ কথা না, নেহাতই আড্ডা । ভাবছি আর অবাক হচ্ছি, আমি একটি নেহাতই সাদামাটা মানুষ, ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ার মত কিছুই নই । আমার উনত্রিশ বছর বয়েস, এখনও বিয়ে হয়নি, মনে যদিও যথেষ্ট ইচ্ছে আছে । আমার বাড়ির লোকের এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা, আমরা যৌথ পরিবারে থাকি, জেঠু আর জেঠিমার সঙ্গে । জেঠু রক্ষণশীল ব্রাম্হন, নিজের দুই মেয়েকে ২৪ বছরের মধ্যে ভাল ঘর, একই জাতের মধ্যে ঠিকুজি কুষ্ঠি মিলিয়ে বিয়ে দিয়েছে । কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমাকে পাত্রস্থ করে উঠতে পারলনা এখনও । আমি পড়াশুনায় খারাপ ছিলাম না, সায়েন্স নিয়ে পড়ে, জয়েন্টে একটু পিছনের দিকে র‍্যাঙ্ক করে, প্রাইভেট কলেজ থেকে বি.টেক করে এঞ্জিনিয়র হলাম, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি পেলাম । এই পুরো সফরে উল্লেখ করার মত কিছু নেই, আমিও আর পাঁচজনের মত কলেজ কেটে সিনেমা দেখেছি, ক্যান্টিনে আড্ডা মেরেছি, একটা দুটো ছেলেকে ভাল লেগেছে, বলতে পারিনি, চেয়েছি তাদেরও আমাকে ভালো লাগুক, সেটা হয়নি যথারীতি। চাকরি পাবার পর থেকেই বাড়িতে পাত্র খোঁজার হিড়িক, আমি অবশ্য তাতে খুব একটা বাধা দিইনি । জেঠুতো উঠেপড়ে লেগেছে সেই থেকে । এখনও পাত্রপক্ষ চাইলে আমার কুষ্ঠি পাঠান হয় তাদের বাড়িতে । তাতেও আমি কোনদিন আপত্তি করিনি । কারুর আমার কুষ্ঠি পছন্দ হয়নি, কারুর আমাকে, আবার আমাদেরও কাউকে পছন্দ হয়নি এমনও হয়েছে । মোদ্দা কথা, বিয়ে আমার কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না । তাই নিয়ে যে আমি বিশেষ উতলা ছিলাম তাও নয়, বন্ধুদের বিয়ের ছবি দেখে, নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ইচ্ছেটা চাড়া দিত । আর ওই হ্যাঁ বিয়ে যদি করতেই হয়, তাহলে সময়টা এসে গেছে, এটাই যা । এইরকম সময়ে হুট করে রূপমের সাথে অনলাইন আলাপ । আস্তে আস্তে বুঝলাম ছেলেটাকে আমার ভাল লাগছে । একটু বেশি ভাল লাগছে। অন্যপক্ষের অবস্থাও অনেকটা একই । এখন আমরা একটু মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা করছি। একদিন সাধ হল স্কাইপে দেখব, রাতের বেলা দরজা বন্ধ হবার পর স্কাইপ চালু হল, প্রথম তো দুজন দুজনকে দেখে হেসেই গেলাম । তারপর গল্প আর ফুরোয় না । রূপম বলল ও ক্রিস্টমাসে আসবে কলকাতা, দেখা হবে তখন । চলছিল বেশ, আগের সপ্তাহে রূপমের ফেসবুক, হোয়াটসআপে একটু কম আনাগোনা,বলল শরীরটা ভাল নেই । ফোন করলাম, গলা ভারি, বেশ জ্বর, অফিসে যায়নি, ডাক্তার দেখাতে যাবে । তারপর দিন দুয়েক জ্বর কিছুতেই কমছে না, ব্লাড টেস্টেও কিছু ধরা পড়ছে না, বুধবার আবার ফোন করলাম, ওর এক বন্ধু ফোন ধরে বলল ওকে হস্পিটালে নিয়ে যাচ্ছে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা । ভীষণ টেনশন হচ্ছে, বুধবার রাত অব্দিও অবস্থা একই, বৃহস্পতিবার সকালে অভ্যাসবশত ফেসবুকটা খুললাম, রূপমের টাইমলাইনে কে একটা লিখেছে ‘কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না তুই আর নেই, যেখানেই থাকিস ভাল থাকিস’, মানে ? বলতে না বলতেই আর একটা পোস্ট ‘আর আই পি’। কি লিখছে এরা ? এরা কি পাগল হয়ে গেছে ? উদ্ভ্রান্তের মত স্বাগতাকে ফোন করলাম, ‘স্বাগতা কি হয়েছে রূপমের ?’ স্বাগতা কান্নাটাকে গিলতে গিলতে বলল ‘রূপমকে বাঁচান গেলনা রে, কিচ্ছু ধরা গেল না, কাল মাঝরাতেই…’

কোনমতে বললাম দাদাকে, দেখি দাদাও কেমন থম মেরে গেল । আমার মাথায় একটা হাত রাখতেই,আমি দাদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম, পাগলের মত ।

দাদা বাড়িতে বলেছে সকলকে, কিন্তু বাড়িতে একটা অশান্তি শুরু হয়েছে, জেঠু নাকি তার এক অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কথা দিয়ে ফেলেছে যে তিনি তার ভাইপোর জন্য মেয়ে দেখতে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন । আসলে আমি যে এমন কিছু করে ফেলতে পারি, এতো কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি, জেঠু বলেছে এটা ক্যান্সেল করা সম্ভবই নয়, যদিও জেঠুর নাকি আমার প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি আছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে বললাম, ‘মা প্লিজ আমি এক্ষুণি পারবনা, আমায় একটু সময় দাও’। মা বলল ‘আমি, বাবা দুজনেই জেঠুকে বলেছি, এখন সম্ভব নয় । পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেছি, জেঠু পাশে এসে বসল, গম্ভীর গলায় শুরু করল ‘আমি জানি তোমার মন ভাল নেই, কিন্তু কি করবে বল, জীবন তো থেমে থাকবে না, একটু মন শক্ত কর’, করুণ গলায় বললাম ‘আমি এক্ষুণি পাত্রপক্ষের সামনে বসতে পারব না জেঠু, আমায় একটু সময় দাও’। জেঠু মুখটাকে শক্ত করে বলল ‘কি নাম ছিল ছেলেটার?’ বললাম ‘ রূপম সরকার’, জেঠুর গলা থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল ‘সরকার’। এই প্রথম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম জেঠুর দিকে, দাদা তাড়াতাড়ি সামলে নিল, ‘যে মানুষটা নেই, তার সম্পর্কে আর জেনে কি হবে জেঠু’। মনটা তেতো হয়ে গেল ।  কিন্তু এখানেই শেষ নয় সবটা, দাদা বলল যে জেঠু নাকি নিজে থেকে ছেলের বাড়িকে বারণ করতে পারবে না, বাবা দায়িত্বটা নিতে চেয়েছিল, জেঠু সেটাও হতে দেবে না, কি নাকি প্রেস্টিজের ব্যাপার আছে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে যে ছেলের সাথে দেখা করে আমাকে সব বিস্তারিত বলতে হবে । কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে, তারপর বললাম ‘আচ্ছা বলে দেব’। আমার আর জেঠুর সাথে লড়ার শক্তি নেই । ঠিক কবে ছিল ?

অফিসে প্রাণপণ কাজের চেষ্টা করছি, কি একটা ঘোরের মধ্যে বারবার রূপমের ফেসবুক প্রোফাইল খুলে ফেলছি, দেখে যাচ্ছি ওর ছবিগুলো, মোবাইল খুলে পড়ছি আমাদের চ্যাট । বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে সব । কোনমতে কাজ শেষ করে উঠলাম, কাছাকাছি সিসিডিতে আসবে ছেলেটা, ফোনে কথা বলে নিয়েছি, নীলাদ্রি, তাকে এখন বলতে হবে আমার গল্প । বলতে হবে আমি এখন বিয়ে করতে পারবনা । ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থাকে, ভাল চাকরি করে, জেঠু আস্ফালন করে মরবে, ‘ভাল ছেলেটা হাতছাড়া হয়ে গেল’, হয়ত বলে দেবে বাবাকে, ‘তোমার মেয়ের পাত্র খোঁজার দায়িত্ব আমি আর নেব না’। বেঁচে যাব আমি তাহলে, ভগবান এই সুযোগ । সিসিডিতে পৌঁছে আবার ফোন লাগালাম,ভিতরে বসা নীল টি-শার্টের ছেলেটা ফোনটা নিয়ে হাত নাড়াল । চশমা পরা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সুপুরুষ ছেলেটা একগাল হেসে বলল ‘হাই আমি নীলাদ্রি, বসুন প্লিজ’। তারপর কিছুক্ষণ টুকটাক আলাপচারিতা, কফির অর্ডার, কফিতে চুমুক দিয়ে আমি সোজা পৌঁছলাম আসল টপিকে । বললাম ‘আপনাকে কিছু কথা বলার আছে আমার’। বাকিটা বলে ফেললাম গড়গড় করে, গলার কাছে কান্নাটা আসছিল, কিন্তু অচেনা একটা ছেলের সামনে ? না, থাক । কথা শেষ হতে দেখি, ছেলেটা কেমন গুম মেরে গেল, তারপর মুখ তুলে বলল, ‘জানিনা ঠিক আপনাকে কি বলব ? ভাল থাকবেন, আর এসব নিয়ে ভাববেন না, আমি বাড়িতে সব বুঝিয়ে বলব’।

দেখতে দেখতে ছটা মাস কেটে গেল । কবে যেন বাংলার স্যার বলেছিলেন, মানুষের জীবনে সময়ের সাথে সাথে কষ্ট যদি বেড়েই চলত তাহলে মানুষ বাঁচত না । হ্যাঁ,কষ্টটা থাকে, শুধু একটা প্রলেপ পড়ে তাতে, একটু একটু করে সয়ে যায় । তাও ভাবি ভাগ্যিস সামনাসামনি দেখা হয়নি, সেটা হলে কি করতাম ? পাগল হয়ে যেতাম তো । একদিন উইকেন্ডে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখে, মলে ঘুরছি, চারদিকে লোক গিজগিজ করছে, একটা জটলা কাটিয়ে এগোতে যাব, আরেকটু হলেই ধাক্কা খেতাম একজনের সাথে । সরি বলতে গিয়ে তাকিয়েছি, আরে নীলাদ্রি না? সেও একগাল হেসে বলল

–           আরে তুমি? কেমন আছ?

(বুঝলাম এ বেশি আপনি টাপনির ধার ধারে না, আমিও তাই, বললাম)

–           ভাল

–           সব ঠিকঠাক?

–           একদম

–           বিয়ে করলে?

–           আরে ধুর,মেয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে পাগল করে দিচ্ছে, বিরক্তিকর । বললাম একটা ব্রেক দাও, সামনের মাসে অফিস থেকে যাচ্ছি ইউ এস । তিন মাসের জন্য । এসে আবার ভাবা যাবে ।

–           বাঃ ভাল

–           ওকে আজ একটু তাড়া আছে, আসি কেমন?

–           ওকে বাই

বাড়িতে ফিরে ফেসবুক ঘাঁটছিলাম, কি মনে হল নীলাদ্রির প্রোফাইল খুঁজে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম । পাঠিয়েই মনে হল, এটা কি হল ? আজ জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে করেছ কিনা, বাড়িতে এসেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট । কি ভাববে ছেলেটা ? আমি কষ্ট টষ্ট সব ভুলে আবার বিয়েতে রাজি ? ছি,ছি । যাগকে, মরুকগে, যা ভাববে ভাবুক, ইচ্ছে হয়েছে পাঠিয়েছি, বেশ করেছি । পরদিন দেখলাম রিকোয়েস্ট এক্সেপ্টেড । আবার অফিস, কাজ, জীবন, বেশ মাসখানেক পর কি একটা ফেসবুকীয় পোস্টে নীলাদ্রির সাথে কথা হয়ে গেল । তারপর দেখি চ্যাটে পিং

–           কি ম্যাডাম শরীর ভাল?

–           হ্যাঁ, তুমি আমেরিকা পৌঁছেছ?

–           একদম

–           কোথায় আছ?

–           মিনিয়াপোলিস

–           ভাল

হাবিজাবি আরও কিছুক্ষণ কথা হবার পর জানলাম ও আর আমি একই টেকনোলজিতে কাজ করি । আমার অফিসে বেশ একটা গ্যাঁড়াকল প্রোজেক্ট চলছে, মাঝে মাঝেই ফেঁসে যাচ্ছি, বলতেই বলল ‘হ্যাঁ আমার সাথে আলোচনা করতেই পার, অবশ্য আমার যদি ফান্ডাতে কুলোয়’। একটা কাজ কর আমার হোয়াটস আপ নাম্বারটা নিয়ে নাও, চ্যাটে আমি সবসময় থাকিনা, আর তোমার আমার যা টাইম ডিফারেন্স’। নিয়ে নিলাম, অতঃপর কোডিং, ডিকোডিং, বাগ হ্যানত্যান চলতেই লাগল, দেখলাম ছেলেটার ফান্ডা বেশ ভালই, আমার কাজে লাগছে বেশ । যাক কোডিং বেঁচে থাক, ছেলেটার মনে  বিয়ে প্রসঙ্গে কোন সন্দেহ নেই বলেই মনে হয়  আমি নিশ্চিন্ত হলাম ।

চলছিল ভালই, আমার সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ, উইকএন্ডে অফিস করছি। একটা দরকারে পিং করলাম নীলাদ্রিকে, বাজে লাগছিল, ওদের ওখানে সবে উইকেন্ড শুরু হয়েছে,আজ  শুক্রবার । রিপ্লাই এল, কথা চলছে, হঠাত শনিবার সন্ধ্যে থেকে হোয়াটস আপে কোন রিপ্লাই নেই । ভাবলাম বেড়িয়েছে হয়ত, শনি গেল, রবি গেল, সোমবার বিকেল অব্দিও না হোয়াটস আপ, না ফেসবুক, জিমেইল চ্যাট, কোত্থাও নেই । এখনও ফেরেনি ? বুকের মধ্যে একটা হালকা ধড়ফড়ানি, কি হল ? কথা বলছে না কেন ? আবার ভাবছি, ধুর ওর তো হাজারটা কাজ থাকতে পারে, উত্তর দিতেই হবে এমন কোন ব্যাপার তো নেই । মঙ্গলবার থেকে ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করল, বারবার ওর টাইমলাইন চেক করছি, কোন খারাপ কিছু নয় তো ? মিনিয়াপোলিসে কোন বড় দুর্ঘটনার খবর আছে নেটে ? নাঃ নেই তো । সেদিন আমার জন্মদিন, সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, আমি ঠিক করে আনন্দ করতে পারছি না, কিছু কি হল ? বাড়িতে পায়েস করেছে মা, খাচ্ছি মানে গিলছি, বারবার টাইমলাইনে দেখছি নীলাদ্রির, এতটা সময় কেটে গেল ।

রাত তখন পৌণে বারোটা, আর পনের মিনিট পরে আমার জন্মদিন শেষ, ফোন বেজে উঠল, বাইরের নাম্বার, তুললাম

–           হ্যালো

–           নীলাদ্রি বলছি, আরে আজ দেখলাম তোমার বার্থডে, আরে আমি এমন ফেঁসে গেছিলাম, তোমার হোয়াটস আপে পিং দেখলাম, সরি, হ্যাপি বার্থডে

–           নীলাদ্রি তুমি কোথায় ছিলে ? কেন তিনদিন তোমার কোন খবর নেই ? জান…

আমি কথা বলতে পারছিনা, কান্নায় আমার কথা আটকে যাচ্ছে, ওদিক থেকে আওয়াজ এল

– আরে বোল না, শনিবার হঠাত প্ল্যান করে কয়েকজন গেছিলাম কাছাকাছি একটা হিলস্টেশনে । আরে পৌঁছনর পর সে কি বৃষ্টি, ল্যান্ডস্লাইড হয়ে, গাড়ি আটকে, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই, যাতা ব্যাপার, তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই ফিরলাম । হ্যালো, হ্যালো…একি তুমি কাঁদছ?

আমি কিছু বলতেই পারছিনা, আমি কি, কেমন বোকা, কেঁদেই চলেছি, ওদিক চুপ, কিছুক্ষণ পর আবার নিলাদ্রির গলা

–           রিয়া

আমি এমন গাধা, আরে এবার নিজেকে সামলে নিয়ে যাহোক কিছু বল, তা না আবার কেঁদে ফেললাম জোরে

–           তুমিতো ভারি ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে দেখছি, দাঁড়াও আসছি পুজোতে কলকাতায়, তোমার একটা ব্যবস্থা করতে হবে

পুজো কেটে গিয়ে আবার নভেম্বর, নীলাদ্রির ঘরণী হয়ে এসেছি ব্যাঙ্গালোর, কাল এসেছি, বিয়ে, হানিমুনের পাট চুকিয়ে । নীলাদ্রি অফিস গেছে, আমি ফেসবুক খুললাম, বেশ কয়েকদিনের ব্যস্ততায় খোলাই হয়নি।

এদিক সেদিক দেখতে দেখতে কি মনে হল,ক্লিক করলাম মেমরিতে……………

What should I write about

Mohona Choudhury

Mohona

 

Should I write about a cat sitting on a mat?

Or about a clock going tick and tock?

Should I write about a mighty tree giving us shade?

Or about my father’s shaving blade?

It’s a lot of effort when it comes to thinking what should I

write about .

Should I write about the dusty road in front of our house?

Or about a piece of mozzarella cheese being chased by a mouse?

Should I write about a woodcutter cutting wood?

Or about a princess who was looking very good?

It’s a lot of effort when it comes to thinking what should I

write about .

Illustration: Mohona Choudhury

অপরূপা খাজ্জিয়ার

সোমা উকিল

 

উফ্ প্রায় ৯- ১০ মাস হয়ে গেল একেবারে  হায়দ্রাবাদে বন্দী । সেই থোড়-বড়ি-খারা র মতো অফিস আর সংসার । উপরি পাওনা হল মেয়ের জুনিয়র কলেজের অহেতুক সিরিয়াসনেস । যাহোক, জানা গেল ইলেভেনের পরীক্ষার পর এক হপ্তা প্যারলে বেরোতে দেবে নাকি । আহা এই সুযোগ !

তাড়াতাড়ি প্ল্যান করে হিমালয় এ কোন নির্জন কোণা খুঁজতে হবে আগে । আজকাল অবশ্য গুগলের শক্তিশালী সার্চ এঞ্জিনে  খোঁজার গতি প্রায় মনের গতির সমান হয়ে গেছে । এবার লটারি –  ভূটান নাকি হিমাচল প্রদেশ । শেষে অবশ্য হিমাচলই জিতল । খাজ্জিয়ার উপত্যকা ও জিয়া গ্রাম, দুটিই চম্বা ও কাংরা ভ্যালী র দুই অপরূপা কন্যা । খাজ্জিয়ার এর বেশ নাম ডাক বেশ আগে থেকেই আছে উত্তর ভারতীয়দের কাছে সুইত্জারল্যান্ড অফ হিমাচল বলে কথা ! তবে জিয়া সেরকম সুখ্যাতি এখনো অর্জন করেনি ।

প্রস্তুতি অনেক, টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, তবে তার উত্তেজনা ও উদ্দীপনা দুটি ই খুব উপভোগ্য । ঠিক হল হায়দ্রাবাদ থেকে সকালে  দিল্লি, সারাদিন দিল্লিতে ঘোরাঘুরি, রাতে ট্রেনে চেপে পাঠান কোট , ভোরে পাঠান কোট থেকে ডালহৌসি হয়ে খাজ্জিয়ার ।

যেমন প্ল্যান, তেমন মেয়ের পরীক্ষা শেষের পরদিন ই সকালে বেরিয়ে পড়া । দিল্লী পৌঁছাতে প্রায় দুপুর । দিল্লীর মেট্রোটা কিন্তু দারুন – পরিকল্পনা, সিস্টেম, ডিসিপ্লিন সবই । নিউ দিল্লী মেট্রো স্টেশনের ক্লোকরুমে সব ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়া গেল । প্রথম চাঁদনী চক, তারপর পারাঠেওয়ালি গলিতে পারোটা খাওয়া ও লাল কেল্লা দেখা । ওই পরোটা গলি তে প্রায় পঞ্চাশ রকম পরোটা পাওয়া যায়, একদম ছাঁকা তেলে ভাজা, সঙ্গে বেশ কয়েক রকম তরকারি, চাটনি । একটু ভয় হলেও [ওই পেট ঠিক ভাবে ব্যাপারটা নেবে কিনা !] বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হোল কিন্তু ।  গলিটার প্রস্থ উত্তর কলকাতার যে কোন কানা গলি কে হার মানায় । দোকানগুলোর সাজ সজ্জা এবং পরিচ্ছন্নতা শিয়ালদা স্টেশনের পাশে উড়াল পুলের নিচে খাবার দোকানের কথা  মনে করায় । কিন্তু তাতে দেশীদের সাথে বিদেশিরাও পাল্লা দিয়ে পরোটা খাচ্ছে । খাওয়া দাওয়া সেরে  দিল্লির চাঁদনি চকে রিক্সা চেপে লাল কেল্লায় পাড়ি দিলাম তিন জন । হাতে অনেক সময়, তাই বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাল কেল্লা দেখা হল, হটাৎ বৃষ্টি আসায় লাইট এন্ড সাউন্ড দেখার ইচ্ছেতে জল ঢালতে হল । কি করা যায় ? ঠিক হোল কনট প্লেসে  যাওয়া  যাক ।  চাঁদনি চকের পর কনট প্লেসের  এ পরিবেশগত তফাতটা ও তো খুব চোখে পড়ার মত তাইনা ? ঘোরাঘুরি করে, ডিনার খেয়ে এবার ট্রেন চাপা । তাই রওনা হলাম রহিলাসারাই এর দিকে, ট্রেনটা ওখান থেকেই । আহ ! সারাদিন ঘুরে ট্রেনে চড়েই দুচোখ সবারই জুড়িয়ে এল ।

ভোর পৌনে পাঁচটা- পাঠান কোট এসে গেছে । মার্চ এর তৃতীয় সপ্তাহ, তাও বেশ ঠাণ্ডা পাঠান কোটে । আগে থেকে কোনও গাড়ি বুকিং করিনি, নেমে যা হোক দেখা যাবে । স্থানীয় একজন পরামর্শ দিলেন যে বাসে করে গেলে সাশ্রয় ও আরাম দুটোই হবে । বাসে উঠে স্থানীয় জীবন যাত্রার এক টা  ছবি নিঃসন্দেহে পাওয়া গেল । পথে দুনহেরা গ্রামে পাউরুটি ও স্থানীয় মাখন দিয়ে দারুন একটা ব্রেকফাস্ট হোল । প্রায় দশটা নাগাদ আমরা ডালহৌসি পৌঁছে গেলাম । অপূর্ব এই শৈল শহর । পুরানো দিনের সুন্দর পাথরের বাড়ি ঘর, পরিচ্ছন্নতা নজর কাড়ে বইকি ।একটু হেঁটে ওপর দিকে গেলে এ ঝকঝকে রুপালি পিরপাঞ্জাল  গিরিশ্রেণীর সৌন্দর্য দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় ।

গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঠিক হোল, ডালহৌসির আশ পাশ ঘুরে খাজ্জিয়ার যাবো । খাজ্জিয়ারে হোটেলের চেক ইন টাইম একটু বেলার দিকে । ট্যাক্সি ও ওখান থেকে সহজে  পেয়ে গেলাম । এদিক ওদিক দেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য  পাঞ্চপুলা ওয়াটার ফলস । ভারি সুন্দর এক জায়গা, প্রকৃতি অনেক যত্ন নিয়ে এমন সুন্দর উপহার আমাদের জন্য সাজিয়েছেন, মন্ত্রমুগ্ধের মত অনেকক্ষণ শুধু তাকে দেখলাম, জলের সুর , পাখির কলতান শোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আর শোনা হোল না । বড় বড় সস্তা সাউন্ড বক্স লাগিয়ে তাতে চলেছে গান নামক চ্যাঁচামেচি ।  বড় কষ্ট হোল দেখে যে কিছু মানুষ শুধু ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে কি ভাবে এই সৌন্দর্যকে শুধু যে নষ্ট করছে তা নয়, সাথে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেও অনিশ্চয়তার মুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে ।

পাঞ্চপুলা ছেড়ে এগিয়ে চললাম খাজ্জিয়ারের দিকে। পথে বিস্তীর্ণ এলাকায় আলুর ক্ষেত, সবই ধাপ চাষ । বিস্তীর্ণ চম্বা উপত্যকা, ঘন সবুজ পাহাড়ের ঢল , মেঘ সূর্যের খেলা, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, সব আমাদের তিন জনের দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি একদম ভুলিয়ে দিল । প্রায় পৌঁছে গেলাম খাজ্জিয়ার , দূর থেকে দেখা যাচ্ছে , আঁচ পাচ্ছি সেই সৌন্দর্যের।  বাঁ পাশে হোটেল দেওদার আর ডানদিকে সেই খাজ্জিয়ার ভ্যালী, অপরূপা খাজ্জিয়ার ! সত্যি তো, আমি কিছু সুইত্জারল্যান্ডের ছবি দেখেছি ,যাবার সুযোগ হয়নি, কিন্তু ভীষণ মিল তো সেই সব ছবির সাথে ! বাঃ , যতদূর চোখ যায়, শুধু মুগ্ধ হবার পালা । ঘন পাইনে ঘেরা উজ্জ্বল সবুজ সেই বিস্তীর্ণ উপত্যকা, মাঝে ছোট অগভীর লেক, তার এক ধারে উজ্জ্বল লাল, নীল রঙ এর চাল দেওয়া ইংলিশ  কটেজ, কিছু ঘোড়া সওয়ারি নিয়ে চলেছে।

Soma

হোটেলের চেক ইন পর্ব সেরে ঘরে ঢুকে খুবই আনন্দ পেলাম। কথা রেখেছে, যেমনটা চেয়েছি তেমনটাই তো দিয়েছে, দেয়াল জোড়া কাচের জানালা দিয়ে যে ভ্যালির বিরাট অংশ দেখা যায় ! ফ্রেশ হয়ে হিমাচলি রান্না দিয়ে দুপুরের খাবার সেরেই ভাবলাম, আর দেরি না বেরিয়ে পড়া যাক এমন সুন্দরের কোলে এক মুহূর্ত নষ্ট করা নয়, প্রাণভরে নিতে হবে এর আস্বাদন । কোথা থেকে যেন কালো মেঘ ছেয়ে ফেলল, দারুণ ঠাণ্ডা হাওয়া আর দু এক ফোঁটা গায়ে বিঁধল । আরে জল নয়, ছোটো ছোটো শোলার বলের মত বৃষ্টি । দৌড়ে চলে আসতে হল হোটেলে আর এই প্রথম আমি দেখলাম সেই বরফ বৃষ্টি । নাহ এত ঠাণ্ডায় জল আর পড়ে না , শুধু বরফ । ঢেকে গেল খাজ্জিয়ার বরফে । আর সবুজ নয়, এবার সাদা পাইনগুলো ছাড়া সব সাদা আর থোকা থোকা মেঘ উড়ে গেল সেই ঘন পাইন এর থেকে । এইসব ফ্রেমগুলো জীবনের অ্যালবামে চিরস্থায়ী।

পরের দিন সকালটা সোনাঝরা এক সকাল । ঝকঝকে নীল আকাশ , নিখুঁত সবুজের বাহার  চারিদিকে । আর কি ঘরে থাকা যায় ? বেরিয়ে পরলাম , চলে গেলাম ওই অন্য প্রান্তটায় । এবার আর একবার অবাক হবার পালা , ওই যে পিরপাঞ্জাল এর পুরো রেঞ্জটা দেখা যায় এই প্রান্ত থেকে । এখান থেকে অল্প দূরে এক পয়েন্ট থেকে মনিমহেশ কৈলাসও দেখা যায় ! প্রতি কোনায় যে কতকিছু দেখার ও আনন্দ পাবার ! কিছুটা বেলা বাড়লে ভাবলাম কালাটোপ এর রিসার্ভ ফরেস্টে ঘুরে আসা যাক । পথে মনিমাহেশ কৈলাস এর পয়েন্ট থেকে তাঁকেও দেখে নেব । সত্যি অপূর্ব দর্শন পেয়েছি মনিমাহেশ এর । কালাটোপতো আরও ঠাণ্ডা ! পায়ে হাঁটা ১২ কিলোমিটার পথ চলে গেছে খাজ্জিয়ারের সেই ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ।

আমরা উৎসাহ ভরে  পা দিলাম সেই পথে । কিছুটা তো এগোই । কিন্তু খানিকটা  গিয়ে আর পারা গেল না, বেশ অনেকটা করে কাঁচা পথ ঢেকে আছে বরফে । যে জায়গায় বরফ গলেছে, সে জায়গা ভীষণ পিছল । পড়লে পাশের খাদে । তাই আবার ফিরে আসা , বেলা ও পড়ে এসেছিলো । চারিদিকে সুন্দর কিছু পয়েন্ট আছে, ঘুরে দেখলাম, পড়ন্ত রোদের তাপ এই ঠাণ্ডায় উপভোগ করলাম ! আমাদের যিনি গাড়িতে করে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন, সেই সুদর্শনজী ফিরিয়ে নিয়ে এলেন আমাদের সেই অপরূপা খাজ্জিয়ারে!

এইচ পি টি ডি সি র ম্যানেজার মানুষটিও ভারি মজাদার । সকালে ব্রেকফাস্ট এ গল্প করতে করতে বললেন “চম্বা ঘুরে আসুন, আমার বাড়ি ওখানে । দেখুন কি সুন্দর !” ঠিক আছে, বেরিয়ে পড়লাম চম্বায় । কত  পুরনো শহর ! সুন্দর মিউজিয়াম, সত্যনারায়ণ মন্দির, অনেক ওপরে চামুণ্ডা মন্দির , বেশ ঘোরা হল এই জেলা শহর । এবার ফিরে আসা খাজ্জিয়ারে, শেষ সন্ধে । ভারি সুন্দর রুপোলি থালার মত দোল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে , তার উজ্জ্বল আলোতে পিরপাঞ্জাল এর আর এক রূপের সাক্ষী হলাম । মনে হল যা দেখলাম, তাদের মধ্যে খাজ্জিয়ারই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ! পরের দিন যাবো জিয়া । সে গল্প না হয় আর একদিন করা যাবে ।

 

অলংকরণ :  সোমা উকিল