পিয়ালী চক্রবর্ত্তী
‘দিয়ে জ্বলতে হ্যায়, লোগ মিলতে হ্যায়, বড়ি মুশকিলসে মগর দুনিয়ামে দোস্ত মিলতে হ্যায়’
রবিবারের সকাল আটটায় এফ.এম চিত্কার করে চলেছে, ঘুমের এইসি কি ত্যায়সি, আমার শাশুড়িকে কিছুই বলা যাবে না, এই যদি গানটা ‘আনারকলি ডিস্কো চলি’ হত, রেডিওর গলা নিজেই টিপে দিতেন, কিন্তু এই গান যে সেই সত্তরের, রাজেশ খান্না, এই কদিন আগে টিভিতে যার অন্তিম সংস্কার দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। আহারে. যাকগে, আড়মোড়া ভেঙ্গে ভাবলাম, দোস্ত কেন, পয়সা-কড়ি, সুখ-শান্তি, এমনকি এই ছুটির দিনে ঘুমটুকুই কত মুশকিলে মেলে।
‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’, আজ নাকি ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’, তাই সেন্টিমেন্টে এত ঝাঁকুনি সকাল সকাল। তাই বল, আমার বরের মোবাইলে সক্কাল সক্কাল ঝাঁকুনি, লন্ডন থেকে এসেছে অনুব্রত, বরের বন্ধু, তা ফ্রেন্ডশিপ ডে’র ইস শুভ অফসর মে, সে নাকি গুটিকয় বন্ধু, বন্ধুপত্নী আর তাদের ট্যাঁ-ভ্যাঁদের লাঞ্চে ডেকেছে. শুনে শাশুরিও খুশি হয়ে বললেন, “ও তা তোরা যা, আমি তবে দিদির বাড়ি যাই”। অনুব্রতকে দেখার আনন্দে নাকি কে জানে, বর আমার জলখাবারে মুড়িমাখা খেতে রাজি হলো, ছেলেও হলো। লাঞ্চ বানানোর তাড়া নেই, বেরোতে দেরী আছে, আমি আলমারি খুললাম খোশ মেজাজে, অনুব্রত যে আমার কত উপকার করলো, সে কি নিজেও জানে?
আজ হঠাত কলেজ জীবনের একটা শাড়ি পরার শখ হলো, এর সাথে বেশ মানাবে পোড়ামাটির কানের দুল আর হার, আছে পাশের ড্রয়ারে, পুরনো কিছু বই-খাতার সাথে। পুরনো গয়না. ড্রয়ার খুলতেই পুরনো গন্ধ, ভীষণ বিপজ্জনক। সব কাজ ভুলিয়ে দেয়,এফ.এমের মত সেন্টিমেন্টে প্রবল ঝাঁকুনি দেয়,দুঃখ হয় একগাদা,আমি এই ড্রয়ারটা তাই খুব দরকার না পড়লে খুলি না। আজ কি যেন এক ঘোরের মধ্যে খুললাম ড্রয়ারটা,পুরনো গয়নাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতেই পাশে সেইসব পুরনো ডায়েরি,স্কুলজীবনে ডায়েরি লিখতে শুরু করেছিলাম,বিয়ের পর ছেড়ে দিয়েছি।
আমি মনে করি ডায়েরি লেখা ভালো না, সেই পুরনো গন্ধটার মত বিপজ্জনক,যা আর ফিরে পাওয়া যাবেনা,সেগুলোকে কালি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে হয়না। ডায়েরি মানুষকে পিছন দিকে টানে, ভুলতে চাওয়া সাল,তারিখ,দিন কিছুতেই ভুলতে দেয়না। এই যেমন আবার ঘোরের মধ্যে আমি হাতে তুলে নিলাম,স্কুলজীবনের ডায়েরি, ‘আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি’।
আজ স্কুলে প্রথম দিন শাড়ি পরে গেলাম। প্রথমে কেমন বাজে লাগছিল, জোরে জোরে হাঁটা যায়না। খালি মনে হয় এই বুঝি শাড়ি খুলে গেল. শাড়ি পরে ঘর থেকে বেরোতেই বাড়িশুদ্ধু লোক হ্যা হ্যা করে হাসলো। রিকুদাদা বলেছে আমায় নাকি বিচ্ছিরি লাগছে , ও নিজে যেন কত সুন্দর। জেঠিমা বলেছে, ‘রিঙ্কু তুই খুব সুন্দর লাগছিস, আমার ছেলেটা পাজি, ওর কথা শুনবিনা’। আমি নাইন’এ’ সেকশনে রয়েছি, সোমরিতা এবার ‘বি’ তে। বাঁচা গেল, এক নম্বরের হিংসুটে একটা। ইস, সবাইকে কি আলাদা লাগছে স্কুলে। সায়নি কে একদম পুতুল পুতুল লাগছে, মধুরিমাকেও, শ্রাবন্তী মুখ গোমড়া করে আছে,ওর বয়েজ কাট চুলের সাথে নাকি একটুও মানাচ্ছে না শাড়ি। আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি। শর্র্মিষ্ঠা আবার চোখে কাজল পরেছে, সব সময় স্টাইল। দীপশ্রী ফার্র্স্ট বেঞ্চে আমার জন্য জায়গা রেখেছিল, রোজ রাখবে বলেছে। আমি আজ একটা মিথ্যে কথা বলে এসেছি মাকে। বলেছি অভিজিত স্যার আজ তাড়াতাড়ি ইংলিশ টিউশন পড়াবে তাই স্কুল থেকে আমরা সোজা টিউশনে যাব। আমি বাড়ি গিয়ে চেঞ্জ করে টিউশনে যাই, কিন্তু,আজ,আজ প্রথম দিন শাড়ি পরেছি না, সুতীর্থ আগের দিন বলেছে আজ স্কুল ড্রেসেই আসতে, আমায় দেখবে। দীপশ্রী জানে, তাই আমি স্কুলের পর দীপশ্রীর বাড়ি গেলাম. ওর বাবা-মা চাকরি করে, ঐসময় কেউ থাকবে না। ওখান থেকে আমি আর দীপশ্রী একসাথে পড়তে গেলাম।
সুতীর্থ যথারীতি দেরিতে এলো,তাও ভালো আজ আমার উল্টোদিকের বেঞ্চটা খালি ছিল। এমনভাব করলো যেন আমায় দেখতে পায়নি,আমি জানি আড়ে আড়ে দেখেছে। টেবিলের তলা দিয়ে দু-তিনবার পায়ের ঠোকাঠুকি হলো, চাইল না। ইস একবারও আমায় সামনাসামনি দেখল না।
সন্দীপ, অয়ন, দীপশ্রী, সুতীর্থ, আমি, কৃষ্ণেন্দু, এতজনে একসাথে বেরোলাম। কেমন লাগছে আমাকে? জিজ্ঞেস করতেই পারছিনা. এইবার আমার রাস্তা চেঞ্জ হবে. মোড়ের মাথায় আমাদের শেষবারের আড্ডা, অয়নটা, এক নম্বরের ক্যাবলাকান্ত, আমায় দেখে বলল ‘তোকে কেমন লেডি লেডি লাগছে, ভালো লাগছে না’। বেশ হয়েছে, মনে মনে বললাম ‘কে শুনতে চেয়েছে তোর কাছে?’
সন্দীপ কাল ওদের পাশের বাড়ির মেয়েটাকে লাভ লেটার দেবে, সেটা পড়ে শোনাচ্ছিল, সকলে ওকে ঘিরে ধরল, সেই ফাঁকে আমি সুতীর্থকে একটু টেনে এনে জিজ্ঞেস করলাম. কেমন লাগছে বললি না তো?
- বাজে
- বাজে?
- হ্যাঁ বাজে
- ঠিক আছে,
- কি ঠিক আছে?
- কিছু না
- তবে একটা জিনিষ খুব ভালো লেগেছে
- কি?
- ওই পড়ার শেষে যখন টেবিলের এপাশ থেকে পা তুলে ওপাশে বেঞ্চ টপকাচ্ছিলি তখন দেখেছি
- কি?
- সাদা রঙের
- কি?
- ওই যে শাড়ির তলায় থাকে, একচিলতে দেখা গেল
ওদের চিঠি পড়া শেষ, সবাই বাড়ির দিকে হাঁটা দিল, সুতীর্থও, আমার কান মাথা গরম হয়ে গেছে, যেন আগুন বেরোচ্ছে, কেমন লজ্জা করছে, ইস সুতীর্থটা খুব বদমাশ. সবসময় এমন বলে. বাড়িতে এসে আজ দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরে চেয়ারের এদিক ওদিক টপকেছি, কেমন করে দেখেছে সুতীর্থ আমাকে?
এখন আমি আমার বরের বন্ধু অনুব্রতর ওপর যতটাই খুশি সে ততটাই রেগে যাবে আমাদের ওপর, কারণ এ ডায়েরি পুরোটা পড়তে বসলে, আজ আর লাঞ্চে যাওয়ার টাইম হবে না. কয়েকটা পাতা ছেড়ে দিলাম।
আজ সকালে বায়োলজি টিউশনটা খুব বাজে গেল. আমরা কয়েকজন যারা মাধ্যমিকে অ্যাডিশনাল বায়োলজি নিয়েছি, তাদের সবাইকে গৌরবদা মানুষের জননতন্ত্র পড়াতে শুরু করলেন। ছি, এইগুলো ছেলে আর মেয়েদের আলাদা করে ক্লাস নেওয়া উচিত। ঋতুচক্র মানে মেন্সট্রুয়েশন সাইকেল মানে, কিসব বলে যাচ্ছিল গৌরবদা আর অনিন্দ্যর মত অসভ্য ছেলে আর হয়না, ও ঠিক এই জায়গাটাই বুঝতে পারছিল না। বার বার ‘গৌরবদা আর একবার বলবে?’ সুতীর্থ, অয়ন আর সন্দীপ মুখ চিপে হেসেই যাচ্ছে. আমি আর দীপশ্রী খাতা থেকে মুখ তুলতেই পারছিলাম না। সুতীর্থ কদিন আগে আমার কাছ থেকে এই ব্যাপারটা আবার ভালোভাবে জেনেছে. ও নিশ্চই সন্দীপ আর অয়নকে বলেছে।
টিফিনের সময় সুজাতা আমাদের কয়েকজনকে বলল সব। ওর দিদি ওকে বলেছে ‘সহবাস’ মানে কি? খুবই বাজে ব্যাপার। যদিও আমার ডায়েরি কেউ পড়বে না, তবুও আমি এখানে লিখতে পারছি না।
আমার ছেলে এফ.এমটা চালিয়েছে আবার. গান হচ্ছে ‘পুরানী জিন্স, অর গিটার’ আমি এতক্ষণ আলমারির সামনে মেঝেতে বসেই পড়ছিলাম, আরাম করে ব্যালকনিতে এসে বসলাম. আজ হয়েছে আমার লাঞ্চে যাওয়া।
বেলাদির খুব বাজে স্বভাব। পড়া ধরে নিজেই গরগর করে উত্তর দিতে থাকেন। আরে পড়া ধরছে তো নাকি? আজ মৌমিতাকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের জলবায়ু বলতে বলে নিজেই বলে যাচ্ছে. মৌমিতা এক ধমক দিয়েছে, ‘আঃ আপনি বলতে দেন না কেন বলুন তো? চুপ করুন না আমি বলছি তো।’ এরপর বেলাদির মুখটা যা হয়েছিল না, হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাচ্ছিলাম। তার ওপর কনিকাদি আজ আগে আগে যাচ্ছিলেন. আমি পিছন পিছন যেত যেতে দীপশ্রীকে বলছিলাম ‘ওই দেখ শাখাঁলু’, আর হাসছিলাম। কনিকাদি হঠাত পিছন ফিরে বললেন, ‘এই কে রে শাখাঁলু’? আমরা তো কেউ না কেউ না বলে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দার উঠতে লাগলাম, আধা সিঁড়ি উঠে যখন কনিকাদি আর আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, দীপশ্রীটা এত পাজি, আস্তে করে বলে কিনা ‘জানো না তুমি তো’, আর আমাদের কি হাসি।
কনিকাদির মুখটা মনে পরে গেল,শাখাঁলু,নামটা ভালই দিয়েছিলাম। না রেখে দি ডায়েরিটা, ধীরে ধীরে পাতা ওল্টাচ্ছি, একটা পাতায় চোখ আটকে গেল
সুতীর্থ আজকাল আমায় খুব অ্যাভয়েড করছে। আমি কি খুব সাদামাটা, বাংলা মিডিয়ামে সরকারী স্কুলে পড়ি বলে? আর ওই নতুন মেয়েটা ‘অর্র্চিতা’ ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, চুলে স্টেপস কাটা, ভুরু প্লাক করা, হাতে পায়ে ওয়াক্সিং করা, তাইতে এত ভালো লেগে গেল সুতীর্থর? দুদিন আসতে পারিনি বলে আজ খাতা চাইলাম, বলল ‘তুই অয়ন বা সন্দীপের থেকে নে না, আমার কাছ থেকে অর্র্চিতা নেবে’। গা জ্বলে যায় শুনলে। মানছি ইংলিশে ও অনেক ভালো। আমি কি খারাপ, শুধু ফটফট করে বলতে পারিনা বলে? আজ সত্যি সত্যি অভিজিত স্যার তাড়াতাড়ি পড়িয়েছে, তাই স্কুল থেকে সোজা পড়তে গেলাম, আজ সুতীর্থর উল্টো দিকে বসেছিলাম, আজ বেঞ্চ টপকেছি। সুতীর্থ কেমন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে. আমার খুব কান্না পাচ্ছে। বাড়ি এসে দেখি কারেন্ট নেই আর মা, বাবা, জেঠু, জেঠিমা কেউ নেই। সবাই পিসির বাড়ি গেছে কি দরকারে। রিকুদাদা একা। রিকুদাদার ঘরে আমার ঢুকতে ইচ্ছা করেনা। কদিন আগে ওর বালিশের তলায় একটা খুব নোংরা মলাটের বই দেখেছি। ইস এইসব পড়ে আজকাল রিকুদাদা? আমাকে জিজ্ঞেস করছিল হ্যারিকেন জ্বেলে দেবে কিনা, আমি বললাম ‘না ছাদে যাচ্ছি’। মনটা খারাপ ছিল, কিছুক্ষণ বাদে দেখি রিকুদাদা উঠে এলো ছাদে।
- কিরে একা একা বসে আছিস?
- এমনি
- কেন মন খারাপ?
রিকুদাদা হাত দিয়ে আমার কোমরটা জড়িয়ে ধরেছে, শক লাগার মত চমকে উঠলাম, ঠিক ব্লাউজের আর শাড়ির মাঝের ওখানে রিকুদাদার হাত, আঙ্গুলগুলো কোমরের ওপর সরগম বাজাচ্ছে। আমার গা ঘিন ঘিন করছে, বমি পাচ্ছে, এক ধাক্কায় হাতটা সরিয়ে দিলাম।
- তুই নিচে যা আমি এখন এখানে একলা বসব
- তুই যাবি না?
- না
কি জানি একটা অদ্ভুত জোর এসেছিল গলায়,’না’ বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল, রিকুদাদা কেমন ছিটকে চলে গেল নিচে। আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আচ্ছা কয়েকবছর আগেও তো রিকুদাদাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতাম, আজ হঠাত গা ঘিনঘিন করলো কেন?
এইজন্য ডায়েরি লিখতে নেই আর পড়তে নেই। কিছুতেই ভুলতে দেয়না সেই সাল, তারিখ, দিনগুলো…
অর্র্চিতা এখন অন্য ব্যাচে পরে, সেই কারণে নানা অজুহাত দেখিয়ে সুতীর্থ ব্যাচ চেঞ্জ করেছে, নতুন ব্যাচের জন্য কেমিস্ট্রি পড়াও চেঞ্জ করেছে. মাধ্যমিক দেবার পর থেকে সুতীর্থ আমায় আর চিনতেই পারেনা। আমরা এখন কো-এড স্কুলে পড়ি, একসাথে । সায়েন্সে, কিন্তু ও যেন কেমন হয়ে গেল। দীপশ্রীর নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে, জয়দীপ। ও আজকাল ওকে নিয়েই ব্যস্ত। মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত, আমি নাকি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি খুব। আজ আমার বাংলা খাতাটা টেবিলের ওপর পড়েছিল, মা দেখছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। খাতার পিছনে লেখা ছিল সু + অনি, মা আমার দিকে তাকালো, কিছু বলল না। আজ বিকেলে গেলাম দীপশ্রীকে ডাকতে, গ্রুপ স্টাডিজ করব বলে ওকে আমি ডেকে নিয়ে আসি, আসলে ও জয়দীপের সাথে দেখা করে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি একটু দূরে, একা একা। আমি এইসময় খুব খুব মিস করি সুতীর্থকে।
সুতীর্থ আমার সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে, আমি পারছিনা, সত্যি পারছিনা। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না। ও আমার। অর্চিতা ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতেই পারেনা। যে করে হোক ওর সাথে কথা বলতে হবে। দীপশ্রী আর আমি মিলে প্ল্যান করেছি যে দীপশ্রীর জন্মদিনে এবার শুধু অয়নকে আমরা খাওয়াতে নিয়ে যাব। সুতীর্থর ব্যাপারটা জানতে হবে, অয়ন জানে সবকিছু, শুনেছি ও নাকি সুতীর্থ, অর্চিতার মধ্যে চিঠি চালাচালি করে।
অয়নটা সত্যি ক্যাবলা, দীপশ্রী যেই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলল, “তুই তো আমাদের একমাত্র ভাল বন্ধু, আর তো কেউ বিশেষ কথা বলেনা, তাই ভাবলাম শুধু তোকেই নেমন্তন্ন করি”। ব্যস গদগদ হয়ে গেল একেবারে। মোগলাই খাওয়াতে খাওয়াতে শুনলাম পুরো ব্যাপারটা। অর্চিতা আর সুতীর্থ সাঙ্ঘাতিক প্রেম করছে। অর্চিতার বাবা খুব স্ট্রিক্ট, কিন্তু অয়নকে চেনেন আর নাকি খুব ভালবাসেন। অয়ন ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। ওদের বাড়ি অয়ন প্রায়ই যায়। তাই সুতীর্থ চিঠিপত্তর সব অয়নের হাত দিয়েই পাঠায়। অয়ন খুব গর্ব করে বলল যে ও ছাড়া নাকি এই অ্যাফেয়ারটা হতেই পারত না। আমার শুনতে শুনতে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
আচ্ছা এমন হতে পারেনা? সুতীর্থ খুব বিপদে পড়ল, আমি ওকে বাঁচালাম, ও আমার হয়ে গেল। নাহলে অর্চিতা ওকে ছেড়ে দিল, ও বুঝতে পারল, এ পৃথিবীতে একা আমিই ওকে ভালবাসি। ও আমার কাছে ফিরে এল। না একবার, একবার অন্তত ওর সাথে কথা বলতে হবে। ওকে কি একটা চিঠি লিখব?
আজ মায়ের ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা চুরি গেছে। বাবা বলছে “তুমি হারিয়ে ফেলেছ”। মা মানছে না, বলছে বিকেল অব্দি নাকি ওটা মায়ের পার্সেই ছিল। সন্ধ্যেবেলা থেকে পাচ্ছে না। আমার পরিস্কার মনে পড়ছে, আমি যখন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকছিলাম, রিকুদাদা তখন আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঘরে কেউ ছিলনা। মা জিজ্ঞেস করল
- হ্যাঁরে তুই আমার পার্স খুলেছিলি?
- নাতো
- টাকাটা কোথায় গেল বলত
- মা আমি স্কুল থেকে ফেরার সময় রিকুদাদাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি
- তাতে কি হয়েছে?
- রিকুদাদা আজকাল সিগারেট খায় জান? খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিসব বাজে বাজে ছেলেদের সাথে মিশছে।
- রিকুদাদার ব্যাপারে তোমার এত না ভাবলেও চলবে। তুমি নিজের পড়াশুনা নিয়ে ভাব। আমি কিন্তু অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করছি, তোমার পড়াশুনায় একেবারেই মন নেই। আমি এখনও ঠিকঠাক জানিনা তুমি কি করে বেড়াচ্ছ, কিন্তু জানার আগে নিজেকে শুধরে নাও। পড়াশুনা আগে, বাকি সব তারপর।
উফ, নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। মা আমায় এরম বলল কেন? কিন্তু রিকুদাদা বাজে সত্যি বাজে ছেলে, আমি একদিন প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব। আজ ভাল করে পড়েছি, না না ভাল রেজাল্ট করতেই হবে।
আজ সন্ধ্যেবেলা আবার কারেন্ট অফ হয়ে গেছিল, বাড়িতে কেউ নেই রিকুদাদা ছাড়া। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছিল। কিন্তু না, শয়তানটা এঘরে আসেনি। আজ সুতীর্থকে চিঠি লিখেছি। একবার অন্তত দেখা করার জন্য। কাল দীপশ্রী দিয়ে দেবে স্কুলে। ইস চিঠিটাকে টেবিলের ওপর রেখে বাথরুমে চলে গেছিলাম, এসে দেখলাম রিকুদাদা ঘরের মধ্যে, বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল।
- তুই এখানে কি করছিস?
- কিছু না, দেশলাই খুঁজছিলাম
- কেন? বাড়িতে বসেই সিগারেট খাবি?
- তোর জেনে কি দরকার?
রিকুদাদা নিজের ঘরে চলে গেল। চিঠিটা তো ঠিক জায়গাতেই আছে, ভাঁজ করা। শয়তানটা পড়েনি তো?
সুতীর্থ আমায় ডেকেছিল ওর বাড়িতে। আইডিয়াটা আমি লিখেছিলাম, আজ বায়োলজি প্রাক্টিক্যাল বাঙ্ক করে যদি দুপুরের দিকে কোন বাহানা করে আমি ওর বাড়িতে পৌঁছে যাই। ওর বাড়িতে ওইসময় কেউ থাকেনা। ও হ্যাঁ বলেছে দীপশ্রীকে। একচোট ঝগড়া হয়ে গেল দীপশ্রীর সাথে। দীপশ্রীটা কেন জানিনা আমায় বারণ করছিল এভাবে ওর বাড়িতে যেতে। আরে কে দেখতে যাচ্ছে? কিন্তু আমাকে তো একবার জানতে হবে, জানতেই হবে। মুখের ওপর বলে দিল “যাচ্ছিস যা, কিন্তু কোন প্রব্লেমে পড়লে আমার কাছে কাঁদতে আসবি না”। মানে ও কি মনে করে আমায়? আমি বাজে মেয়ে? নিজে ধোওয়া তুলসিপাতা? অন্ধকারে জয়দীপের সাথে অ্যাপো মারার সময় কিসব হয়, আমি জানি না, না?
আজ সুতীর্থ স্কুলেই আসেনি। মানে আমার জন্য ও অপেক্ষা করছে সারাদিন।
আমি হনহন করে হাঁটা দিলাম ওর বাড়ি, বুকের ভিতর লাব-ডাব শব্দটা শুনতে পাচ্ছি, প্রত্যেকটা। কলিং বেল বাজালাম, দরজা খুলল। খালি গা সুতীর্থ দাঁড়িয়ে আছে।
ওর পিছন পিছন ওর ঘরে ঢুকলাম, চড়া সিগারেটের গন্ধ ঘরময়।
- তুই সিগারেট খাচ্ছিলি?
- হ্যাঁ খাই তো?
- তোর গার্লফ্রেন্ড জানে?
- আমার গার্লফ্রেন্ডের ওপর তোর এত রাগ কেন? তোরা নাকি অয়নকে কিসব জিজ্ঞেস করেছিস আমার ব্যাপারে।
- না না রাগ হবে কেন?
- ছাড় ওর কথা, তুই আমায় খুব ভালবাসিস আমি জানি। আজ সারা দুপুরটা আমরা খুব এঞ্জয় করব কেমন?
সুতীর্থর চোখ দুটোতে কেমন যেন নোংরা নোংরা একটা চাউনি। আমার ভয় করতে লাগল। হ্যাঁ আমি ওকে ভালবাসি, কিন্তু তা বলে শুধু একটা দুপুর এঞ্জয় করতে এসেছি? মানে? হঠাত ও বলল
- আরে ভাল করে বস না, বাবার ঘরে হুইস্কি আছে, টেস্ট করবি? কিরে? কিরে কি হয়েছে?
সুতীর্থ এগিয়ে আসছে আমার দিকে, খালি গা, আমার কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠল, বমি পাচ্ছে, এক ঝটকায় ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
- আমি আজ আসিরে সুতীর্থ, সরি আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে
- কেন কি হল? এই তো চিঠি লিখলি
- না মানে…ভুল করে লিখেছি, আমি আসি বুঝলি
সুতীর্থকে কিচ্ছু বলতে না দিয়ে বেরিয়ে এলাম। হনহন করে এগোচ্ছিলাম, একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি, মা আর রিকুদাদা দাঁড়িয়ে। আমার পা দুটো মাটির সাথে আটকে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ।
মার দুচোখে আগুন জ্বলছে,“বাড়ি চল”, মার এমন গলা কক্ষনও শুনিনি আগে।
কে একটা আলতো করে কাঁধে হাত দিল, কে? বলে চমকে উঠেছি
আমার ছেলে ফোকলা দাঁতে হেসে উঠল,“এমা ভয় পেয়েছে, বাবা বলল তুমি চানে যাবেনা? কখন রেডি হবে?”
কলেজ লাইফের শাড়িটাই পরলাম, মাটির গয়নাগুলও,আরও একটা দুটো ডায়েরি ঘাঁটলে এই শাড়ি-গয়নার কাহিনীগুলো খুঁজে পাব। কি বোকা ছিলাম না? কি ভীষন বোকা।
অথচ আজ এইসব দিনে ফিরে যেতে কি ভীষণ ইচ্ছে করে, কই এত অবিশ্বাস, এত আশাভঙ্গের গল্পের পরেও, রাস্তা-ঘাটে, পুরোন পাড়ায়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে, এইসব পুরনো মুখের খোঁজ করে যাই। কই রাগ হয় না তো, বরং মণি-মুক্তোর মত এইসব মুহুর্তগুল ঝরে পড়ে, খুব খুব হাসি, প্রাণ খুলে।
গাড়িতে বসে আবার এফ.এমটা চালিয়ে দিলাম, গান হচ্ছে
‘হঠাত রাস্তায় অফিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে
বন্ধু কি খবর বল?
কতদিন দেখা হয়নি’।