ইশকিয়া

সোমা ঘোষ (চক্রবর্তী)

ইটালির কথা ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভাবছি। ঐতিহাসিক শহর রোমের বর্ণনা দিয়ে নাকি রোমান্টিক বর্ণালী জল-শহর ভেনিসের গন্ডোলা রাইডের অভিজ্ঞতা দিয়ে। নাকি রেস্তোঁরার সেই মিষ্টি হাসির মেয়ে অ্যান-এর আখ্যান শোনাব, যে রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে আলাপ করে অতি যত্ন সহকারে নিজের রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে বীফ লাজানিয়া খাইয়েছিল। তারপর থেকে দুবেলা আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত অপেক্ষায়, কখন পার করব ওর পথ? সেই যে গ্রীক গডের মত সুন্দর সুঠাম এবং ততটাই সুন্দর মনের মানুষ ড্রাইভার রোনালদিনো’? তার কথা বলব? যার কাছে ইংরাজি ‘ডিফিকাল্ট’ শব্দের প্রতিশব্দ স্ট্রং? নাকি বলব, দীর্ঘ দেড় হাজার বছর ছাইএর নীচে চাপা পড়ে থাকা তিন হাজার বছরের পুরনো শহর পম্পেই এর মৃত্যু মূহুর্তে থমকে থাকার ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার কথা! ক্যাপ্রি নামের সেই গভীর নীল দ্বীপটা? যার সীমানা জুড়ে অদ্ভুত সাদাটে পাথুরে পাহাড়ের সারি, যার পায়ের কাছে গিয়েই হঠাতকরে সমুদ্রটা আরও স্বচ্ছ আরও অভাবনীয় অবাস্তব সবজে নীল হয়ে উঠল! একেবারে হলিউডি রূপকথা ছায়াছবির সমুদ্রের মত মায়াবীসুন্দর!  আমাদের বোট একের পর এক প্রাকৃতিক আর্ক ফুঁড়ে ফুঁড়ে সবাইকে যেন অন্য গ্রহের এক স্বপ্নজগতে নিয়ে চলেছিল!

ম্যাঞ্চেষ্টার এয়ারপোর্ট আমাদের বাড়ির লাগোয়া বললে অত্যুক্তি হয়না। তবু উড়ানের দুঘন্টা আগে পৌঁছে গেছিলাম। কস্টা’য় কফিসহ ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে যথাসময়ে প্লেনে চাপলাম দুই পুত্র এবং বরকে বগলদাবা করে।

আমাদের সেদিনের যাত্রার অন্তিম গন্তব্য ছিল নেপলস। দক্ষিণ ইটালির ছোট্ট একটা শহর। জেনেছিলাম নেপেলস শহর রোম থেকে তীব্রগতি (৩০০কিমি/ঘন্টা) ট্রেনে মাত্র দেড় ঘন্টার পথ। এই শহর কে কেন্দ্র করে আমরা বাকি শহরগুল ঘুরব এমনি প্ল্যান। পাঁচদিন পর নেপলস ছেড়ে শেষ দুটো দিন ভেনিসে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। আমরা ইন্টাররেল পাস কিনে নিয়েছিলাম দ্রুতগতিতে ইটালির শহরগুলয় যাতায়াতের জন্যে। ইন্টাররেল পাস যথেষ্ট দামি হলেও অনেকগুলো শহর কভার করতে গেলে আলাদা করে টিকিট কেনা অনেক বেশী খরচসাপেক্ষ হয়ে যায়, তাই আখেরে সাশ্রয়। যাইহোক,আমাদের মনে হয়েছিল আমরা বিকেল ৪ টের দিকে হোটেল ঢুকে যেতে পারলে পাঁচটার দিকে পম্পেই রওনা দেব। তাহলে পরদিন এ্যামালফি কোস্ট, সরেন্টো, পোসিটানিও এই কোস্টাল পয়েন্টগুল দেখা যাবে। কিন্তু বিধি বাম। আজ সেই গপ্পটাই নাহয় করা যাক।

প্লেনে উইন্ডোসাইড সীটটা ছোটোজন দখল করল,কারণ এই আড়াই ঘন্টার যাত্রাপথে সিনেমার ব্যাবস্থা নেই। ওর সাথে কিছুটা বায়নাক্কা করে যখন দেখলাম লাভ হলনা উপরন্তু লোকজন কিঞ্চিত বিস্মিত দৃষ্টি দিচ্ছে এই আধ-দামড়া মহিলার হাব ভাব দেখে,অগত্যা মাঝের সীটে বসলাম। বেশ রোদ ঝলমলে আকাশে ফুরফুরে মুডে চলেছি,পার হয়েছে ঘন্টা দেড়েক,এমন সময় পাইলট এনাউন্স করল- ‘আমরা এখন আল্পসের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পরে ডান দিকে মাউন্ট ব্ল্যাঙ্ক (মঁ ব্লঁ,আল্পস এর উচ্চতম শৃঙ্গ) দেখা যাবে। পারলে তখন ছেলেকে মেরে ধরেই সরাই। তবু লোকসমক্ষে,‘বেবি, প্লীজ সুইচ আওয়ার সীটস’। বিশ্বওঁচা বেবি বললে,‘নো আই উইল সী দ মাউন্টেইন’। দাঁত কিড়মিড়ানি চেপে মুখে হাসি বজায় রেখেই বললাম,‘বাট আই হ্যাভ টু টেক সাম পিকচার্স ফর ইওর ‘শো এন্ড টেল’এট স্কুল,বেবি!’তার উত্তর,‘মা, হু টেইক ইওর পিকচারস  অফটেন, হুহ? গিভ মি দা ক্যামেরা।‘জনান্তিকে বলে রাখি,আমার ফোটোশুট এর একমাত্র সহায় সম্বল এই ছোটো পুত্র। বড় পুত্র বা বরকে একটার বেশী দুটো ছবি তুলতে বললে,পারে তো দা কাটারি নিয়ে তেড়ে আসে। অগত্যা চেপে বসে গেলাম মুখ ব্যাজার করে।

কিন্তু ছেলে যখন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে বল্ল, ‘মা, লুক আউটসাইড’… আমি তার গায়ের ওপর দিয়েই হুমড়ি খেয়ে জানলার দিকে চেয়ে দেখি-  যতদুর চোখ যায় তুষার ঢাকা শৃঙ্গের সারি।  জানিনা প্লেনের উচ্চতা ৪০০০ ফুট থেকে কিছু নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল কিনা, কিন্তু তুষারাবৃত চড়াই আর ঘন আঁধার উতরাই ঢেউএর বিস্তার নিয়ে ভারি স্পষ্ট ভাবে পাহারগুল ঝিমঝিমে নীল আকাশের গায়ে মিলিয়ে যাচ্ছে,দেখছিলাম। অন্তত বিশ পঁচিশ মিনিট জানালায় ওই উৎকট ভঙ্গিমায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বড় ছেলে পেছনের জানলা থেকে বেশ অস্বস্তিমাখা স্বরে বলল,‘এবার তো বস।‘তখনও কালো পাহাড়ের পেছনে রূপোলী পাহাড়েরা সরে সরে যাচ্ছে অতি ধীরে। আশাতিরিক্ত প্রাপ্তিতে মন ভরপুর হয়ে গেল!

বাক্সপ্যাঁট্রা পেয়ে যাবার পর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে রোম এয়ারপোর্ট ছাড়তে ছাড়তে বেজে গেল আড়াইটে প্রায়। রোমা টার্মিনি,রোমের মেইন রেলওয়ে স্টেশনে এসে ইন্টাররেল পাস কেনার পালা। ভেবেছিলাম সে কাজ হবে- ‘টাকা দাও আর হাতে নাও’টাইপ। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম,দেশের ন্যাশলাইজড ব্যাঙ্কগুলোর মত হাতে ধরিয়ে দিল নাম্বার লেখা একটা স্লিপ। যেখানে কিউতে ত্রিশ জনের পরে ডাক। আর এক একজনের মিনিট দশেক করে সময় লাগছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম,ওদিন পম্পেই দেখার প্ল্যান তো মায়ের ভোগে গেল! যাকগে যাক, নেপলস শহরটাই ঘুরে দেখা যাবে। তবে হোটেলে পৌঁছতে হবে সাতটার মধ্যে। থুড়ি হোটেল নয়,রিসর্ট। যেখানে সন্ধ্যে সাতটার পর রিসেপশন বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের চাবি দেবার আর কেউ থাকবেনা দেরী হলে।

তা যাইহোক,টিকিট কিনেটিনে ট্রেনে চেপে বসে তো দিল একেবারে ঝিঙ্কাচিকা। যেমনি ট্রেনের রংরূপ (একেবারে ফুলটু ঝক্কাস),তেমনি দুপাশের ঘন সবুজ পাহাড় রূপের পসরা নিয়ে তীব্র বেগে পেছনে ছুটে যেতে যেতে কখনও দূরে যাচ্ছে কখনও কাছে সরে আসছে। কোথাও চোখে পড়ছিল সবুজ পাহাড়ের পেছনে বরফ ঢাকা পাহাড়ের ঝিলমিলে রেখা। তার ফাঁকে ফাঁকে আঙুরের অর্চারড অথবা হলুদ ক্ষেত কিংবা জলপাই বাগান কে যেন গুঁজে দিয়ে গেছে।

তাপমাত্রা ১৭/১৯ ডিগ্রীর মধ্যে বলে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা হল ক্লান্তি এসে জুড়ে বসতে অবসর পায়না। ভাবছি সাড়ে ছ’টার মধ্যে নেপেলস পৌঁছে যাব,তাহলে হোটেলে সাতটার মধ্যে অবশ্যই ঢুকে যাব। কারণ বলা হয়েছিল ঘন্টা দেড়েকে রোম পৌঁছোন যাবে হোটেল থেকে। তাই চিন্তা না করে ট্রেন যাত্রাটা আপাতত উপভোগ করা যাক।

সব ভালর শেষ আছে। আমাদের যাত্রাপথের একটা ঘন্টা উবে গেল কোথা দিয়ে। মনে এই আনন্দ নিয়ে নাবলাম যে আগামী চারটে দিন এই পথে যাতায়াত জারি থাকবে।

দেখে মনে হল না নেপেলস ছোটো শহর,বিশাল স্টেশন,স্টেশনস্ত দোকানপাট সব ধোপদুরস্ত- এলাহি ব্যাপার। আবার বাক্সপ্যাঁট্রা বর ছেলেপুলে সমেত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। লাইনে দাঁড়াতে বেশ জলদিই আমাদের টার্ন এল। ড্রাইভারকে দেখানো হল আমাদের আবাসের ঠিকানা। ড্রাইভার বলল ২০ মিনিট ড্রাইভের পর ফেরী। আমরা বললাম,ফেরী চাইনা আমরা পুরো পথটাই ট্যাক্সিতে যাব। উত্তরে ড্রাইভার বললে, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ উইংস!’ উত্তর শুনে আমি আর বর চোখ চাওয়াচাওই করলাম। বলে কি …  ব্যাটারা মোটেই ইংরিজি বোঝেনা ভুল ভাল বকছে। ওকে ফেলে এগিয়ে চল্লাম অন্য ট্যাক্সির উদ্যেশ্যে। সেই ড্রাইভার তুলনামুলক ভাল,কিছুটা ভরসাযোগ্য ইংরিজি বলে। বলল, ‘দ্যাট উদ বি ভেরি স্ত্রং’। আগেই বলেছি এঁর কাছে স্ট্রং মানে ডিফিকাল্ট। পরবর্তীতে আমাদের সারথীর ভুমিকা যথার্থ ভাবে পালন করেছে এই হ্যান্ডসাম ইতালীয় যুবক।

ওর কথাবার্তা শুনে যা বোঝা গেল,এই রিসর্টটি একটি দ্বীপে অবস্থিত। যেখানে হাই স্পীড ফেরীতে পৌঁছতে লাগবে দেড় ঘন্টা। তাও নির্ভর করবে সমুদ্রের আবহাওয়ার ওপর।

এবং লাস্ট ফেরী ছাড়বে ৭টায়,ফেরী ঘাট পৌঁছতে লাগবে ২০ মিনিট। তারপর টিকিট কাটার কিছুটা সময়,শেষ ফেরী পাওয়া প্রায় অসম্ভব। চমক ভাঙ্গার আগেই গাড়িতে বসে লাগাও তাড়া,‘হারি আপ প্লীজ। ফেরী ঘাটে নেমে বর ছুটল টিকিট কিনতে- আমরা লাগেজ নিয়ে ল্যাজে গোবোরে হয়ে অসহায় ভাবে ছুটোছুটি করে বোঝার চেষ্টা করছি গোটা সাতেক জেটির মধ্যে ঠিক কোনটাতে আমাদের ফেরী বাঁধা।

যাইহোক অবশেষে ফেরীতেও বসা হল এবং যথা সময়ে ভেঁপু বাজিয়ে যাত্রাও শুরু হল। লাগেজ টাগেজ রেখে প্রায় ফাঁকা ফেরীতে গুছিয়ে বসলাম। বাইরে তখন দিব্য দিবালোক। মেঘলা আকাশ,সমুদ্র কিছুই আর শিহরণ জাগাচ্ছেনা,এতটাই অবসন্ন বোধ করছি। ইতিমধ্যে ৭টা দশ বেজেছে,তড়িঘড়ি ফোন করা হল রিসর্টে আমাদের বিলম্বের খবর জানাতে। গোটা আষ্টেক কলের পরেও অন্যতরফ নিরুত্তর। ফোন বেজে গেল। সুতরাং রিসর্টে খবর দেওয়া গেলনা।

অজানা নির্জন দ্বীপে,রিসর্ট বন্ধ হয়ে গেলে রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মিলবে কোথায় সেই দুশ্চিন্তায় দিশাহারা লাগছিল। এরমধ্যে লোকজনের সাথে কথা বলে আরও কিছু আশঙ্কাজনক তথ্য পেলাম-  ইশকিয়া নামের রিমোট এই নির্জন দ্বীপে খুব অল্প লোকের বাস। তিন ঘন্টা পর পর নেপেলস থেকে আসা যাওয়ার ফেরী। সুতরাং ওখানে পৌঁছনোর অর্থ বাকী দুনিয়া ভুলে ইশাকিয়ার ইশকেই মজে থাকা।

হিলটন হলিডে টাইমশেয়ার কেনা আমাদের। ওরাই নেপলসে আমাদের হোটেল বুক করেছে। তা যে আদৌ নেপলস এ নয়, একটা নির্জন দ্বীপে সেই তথ্য আমাদের একেবারেই আজানা। উপরন্তু ওদের ইনফর্মেশন অনুযায়ী আমাদের হোটেল থেকে রোমের দূরত্ব মাত্র দেড় ঘন্টা।

তবে? কি হবে আমাদের বাকি প্ল্যানের? এই যে এত টাকা দিয়ে কাটা হল আট দিনের ইন্টার রেল পাস? তার সাথে রোম শহরের বেশ কিছু মিউজিয়াম, কলোসিয়াম ইত্যাদি দেখার জন্যে কেনা হল অমনিয়া পাস? এত এত প্ল্যান সব স-অ-ব জলে গেল? বেড়াতে আসার সবটুকু মজাই কেমন ব্লটিং পেপারে তরলের মত কেউ কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ শুষে নিয়েছে মনে হল।

মন খারাপ নিয়ে চারটে প্রাণী তখন ভাবছি কোনোমনে থাকার একটা ঘর যেন জুটে যায়। কারণ রাতে নেপলস ফেরার কোনও সুযোগ আর নেই। কিন্তু কপালের লিখন আরও খারাপ।

আধ ঘন্টা পার হতেই হঠাত সমুদ্র উঠল ফুঁসে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল সামনের জলরাশি। বোটটা খ্যাপা ষাঁড়ের মত উথাল পাতাল দুলতে লাগল। আমরা মোটেই ডিঙি নৌকো টাইপের ছোট খাটো কিছুতে যাচ্ছিলামনা। দুটো ফ্লোর মিলে তিনশো সীট আছে এতোটাই বড় এই নৌকো। এবং সজ্জায় রীতিমত আধুনিক।

এই উঠে যায় কত্ব উঁচুতে আবার ধপাস করে পড়ে। গোটা শরীরে কি অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত এক দুলুনি, মনে হচ্ছিল পেটের ভেতর থেকে সব পাকিয়ে নিয়ে বের করে আনবে। আমি আর ছোটো ছানা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নিত্য যাত্রীরা অব্দি বেশ শঙ্কিত বোঝা যাচ্ছিল। আর আমি তো ভীতুর ডিম। ভাবলাম,এই ছিল কপালে? এভাবে সলিল সমাধি?

যাইহোক সব ভালোর যেমন শেষ আছে,খারাপেরও আছে। এই ভয়ংকর দুলে দুলে ওঠা-পড়াও এক সময় শেষ হল। আমাদের বোট তীরে এসে ভিড়ল। সেই জেটিতে আমাদের বোটের গুটিকয় যাত্রী ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না। বেড়িয়ে দেখলাম দুসীটের ছোটো ছোটো কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে,যারা যাত্রী নিয়ে ফেরীঘাট বেবাক খালি করে কেবল আমাদের রেখে চলে গেল। আমরা বাদে বাকি যাত্রীরা কুলিয়ে গেল এমনি মাপে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। অনুমান করলাম এই গাড়িদের ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়েছে।

দু একজন ড্রাইভারকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা দেখাতে কিছুই না বলে নিজেদের যাত্রী নিয়ে চলে গেল। একজন ড্রাইভার শুধু বললে,‘আই উইল সেন্ড আ ট্যাক্সি ফর ইউ’। একটু ভাবুন কি অসহায় ভাবে একটা নির্জন দ্বীপে আমরা চারজন। প্রাণে বাঁচলাম বটে কিন্তু চুড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা একটা সেকেন্ড অপেক্ষা করে চলেছি ট্যাক্সির আশায়। অদূরে গোটা তিনেক ঝাঁপ বন্ধকরা দোকান। বৃষ্টি থেমে গেছে বটে,তবে ঠান্ডাটা জমিয়ে পড়েছে। সামার জ্যাকেট আর কাজ করছেনা।

কিন্তু ট্যাক্সি এল অবশেষে। এবং ড্রাইভার ঠিকানা দেখে বলল পাহাড়ি রাস্তায় চল্লিশ মিনিটের পথ। আর তখন কিছুই ভাবছিনা,আমাদের একটা ছাদ চাই শুধু। আরও একটু অপেক্ষা নাহয় করলাম। ছোটোটা ট্যাক্সিতে আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পাকদন্ডী বেয়ে আমরা উঠে যেতে থাকলাম আমাদের হোটেলের দিকে। বিরক্তির সাথে ভাবছি,কারো মাথায় আসে কিকরে এমন জায়গায় হোটেল বানাবার কথা!!

রাস্তাঘাট যদিও একেবারে টিপটপ,যেমন ইউরোপের যেকোনো জায়গায় হয়। বেশ কিছু বাড়িঘর দোকানপাট,পথে লোকজন,ছোট্ট ক্যাফে চোখে পড়তে মনে হল, যাক একেবারে গোবিন্দপুর নয়। ঘর পেলে একটু খাবারও জুটে যেতে পারে। ততক্ষণে খিদেটা চাগাড় দিতে শুরু করেছে।

এতক্ষণে আমরা গল্পের ক্লাইম্যাক্সে এসে পৌঁছেছি।  রিসর্টের সামনে নামলাম। একটা খাড়া ঢালু রাস্তা বেয়ে গাড়িটা দাঁড়াল একটা আধো অন্ধকার হট সুইমিং পুলের পাশে।  রিসেপশন লেখা জায়গায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দরজা লকড। তিনটে খাড়া পায়ে চলার পথ ওপরে উঠে গেছে,সেদিকেই বিল্ডিং মনে হচ্ছে। আলো এত কম যে পুরো জায়গাটাকেই আন্দাজে ধরে নেওয়ার চেষ্টা। এসব দেশে আলো নেভানোর রীতি নেই। বড় বড় দোকান কাঁচের দরজার ভিতরে আলোকিত হয়ে রাত কাটায়। আথচ এই বেয়াক্কেলে রিসর্টের রিসেপশন অন্ধকার।  বর বেচারা ফোনের পর ফোন করছে আর রিং টোন ওই অন্ধকার রিসেপশন থেকে আমাদের কানেই ফিরত আসছে। এ কেমন আধো অন্ধকার ভুতুড়ে এক জায়গায় এসে উঠলাম আমরা! জনমনিষ্যির নামনিশান নেই। ভয়ে শীতে গা ছম ছম করছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যখন গাড়ি ঘোরাচ্ছে ছুটে গিয়ে জানতে চাইলাম,কি করব? সে ইটালিয়ান ভাষায় কিছু একটা বলে চলে গেল। ইচ্ছে করছিলাম ডাক ছেড়ে ভ্যাঁ করে কাঁদি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় একেই বলে! আমরা স্থাণু হয়ে ওখানে আটকে গেছি। পরে কি হবে কিছুই জানিনা। কিছু সময় এভাবে কেটে গেল!

হঠাত শোনা গেল নারী পুরুষের কন্ঠস্বর ওপর থেকে নেমে আসছে। প্রায় ‘ইউরেকা’ বলে বর দৌড়ে গিয়ে পাকরাও করলে কন্ঠস্বরের মালিক মালকিন দের। তিন আমেরিকান বৃদ্ধ বৃদ্ধা রেস্টোরান্টে খেয়ে ফেরত আসছে। বললে, ‘ ম্যানেজার চলে গেছে সাতটায়, নো সার্ভিস আফটার সেভেন, তবে রেস্টোরান্টে স্টাফ আছে হয়তো তোমাদের সাহায্য করতে পারে।’

এই বলে তারা নিজেদের রুমের দিকে চলে গেল। বড়পুত্র সবে  দিকে হাঁটা দিয়েছে রেস্টোর‍্যান্ট- পানে,দেখা গেল ওপর থেকে হুডপরা একজন নেমে আসছে।

যাক,কাজের শেষে এর কাছে চাবি দিয়ে গেছে আমাদের ম্যানেজার। ট্যাক্সির আওয়াজ পেয়ে খবর নিতে এসেছে আমরা এসেছি কিনা।

অবশেষে আমরা রুমে পৌঁছলাম।  তখন রাত প্রায় দশটা। কিছুক্ষণের মধ্যে বড়পুত্র আর বর মিলে গরম গরম অমৃতসমান পিত্জা নিয়ে এল। পিত্জার ডো মাখা থেকে শুরু করে সবটাই ওদের চোখের সামনে। পিত্জা তৈরী হবার ফাঁকে বর এক্সপিডিয়াকে ফোন করে পরদিন থেকে চার রাতের জন্যে নেপেলসে হোটেল বুক করে ফেলল। ইশকিয়া গোল্লায় যাও এমন একটা ভাব।

এরকম ফ্রেশ পিত্জা আগে পরে আর কোনওদিন খাইনি। কি যে সুবাস! ইটালিয়ান রেড ওয়াইন সহযোগে তাকে গলঃধকরণ করে একটা দুধসাদা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম! আঃ শান্তি।

পরদিন ঘুম ভেঙে পর্দা সরিয়ে দেখি অদ্ভুত সুন্দর কালচে সবুজ পাহাড় খুব কাছেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার পায়ের কাছে জলপাই বন। ছুটে ব্যালকনি গেলাম- সদ্য ঘুমভাঙা অপূর্ব শান্ত নীল সমুদ্র নীল আকাশের সাথে আদুরে দুষ্টুমি করার ফাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল,আমায় ছেড়ে চলে যাবি? ভোর সকালের ঢুলু ঢুলু সুন্দর এরকম একটা রিসর্ট কে রাতে এমন ভুতুড়ে লাগছিল কেন কে জানে? রাতে যতক্ষণ না ঘুম এসেছে হিল্টনের তো আয়িসি কি ত্যাইসি করে গেছি স্বামী স্ত্রীতে। আর এখন? ইশকিয়া ছেড়ে যেতেই মন কেমন করছে! এক নজরেই হামলিয়ে ইশক হয়ে গেল ইশকিয়ার সাথে।

৫০টি বছর পার করে খুঁজে পেলাম তারে

দেবাশীষ বসু

  যাকে খুঁজে পেলাম সে শিলং এর লাবানে, পাহাড়ের কোলে ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ী। বাড়ীর একধারে বেশ কিছু সিঁড়ি নেমে, বয়ে যাওয়া জলধারার ওপরে একটা ছোট্ট সাঁকো। সেই সাঁকো পেরিয়ে বড় রাস্তা। আর রাস্তার ওপারে পাহাড়ের ওপর পাইন গাছের সারি। বাড়ীর অন্য ধার দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হরিসভা মন্দিরের পাশ দিয়ে লাবান বাজার যাবার পথ।
এই কথাগুলো আজকের নয়। তখনকার কথা যখন আমার বয়স ছিল ১২ কি ১৩। অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর আগে। আমি পড়তাম দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে, আর আমার বাবা মা থাকতেন শিলং-এর এই সুন্দর বাড়ীটার এক অংশে। সেখানে আমি যেতাম প্রতি বছর গরমের আর শীতের ছুটিতে। এই বাড়ীটার স্মৃতি কেন যে আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল জানিনা। মনে পড়ত পাইন গাছের সারি আর তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলের স্রোতের আওয়াজ। আর ভাবতাম কবে আবার যাবো শিলং-এর বাড়ীতে।
দেওঘরে থাকাকালীন হঠাৎ এক দিন জানতে পারলাম যে বাবা চাকরিসূত্রে শিলং ছেড়ে কোলকাতা চলে যাবেন। তাই স্কুলের ছুটিতে আমার আর শিলং যাওয়া হবে না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বাড়ীর ছবিটা মনে রয়ে গেল স্বপ্নের মত। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল,কিন্তু একবারের জন্যেও আমার আর শিলং যাওয়া হলনা। এত বছর পরেও বাড়ীটা কি এখনও আছে? কে জানে?

অবশেষে শিলং যাবার পরিকল্পনা হল আমাদের। স্ত্রী মন্দিরা, বড়ছেলে শতজিত এবং ওর স্ত্রী মীনাক্ষীকে নিয়ে। যেদিন যাবার পরিকল্পনা হল, সেদিন আমার মনে হল যদি সেই বাড়ীটা আজও অটুট থাকে,আমি সেটা খুঁজে বার করবই আর সেই থেকে মনে একটা উত্তেজনাও সৃষ্টি হল।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, শিলং-এর কাছে বড়াপানি বিমান-বন্দর হয়ে পৌঁছলাম শিলং-এ। শিলং-এ পৌঁছেই বয়সটাকে কমিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম ১৯৬৬/৬৭ সালে। চোখটা বন্ধ করতে মনে হল, ছোট ছেলেটা সিঁড়ি ভেঙ্গে ওই সুন্দর বাড়ীটার দিকে যাচ্ছে। তাই চোখ খুলে ঠিক করে ফেললাম আগামীকাল শিলং-এ বেড়াতে বেড়িয়ে প্রথম কাজ হবে ওই বাড়ীটা খুঁজে বার করা।

হরিসভা মন্দির

পরদিন হোটেল থেকে রওনা হয়ে গাড়ীর ড্রাইভারকে বললাম আমাদের লাবানে নিয়ে যেতে। লাবানের কোথায় যাব জানতে চাইলে বললাম হরিসভা মন্দিরের কাছে। ড্রাইভার এই মন্দিরের নাম শোনেনি। লাবানের একটা জমজমাট রাস্তার কাছে নিয়ে গাড়ী দাঁড় করাল। আমরা গাড়ী থেকে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম হরিসভা মন্দির। এক দোকানের মালিক আমার প্রশ্ন শুনে হরিসভা মন্দির যাবার হাঁটা পথ দেখিয়ে দিল। আমরা সেই রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম হরিসভার মন্দির।

 

ভীষণ ভাল লাগল মন্দিরের সামনে দাড়িয়ে। যদিও মন্দিরের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত হলাম যে এটাই সেই মন্দির যেটা আমি শেষবার দেখেছি ৫০ বছর আগে। এবার বাড়ী খুঁজে

বার করার পালা। মন্দিরের ভেতরে কয়েকজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। বাড়ীর যিনি মালিক তাঁর নাম করে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীটার হদিস দিতে পারেন কিনা। বাড়ীটার বর্ণনা দিলাম। বাড়ীতে পৌঁছতে যে সিঁড়ি ভাঙতেই হয় তাও বললাম। কিন্তু কেউই সঠিক হদিস দিতে পারলেন না। আমি এই বাড়ীতে ৫০ বছর আগে থেকেছি শুনে একজন ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি বাড়ীটা কেন খুঁজছি। সঠিক উত্তর দিতে পারলাম না। ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে মন্দিরের সামনের রাস্তায় চলে এলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। পাব কি খুঁজে সেই বাড়ী?

সিঁড়ি ভেঙ্গে নামলে বাড়ীসিঁড়ি ভেঙ্গে উঠলে বাড়ী

মন্দিরের মুখোমুখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখটা বন্ধ করে একমনে ভাববার চেষ্টা করলাম সেই রাস্তাটা যেটা ধরে ৫০ বছর আগে ছোট ছেলেটা অনায়াসে মন্দির থেকে বাড়ী পৌঁছে যেত। হঠাৎ মনে পড়ল বাড়ী থেকে মন্দিরের পাশ দিয়ে গেলে মন্দিরটা হাতের বাঁ দিকে পড়ত। তাহলে কি আমরা ঠিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আর আমাদের যেতে হবে বাঁ দিকে? চলতে শুরু করলাম আর মনে হতে লাগল সরু পাহাড়ী রাস্তাগুলো ভীষণ চেনা লাগছে। আরও মনে হল যেন আমরা আর বাড়ী থেকে বেশি দূরে নেই।

ঠিক এই সময় রাস্তার পাশের বাড়ীতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম সেই একই কথা যা করেছিলাম মন্দিরের ভদ্রলোকদের।

ভদ্রলোক কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। নামটা শুনে বললেন যে তিনি আমার বাবাকে মনে করতে পেরেছেন। ভীষণ আবাক লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীটা কি এখনও আছে? উনি আমাকে আর একটু কাছে ডেকে নিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে আঙুল দেখিয়ে বললেন “দেখতে পাচ্ছেন ওই সিঁড়িগুলো? সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেই ওই বাড়ীতে পৌছে যাবেন”। হেঁটে গিয়ে দাড়ালাম সিঁড়িগুলোর সামনে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে খুঁজে পেলাম বাড়ীটাকে। মনে

একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। বাড়ীটা ঠিক সেই রকমই আছে যেমনটা ছিল আমার স্মৃতিতে। এমনটা যে দেখব সত্যি ভাবিনি। বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মনে পড়তে লাগল সেই ছোটবেলার দিনগুলো। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে কত যে আনন্দ হয়…..

 

মন্দিরা পাশে দাড়িয়ে বোধহয় আমার মনের অস্থিরতার আঁচ পেয়েছিল, বলল “যাবেনা বাড়ীটাতে”?

শুকতারা পড়ার জায়গা

বেল বাজাতে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, তাকে একটু অস্বস্তির সঙ্গে বললাম “এই বাড়ীতে অনেক বছর আগে আমরা ভাড়া থাকতাম। অনেক স্মৃতি আছে এই বাড়ীটাকে ঘিরে, তাই বাড়ীটা আবার দেখতে এসেছি”। ভারী অবাক হলেন তিনি। ভেতরে আসতে বললেন। অনেক কথা হল। বুঝলাম উনি

সেই পরিবারেরই লোক। তথনকার দিনে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে দাদু ,দিদা আর নেই।আর যারা আমার পরিচিত ছিলেন তারা কেউ আর এই বাড়ীতে থাকেন না। বাড়ীর ভিতরটা ঘুরে দেখলাম। যে দিকটায় আমরা থাকতাম সেই দিকটাতেও গেলাম। হুবহু একই রকম আছে। দেখতে দেখতে ঘরের সামনের উঠোনে এসে দাড়ালাম। এই উঠোনে পিঠে রোদ লাগিয়ে বসে শীতকালে শুকতারা পড়তাম। সেখানে আমার একটা ছবি তুলতে বললাম মন্দিরাকে।

প্রায় কিছুই বদলায়নি এই বাড়ীটাতে ৫০ বছরে। এত মনে পড়ছিল ছোটবেলাটা যে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম যে আমি আজ চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে। সার্থক হল এই বাড়ীটা খুঁজে বার করার চেষ্টা।

বাড়ীর বাইরে এসে দেখলাম বাড়ীর চারপাশে আর কিছুই আগের মত নেই। নেই সেই পাইন গাছের সারি, না আছে বয়ে যাওয়া জলের ধারা। আছে উঁচু উঁচু বাড়ী, দোকান আর মানুষ এবং গাড়ীঘোড়ার ভীড়।

ফেরার সময়ে মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল, কারণ বাড়ীটা ঠিক সেইরকমই সুন্দর আছে আর

একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় বুঝতে পেরেছিল একদিন আমি ওকে খুঁজতে আসব আর আমাকে

দেখে ওরও নিশ্চয়ই খুব ভাল লেগেছে যে ছেলেটা এর মধ্যে কত বড় হয়ে গেছে।

 

হারিয়ে গেছে ছোট্ট ঝরণাখানি

হারিয়ে গেছে পাইন গাছের সারি

তবুও স্মৃতি জড়িয়ে নিয়ে গায়ে

জেগে আছে আমার বসতবাড়ি

এই সেই বাড়ী

স্বপ্ন

সোমালী সরকার

বিনিদ্র মধ্যরাত্রি অদ্ভুৎ এক

বোধের জন্ম দেয়।

শব্দের জলতরঙ্গে রাগরাগিনীর অভ্যুদয়।

কাল্পনিক মায়াজালে স্বপ্নপুরী

মোহময়ী মূর্তিতে দেয় ধরা।

যেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব অবান্তর,

নেই বাস্তবের হিংসা-দ্বেষ,মান-অভিমানের পালা

মুগ্ধ হয়ে জীবনটাকে দেখা।

নিদ্রা এসে দুয়ারে কড়া নাড়ে-

ক্লান্ত হয়ে ঘুমের পরশ মাখো,

সূর্যোদয়ে নতুন প্রভাত স্বাগত।

অন্য শহীদ

শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী

এই পিংলাশ গাঁ খানাকে নিয়ে ভারী গর্ব আছে হরিশচন্দ্র খাঁনের। অবশ্য সেটা যে ঠিক গর্ব – তা হরিশ খাঁও ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না। তবে যখনই কোন কাজে এক-দু’দিনের জন্য হলেও গাঁয়ের বাইরে যেতে হয়, গাঁয়ে ফেরার জন্য প্রাণটা কেমন আঁকুপাকু করে। গ্রামটির বহিরঙ্গে তেমন কোন ফারাক কিন্তু চোখে পড়ে না – হয়তো তা আছে মুগ্ধ মনের কল্পনায়। গ্রামখানি আশেপাশের অন্য পাঁচটা গ্রামেরই কার্বন কপি যেন। যে সময়ের কথা লিখছি – তখনও বাজারে জেরক্স মেশিন আসে নি, নাহলে জেরক্স কপি বলা যেত হয়তো।

গ্রামের শেষ প্রান্তে হরিশ খাঁর বাড়ি। বাজার ডাঙা অথবা পাকা রাস্তাকে রেফারেন্স পয়েন্ট ধরলে গ্রামের শুরুও বলা যায়, কিন্তু এমনটাই ভেবে এসেছি চিরকাল। শুরু বামুনপাড়া দিয়ে, যা পাশের গ্রাম আগরাপাড়ার সীমানা শেষ হলেই। তারপর হাজরা-ঘোষ-পান-দলুই-বাগদি পাড়া পার হয়ে এলেই হরিশ খাঁর বাড়ি। দু কামরার একতলা মাটির বাড়ী। খড়ের চাল। একটু দূরে রান্নাঘর। কামরা দু’টোর সামনে একফালি দুয়ার, তিনটে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। সামনে গাছগাছালি ঘেরা উঠোন। একপাশে একটি ছোটো ডোবা – সারা বছরের মাছের বন্দোবস্ত হয়ে যায়। ডোবার চারপাশে কলাগাছ। একটু দূরে রাস্তার মোড়ে একটি টিউবওয়েল, হ্যান্ডপাম্পের দরকার হয় না, সবসময় জলের ধারা বইতে থাকে, আর্টেসিয়ান ওয়েল। ছোটবেলায় জানা ছিল এসব হরিশ খাঁর পোষা দুই ভুতের কীর্তিকলাপ। সেই কলের জল কাঁচা নালা দিয়ে বয়ে হরিশ খাঁর ডোবায় জমা হয়, ফলে তার ডোবা কখনো শুকোয় না। এই কলের জলেই গাঁয়ের অর্ধেক লোকের পানীয় জলের সংস্থান হয়। আর একটা টিউবওয়েল আছে, চৌধুরীপাড়ার দিকে। স্নানাদি ডোবা অথবা পুকুরের জলে, রান্নাবান্নাও পুকুরের জলে। অন্যান্য প্রাকৃতিক কাজকর্ম উদার আকাশের নীচে, শিব্রাম চক্রবর্তীর ভাষায় বলতে গেলে ‘উন্মুক্ত প্রকৃতির নীচে নিজেকে বিমুক্ত করার রেওয়াজ আছে’।

বউ (মাগ অথবা পরিবার ও বলা চলে), দুই মেয়ে ও তাদের পরিবার, একটি গাই ও বাছুর, একটি পোষা শালিক পাখি, কয়েকটি ছাগল, বিঘে তিনেক জমি, দুটি পোষা ভুত (তর্কসাপেক্ষ), শিবমন্দিরের চাতালে তরজা গান, বামুনদের ছোট-বাখুলে আকাশবাণী, পিংলাশ গাঁ তার সমগ্রতাসহ – এসব নিয়েই হরিশ খাঁর ছোট অথচ সম্পূর্ণ পৃথিবী।

সেদিন ভোর থেকেই বাগদি পাড়ায় উচ্চৈঃস্বরে ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে। ঝগড়ার কারণ গুরুতর কিছু নয়। একজনের ছাগল অন্যজনের শাকের ক্ষেতের কিছুটা অংশ সাফ করে দিয়েছে। এইসব সামান্য কারণেই এখানে তুলকালাম হয়ে যায়…অল্প লইয়া থাকি তাই মোর…ইত্যাদি।

খেঁদি বাগদি শাড়ীটাকে প্রায় হাঁটু অবধি তুলে, কখনো তিন পা এগোচ্ছে, কখনো দু’ পা পিছোচ্ছে। হাতের মুদ্রায়, মাথা ঝাঁকানোয়, রুক্ষ চুলের উড়ানে সমস্ত শরীর যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বাখান পাড়া (খিস্তি)।

  • নিজের ছাগল নিজে সামলে রাখতে পারু নি হারামজাদি? আমার শাগ খেয়ে গেল। ইবার তোর কুন ভাতার এসে আমাকে খাওয়াবে শুনি? আগে দেখতে পেলে খুঁয়াড়ে দিয়ে আসতম। দু’টাকা দিয়ে ছাড়াতে হলে, ঠ্যালা বুঝতিস।
  • শুদুমুদু গাল পেড়োনিগো খেঁদিদ্দি, ভাল হবে নি বলে দিচ্চি। তুমি কি দেকেচো আমার ছাগলই তোমার শাগ খেয়েচে?গাঁয়ে কি ছাগলের অভাব আচে?
  • ক্যানে মিছা কতা কইচু? উটা তোর ছাগলেরই কাজ। অমন ঝেঁটিয়ে খেতে আর কুনু ছাগল পারবেনি, যেমন তুই তেমন তোর ছাগল। সব সময় নোলা ঝরছে। আমি দেখতে পেলে তো এতখন তোর ছাগল খুঁয়াড়েই থাকত। হারুর মা তো দেখেচে। সে কি মিছা কতা কইবে?
  • অ্যাকেই বলে শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। হারুর মার কতা আর বোলো নি। ক্যানে শুদুমুদু আমার মুক খুলাচ্চো?

খেঁদি বাগদি কোনকালেই যুক্তি-তক্কের ধার ধারে না। এবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘ওলো মাগী, বারোভাতারি, তুই উকিলি ফলাচ্চু আমার সঙ্গে? আমি বলেচি যখন তোর ছাগলেই খেয়েচে, তখন তোর ছাগলেই খেয়েচে’।

ভাতার সংক্রান্ত বিশেষণটি ধনার মার মর্মে প্রবেশ করল। ফলতঃ ঝগড়ার অভিমুখ সহসা ছাগল ও শাকের ক্ষেত থেকে ঘুরে গিয়ে ভাতারে পড়ল।ধনার মা বলল, ‘তুমি মুক লাড়চ কুন মুকে, ভাতারখাগি? তমার মুকের জ্বালায় তো ভাতারটা মরল। মুকে তো ভাল কথা কুনুদিন শুনিনি একটা’।

হরিশ খাঁ বাগদি পাড়া ছেড়ে এগিয়ে বামুনপাড়ার পথ ধরল। সকাল সকাল এই ঝগড়াঝাঁটি, চিল্লামিল্লি, হরিশ খাঁর একেবারেই ভাল লাগে না। নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় মানুষ চিরকালের – এইসব গোলযোগ থেকে শতহস্ত দূরে থেকে এসেছে সবসময়। জগতে কত কী জানার আছে – রেডিও তে বলে সব – প্রভাতী, সঙ্গীতাঞ্জলি, খবর, সমীক্ষা, অনুরোধের আসর, চাষবাসের খবর, তরজা গান। তা নয় – সকাল থেকে ছাগল, শাগের ক্ষেত, ভাতার নিয়ে ক্যাচাল।

ঝগড়ার আওয়াজ তখনও ভেসে আসছে।

  • ওলাউঠা হবে তোর, হেগে মুতে পড়ে থাকবি। মুকে জল দেওয়ার জন্যিও একটা লোক থাকবে নি।
  • তমার কুঠা হবে। মুকে পকা পড়বে। ওই যে অত হাত লেড়ে লেড়ে ঝগড়া করচ, ওই হাত তমার খসে যাবে। মা বাজারচন্ডীর কিরা আমি শুদুমুদু তমার সঙ্গে ঝগড়া করি নি। আমার ছাগলের কুনু দোষ নাই।

ঝগড়া যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎত শেষ হয়ে যায় – পারস্পরিক অভিসম্পাতে, অকাল্যাণ-কামনায়।

বামুনপাড়ায় তিন ঘর বামুন। ছোটবাখুল অর্থাৎ ছোট তরফের বামুনবাড়িতে হরিশ খাঁর নিত্য যাতায়াত, সকাল-সন্ধ্যে দু’বেলা। বাড়ির কর্তামশাই, এই অঞ্চলের নামকরা পণ্ডিত। আশপাশের বিশটা গ্রাম থেকে পণ্ডিতমশাই এর ডাক আসে – পুজো, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন ও অন্য নানাবিধ বৈদিক ক্রিয়াকর্মের জন্য। হরিশ খাঁ শুনেছে – পণ্ডিতমশাই এর নাম পি এম বাগচি পাঁজির পণ্ডিতদের লিস্টিতে আছে – শ্রী লক্ষ্মীনারায়াণ কাব্যতীর্থ। নিজের চোখে দেখেছে, মানুষটাকে সবাই কেমন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। অগুন্তি শিষ্য-সামন্ত, ভক্ত ছড়িয়ে আছে দূরদূরান্তরে। বাড়ির পুজো-পার্বণে তো বটেই, যে কোন সময়ে ভক্তবৃন্দের আনাগোনা লেগেই আছে বাড়িতে। সবার জন্য অবারিত দ্বার, আর আছে গুরুমার হাতের রান্না – অমৃতসমান।

শুধু যে তিনি ঝাঁকরা হাইস্কুলের সংস্কৃত হেডপণ্ডিত তাই নন, ছাত্রছাত্রীদের ব্রতচারী শেখান, ছেলেদের ফুটবল খেলায় রেফারি। বাংলা ভাষাতেও অসামান্য জ্ঞান। বাংলার স্যারেরা কোন সমস্যায় পড়লে পণ্ডিতমশাই এর কাছ থেকেই বুঝে নেন। কথায় কথায় বেদ, পুরাণ, সংস্কৃত স্তোত্র-মন্ত্রের ব্যাখ্যা, গল্পের আকারে বিশ্লেষণ – হরিশ খাঁ হাঁ হয়ে শোনে সব। ভারি ভালো লাগে পণ্ডিতমশাই এর কাছাকাছি থাকতে। কত কি জানা যায়!

  • ‘বড় লাতনিটা ভালো আছে তো?’ জিজ্ঞেস করল বামুন-মা।
  • ‘না, খুব একটা ভালো নাই। জ্বরটা এখনো নামে নি। কাশিও আছে’। হরিশ খাঁ জানায় বিরস মুখে।
  • ডাক্তার দেখালে, না তোমার কবিরাজিই চলছে?
  • কবরাজিই চলছিল, কিন্তু মাগ বলল অ্যালাপাথি করাতে। বড় মেইছ্যানাটাও দেখলম মায়ের দলে। কবরাজি করে কি আমি কম অসুক-বিসুক সারিয়েচি? এরা কি বুঝবে তুলসী পাতা, বাকস পাতা (বাসক), থানকুনি পাতার মর্ম? বড় বড় গরুর সান্নিপাতিক পর্যন্ত ঠিক করে ফেললম, আর সামান্য জ্বর!
  • কোন ডাক্তার দেখালে?
  • কাল হাটবারে ঝাঁকরা গেছলম, দেখালম মদন ডাক্তারকে। তিনদিনের মিকচার দিয়েচে। বলেচে ঠিক হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ বসতে হল কাল। হাটবারের ভিড় মদন ডাক্তারের চেম্বারে।

মদন ডাক্তার সাক্ষাৎ ভগবান এই অঞ্চলের মানুষের কাছে। ছেলে, বুড়ো, মহিলা সবার জন্যই তার কাছে পাওয়া যায় এক অপার্থিব মিক্সচার। কাচের বোতলের গায়ে, কাগজ কেটে লেবেল সাঁটা থাকে, প্রতিদিনের ডোজ বোঝানোর জন্য। কত যে জটিল, দুরারোগ্য রোগ ঠিক করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। জীবনের ঋণ রয়ে যায় এই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সাদামাটা মানুষটির অন্তরের বৈভবের কাছে!

হরিশ খাঁ বলেই চলল, ‘তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার নম্বর এল। একেবারে ঝেঁটিয়ে লোক এসেচে গো পিংলাশ, খলকপুর, আগরাপাড়া, সাতডুবি, কুঁয়াপুর, ভগীরথপুর, রাজগঞ্জ, ধান্যগাছি সব জায়গা থেকে। মানুষের রোগ জ্বালার আর শেষ নাই। সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটখারাপ, মাথাধরা, বুক আটুবাটু, বুক ঢিপঢিপ সব লেগেই আছে’।

ইতিমধ্যে গোবিন্দ মণ্ডল, জলধর হাজরা, প্রফুল্ল ঘোষ এবং আরও কয়েকজন প্রতিবেশী হাজির হয়েছে। কাপে কাপে চা এসে গেল। আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান চলছে। চলছে কিছু বৈষয়িক কথাবার্তাও। চাষের সময় অনুযায়ী সেই সব কথাবার্তাও বদলে যায়। ধানের দর, কোন জমিতে বাত হল, মাজরা পোকা, ধান রোয়া, বীজতলা, কার ঘরে হল বকনা বাছুর, চন্দ্রমুখী না জ্যোতি আলু, ঘনরামপুরে এবার শীতকালে কোন যাত্রা পার্টি আসবে – আলোচনা গড়িয়ে চলে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে।

জলধর হাজরা বলল, ‘হরিশদা, ইবারে একদিন ঘপসা দিগর এর ছোট মেয়াটার দেখাশুনা ফাইলেন করতে হবে। ঘপসা দিগর অনেক দিন ধরেই বলচে’।

বিয়ের সম্বন্ধ ফাইন্যাল করায় বিস্তর অভিজ্ঞতা হরিশ খাঁ ও জলধর হাজরার। হরিশ খাঁ জিজ্ঞেস করল, ‘কুন সম্বন্ধটা, সেই বালা গাঁয়ের?’

  • না গো সেই বালার সম্বন্ধটা কেটে গেচে, ইটা এসচে গড়াল থিকে। ছ্যানাটি ভাল, নিজেদের জমি-জায়গা আচে।
  • টাকাপয়সার খাঁই কি রকম?
  • লগদ কুড়ি হাজার, সাইকেল, রেডিও, সোনার চেন আর টিটম ঘড়ি খুঁজচে।
  • টিটম ঘড়ি টা আবার কি জিনিস? আমরা তো চিরকাল এইচ এম টি ঘড়িই শুনে এসেচি।
  • আজকালের ছ্যানা-ছোকরাদের ব্যপার সব – এখন ওই লতুন টিটম ঘড়ি বাজারে এসেচে বলচে, টাটা কুম্পানির।
  • ই তো ভালই চাহিদা দেকচি, ঘপসা দিগর কি অত দিতে থুতে পারবে? বড়জোর হাজার পাঁচেক টাকা আর রেডিওটা। রেডিওটা ঘরে একটা থাকা ভাল, অনেক কিছু জানতে পারবে। সাইকেল লিয়ে করবেটা কি?
  • হরিশদা, রেডিওটা দরাদরি করে শেষ পর্যন্ত না দিলেও চলবে, অত কারো জানার ইচ্ছা নাই, কিন্তু সাইকেল তো দিতেই হবে। আজকাল হাটে, মেলায় দেখোনি, সামনের রডে লতুন বউকে বসিয়ে সব ফাঁট মেরে ঘুরচে।
  • তাহলে হাট বার ছাড়া অন্য কুনু দিন দেখে বল, একবারে ফাইলেন করে আসতে হবে।

রবিবার ও বৃহস্পতিবার হাট বসে ঝাঁকরায় নতুন দিঘির পাড়ে। তাই সপ্তাহের ওই দুটি দিন হাটবার নামেই পরিচিত হয়ে গেছে। যেন হাট ছাড়া অন্য কোন নিজস্বতা অথবা গুরুত্ব নেই ওই দুই বারের – যেমন হয়ে যায় ধনার মা, গনার মায়েরা।

হাটবারে হরিশ খাঁ কে হাটে যেতে হয় চাষের আনাজপাতি বিক্রি করতে, ফিরতে ফিরতে বিকেল। তাই হাটবার ছাড়া অন্য দিন – ঘপসা দিগর এর ছোট মেয়াটার সম্বন্ধ ফাইলেন করার জন্য।

সেদিন পণ্ডিতমশাই বলছিলেন দধীচি মুনির গল্প।বৃত্রাসুর নামের অসুর দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাস্ত করে স্বর্গের দখল নিলেন। জগতের সব জল শোষণ করে বৃত্রাসুর নিজের অসুর সেনার কাজে লাগালেন এবং জগতবাসীকে টাইট দিতে লাগলেন। গাঁয়ের কারুর জল, নাপিত বন্ধ করলে কি হয়, তা হরিশ খাঁর ভালই জানা আছে। ইন্দ্র ঠ্যালায় পড়ে শরণাপন্ন হলেন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর। বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন একমাত্র দধীচি মুনির বজ্রসম হাড় থেকে প্রস্তুত অস্ত্রের সাহায্যেই বিনাশ সম্ভব বৃত্রাসুরের। তখন ইন্দ্র ও অন্য দেবগণ দধীচি মুনির কাছে পৌঁছলেন এই অদ্ভুত আব্দার নিয়ে – আপনি মরুন স্যার, আমরা বাঁচি। আরও আশ্চর্য ব্যপার ইন্দ্রদেব এই দধীচি মুনিরই মস্তক ছেদন করেছিলেন একবার, নিজের গদি হারানোর ভয়ে। সে যাত্রা অশ্বিনীকুমারদ্বয় বাঁচিয়েছিলেন দধীচি মুনি কে।যাই হোক, মহৎ প্রাণ তো থাকে সব জায়গায়, সব যুগে। দধীচি মুনি সম্মত হলেন, জগতের কল্যাণে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে। তিনি জানালেন তাঁর অন্তিম ইচ্ছার কথা – তিনি তীর্থভ্রমণে যেতে যান, দেখতে চান জগতের সমস্ত পুণ্যসলিলা স্রোতস্বিনীকে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্যবস্থা করে দিলেন –  সমস্ত নদীকে নৈমিষারণ্যে এনে ফেললেন, যাতে তীর্থভ্রমণে অযথা টাই্ম পাস না করে, কাজের কাজটা তাড়াতাড়ি করা যায়। তখন নদী দর্শন সমাপ্ত করে মহামুনি বসলেন গভীর ধ্যানে, মুক্ত করলেন প্রাণের বন্ধন। অতঃপর কামধেনু গাভীর বৎস লেহন করতে লাগল মহামুনি দধীচির শরীর। ধীরে ধীরে প্রকট হোল অস্থিসমূহ। সেই অস্থি দিয়ে প্রস্তুত অস্ত্রের সাহায্যেই ইন্দ্রদেব পরাস্ত করলেন বৃত্রাসুরকে, ফিরে পেলেন স্বর্গরাজ্য। তারপর থেকেই এ ধরায় খ্যাত দধীচির ত্যাগ।

পণ্ডিতমশাই আরও বললেন, ‘আমাদেরও দেশের সীমানায় দিন-রাত পাহারায় আছে যে সব সেনাবাহিনীর জওয়ান, তারাও নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে, দেশের সেবায় নিযুক্ত। দেশের কাজে অদম্য সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরষ্কার হল পরম বীর চক্র, যাতে খোদাই করা থাকে বজ্র-চিহ্ণ, সেই বজ্র যা দেবরাজ ইন্দ্র প্রস্তুত করেছিলেন দধীচি মুনির অস্থি থেকে’।

পণ্ডিতমশাই মাঝে মাঝে খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। হরিশ খাঁর মনে পড়ল অনেক বছর আগে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর এরকমই একটা পুরষ্কার কিছু মিলিটারিকে দিয়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগ পুরষ্কার পাওয়া সেনাই তো মারা গিয়েছিল যুদ্ধে, তাদের পরিবারের লোকেরা নিয়েছিল পুরষ্কার। রেডিওতে খুব যুদ্ধের কথা শোনা যেত সেইসময়। হরিশ খাঁ ভাবে – এই পিংলাশ গাঁয়েরও তো অনেকে লড়াই করেছে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সঙ্গে। তাদের নাম কি কোথাও লেখা আছে? কত লাশ গায়েব হয়ে গেছে নীলকুঠীর গুম ঘরে কে তার খবর রাখে? পণ্ডিতমশায়ের কাছে শুনেছে এই পিংলাশ নামটা নাকি এসেছে পিঙ্গল দের লাশ থেকে। গাঁয়ের লোকেরাও মেরেছিল অনেক পিঙ্গল চোখের অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের।

নীলকুঠীটা এখন একটা পোড়ো বাড়ি, গোটা কয়েক দেওয়ালই অবশিষ্ট আছে। দরজা, জানালা চুরি হয়ে গেছে কবেই। পুরো জায়গাটা জুড়ে, নানা রকম গাছের ঝোপ। অশথ গাছও আছে দু’-একটা। একটু দূরে এক দিঘি, নাম তার কৃষ্ণসায়র। হয়তো কৃষ্ণসায়র এর জলেই হত নীল চাষ। হয়তো কৃষ্ণসায়র এর জলেই একদা মিশেছে গরীব নীল চাষির রক্ত, অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের রক্ত।

সকালের চা-পর্ব শেষ হয়। সবাইকে যেতে হয় চাষের কাজে। পণ্ডিতমশাইও উঠে পড়েন। ভাল করে সারা গায়ে সরষের তেল মেখে চট করে একটা ডুব দিয়ে আসেন পুকুরের জলে। তারপর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকেন – ব্যাকব্রাশ – জীবনের একমাত্র বিলাসিতা। ধুতি পাঞ্জাবি পরে খেতে বসেন। ঝাঁকরা হাইস্কুল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পিংলাশ থেকে। পঞ্চাশো্দ্ধ্ ঋজু শরীরে, এটুকু রাস্তা তিনি হেঁটেই যাতায়াত করেন – যদিও বাস সার্ভিস চালু হয়েছে কয়েক বছর। কিন্তু পণ্ডিতমশাই কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাকে অপছন্দ করে এসেছেন চিরকাল – তা পথিকৃৎ, চন্দ্রাণী (বাসের নাম) কোন্ ছার।

দেশের পুজোটা খুব জমিয়ে হয় পিংলাশে, বছরে দু’বার – অঘ্রানে আর ফাল্গুনে। বড় শীতলা, ছোট শীতলা, যোগিনী, বাজারচন্ডী, শ্মশানকালী – এই পাঁচ মন্দিরে পুজো হয়। শ্মশানকালীর পুজো অঘ্রানে হয় না, শুধু ফাল্গুনে। ব্যাপ্তি এবং জৌলুসে আশেপাশের আর কোন গ্রাম এর ধারে কাছে আসতে পারে না। এরমধ্যে বড় শীতলা, ছোট শীতলা এবং বাজারচন্ডীর স্থায়ী মন্দির আছে, নিত্যসেবা হয়। সব মন্দিরেই পাঁঠাবলি হয় পুজোর সময়। যোগিনী মায়ের পুজো হয় গাঁয়ের ঈশান কোণে এক কয়েত গাছের তলায় মাটির অস্থায়ী বেদী তৈরি করে। বেদীটি পুজোর দিনই তৈরি করা হয়। বেদীর মাঝে প্রোথিত করা হয় এক কলাগাছ – তিনিই যোগিনী মাতা। চারপাশে চাষের ক্ষেত।কয়েত গাছের স্নিগ্ধ হাওয়া। দূর থেকে লোকে দেখে, শূন্য মাঠে কিছু উৎসবমুখর মানুষের জটলা।

পুজো শুরু হয়ে যায় সকাল থেকেই। এক পুজো শেষ হলেই সব লোকজন পরের পুজোর থানে হাজির হয়। বড় শীতলা এবং ছোট শীতলার মন্দিরে কলস পুজো হয়, সঙ্গে থাকে মা শীতলার ছবি। দুই শীতলা এবং যোগিনী মার পুজো হবার পর সকলে যায় বাজারচন্ডী মার মন্দিরে। মন্দিরটি যে জায়গায় – তার নাম বাজারডাঙা। এটিই একমাত্র বাজার এখানে। যে গুটিকয় বাস যায় পিংলাশ হয়ে, তাদের স্টপেজ এখানেই। একটি ছোট বটগাছের তলায়, দুটি বাঁশের বেঞ্চ – এই হল বাস-স্টপ। দুটি মুদি দোকান, একটি মণিহারী, দুটি চায়ের দোকান, একটি সারের দোকান, এক-দুটি ছোট পান-গুমটি এই নিয়েই বাজারডাঙার বাজার। বাজারচন্ডীর মন্দিরে যে পাথরের বেদীটিকে পুজো করা হয় মাতৃজ্ঞানে, লোককথা অনুসারে তা আসলে মূল মন্দিরের চুড়ো। মূল মন্দির মাটির তলায়। শোনা যায় কোন রাখাল ছেলে গরু চরাতে এসে ওখানে মূত্রত্যাগ  করেছিল। তারপরে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওখানেই গড়ে উঠে মন্দির। আরও গভীরে খনন করে পুরো মন্দিরটি বের করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয় নি।দেশের পুজোর সময় ছাড়াও দুর্গানবমী এবং দোলপূর্ণিমাতে খুব আড়ম্বর সহকারে পুজো হয়। বাজারডাঙা থেকে কিছুটা এগিয়ে, পিংলাশ হাইস্কুল, নীলকুঠী আর কৃষ্ণসায়র পেরিয়ে গেলেই পড়ে এক গোচারণভূমি – গোডাঙা, যা কালক্রমে অপভ্রংশ হয়ে গোড্ডাঙা অথবা গোড্ডাঙর। সেখানেই অস্থায়ী ছাউনিতে হয় শ্মশানকালীর পুজো, গভীর রাত্রে। একশোরও উপর পাঁঠা পড়ে, অর্থাৎ পাঁঠাবলি হয়। পাঁঠাদের ম্যা ম্যা, ভক্তদের মা মা ডাকে চমকিত হয় রাতচরা পাখি।

তিন ব্রাহ্মণ বাড়ীর সকলেই যুক্ত থাকে পুজোর সঙ্গে। বাড়ীর পুরুষরা পুজোর বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত থাকে।বাড়ীর মহিলারা পুজোর ভোগের জন্য বানায় মুড়কি, সুজি, লুচি। গাঁয়ের প্রায় সব বাড়ি থেকেই পূজোর সিধে আসে, আতপ চাল আর কলা, অন্য ফলমূলও দেয় সাধ্যমত। ছোট মত মেলাও বসে – কাঠি আইসক্রিম, শশা কুচি দেওয়া চানাচুর, গ্যাস বেলুন, ডুগডুগি এসব পাওয়া যায়। আর একটা হয় মজার খেলা। এক বালতি জলের মাঝখানে একটা ছোট গ্লাস বসানো থাকে। জলের উপর থেকে একটা দশ পয়সা এমনভাবে ফেলতে হবে যাতে সেটা গিয়ে ওই গ্লাসের মধ্যে পড়ে। পয়সা যতবারই ফেলা হয় সেটা উপর থেকে নিচে নামার সময় জলের মাঝে দুলতে দুলতে ঠিক গ্লাসের বাইরে গিয়েই পড়ে। লক্ষ্মী যে চঞ্চলা – তা এই পরীক্ষার মাধ্যমেই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণ হয়ে যায়।

হরিশ খাঁ পুজোর দিন সকাল থেকেই পরিষ্কার ধুতি ও হাফ হাতা গেঞ্জি পরে ঘুরতে থাকে এক পুজো থেকে অন্য পুজো প্রাঙ্গণে। শোনে পণ্ডিতমশায়ের উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেয় দেশের পুজোর প্রতিটি মুহূর্ত। মনে মনে আওড়ায়, পিংলাশ হাইস্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীতের এক কলি – এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। পিংলাশ গাঁ কে নিয়ে এমন একটা গান – ভাবা যায়! কে লিখেছে কে জানে? আরও একটা গান হরিশ খাঁর খূব মনে ধরেছিল। এক হাটবারে (বৃহস্পতিবার)হাট থেকে ফেরার সময় একবার উঁকি মেরেছিল ঝাঁকরা হাইস্কুলের মাঠে। দেখেছিল পণ্ডিতমশাই ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছেন একটা গান। তারা সব গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, নেচে নেচে, দুলে দুলে গাইছে –

চল কোদাল চালাই,

ভুলে মানের বালাই

ছেড়ে অলস মেজাজ,

হবে শরীর ঝালাই।

যত ব্যাধির বালাই,

বলবে পালাই পালাই

পেটে খিদের জ্বালা,

খাব ক্ষীর আর মালাই…

 

এটাই তাহলে পণ্ডিতমশায়ের সেই ব্রতচারী গান। আহা কি সুন্দর! কোদাল চালাতে বলছে, ছেলেমেয়েরাও মিছিমিছি কোদাল চালানোর ভঙ্গী করছে। কোদাল চালানোটা তাহলে খারাপ কিছু নয়। খারাপ হবেই বা কি করে, ওই কোদাল চালিয়েই তো আনাজপাতি ফলানো হয়, সেই আনাজ নিজেদের খাওয়া হয়, হাটে বিক্রি হয়। হরিশ খাঁ মনে মনে একবার, হাত বুলিয়ে আদরই করে নেয় কোদালের লোহার চ্যাটালো অংশ আর কাঠের বাঁটটাকে।

 

  • হরিশ খুড়া, যাবে নাকি আজ সন্ধ্যাবেলা? বিচার আছে আজ মুখ্যার বাখুলে।
  • কিসের বিচার?
  • সে একটা লট কেস আছে, জাঁত দেয়া হবে।
  • না না, উসব জাঁত ফাঁত দেয়া আমি দেকতে পারবনি। তোদের কী ভাল লাগে উসব জাঁত দেয়া দেকতে? একটা নিরীহ লোককে সবাই মিলে ঘিরে ধরে, নীচে বাঁশ, উপরে বাঁশ দিয়ে ডলে দিয়ে তোদের কী লাভ হয়?
  • নিরীহ বলচ? যখন লট করেছিল তখন মনে ছিল নি? দেশে বিচার ব্যবস্থা বলে তো একটা জিনিস আছে নাকি?

অবৈধ প্রণয় বা লটঘট কে সংক্ষেপে লট বলা হয়। লট করলেই যে সবসময় শাস্তি হবে তেমন কোন কথা নেই, সেটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের উপর। সব লট নয় সমান! এভাবেই এক সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা বা বিচারব্যবস্থা চলে আসছে। নিকটবর্তী থানার ভৌগোলিক দূরত্ব হয়ত বেশী নয়, কিন্তু পুলিশের কাছে অঞ্চলটি আজও দুর্গম। কদাচিৎ দর্শন মেলে পুলিশের। ভাবতে অবাক লাগে কত বছর আগে ব্যবসার জন্য ইংরেজরা সেই দুর্গমতা অতিক্রম করে, হয়ত ঘোড়ায় বা পাল্কিতে চড়ে, পৌঁছে গিয়েছিল এই পিংলাশ গাঁয়ে।

 

গনা গলাটাকে একটু খাদে নামিয়ে বলে, ‘না গো খুড়া শুদু জাঁত দেয়া লয়, আরও আলোচনা আচে মিটিঙে। জান কি অরা সড় (ষড়যন্ত্র)করচে – দেশের জমিটা হড়প করবে। দেবোত্তর সম্পত্তি – পাঁচ বিঘা জমি, যার আয়ে আমাদের দেশের পুজো, সেটা লিয়ে অরা হজম করতে পারবে? দেশে কি ঠাকুর দ্যাবতা বলে কিছু নাই?’

 

অরা মানে পাশের গাঁ, ফিসফিসিয়ে তার নামটাও বলে গনা। হরিশ খাঁর ঠিক বিশ্বাস হয় না, এমন কিছু হবে বলে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে এই দেশের পুজো। মা শীতলা, মা কালীর দয়ায় রক্ষে পেয়েছে এই গাঁ, নাহলে কবেই কলেরায় সাবাড় হয়ে যেত। সেই পুজো বন্ধ হয়ে যাবে? না না, দেশের লোক ঠিক আলাপ আলোচনা করে কিছু ব্যবস্থা করবে। পাশের গাঁয়ের লোকেরাও তো আনন্দ করে এই আমাদের দেশের পুজোয়। তারা কি এমনটা করতে পারে?

 

হরিশ খাঁ বলে চলে, ‘না না, তরাই যা, আমি আর যাবনি মীটিঙে। পুজো কখনো বন্ধ হয়?’ হরিশ খাঁ বলল বটে, তবে মনে একটা খটকা রয়েই গেল, দেশের পুজোর অনিশ্চয়তা নিয়ে।

 

গোপন খবর এসেছে, আজ রাতেই জমি দখল হবে। সন্ধ্যে থেকেই গনা গোড্ডাঙরের মাঠে একটা বটগাছের মাথায় উঠে বসে আছে। বিতর্কিত জমির কাছাকাছি কোন আলোর রেখা দেখা দিলেই, গনা খবর দেবে গাছের নীচে বসে থাকা ধনাকে। ধনা জানান দেবে পিংলাশের লোকজনকে। তারাও সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকবে। সমস্ত কাজটা করতে হবে অত্যন্ত গোপনে। ওদের তরফের লোকজনও নিশ্চয় নজর রাখছে অন্য কোন গাছ থেকে। গনা, ধনা দুজনের কাছেই তিন সেলের টর্চ, তবে সেটা জ্বালানোর ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। খুব প্রয়োজনে, অল্প সময়ের জন্যই জ্বালিয়েই আবার নিভিয়ে দিতে হবে, নাহলে ওরা বুঝতে পেরে যাবে। সন্ধ্যে থেকে মশা মেরে মেরে ক্লান্তিতে যখন গনা ধনার প্রায় ঘুম আসার জোগাড়, তখন দূরে আলো দেখা গেল, রেখা নয় – একেবারে হ্যাজাক বাতির চড়া আলো। অনেক লোকলস্কর, মিছিলের মত এগিয়ে আসছে জমির দিকে। হাতে কুড়ুল, টাঙ্গি, বর্শা, লাঠি, বাঁশের কঞ্চির মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়ে পতাকা। জমি দখল করে, পতাকা লাগিয়ে সীমানা চিহ্নিত করে তবে ঘরে ফিরবে সব। কেউ বাধা দিলে কি হবে তা সঙ্গের অস্ত্রশস্ত্র থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

 

মুহূর্তের মধ্যে খবর পৌঁছে গেল পিংলাশের মোড়লদের কাছে। মুখ্যার বাখুলে সবাই অপেক্ষা করছিল এই সংবাদের জন্যই, তেড়েফুঁড়ে লাফিয়ে উঠল সবাই। এ পক্ষেও সবাই প্রস্তত হয়েই ছিল – লুঙ্গি পরে, গায়ে তেল মেখে, কোমরে গামছা। হাতের অস্ত্রশস্ত্র ওদের মতই। যোদ্ধা বাহিনী এগিয়ে চলল জমির দিকে। রক্তে আগুন জ্বলছে। হরিশ খাঁর ক্ষীণ আওয়াজ চাপা পড়ে গেল সমবেত রোষের উল্লাসে – ‘একবার অদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে…’।

 

দুই দল মুখোমুখি ভুঁইতার মাঠে। গর্জন, প্রতিগর্জনে কেঁপে উঠছে রাতের আকাশ। ফুলে ফুলে উঠছে গলার শিরা, হাতের পেশী।

 

  • এই জমিটা আমাদের। শালা, তরা ঠাকুরের নাম করে অনেকদিন ভোগ করেছু জমিটা। আজ যদি এর দখল না লিয়ে যাই, তাহলে শালা, আমি এক বাপের ব্যাটা লই। অনেক ঢ্যামনামি করেছু শালারা, আজ এর শেষ দেখে ছাড়ব। তোদের দেশের পুজা লিয়ে খুব গুমোর আছে লয়? ওই পুজা এবার বন্ধ করে ছাড়ব। আয় কে আছু বাপের ব্যাটা, এগিয়ে আয়।

 

দু’ পক্ষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি, গুঁতোগুঁতি, খিস্তি খেঁউড় চলতে থাকে। হঠাৎ ভিড়ের পেছন থেকে হরিশ খাঁ এগিয়ে আসে সামনে। দধীচি মুনি, পরম বীর চক্র, বর্ষার জলে-ডোবা ধানক্ষেত, আল পেরনো সাবধানী কাঁকড়া, অঝোর বর্ষায় তালপাতার পেখা মাথায় হরিশ খাঁ নিজেই, শিবের গাজনের সময় তরজাগান, ভুঁইতার মাঠের ধারে অশথ গাছের তলায় খেঁজুর পাতার ত্যালাই পেতে পণ্ডিত মশায়ের পরীক্ষার খাতা দেখা, সবার উপরে মা শীতলা, যোগিনী, বাজারচন্ডী, শ্মশানকালীর পুজো – এই সব দৃশ্যকল্প কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় হরিশ খাঁর মগজে কে জানে, সে হঠাৎ সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করে উঠে, ‘আমি আছি বাপের ব্যাটা, এই জমি দখল আমি বন্ধ করবই। ঠাকুরের জমি। নরকেও ঠাঁই হবে নি তোদের..’

 

এই বীরপুঙ্গবকে দেখে, ওদের রাগের থেকে কৌতুক হয় বেশী। বলে, ‘সরে যা সামনে থেকে, প্যাঁকলা বুড়া। রাগের মাথায় কখন কি হয়ে যায়…’ বলতে বলতেই পাশ থেকে হঠাৎই এক টাঙ্গির কোপ এসে পড়ে হরিশ খাঁর মাথায়।

 

গাঁয়ের মোড়লরা শলাপরামর্শ করে – গঞ্জে লিয়ে গেলে বহুত হ্যাপা। কে পড়বে পুলিশ কেসের চক্করে? ওখানেও কি ডাক্তার বসে আছে এত রাতে চিকিছ্ছের জন্য, তার চেয়ে মদন ডাক্তার কেই খবর দেওয়া হোক। মদন ডাক্তার এসে এটুকুই শুধু জানাতে পারল – সব শেষ, এত রক্তপাতের পর আর মানুষ বাঁচে?

 

পূর্ণ গ্রাম্য মর্যাদায় হরিশ খাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল কৃষ্ণসায়রের পাড়ে, রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি। তার হৃদয় রয়ে গেল ভুঁইতার মাঠে, কৃষ্ণসায়রের কালো জলে, যোগিনী মার থানে, নীলকুঠীর ক্ষয়িষ্ণু ইটে। কিছুদিন পর একটি সমাধি মন্দির, গাঁয়ের মানুষেরই উদ্যোগে। কয়েক বিঘা জমি, ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিধবা স্ত্রীকে।

সমাধি মন্দিরের মার্বেল ফলকে লেখা রইল –

দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ

হরিশ চন্দ্র খাঁন

দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করলেন হরিশ চন্দ্র খাঁন। হয়ত আরও কিছুদিন বেঁচে থাকবেন লোকমুখে – গালগল্পে। মৃত্যুই বোধহয় তাঁর জীবনের একমাত্র স্মরণীয় কীর্তি। মৃত্যু কি মহিমান্বিত করে কোন আপাত-সাধারণ জীবনকে, নাকি মানুষই প্রয়োজনে মহিমান্বিত করে মৃত্যুকে – এইসব গূঢ় প্রশ্ন ভেসে বেড়ায় গোড্ডাঙরের করুণ বাতাসে। দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত ……দেশই বটে! এই পিংলাশ গাঁ ই ছিল তার দেশ, তার ভারতবর্ষ।

 

তুমি মহাপুরুষ, আমরা সাধারন লোক

সুশান্ত কুমার দাস

যুগে যুগে তুমি এসেছ আমাদের মাঝে
ভগবানের বাণী নিয়ে
জীবন কাটিয়েছ অতি সুন্দর সরলভাবে
চলে গেছে আমাদের ছেড়ে ভগবানের
বাণী দিয়ে।
আমরা সাধারন লোক তাই তো
তোমার জন্মদিন নানাভাবে ঘটা করে
পালন করি,
মৃত্যু দিবসেও নানা জায়গায় সভা করে
ফুল দিয়ে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তোমার
ফটোতে রাখে পুষ্পমন্জরী।
সত্যি কথা বলতে কি আমরা কিন্তু
কোন কালেই তোমার উপদেশ শুনি নাই
যে কোন দেশের সব যুগের ইতিহাসে এ
বিষয়টি অতি পরিস্কার দেখতে পাই।
তুমি তো একযুগে এসে বাণী
দিয়েছ নিজেকে যেমন ভালোবাসো তেমনটি বেসো
তোমার প্রতিবেশি আমরা সাধারন লোক — আমরা অস্ত্র
ধারণ করে বহু দেশ দখল করেছি— আর
বাধা হয়ে আমাদের কাছ থেকে
ধর্ম শিখেছে অনেক বিদেশী।
এসবের জন্য কিছু লোকের প্রাণ হারানো
ছিল স্বাভাবিক, স্বাভাবিক ছিল সব
রকমের শঠতা ও নিষ্ঠুরতা।
দূর দেশ থেকে কালো চামড়ার শক্ত দেহ লোককে  ক্রীতদাস করে
কাজে খাটানোতে ছিল না কোন ধর্মহীনতা।
তার পরেও তো হে ভগবান!তোমার দূত এসে
বলে গেল শুধু মানুষের মাঝে শান্তি স্থাপন করা।
আমরা সাধারন লোক — শান্তির জন্যই
চিরকাল অস্ত্রধারণ করেছি — আর এতে
লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু তো উচিত খুবই
স্বাভাবিক ধরা।
তারপর আবার হাজার বছর পর তুমি মহাপ্রভু হয়ে
এসে বলে গেলে জাতপাত নাই — শুধু নাম
করে যেতে।
সমাজের নিম্নতম শ্রেণীর হরিদাসও শুধু নাম
করে করে সব বাধা সরালো তোমার আলিঙ্গন
পেতে।
আমরা সাধারন লোক — এ সব আমরা বুঝি না —
মানি না তাই তো কতজনকে অত্যাচার
করে পাঠিয়েছি ধর্মান্তরে।
কিছুদিন আগেও তো একজন কবি — মহাপুরুষ
করলেন আবেদন — উপরের সবজন
যেন “শুচি করি মন”– সবার
হাতে হাত ধরে এক সাথে যেন কাজ করে।
আমরা সাধারন লোক — আমরা তো
এসব মনে রাখি শুধু তেমার মৃত্যু ও জন্ম দিবসে।
যখন ফুলের মালা দিয়ে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে
তোমাকে স্মরণ করি কিছুটা কৃত্রিম বিষাদ — হরষে।

পাথরে জলছবি

ডঃ সুবীর চৌধুরী

আজ দেখি চারপাশে পাথরে জলছবি
আর মরীচিকার ঝিকিমিকি
আমি হাঁটি ভুল পথে রঙীন নেশায়
ব্যস্ত দুনিয়ায় সামান্য রঙের আশায়।

জীবনের গোধূলী বেলায় সবাই ব্যস্ত
বোধহয় দলে পড়ে আমিও ক্লান্ত
কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের কফি হাউস
এ তো চারিদিকে ছড়িয়ে ম্যাড হাউস।

কেউ বড় হিসাবী অথবা খিলাড়ী
আমি তো ছন্নছাড়া উদ্ভ্রান্ত পাখি
মনে পড়ে আমাদের সেই পুরানো সাথী
আমি চাই পথের ধারে কান্ডারী।

আজ আমরা মার্চ করে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী
সবাইকে বলে রাখি আগামি দিনের হুঁশিয়ারী
বন্ধু ধৈর্য্য ধরো অস্থির দুনিয়ায়
পুরনো রঙীন রিমঝিম ট্রিবল্ বিটের বাজনায়।

লাল মেঝে, কালো বর্ডার

অনমিত্র রায়

এই লেখাটা অনেক বছর ধরে আমার মধ্যে ছিল। ঘুমিয়ে ছিল। শ্রুতি গোস্বামীর ‘আমাদের বাড়ি’ সিরিজের চারটে লেখা পর পর পড়ে আচমকা ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। ধন্যবাদ, শ্রুতি।

আমার একটা একক শৈশব ছিল। পাড়ায় কোনো কোনোদিন বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তেমন অন্তরঙ্গতা ছিল না। বাবা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর, মা কাছাকাছি কোনো কাজে বেরোলে আমাকে পাশের বাড়িতে ঠাম্মা, কাকু, কাকিমাদের কাছে রেখে যেত। ওঁরা আমাকে যারপরনাই ভালোবাসতেন, আর আমিও ওঁদের কাছে দিব্যি থাকতাম।

বাড়িটা একটু অন্ধকার অন্ধকার মতো, সামনে একটা কুয়োসমেত বেশ বড়ো একটা উঠোন। সেই উঠোনে ছিল একটা কাঠচাঁপা গাছ। বেশির ভাগ সময়টাই গাছের তলাটা ঝরা ফুলে ভরে থাকত। আর একটা অদ্ভুত, ঘোর লাগা মিষ্টি গন্ধে জায়গাটা ম ম করত।

তবে বিশাল বড়ো বাড়িটার আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণের ছিল দোতলার ঘরটা। কারণ ওই ঘরের মেঝেটা ছিল টকটকে লাল। শুধু তাই নয়, সেই লাল মেঝের চার ধারে ছিল চওড়া, কালো বর্ডার। সেই প্রথম আমার লাল মেঝের প্রতি প্রেম।

এর পর বেশ কিছু পুরোনো দিনের বাড়িতে ‘লাল মেঝে কালো বর্ডার’-এর সুখ উপভোগ করেছি। মনের এক কোণে একটা ছোট্ট ‘চাওয়া’ জন্ম নিয়েছে। পাহাড়চুড়োয় স্বপ্ন ও সুখের কুটো দিয়ে বাড়ি না হয় না-ই হল, যে বাড়িতে আছি সেখানেই অন্তত একটা ঘরও যদি লাল মেঝের ছোঁয়া পেত, বেশ হত!

অবশেষে একদিন স্বপ্নপূরণের সুযোগ এল। বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ হবে। তেমন কিছুই না, শোয়ার ঘরটা রান্নাঘর হয়ে যাবে, আর এক চিলতে সরু বারান্দাটা পেরিয়ে বাড়ির পুব দিকের অংশে পাশাপাশি দুটো ঘর; একটা মা-বাবার, একটা আমার।

তিন সদস্যের পরিবারে দুজনের ঝোঁক ছিল মোজেইক বা টাইলের দিকে, আর আমি নাছোড়বান্দা ‘লাল মেঝে, কালো বর্ডার’।

‘ওরে শোন, তোর স্বপ্নে যে লাল-কালো, সেই মিস্তিরি আজ আর নেই। সেই রংও নেই।’

‘তা হোক, তবু।’

শেষমেষ লাল-কালোরই জয় হয়। প্রথমে হয় মা-বাবা আর আমার ঘরদুটো। সিমেন্টের ওপর ঘন লাল রংটা পড়তে শুরু করতেই আমার অস্তিত্বে শুরু হয় উত্তেজনা। কালো বর্ডার সমেত পুরো ঘর সম্পূর্ণ হওয়ার পর সেদিক থেকে আর কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না। বার বার মনে হতে থাকে বালিশ নিয়ে এসে মেঝেতেই শুয়ে পড়ি।

দিন যায়। মিস্তিরিদের দেওয়া পরামর্শমতো জলে অল্প কেরোসিন দিয়ে রোজ মোছা হতে থাকে লাল মেঝে। একদিন হঠাৎই চোখে পড়ে লাল মেঝের সারা গায়ে কালো কালো ছোপ। কেন? কী করে হল? প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যায়, উত্তর মেলে না।

একটা মন খারাপ নিরুচ্চারে দানা বাঁধতে থাকে। এর পর আসে বারান্দার মেঝের পালা। একদিন ভোরে বাবা বড়োরাস্তার মোড়ে বটতলা থেকে দুজন মিস্তিরিকে নিয়ে আসে। তাঁদের সহকর্মীরা কাজের ফরমাশ পেয়ে চলে গেছেন, কেবল তাঁরা দুজনই রয়ে গেছেন।

তাঁরা এসে জিনিসপত্তর গুছিয়ে কাজ শুরু করলেন। আর আমার শুরু হল এক উদগ্রীব অপেক্ষা। সন্ধে পেরিয়ে (বিশেষ জোরালো আলোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিল) রাতের দিকে যখন বর্ডার ছাড়া  সেই লাল মেঝে জন্ম নিল, তার দিক থেকে আর চোখ ফেরাতে পারি না।

দিন যায়। নানাভাবে বারান্দার লাল মেঝে মোছা হতে থাকে। দিনে দিনে তার রূপ খুলতে থাকে। এক চিলতে সরু বারান্দাটার একটা ধার ঘেঁষে সার দিয়ে জলের ড্রাম, বালতি। ড্রামের শেষ প্রান্ত আর পাশের দেওয়ালের মাঝে চলাচলের জন্য ফাঁক খুব বেশি নয়। তবু।

তবু স্বপ্নে ও জাগরণে মন মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, ‘যাই, একটু হেঁটে আসি।’

বৈশাখে-বসন্ত (অকুস্থল সিয়াটেল)

সঞ্চিতা ধর

অবকাশ আর বিশ্রান্তির মাঝে

আষাঢ়ের ঘন মেঘের ভিজে হাওয়া৷

যদিও ঋতুটা বর্ষা নয়-

দেশটাও বাংলা নয় ৷

মনের তারে বাজছে গ্রীষ্মের উদাসী সুর-

কখনো বা রুক্ষতার ক্লান্ত আবেশ৷

এখানে সুনীল আকাশ সেজে উঠেছে

বাদল মেঘের আস্তরণে,

কখনো সূর্যাস্তের দ্যুতিতে

আঁকা হচ্ছে রামধনু,

বিলাসী হাওয়ায় অল্প স্বল্প শীতের পরশ৷

 

প্রকৃতি ঋতুরাজ বসন্তের অপেক্ষায়

আকুল এখন!

ফুলে ফুলে প্রজাপতি রং-

নিষ্পত্র গাছগুলিতে কচি সবুজের আলোড়ন,

আকাশে বাতাসে ঋতুবদলের ঘণ্টা,

বৈশাখে এমন বসন্ত-

জীবনে এক পরম প্রাপ্তি!!

সেই সময়

শ্যাম সুন্দর মুখোপাধ্যায়

প্রাক কথন : এই কাহিনী যে সময়কার তখন শিশুদের শৈশব ছিল ।সমাজ সংসার ও অভিভাবকেরা শিশুদের মূল্যবোধ শিক্ষায় উৎসাহ দিতেন । কাহিনীর সময় কাল – বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক ।

ছোটখোকার গল্প ১

শিশুটির বয়স সবে পাঁচ পেরিয়েছে ।অনেক দিন আগের কথা । ষাটের দশকের গোড়ার দিক ।ওর ডাকনাম ছোটখোকা ।বড়খোকা একজন আছে,সে ওর দাদা ।সে স্কুলে যায় । ক্লাস ফোরে পড়ে ।আজ ছোটখোকার খুব মজা ।ওর মাসি এসেছে ।মাসি মায়ের থেকে ছোট , তাই মাকে দিদি বলে । বছরে একবার মাসি ওদের মফস্বলের বাড়িতে আসে ।দূর্গা পূজার পরে পরেই । ছোটখোকারা কোথাও যায় না ।বাবার সময় হয় না । মা কোথাও একা একা যেতে পারে না । মা বলে, মাসি একা একা সব জায়গায় যেতে পারে ।

 

মাসির ছেলে জয় ছোটখোকার থেকে একটু বড়। জয়রা বালিগঞ্জে থাকে । জয় এবার স্কুলে ঢুকেছে, ক্লাস ওয়ান। জয়ের কাছে কোলকাতার কথা, স্কুলের কথা একমনে শুনছিল ছোটখোকা। একসময় তার মনে পড়ল দাদা স্কুলে গেছে, এখন ক্যারম খেলা যায়। একটু আগে ওরা সকালের জলখাবার খেয়েছে। দুপুরে স্নান করতে খেতে অনেক দেরি। দাদা বাড়ি থাকলে ও ক্যারমে হাত দিতে পারে না, ধুন্ধুমার লেগে যায় ।

 

দুই ভাই ধরাধরি করে ভারি ক্যারম বোর্ড মাটিতে পাতল। জয় স্ট্রাইকার হাতে নিয়ে পাকা খেলোয়াড়ের ভান করে কয়েকটা রিটার্ন মারল খালি বোর্ডে। দুজনেই আসল খেলা জানে না। তারা তালগাছ খেলবে। বোর্ডের মাঝখানে সবকটা গুটি উপর উপর সাজিয়ে তালগাছ বানানো হবে। তার পর খেলে খেলে যে যত গুটি ফেলতে পারে তার ততো পয়েন্ট। কালো গুটি দশ পয়েন্ট, সাদা গুটি কুড়ি আর রেড পঞ্চাশ।

 

সব খেলার মত ক্যারম খেলার নিয়ম কানুন আছে এবং সেটা মেনেই খেলতে হয়। ছোটখোকা অতশত জানে না। সে মাঝে মাঝেই বেস লাইনের বাইরে স্ট্রাইকার বসিয়ে গুটি মারছিল। এ নিয়ে লেগে গেল ঝগড়া। ঝগড়া কেউ না মেটালে সাধারণত থামে না। তর্কাতর্কি বাড়তে বাড়তে গালাগালি ।

  • তোর সঙ্গে খেলব না তুই একটা চোর।
  • তুই একটা গাধা।
  • তুই বাঁদর, তুই উল্লুক।
  • তুই খানকির ছেলে।

জয় এ গালি কোনও দিন শোনেনি কারও কাছে। তার কাছে এ শব্দ একেবারে নতুন। এর প্রত্যুত্তর কি দেওয়া যায় সে ভেবে পেল না। সে খেলা ফেলে তার মাকে গিয়ে নালিশ করল।

 

মা ও মাসি হৈ হৈ করে ছুটে এল। মাসি ছোটখোকার কানটা পেঁচিয়ে ধরে বললেন – বল, এ রকম খারাপ কথা কার কাছ থেকে শিখেছিস?

  • হারানের কাছ থেকে ।

মাসি মার দিকে ঘুরে বললেন – হারান কে রে দিদি?

  • আমাদের বাগানের পেছন দিকে একঘর ঘরামি থাকে। ওদের ছেলে। ওর সমবয়সি।
  • একদম মিশতে দিবি না ওদের সঙ্গে। ছোটলোকদের মত কথা শিখবে।

মাসি এবার ছোট খোকাকে চোখ পাকিয়ে বললেন – হারানের সঙ্গে আবার যদি মিশিস আর কোনও দিন তোদের বাড়ি আসব না। মনে থাকবে?

ছোটখোকা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল ।

ছোটখোকা বুঝল সে অত্যন্ত খারাপ কথা বলে ফেলেছে। আর, হারানরা ছোটলোক। হারানের সঙ্গে মা আর খেলতে দেবে না।

দুপুরে খাওয়ার সময়, মাটিতে দুটো আসন পাতা পাশাপাশি। জয় আর ছোট খোকা খেতে বসেছে। ভাত আর ডিমের ঝোল। মাসি থালার ভাতের উপর ডিমের বাটি দুটো উপুড় করে দু থালার ভাত মেখে দিলেন। ডিম আলু সব থালার এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। দুজনেরই একটা করে গোটা ডিম। ডিমটা লাল করে ভাজা। ছোট খোকার মা যেরকম সাদা সাদা ডিম করে সে রকম নয়। দুই ভাই খাওয়া শুরু করল।

ছোটখোকা ডিমটা থালার একপাশে জমিয়ে রেখেছে। সব শেষে খাবে। চেটে চেটে থালা পরিস্কার করে ফেলেছে।

মাসি জিজ্ঞাসা করল – কিরে ডিমটা কেমন হয়েছে?

ছোটখোকা চোখ বড় বড় করে বলল – ভালো।

  • কেমন ভালো?
  • ছোটলোকদের মত।

মাসি বুঝতে পারছে না দেখে ছোটখোকা তার নিজের ভাষায় যা বলল তার মর্মার্থ হল – এরকম লাল করে ভাজা ডিম সে হারাণদের বাড়িতে একদিন খেয়েছে।

মাসি রাগ করলেন না। উল্টে হেসে উঠলেন।

মাকে বললেন – দিদি তোর ছেলেটা হাঁদা আছে, সামলে রাখিস। নাহলে গোল্লায় যাবে।

 

ছোট খোকার গল্প – ২

ছোট খোকা এখন স্কুলে যায়, ক্লাস  থ্রি-এ পড়ে। একদিন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে সে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। পথে পড়ে একটি পাঁচিল ঘেরা একতলা বাড়ি। পাঁচিলের পাশে ভিতর দিকে এক পেয়ারা গাছ। পাকা–ডাঁসা ফল ধরে আছে। পাঁচিল বেয়ে উঠলে ফল পাড়া সহজ ব্যাপার। উৎসাহী কর্মনিপুণ বন্ধু কজন চটপট গাছে উঠে পড়ল। গৃহস্থ টের পাওয়ার আগেই পেয়ারা পেড়ে রাস্তায় নেমে এল। দে ছুট। অকুস্থল থেকে ছুটে পালাল সবাই। ছোট খোকা ভাগে পেল দুটি পেয়ারা। তার পিঠে স্কুল ব্যাগ, দুহাতে দুটো পেয়ারা। একহাতেরটা খাচ্ছে, অন্য হাতেরটা অক্ষত। দিন খারাপ ছিল, বাড়ি ঢুকতেই উঠোনে মায়ের মুখোমুখি। দুই হাত পিছনে চলে গেল পিছমোড়া ভঙ্গিতে।

  • হাতে কী দেখাও!

দু হাত সামনে চলে এল। একহাতে ধরা আধখাওয়া অন্য হাতে গোটাটা।

  • কোথায় পেলে পেয়ারা, কে দিল ?

দোষ কবুল হল, পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সমেত ।

  • ওদের বাড়িতে গিয়ে সব বল। তারপর ওরা যদি পেয়ারা খেতে দেয় তবে খাবে।

বালক তখনই দৌড়োয় মায়ের আদেশ পালন করতে ।

  • স্কুলব্যাগ রেখে যাও।

পেয়ারার মালিকের বাড়ি বেশি দূর নয়। অতি কষ্টে পাঁচিলের ভারি গেট খোলে বালক। গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এলেন এক ভদ্রমহিলা।

তিনি গৌরবর্ণা, মধ্যবয়সী, মোটাসোটা। মুখমন্ডল গোলাকার, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, মাতৃস্নহে ভরা মুখ। স্নেহপূর্ণ নরম গলায় জানতে চাইলেন বালকটি কী বলতে চায়। অপরাধবোধ, মায়ের কাছে ধরাপড়া তারপর দোষ স্বীকার করতে আসা। বালকের মন উৎকণ্ঠায় ভরে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই সে দোষ স্বীকার করার চেষ্টা করছে আর ছোট ছোট দুহাত সামনে বাড়িয়ে বামাল প্রদর্শন করছে। একহাতে আধখাওয়া অন্য হাতে গোটাটা।

কিছু বুঝতে না পেরে ভদ্রমহিলা বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। এবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। গৌরবর্ণ, লম্বা ভারিক্কি চেহারা, ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত। যেন বাংলা সিনেমার ছবি বিশ্বাস। বালকের আবেগ এখন অনেক প্রশমিত হয়েছে। সে দু হাত বাড়িয়ে পেয়ারা দেখাল, এক হাতে আধখাওয়া আর এক হাতে গোটা।

  • এই পেয়ারা দুটো আমি আপনাদের গাছ থেকে চুরি করেছি। এগুলো নিয়ে নিন। আমায় ছেড়ে দিন। আমি আর কোন দিন পেয়ারা চুরি করব না।

গম্ভীর গলার আওয়াজ বেরল – অ ।

বালক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বালকের পিঠে হাত রাখলেন। শান্ত স্বরে বললেন – ভেতরে এস।

বালক এক প্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে নীচু টেবিল ঘিরে কুশন দেওয়া বেতের চেয়ার। অঙ্গুলি নির্দেশ মেনে বালক কোন রকমে চেয়ারে বসে। কুশন দেওয়া বেতের চেয়ারে বালকের পক্ষে বসা কঠিন। ব্যালান্স সামলাতে হাত দুটো টেবিলে রাখে।

  • চেয়ারে ঢুকে ভাল করে বস। যেটা খাচ্ছিলে ওটা খাও।

বালক বুঝতে পারে পরিস্থিতি সহজ হচ্ছে। গোটা পেয়ারাটা টেবিলে রেখে আধখাওয়াটা খেতে শুরু করে।

একের পর এক প্রশ্ন আসছে উল্টো দিক থেকে। কী নাম, কোন ক্লাসে পড়? কোন ইস্কুলে? বাড়ী কোথায়? বাড়ীতে কে কে আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

বালক পেয়ারা খেতে খেতে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়।

প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জেরা সারলেন। বসার ঘর থেকে ভিতর বাড়িতে গেলেন। একলা হতেই সুযোগ পেয়ে বালক মুখ তুলে ঘরের চারপাশ দেখে নিল।

আবার প্রৌঢ়ের প্রবেশ। বালকের মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন।

ঘরে ঢোকে গৃহকর্ত্রী, হাতে ব্রাউন কাগজের ঠোঙা। ঠোঙাটা  টেবিলের উপর রাখলেন, ঠক করে আওয়াজ হল। গৃহকর্তা এবার টেবিলের আস্ত পেয়ারাটা ঠোঙায় ভরে বালকের হাতে দিলেন।

  • এটা নাও, এবার বাড়ি যাও। সোজা বাড়ি চলে যাবে।

বালক সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। বাড়ির বাইরে এসে ঠোঙা খুলে ভিতরে উঁকি মারে। এক দৌড়ে বাড়ি।

  • মা, দেখ আমায় কতগুলো পেয়ারা ……. ।

 

উজবেকিস্তানের নৃত্য প্রদর্শন

সোহিনী বসু

সংগীতকে যদি বলি স্বর ও লয়ের মাধ্যমে সুন্দরের নির্মিতি, নৃত্যকে তাহলে বলা যায় ছন্দ ও দেহভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে সুন্দরের প্রকাশ । নৃত্যকলা একটি স্বতন্ত্র ভাষা যার উদ্ভাসন মুদ্রা এবং দেহভঙ্গিতে । এটিকে আমরা বলি মার্গ বা শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা । আর এক ধরনের নৃত্যে দেখা যায় ভাব এবং লৌকিক অনুভূতির প্রাধান্য, যাকে আমরা সাধারণভাবে লোকনৃত্য নামে জানি ।

এই দিক থেকে ভারতীয় লোকনৃত্যের সঙ্গে উজবেক লোকনৃত্যের আত্মীয়তা অনেকের কাছে আশ্চর্য মনে হতে পারে । তবে এটুকু যদি মনে রাখি যে, তাসখন্ড সমরখন্দ ইত্যাদি মধ্য-এশীয় অঞ্চল একদা ইন্দো-ইরানীয় সংস্কৃতির প্রবাহের অন্তর্গত ছিল তাহলে এই সাদৃশ্য হয়তো তেমন বিস্ময়কর নাও মনে হতে পারে । ১৯১৭ সালের পূর্বে এই অঞ্চলের নৃত্যে যদি পাদুকা ব্যবহারের রেওয়াজ না থেকে থাকে তাহলে এই সাদৃশ্য তখন হয়তো আরো নিকট ছিল । সোবিয়েত ব্যবস্থার প্রভাবে নর্তক-নর্তকীদের মধ্যে জুতো পরে নাচার রেওয়াজ হয়েছে এ অনুমান অন্যায় হবে না । এই কথা মনে হচ্ছিল এ. বি. ইউ., তেলেঙ্গনা সরকার ও দূরদর্শন আয়োজিত নৃত্য উৎসবে তাসখন্ডের বাহর এনসেম্বলের লোকনৃত্য দেখতে দেখতে *।

এদের লোকনৃত্যের অধিকাংশ সামাজিক বিষয় অবলম্বনে রচিত । পুরাতন বিষয়বস্তু অনেক কিছু বর্জিত হয়ে নৃত্য রচনাগুলি আধুনিক অনুভবের প্রকাশবাহন হয়ে উঠেছে । এইখানে আমাদের লোকনৃত্যের সঙ্গে এদের নৃত্যের পার্থক্য । আমাদের নৃত্যে এখনো ধর্মীয় বা কৌলিক আচারের প্রভুত্ব । ফলে দেবদেবী এবং সনাতন লৌকিক ধ্যান-ধারণার প্রভাবই বেশি । ওদের নৃত্যে হর্ষ এবং জীবনতৃষ্ণাই মূল সুর । অবশ্য আমাদের কর্মভিত্তিক নৃত্যগুলিতে এর কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায় ।

উজবেক নৃত্যের ছন্দ রচনায় চতুর্মাত্রিক সম তালের একাধিপত্য দেখা গেল । আমাদের কাহারবার সঙ্গেঁ কোনো পার্থক্য নেই । অবশ্য দু একবার পরিবর্তন হিসেবে অতিদ্রুত দাদরার তালফেরতা শোনা গেছে । অতএব পদচালনা দিক থেকে আমাদের সঙ্গে খুব বেমিল নেই । পা ফেলার কায়দাও অনেকটা আমাদের মত, পার্থক্য শুধু জুতো পরে নাচাতে আর ঘুঙুরের অব্যবহারে । এই আশ্চর্য সাদৃশ্য চোখে পড়ার মত ।

কিন্তু আসল পার্থক্য ধরা পড়ল মেজাজ এবং রচনায় । গানে যেমন আমাদের কানু ছাড়া গীত নেই, নৃত্যেও তেমনি । এরা দেখলাম মধ্যযুগীয় বিষয় পরিহার করে আধুনিক সামাজিক এবং ব্যক্তিক বক্তব্য এবং সৌন্দর্যপ্রকাশে তাদের লৌকিক নৃত্যকলাকে সংযুক্ত করতে পেরেছেন । আবেগের মধ্যে বিরহ ও বিষাদের অনুপস্থিতি সর্বপ্রথমে উল্লেখ করতে হয় ।আমাদের নৃত্যে নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ এবং হতাশার মাধ্যমে যে দুঃখবাদের রাজত্ব দেখা যায় এদের নৃত্যে তার চিহ্ন মাত্র নেই । এদের নৃত্যের বাণী আনন্দময় কিন্তু সে আনন্দের কথা, সুখের বিষয়, নিছক প্রচারধর্মী নয়–তার মধ্যে সুন্দরের আলোকপাতও বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে ।

উজবেকিস্তানে এখন ইউরোপীয় প্রভাব যথেষ্ট । যেমন ধরা যাক ওদের নামটি – বাহর । কথাটি আমাদের বিখ্যাত রাগ বাহারের সগোত্র। বাহার মানে বসন্ত। বাহর মানেও নাকি তাই। ফার্শি বাহার, সংস্কৃত বাসর এবং উজবেক বাহরের উৎস হয়তো এক। ভারতীয় উজবেক কন্যাদের ফুল উপহার দেওয়ার নাচে ওরাই যখন আবার ঘাগরা আর ওড়না পরে নাচতে এল তখন কথাটার আরো স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল। এবারে একমাত্র বৈসাদৃশ্য জুতো পরে নাচ।

এঁরা যন্ত্র নিয়েছিলেন অ্যাকর্ডিয়ন, দুটি জাতীয় যন্ত্রের আদিম সংস্করণ – একটি ব্যাস বাঁশি, একটি টেনর বাঁশি এবং একটি ডফ্ জাতীয় ট্যাম্বুরিন। কাউন্টার পয়েন্টের ব্যবহার বেশী নেই কিন্তু সুন্দর হারমনি সংযোগ করা হয়েছে। তালকে এরা প্রাধান্য দেননি – না বাদ্যে, না নৃত্যে। প্রাধান্য দিয়েছেন ছন্দকে।

এঁদের নৃত্যে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ফর্মের চেয়ে ভাবের প্রাধান্য। সম্মেলক কম্পোজিশন এত সাবলীল যে তা শিক্ষণীয় । স্টেজকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা যথেষ্ট মঞ্চাভিজ্ঞতার পরিচায়ক। এঁদের তালিম যে এত পাকা তা এঁদের নৈপুণ্য থেকে মালুম হয়। কোনো পদক্ষেপেই অপেশাদারিত্বের চিহ্ন দেখা যায় নি । সমস্তটা মিলে একটা আনন্দরস বিতরণ যা হায়দ্রাবাদের বিদেশীরাও সহর্ষে গ্রহণ করে আস্বাদন করেছেন।

 

*দৃষ্ট নৃত্য প্রদর্শন : শিল্পকলা ভেদিকা, হায়দ্রাবাদ, জানুয়ারি ২০১৭