সবুজ দ্বীপ

গার্গী রায় চৌধুরী

আজ সকালটা অনেক অন্যরকম, অন্তত পুপুর তাই মনে হল। ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই, স্কুলে যাবার তাড়া নেই। যেন বিশ্বাস হতে চায় না গতকালই আনুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সে এবার ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠবে। পরীক্ষা ভালই হয়েছে। আজ শুক্রবার, কাল সে মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে সাগর দ্বীপে। সঙ্গে কাকাই, কাম্মা আর পুটুশও যাচ্ছে। পুটুশ পুপুর খুড়তুতো বোন, সে ক্লাস টু এ পড়ে। পুপুর ছায়া সঙ্গী। আর পুপু যা যা করে তারও সেই সেই কাজ করা চাই। পুপুও এঞ্জয় করে তার কান্ড কারখানা, দরকার পড়লে শাসন করে কিন্তু পুটুশকে ছাড়া তারও চলে না।

সেদিনটা হুস করে কেটে গেল গোছগাছ করতে করতে। পুপু সবার আগে প্যাক করে নিল তার ফেলুদার বই তারপর মাকে গোছাতে সাহায্য করলো সারাদিন। রাতে মা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বললেন পুপুকে, কারণ পরের দিন খুব ভোরে উঠে যেতে হবে। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতে চাইছিল না পুপুর, চোখের সামনে যেন সাগর দ্বীপ। সে শুনেছে অনেক নদী এসে মিলেছে যেখানে সেটাই সাগর দ্বীপ। এর চারিদিক শুধু জল আর জল। আজ দুপুরে একবার ম্যপ খুলে জায়গাটা দেখেও নিয়েছে পুপু। ছোট্ট একটা বিন্দু। চারিদিকে জল, তার ভাবনা মানুষ সেখানে থাকে কি করে? জলে পড়ে যায় না? মনের মধ্যে এসব নানা কথা নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।

সময়ের নিয়মে ভোর হয়, গাড়ি এসে যায়, পুপুদের যাত্রাও শুরু হয়ে যায়। গাড়ি শহর কলকাতা ছাড়িয়ে ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। পুপু আর পুটুশ দুজনে বসেছে পাশাপাশি। পুটুশ পুপুর হাতটা ধরেই আছে সে গাড়িতে উঠে বসা থেকে। নানা রকম প্রশ্ন করে চলেছে পুপুকে,

“দিভাই আমরা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছি, না রে?”

পুপু হেসে বলে, “ না রে বোকা, সাগর দ্বীপে”।

পুটুশ পুপুর কাছে সবুজ দ্বীপের রাজার গল্প শুনেছে, তাই তার খালি মনে হচ্ছে তারা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছে। সে মানতে চায় না, বলে,

“জেঠু বলেছেন আমায়, আমরা সবুজ দ্বীপেই যাচ্ছি”।

বাবা হেসে উঠলেন ,

“কেন হবে না সবুজ দ্বীপ, যেখানে যাচ্ছি সেখানেও তো শুধু সবুজ আর সবুজ”।

পুপুরও মনে ধরে কথাটা। সঙ্গে একটা রোমাঞ্চও হয়। ২-৩ ঘণ্টা যাওয়ার পর তারা এসে দাঁড়ায় একটা বিশাল নদীর সামনে। তার একুল ওকুল দেখা যায় না। পুপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে, এত্ত বড় নদী সে আগে কখনো দেখেনি।  তারপর লঞ্চে করে সেই নদী পার হয়ে সাগর দ্বীপে যখন তারা পৌছল ঘড়ির কাঁটা তখন ১টা ছুঁয়েছে। বাবা কাকাইকে বললেন,

“বুঝলি বাবুই, কলকাতা থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টা লাগলো”।

এখন মার্চ মাস, সূর্যের তেজ বেশ বেশী। কিন্তু হাওয়াও খুব। রোদের তেজ আর গরম গায়ে লাগে না। লঞ্চ ঘাটে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল পুপুদের গেস্ট হাউসে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা উঠে বসলো গাড়িতে। গাড়ি ছুটল সবুজ দ্বীপ দিয়ে। পুপুরা আজ আর কাল এখানে থেকে আবার পরশুই ফিরে যাবে কলকাতায়। বাবা, কাকাই, মা, সবার অফিস আছে, তাই বেশিদিন থাকা হবে না। বাবা বললেন,

“এখন গেস্ট হাউসে গিয়ে স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে হবে সবাই কে, পুপু, পুটুশ তোমরাও দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেবে না হলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে”।

পুপু- পুটুশ কারও এই কথাটা পছন্দ হল না, একটুও ক্লান্ত লাগছে না তাদের। কিন্তু বাবা বলেছেন, শুনতেই হবে।

সেই বিকেলটা সাগরের পারে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিল ওরা। পুপুরা পা ভেজালো জলে। গেস্ট হাউসটা প্রায় সাগরের পারেই বলা যায়, তাই গাড়িতে না উঠে হেঁটে হেঁটেই ঘুরে বেড়ালো ওরা। ঠিক হল কাল যাওয়া হবে এখানকার খুব বিখ্যাত এক মন্দিরে। এই দ্বীপে এসে সেখানে না গেলে, ঘুরতে আসাই নাকি বৃথা।

পরদিন সকালে স্নান সেরে সবাই গেল মন্দিরে। মন্দির দেখে তো পুপু তাজ্জব। বিশাল বড় তো বটেই, কত দর্শনার্থীর ভিড় সেখানে। মন্দিরের একপাশে আবার গেস্ট হাউসও আছে, দর্শনার্থীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। যদিও একটি ঘরও খালি নেই। বাবা বললেন,

“যেন একটা ইনডাস্ট্রি চলছে”।

এমন সময় একজন সন্ন্যাসী এসে তাদের পুজোর প্রসাদ দিয়ে গেলেন। মা কাম্মাকে বললেন, “অনেক বড় মন্দির, ভালো করে সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখি চল”।

বাবা আর কাকাই গেলেন, মন্দিরের বাইরের আশপাশ দেখতে, মা , কাম্মা, পুপু আর পুটুশ ঘুরে বেড়াতে লাগলো মন্দির চত্বরে। মা পুপুকে মন্দিরের গায়ে আঁকা দেবদেবীর মূর্তি চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, তাদের নিয়ে কথিত গল্প বলছিলেন, পুটুশ ঘুরছিল কাম্মার সাথে। হঠাৎ পুপু দেখল কাম্মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে তাদের দিকে আসছেন, এসে মা কে বললেন,

“দিদি পুটুশ কে দেখতে পাচ্ছি না”।

কাম্মার মুখ লাল, চোখে জল এসে গেছে। মা বললেন,

“কখন থেকে দেখতে পাচ্ছিস না?”

কাম্মা বললেন,

“আমার সঙ্গেই তো ছিল, এই এখুনি লক্ষ্য করলাম নেই, তারপর আসেপাশেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না”।

মা কাম্মা কে সঙ্গে নিয়ে মন্দির চত্বর খুঁজতে লাগলেন আর পুপুকে মন্দিরের পিছন দিকটা দেখিয়ে বললেন ,

“পুপু তুই ওই দিকটা একবার দেখে আয় তো”?

পুপু, মার কথা মতো সেই দিকে গিয়ে পুটুশ কে দেখতে পেল না, কিন্তু এপাশ অপাশ করার পর দেখলো দালানের এক পাশ ঘেষে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে, তার মনে হল পুটুশ ওখানে পড়ে  যায়নি তো? পুপু আসতে আসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। গিয়ে দেখল ওটাও একটা ঠাকুর ঘর, সাদা পাথর দিয়ে বাঁধানো, খুব পরিষ্কার। বোঝাই যাচ্ছে এখানে লোক বেশী আসে না। ঘরটা এল-সেপের, পুপুর আর এগুতে সাহস হল না, সে পটুশের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। কয়েকবার ডাকার পর সে যখন ফিরে আসবে ভাবছে তখন দেখল এক সৌম্য কান্তি সন্ন্যাসীর হাত ধরে তার বোন এগিয়ে আসছে ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে। পুটুশের দু হাতে সন্দেশ। পুপুর ধড়ে প্রান এলো। সন্ন্যাসী বললেন,

ভয় নেই, ওকে আমি মন্দির ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম। প্রসাদ দিয়েছি, দাঁড়াও তোমাকেও দিচ্ছি”।

পুপুর দাঁড়ানোর সময় নেই, সে জানে মা-কাম্মা এতক্ষনে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে হয়ত বাবাদেরও খবর দিয়েছেন। সে সন্ন্যাসী ঠাকুর কে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,

“না এখন না, পরে এসে প্রসাদ নিয়ে যাব। মা আমাদের খুঁজছেন”।

সন্ন্যাসী হেসে বললেন, “আচ্ছা যাও”।

পুপু তার বোনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলল মা-বাবা দের সন্ধানে। মা-কাম্মা যথারীতি বাবা- কাকাই কে খবর পাঠিয়েছেন। তাঁরাও এসে গেছেন। পুপু গিয়ে সব কথা বলল তাঁদের, তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। কাকাই বললেন,

“ বললাম না, কিচ্ছু হবে না, এখানে এত লোক, এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান”।

কাম্মা পুটুশ কে একটু বকলেন একা একা না বলে যাওয়ার জন্য। পুটুশের মুখ কাঁদো কাঁদো, তার হাতের সন্দেশ হাতেই পড়ে রইল। বাবা বললেন,

“বেলা বেড়ে গেছে, চলো গেস্ট হাউসে ফিরে যাই”।

গেস্ট হাউসে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়ার শেষে হঠাৎ জ্বর এসে গেল পুটুশের। সে বেচারা ধমক খেয়ে একটু মন মরা হয়েই ছিল, ঠিক করে খেলোও না। তারপর এই জ্বর। দুপুর তিনটে নাগাদ দেখা গেল জ্বর বেড়ে ১০২ ডিগ্রি হয়েছে। বাবা বললেন,

“চলো আমরা আজই কলকাতায় ফিরে যাই”।

গাড়ি তো সঙ্গে ছিলই, পুপুরা সবাই বেড়িয়ে পড়ল কলকাতার দিকে।

কলকাতায় এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে পুটুশের জ্বর কমলো কিন্তু সেই মনমরা ভাব কমলো না। দুই বোনেরই পরীক্ষা শেষ, স্কুল ছুটি, তাই মা পুপুকে দুদিনের জন্য কাকাই এর বাড়ী থাকতে পাঠিয়ে দিলেন। পুটুশ খুব খুশি দিদিকে পেয়ে, দুজনে একসঙ্গে সারাক্ষন। দুপুরে পুটুশ জোর করে কাম্মাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিল দিভাই এর সাথে সিক্রেট শেয়ার করবে বলে। পুপু জানে এটা পুটুশের ছেলেমানুষী। সে পুপুর সঙ্গে একদম একা সময় কাটাবে বলে কাম্মাকে অন্য ঘরে যেতে বলছে। বিছানায় শুয়ে পুপুর গলা জড়িয়ে পুটুশ চুপ করে শুয়ে রইল, পুপু বলল,

“বলো তোমার সিক্রেট  কি?”

বলে পুপু বোনের মুখটা তুলে ধরতেই দেখল, পুটুশের চোখে জল। পুপু উঠে বসে ওকে কোলে বসাল, বলল, “কি হয়েছে সোনা”?

পুটুশ বলল, “এটা রিয়েল স্টোরি দিভাই, তুমি কাউকে বোলো না, তাহলে তুমি, মা বাবা, জেঠু, জেম্মা সবাই আকাশের তারা হয়ে যাবে”।

পুপু বোঝে কোনও গোলমাল আছে, সে জোর দিয়ে পুটুশকে বোঝায় কারও কিচ্ছু হবে না। পুটুশ বলে সাগর দ্বীপের মন্দিরে সেই সিঁড়ির তলার কথা, সেখানে ওই সন্ন্যাসী পুটুশকে নিয়ে গিয়ে তার শরীরের গোপন জায়গায় হাত দিয়েছেন, পুটুশকে ভয় দেখিয়েছেন, বলেছেন, একথা কাউকে জানালে উনি ঠাকুর কে বলে তাদের আকাশের তারা করে দেবেন। পুটুশ বলে চলে,

“দিভাই সন্ন্যাসী আমার সিক্রেট প্লেসে হাত দিয়েছেন। আমার খুব ব্যথা লেগেছে”।

পুপু বড় হয়েছে, সে জানে এই কাজ কত বড় অন্যায়, মা বার বার তাকে বলে দিয়েছেন শরীরের সিক্রেট প্লেসে কেউ হাত দিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা কে বলতে হয়, যাতে ওই দুষ্টু লোকটি শাস্তি পায় আর অন্য কারও সাথে ওই একই কাজ করতে সাহস না পায়। পুটুশ ছোট, তাকে হয়তো কাম্মা এসব কথা কখনো বলেননি। তাই বেচারা জানেই না। পুপু চোখে জল এসে গেল, দুঃখে নয় রাগে। তার মনে হতে লাগলো লোকটার এত বড় সাহস যে সে বাবা-মা , কাকা-কাম্মা, পুপু সবার প্রেজেন্সকে উপেক্ষা করে ছোট্ট পুটুশের গায়ে হাত দিল, আর তারা কেউ কিচ্ছু করতে পারল না। লোকটা এখনও ওখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আরও কত বাচ্চার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছে কে জানে? পুপু বুঝতে পারে এই লোকটিকে শাস্তি না দিলে পুটুশের চোখের দিকে তাকাতে পারবে না সে। সে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“তুই কি বোকা পুটুশ, তুই তো জানিস লোকটা দুষ্টু লোক, ভালো লোক কি সিক্রেট প্লেসে হাত দিয়ে ব্যথা দেয়? আর দুষ্টু লোক দের কথা কি কখনো ভগবান শোনেন? ও তোকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে। তুই তখনই বললে আমরা সঙ্গে সঙ্গে লোক টাকে ধরতে পারতাম। যাক গে, এখনও ধরব লোক টাকে আর শাস্তিও পেতে হবে ওকে আমার ছোট্ট বোন টাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য”।

পটুশ বলে, “তুমি সত্যি বলছো দিভাই? তোমরা কেউ আকাশের তারা হয়ে যাবে না তো?”

পুপু বলে, “দূর বোকা, তোর দিভাই কি তোকে কখনো মিথ্যে বলে?”

পুটুশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

সন্ধ্যেবেলা সবাই অফিস থেকে ফিরলে পুপু, মা-বাবা, কাকা-কাম্মা কে একজায়গায় বসিয়ে গোটা ঘটনাটা বলে। বাবা বলেন,

“যেহেতু ঘটনার সময় লোকটিকে ধরা যায়নি তাই এখন তাকে দিয়ে স্বীকার করানো যাবে না”।

পুপু বলে,  “আমি লোকটিকে চিনি, আমি যদি ওর কাছে যাই, ও আমার সঙ্গেও একই রকম কাজ করার চেষ্টা করতে পারে, তোমরা পুলিশ নিয়ে আশেপাশে থাকবে, আর ঠিক সময়ে লোকটিকে ধরবে”।

বাবা বললেন, “সাবাশ, এই তো চাই, ভীষণ ভালো আইডিয়া”।

কাকা আর মা একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন, কিন্তু বাবা যখন বললেন, “কোনও রিস্ক নেই, আমরা তো থাকব ওখানে”,  তখন ওরা রাজি হলেন।

এরপর বাবা তার এক বন্ধু মারফত সাগর দ্বীপের লোকাল থানায় যোগাযোগ করলেন, ঠিক হল পরের দিন বাবা, কাকাই, পুপু যাবে সাগর দ্বীপে, তবে এবার আর বেড়াতে নয়, একজন অপরাধীকে শাস্তি দিতে।

পাঁচ ঘণ্টার পথ যেন কাটতে চায় না। নদী পার করে সাগর দ্বীপে পৌঁছতে পুপুরা দেখল একজন পুলিশ অফিসার ও চারজন পুলিশ কাকু সিভিল ড্রেসে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। সবাই মিলে যাওয়া হল মন্দিরে, মন্দিরের বাইরে একটু দূরে গাড়ি রেখে সবাই হেঁটে গেলেন মন্দিরের মধ্যে। গাড়িতে আসতে আসতে পুলিশের মুখে পুপু শুনেছে খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে, অপরাধী টের পেয়ে গেলে পালিয়ে যাবে, তখন তাকে ধরা মুশকিল, তারপর পুপুকে আইডেন্টিফাই করতে হবে অপরাধী , পুলিশ তো জানেই না কে সেই লোক। তাছাড়া লোকটি মন্দিরের পুরোহিত, তাই কোনও প্রমাণ ছাড়া তাকে ধরাও সম্ভব হবে না। পুপু বুঝতে পারল ব্যাপারটা সহজ নয়, বুদ্ধি করে লোকটিকে ধরিয়ে দিতে হবে তাকেই।

মন্দিরে ঢুকে পুলিশ অফিসার, একজন পুলিশ ও বাবা গেলেন হেড সন্ন্যাসীদের ঘরে তাদের সঙ্গে কথা বলতে। পুপু একা মন্দির চত্বরে উঠে মন্দির দেখার ভান করে খুঁজতে লাগলো সন্ন্যাসীটিকে, কাকাই আর অন্য দুজন সাধারন পোশাকের পুলিশ দূর থেকে নজরে রাখতে লাগলো পুপুর উপর। পুপুর বুকের মধ্যের ধুক পুক আওয়াজ টা তখন দ্রাম দ্রাম করে বাজছে, সে লক্ষ্য করলো তার হাত পাও কাঁপছে। মুখটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে মন্দিরের এঘর ওঘর ঘুরতে লাগলো, তার ভয় হতে লাগলো যদি সে লোকটিকে খুঁজে না পায় তাহলে পুটুশের অপরাধীকে আর ধরা যাবে না। সে ভালো লোকদের মধ্যে মিশে থেকে মানুষের ক্ষতি করে বেড়াবে। এসব ভাবতে ভাবতে পুপু দেখল আরতি হচ্ছে আর লোকটি, হ্যাঁ সেই লোকটিই আরতির সঙ্গে কাঁশর ঘণ্টা বাজাচ্ছে। পুপুর মন শান্ত হল। অনেক লোক দাঁড়িয়ে আরতি দেখছে, পুপুও তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, এমন জায়গায় দাঁড়াল যাতে লোকটি তাকে স্পষ্ট দেখতে পায়। তারপর সুযোগ বুঝে ঘাড় ঘুড়িয়ে কাকাইকে ইশারা করে লোকটিকে চিনিয়ে দিল। আরতি চলাকালীনই লোকটির সঙ্গে চোখাচোখি হল পুপুর। সে মৃদু হাসল লোকটিকে দেখে, লোকটিও হাসল। তারপর আরতি শেষ হলে পুপুর কাছে এসে বলল,

“কি দুদিন আসনি যে তোমরা?”

পুপু বলল, “সাগরের দিকে ছিলাম তাই আসা হয়নি”।

লোকটি বলল, “কতদিন আছো”?

পুপু বলল, “কালই চলে যাব”।

সন্ন্যাসী বেশী লোকটি বলল, “বোন কোথায়?”

পুপু বলল, “ও মায়েদের দের সাথে বাইরে আছে”।

লোকটি পুপুর চিবুকে হাত রেখে বলল,”তুমি প্রসাদ নেবে?”

পুপু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, আর লোকটি এসো, বলে পুপুকে নিয়ে চলল ওই সিঁড়ির নিচের ঘরের দিকে। পুপু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল, সে জানে তার কোন ক্ষতি হবে না ফেলুদা তার সহায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে লোকটির সাথে ঘরের ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল পুপু, এল শেপের আড়ালে গিয়েই লোক টি পুপু কে কাছে টেনে নিল, পুপু চিৎকার করে উঠল “কাকাই…”

কোনও আওয়াজ এলো না ওপাশ থেকে, লোকটি বলল,

“তোমার কাকাই তো এখানে নেই, আমি আছি শুধু, কোনও ভয় নেই,”

বলে লোকটি পুপুর সিক্রেট প্লেসে হাত দিতে গেল। আর ঠিক তখনি, কাকাই আর দুজন পুলিশ এসে লোকটিকে চেপে ধরল আর ধুমাদুম করে রদ্দা কষাতে লাগলো তার ঘাড়ে। এরপর লোকটিকে বাইরে বের করে আনা হল, গ্রেপ্তার করা হল সবার সামনে। পুলিশ অফিসার কাকু পুপুকে স্যালুট করলেন, তারপর অনেক আদর করলেন। বাবা আর কাকাই তো পুপুর সাহসে মুগ্ধ, গর্বিত। পুপু শুধু ভক্তিভরে মনে মনে তার ইষ্টদেবতা ফেলুদাকে প্রণাম করতে লাগলো।

shobujdeepillust

Illustration by Aditi Chakraborty

A TRANSFORMATION

Prateek Dhar

Robert Rodney went to church on Sundays. He had a perfect Caucasian accent; was very polite, had none but two enemies, David and Daniel. He was a well-built, muscular boy. He got ‘A’s in every test, was respectful to his parents and teachers, and very good in tennis. He wanted to be a bio-engineer when he grew up and looked like Ronald Weasley from the movies.

You would think he is the perfect boy, would you not?

WRONG.

His parents tried to cover up the fact that he still continued to wet the bed even when he was twelve. Every night.

Only one dude knew about his unusual habit. He was Mitchell. Mitchell was the most awesome dude that ever lived. He always wore a blue Aviator jacket, cool shades, and never left home without his smartphone. He was of a short stature, very athletic, and a gamer like Robert.

One fine day, Robert and Mitchell were texting.

Robert: Hey yo, what’s up?

Mitchell: Dude, nothing.

Robert: Did you murder anyone yet?

Mitchell: What?

Mitchell: I am not your friend any more!

Robert: But why not?

Mitchell: You think I am a murderer?? I think I should tell David and Daniel about your habit.

Robert: NO! I SWEAR THAT WAS AUTOCORRECT. I SWEAR I MEANT TO WRITE SOMETHING ELSE.

Mitchell: Oh! was it autocorrect? Sorry….

Robert: I hate you.

Mitchell: I will text them saying it was a lie…

Mitchell: Wait, you hate me? I hate you too!

Don’t you feel awesome and happy right now after reading that text? Does it not remind you of cherries in the spring? Don’t you…

Fine, enough sarcasm for a day.

Robert kept on texting Mitchell that he did not mean what he said, but Mitchell did not budge. He knew Daniel Andrew and David Clarkson were the biggest gossipers of the school. His perfect reputation was going to be ruined because of his ex-best friend.

He screamed at the top of his lungs

“I HATE MY LIFE”

(Echo phenomenon occurs).

His parents rushed to his room. “What is wrong with you?” They asked. After maybe, like 7 seconds of persuasion Robert confessed the entire tale .

He said: ”Mom, Dad. I have always respected you. Mitchell Jeffrey, my best friend, has told Daniel Andrew and David Clarkson about my ’embarrassing habit’ due to a serious miscommunication. Will you help me?”

Mrs Rodney asked “What is Mitchell’s Number?”

“22661279”, replied Robert .

(Mrs. Rodney dialled the number.)

Mrs Rodney: “Hello, who is this?”

Mitchell: “The Jeffrey Residence.”

Mrs Rodney: “May I speak to Mitchell?”

Mitchell : “Yes. This is Mitchell. Who is this?”

Mrs Rodney: “Ok, this is Robert’s mother and how dare you do such a thing to him!”

Mitchell: “It was not intended…”

Mrs Rodney: “Come to my house this instant!”

Mitchell: Sure. “I will be there in 3 mins.”

(Call disconnected).

Mrs Rodney muttered some curses towards the Jeffreys. Meanwhile, Mitchell could not believe his ex-best friend was a complaint box (he was already a bed-wetter).This would seriously reduce his popularity ratings.

DING-DONG!

Mrs Rodney opened the door.

Mitchell: “Hello, Mrs. Rodney, Mr. Rodney, Robert.”

Mrs Rodney (coldly): “Hello.”

Mitchell: “I have got homework to do today. I do not have time. I will make a deal. Do you want to hear it, Robert Rodney?”

Robert: “I sure do.”

Mitchell: “If you do not wet your bed for a week continuously, I will go and tell David and Daniel that I was simply joking. Finally, we will conduct a test on you. David, Daniel, you and I will have a sleepover. We will watch a horror film. I will not stop David and Daniel from teasing you if you wet the bed.”

(Mitchell left the house.)

Mr Rodney said: “Son, you should accept Mitchell’s challenge.”

Mrs Rodney agreed “I think so too. We will make you go to the bathroom before sleeping and make you watch more horror fims.”

Robert asked “Why are you betraying me?”

Mr. Rodney replied “You need to be brave, braver than what you are now.”

A week later it was the time for the sleepover.

The film chosen was ‘Evil Dead’. It had been one of his training films. While everyone else was shivering over the horror scenes, Robert, like a tough man was making jokes on how terrible the acting was.

Midnight; it was finally time for lights out.

Robert’s bed was dry the next morning.

Mitchell congratulated him and asked him if they could be best friends again.

Robert replied: “Yes!!”

He asked David and Daniel if they would now consider not teasing him.

They replied “No. It does not make up for good gossip.”

Robert Rodney was sure there was a law against murdering people in a sleepover. So he asked Mitchell to cool it .

When Robert went home he reported to Mr Rodney about his success.

Mr Rodney was delighted and gave Robert 5000 bucks to spend.

Robert gave 2000 bucks to Mitchell.

They went to the nearby weapon store.

Robert bought an MSMC gun and a bulletproof jacket while Mitchell bought a Remington 870 MS. (They obviously wore fake beards that made them look like adults and printed the licences at home).

The next day Robert and Mitchell walked into school with their weapons.. Whoever insulted Robert was in the coffin within an hour.

TRULY, ROBERT RODNEY HAD TRANSFORMED.

অপরিণত হাফ গদ্য

পার্থপ্রতিম মল্লিক

কয়েকটা শব্দ, পিঠোপিঠি জুড়ে

তৈরী কিছু কথা;

কয়েকটা কথা

পরপর জুড়ে তৈরী হওয়া একটা হাফ গদ্য

মাঝে কিছু যতি চিহ্ন।

একটু জীবন আর খানিকটা অক্ষম প্রেম,

আর কিই বা দিতে পারি।

চকোলেট, ফুল, সোনালী অহঙ্কার তো

সবাই দেয়।

দুর্দান্ত কিছু কবিতা বা

ভালবাসার কিছু সুর-

নিশ্চই দিয়ে রেখেছে কেউ না কেউ।

আমি জাস্ট এমনিই

কয়েকটা শব্দ আর

অপরিণত হাফ গদ্য।

বর্ষামঙ্গল

সঞ্চিতা ধর

borshamangal_e

 

দিনের পর দিন আচ্ছন্ন

বর্ষামেদুর সুরে ৷

পবিত্র জলধারায় সব

মলিনতার অন্ত আজ ৷

মনের মধ্যে উথাল পাথাল-

মনও শুদ্ধ হোক ৷

সহজবোধ্যতার ছন্দে

সব স্তব্ধ হোক ৷

এ শুণ্যতার আভাষ নয়

পূর্ণতার আশ্বাস ৷

যেমন করে গাছের সবুজেরা

আনন্দে উত্তাল, সরব ৷

হিমঝুরি ফুল সুগন্ধে আকুল ৷

Illustration by  Soma Ukeel

 

কংক্রিট

চন্দনা খান

এত কংক্রিট, এত ছাইরং

মাটি ফুঁড়ে যে ওঠেনি, সেতো জানি।

কাল্পনিক আকাশকে অপ্টিক্যাল ইলিউশনে

ছুঁয়ে থাকা

চকোলেট বারের মত সিমেন্টের বার

আই আই এম আমেদাবাদের এই ক্যাম্পাসে

গহন মায়াবী রাত ইলেকট্রিক ব্লু

ধ্রুবতারা সিংহাসনে, আশেপাশে প্রজা প্রজা

খেলে তারা সব

নিবিড় স্তব্ধতায় তারা জেগে ওঠে

যেন ক্ষমাপ্রার্থী, যেন সঙ্কুচিত,

আকাশের অধিকার নিয়ে।

প্রাচীন ধ্বংসের মত দাঁড়িয়ে আছে

সারি সারি কংক্রিট।

এ দৃশ্য দেখার কেউ নেই তো এখানে।

এম বি এ ডিগ্রীপ্রার্থী ছেলেরা এখন

ঘরের খোপে খোপে।

 

কয়েকটি জুঁই ফুল

শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী

 

  • কয়েকটি জুঁই ফুল এনেছি,

রাখব কোথায়?

  • ডাস্টবিনে।

সংক্ষিপ্ত উত্তর।

 

  • কয়েকটি জুঁই ফুল এনেছি,

রাখব কোথায়?

  • খুঁজে নাও

অন্য কোন খোঁপা।

 

  • কয়েকটি জুঁই ফুল এনেছি,

রাখব কোথায়?

  • জ্বালিও না, এই সকালে

ছেলেদের স্কুল, তোমার অফিস।

 

কয়েকটি জুঁই ফুল

ভোরের শিশির মাখা,

বাক্য যেথায় পথ হারাল,

সুরভি লিখেছে গাথা…..

 

  • কয়েকটি জুঁই ফুল এনেছি,

রাখব কোথায়?

  • আমার মাথায়!

ধরা যাক, মাথা মানেই খোঁপা।

koekti-juin-phool

Illustration by  Aditi Chakraborty

বাঁধন ভাঙার গান

সুলেখা বিশ্বাস

bandhonbhangargaanillust

আমি যে সেই নিয়মগড়ের প্রজা

রাজার বিধির বন্ধনে যে অষ্টপাশে বাঁধা।

বেড়ার ভেতর ব্যস্ত থাকি

কাজে বা অকাজে।

তোমার বাঁশি বাজে তখন

অসীম আকাশ মাঝে।

সুখ সাগরে ডুবি ভাবি এটাই আমার দেশ

সুখেই আছি বেশ।

এমন সময়ে প্রলয় এলো ব্যেপে

থরথরিয়ে উঠলো ভুবন কেঁপে।

আবার যখন মেঘ জমে যায়  দিগন্তেরই কোণে।

মনময়ূরী নেচে বেড়ায় পিউ পাপিয়ার বনে।

কিন্তু তখন জলদ ঘন বাজ

নেমে করে প্রচন্ড আওয়াজ।

নিয়মগড়ের বাঁধন হলো ঢিলে

চোখের জলে ভেসে চলি কোন সে অকূলে।

তোমার বাঁশির সুরটি তখন মনের মাঝে এসে

নিয়ে চলে অজানা এক দেশে।

গেয়ে উঠি বাঁধন  ভাঙার গান

সুখ দুঃখের মিথ্যে ডোরের হলো অবসান।

Illustration by Aditi Chakraborty

 

 

রুমাল

অনমিত্র রায়

rumal

‘রুমাল’-এর কথায় প্রথমেই মনে পড়ে সুকুমার রায়। মনে পড়ে হ য ব র ল। সেই বেড়াল, রুমাল ইত্যাদি। মনে পড়ে কিশলয়, লেজের কাহিনি। সেই যে সেই হরিণ, যে তার লেজকে রুমালের মতো নেড়েচেড়ে তার ছানাদের পথ দেখাত!

ঠিক কোন ক্লাস বা বয়স থেকে স্বতন্ত্র রুমাল ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম, প্যান্টের বাঁ-পকেটে তার স্থান হয়েছিল সেসব মনে থাকার কথাও নয়, মনে নেইও। তবে কিন্ডারগার্টেনে টিফিন খাওয়ার সময় টিফিন বাক্সর তলায় একটা রুমাল পেতে নিতে হত, সেকথা বেশ মনে আছে।

সে-রুমালের একটা বিশেষ নাম ছিল বা আছে। তোয়ালে-রুমাল।

বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটা মজার রুমাল-জীবন তৈরি হল। কারণে-অকারণে পকেট থেকে রুমাল বের করে অদৃশ্য ঘাম মোছা বা মুখ মোছার মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চ, যেন হঠাৎ বড়ো হওয়া। কিন্ডারগার্টেনের ঘেরাটোপে রুমাল অতি আবশ্যক একটা বস্তু। একেবারে চলতি ভাষায় বললে বলতে হয়, রুমাল শৈশবের একটা অন্যতম জরুরি প্রপ। কারণ সেই যে, স্কুলবাড়ির সামনের মাঠে ক্লাসের বাকি তিরিশজন বন্ধুর সঙ্গে গোল হয়ে বসে ‘রুমাল-চোর’ আর পিঠে অকাল ভাদ্রের তাল!

বয়েস বদলায়, রুমালও তার ভূমিকা বদলায়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে রাত্তির থেকে নাক সড়সড়। তাই সাতদিন-চব্বিশ ঘন্টা, পকেটে বা হাতে রুমাল।

এদিকে রুমালেরও যে শ্রেণী আছে, ভাগ আছে। মা যে রুমাল নিয়ে যায় ভুল করে কোনোদিন সেই রুমাল নিয়ে স্কুলে গেলে সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকা। বন্ধুরা একবার দেখে ফেললে বলবে ‘লেডিস’ রুমাল নিয়ে এসেছে। বড় হয়ে রুমালের আরও একটা দিক চোখে পড়েছে। পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে দেখতে চোখে পড়েছে, নায়িকা নায়ককে একটা রুমাল উপহার দিচ্ছে, যে রুমালের এক কোণে তার নিজের হাতে সেলাই করা রঙিন ফুল, লতাপাতা অথবা তার নামের প্রথম অক্ষর। কিংবা, রাস্তায় বা মাঠের ঘাসে পড়ে থাকা রুমাল কুড়িয়ে পেয়ে, নায়ক চলেছে তার প্রেমের সন্ধানে।

এই যে এক দীর্ঘ রুমাল-জীবন, এই রুমাল-জীবনে ছোটো থেকে বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি একটা বোধ জেগে ওঠে রুমালের আবশ্যকতা সম্পর্কে। কখনো কখনো মাকে দেখেছি, স্কুল যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে শুধু রুমাল নিতে ভুলে গেছে বলে।সামান্য একটা রুমাল বই আর কিছু তো নয়! অথচ সেই নিরীহ রুমালকেই একটু সরু ভাঁজ করে শার্টের কলার আর ঘাড়ের মধ্যে রেখে রাস্তায় বেরোনোর জো নেই। বড়োরা কেউ দেখে ফেললেই—‘কি ব্যাপার, ডানা গজিয়েছে মনে হচ্ছে? যতসব লাফাঙ্গা, লোফারদের মতো হাবভাব! এক চড়ে. . .’

নিমেষে রুমাল আবার ঘাড় থেকে পকেটে।

লোকাল ট্রেনে যে হকার দাদা অন্য আরও অনেক জিনিসের সঙ্গে রুমালও বিক্রি করেন তাঁর রুমালগুলো আকারে আলাদা, বিশেষ। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো তারা ঠিক রুমাল নয়, হয়তো-বা ‘রুমাল’ নামের আড়ালে গামছার পরিমার্জিত, ক্ষুদ্র সংস্করণ।

এই প্রবল মোবাইল, ট্যাব-এর যুগেও রুমাল ভুলে রাস্তায় বেরোলে কখনো কখনো মনটা খাঁ খাঁ করে বই কী । মনে হয় কী যেন থাকার কথা ছিল, কী যেন নেই!

Illustration by  Aditi Chakraborty

বাঙাল থেকে বাঙালি

সুদর্শনা ধর

bangalbangali

 

সংলাপ ১

ক: ওটা কুমড়া নয় রে, বল কুমড়ো!

খ : আইচ্ছা! কুমড়ো!

ক: কুমড়ো, তাড়াহুড়ো, তানপুরো, পড়াশুনো…এই ভাবে বলবি, কেমন?

খ : আইচ্ছা। আমাকে ওই মুড়োর উপর রাখা মুজোটা এনে দেবে?

ক: আরে আরে, ওটা মোড়ার ওপর মোজা …আ…আ..

খ: কেন? তুমি যে বললে আকার না বলতে?

 

সংলাপ ২

ক: ভাইগ্য না, বলবে ভাগ্য। জইগ্য না, বলবে যজ্ঞ।

খ: আইচ্ছা ।

(দু দিন পর অফিস ফেরত খ)

খ: আইচ্ছা, বাংলা এ 22 কে কি বলে?

ক: কেন? বাইশ!

খ: কেন বাইশ হবে? ভাগ্য, যজ্ঞ এগুলোতে ইকার না থাকলে, ইটাতে কেন থাকবে?

ক: কি বলে এসেছ অফিসে?

খ: আমি তো বললাম বাস, তেস..সবাই এমন করে তাকিয়েছিল যে ভাবলাম বাড়ী এসে তুমাকে জিজ্ঞাসা  করি।

“আমি বাংলায় গান গাই“ প্রতুল মুখোপাধ্যায়র সেই আবেগভরা গান অনেক বাঙালির মনকেই নাড়া দেয়। কিন্তু ধরুন, আমি বাঙালি কিন্তু “বাংলা“ বলিনা। না না, আমি প্রবাসী বাঙালি না। কিন্তু তাও “বাংলা” বলতে বললে আমার ঘাম ছুটে যায়! কি অদ্ভুত, তাই না? মানে আসলে আমি বাঙালিই, কিন্তু আমি যে বাংলা বলি সে বাংলা এ বাংলা নয়। পরীক্ষার ফর্ম, চাকরির সি ভি, পাসপোর্ট, ইত্যাদিতে অবশ্যই লিখি যে আমার মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু আমার মা-বাবা কেউই বাংলা বলেন না। হেঁয়ালী করছি না, আসলে আমি হচ্ছি বাঙাল। আকার ইকার একটু এদিক ওদিক হয়ে গেছে আরকি, হেঁ হেঁ।

অহমিয়া বা অসম এর লোকেরা যখন পঞ্চাশের দশকে আসামে “বঙাল খেদাও” আন্দোলন করেছিল, তখন ওরা বোধয় ভেবেছিল যে ওরা বাঙালিদেরকেই খেদাচ্ছে বা তাড়াচ্ছে। ওরা ঠিক ঠাহর করতে পারেনি যে, বাঙালিরাও এই দলটাকে বাঙালি বলেনা। এই বাঙালরা আলু পোস্তর মর্ম বোঝেনা, পান্তাভাত, কলাই ডাল, সর্ষেবাটাকে খানিক অচেনা বোধ করে, বারোমেসে ষষ্ঠী করেনা, বিয়ের কনেকে পিঁড়িতে তোলেনা, বাসর জাগেনা, ইত্যাদি। কিন্তু এরাও অতি আবেগপূর্ণ ভাবে নিজেদের কে বাঙালি বলে!

মুশকিল হল এই যে এদের মধ্যে অনেকেই দেশভাগের সময় প্রাণে বাঁচতে এপারে চলে এসেছিল। সঙ্গে অল্প টাকাকড়ি আর কাপড়-চোপড়। ঘরবাড়ি, ক্ষেত-পুকুর, ইস্কুল-কলেজ, বন্ধু-বান্ধব সবই পড়ে রইল। রইল শুধু নাম, ভাষা, রান্না আর সামাজিক রীতি নীতির স্মৃতিকে আঁকড়ে থাকার প্রবল ইচ্ছা। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ এই বাঙালদের নিয়ে ভরে উঠলো। এরা অনেকেই নতুন করে ঘরবাড়ি করল। যারা পারল না, না খেতে পেয়ে মরেই গেল, তাদের কথা আমরা অবশ্য জানিনা। কিন্তু সে যাকগে।

এই বাঙালরা পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা, ইত্যাদি করে নিজেদের সমৃদ্ধি আবার ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতে ব্যাপারটা নির্বিঘ্নেই চলছিল, কিন্তু মুশকিল হল যেইনা পশ্চিমবঙ্গে পা পড়ল।

“আচ্ছা আপনারা কি অহমিয়া ভাষা বলছেন?”

“সে কী? আপনারা বাঙালি? তাহলে ভাষাটা এত আলাদা কেন?”

“হি হি! ওটার নাম মকা না, মৌরলা মাছ!” “আরে তেলচুরা আবার কি রে? বল আরশোলা! ঝ্যাং আবার কী? বল ঝাঁঝ! সর্তা আবার কি? বল জাঁতি। বাশপাতা না কাজরী। বুগুইল না থোড়।”

পদে পদে শোধরানো। পদে পদে শোনা যে তুমি ভুল আর আমি ঠিক। যতই “বাংলা” বলার চেষ্টা করে, উঁহু, কিছুতেই হয়না!

হঠাৎ একটা বেমক্কা গল্প মনে পড়ে গেল। সেই যেবার রবীন্দ্রসঙ্গীত এর উপর বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠে গেল, সবাই মনের সুখে এলোপাথাড়ি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, সেবার টিভিতে দেখলাম নচিকেতা গীটার  ঝমঝমিয়ে গাইছে “ঝর ঝর বরিষে বারি ধারা”। দু লাইন গেয়েই বলল, “উঁহু, ওদের মত হচ্ছে না”, বলেই মিচকি হেসে বাকি গানটা গেয়ে গেল।

সে যাই হোক, বাঙালদের বাংলা ঠিক বাঙালিদের বাংলার মত কিছুতেই আর হলনা। বাঙালিদের মুচকি হাসি, কটাক্ষ, আর জোক ও বৃদ্ধি পেল এবং সেগুলো খানিক অভ্যাস ও হয়ে উঠলো। না হয়ে যে উপায় নেই, এ কপিরাইট তো আর কোনদিন উঠবে না ।

দেশ স্বাধীন হবার পর, সিনেমা জগতে হই হই করে এলেন, ভানু বন্দোপাধ্যায় আর গানের জগতে শোনা গেল নির্মলেন্দু চৌধুরীকে। এরা খোলাখুলি বাঙাল ভাষা – এ ক্ষেত্রে, ঢাকাইয়া এবং সিলেটিতে প্রান খুলে পারফর্ম করলেন আর তাই দেখে শুনে বাঙালিরাও প্রীত এবং মুগ্ধ। বাঙালরা তখন যারপরনাই খুশি। হেঁ হেঁ, বলেছিলাম না? আমরাও দেখিয়ে দিতে পারি।

কিন্তু এই নাম যশ অনেকটাই তাৎক্ষনিক হয়েই রয়ে গেল। এবং বাঙালরা অনেকটাই কৌতুক আর কোঁদলের সঙ্গে স্টিরিওটাইপড হয়ে রইল। যথা – বাঙাল কে হাইকোর্ট দেখাচ্ছ? ওই দেখ দেখ, কেমন বাঙালদের মত হাঁটছে।

একদল বাঙাল তো এই ঝামেলা এড়াতে কলকাতা ছেড়ে চলে গেল, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই যেখানে বাঙালির বাংলা বলতে হয়না। সেখানে হিন্দি, ইংরাজি বা লোকাল ভাষা বললেই চলে আর নিজেকে সগর্বে বাঙালি  বলা যায়।

দোষ কারো নয় গো মা। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে হিন্দি ও ইংরিজি পড়ে, কারণ বাংলা খুব কম ইস্কুলেই পড়ানো হয়। শিলং, আগরতলা, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলায়ে বাংলা পড়ানো হয় বটে, কিন্তু সেটা বইয়ের ভাষা, চলতি বাংলা নয়। ঠিক যেমন আমরা বইয়ের ইংরিজি স্কুল এ শিখি, কিন্তু সেই বিদ্যে নিয়ে চলতি বা কলোকুয়াল ইংরিজি বলতে গেলে, লোকে শুনে হেসেই খুন হবে। অতএব যাঁরা কাছাড়, করিমগঞ্জ, শিলং, ত্রিপুরার স্কুলে পাঠ্যবই এর বাংলা শিখলেন এবং অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র আওড়ে গেলেন, তাঁদের কিন্তু বাংলা সাহিত্য পড়া হল, কিন্তু বাঙালি হওয়া হলনা। ঠিক যেমন আমরা প্রচুর শেক্সপীয়ের, কীট্স, ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েও ইংরেজ হতে পারলাম না।

কিন্তু তাই বলে চেষ্টা ছাড়া যায়? সূর্যমুখী ফুলের যেমন সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিন কাটে,বাঙালদেরও অনেকটা সময় কেটে যায় বাঙালি হবার চেষ্টায়। ছেলেমেয়েকে ওই ভাষায় কথা বলতে শেখানো চলবেনা, এই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। তাতে সুবিধে হচ্ছে, সেকেন্ড জেনারেশন অতি সহজেই কলকেতার কেতা-কায়দা রপ্ত করে ফেললেই ব্যাস কেল্লা ফতেহ! আর মিচকি হাসির খোঁচা খেতে হবেনা। অনেকটা আমেরিকাতে যাঁরা সেটল করেন, তাঁদের ছেলেমেয়েদের আমেরিকান অ্যাকসেন্ট শেখার মত।

ক্রমেই মঙ্গলাচরণ হয়ে গেল আশীর্ব্বাদ, বাসি বিয়ে চুপিচুপি সেরে ফেলা হলো, চতুর্থ মঙ্গল হয়ে উঠলো বউ ভাত। যে দেশে মেয়েদের শিক্ষাকে খুব প্রাধান্য দেওয়া হত, বাল্যবিবাহ বা পণ প্রথার প্রচলন ছিলনা, সেই দেশের লোকই এখন ভিনদেশের ভীড়ে মিশে যাবার তাগিদে তড়িঘড়ি মেয়েদের বিয়ে দেবার আয়োজন করতে লাগলো। জুটলো এসে এলাহী তত্বের রীতিও। জামাই ষষ্ঠীর দিনে যেখানে বাড়ির সকল সন্তান সন্ততিকে সমান ভাবে আশীর্ব্বাদ করা হত, সেখানে শুধু জামাই বাবাজীবনের প্রাধান্য বেড়ে চলল |

না না, আবার বলি, দোষ ধরাটা উদ্দ্যেশ্য নয়। এই পরিবর্তনের একটা বড় কারণ, লিপির অভাব। লিপির অভাবে যদিও গান ও পদ্যের মত মৌখিক সাহিত্য রচনা হয়েছে, লিখিত সাহিত্য হওয়া সম্ভব হয়নি। সিলেটিতে ক আর খ; প আর ফ; চ আর ছ; দ আর ধ এর মাঝামাঝি কিছু উচ্চারণ আছে, যা বাংলা হরফ ব্যক্ত করতে পারেনা।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় নিশ্চয়ই বাঙাল বাঙালির এক হয়ে ওঠার বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তখন দলে বিভেদ নয়, ঐক্য বাড়ানোই উদ্দ্যেশ্য ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর, এর এক অন্য প্রতিক্রিয়া হল, আর এই লঘু আঞ্চলিক ভাষা আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা বড়ই শক্ত হয়ে উঠলো। এই নথিকরণের যুগে কি মৌখিক সাহিত্য নিয়ে টিকে থাকা যায়?

তবে একেবারে টেকে না, তা বলা যায়না। মৌখিক সাহিত্যের একটা গুণ হল, এ সাহিত্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক নয়, কারো একার মগজে বা কাগজে তার নিবাস নয়, এই সাহিত্য সমষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকে। লেখার যেখানে সুযোগ নেই সেখানে মগজাস্ত্রই ভরসা। অর্থাৎ, লোকের মুখে মুখে ফেরা। তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরন হল গান।

২০০০ সাল নাগাদ এক বাংলা গানের দল তৈরি হল, নাম দোহার। শিলচর নিবাসী কালিকাপ্রসাদ আর রাজীব, কলকাতা শহরে নিয়ে এলো ঝুলি ভর্তি বিভিন্ন স্বাদের প্রান্তিক বাংলা ভাষার গান। সারি গান, ছাদপেটার গান, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বরাক উপত্যকার গান, চা বাগানের কুলিদের গান, আরও কত কী। ওদের গান বড় সহজ ভাবেই ক্রমে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো আর ওদের মিঠে সুর, ক্ষণিকের জন্যে হলেও, দিল বিভেদগুলো ভুলিয়ে, ফিরিয়ে দিল আহত সম্মান।

তবে ঠিক যেমন আমাকে এই লেখাটা কলকাতার বাংলায় লিখতে হচ্ছে, সবার কাছে সমান ভাবে বোধগম্য হবার জন্যে, দোহারকেও কলকাতার বাংলায় কথা কইতে হয়, সবাইকে তাদের গান শোনানোর জন্যে। অন্য উপায় এখনো বের হয়নি যে!

ছোট-ছোট নাম-না-জানা নদী যেগুলো গ্রাম-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়, তার প্রত্যেকেরই প্রকৃতি আলাদা। গ্রামের লোক সেখানে নাইতে যায়, গরু বাছুর সেখানে জল খেয়ে তৃপ্ত হয়। সবার সেই চেনা স্বাদ গন্ধই প্রাণবায়ু। নদীর ধারে গড়ে ওঠে বসতি, মাঠ-ঘাট। অজানা, অচেনা, অল্প-চেনা, গভীর-চেনা বাংলা ভাষার ঝুলিও ঠিক তেমনি। এই ছোট নদীগুলো যদি বয়েই যেতে পারতো, কোনোদিন যদি মোহনায় মিশতে না হত, তাহলে ভারি মজার দেশ হত, তাই না?

 

Illustration by  Aditi Chakraborty