উড়োচিঠি তোমাকে।।

ডঃ পারমিতা পূর্ণেন্দু পালিত

পুজোর লেখালেখি বা পড়ার অভ্যেস নিতান্তই পুরোনো আমার। লেখার সূত্রপাত পুজোর ছুটির পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াল পত্রিকায় উত্তরণ ঘটেছিল কাঁচা বয়সেই ।কচি হাতের লেখার মস্ত গুণ, আনকোরা স্বপ্ন বোঝাই থাকে অনেক।আর পড়ার অভ্যেস বাবা জেঠুর সূত্রে পাওয়া।মেজজেঠু দিব্যেন্দু পালিত প্রথিতযশা সাহিত্যিক হওয়ার সুবাদে “সাহিত্য” শব্দটি খুব ছোটবেলাতেই মগজে ঠাঁই পেয়েছিল।পুজো মানে চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন বাবার হাত ধরে জেঠুর বাড়ি একবার ঢুঁ মেরে আসা। অবশ্যম্ভাবী জেঠুর কোনো সদ্যপ্রকাশিত বই-এর প্রথম পাতায় স্নেহমিশ্রিত দু’কলম লিখে উপহার দিতেন। বড় উতসাহের সাথে স্কুলে দেখানোর মত একটা জিনিষ পাওয়া হত। আবছা আবছা শুনতাম লেখকেরা কত আগে থেকে পুজোর লেখার প্রস্তুতি শুরু করেন।
তা আমার এখন তাড়া খেয়ে কলম চলছে গড়গড়িয়ে ।আকাশের মুখ ভার। বারান্দার ফরাসি বাতায়ন (French window)দিয়ে দেখলুম, দিশি মৌসুমী ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে পেটমোটা ছাই রঙের মেঘবাবু টিকে। মুখ বেকিয়ে বললে আমায়, “তুমি বরষামঙ্গল লেখ হে, এখন তাই প্রাসঙ্গিক”। আমি আর তাকে বল্লেম না, গতকালের ঝকঝকে নীলে হাশিখুশি সাদা মেঘের পানসিটি ফিস্ফিসিয়ে বলে গেছে, “দেরী হল বটে, চিন্তা করিস না, আমি আসছিই, মা আসছেন যে”।
“মা আসছেন” বড় প্রিয় শব্দ বাঙ্গালীর। এই মা কে? জগদজননি দেশমাতৃকা নন, বড় আপন, আটপৌরে শাড়ি পড়া, সাঁঝবেলায় ধুনোর গন্ধ মাখা, পিদিম জ্বালা, বুকের কাছে ধুকপুকুনির মত জেগে থাকা মা আমাদের। তাইতো পুজো মানে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের থেকে অষ্টমীর অঞ্জলির অপার্থিব সকালে লাল পেড়ের খসখসানি আর পাশের বাড়ির উঠোন কুড়োনো এক গোছা শিউলি ফুল দেখে মা লুকিয়ে মুচকি হাসেন।
পুজো মানে আমার কাছে ইস্কুলের শারদীয়া উৎসব, নাটকের, আলেখ্যর স্ক্রিপ্ট লেখা। আলসে দুপুরে পূজা বার্ষিকী। প্রথম আলোর প্রসাদ খুঁজে পাওয়ার মত গীতবিতানের শরত ঋতুর গান গুলি কণ্ঠস্থ করা। “তোমার ছুটি নীলাকাশে”; শুধু নীল আকাশ নয়, অকালবোধনের কালটির বিশেষত্ব এই যে, সবটুকু জুড়ে পূর্ণতার প্রসাদ। বৃষ্টি ভেজার পর গাছগুলি সতেজ, দীঘির জলে নীলাকাশের প্রতিবিম্ব, কাশের বনে অপু-দুর্গা।
আমার ছেলেবেলার পুজোয় এসবের মাঝে ছিল “পুজোর চিঠি”। চিঠি আসত প্রবাসী বাবার কাছ থেকে। আমার এবং বোনের দুটি আলাদা চিঠি, মুক্তোর মত গোটা অক্ষরে নিচে লেখা থাকত, “ইতি, তোমাদের বাবা”। চিঠি এসেছে, ট্রাঙ্কলের প্রতীক্ষার অবসান, এবার বাবা আসবে। আমাদের পুজোর ঘণ্টা বাজল বলে। আর ছিল চিঠি লেখার ধুম, বিজয়ার পরে, শ্রীচরণেষু বানানটিতে হোঁচট খাইনি কোনোদিনও। পুজোর মধ্যে এসে পৌঁছতো তুতো ভাইবোনদের কার্ড, মা পাশে বসিয়ে লেখাতেন চিঠি। আজ চিঠি কই? সবই তো মেলে, তবু মেলে না কিছুই। সেই যে পুজোর ছুটিতে ইস্কুলের বন্ধুদের একখানি উড়োচিঠি, কোন অন্তরজালে তার আনন্দটুকু ধরতে পারিনা আজ। বাঙ্গালীর চিঠিপত্রের ইতিহাসে সেই যে, “দিলে তুমি সোনা মোড়া ফাউন্টেন পেন”, বলে পুজোর চিঠিটি লিখলেন রবিঠাকুর, আজও তার মেদুরতা অম্লান।
পুজোর মধ্যে লিখতেই হবে দু চার পাতা। না হলে যেন পুজোটা ঠিক পূর্ণ হয়না আমার। এখন এই সুদুর প্রবাসে বসে, তিরিশটা আস্ত শরত পার হয়ে গেলেও পুজোর লেখার আনন্দটা মাটি হয়নি একটুও।
তারই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে একটুকরো বেমানান দুশ্চিন্তা। এই মুঠোফোনের যুগে, আর কতদিন, এবং কীভাবে এই ছোট্টো ভালোলাগার অকৃত্রিম আবেগটুকু তুলে দিতে পারব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে? যে কচি মানুষ টা এখন তার দ্বিপ্রাহরিক খেলার ফাঁকে আমার ডায়েরির পাতার নীলচে হরফের মাঝে সরসরিয়ে চলা কলমটিকে দেখে অবাক বিস্ময়ে হেসে উঠছে, পারব তো এইটুকু ঐতিহ্য তুলে দিতে আমার আত্মজের হাতে?
কেমন যেন সময়টা বদলে যাচ্ছে মাত্র। পুজোর আগের অকাল বরিষণের মতই মন জুড়ে শুধু অজস্র প্রশ্নচিহ্ন আর না পাওয়ার ক্ষোভ নিয়ে বিদঘুটে নীল তিমির বুকে মিথ্যে আশ্রয় খোজা মরণ খেলায় মেতে ওঠা ছানাগুলোকে যদি ছোঁ মেরে উড়িয়ে আনতে পারতো মা নিকষ আঁধার থেকে, যদি মা দুগ্গার ত্রিশুলের এক খোঁচায় সমস্ত দুঃখবোধ মিলিয়ে যেত, তবে বোধহয় সত্যি দানবদলনী হতেন মা।
এবার পুজোয় লেখা জুড়ে তাই অকালে নিভে যাওয়া তেষট্টিটা সন্ধ্যেপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে চাই। এবার পুজোয় তাই, যে খবরগুলো না পড়তে পারলে খুশি হতেম, তাদের একটা কাগুজে প্লেন বানিয়ে ছুঁড়ে দিলাম শরত মেঘে। জানলার বাইরের, পরিসর কমে আসা নীলাভ আকাশ্টাকে ধরে রাখতে চাইছে, তাকে লিখে দিলেম আজ, ভাল থেকো বন্ধু। আমার পুজোর উড়োচিঠিরা এখনও স্বপ্ন দেখার সাহস করে যে! এখনও তাদের মনের চোরকুঠুরির দরজা খুলে মুক্তি দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করি, মা নিষাদ!

আগমনী

কৃষ্ণা ব্যানার্জী

মা আসছেন, মা আসছেন
বলে উঠে গেল রব,
চারদিকেতে খুশীর বান
আনন্দতে মাতবে সব,
ডাকবে সবে মা মা বলে
দেবী তুমি সবার কাছে
খুবলে খাবে সুযোগ পেলে,
হোক না বারো, মেয়ে তো বটে
হতে পারে সাত বা সত্তর, ফুটপাতে
বা রাজপ্রাসাদে,বাসে,ট্রেনে, ট্যাক্সিতে,
কোথাও যে তোর নেই বাঁচোয়া
শরীর, কেবল শরীর খোঁজা,
শরীর ছাড়া আছেটা কি
মেয়ে হয়ে যে জন্মেছি
এটাই বড় পাপ করেছি,
মরতে হবে রাতবিরেতে
ভাসতে হবে খালের জলে
মোমবাতিটা জ্বলতে পারে,
ইচ্ছে হলে তোমার, আমার,
ইচ্ছে মত বাঁচব না তো
মরব যে তোর ইচ্ছে মত,
তবুও মা আসবে আবার
ডাকবে সবে মা, মা বলে
মা যে আসে, যায় যে চলে,
মেয়ে যে মরে কার ইচ্ছেতে,কে বা জানে!!!

Illustration by Somali Sarkar

টীনটোরেটোর ছবি

সায়ন্তন ভট্টাচার্য

গতবছর, নভেম্বরের কুড়ি। উত্তর ইতালির কাস্তেলেভেচ্চিও মিউজিয়ামে সন্ধ্যে নেমে আসছে, সাথে হালকা হাওয়া। গার্ডদের শিফট বদলের সময় আচমকাই গোটা মিউজিয়াম কেঁপে উঠল। তিনজন মুখোশধারী আর্মড রবার একে একে এগারটা ছবি চুরি করে পুলিশের নাকের সামনে দিয়ে পালাচ্ছে, সবাই দেখছে ফ্রেমের বর্ডার বরাবর চাকু চালিয়ে নিখুঁত হাতে তিনজন ক্রিমিনাল কেটে নিচ্ছে একের পর এক মাস্টারপিস যাদের মধ্যে, না, টীনটোরেটোর যীশু নেই, রয়েছে তাঁর আঁকা দুর্মূল্য কিছু মেল পোর্ট্রেট আর পিটার পল রুবেন্সের ১৬২০’র ওয়র্কশপ থেকে কালেক্টেড সামান্য কয়েকটা কাজ। ছবিগুলো এমন কিছু ফেমাস নয়, পরের দিন প্রেস কনফারেন্স থেকে জানা গেল এগারোটা পেইন্টিঙের সব মিলিয়ে দাম ছিল মোটে পনেরো মিলিয়ন ইউরো।

এবার সংখ্যার একটা মজা আছে, আমরা যতক্ষণ না সেটার প্রকৃত ভ্যালু বুঝতে পারি, অঙ্কের হিসেব বিশেষ মাথায় ঢোকেনা…পনেরো মিলিয়ন ইউরো হল একশো নয় কোটি, আটত্রিশ লক্ষ, একাত্তর হাজার দুশো চার টাকা। মানে একজন মধ্যবিত্ত ভারতীয় চাকুরিজীবী’র অ্যানুয়াল ইনকাম ৬ লাখ অ্যারাউন্ড ধরলে বিশ’এ নভেম্বর, ২০১৫ তে তিনজন মুখোশধারী লুম্পেন এসে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে প্রায় চল্লিশজন মধ্যবিত্ত মানুষের গোটাজীবনের আয় লুট করে পালিয়ে গেছিল। তবে অন্যান্য আর্ট থেফটের কাছে এই ঘটনা বাচ্চা, পৃথিবীর ইতিহাসে পেইন্টিং চুরির যে কত রোমহর্ষক ঘটনা আর তাদের ঘিরে টাকার ছড়াছড়ি রয়েছে তার হিসেব নেই।

আকাশ কালো করা বিকেল, সমুদ্রে ওঠা ভয়ানক ঝড়ে নৌকোটা এই ওল্টালো বলে! যাত্রীদের সবার নাজেহাল অবস্থা, কেউ বমি করে ফেলছে তো কেউ হাউমাউ করে কাঁদছে, কেউ পাল আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে…শান্ত কেবল একজন- যীশু, তিনি উদাস মুখে বললেন, “হোয়াই আর ইয়ে ফিয়ারফুল? ও ইয়ে অফ লিটল ফেইথ?” ছবিটার নাম ‘দ্য স্টর্ম অন দ্য সি অফ গালিলি’, ১৬৩৩ এ রেমব্রান্টের আঁকা একমাত্র সি ল্যান্ডস্কেপ যেটা ১৯৯০ সাল অবধি ম্যাসাচুসেটস’এর ইসাবেলা স্টেওয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়াম আলো করে রাখত। তারপর? হাওয়া!

ঠিক একই ভাবে সন্ধ্যের শিথিল হয়ে আসা গার্ডদের শিফটকে কাজে লাগিয়ে নকল পুলিশের বেশধারী দু- তিনজন ছিনতাইকারী ৯০ সালের ১৮ই মার্চ তিনটে রেমব্র্যান্ট, একটা ভামেয়ার, পাঁচটা দেগা, একটা মোনে মিলিয়ে মোট ১৩টা পেইন্টিং চুরি করেছিল যার মোট প্রাইস ৫০০ মিলিয়ন ডলার। হিসেবটা আরেকটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক? ৫০০ মিলিয়ন ডলার হল ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে তিন হাজার তিনশো সাতচল্লিশ কোটি ছত্রিশ লক্ষ টাকা। হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ ২০১৫ তে গ্রীসের যে দ্বীপটি কিনেছিলেন তার দাম পড়েছিল ৪.২ মিলিয়ন ইউরো, হিসেব করে দেখলাম সেদিনের লুট করা শিল্পগুলি বেচলে এই রকম ১১০ টা দ্বীপ কেনা যাবে!

পরের অ্যাটাকটা হল ১৯৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর, মধ্যরাত্রে যখন গোটা পৃথিবী মিলেনিয়াম সেলিব্রেট করছে। রাত দেড়টা নাগাদ অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামের ছাদে বেড়ালের মত সাইলেন্ট পদক্ষেপে উঠে এল এক ক্রিমিনাল মাস্টারমাইন্ড, তার হাতে সময়ের অভাব নেই, গার্ডরাও পার্টির নেশায় মত্ত। সেই তস্কর চূড়ামণি ছাতের গ্লাস সিলিং থেকে একটা চৌকো স্ল্যাব কেটে আলাদা করে, সেই ফুটো থেকে মিউজিয়মের ভেতরে স্মোক বম্ব ছেড়ে ফায়ার অ্যালার্ম অ্যাক্টিভেট করে দেয় কারণ ফায়ার রেগুলেশন অনুসারে মিউজিয়ামের ভেতরে আগুন লাগলে প্রহরীদের প্রবেশ নিশিদ্ধ। তারপর? মিশন ইম্পসিবল স্টাইলে রোপ ল্যাডার ঝুলিয়ে ভেতরে ঢোকা এবং ৩ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সেজ্যানের বিশ্বখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ চুরি। বেশি না, চব্বিশ কোটি বাহান্ন লক্ষ চার হাজার ষোলো টাকা। মানে ওই আট ন’টা ল্যাম্বর্ঘিনি অ্যাভেন্তাদর কেনা যাবে মোটে!

এসব হল জাস্ট কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা, আর্ট লস্ট রেজিস্টারের ডেটাবেস অনুসারে গোটা বিশ্বে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৪ লক্ষ পেইন্টিং চুরি হয়েছে এবং কেসদের মধ্যে সলভড হয়েছে জাস্ট ১৮%। ভ্যান গঘ, মোনে, দাভিঞ্চি, গোয়া, রেমব্রান্ট- কে নেই সেই লিস্টে! কিন্তু তখনই এলো আসল প্রশ্ন। কেউ কেন একটা ওয়র্ল্ড ফেমাস পেইন্টিং চুরি করবে? কাজটা যতই ভ্যালুয়েবল হোক, আপনি তো কোনো দোকানে গিয়ে বলতে পারবেন না, “দাদা মোনালিসাটা বেচব ভাবছি, বেশি বার্গেন করবেন না- ওই ষাইট কোটি ধরুন, কাল পে করে দিয়েন!” তবে? কালেকশন বাড়ানোর জন্যে?

আপনি কল্পনা করতে পারেন একজন বিলিওনেয়ার আর্ট এন্থুসিয়াস্ট নিজের রেপুটেশন, সেফটির কথা না ভেবে রোপ ল্যাডার নিয়ে ঝুলে ঝুলে এসব লেজেন্ডারি আর্ট হাইস্ট করছে? না মশাই, ওসব ওশানস ইলেভনে হয়, রিয়েল লাইফে হয়না। রিসার্চ করে পাওয়া গেল এক ভয়ানক তথ্য- এইসব প্রাইসলেস পেইন্টিং আসলে মাফিয়ারাজ্যে গোল্ড লোনের মত কাজ করে, লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট। মানে ভেবে দেখুন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে শুরু করে এফ বি আই হয়ে দুনিয়ার বাঘা বাঘা পুলিশ এজেন্সীরা মাথায় হাত দিলে হতাশ সরকারের আর কী করার থাকে? রিওয়ার্ড ঘোষণা।

তাছাড়া একে লেজেন্ডারি কাজ তায় স্টোলেন- ফলে বিক্রীর অযোগ্য হয়েও পেইন্টিঙগুলোর মার্কেট ভ্যালু রাজারহাটের ফ্ল্যাটের মত সময়ের সাথে সাথে বাড়তেই থাকে। অর্থাৎ নিখুঁত প্ল্যানে চুরি করা পিকাসোর কিউবিজমকে কোনো বড়লোক বাড়ির দেওয়ালে সাঁটানো পাওয়ার চেয়ে কোনো ইতালিয়ান কিংপিনের সিক্রেট ডার্করুমে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকতে পাওয়ার চান্স অনেক বেশি…

আমরা তবে কী বুঝলাম? পেইন্টিং জিনিসটাকে আপনি সিরিয়াসলি নাই নিতে পারেন, অ্যাবস্ট্রাক্ট দেখে বলতেই পারেন সীমাহীন আঁতলেমো, ফ্রিদা কাহ্লো’র সেলফ পোর্ট্রেট দেখে মনে হতেই পারে এর চেয়ে প্রিজমা বেটার, দালি’র ‘প্রিন্টেম্পস নেক্রোফিলিক’ দেখে ভাবতেই পারেন এমন ছবি আপনার ছোটো বোন আঁকে। কিন্তু মনে রাখবেন, একটা পেইন্টিং কেবল কাপড়ের ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি নয়, এক একটা এরা’র রিপ্রেজেন্টেশন, হিস্টোরিকাল খাজানা যাদের একখানি পিস আমাদের কারো কাছে থাকলেও পরবর্তী তিন পুরুষ স্রেফ বিছানায় শুয়ে দিদি নং ওয়ান দেখে কাটিয়ে দিতে পারত…কখনো ভাবেন এগুলোর কথা?

ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। তারপর রং, তুলি নিয়ে বসে যান। কে জানে একদিন আপনার আঁকাও মিউজিয়াম আলো করে থাকবে সুদূর ভবিষ্যতে।

সত্যম শিবম সুন্দরম

বাণীব্রত দে

অবাক আকাশে কত মেঘ ভাসে
হেঁয়ালি হাওয়ার দোলায়
তারই বুক চিরে পাখি যায় উড়ে
বিঘ্ন আমার পথ চলায়
তোমারি জন্যে মেতেছি আনন্দে
তাই গুন্ গুন্ সুরে গেয়ে উঠি সেই গান
ত্বমেব সত্যম ত্বমেব শিবম ত্বমেব সুন্দরম

বুনো ফুলে ছাওয়া অজানাকে পাওয়া
প্রজাপতিরা ডানা মেলে হয় নীল
মেঠো রঙে আঁকা আদরে ঢাকা
দিগন্তে যেন হয়ে গেছে সব লীন
ভাবনায় তুমি চেতনায় তুমি
তাই গুন্ গুন্ সুরে গেয়ে উঠি সেই গান
ত্বমেব সত্যম ত্বমেব শিবম ত্বমেব সুন্দরম

অযুত জোনাকি যেন চকমকি
মিটিমিটি চায় অন্ধকারে
আনাচে কানাচে কিছু স্মৃতি আছে
চুপিচুপি তারা রূপকথা হয়ে যায়
আলোতে তুমি আঁধারে তুমি
তাই গুন্গুন্ সুরে গেয়ে উঠি সেই গান
ত্বমেব সত্যম ত্বমেব শিবম ত্বমেব সুন্দরম

Source: Internet

লক্ষ্মীর পা

শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী


– শুনা হ্যায়, আপ পহেলি বার ঠেকেদারি করনে আয়ে হ্যায়। ঠেকেদার কা মতলব জানতে হ্যায় আপ?
– জি, ওহি…ঠেকেদারি মতলব…গাঁও সে কুছ লেবার লেকে আয়া হঁু। উও লোগ পহেলে খেতি কা কাম করতা থা, অভি ফেক্টিরি বনানে কা কাম করেগা।
– আপকো লাগতা হ্যাঁয় কেয়া, ফ্যাক্টরি বানানে কা কাম ইতনা আসান হ্যায়? কোই ভি কর লেগা?
– স্যার, উও লোগ তো আন-ইস্কিল্ড লেবার হ্যায়। আনপড়, গাওয়ার হ্যায়, পর কংক্রিট ডালনে কা কাম কর লেগা। ম্যায় মানতা হঁু, উও লোগ আপকা শাটারিং উটারিং ইয়া সরিয়া কা কাম নেহি কর পায়েগা। উসকে লিয়ে তো টেরনিং কা জরুরৎ হোগা। লেকিন স্যার আপ দেখ লিজিয়ে গা, হামারে লেবার গ্যাং বহুৎ তাগতদার অউর মেহনতি হ্যায়। ইসি লিয়ে ভরদ্বারাজন সাব আপকে পাস ভেজা।
ব্যাপারটা এতক্ষণে স্পষ্ট হয় কার্ত্তিক ঘোষের কাছে। ভরদ্বারাজন হলেন এই প্রোজেক্টের ডেপুটি প্রোজেক্ট ম্যানেজার। তাঁর প্রধান কাজ সব সাইটে লেবার বণ্টন করা। বয়স্ক মানুষ। বেশি চাপ নিতে পারেন না। অন্য সব কাজে এত অপারদর্শিতা দেখিয়েছেন যে তাঁর প্রধান কাজ বলে যা বলা হল, কালক্রমে সেটিই তাঁর একমাত্র কাজ। সাইটে একটা চুটকি চালু হয়েছে সম্প্রতি, প্রোজেক্ট ম্যানেজার অর্থাৎ বোস সাহেবের দুই ডেপুটিকে নিয়ে। সেটা হল – বিশ্বকর্মার দুই চ্যালা, নিষ্কর্মা আর দুষ্কর্মা। প্রথমোক্ত ডেপুটি ওই প্রথম গোত্রের। এই অসামান্য বিশ্লেষণী শক্তি – বিন্দুতে সিন্ধুকে ধরবার ক্ষমতা স্টোরের দাসবাবু ছাড়া আর কারুর নেই।
কার্ত্তিক ঘোষ বললেন, ‘তব তো আপ সব কুছ সমঝ হি চুকে হ্যায়, বাকী ভি আপ ভরদ্বারাজন সাব সে হি সমঝ লিজিয়ে’।
সতীন্দর শর্মাকে মোলায়েম হাসতে হয়। বুঝতে পারে বেশী বিদ্যা জাহির করাটা ভুল হয়েছে। বলে, ‘নেহি নেহি স্যার, আপ হি সে তো সব কুছ শিখনা হ্যায়। ম্যায় তো পহেলি বার আয়া কন্সট্রাকশন সাইট মে কাম করনে কে লিয়ে। বাতাইয়ে না ক্যায়সে হোতা হ্যায় ই সব মেজারমেন্ট আউর পেমেন্ট বাগারা…স্যার চলিয়ে না, উধার বৈঠতে হ্যায়, ম্যায় চায়ে মাঙ্গাতা হঁু’।
চায়ে চুমুক দিয়ে কার্ত্তিক ঘোষ বললেন, ‘আভি আপ নে যো পুছা, ওহি হ্যায় সবসে কাম কি বাত। কাম তো আপ কর লেঙ্গে, লেকিন প্যায়সা ক্যায়সে মিলেগা, কিতনা মিলেগা, ইয়ে সব সমঝ লেনা বহুত জরুরী হ্যায়’।
অতঃপর কার্ত্তিক ঘোষ সব কিছু বুঝিয়ে দেন। কিছু কাজ হয় মেজারমেন্ট বেসিস এ, কিছু কাজ সাপ্লাই বেসিস এ। কংক্রিট ঢালাই, মাটি কাটা, মাটি ভরা এসবের মেজারমেন্ট হয় কিউবিক মিটারে। লেংথ, ব্রেড্থ, হাইট গুণ করলে ভল্যুম হয়, একথা নিশ্চয় ঠিকেদারের অজানা নয়, বিশেষত যখন তিনি দাবি করছেন নিজেকে ম্যাথেমে্টিক্স অনার্স পাশ বলে। বাকী যে সব কাজ সরাসরি মেজারমেন্ট করার অসুবিধে আছে যেমন হাউসকিপিং বা ঝাড়ু লাগানো, এদিকের মাল ওদিকে শিফটিং করা, সেগুলো সাপ্লাই বেসিস এ করানো হয়, মানে কতজন লেবার কতক্ষণ কাজ করলো, সেই হিসেবে পেমেন্ট হয়। এই যে, কতজন লেবার কতক্ষণ কাজ করলো এবং কীই বা করলো – এই ব্যাপারটা মাত্র তিনজন জানতে পারেন, সাইট ইঞ্জিনীয়ার, ঠিকেদার এবং স্বয়ং ভগবান। মাসের শেষে যখন বিল পাশ হবে, তখন প্রোজেক্ট ম্যানেজার, বিলিং এবং অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট একটু হল্লাগুল্লা করতে পারে, সে দেখা যাবে’খন। মেজারমেন্টের কাজে কোন ঝুট ঝামেলা নেই, ড্রয়িং থেকে সরাসরি হিসেব করে কোয়ান্টিটি বেরিয়ে আসে। সব আইটেমের ফিক্সড রেট আছে, সেই হিসেবে পেমেন্ট হয়ে যাবে।
সতীন্দর বলে, ‘সাব, আপনে তো বহুত আচ্ছাসে সমঝা দিয়া সব কুছ’।
– আউর কুছ পুছনা হ্যায়? ……আরে দেখিয়ে ম্যায় আপকা নাম হি নেহি পুছা। কাঁহা সে আয়ে আপ? মেরা নাম তো আপ কো মালূম হি হোগা।
– জি… মেরা নাম সতীন্দর শর্মা, হাম বিহার সে আয়ে হ্যায়।
– উও তো আপকা বাতোঁ সে হি সমঝ গয়া, বিহার মে কাঁহা?
– জেহানাবাদ জিলা।
– ‘জেহানাবাদ মে কিধর?’, কার্ত্তিক ঘোষ কিঞ্চিৎ ভৌগোলিক গভীরে যেতে চান।
– আরওয়াল কে পাস।
– ইয়ে আরওয়াল বাড়ওয়াল নেহি শুনা কভি।
সতীন্দর কিছুক্ষণ ইতিহাস হাতড়ায়। আরওয়ালের গৌরবময় অতীত কিছু সামনে আসে না। শেষে বলে ফেলে, ‘সাব, উও এইট্টি সিক্স মে হত্যাকান্ড্ হুয়া থা না…পুলিশ ফায়ারিং মে মারে গয়ে থে গরীব কিষাণ লোগ……দুসরা জালিয়ানওয়ালাবাগ….’
কার্ত্তিক ঘোষের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলা করে, বলেন, ‘আরে, তুমহারা উধার তো হর জায়গা মে হত্যাকাণ্ডঅ হোতা হ্যায়’।
সত্যিই লজ্জিত হয় সতীন্দর। বলে, ‘হামারা উধার কা গরিবি, জাতপাত, পলিটিক্স, বেরোজগারি, গুন্ডাগর্দি … আপলোগ সোচ ভি নেহি সকতে সাব…। পিছলে সাল হি তো বাথানি টোলা মে…’
কার্ত্তিক ঘোষ থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘উও সব হিস্ট্রি উস্ট্রি ছোড়িয়ে, অব ঠেকেদার কা আসলি মতলব শুনিয়ে। ঠ সে ঠগ, ক সে কমিনা, দ সে দারুবাজ, র সে রাণ্ডীবাজ’।
শেষ শব্দটি বলার সময় কার্ত্তিক ঘোষের ডান চোখ ছোট হয়ে আসে। একবার চোখ বুলিয়ে নেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সতীন্দরের ফিমেল লেবার দলে।
প্রায় পঁচিশ তিরিশ জনের দল। চার জন মাত্র পুরুষ, বাকিরা সবাই মহিলা। এইসব দলের পুরুষরা মিক্সার মেশিন চালায়, রাজমিস্ত্রির কাজ করে, কেউ রাজমিস্ত্রির হেল্পার। বাকী সব কাজ যেমন, গিট্টী, বালি, সিমেন্ট বয়ে এনে মিক্সার মেশিনে ঢালা, মিক্সারে মশালা মাখা হয়ে গেলে অন্যদিক থেকে সেই কংক্রিট তশলায় (গামলা) ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ঢালাই এর জায়গায় ফেলা এসব কাজ মহিলারাই করে থাকে। বড় ঢালাই হলে, কংক্রিট সরাসরি ব্যাচিং প্ল্যান্ট থেকেই আসে।
কার্ত্তিক ঘোষ অর্থপূর্ণ হেসে বলেন, ‘উস ডেফিনেশন কা হিসাবসে আপ তো ঠেকেদার হি নেহি লাগতে’।
সতীন্দরের বলতে ইচ্ছে করছিল যে আপনি একদিন খুব বড় ঠিকেদার হবেন। এমন সময় ভরদ্বারাজন সাব হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেয়া গোস বাবু, আপ আবি তক ইনকো কাম পে নেই লাগায়া? সুবে সে বৈটে হ্যায় ইয়ে লোগ’।
কার্ত্তিক ঘোষ বললেন, ‘সাব, আভি তো আয়ে ইয়ে লোগ। পুছিয়ে ঠেকেদার কো, ম্যায় সুভেসে কিতনা বিজি হঁু। পিসাব করনে কা ভি টাইম নেহি মিলা’।
ভরদ্বারাজন সাব প্রায়োরিটি ঠিক করে দেন। বলেন, ‘নেয়ি নেয়ি …পহলে পিসাব করো’। বলে দ্রুতই সিন থেকে অন্তর্হিত হন।

অর্কদের অফিসটি তেমন কোন সম্ভ্রম-জাগানো বিল্ডিং নয়, অফিস বলতে যেমন বোঝায়। নিছকই ইটের গাঁথনি আর টিনের চালের তৈরি অস্থায়ী অফিস, যাকে সাইট অফিস বলা হয়। প্রোজেক্ট শেষ হলে, অফিসটিও ভেঙে ফেলা হবে। জায়গাটি রাজস্থানের ব্যাওয়ার শহর থেকে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে। অনেক উঁচু-নিচু, কাঁচা-পাকা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় এই রাবড়িওয়াস গ্রামে। এখানেই চলছে একটি সিমেন্ট কারখানার নির্মাণ কাজ। আর সেই সূত্রেই অর্ক এবং তার দুই বন্ধুর আগমন এই পাহাড়ি রাজস্থানি গ্রামে।
অর্কদের চাকরি পাবারও একটা ইতিহাস আছে। তখন ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল সেমেস্টার পরীক্ষা হয়ে গেছে। কয়েকটা কোম্পানির তখনও ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে আসা বাকি আছে। অর্ক, সপ্তর্ষি আর হারাধান হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। যে-সব কোম্পানির নামের শেষে কন আছে (কন্সট্রাকসনের কন), খুঁজে খুঁজে তাদের অফিসে হানা দিচ্ছে। পারলে ইস্কনেও চলে যায় – এমন অবস্থা। এমন সময় অর্করা খবর পেল, তাদের অন্য তিন বন্ধু যারা রাজস্থান গিয়েছিল, ওই প্রোজেক্টের কাজে, তারা ফিরে এসেছে। সেখানে টিকে থাকা নাকি সহজ নয়। এই সুযোগে কিংবা দুর্যোগে, অর্ক আর সপ্তর্ষি পৌঁছে গেল ওই কোম্পানির এন এস রোড স্থিত সদর দফতরে। সেখানে জনৈক চক্রবর্তী সাহেব ওদের দুজনকে বসিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার নির্যাস এইরকম – প্রথমতঃ, এমন আতুপুতু হলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করা যায় না। দ্বিতীয়তঃ, তিনি আর কোন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছেলেকে সাইটে পাঠাবেন না, কারণ তাঁর অভিজ্ঞতায় যাদবপুরের ছেলেরা একেবারেই কষ্টসহিষ্ণু নয়। তৃতীয়তঃ, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাঁকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে তিনিও যাদবপুরের প্রাক্তনী। কিন্তু তাঁর সময়ে, হাতে-কলমে কাজ শেখার এক অদম্য ইচ্ছে তাঁর এবং অন্য সহকর্মীদের ছিল। তিনি তো নিজের হাতে ভাইব্রেটরও (কংক্রিট থেকে হাওয়া বের করে, পোক্ত করার যন্ত্র) চালিয়েছেন। রাতে ঘূম আসত না। নাইট ডিউটি না থাকলেও হঠাৎ হঠাৎ সাইটে চলে যেতেন – মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতেন কিভাবে ড্রয়িং এর অ্যামোনিয়া প্রিন্ট আস্তে আস্তে মাঝরাত্তিরে কল্পনা থেকে বাস্তব হয়ে উঠছে।
অর্ক মাঝখানে একবার মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল, ‘না স্যার, মানে এইভাবে যাদবপুর বলে একেবারে জেনারেলাইজ করে দেওয়াটা কি ঠিক হবে স্যার? আমাদের একবার সুযোগ দিন, আমরা কথা দিচ্ছি, প্রোজেক্ট শেষ করে তবেই ফিরব’।
কিন্তু চক্রবর্তী সাহেবকে অত সহজে গলানো গেল না। বললেন, ‘না ভাই, আমি ক্যাটাগোরাইজ করে ফেলেছি, আর যাদবপুর নয়’।
অফিস থেকে বেরিয়ে সপ্তর্ষি বলল, ‘যাঃ শালা, এটাও কেঁচে গেল। একবার হারাধন কে ধরতে হবে, ও ব্যাটা একা একা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওর কাছে নিশ্চয় কিছু খবর আছে’। দুই বন্ধু হতাশ হয়ে যাদবপুরের বাস ধরল। তারপর দুঃখ ভুলতে সেলিমপুরের ফুটপাথের দোকান থেকে পেট পুরে পরোটা আর কাবুলি ছোলার তরকারি খেয়ে হোস্টেলে ফিরে লম্বা ঘুম।
দিন তিনেক পরে, হারাধন খবর দিল, ‘আমাদের তিনজনকে কাল একবার চক্রবর্তী সাহেব যেতে বলেছেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নেওয়ার জন্য’। যাকে বলে একেবারে বিনামেঘে পুষ্পবৃষ্টি!
তিনদিন পরে অর্ক, সপ্তর্ষি ও হারাধন হাওড়া থেকে চড়ে বসল তুফান এক্সপ্রেসের স্লিপার ক্লাসে। গন্তব্য দিল্লি। ট্রেনে অনেক অবাঙ্গালী যাত্রী। তিনজনে কান খাড়া করে রইল। যেতে যেতেই যতটা সম্ভব হিন্দি শিখে ফেলতে হবে। হিন্দি সিনেমার কল্যাণে হিন্দি বুঝতে পারলেও হিন্দি বলায় তেমন সড়গড় নয় তিনজনেই। ট্রেন ঢিক ঢিক করে চলতে লাগল। মাথার উপর ফ্যানও ঘুরছে ঢিমেতালে। তিনটে ফ্যানের মধ্যে একটা খুলে নিয়ে গেছে লোকে। একজন বললেন টু ফ্যান থেকেই তুফান নামটা এসেছে! তাই হবে নিশ্চয়, তাছাড়া তো তুফান এক্সপ্রেসের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
দিল্লি থেকে রাতের বাসে চড়ে তিনজনে ব্যাওয়ার এসে পৌঁছল পরদিন সকালে। রাতের অন্ধকারে যাত্রাপথ ভাল করে দেখা হয় নি। মাঝে একবার এক ধাবায় বাস দাঁড়িয়েছিল রাতের খাওয়ার জন্য। ওরা এতই কাহিল ছিল, বাস থেকে নামে নি। শুধু ঘুম চোখে দেখেছিল – বড় বড় উনুনে তন্দুরি রুটি বানানো হচ্ছে, ইতস্তত ছড়ানো দড়ির খাটিয়া, বাল্বের ম্রিয়মাণ আলো, গরগরে মশালাদার তরকারি নিয়ে ধাবা কর্মচারীদের ছোটাছুটি। হাইওয়ের দুধারে যে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের স্তূপ ছিল, ভোর হতে বোঝা গেল, সেগুলো আসলে পাহাড়ের শ্রেণী – আরাবল্লি পর্বতমালার অংশ। সকালে এরকমই দুই পাহাড়ের মাঝখানে দেখা গেল এক অবিস্মরণীয় সূর্যোদয়!
ব্যাওয়ার শহরটি আজমীর থেকে আরও পশ্চিমে যোধপুর যাওয়ার পথে পড়ে, প্রায় ঘণ্টা খানেকের জার্নি। ওদের থাকার ব্যবস্থা হল আদর্শনগরে কোম্পানির মেসে। কাছাকাছি আরও একটি মেস ছিল। তাছাড়া যারা পরিবার নিয়ে থাকতেন তাদেরও অনেকেই আদর্শনগরেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকাল সাতটায় একটি জীপগাড়ি আদর্শনগর থেকে ওখানকার সকলকে নিয়ে সাইটে রওনা হত। অন্য একটি জীপগাড়িতে, প্রোজেক্ট ম্যানেজার ও আরও কিছু স্টাফ, যারা শহরের অন্য প্রান্তে থাকতেন, তারা সাইটে যেতেন।
প্রথমদিন সাইটে পৌঁছে ওরা দেখল, সে-এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। নানা আকার-প্রকারের বিল্ডিং – লাইম-স্টোন ক্রাশার, কোল মিল, সিমেন্ট মিল, সিমেন্ট সাইলো ইত্যাদি। কোনটা মাটির তলা থেকে সবে উঠতে শুরু করেছে, কোনটা তিন-চারতলা অব্দি পৌঁছেছে, কিছু বিল্ডিং আরও উঁচু। কোথাও চল্লিশ ফুট গভীর বড় পুকুরের মত মাটি কাটা হয়েছে, তো কোথাও চারশ ফুট লম্বা কনভেয়ার বেল্টের সারিসারি পিলার।
অর্কর ডিউটি পড়ল লাইম-স্টোন ক্রাশারে, সপ্তর্ষির সিমেন্ট মিল আর সিমেন্ট সাইলো তে, হারাধনের লাইম-স্টোন স্ট্যাক-পাইল এ। সাইটে আরও অনেক কোম্পানি আলাদা আলাদা কাজে যুক্ত। সাইটের একপাশে লেবার কলোনি – লোহার রড, জি আই শিট, ভাঙা ইট, ত্রিপল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি সারি সারি ঘুপচি ঝুপড়ি – প্রায় সুকুমার রায়ের ‘বুড়ীর বাড়ি’র মতোই। তিনজনে সাইটে ঘুরতে ঘুরতে আরও দেখতে পেল – দুটো ক্যান্টিন। সেখানে জিলিপি, শিঙাড়া, দইবড়া, পুরী, গুলগুলা পাওয়া যাচ্ছে। গুলগুলা হল টেনিস বলের সাইজের একটি খাদ্যবস্তু, বোধ হয় ময়দা আর গুড় দিয়ে তৈরি।
সাইটে গিয়েই ওরা বুঝতে পারল, ওরা ‘লাইনে’ এসে গেছে, লাইন অর্থাৎ কন্সট্রাকসন লাইন। এই লাইনটা যে অন্যান্য লাইন থেকে একেবারেই আলাদা, সে-কথাটা রাজমিস্ত্রি, ঠিকাদার, মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান থেকে শুরু করে প্রোজেক্ট ম্যানেজার পর্যন্ত সকলেই নানা ভাবে, নানা ভাষায় বোঝাতে লাগলো। জানতে পারল নির্মাণ শিল্পের অ আ ক খ। কাজকে বলে প্রোজেক্ট, যারা কাজ দেয় তারা ক্লায়েন্ট, যারা নকশা বানায় তারা কন্সালট্যান্ট, আর যারা কাজ করে তারা কনট্রাক্টর। বোঝা গেল, অর্করা যেহেতু কনট্রাক্টর কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছে, ক্লায়েন্ট ও কন্সালট্যান্ট এর কাছ থেকে নিয়মিত গালি খাওয়াই তাদের বিধিলিপি। কলেজে ওদের রাস্তা, বাড়ি, ব্রিজ ডিজাইন করা শিখিয়েছিল, কিন্তু পাগলা ক্লায়েন্ট তাড়া করলে কী করতে হবে, সে-কথা কোন ‘নোটবুকে’ লেখেনি।

কার্ত্তিক ঘোষের সঙ্গে ঠিক জমল না সতীন্দরের। ভদ্রলোক এত খুল্লামখুল্লা সব কিছু বলেন, সতীন্দরের মনে হয়, সে বুঝি বিহারের কোন সরকারী দপ্তরে বসে আছে। তাছাড়া, লছমির দিকে খুব বাজে ভাবে তাকান। তাই সতীন্দর এখন ভার্মা সাহেবের সাইটে কাজ নিয়েছে। সেখানেই আলাপ হল অর্কর সঙ্গে। মাঝে মাঝে গল্প-স্বল্প হয়। ভার্মা সাব – অর্কর বস, একটু রেগেও যান। অর্ক কে বলেন, ‘বাবু, আপ ইঞ্জিনীয়র হো, কলেজ সে নয়ে নয়ে নিকলে হো, থোড়া ডিস্ট্যান্স মেনটেন করো ঠেকেদার সে। ইতনা মৎ সমঝো উনকা দুখ-দর্দ’।
অর্ক সতীন্দরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার সঙ্গে লছমির সম্পর্কঅ কেয়া হ্যায়?’
তারপর দশ মিনিট লক্ষ্মীর পাঁচালী শোনার পর অর্ক মোটামুটি যা বুঝতে পারল, সেই একই প্রেমের গল্প ঃ উঁচু জাত-নিচু জাত, ধনী-গরিবের সেই চিরন্তন দ্বন্দ্বমূলক প্রেমবাদ। সতীন্দর ভূমিহার আর লছমিরা দলিত, অচ্ছুৎ। ভূমিহীন কিষাণ। ভূমিহারদেরই আখ, ভূট্টা, গেঁহু ক্ষেতে কাজ করে দিন চলে লছমি এবং ওদের মত দলিত পরিবারের। গ্রামের এক প্রান্তে থাকে দুসাধ, পাসি, ধোবি, চামার, মাল্লা এইসব নিচু জাতের লোকেরা। আজাদির পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। ওদের জীবন বদলাল না বিশেষ। তবে আজকাল ওরাও একজোট হচ্ছে। ওদের মোকাবিলা করার জন্য বিহারে এখন ভূমিহার আর রাজপুতরা মিলে রণবীর সেনা বলে প্রাইভেট সেনাদল বানিয়েছে। আরও আছে নানারকম সেনাদল। শোনা যায় পুলিশ, প্রশাসন, নেতাদের প্রছন্ন মদত আছে। আর্মির হাত থেকেই বেআইনি অস্ত্র চলে আসে। প্রশিক্ষণও দেয় নাকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মীরা। জমির দখল নেওয়া, কিষাণ মজদুরদের ন্যায্য মজুরী না দেওয়া, নকশাল/ দলিত নিকেশ করা, একটা ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা এসবই হল ওদের প্রধান কাজ। ওদের গ্রামেও যে কোন সময় বড় হাঙ্গামা হয়ে যেতে পারে। এই পরিবেশে যদি সতীন্দর আর লছমি বিয়ে করতে চায়, তাহলে দুজনেই যে খুন হয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তাই সতীন্দর পালাতে চায়। সে ঠিকেদারি করবে, সারা ভারতের কন্সট্রাকসন সাইটে সাইটে ঘুরবে। লছমি থাকবে বাড়িতে, তাকে সে সাইটে কাজ করতে দেবে না। বঙ্গালে চলে যাবে। শুনেছে, বঙ্গালে নাকি জাত টাত নিয়ে অত কেউ মাথা ঘামায় না। পালিয়ে যাবে কোন ছোট গ্রামে, সেখানে কেউ কোনদিন ওদের খোঁজ পাবে না। ছোট মাটির বাড়িতে থাকবে – এক সকুন কি জিন্দেগি জিতে চায়।
অর্ক সব শুনে বলল, ‘আপনি তো দেখতা হ্যায় একেবারে দৈত্য কূল মে প্রহ্লাদ’।
– কেয়া, কেয়া বোলা আপনে?
– বাদ মে বুঝাউঙ্গা, আগে হিন্দিটা ঠিকসে শিখনা পড়েগা।
প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন ঘটনা ঘটে ওদের জীবনে। মেসে ফিরে রাতে শুয়ে শুয়ে গল্প হয় তিনজনে। আজ বাপি মণ্ডল ধরেছিল সপ্তর্ষিকে। বাপি হল এক ঠিকেদার, মালদা থেকে লেবার এনেছে। মালদা থেকে আরও একজন ঠিকেদার এসেছে, নুরুল ইসলাম। বাপির সঙ্গে সবসময় একটা ট্রিপ্লিকেট বুক থাকে, তাতে মেজারমেন্ট আর সাপ্লাই লেবারের হিসেব লেখা থাকে। বাপি এসে সপ্তর্ষিকে বলছিল, ‘আপনি তিরিশ জনের সাপ্লাই লেখে দ্যান, হাফ ডে। আপনার সাইটে ঝাড়ু লাগিয়েছে, সাফাই করেছে, মাল মেটিরিয়াল স্ট্যাক করেছে’।
সপ্তর্ষি বলল, ‘সে তো এক-দেড়ঘন্টার কাজ ছিল, তারপরে তো আপনার লেবাররা অন্য সাইটে ঢালাই করতে চলে গেছে। আর লেবার আমি গুনেছিলাম, বুড়ো-বাচ্চা সব মিলিয়ে আঠার জন ছিল’।
বাপি সুর করে বলতে লাগলো, ‘লেবারের আসতে যাতে সময় লাগে না? আপনি গিণতি করে দেখেছেন সব? কত লেবার পানি পিতে গেছিল, কতজনায় পিসাব করতে গেছিল, আপনি তার হিসাব রেখেছেন?’
সপ্তর্ষি বলল, ‘কেন? এখানে আসার সময় কি সিনেমা হলের ইন্টারভ্যাল হয়েছিল যে সবাইকে একসঙ্গে মুততে যেতে হল?’
– তাহলে আপনি তিরিশ জনের হাফ-ডে সাপ্লাই লিখবেন না?
– না। আমার হিসেবে যা হয়েছে তাই লিখব।
– হামি যদি এখন আপনাকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে ঢালাই করে দিই, কেউ আপনাকে বাঁচাতে আসবে?
– হামিও যদি আপনার পাছায় লাথি মেরে সাইট থেকে বের করে দিই, কোন বাপ আপনাকে বাঁচাতে আসবে?
– মুখ সামলে কথা কইবেন। বাপ তুলবেন না। আমি কার্ত্তিক ঘোষকে রিপোর্ট করব।
– করগে যা শালা। আমাকে কার্ত্তিক ঘোষ দেখাচ্ছে……রাগে গজগজ করতে করতে বাপি মণ্ডল চলে যায়।
সাইটের অন্যদিকে কাজ করছে নুরুল ইসলামের দল। ভারি অমায়িক মানুষ। আগে তাদের অনেক জমিজমা, আমবাগান ছিল, গঙ্গার ভাঙনে সব গেছে জলের তলায়। এখন পার্ট টাইম ঠিকেদারি করে। মাটি কাটার কাজে তার লেবাররা বিশেষ দক্ষ। ভোর থেকে এসে কাজে লেগে পড়ে। গায়ে ফুলশার্ট অথবা গেঞ্জি, লুঙ্গি হাঁটুর উপরে গোটান। সঙ্গে বড় বড় ঝোড়া আর কোদাল। ঝোড়ার ভেতরের দিকে সিমেন্ট ব্যাগ পাতা, যাতে মাটি বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারে। অন্য ঠিকেদারের লেবাররা যখন সাইটে পৌঁছয়, ওদের ততক্ষণে ঘণ্টা তিনেক কাজ হয়ে গেছে। তারপর ওরা নাস্তা করতে যায় লেবার কলোনিতে। মাটি কাটায় পাল্লা দিতে হয় যন্ত্রের সঙ্গে। এক সর্দারজি বসে আছেন বিশাল এক্সক্যাভেটর মেশিনের কেবিনে। সর্দারজিও বিশাল। দাড়িগোঁফের ফাঁকে ঈশ্বরের মত রহস্যময় হাসি। একবার দেখেন মালদা গ্যাং কে। পরক্ষণেই মেশিনের ধাতব হাত-নখ ঢুকিয়ে দেন মাটির গভীরে। এক মুঠো মাটি নিয়ে মেশিন ঘুরে যায় টিপারের দিকে, সেখানে মুঠো আলগা করে মাটি ঢেলে দেন তিনি। কয়েক মুঠো মাটিতেই টিপার ভরে যায়, তারপর মাটি নিয়ে রওনা হয়, সাইটেরই অন্য জায়গায় স্তূপ করে রাখে। মালদা গ্যাং ও দেখে সর্দারজি কে। কী অবলীলায় সর্বত্র বিচরণ করছে ওই যন্ত্র-খনক। খর্বকায় মানুষগুলি মাথায় মাটিভর্তি ঝোড়া নিয়ে আরও খর্ব, নুব্জ হয়ে যায়। নদী নিয়েছে জমি বাড়িঘর, যন্ত্র বুঝি বা কেড়ে নেয় পেটের ভাত। প্রাণপণে মাটি কাটে মালদা গ্যাং!
সাইটের সামনেই এক অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট কাঁটা গাছ, পাথর, কোনদিকে বালির আস্তরণ অনেকটা ঢাল জুড়ে। ছাগল, ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। একটা মাইনিং কোম্পানি ড্রিলিং করছে পাহাড়ের উপরে। ওই পাহাড়ের পেটের ভিতরেই আছে লাইমস্টোন বা চুনাপাথর – সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল। লাইমস্টোন প্রথমে এসে জমা হবে ক্রাশারে, সেখান থেকেই পরে, পুরো সিমেন্ট প্ল্যান্ট জুড়ে নানা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে সিমেন্ট তৈরি হবে এবং শেষে সিমেন্ট সাইলোতে জমা হবে। তারপর সেখান থেকে প্যাকিং করে ফ্যাক্টরির বাইরে বেরিয়ে যাবে।

আমি যত দূরেই যাই
আমার সঙ্গে যায়
ঢেউয়ের মালা গাঁথা
এক নদীর নাম –
আমি যত দূরেই যাই।
আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোন
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
আমি যত দূরেই যাই।
লিখেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আজ এই শীতের রাতে, রাজস্থানের ব্যাওয়ার জেলায় রাবড়িওয়াস গ্রামে নির্মীয়মাণ সিমেন্ট কারখানার প্রান্তরে, পঙক্তি ক’টি হানা দিল অর্কর মাথায়। সিমেন্ট সাইলোর কাজ চলছে। সাইলো হল সিলিন্ডারের আকৃতির একটি কংক্রিট স্ট্রাকচার। এখানে দিন রাত একটানা ঢালাই চলতে থাকে যতক্ষণ না সাইলো নির্ধারিত উচ্চতা অবধি পৌঁছয়। এই স্ট্রাকচারে এক বিশেষ পদ্ধতির শাটারিং ব্যবহার করা হয়। শাটারিং খোলার দরকার হয় না, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় তা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে, ঢালাই ও চলতে থাকে। সাইলোর যদি ভাষা থাকতো, পাশের বড় সাইলোকে বলতে পারত, ‘দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’।
মাটি থেকে প্রায় দেড়শ ফুট উঁচু সাইলোর ডেকে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক। গভীর রাত। হু হু করে হাওয়া বইছে। সোয়েটার, জ্যাকেট, টুপি, গ্লাভস পরেও ঠাণ্ডাকে কাবু করা যাচ্ছে না। উঁচুতে থাকার ফলে হাওয়ার বেগও প্রবল। ঢালাই চলছে। নীচে থেকে মেশিনে করে কংক্রিট উপরে উঠে আসছে। লেবাররা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঢেলে চলেছে সেই কংক্রিট। জেনারেটর, মিক্সার, ভাইব্রেটরের যান্ত্রিক শব্দ। তারই মাঝে কিছু দৃশ্যের জন্ম হয়। ধান কাটা হয়ে গেছে। শূন্য মাঠ। মাঠে পড়ে থাকা ধানের শিষ কুড়িয়ে নিচ্ছে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা। লুকোচুরি খেলছে মেঠো ইঁদুর। ধান বিক্রি করে যে-কটি টাকা পাওয়া যাবে, তাই দিয়ে মকর সংক্রান্তির মেলায় কিনে নেওয়া যাবে কিছু স্বপ্নে-দেখা খেলনাপাতি। ক্ষেতের মাঝখানে ছেড়ে রাখা ধানের শেষ আঁটিটি পূজো করা হল সর্ষে ফুল দিয়ে, তারপর কাস্তে দিয়ে কাটা হল। মাথায় করে তাই নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে চলেছে একটি বালক। সঙ্গে শাঁখের শব্দ, পেতলের গাড়ু থেকে জলের ধারা। পেছন ফিরে তাকাতে নেই। সেই ধানের আঁটিটিই পরে রাখা হবে খামারের মাঝখানে। সেখানেই খামার-লক্ষ্মী পূজো হবে মকর সংক্রান্তিতে। উঠোন জুড়ে আলপনার কারুকার্য। ফুল, লতাপাতা, কুলো, ধামা, লাঙল, মই, প্যাঁচা, লক্ষ্মীর পা। সন্ধ্যে থেকেই শেয়াল কিংবা প্যাঁচার ডাকের জন্য প্রহর গোণা। প্রতিটি ডাকের সঙ্গে শঙ্খধ্বনি, জলের ধারা, খামার প্রদক্ষিণ। ছোট্ট খালের জলে তুসু বিসর্জন। গানের লড়াই – আমাদের তুসু…..তোদের তুসু……। পুলি পিঠে, খেজুর গুড়, চালের গুঁড়ি ও ফলের কুচি দেওয়া মকর। খেজুর রসের অপার্থিব ভোর।
কত কীই তো জানা গেল এই কয়েক মাসের প্রবাস জীবনে! বড় কাঁচি দিয়ে কেটে উপরে দই ঢেলে শিঙাড়া পরিবেশন, গুড়ের চা, উটের গাড়ি, কাঁটা না বেছেই উটের কাঁটাগাছ খাওয়া, টিন্ডের তরকারি (অর্কদের পছন্দ না হলেও, উটকে পরমানন্দে কাঁচা টিন্ডে খেতে দেখা গেছে), খাটো ধুতি আর মাথায় পাগড়ি পরা রাজস্থানি পুরুষ, আগলালম্বিত ঘোমটা দেওয়া রাজস্থানি মহিলা, ‘রাজকীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়’ থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি দপ্তরের রাজকীয়তা, রাজস্থানি বিয়ের ‘সংগীত’ অনুষ্ঠান আর বাঙালিদের বাংলা ভুলে যাওয়া। ওদের বিলিং ইঞ্জিনিয়ার দাসদা একবার ট্রেনে আগুন লাগার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার ‘আগ’ ‘আগ’ করছিলেন। আগ থেকে আগে বঢ়তে তাঁর যথেষ্ট সময় লেগেছিল, দু-চারবার হোঁচট খেয়ে শেষ পর্যন্ত আগুনে পৌঁছেছিলেন। দুপুরের খাবার আসত ব্যাওয়ারের মেস থেকে, সেই সময় সবাই গিয়ে সাইট অফিসে জড়ো হোত। মঙ্গলব্রত মুখার্জি ছিল প্রায়-পার্মানেন্ট মেস ম্যানেজার। ডিম খাইয়ে খাইয়ে সবার মঙ্গল করাই বোধ হয় তার জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল – মেনু জিজ্ঞেস করলেই বলত, ডবল ডিমের আন্ডা কারি। এই সব ঘটনাপ্রবাহের ভেতরেও, অর্কর অবচেতনে কোথাও রয়ে গেল – নিকোনো উঠোন, সারি সারি লক্ষ্মীর পা!
সেদিন সতীন্দর সাইটে এল রাগে গরগর করতে করতে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।
সতীন্দর বলল, ‘ম্যায় আভি যা কে বোস সাব কো কমপ্লেন করুঙ্গা। ক্যায়া চল রাহা হ্যায় ইয়ে লেবার কলোনিমে?’
অর্ক জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যায়া হুয়া?’
জানা গেল, কাল রাতে লেবার কলোনিতে মদের আসর বসেছিল। সেটা অবশ্য নতুন ঘটনা কিছু নয়, এরকম দারুপার্টি মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে। কয়েকজন ঠিকেদার, প্ল্যান্ট অপারেটর, হেল্পার, মেকানিক, ইলেক্ট্রিসিয়ান, ফোরম্যান, সুপারভাইজার সবাই মিলে মদ মাংস সহযোগে আড্ডা চলে। এক-আধজন, নাইট শিফটের ইঞ্জিনিয়ারও জুটে যায় কখনও সখনও। কালও সেই রকম পার্টি চলছিল। তারপরই হঠাৎ মাঝরাতে লছমিদের ঝুপড়ির টিনের দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা পড়তে থাকে। দরজা খুলে কয়েকজন মহিলা বাইরে এলে, মাতালরা তাদের হাত ধরে টানাটানি করতে শুরু করে। সেইসময় মহিলাদের চিৎকারে, কলোনির অনেকেই বাইরে বেরিয়ে আসে। দুপক্ষের হাতাহাতি শুরু হয়। কিল-চড়-ঘুসিতে আহতও হয় অনেকে। এরই মধ্যে যাদের নেশা কম হয়েছিল, তারা সবাইকে শান্ত করে ঝুপড়িতে ফেরত পাঠায়। বলে দেয়, এসব কথা যেন বোস সাহেবের কানে না পোঁছায়। সতীন্দরকেও এক ঠিকেদার বলেছে, ‘ইয়ে সব বাত লেকর আপ যেয়াদা হল্লা মত করো। সাইট মে অ্যায়সা হোতা হ্যায়। আপ পহেলি বার ঠেকেদারি করনে আয়ে হো, আপকো যেয়াদা মালুম নেহি হ্যায়। হাম আপস মে ব্যায়ঠকে মামলা সুল্টা লেঙ্গে। আপ বোস সাব কো কমপ্লেন মত করনা’।
এসব যে নিছক পরামর্শ নয়, আসলে হুমকি – বলার ধরণ দেখে তা পরিস্কার বুঝতে পারে সতীন্দর। তবে সেও ভুমিহার, এত সহজে ওদের ছেড়ে দেবে না। আজ সতীন্দরের দল কাজে আসেনি। যতক্ষণ না এই ঘটনার বিচার হয়, ততক্ষণ ওরা কেউ কাজে আসবে না। লছমি আর তার সঙ্গের কয়েকজন তো ওই ঘটনার পর সারারাত ঘুমোয়নি, একটানা কেঁদেই চলেছে। এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সতীন্দর অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কোন ফল হয় নি।
ঘটনার সময় সতীন্দর লেবার কলোনিতে ছিল না। ঠিকেদাররা প্রায় সবাই সাইটের বাইরে, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ‘রাস’ নামে এক জায়গায় আলাদা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। সেটাও প্রায় গ্রাম, তবে কয়েকটা মুদিখানার দোকান আছে, সব্জি বাজার বসে, ওষুধের দোকান আছে, অংরেজি শরাবের দোকান আছে – ব্র্যাকেটে লেখা ‘ভাও মে ভারি কমি’। সতীন্দর ঠিক করল এবার থেকে সে একটা মুন্সি রাখবে, লেবার কন্ট্রোল করার জন্য, যে সবসময় লেবারদের সঙ্গে থাকবে। ফিমেল লেবারদের একা ছেড়ে দেওয়াটা নিরাপদ নয়। তবে সবার আগে বোস সাবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বোস সাহেব মন দিয়ে শুনলেন সতীন্দরের কথা। ঘটনার সময় যারা ছিল তাদের প্রত্যেককে ডেকে পাঠিয়ে তাদের বক্তব্য শুনলেন। বোস সাহেবের চোখ কান সব সময় খোলা থাকে। অল্প সময়েই বুঝতে পারলেন কারা জড়িত এই ঘটনায়। ডাকলেন সেই ঠিকেদার, অপারেটর, হেল্পার, মেকানিকদের। তারপর সতীন্দরের সামনেই তুমুল গালিগালাজ করলেন সবকটাকে। প্রায় মারতে বাকি রাখলেন। পরিস্কার বলে দিলেন, এটাই লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর এরকম ঘটলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সাইটের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। পুলিশ কেস হয়ে যাবে। সবাইকে দিয়ে সতীন্দরের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ালেন।
সতীন্দর মোটামুটি খুশী হয়েছিল বিচার প্রক্রিয়ায়। কিন্তু লছমি এবং আরও চার-পাঁচ জন মহিলা আর থাকতে চাইল না সাইটে। অগত্যা সতীন্দর ওদের সঙ্গে একজন লোক দিয়ে ওদের বিহারে পাঠিয়ে দিল। কিছুদিন পরে সে নিজে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।
সতীন্দর মনমরা হয়ে ঘোরে সাইটে। অর্ককে বলে, ‘গরীব লোগো কা কোই ইজ্জৎ নেহি হোতা। গরীব হোনা পাপ হ্যায়, আওরত হোনা পাপ হ্যায়, আউর গরীব আওরত – উয়ো ভি নীচা জাতকা, উসকা তো মর যানা হি আচ্ছা হ্যায়’।
ডিসেম্বরের সকাল। ভগবান শুনেছিলেন সতীন্দরের প্রার্থনা! কাল রাতে খুন হয়ে গেছে লছমি পাসওয়ান। লক্ষ্মণপুর বাথে গ্রাম। মুখে কাপড়-বাঁধা লোকেরা এসেছিলো নদী পেরিয়ে। হাতে তরোয়াল, রাইফেল, ভোজালি। ঠাণ্ডা শীতের রাতে ঘুমোচ্ছিল সবাই। পুরুষরা বেশীর ভাগই বাড়ির বাইরে। ন্যূনতম প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারে নি অসহায় মহিলা আর শিশুর দল। সবচেয়ে ছোটটি এক বছরের বাচ্চা। ওদের খতম করো। ওরা সব বড় হয়ে নকশাল হবে। মেয়েদের খতম করো, ওরা কেবলই নকশালদের জন্ম দেয়। ওই তো লুকিয়ে আছে চালের বস্তার আড়ালে। টেনে বের করে আনো, আগে ধর্ষণ করো, তারপরে খুন। গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দাও জন্মপথ। সফল অপারেশন শেষ করে বুক ফুলিয়ে চলে যায় সেনাদল। পড়ে থাকে জীবনের সংক্ষিপ্ত আয়োজন – বাঁশ আর টিনের চালের ছোট কুঁড়েঘর, পলেস্তারা-হীন দেওয়াল, দড়ির খাটিয়া, ছেঁড়া কাঁথা, হাঁড়ি-কলসি, পাতকুয়ো, গরুর জাবনা খাওয়ার পাত্র।
পরদিন শোণ নদের তীরে গণচিতায় জ্বলে প্রভা, মনমতিয়া, লছমিদের শরীর। পোড়ে লছমির পা। পোড়ে নিকোনো উঠোনের স্বপ্নও!

গিরগিটি কথা

                                                                                                                                                                 Illustration by Priyanka Lonare

পুপু-শ্যাডো ‘ছিবো’তে

গার্গী রায় চৌধুরী

ঘুমের ঘোরে শ্যাডো শুনল বাবা কোথাও একটা বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছেন। মাও বলছেন ‘চলো ঘুরে আসি। অনেকদিন যাই না কোথাও’। এর আগেও মা বাবার সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে ও আর পুপু। বুকের মধ্যে আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো। স্বপ্নে দেখল একটা পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে চলেছে ও আর পুপু। পাহাড়ের গায়ের জঙ্গল থেকে একটা বন মুরগি বেরোনো মাত্র যেই ও ভউ করে ছুটে গেছে, পিছন পিছন ছুটেছে পুপু। কিন্তু ওরা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না মুরগি টাকে। এরমধ্যে পুপুর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল শ্যাডোর। ওর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে পুপু ডাকছে, ‘শ্যাডো ওঠ খেলতে যাবি না? বিকেল হয়ে গেছে’। শ্যাডো গড়াগড়ি খেয়ে লেজ নেড়ে বোঝাল পুপুর কথা ও খুব বুঝেছে।
খেলতে খেলতে বেড়াতে যাবার কথা আর মনে ছিল না শ্যাডোর। রাত্রে ডিনারের সময় মা পুপুকে বললেন পুপু আমরা পরশু কালিম্পং এর খুব কাছে একটা ছোট্ট গ্রামে যাব, গ্রামের নাম ছিবো। পুপুর সামার ভাকেসান শুরু হয়েছে সবেমাত্র, এর মধ্যেই এত ভাল খবর টা যে আসবে তা একেবারে ভাবতেই পারেনি পুপু। শ্যাডো বসে ছিল ডাইনিং টেবিলের পাশে, ওর মনে পরে গেল আর ভউউউউউউ করে বলতে চাইল সেকথা। আনন্দ ওর হচ্ছে কিন্তু সঙ্গে একটা দুশ্চিন্তাও আছে, মা বাবা যদি ওকে না নিয়ে যান? যদি রেখে যান দাদা-দিদার কাছে? গত পুজোয় যখন লাদাখ গিয়েছিল ওরা তখন শ্যাডো কে রেখে গিয়েছিল দাদার বাড়িতে। পুপু খুব কান্না কাটি করেছিল আর বায়নাও করেছিল শ্যাডো কে নেওয়ার জন্য কিন্তু বাবার সেই এক কথা শ্যাডো কে ওখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। কেন নেওয়া যাবে না সেটা পুপু শ্যাডো কেউই বুঝতে পারেনি। কিন্তু পুপু কে ছাড়া পূজো টা পুরো মাটি হয়েছিল শ্যাডোর। পুপু ও বেরিয়ে এসে বলেছিল ও নাকি একটু ও এঞ্জয় করেনি শ্যাডো কে ছাড়া। কিন্তু মা বাবা সেকথা বুঝলে তো? এবার কি হবে কে জানে? ভাবতে ভাবতে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শ্যাডো। তাকিয়ে দেখল পুপু চেয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখটা গম্ভীর মানে শ্যাডো যা ভাবছে পুপুও তাই ভাবছে। বাবা টেবিলে এসে বসতেই পুপু জিজ্ঞেস করল, ‘এবারে শ্যাডো যাবে তো? ও না গেলে কিন্তু আমি যাব না কিছুতেই’। শ্যাডো দেখল বাবা মিটি মিটি হাসছেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ শ্যাডো যাবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে’। কথাটা শোনা মাত্র শ্যাডো আর সামলাতে পারল না নিজেকে। ভউউউউউউউ বলে ছুট্টে গিয়ে বাবার কোলে উঠতে গেল আর ওর ধাক্কা লেগে কাঁচের গ্লাস টা টেবিল থেকে মাটিতে পরে ভেঙ্গে গেল। এক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ব্যাপার তা ঘটে গেল। শ্যাডো বুঝতেও পারল না কি করে কি হল। ও তো বাবা কে আদর করতে গেছিল। মা তখন রান্না ঘরে। পুপু শ্যাডো বাবা সবাই জানে এর পর কি হবে, মা ভীষণ রেগে গিয়ে বকবেন সবাই কে। তাই বাবা আর পুপু তাড়াতাড়ি করে ভাঙ্গা কাচের টুকরো গুলো সরিয়ে ফেলতে লাগলো। আর শ্যাডো সোজা গিয়ে ঢুকে পড়ল সোফার তলায়। মা রেগে গেলে এই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হয় শ্যাডোর।
দেখতে দেখতে একটা দিন কেটে গেল, আজ ওদের বেরোনো, মা বাবার সঙ্গে পুপু যাবে ফ্লাইটের চেয়ারে বসে আর শ্যাডো কে যেতে হবে মালপত্রে ঠাসা ফ্লাইটের পেটের মধ্যে একটা খাঁচার ভিতর। অসহ্য লাগছে শ্যাডোর, কান্না পাচ্ছে খুব। পুপু বাবা মা সবাই ওর কষ্ট বুঝতে পেরে সকাল থেকে ওকে আদর করছে আর বোঝাচ্ছে, মাত্র এক ঘণ্টার ব্যাপার, একটু কষ্ট করতে হবে। শ্যাডোও জানে এক ঘণ্টার কষ্টের পর শুধু মজা আর মজা। ওর ভয় করে মা বাবা পুপু কে ছেড়ে থাকতে। আগের বার ফ্লাইটে উঠবার আগে এয়ার লাইনের দুটো ছেলে টিজ করেছিলো ওকে, কান টানছিল, চড় মারছিল অকারণ। এই সব ছেলেপুলেদের কামড়ে দিলে তবে শায়েস্তা হয়। কিন্তু মার মুখটা মনে পড়লে আর কোন দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হয়না শ্যাডোর। মা বকবেন, বাবাও অপদস্ত হবেন এসব ভেবে চুপ করে ও সহ্য করেছিল ছেলে দুটোর বদমায়েশি। এবার কি হবে কে জানে। এয়ারপোর্টে পৌঁছেই তো ওকে আলাদা হয়ে যেতে হবে মা বাবা আর পুপুর কাছ থেকে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল ওর। পুপুর কাছে ছুটে গিয়ে ও পুপুর হাত টা চেটে আদর করে দিল একটু।
বাগডোগরা এয়ার পোর্টে পৌঁছে মা বাবা পুপুর সঙ্গে দেখা হতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল শ্যাডো। যেন কতদিন দেখেনি ওদের। বাবা এক প্যাকেট কাজু বিস্কিট কিনে শ্যাডো কে খাওয়ালেন তারপর গাড়ি করে ওরা রওনা হোল ছিবোর দিকে। পৌঁছল যখন তখন বেলা দুটো টো বেজে গেছে। কালিম্পং আট মাইল পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেছে ছিবো যাওয়ার রাস্তা। দূরত্ব চার কিলোমিটার মাত্র। পাইন বনের মধ্যে দিয়ে গেছে এই পাথুরে রাস্তা, পিচ পড়েছিল কোনসময় কিন্তু তা ভেঙ্গে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পাথর। রঙিন পাহাড়ি ফুল আর নানা রকমের ফার্ন পথের দুদিক জুড়ে। পাথুরে রাস্তা তাই চার কিলোমিটার যেতে সময় লাগলো প্রায় আধ ঘণ্টা। পাহাড়ের মাথায় গাড়ি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল যেখানে তার পরে আর রাস্তা নেই। সামনে ভরত কালিকটির ছোট্ট দোকান, ওটাই ল্যান্ডমার্ক বাবা বললেন। রিসর্টে ফোন করতে তারা লোক পাঠাল, সে এসে মালপত্র নিল আর ওর পিছন পিছন চলল বাবা মা পুপু আর শ্যাডো। পাথর দিয়ে বাঁধাই করা সুন্দর রাস্তা। সামনে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কানচঞ্জঙ্ঘা, সূর্যের রঙ তার সারা গায়ে তখনও লেগে আছে। রিসর্টের লোক এসে ওদের কটেজের দরজা খুলে দিল।
কটেজের ঘর থেকে বেরোলেই খোলা বারান্দা, কাঠের রেলিং দেওয়া, সামনে তাকালে উন্মুক্ত আকাশ, বনভূমি, আর পাহাড়। পুপু আর শ্যাডো মহানন্দে হুটপাটি লাগিয়ে দিল বারান্দাতেই। কিন্তু সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। খেলতে খেলতে শ্যাডো দেখল দূর থেকে ওদের কটেজের দিকে দৌড়ে আসছে একটা পেল্লাই কুকুর। ভয়ে শ্যাডোর গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না, মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীরের ভিতর অব্দি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল ওর। পুপু তখন খেলায় ব্যস্ত এমনকি শ্যাডো যে খেলছে না সেটাও ও লক্ষ্য করেনি। লক্ষ্য করল যখন তখন কুকুর টা ওদের কটেজের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় পা রেখেছে। শ্যাডো অবাক হয়ে দেখল পুপু ভয় পেলনা একটুও। বরং কুকুরটাকে ব্রুনো বলে ডাকতেই ও পুপুর গায়ে উঠে পুপুকে আদর করতে লাগলো। পুপু শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে বলল ‘শ্যাডো ওর নাম ব্রুনো, ও এখানেই থাকে, মাল বয়ে আনল যে কাকু টা সে বলেছিল। আর ব্রুনো, ও হচ্ছে শ্যাডো, আমার বোন’। পুপু ব্রুনো কে আদর করছিলো দেখে একটু অভিমান হয়েছিল শ্যাডোর, কিন্তু এখন আর তা নেই, শ্যাডো জানে ও মানুষ নয়, কুকুর। কিন্তু পুপু যখন ওকে নিজের বোন বলে পরিচয় দেয় তখন ওর ভীষণ আনন্দ হয়। ব্রুনো এগিয়ে এসে আদর করল শ্যাডোকে। ব্যাস বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দুপুরে খাবার ঘরে খেতে গিয়ে ওরা দেখল পর্দার আড়াল থেকে একে একে বেরিয়ে এলো আরও তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে। রিসোর্টের মালিক সুজানের ছেলে ও ভাইপো,ভাইঝি ওরা। পুপু নিজে থেকে সবার সঙ্গে আলাপ করল, আর পকেট থেকে চকলেট বার করে ওদের হাতে দিল। ওদের সবার মুখ গুলো হাসি হাসি হয়ে গেল, সবাই হ্যান্ডসেক করল পুপু আর শ্যাডোর সঙ্গে। ওদের নাম জসুয়া, নিকোলাস, রুথ আর আয়ুশ। আয়ুশ আর পুপু একই বয়সী। ক্লাস সিক্সে পড়ে। বাকীরা ক্লাস ওয়ান টু। সঙ্গে আছে ব্রুনো, তার দুবছর বয়েস, মানে শ্যাডোর চেয়ে সে একবছরের ছোট। সবার মনে খুব আনন্দ । ছুটির দিনগুলো দারুন কাটবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না কারো।
(২)
মহাআনন্দে দুদিন কেটে গেল ওদের সকলের। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো। বড়রা মেতে রইলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তিস্তা কে নিয়ে। প্রকৃতি এখানে আরও বেশি উন্মুক্ত ও রমনীয়। অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। দেখে দেখে আশ মেটে না।
এদিকে পুপুদের নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে নানা রকম পাখি চেনাচ্ছে আয়ুশ। নিকোলাস শেখাচ্ছে কি করে পাহাড়ি ঝোরার মধ্যে থেকে কাঁকড়া ধরতে হয়। বড়দের অলক্ষ্যে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা ছোট বড় অ্যাডভেঞ্চার। পুপু ও শ্যাডো মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওদের দ্রুত ওঠা নামা দেখে। স্পাইদারম্যানের চেয়ে ওরা কোন অংশে কম নয়, পুপুর মনে হয়। আয়ুশ পুপু কে বলেছে একটা আশ্চর্য জায়গায় নিয়ে যাবে, সেই জায়গা টা নাকি এই অঞ্চলের সব চাইতে সুন্দর জায়গা। সেখান থেকে আকাশ টা খুব কাছে আর আকাশে পর পর সাজানো আছে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া, পায়ের নীচে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। আয়ুশ বলেছে সেই জায়গাটা নাকি ও ছাড়া আর কেউ জানে না। বড়রাও না। সেখানে ও নিয়ে যাবে পুপু কে। ব্রুনো আর শ্যাডো কে নেওয়া যেতে পারে। রুথ কে নেবে না মোটেই, কারণ ও খুব ভিতু আর বড্ড কাঁদে। নিকোলাস আর জাসুয়া কেও নেবে না বলল কারণ ওরা ছোট। আয়ুশ বলল ‘আগলা সাল সে নিকোলাস কো লেগা’। কারণ নিকোলাস ছোট বটে তবে এখনি সে বেশ সাহসী। বড় দের চোখ এড়িয়ে ঝোড়া থেকে আয়ুশের সঙ্গে কাঁকড়া ধরেছিল নিকোলাস আবার সেগুলো সবার চোখ বাঁচিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলো চৌবাচ্চার মধ্যে । বড় বড় কাঁকড়া গুলো ধরতে খুব ই বেগ পেতে হয়েছিল ওদের। দড়ি দিয়ে দাঁড়া গুলো বেঁধে আগুনে ঝলসে ওদের খাওয়া হবে এমনই প্ল্যান ছিল সবার। রাতে হবে বন ফায়ার, সেখানেই পোড়ানো হবে ওদের এমনই কথা ছিল। আর পরের দিন দুপুরের খাওয়ার পর যখন বিশ্রাম নেবেন বড়রা তখন আয়ুশ পুপুকে নিয়ে যাবে সেই অপূর্ব জায়গা টায়, আবার ওরা ফিরে আসবে সন্ধ্যার সময়, ওখানে যেতে হলে হাঁটতে হবে দু ঘণ্টা এমনই বলেছিল আয়ুশ। পুপুর রাতে ঘুম আসছিল না উত্তেজনায়। রাত পোহালেই সেই অ্যাডভেঞ্চার। মা বাবা কে না বলে যেতে হবে তাই একটু ভয় ও করছিলো পুপুর, কিন্তু এই সুযোগ ও হারাতে চায় না কোন মতেই। পরশু দিনই ফিরে যেতে হবে কলকাতায়। মাত্র একটা দিন সময় আছে হাতে।
(৩)
রাত দশটা বেজে যাওয়ার পরও যখন পুপু শ্যাডো আয়ুশ আর ব্রুনোর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না তখন মা ভেঙ্গে পড়লেন একেবারে। বাবা ফোন করছেন এখানে ওখানে। আয়ুশের সব বন্ধুদের বাড়িতেও খোঁজা হয়ে গেছে। কোত্থাও পাওয়া যায়নি ওদের। এদিকে জাসুয়া আর নিকোলাস ও জানে না কোথায় গেছে ওরা। বড়দের ধমক খেয়ে রুথ এই দুদিনের কাঁকড়া ধরা, পাখির পিছনে জঙ্গলে ছোটা ইত্যাদি অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলে দিয়েছে। খুব করে মার খেতে হয়েছে নিকোলাস আর জাসুয়া কে। ওই সব ঝোড়া তে নাকি বিষাক্ত সাপ থাকে, তাদের কামড়ে নাকি মারা যেতে পারত ওরা। নিকোলাস অনেক বার ঝোড়াতে সাপ দেখেছে, কিন্তু ওদের তাড়া দিতেই ওরা সরে যায়, কোনদিন ফোঁস পর্যন্ত করেনি। আর কামড়াতে এলে কাঁকড়া ধরার মতো করে ওদেরও ধরে ফেলত নিকোলাস। এ এমন কি ব্যাপার যার জন্য মার খেতে হয়। বুঝতে পারে না ওরা। আর আয়ুশ ওদের হিরো। সব চেয়ে উঁচু থেকে ওই লাফ দিতে পারে, সবচেয়ে বড় কাঁকড়া ওই ধরতে পারে। তাই নিকোলাস আর জাসুয়া নিশ্চিন্তে থাকে, আয়ুশ ঠিক চলে আসবে, আবার গেস্ট নিয়ে গেছে। ‘কুছ নেহি হোগা উসকো’। চারদিক খোঁজা খুঁজির পর রাত দশটায় কালিম্পং পুলিশের দ্বারস্থ হন পুপুর বাবা, আয়ুশের মামা নির্মলও যান সঙ্গে। পুপুদের ছবি বর্ণনা ইত্যাদি পুলিশকে দিয়ে ওঁরা ফিরে চলে আসেন রিসোর্টে।
(৪)
ভোর চারটে নাগাদ একটা ফোন আসে থানা থেকে। ‘আপনারা এখুনি একবার থানায় আসুন। আইডেণ্টিফাই করতে হবে’। পুপুর বাবা মিস্টার সেনের হাত থেকে ফোন পড়ে যায়, কি আইডেণ্টিফাই করতে ডাকছেন ওরা। পুপুরা ঠিক আছে তো। নির্মলকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ছোটেন থানার দিকে। উদ্ভ্রান্তের মতো ওরা থানায় পৌঁছে দেখেন এক কোণে একটি বেঞ্চির উপর বসে আছে পুপু আর আয়ুশ, পাশে শ্যাডো আর ব্রুনো। ওদের সারা গায়ে কাদা মাখা, বোঝা যাচ্ছে ভেজা জামা কাপড় গায়েই শুকিয়েছে। পুপু বাবা কে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, ‘সরি বাবা। আর কোনদিন হবে না এরকম’। আয়ুশ দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। ওর মামা নির্মল বকাবকি শুরু করতে যাবেন এমন সময় বড়বাবু এসে সামনে দাঁড়ান। ‘স্যার, উই আর প্রাউড ওব দিস কিডস। ওরা আজ দুজন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। মোটর সাইকেলে যাচ্ছিলেন এক দম্পতি। পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে খাদে পড়ে যান তারা। সন্ধ্যে নেমে আসে, বাচ্চা দুটো অন্ধকারে খাদে নেমে ওদের তুলে আনে। গাড়ি থামিয়ে পৌঁছে দেয় হসপিটালে। ওরা বেঁচে গেছে। বাচ্চা দের আর কুকুর দুটোকে হসপিটাল থেকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে গেছে থানায়’। বাবা বলেন, ‘কিন্তু ওরা বড় মানুষ দুজনকে তুলল কি করে খাদ থেকে’? ‘স্যার সুবুদ্ধি, আর সাহস থাকলে সবই হয়’। বড়বাবু পুপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। এবার পুপু বলল, ‘আমি আর শ্যাডো বসে পাহারা দিচ্ছিলাম ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী কে। ওদের জ্ঞান ছিল না। একজনের তো খুব রক্ত বেরোচ্ছিল। আয়ুশ আর ব্রুনো অনেক হেঁটে গ্রাম থেকে লোক ডেকে এনে তুলেছে ওদের’। ‘লেকিন তুমলোগ শামকো উতনা দূর ঊস রাস্তে পে গয়ে কৈসে’? নির্মল প্রশ্ন করে। পুপু কিছু বলার আগেই আয়ুশ বলে ওঠে, ‘ঘুমতে ঘুমতে রাস্তা ভুল করকে চলে গয়ে থে’। পুপু অবাক হয়ে তাকায় আয়ুশের দিকে, কেন রাস্তা ভুল করে গেছে এই মিথ্যেটা বলল আয়ুশ? আয়ুশ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন পড়ে ফেলল ওর প্রশ্ন। রিসোর্টে ফিরবার সময় বড় দের কান বাঁচিয়ে আয়ুশ বলেছিল বড় দের ও বলতে চায়না ওই সুন্দর জায়গাটার কথা। বড়রা জানলেই ওখানে ভিড় করবে সব ট্যুরিস্ট আর রেগে গিয়ে দূরে সরে যাবে আকাশ, পাহাড় আর তিস্তা। আয়ুশ শুধু ওর প্রিয় বন্ধুদেরই নিয়ে যাবে ওখানে।
কালিম্পং থেকে ছিবোর রিসোর্টে পৌঁছে ওরা দেখল সারা মহল্লা জড়ো হয়েছে মালা হাতে ওদের স্বাগত জানাতে। দুটো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে পুপু, শ্যাডো, আয়ুশ আর ব্রুনো তখন সুপার হিরো। পুপু দেখল শ্যাডোর দুচোখ চকচক করছে আনন্দে।

স্বপ্ন

রঞ্জন চক্রবর্তী

আমার বুড়ি জরাজীর্ন
বর্ষণে আর ধর্ষনেই
কূটনীতি বা রাজনীতিও
দেখেছে অনেক, ভরসা নেই।

ভরসা নেই, ভরসা নেই আশা আছে ভরসা নেই
হীরে মাণিক উঠল যদিও সুনাগরিকের কর্ষণে
ভবিষ্যতের আশা নিয়ে জন্মাবে যে তার ভরসা নেই
আয়েষা ও আরতি তারা আজও আর্ত “অ্যাবর্শানে”।

আমার বুড়ি আশা রাখে
চেয়ে আকাশপানে
তার স্বপ্ন দেখা থেমে না যায়
চাওলা ম্যা’মের মহাআকাশযানে।

বুড়ি শোনায় গল্পকথা
যতীন, ভগৎ, ক্ষুদির
চেয়ে দেখে তার চারিধারে
যত বাচাল, মূক ও বধির।

তোমরা বল যুবতী সবে
হলই বা সে সত্তর
এক নিমেষে চাঙ্গা হবে
জাদুর বলে সত্বর।

সেই সবুরে হাঁপায় বুড়ি
( কবে ) আসবে রাজার রথ
জিয়নকাঠির ছোঁওয়ায় পাবে
জগৎসভার পথ।

দস্যি মেয়েদের গল্প

নীতা মণ্ডল

(১)
‘আই লাভ ইউ বাতাবি’…
নধর চকচকে বাতাবির গায়ে কালো রঙের আঁচড় দেখে মাথায় আগুন জ্বলে গেল লতিকার। আগামীকাল গুরুবার। সন্ধ্যেবেলা লক্ষীপুজো। সকালে স্নানের পরেই পাড়ার কথা। বেড়া ঘেঁসে বেশ আড়ালেই ছিল বাতাবিটা। তাতে কি! মেয়েগুলো কম ধিঙ্গী!
‘হে ঠাকুর, এর শাস্তি যেন ওই দস্যি, বজ্জাত মেয়েগুলো পায়।’ মনে মনে নিবেদন করেই ধিক্কার দিয়ে উঠল লতিকা, ‘অসভ্য, গেছোমেয়ে যত্তসব! বাপ, মা, দিদিমনিরা এই শিক্ষে দেয়! চুরিবিদ্যা! ছিঃ ছিঃ ছিঃ…’
মেয়েরা সব ক্লাসে। চারিদিকে পড়ানোর একটানা মৃদু গুঞ্জন। লতিকার চিৎকারে পরিবেশটাই কর্কশ হয়ে উঠল। শিক্ষিকারা নিমেষের জন্যে থামলেন। বেরিয়ে এলেন প্রধান শিক্ষিকা সুনয়না সেন। সেভেন-সির পেছনের বেঞ্চে বসা স্বাতী সুস্মিতার খাতায় লিখল, ‘আজ ওটা খেয়েই বাড়ি ফিরব।’
‘চুরি করবি?’ অনন্যা লিখল।
‘চোর বলল, শুনলি? ইশকুলের জিনিস মানে আমাদেরই জিনিস।’ লিখল স্বাতী।
(২)
লতিকা একটি বালিকা বিদ্যালয়ের পিয়ন। গার্ড মঙ্গলের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে মেয়েদের কাছে ও লতিকাবৌদি। বিদ্যালয়ের একপ্রান্তে ওদের স্বামী স্ত্রীর আস্তানা। ওর ধারণা এখানকার কাঁঠাল, নারকেল, বাতাবি, করমচায় ওর একচেটিয়া অধিকার।
টিফিনের সময় কাঁঠালতলায় টেবিল পেতে কেক, লম্বু, মদন কটকটি বিক্রি করছে লতিকাবৌদি। সুস্মিতা, অনন্যা আর স্বাতী পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। ইশকুলের মাঠ জুড়ে সাদা টপ আর সবুজ স্কার্টের মেলা বসলেও এদিকটা ফাঁকা। সুস্মিতার পায়ে লেগে একঝাঁক সাইকেল উল্টে গেল। সেগুলো তুলে দাঁড় করানো হতেই স্বাতীর স্কার্ট আটকাল বেড়ায়। সেটা ছাড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে নিল বাতাবিটা। অনন্যাকে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার দৌড়। স্টার্ট।’
‘কোথায়!’ অনন্যা জিজ্ঞেস করতেই খেয়াল হল, বাতাবিটা পাড়ার পর কি করবে ঠিক করা হয় নি।
স্বাতী বলল, ‘স্টাফ কোয়ার্টারের দিকটায় এসময় কেউ থাকে না। এক্ষুনি ঘণ্টা পড়বে। ভাবার সময় নেই অনন্যা, তুই না ২০০ মিটার রানে চ্যাম্পিয়ান!’
বাতাবিটা যথা সম্ভব লুকিয়ে অনন্যা দৌড়েছিল। কোয়ার্টার চত্বর শুনশান। ইউক্যালিপটাস গাছের সামনে সবে থেমেছে। হাঁফ ছাড়ার আগেই একটা গলার স্বরে ওদের হাড় হিম হয়ে গেল। ‘কে রে ওখানে?’
অঙ্কের দিদিমনি বেদবিভা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্রীদের কাছে ত্রাস। কখনও ওনাকে হাসতে দেখা যায় না। সব সময় রাগে মুখ থমথমে। অনেকটা বয়েস হলেও অবিবাহিতা। সে নিয়েও মেয়েদের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। প্রথম কোয়ার্টারটাই যে ওনার তা মনেই ছিল না।
উল্টোদিকে দৌড়নোর আগেই বেরিয়ে এসেছেন, ‘তোরা? এখানে? ওটা কি?’
উত্তর নেই। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির সম্ভবনায় ওরা বিহ্বল। হঠাৎ বেদবিভাদির স্নেহ মিশ্রিত কন্ঠস্বর, ‘ভেতরে যা। ওদিকটায় রান্না ঘর। বটি আছে, নুন আছে। খেয়ে সব জায়গায় রেখে দিবি।’
ওরা মুখ তুলে দেখল, বেদবিভাদি মুচকি হেসে ক্লাসের দিকে চলে গেলেন!
(৩)
ঝাপসা হয়ে আসা একটা ছবি মিস বেদবিভার চোখের সামনে দুলছে। শাস্তি হয়েছে তিনজনের। মাঠ ভর্তি মেয়েদের সামনে বেদবিভা, দেবযানী আর শ্যামলী কান ধরে দাঁড়িয়ে। অনামিকাদি ধিক্কার দিচ্ছেন, ‘আমি ভাবতে পারছি না। তোমরা টিফিন চুরি করেছ? পরীক্ষায় এত নম্বর পাও অথচ …!’
টিফিন চুরি নয়, নাক উঁচু সুমিত্রাকে শিক্ষা দেওয়াই ছিল সেদিনের উদ্দেশ্য। সৎমায়ের অবহেলায় বড় হওয়া মলিনার টিফিন বলে কিছু থাকত না। সুমিত্রারা তাই নিয়ে উপহাস করত। তাই নিজেদের মত করে শাস্তি দিতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল বেদবিভারা।
লতিকার তখনকার চিৎকারের মানে বোঝা গেল। ভাষাগুলো আজও পাল্টায় নি। বেদবিভাও ‘ধিঙ্গী’, ‘গেছো মেয়ে’ বিশেষণে ভূষিত হয়েছে ইশকুলে। কলেজের খেতাব ‘টমবয়’। তারপর সারাজীবন একঘরে। ওই ডানপিটে মেয়ে তিনজন যেন সেই বেদবিভা, দেবযানী আর শ্যামলী। চোখের কোণে বাষ্প জমছে বেদবিভার। সামনের ক্লাসরুমে কলরব করছে মেয়েরা। ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছে ভেতরটা। ওনাকে দেখেই এক লহমায় মেয়েরা থেমে গেল। মিস বেদবিভা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গম্ভীর গলায় ডাকলেন, ‘রোলনম্বর ওয়ান…’

Illustration by Soma Ukeel

মেঘপিওনের ডাক

চন্দন কুমার চৌধুরী

শ্রাবণমাসে সুয্যিবাবু প্রায় ছুটি নেয় যখন তখন,
আকাশটা তো মুখ করে ভার, বেশ বোঝা দায় রকম সকম।
ভাবছি এখন নিই ঝিমিয়ে, হাইতোলা এই অলস দুপুর
ঝমঝমিয়ে ঝরুক আকাশ ফোঁটায় ফোঁটায় টাপুর টুপুর।
মেঘবালিকা খিলখিলিয়ে পশলা ছোড়ে ইচ্ছে করে
কোন সুদুরে বায়েন পাড়ায় ঢাক বাজানর মসকো চলে।
ঠিক শুনছি বাদ্যি বাজে?
সময় হোলো? শিউলি ভোরে ফুরফুরে সব মেঘের সাথে
আসছে শরৎ, চনমনে মন সাজবে এবার পুজোর সাজে।
মনের খোরাক মেঘপিওনের ডাকএসেছে, নাড়ছে কড়া,
মাস পোহালেই লিখতে হবে, এ সংখ্যাতে, ভীষণ তাড়া।
লিখব কি যে, ভাবছি নিজে, আবোল তাবোল চিন্তা যতো,
তেমন লেখা শক্ত বড়, পাঠককুলের মনের মতো।

Illustration by Debjyoti Mahapatra