(০৩৩)২৬৪৩-৪৩২১

অনমিত্র রায়

তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। কয়েক বছর আগে আমাদের মায়া কাটিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন। তিনি (০৩৩) ২৬৪৩-৪৩২১।

ঠিক কবে তিনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে তাঁর আরামের জন্য একটা স্থায়ী কোণের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। তিনি ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠলেন। সময়ে অসময়ে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়ে আমাদের মাতিয়ে রাখলেন (০৩৩)২৬৪৩-৪৩২১।

অনেকের হিংসে হত। অনেকে জানতে চাইত ৪৩২১ কে আমাদের বাড়ির সদস্য করার জন্য আমরা কী কী করেছি। আমরা বার বার হাসিমুখে একই উত্তর দিয়েছি। তেমন কিছুই আমরা করিনি, ৪৩২১-এর বাপের বাড়িতে গিয়ে নিমন্ত্রণপত্রটা কেবল দিয়ে এসেছি।

মাঝে মাঝেই ৪৩২১-এর মধ্যে দিয়ে আমরা শুনতে পেতাম এক নারীকণ্ঠ, ‘বুবুন আছে?’ প্রথম প্রথম আমরা খুব অবাক হতাম। বার বার কেন বুবুনেরই খোঁজ পড়ে! আমাদের তিনজনের সংসার। আমার বাবা শ্রীঅনিমেষ রায় বা বাবলু, আমার মা গায়ত্রী রায় বা টুটুন আর আমি অনমিত্র রায় বা পাপ্পু, খুব ভালোবেসে পাপু। এর মধ্যে কোথাও বুবুন নেই। কোনোদিন ছিল না। তবু। তবু বুবুনের খোঁজ পড়ে। এক উত্তর দিতে দিতে আমাদের রাগ হয়ে গেলে আমরা বলতাম, ‘বুবুন বাড়ি নেই।’ যেন ‘অবনী বাড়ি আছ?’-র ছায়া। সকাল ছ-টাতেও নেই, বেলা দশটাতেও নেই, দুপুর দুটোতেও নেই, এমনকী রাত দশটাতেও বুবুন বাড়ি নেই। সেই বুবুনের কোনো বাড়ি নেই। একদিন বুবুনের খোঁজ নেওয়া বন্ধ হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, বুবুনকে কি পাওয়া গেল?

একদিন হঠাৎ ৪৩২১-এর কোনো সাড়া নেই। সকাল থেকে। তাঁর বাপের বাড়িতে খবর দেওয়া হল। বাপের বাড়ির মানুষরা এলেন দু-তিন দিন পর। একসঙ্গে চারজন। উৎকণ্ঠিত। তাঁদের স্নেহের স্পর্শে ৪৩২১ আবার জেগে উঠলেন। এর পরে বেশ কয়েকবার এভাবে ঘুম ও জাগরণে জীবন কাটল ৪৩২১-এর। একদিন তাঁর গায়ের রং বদলে গেল। স্বরও যেন একটু স্তিমিত। আগের মতো উপস্থিতি জানান দেওয়ার ক্ষমতা যেন আর নেই।

দিন যায়। ৪৩২১ একটু একটু করে বুড়ো হতে থাকেন। তাঁর বাপের বাড়ির মানুষজন একটু ঘন ঘনই তাঁর খোঁজ নিতে থাকেন। একদিন তাঁরা এসে দেখেন ৪৩২১ আর এ জগতে নেই। তাঁরা তাঁকে নিয়ে যেতে চান। আর কোনো উপায় নেই দেখে আমরাও চোখের জলে ৪৩২১ কে বিদায় জানাই।
তার পর কালের নিয়মে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। ৪৩২১-এর কথা আজও মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। বিশেষ করে, যখন আমি আমার কাজের টেবিলে মনোযোগী আর পাশের ঘরে খাটের ওপর শুয়ে থাকা চলভাষ ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তখন মনে হয়, আজ যদি ৪৩২১ থাকত তাহলে হয়তো ওপারের মানুষটিকে হতাশ হতে হত না।

রবীন্দ্রনাথ এবং সুভাষ চন্দ্র

কল্পনা রায়

হ্যাঁ, সে প্রায় অনেকদিন হল, প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গেই মনে হয় আজ বুঝি উত্তর আসছেই আসছে। প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় দিন অতিবাহিত হয়, রাত কেটে যায়। ভোর হয়, আবার আরেকটি দিনের প্রতীক্ষা শুরু হল।
রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে একজন বিরাট মাপের মানুষ। দেশে বিদেশে সকলেই তার নাম জানে। আবার এও সকলের জানা আছে যে তার কাছে চিঠি লিখলে দু-লাইন হলেও উত্তর ঠিকই পাওয়া যায়। সুভাষের সাথে তাঁর তেমন হয়ত ঘনিষ্ঠতা নেই, তা বলে উত্তর দেবেন না, তাও কি হয় ? বিশেষতঃ সুভাষ যে একখানা দীর্ঘ চিথি লিখেছিলেন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে, সে চিঠি কি এতটাই গুরুত্বহীন হয়ে পৌঁছবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে?
১৯৩৩ সন ব্রিটিশ সরকার সুভাষকে ইউরোপের স্বাস্থ্যনিবাসে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ইউরোপে এসে চিকিৎসকদের চিকিতসায়, পরামর্শে সুভাষ অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন । নষ্ট স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবু ডাক্তারের নির্দেশে তাকে আরও বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। কিন্তু কেবলই শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে, দিন কাটাবার মানুষ তো সুভাষ নন। অতএব তিনি লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। দেখতে দেখতে কয়েক পাতা লেখা হয়ে গেল।
লন্ডানের একজন প্রকাশক নাম তার Wishart & Company, ঠিকানা – ৯, জন স্ট্রিট, এডেলফিতে তার বাসস্থান – সেই প্রকাশক বাতাসে বাতাসে তার খবর পেল, সুভাষচন্দ্র লিখছেন কিছু। পাতার পর পাতা লিখে শেষ করে ফেলছেন। সে দৌড়ে এসে লেখার জন্য বায়না করল। অগ্রিম টাকাও দিয়েছে। সুভাষ বসু সেই টাকা নিয়ে নব প্রেরনায় নব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নব উৎসাহে লিখতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। তারপর দেখতে দেখতে অনেক পাতা লেখা হয়ে গিয়ে সে এক বিরাট বইয়ের আকার নিয়েছে। বইটির নামও স্থির হয়ে গেছে। ‘The Indian Struggle’। পুস্তকের গোড়ায় Historical Background’ নামে একটি অধ্যায় রয়েছে। তারপর ‘Laming Events’ নামে আরেকটি অধ্যায়।
সুভাষ বসুর দৃঢ় প্রতীতি, পুস্তকের খুবই আদর হবে। আর এ বিশ্বাস কেবল মাত্র সুভাষের নয়, প্রকাশকের আরও বেশি। প্রকাশক রয়্যালটির টাকা আগেই ধরিয়ে দিয়েছে। সুভাষ চন্দ্র আশা রাখেন এই বই ইংল্যান্ড আমেরিকায় অনেক বিক্রি হবে। বই এখন প্রকাশিত হয়নি অথচ এরই মধ্যে এই বই-এর ফারসী এবং জার্মান অনুবাদের কথাও অনেকে ভাবছেন।
সবকিছুই প্রস্তুত। এখন বইটির একটি সুন্দর ‘সূচনা ’ চাই। অর্থাৎ যাকে বলে Foreword।এই ‘Foreword’-এর ব্যাপারেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন সুভাষ চন্দ্র।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত পনেরো দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে চিঠির উত্তর এল। এক বন্ধু লোক অবশ্য আগ বাড়িয়ে এসে বললেন, ‘কি এমন দেরী করেছেন রবীন্দ্রনাথ। পনেরো দিনের মাথায় ইন্ডিয়া থেকে উত্তর এসে গেল’। সুভাষ চন্দ্র বোঝালেন নিজেকে, ‘হয়তবা হবে’। আসলে প্রতীক্ষার সময় দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়। কলেজ জীবনে পাঠ্যবস্থায় বৈষ্ণব পদাবলী কি পড়েননি সুভাষ বসু! সেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রেমকথা। শ্রীরাধার প্রতীক্ষায় “সময়, এক মিনিট” কি ভীষণ বিলম্বিত লয়ে এক যুগে পৌঁছে যায়।

যাক, শেষ পর্যন্ত যে প্রতীক্ষার অন্ত হল, এটাই বড় কথা। চিঠিটি বের করতে করতে উত্তেজনায় কাঁপছিলেন সুভাষ চন্দ্র। চিঠিটি খুলতে খুলতে আনন্দে, আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠছিলেন। আর যখন চিঠিটি বের করে চোখের সামনে ধরলেন, তখন তার মুখ গম্ভীর রক্তিম হয়ে উঠলো। তার প্রচন্ড উৎসাহ যখন টগবগ করে ফুটছে, তখন ঐ চিঠি যেন এক বালতি ঠান্ডা জল হয়ে ঝপাৎ করে তার উপর পড়ে তাকে, তাঁর আনন্দ-উৎসাহকে একেবারে নিভিয়ে দিল।
সুভাষ চন্দ্র লিখেছিলেন দীর্ঘ একটি চিঠি, আর তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন একপাতার ছোট্ট চিঠি। সুভাষচন্দ্র বসু যে অনুরোধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্রনাথ সে অনুরোধ রাখেন নি। ফিরিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সোজাসুজি লিখেছেন, “Bernard Shaw কে আমি ভালোমতই জানি। তোমার বইয়ের পূর্বভাষন লেখবার জন্য তাকে অনুরোধ করতে আমি সাহস করিনে। করলেও ফল হবে না এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তোমার পান্ডুলিপিখানির এক কপি তুমি নিজেই তার কাছে পাঠিয়ে দেখতে পার। এতদিনে সংবাদপত্র যোগে নিশ্চয়ই তিনি তোমার পরিচয় পেয়েছেন”।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সুভাষ আনমনা হয়ে বসে থাকলেন। তিনি রবি ঠাকুরকে H G Wells এবং Bernard Shaw দুজনের কথাই লিখেছিলেন। তার বইয়ের ‘সূচনা’ লেখবার জন্য তিনি এই দুজনকেই মনোনীত করেছিলেন। রবি ঠাকুর H G Wells-এর কথা কিছু লেখেন নি।
সুভাষ বসু মাপের মানুষটি কোন ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে যান না। তিনি রবীন্দ্রনাথকে সোজাসুজি লিখেছিলেন যে, বইয়ের ‘সূচনা’ লেখবার জন্যে ‘Romain Rolland’-র কথা তার মনে হয়েছিল। আর ইতিমধ্যে এদেশে আসবার পর তার সঙ্গে সুভাষের ভালই পরিচয় হয়েছে। কিন্তু তার পুস্তকের ‘সূচনা’ লেখবার জন্য তিনি মোটেই তাকে উপযুক্ত মনে করেন না। কারণ রোমা রঁল্যা প্রচন্ড ‘গাঁধীভক্ত’। আর কেবল ভক্তই বলা যায় না, একেবারে অন্ধ ভক্ত। সুভাষ নিজে গান্ধিজীর অনুসৃত নীতিকে সর্বত ভাবে সমর্থন করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে সোজাসুজি এও লিখেছেন সুভাষচন্দ্র যে, যে কারণে তিনি রম্যা রঁল্যাকে সূচনা লেখবার উপযুক্ত মনে করেননি, সেই একই কারণে তিনি রবিন্দ্রনাথকেও তার বইয়ের সূচনা লেখবার উপযুক্ত মনে করেন না। কারণ রবীন্দ্রনাথ কেবল ভক্তমাত্র নয়, তিনিও গান্ধিজীর অন্ধভক্ত। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে এই রকমই বোধ হয়।
সুভাষ অতো মানুষের মন বুঝে কথা বলতে পারেন না। তোয়াজ টোয়াজ করতে পারেন না। তিনি সরাসরি লিখে দিলেন যে, Bernard Shaw আর H G Wells — দুজনে নিশ্চয়ই গান্ধিজী সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষন করেন, কিন্তু অন্ধ ভক্ত কেউই নন।
সুভাষ বসু রবীন্দ্রনাথের চিঠির উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। সুভাষের অতো বড় চিঠি রবীন্দ্রনাথ কেবল ছুঁইয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁকে যে গান্ধিজীর অন্ধভক্ত বলা হয়েছে, এতে গভীর উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং ঘটা করে ঐ কয়েক ছত্রের উত্তর দিয়েছেন। সুভাষ বসু চিঠিটিকে চোখের সামনে মেলে ধরলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মহাত্মা গান্ধী অতি অল্পকালের মধ্যে সমস্ত ভারতবর্ষের মনকে একযুগ থেকে আরেক যুগে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কেবল একদল রাষ্ট্রনৈতিকের নয়, সমস্ত জনসাধারনের মনকে তিনি বিচলিত করতে পেরেছেন। আজ পর্যন্ত আর কেউ তা করে উঠতে পারেনি। মহাত্মাজীর চরিত্রের এই প্রবল নৈতিক শক্তিকে, ভক্তি যদি না করতে পারি, তাহলে সেটিকেই বলব অন্ধতা। অথচ তার সঙ্গে আমার স্বভাবের, বুদ্ধির ও সংকল্পের বৈপরীত্য অত্যন্ত প্রবল। মনের দিকে, ব্যবহারের দিকে তিনি আর আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর জীব। কোন কোন বিষয়ে তিনি দেশের ক্ষতি করেছেন। কিন্তু দেশের নির্জীব চিত্তে হঠাৎই যে বল এনে দিয়েছেন, একদিন সেটা সমস্ত ক্ষতিকে উত্তীর্ণ করে টিকে থাকবে। আমরা কেউই সমস্ত দেশকে এই প্রাণশক্তি দিইনি”।
চুপচাপ অনেক্ষণ বসে রইলেন সুভাষ। মনে পড়ছে তার, এইখানে আসবার আগে, রবীন্দ্রনাথের সাথে সে দেখা করেছিল। উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একখানা পরিচয়পত্র জোগাড় করা। রবিন্দ্রনাথ সেই পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছিলেন।
গান্ধিজীর কাছেও গিয়েছিলেন। গান্ধিজী প্রথমে বললেন,” পরিচয়পত্র লিখে দেবেন।“ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দেননি। অচেনা মানুষ, অচেনা জায়গা। একটা পরিচয় পত্র থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। তখন মন খারাপ হয়েছিল বটে। কিন্তু তাতে কি আর অসুবিধে হয়েছে। সুভাষ নিজে গিয়ে সকলের সাথে পরিচয় করলেন। এমন কি রোম্যা রঁল্যার বাড়িতে তো একাই গেলেন।
চিঠি হাতে নিয়ে সুভাষ ভাবলেন, “দরকার নেই কারোকে”। অভিমান ভরা হৃদয়ে ভাবলেন, নিজের বইয়ের সূচনা তিনি নিজেই লিখবেন। কাউকে প্রয়োজন নেই তার। সুভাষ নিজেই নিজের পরিচয় হয়ে উঠবেন। লিখতে ইচ্ছে হল তার, লিখলেন। আর অমনি প্রকাশক তার রয়্যালটির টাকা হাতে ধরিয়ে দিল। এ যে রাজকীয় যোগাযোগ! ‘Foreword’-এর জন্য এই বই থেমে থাকবে না। নিশ্চয়ই না।
এতসব ভাবলেন সু্ভাষ। কিন্তু শেষপর্যন্ত যে দেশ থেকে এমন একটি দুঃসংবাদ আসবে, তা কি জানতেন ?
পিতা, জানকীনাথ বসু, প্রবল দেহপীড়ায় আক্রান্ত। সুভাষ বসু বিমান যোগে ভারতবর্ষে রওয়ানা হলেন। করাচি বিমান বন্দরে অবতরণ করে সুভাষ খবর পেলেন, পিতা পরলোক গমন করেছেন। পিতৃশোকে মুহ্যমান সুভাষ। এরই মধ্যে ঘটলো আরেক দুর্ঘটনা । পুলিশ তার জিনিষপত্র তল্লাশি করে ‘Indian Struggle’ বইটির টাইপড কপি বাজেয়াপ্ত করল।
কলকাতায় পৌঁছতে সুভাষ খবর পেলেন, তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশের এই কঠোর দমননীতির প্রতিবাদ দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক ব্যক্তি এই দমননীতির প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এইসব ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আছেন ভারতবর্ষের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের Bernard Shaw আর H G Wells।
এই ঘটনায়, এতো অল্প সময়ে সুভাষ এই তিনজনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন, এতটাই কাছাকাছি যে এই মূহুর্তে সুভাষ এদেরকে দিয়ে ‘সূচনা’ অনায়াসে লিখিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সুভাষ আর ঐ পথে হাঁটলেন না।
সুভাষ মনস্থির করে নিয়েছেন, নিজের বইয়ের ভূমিকা তিনি নিজেই লিখবেন।
পিতার পারলৌকিক কাজ শেষ হল। সুভাষ শর্তাধীনে গৃহবন্দী রয়েছেন ওদের এলগিন রোডের বাড়িতে।
তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেছেন। লিখছেন আর গুনগুন করে সুর ভাঁজছেন। কখনো উচ্চস্বরে গেয়ে উঠছেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে”। এই গানের কি প্রচন্ড শক্তি। নির্জীব প্রাণতন্ত্রীতে যেন বিদ্যুত-তরঙ্গ জাগে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয় প্রাণ। নির্ভীক করে মননকে। আত্মপ্রত্যয়ী সুভাষ লিখে যাচ্ছেন তাঁর বই Indian Struggle-এর সূচনা, Foreword, Preface কিংবা ভূমিকা। An Indian movement from the standpoint of Indian Nationalist… সুভাষ চন্দ্র লিখছেন আর মাঝে মাঝে টেবিলে আঙ্গুলের শব্দ করে সঙ্গত করছেন।
সুভাষ চন্দ্র হাসছেন। মুচকি হাসি। আচ্ছা বোকা বনবে ব্রিটিশ। যতই উঠে-পড়ে লাগো, বই – Indian Struggle – প্রকাশ পাবেই। কারণ মূল কপিটি এখনও প্রকাশকের জিম্মায়ই রয়েছে।

আমি, রাধা

চন্দনা খান

কিছু সময় তো তুমি আমায় দিয়েছিলে।
সেই সব ক্ষণ, সেই আমার অনন্ত জীবন।
আগে পরে, ধোঁয়াশা – কুয়াশার মতো ঝাপসা।
এমনই তো বেঁচে থাকা, উদ্বেগ, উদ্বেলিত হৃদয়
কখনো আনন্দের ঢেউয়ের শিখরে
কখনো বা টলোটলো বেদনায় সাগরের গর্ভই আশ্রয়।
আমি কি জানিনি ?
আমি কি বুঝিনি ?
এক অলৌকিক সময়ের মধ্যে দিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি
এই ব্রজধাম, এই গোপিনীরা, রাখালবালক
তোমার দুরন্ত বাঁশী টান দেয় রক্তের শিরায় শিরায়
কুলশীল? যে অভিধানে আছে, সেইখানেই থাক।
সংসার? যমুনার জল বয়ে আনার জন্য যার প্রয়োজন।
যখন ডাক দিল তোমার স্বর্গনিন্দিত বা স্বর্গনন্দিত ভালবাসা
গৃহবধূ গেল ভেসে, জন্ম নিলো চিরকালের দয়িতা।
তোমার নীল অবয়ব আমার নীল গরল
সেই পানে মদিরার মতো নেশা
তুমিহীন জীবন ছেড়ে মৃত্যুর শান্তি।

একদিন তুমি চলে গেলে বৃহৎ, বৃহত্তর জীবনের দিকে
সমাজে, সংসারে, রাজনীতি, রণাঙ্গনে
তোমার কত কত কর্তব্য
শঙ্খরবে করে আহ্বান।
তখন কেই বা রাধা, গ্রাম্যরমণী এক।
সখীদের সাথে কলহে, কৌতুকে কাটিয়ে দেবে কাল।
তোমরা চলে গেলে দূরে রাধাদের কি হয়?
মনহীন দেহ ফিরে আসে সংসারের আঙ্গিনায়।
জীবন চলতে থাকে যমুনার নীল জল অশ্রুজলে ঘন নীল।
কদমফুল বালকের পায়ে পায়ে ক্রীড়ার সামগ্রী।
সখীদের নতমুখ, তুমি যে ছিলে তাহাদেরও সখা।
সখা? শুনেছি তুমি পরে হয়েছিলে দ্রৌপদীরও প্রিয়সখা
তার পরিত্রাণদাতা, বিবস্ত্র হওয়ার লাজ থেকে।
চাওনি যুদ্ধ তুমি কোনদিন, তবু অর্জুনকে ঠেলে দিলে রণাঙ্গনে
তুমি তো জানতে ধরাধাম মায়ার প্রতীক।
মায়া? হে প্রিয়, তোমার আমার নেই রামধনু সময়
সেও মায়া?
বলো না, বলো না, রিক্ত করো না আমাকে।
সময়ের দুধটুকু থেকে ক্ষীরসম্ভার
উপহার দাও আমায়।
স্মৃতি নয়, ওই তো বাস্তব।
আনমনা পথে চলি কলসী কাঁখে
দূর হতে তোমার কীর্তিকাহিনী কানে ভেসে আসে।
জানি তুমি অজেয়, তবু ভয় হয়
ইতিহাস গড়বে, তাই ধর্মযুদ্ধের জন্য কাটিয়ে দিলে সারাটা জীবন।
রুক্মিনী, সত্যভামা, তারাও কি করে অভিমান?
রাধার গল্প কি শুনেছে তারা?
কোনও বিরল বিরতিতে, স্বপ্ন-স্মৃতি কি জানা দেয় তবে?
নীল যমুনার তীরে, কদম্বের মূলে
কোন এক সামান্যা রমণীর আকুতি
অশ্রু আখিঁ, পূজা-সমর্পণ
কবির কাব্য, আর প্রেমিকের গান
শেষে অমরত্বে জড়ালো, আমাকে তোমাকেই।

দেবগনের মর্ত্য পরিদর্শন

প্রদীপ কুমার ভট্টাচার্য

ভূমিকা
চুকলিটা নারদই করেছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস গজাননের। কিন্তু গণ্ডগোল যা হবার তাতো হয়েই গিয়েছে। কৈলাসে বোর্ড রুমে পিতাশ্রী কে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন শ্রী বিষ্ণু। প্রতিবারের মত এবারও মহালায়ার প্রাক্মুহুরতে বোর্ড কমিটির সামনে দেবী দুর্গা আর তার আপত্য পরিবারের মর্ত্য ভ্রমন বাবদ খরচার বাজেট পেশ করা হয়েছিল চেয়ারম্যান গঞ্জিকা গৌরব শ্রী মহেশ্বরের অনুমোদনের জন্য। আর তখনি বোমটা ফাটালেন মুরলী মনোহর। এক পেশে হাসিটা মুখের কোনায় ঝুলিয়ে, গলায় মিষ্টি ভাবে শ্লেষ মিশিয়ে জানতে চাইলেন ‘ এই যে এতো অর্থ আর আয়োজন করে, কখনও গজ গমনে কখনও নৌকা বিহারে কখনও অশ্ব পিঠ, সম্বৎসর চেয়ারম্যান এর পরিবারকে পিতৃগৃহের নামে মর্ত্য ভ্রমণের বিলাসিতায় দেবলোক অর্থ বরাদ্দ করে চলেছে, তার উপযোগিতা মূলক কখনও কি দেবী দুর্গা বা তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কোন ট্যুর রিপোর্ট জমা করেছে ফিরে এসে? মণ্ডপের ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে মনুষ্যলোক, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির উন্নতি/অবনতির কোন ব্যাখ্যান কি জমা দিয়েছে?’
প্রশ্নের তেজে ব্যতিব্যস্ত মহেশ্বর গঞ্জিকা নলে খান দুই বৃহৎ টান দিয়ে আঁখি রঞ্জিত করে ফরমান দিলেন ঃ
ট্যুর রিপোর্ট না পেশ করলে পরের বছর থেকে পিতৃলোক অধরাই থেকে যাবে দেবী আর তার দলবলের কাছে।
ন্যাপাটিজম থেকে যে মহাদেব মুক্ত তার প্রমান রেখে সভা তো ভঙ্গ হয়েছে তাঁর গুণগান গেয়ে। কিন্তু গৃহে ফিরে প্রবল বিড়ম্বনার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে মীটিং থেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছেন দেবাদিদেব। কিন্তু এতো আর মর্ত্য লোকের কর্পোরেট মিটিং নয়, রাজাধিরাজের আদেশের বিচ্যুতি হয় এমন সাধ্য প্রকাশ্যে দৈবী শক্তিরও নৈব নৈব চ!
অতএব চার ভাইবোনকেই মায়ের এই অবমাননা ঘোচাবার দায়িত্ব নিতে অঙ্গিকারবদ্ধ হতে হয়েছে।
আর সত্যি বলতে কি, গণপতি বুঝিয়েছেন , শারদকালীন এই মর্ত্য ভ্রমণ তাদের জন্য মোটেই সুখকর নয়, সত্যি কথা বলতে কি এটা একরকম অত্যাচারই বলা যায়। কেননা মাতাশ্রী তো ভক্তদের ভক্তির আতিশয্যে, পূজার পারিপাট্যে মণ্ডপে মণ্ডপে নেশায় বুঁদ হয়ে চারদিন অনায়াসে কাটিয়ে দেন। কিন্তু সমস্যা তো তার সন্তানদের। ডেকোরেশন ছাড়া যাদের আর কোন অস্তিত্বই নেই এই অকালবোধনের উৎসবে। অসুর আর মায়ের বাহন সিংহ সেই তুলনায় ভাগ্যবান, নিন্দা অথবা প্রশংসার মর্যাদায় তারা মর্যাদাসম্পন্ন । তাই বলতে গেলে এ একদিকে শাপে বর। বক্তব্যের যৌক্তিকতায় চার ভাইবোন একমত। পরামর্শে ঠিক হল, নমুনা হিসেবে কলকাতাকে রাখাটাই সবদিক থেকে সংগত। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে শ্রী গণেশ করবেন সামাজিক অনুসন্ধান, লক্ষ্মী দেখবেন বানিজ্যিক হালচাল আর কনিষ্ঠ বলে কার্ত্তিক সরস্বতী যুগলের দায়িত্ব বর্তাল সাংস্কৃতিক হাল হকিকত সন্ধান।

দৃশ্য কল্প ১

পঞ্চমীর রাতটা মণ্ডপে কাটিয়েই ভোর ভোর থাকতে পরিভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেন গণপতি । তা যস্মিন দেশে যদাচারেৎ! শুঁড়টাকে নিয়ে যে মুশকিল হয়নি তা নয়, তবে পরিশেষে স্যুটে টাই বাঁধার মতো করে কোটের মধ্যে চালান করে নাসাগ্রে, থুরি, শুঁড়াগ্রে জনসন কোম্পানির মাস্ক লাগিয়ে গজানন যখন বেরোলেন তখন কে ভেদ করবে তাঁকে রাজস্থানবাসি প্রবাসী না ভেবে। এত অবধি সদাই গজানন শুনে এসেছেন পূজা পূজা গন্ধ নাকি মাতাশ্রীর আগমনের সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ে মর্ত্যলোকের আকাশে বাতাসে। বড় রাস্তায় এসে কোটের মধ্য থেকে লম্বা এক শ্বাস নিয়ে চোখ বুজলেন সেই সুবাস আস্বাদন করতে পরমুহুরতেই দুর্গন্ধে আঁতকে উঠলেন। ইতি উতি চাইতেই নজরে এল দুর্গন্ধের উৎস। কর্পোরেশন এর আবর্জনা সংগ্রহের স্থান উপছে পড়ে রাস্তার একাংশ গ্রাস করে আছে জঞ্জাল, নোংরা। কি নেই তাতে? পচা খাদ্যাংশ,পশু বিস্ট আর তা ধুয়ে দেবার জন্য সর্বজন সমক্ষে মনুষ্য মুত্র। আহা! কি মনকাড়া ভোরের দৃশ্য !!
গজানন বড় রাস্তা ছেড়ে পল্লীতে ঢুকলেন।
বাঃ ভারী সুন্দর আবাসিক পরিবেশ। প্রসন্ন চিত্তে গজানন সপ্রশংস নয়নে মনুষ্য কৃত স্থাপত্য সৌন্দর্যে মগ্ন হলেন। বলা বাহুল্য এখানকার বাসিন্দারা শুধুমাত্র নান্দনিক বিচারে ধনী নয়, আক্ষরিক অর্থেও বটে। কিন্তু ঐ যে বলে না ‘ মর্ত্য সুখ স্বর্গবাসীদের সহ্য হয় না’ এ ক্ষেত্রে তার বিপরীত হয় কি করে? প্রথমে এক ঘূর্ণায়মান বাহন চালিকার নির্গত কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার দেখলেন ( ভাগ্যে মাস্ক
পরে আছেন নইলে পর্যটন শিকেয় তুলে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের হাসপাতালে বন্দী হতেন) আর তার পরেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এক আবাসন এর প্রাইভেট লেন এ ঢুকে সুরক্ষা কর্মীর কাছে যা তা ভাবে অপমানিত হলেন।
আর সেটা হজম হতে না হতেই অকাল বোধনের মত অকাল বৃষ্টি অর্থাৎ উপর মহলের অলিন্দ থেকে অঝোর ধারায় নেমে আসা ময়লায় সিক্ত হলেন। টালা থেকে টালিগঞ্জ, বালি থেকে বালীগঞ্জ পরিভ্রমণ শেষে এই অভিজ্ঞতাই গজানন অর্জন করলেন ‘মর্ত্যবাসীর সামাজিক স্বাধীনতার সংজ্ঞা বড়ই বিচিত্র। যত্রতত্র আবর্জনা ছড়িয়ে পরিবেশ দুর্গন্ধ যুক্ত করা,জনসমক্ষে মূত্র বা মল পরিত্যাগ করে কলুষিত করা, রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খান খান করে যুব জনিত আহ্লাদে আনন্দ সূচক অশ্লীল ধবনি করে শান্তিপ্রিয় পল্লীবাসীর হৃৎকম্প সৃষ্টি করা আর নিজের অপারগতার কারণ অপরের স্কন্ধে চাপিয়ে ভারমুক্ত হওয়া !

দৃশ্য কল্প ২
মা লক্ষ্মী প্যাঁচাটাকে মায়ের কাছে জমা রেখে বেরোলেন। প্রথমেই পোস্তায় এলেন। বড় নাম শুনেছেন চিরকাল, আজ চাক্ষুষ দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না। ব্যবসা বানিজ্যের হৃদয় যে বড়বাজার আর পোস্তা তা বলাই বাহুল্য। সার সার চক্র যান দাড়িয়ে আছে নানাবিধ উপকরণ,শাক সব্জি নিয়ে এক শ্মশানের স্তব্ধতায়। কিন্তু কেন? একটু এগিয়ে যেতেই ব্যস সব জলের মতো পরিস্কার! পথ সুরক্ষা কর্মী যাদের যবন ভাষায় পুলিশ ( নাকি ফুলিশ ) বলা হয় তারই প্রতিনিধি পর্যবেক্ষণ মুলতুবি রেখে উৎকোচ গ্রহণে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়ে চলেছে এবং তার দরাদরির ফলস্বরুপ এই যান স্তব্ধতা। সেই শুরু,পোস্তা থেকে সরকারি কার্যালয়, কর্পোরেট অফিস, চিকিৎসা কেন্দ্র, এজরা স্ট্রীট, লালবাজার ইত্যাদি নানাবিধ স্থান পরিদর্শন শেষে উৎকোচের তথা দুর্নীতির নতুনতর ব্যাখ্যায় দারুণ ভাবে শিক্ষিত হলেন বিষ্ণুপ্রিয়া।
উৎকোচ আধুনিক মানব সভ্যতার অর্থনৈতিক স্তম্ভ। রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তা চাঁদা হিসেবে পরিগনিত হয়। ব্যবসায়ীক লেনদেনে তা পরিষেবা বলে বিবেচিত, ধর্মীয় বলয়ে তা সেবা বা ভক্তি হিসেবে তুল্য। সরকারি প্রশাসনে তা হোল নাগরিক কর্তব্য। উৎকোচ গ্রহণকারীর বিবেক নিতান্তই পরিস্কার। যুক্তি সর্বজন গ্রাহ্য ‘ আমি তো চুনোপুঁটি রাঘব বোয়ালদের সুমুখে। আরে বাবা এটা আমার আর্থ – সামাজিক দায়ব্ধতা।‘
তৃতীয় নেত্রের উন্মেশ বোধ করি একেই বলে !!

দৃশ্য কল্প ৩
বীনানন্দিত সুরধনি দেবী সরস্বতী রবীন্দ্রসরোবর পরিক্রমায় এলেন মণ্ডপ ছেড়ে। হংস বাহন সরোবর পেয়ে যারপরনাই তৃপ্ত । পাঁচপাঁচ টা দিন দেবী কে বহন ( তবুও রক্ষে ফিগার সম্বন্ধে সরস্বতি সদা সচেতন) করা কি সহজ কথা। এদিকে দেবীর বীনার টুং টাং আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে জড় হয়েছে এক দল ছেলেমেয়ে। তাদের মাথায় নানারকম ফেট্টি বাধা, হাতে রকমারি বাদ্য যন্ত্র। সবারই হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা আর চক্ষু এই সাত সকালেই ঢুলু ঢুলু ।
‘দিদি কি ঐ আদ্যিকালের যন্ত্রটা বিক্রি করতে বেড়িয়েছেন নাকি?’
সরস্বতী নির্বাক।
‘অ্যান্টেক হলেও দাম বেশি দিতে পারব না কিন্তু।‘
‘আমাদের ব্যান্ডে যোগ দেবেন নাকি?’
সুযোগ যখন আসে এরকম ভাবেই আসে। সঙ্গীত জগত পরিভ্রমণের সুবর্ণ সুযোগটা সদ্ব্যবহার করলেন বীনপানি এদের মাধ্যমে।
পরিভ্রমণ অন্তে জানলেন ব্যান্ড সঙ্গীত এখন সর্বাধুনিক ফিউসন সঙ্গীত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়। বুঝলেন এই সঙ্গীত ধারায় কর্ণ প্রিয় সুরধবনি ব্রাত্য, কর্ণ বিলাপ আর্তনাদই গণ্য। শিখলেন ব্যান্ড সঙ্গীত জগতে বাদ্য যন্ত্র ছুৎ মার্গ থেকে পেয়েছে মুক্তি। শব্দ সৃষ্টিকারী যে কোন উৎসই গ্রহণীয়।
সঙ্গীত দুনিয়ার এই অসাধারন সাম্যবাদ দর্শনে আপ্লুত হলেন দেবী। সঙ্গীত কে আপারমর জনতার অধিকারের জন্য অর্গল মুক্ত করা হয়েছে তথাকথিত মুষ্টিমেয় সঙ্গীত শিক্ষার সংস্থার কবল থেকে। কার ঘাড়ে কটা মাথা যে প্রশ্ন তোলে সুর না বেসুর! বীনাটাকে সুভাষ সরোবরে বিসর্জন দিয়ে হাঁসের পিঠে চেপে দেবী ডিভিডি হস্তে উদ্বেলিত হয়ে ফিরলেন একেবারে সুসজ্জিত ডিস্ক থিক থেকে।

দৃশ্য কল্প ৪
কার্তিকের চিরকালই একটু ইয়ের দোষ আছে! একে মায়ের আদরের দুলাল তাতে মোহন গঠন আর রূপ। এরপরেও যদি তাকে বিবেকানন্দ হতে বলা হয় সেটা অন্যায় বলা হয় নাকি? তবে স্বর্গই বলুন আর কৈলাসই বলুন ইয়ে ব্যাপারটায় উৎসাহ পাওয়া খুবই দুরস্ত। ইন্দ্রের সভার কথাই ধরা যাক না। মেনকা, রম্ভা, উর্বশী দের নিয়ে যত গালগল্পই প্রচলিত থাকুক না কেন আসলে নান্দনিক নৃত্যে আক্ষরিক অর্থে বসনে ঢাকা অঙ্গ দেখে আর যাই হোক কার্তিকের ইয়ে ত হয়ই না বরং দেবরাজ এর জন্য অনুতাপই হয়। মর্ত্য লোকের মণ্ডপে বাধা থাকতেন বলে অঞ্জলি দিতে আসা লাল পেড়ে শাড়ি পরিহিত স্নিগ্ধ রমণী সৌন্দর্য অথবা লাস্যময়ী তরুণী দর্শন ছাড়া তার ভাগ্যে এতবিধিকাল কিছুই আর জোটে নি। অতএব মুক্তি পেয়েই কার্তিক চললেন সভ্যতার সাংস্কৃতিক অন্বেষণে। প্রথমে আইনক্স এর মাল্টিপ্লেক্স, তদবধি পার্কস্ট্রীট, ফ্রিস্কুল স্ট্রীট,পাঁচ তারা,সাত তারা হোটেল এবং পরিশেষে সমুদ্র তট সন্দর্শনে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা আর তৃপ্তি অর্জন করলেন।
‘ইন্দ্র কে একবার ক্যাবারে দেখাতে হয় মর্ত্যে এনে, ব্যাটা বুঝতে পারত পানসে সরবত আর স্কচ হুইস্কিতে কি তফাৎ। অমৃতর নামে কি যাচ্ছেতাই পানীয় পরিবেশিত হয় তা মর্মে মর্মে অনুভব করতেন দেবরাজ। আর ঐ অপ্সরাদের নেত্য? ছ্যা ছ্যা, প্রায় বিবসনা মর্ত্য সারসীদের সামনে তা যে কত ফিকে আর জোলো তা মালুম পড়ত স্বর্গবাসীদের!’
দেখতে দেখতে কার্তিকের সেই না পাওয়া সৌভাগ্যের স্বপ্নে বড়ই কাতর হয়ে পড়লেন । এহেন স্বর্গপুরী থুড়ি মর্ত্য পুরী ছেড়ে দশমীর লগ্নে বিদায় যে কি মাত্রায় মনোবিদারক তা সর্বপ্রথম হাড়ে হাড়ে অনুভব করলেন শ্রীমান!!

উপসংহার
কৈলাসে আপতকালীন জরুরি সভার তলব করা হয়েছে। সকল দেবতাদের উদ্দেশ্যে হুইপ জারি করেছেন মহেশ্বর যোগদানের জন্য। কারন? এই প্রথম দেবলোকে অভাবনীয় ও অশ্রুতপূর্ব ঘটনা ঘটে চলেছে। স্বর্গ্য মর্ত্য বিভাজন সীমায় যমরাজের প্রশাসন
দুর্নীতি তে পাকাপোক্ত হয়ে উৎকোচ গ্রহন করে দুরাত্মাদের স্বর্গে প্রবেশ অধিকার দিচ্ছেন আর মহাত্মাদের পাঠাচ্ছেন নরকে!
নন্দন কাননের নান্দনিক শ্বাশত সনাতন শান্তি বিঘ্নিত বিচিত্র শব্দ আর বাদ্যের অনৈক্য তানে। দেবরাজ ইন্দ্রের নৃত্য সভায় প্রায় বিবসনা অপ্সরাদের প্রমত্ত নৃত্যে দেবগন আন্দোলিত!
স্কচ হুইস্কির এমনি মাধুর্য দেবতারা নাকি অমৃতের সাথে বিনিময় করে চলেছেন অসুরদের মাধ্যমে। এমনকি মহাদেবের সাক্ষাৎ সাঙ্গাত নন্দী ভিরিঙ্গির পর্যন্ত গঞ্জিকা সেবনে অরুচি দেখা দিয়েছে। ড্রাগ এর শুকনো নেশায় তাঁরাও দিবারাত্রই ধরাশায়ী।
‘তারুন্যের মুক্তি’ এই ব্যানারে নবীন দেবদেবী গন দল ঘোষণা করে ব্রম্ভা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর এর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এ কথা তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেবলোকে প্রচলিত নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ সামাজিক ব্যাবস্থা আবার পুনঃ বহাল করতে দেবী দুর্গার পিতৃলোক ভ্রমণের ট্যুর রিপোর্ট জমা করার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। মণ্ডপ ছেড়ে পরিদর্শনের নির্দেশও তুলে নেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যান এর পরিবারের জন্য।

পরিশিষ্ট
এই মাত্র স্বর্গ সংবাদে প্রকাশ বৈকুণ্ঠ ছেড়ে শ্রী বিষ্ণু সুদর্শন চক্র হাতে ধাওয়া করেছেন ত্রিলোকে নারদের সন্ধানে!!

ভালবাসার সেদিন এদিন

সুমিতা সাঁতরা

যখন তুমি উড়েছিলে পক্ষীরাজের পিঠেয় চড়ে-

তোমার নামের প্রথম অক্ষর লিখেছিলাম স্লেটের পরে।

তখন তুমি রাজপুত্তুর, আর আমি রাজকন্যে টুপুর

সেও সে ছিল ভালবাসা, আজও আছে হৃদয়ঠাসা ।

 

সেদিন তুমি দৌড়েছিলে ঘুড়ি নিয়ে মেঠো আলে-

কোঁচলে গাঁথা শিউলিমালা পরিয়েছিলেম তোমার গলে।

তোমার চোখে খুশীর ঝলক, আমার প্রাণে পরম পুলক

সেও সে ছিল ভালবাসা, আজও আছে হৃদয়ঠাসা ।

 

যেদিন তুমি চলে গেলে শহরেতে ভর্তি হতে-

ট্রেনের পিছে ছুটেছিলেম হাত নাড়িয়ে কাশবনেতে।

তোমার মন আনমনা,আমার যে আর দিন কাটেনা

সেও সে ছিল ভালবাসা, আজও আছে হৃদয়ঠাসা ।

 

যেদিন তুমি ডিগ্রী নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরলে দেশে-

জমা কথা লিখে তোমায় পত্র দিলেম মৃদু হেসে।

আপন করে নিলে তুমি, হলেম আমি তোমার জানি

সেও সে ছিল ভালবাসা, আজও আছে হৃদয়ঠাসা ।

অভিসার

সুস্মিতা সরকার
(প্রাক্তনী, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ)


জয়শ্রী যখন স্নান করে বের হল, গোটা ঘরটা চন্দনের গন্ধে ভরে উঠল। গন্ধটা ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ লেপ্টে থাকবে, জানে জয়শ্রী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে ধবধবে সাদা সিল্কের শাড়ি পরতে পরতে আপনমনে গুনগুন করছে, ‘বহু মনরথে সাজু অভিসারে…’।

শাড়িটায় পাড় নেই। তবে লম্বাহাতার উজ্জ্বল ময়ূরকণ্ঠী রঙের ব্লাউজের সঙ্গে এক অসামান্য কনট্রাস্ট তৈরি হয়েছে। ওর ছিপছিপে মেদহীন চেহারাটা চাবুকের মত দেখাচ্ছে। একটু ময়শ্চরাইজার নিয়ে হাল্কা হাতে ঘষতে ঘষতে ভাবল, চুলটা খোলা রাখবে নাকি একটা হাতখোঁপা করে নেবে! ময়শ্চরাইজার মাখা শেষ করে অল্প পাউডার। এবার আই লাইনারের টান। ভাবল, সারাদিনের জন্য যাওয়া, তাই সরু লাইনই থাক। জয়শ্রী জানে ওর চোখ দুটো কতটা বাগ্ময়, কতটা আকর্ষণীয়! তার উপর হাল্কা কাজল আর লাইনারের টান দিলে তা কতখানি ধারাল হয়ে ওঠে সেটা বুঝেই টানল রেখা। কাজল লাগিয়ে আয়নায় নিজের চোখদুটো দেখে সেই কিশোরীবেলার মতই মুগ্ধ হল। ইচ্ছে হল বারে বারে দেখে নিজেকে।

হঠাৎই ঠোঁটের কোণায় একটা দুষ্টুমি মাখানো মুচকি হাসি খেলে গেল। যেন কিছু একটা ষড়যন্ত্র করেই তুলে নিল লিপস্টিকের বাক্সটা। মন দিল ঠোঁটের রঙ বাছায়। এটা ওর অনেকদিনের শখ। কত রঙ যে ওর সংগ্রহে আছে তা বলার নয়। বেগুনি ঘেঁষা হাল্কা গোলাপি, গাঢ় গোলাপি, পিচ, কমলা, কফি রং; কি নেই! আজকে কি কমলাই লাগাবে? চেরি রঙটাও তো বেশ মানায়! অবশ্য টকটকে লালটা লাগালেও মন্দ হয় না! একটা একটা করে রং হাতে নেয় আর এক একটা ভাবনা খেলে জয়শ্রীর মাথার মধ্যে। তার ছাপ পড়ে ওর চোখের ঝিলিকে আর ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখায়। শেষমেশ লাল আর পিচ এই রঙদুটোই পছন্দ হল। সাদা শাড়ির সঙ্গে ঠোঁটের রঙটা উজ্জ্বল হলে বেশি মানায়। লিপ লাইনার দিয়ে নিপুণ হাতে ঠোঁট এঁকে নিল প্রথমে। তারপর লাল আর পিচ পর পর মিশিয়ে দিল। ‘নট ব্যাড!’, আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পাস নম্বর দিল নিজেকে। এবার উঁচু করে বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে আঁচড়াতে আঁচড়াতে টের পেল নিজের মনের চোরা শিরশিরানি। খোলা রাখবে ভেবেও কি মনে করে একটা চিমটি ক্লিপ দিয়ে আটকে নিল চুলে। কানে লাল পাথর দেওয়া রুপালি রঙের বড়বড় ঝোলা দুল। লিপস্টিকের মতই কাঁচের চুড়িও প্রতিও ওর তীব্র আকর্ষণ। বাঁ হাত ভর্তি রংবেরঙের কাঁচের চুড়ি গলিয়ে ডান হাতে পরে নিল গাঢ় নীল ডায়ালের রুপালি ব্যান্ডের ঘড়ি । কানের পিছনে, গলায়, বুকের খাঁজে আর হাতে ফুলেল সুগন্ধির ছোঁয়া। ব্যাস, জয়শ্রীর সাজ শেষ। হ্যাঁ, গলাটা খালিই রইল। সেই স্কুলবেলার এক গুণমুগ্ধ বালক প্রেম নিবেদন করে বলেছিল, ওর নাকি মরাল গ্রীবা। ছেলেটাকে ভুলে গেলেও কথাটা মনে গেঁথে আছে। আর সেই গ্রীবায় আছে একটা লাল তিল। গলাটাকে সাজালে ওই তিলটার অমর্যাদা করা হয়।

আজ জয়শ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় পুনর্মিলন উৎসবে যাচ্ছে। প্রতিবছরই এই দিনটা এক বিশেষ দিন। নাচ, গান, নাটক, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। এই একটা দিনে সিনিয়ার, জুনিয়ার, স্যার, ম্যাডামেরা সবাই দারুণ উৎসবের মুডে থাকে। অনেক পুরনো, বিখ্যাত প্রাক্তনীও এই দিনটিতে তাদের ছাত্রজীবনে ফিরে যায়। তবে দিনটা এবছরে জয়শ্রীর কাছে অন্য কারণে বিশেষ। পাস করে বেড়িয়ে যাওয়ার পর এটাই ওর প্রথম বছর। তাছাড়া ইন্দ্রদার সঙ্গে পাক্কা এক বছর পর দেখা হবে। কথাটা ভেবেই বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার মত একটা অনুভূতি হল। কানের লতিগুলো জ্বালা করে উঠল। এবারেও কি কিছু বলবে না ইন্দ্রদা?

সাড়ে দশটা নাগাদ গান্ধীভবনের সামনে পৌঁছে দেখল, ভিড় জমে নি মোটেই। রেজিস্ট্রেসন কাউন্টারে দুজন চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছে। কেউ এলে মন দিয়ে নামের লিস্ট মিলিয়ে টাকা নিয়ে কিট এগিয়ে দিচ্ছে। সই করতে গিয়ে জয়শ্রী দেখল ওর নামের বেশ কিছুটা আগে ইন্দ্রনীল রায়ের নাম। মানে, ইন্দ্রদা এসে গিয়েছে। বুকের ভিতর আবার সেই হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার অনুভূতি। কি মনে করে ফাঁকা গান্ধীভবনের ভিতরেই ঢুকল ও। আর ঢুকেই ইন্দ্রর সঙ্গে মুখোমুখি! অপেক্ষা অধীর হলেও ঠিক এতটাও আশা করে নি জয়শ্রী।

‘আরে করেছিস কী? তোর দিকেই তো তাকিয়ে থাকতে হবে আজ সারাদিন!’ কোমরে হাত দিয়ে জয়শ্রীর সামনে দাঁড়িয়ে একটু পিছনে হেলে নিরীক্ষণ করার ভঙ্গীতে বলল ইন্দ্র।

‘তাই নাকি?’ নিরীহ মুখে বললেও অন্য কথা বলল জয়শ্রীর মন, ‘হুঁ হুঁ, সেটাই তো চাই শ্রীমান ইন্দ্রনীল রায়! তুমি শুধু আমাকে দেখবে বলেই তো আজ এত সাজলাম!’

‘কেন, তুই জানিস না?’শুনেই জয়শ্রীর ঘোর কাটল।

চমকটা নিমেষে লুকিয়ে নিয়ে বলল, ‘কেউ তো বলে নি! কি করে জানব?’

‘বলার কী আছে? ছেলেদের চোখের দিকে তাকা, তাহলেই বুঝতে পারবি।’

‘মুখ ফুটে তুমি বললেই যখন, তার তো একটা দাম দিতেই হয়। এক কাজ কর তুমি, আমার দিকেই তাকিয়ে থেকো আজ সারাদিন।’

‘ইস, মামার বাড়ি! আর আমি যে এতগুলো টাকা দিলাম! নাচা, গানা না দেখলে আর এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের ঝারি না মারলে উসুল হবে?’

‘তা অবশ্য ঠিক কথা।’ আয়ত চোখদুটোয় একটা মারকাটারি কটাক্ষ হেনে জয়শ্রী বলল, ‘ওই যে ঢুকছে তোমার সুন্দরী প্রমীলাবাহিনী। আমি চললাম, তুমি ঝারি মার। কেমন?’ পাশ কাটিয়ে এগোনোর উপক্রম করতেই দুহাত দিয়ে ওর পথ আটকালো ইন্দ্র।

‘এই, তুই রাগ করলি! ব্যাপার কী রে? সেন্টু?’

‘তুমি অন্য মেয়েদের দেখলে আমি কেন সেন্টু খাব? তুমি কি আমার বয়ফ্রেন্ড?’

‘মানে তোর বয়ফ্রেন্ড হলে রাগ করতিস?’ প্রশ্নটা করতে করতে আরেকটু কাছে ঘনিয়ে এল ইন্দ্র।

‘জানি না যাও।’ বলে দ্বিতীয় কটাক্ষটা হানল জয়শ্রী।

‘একটা কথা ভাবছি, বুঝলি।’

‘বলার হলে বলে ফেল কি ভাবছ?’ ইন্দ্রর চোখের দিকে তাকাল জয়শ্রী।

‘আজ থেকে তুই রাগ করিস, আমি যদি অন্য মেয়েদের দেখি। আমি তোকে রাগ করার পূর্ণ অধিকার দিলাম।’

‘মানে?’

‘মানে বুঝতে পার না হাঁদারাম! আসলে আমার খুব ইচ্ছা তোর বয়ফ্রেন্ড হওয়ার।’

‘এই, তুমি আমাকে হাঁদারাম বলছ?’

‘হাঁদা মেয়েকে হাঁদা বলব না? তুই বুঝিস না আমি তোকে ভালোবাসি?’

‘না বললে কী করে বুঝব?’

‘ওই জন্যই তো হাঁদা বললাম রে! বুদ্ধিমান হলে কবেই বুঝে যেতিস। আর বকাস না। চল একটু দক্ষিণাপণে যাই।’ বলে আচমকা জয়শ্রীর হাত ধরে টান দিতেই ও প্রায় ইন্দ্রের বুকের উপর এসে পড়ল।

‘সবাই আসবে আর আমরা এখন দক্ষিনাপণে যাব?’ বোকা বোকা মুখে প্রশ্ন করল। গলায় জোর নেই, একটু দূরে সরে যাওয়ার শক্তিও যেন নেই জয়শ্রীর।

‘যেখানে খুশি যাব। কি মুশকিল, যেতে পারি না! আচ্ছা চল দক্ষিণাপণের সামনে ফুচকা খাওয়াব, তারপর তারপর আইসক্রিম … ইশ, আমার জিভে জল চলে আসছে। কতদিন ফুচকা খাই নি, ওই খোট্টাদের পানিপুরিতে পোষায় বল?’

জয়শ্রী চুপ করে থাকায় ইন্দ্র আবার বলল, ‘কি হল? তুই রাজি না থাকলে বলে দে বাবা! এসেই দেখেছি সম্প্রীতা বেশ আমার দিকে প্রেম প্রেম চাউনি দিচ্ছে। ওকেই আবার খুঁজে বের করি না’হয়।’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গুনগুনিয়ে গান ধরল ইন্দ্র, “ও কেন এত সুন্দরী হল, অমনি করে ফিরে তাকাল, দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই…।”

জয়শ্রী বাক্যহীনা। গত তিনবছর ধরে যার প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু সে যে হঠাৎ করে এরকম ভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেবে সেটা যেন অপ্রত্যাশিত। অনেকবার অনেকরকম ভাবে কল্পনা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ রকম হালকা চালে, ইয়ার্কি মারার ভঙ্গীতে কেউ প্রেম প্রস্তাব দেয় ওর মাথায় আসে নি। আবার বলে সম্প্রীতাকে খুঁজে বের করবে! মানে? ছুরি চালিয়ে নুন ছিটনো! কি বিপজ্জনক ছেলে রে বাবা! ভাবলেও ভাল লাগায় অবশ হয়ে আসছে জয়শ্রীর দেহ ও মন।

‘খুঁজলেই হল না?’ বলে অস্থির হাতে ও একটা কিল মারল ইন্দ্রর বুকে। ইন্দ্র ওর হাতটা চেপে ধরে চারিদিকে তাকাল। ‘শিগ্রী এই কিল মারার শোধ নিচ্ছি, ওয়েট।’, বলে হাতটা ছেড়ে দিল।

অনুষ্ঠানের আকর্ষণ কোথায় পালিয়ে গেল দুজনের। রাস্তায় পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ায় মধ্যে যে কি আনন্দ! অনেকক্ষণ চুপ করে আছে জয়শ্রী। সেই যে কিল মেরেছিল তারপর থেকেই। ইন্দ্র তাকাল ওর দিকে। খুব নরম স্বরে বলল, ‘এই ভিড় রাস্তায় কেউ আমাদের চেনে না, তাই এই ভিড়েও আমরা একা। ওখানে সবাই চেনে আমাদের। একটু পরেই সব গান গাওয়ার আবদার জুড়ত, তাই আগেভাগেই তোকে নিয়ে কেটে পড়লাম, বুঝলি?’

জয়শ্রী উত্তর দিল না। অন্যসময় এই রাস্তার হাঁটলে, রাস্তার পাশের দোকানগুলো ওর নজর কেড়ে নেয়। আজ অন্য রকম। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে ও। এই একটা দিনের জন্য কতদিনের অপেক্ষা, সেকথা শুধু ওই জানে। অথচ আজ সোজাসুজি কথাটা বলল ইন্দ্র, আর ওর যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না।

‘কিরে, কিছু বলবি না তুই?’ জয়শ্রীর বাঁ হাতখানা নিজের ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ইন্দ্র বলল, ‘তুই কি জানিস, আজ আমি শুধুমাত্র তোর সঙ্গে দেখা করার জন্যই এসেছি? নাহলে দিল্লি থেকে রিইউনিয়নে কেউ আসে? মা পর্যন্ত বলছিল, ‘শুধু রিইউনিয়নের জন্য যাবি? অকারণ ছুটি নষ্ট, টাকা নষ্ট।’ আর দেখ, তুই কিছু বলছিসই না’।

‘কী বলব?’

‘এই যে আমি বললাম, আমি তোর বয়ফ্রেন্ড হতে চাই। তুই বললি না তো, তুইও তাই চাস কিনা?’

‘তুমি জান না?’

‘না বললে কী করে জানব?’ একটু আগেই বলা জয়শ্রীর কথাটা ফেরত দিল ইন্দ্র। মুচকি হাসির সঙ্গে বেশ কিছুটা দুষ্টুমি মিশেছে এখন।

‘তাহলে শোন, হ্যাঁ আমিও চাই।’ ফুটপাথের একপাশে সরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জয়শ্রী। তারপর স্পষ্ট চোখে তাকাল ইন্দ্রর দিকে, ‘সেই প্রথম দিন থেকেই চাই। যেদিন ভাঙ্গা হাত নিয়ে গান্ধীভবেনের সামনে রিক্সা থেকে নামলে সেদিন থেকেই।’

ইন্দ্রের মুখের দুষ্টুমি মেশানো মুচকি হাসিটা আর নেই। তার বদলে একটা শান্তির ছায়া। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জয়শ্রীর খুব ইচ্ছে হল ওর বুকে মাথা রেখে একটু দাঁড়াতে। কতদিন, কতদিন ও এই একটা দিনের স্বপ্ন দেখেছে সে ওই জানে!

‘ওয়েক আপ, ওয়েক আপ, ওয়েক আপ, ওয়েক আপ…’
মোবাইলের অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গতেই মুখখানা বাংলার পাঁচের মত করে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল জয়শ্রী। ভাবল, ‘এমন স্বপ্ন ভেঙে যেতে আছে?’ নিজের হাতের দিকে খানিকক্ষণ এক নিমেষে তাকিয়ে থেকে একটা শ্বাস ফেলল। তারপর আলতো করে হাতটা বুলিয়ে নিল গালে, গলায় আর ঠোঁটে।

ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রী জয়শ্রীর প্রেম নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না কোনদিনই। কলেজে পড়তে এসেও ভাবত এতখানি একটা তুচ্ছ বিষয়কে কি করে ওর বন্ধুরা জীবনমরণ সমস্যা বানিয়ে বসে আছে। শুধু খারাপ ছেলেমেয়েরাই যে পড়াশোনা না করে প্রেম করে সময় নষ্ট করে সে ব্যাপারে ওর কোন সন্দেহ ছিল না। রাস্তাঘাটে হাতে হাত রেখে চলা প্রেমিকযুগল দেখলেই ওর মনে হত একটা থাপ্পড় মেরে পড়তে বসিয়ে দেয়। ও বরাবর এটাই জানত যে পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি পাওয়াই ওর জীবনের আসল লক্ষ্য। পড়াশোনাই ছিল ওর জীবন। আর তাই কাউকে ভালো লাগার অবকাশ ছিল না।

সেই জয়শ্রীও একদিন প্রেমে পড়ল! ততদিনে পড়া শেষ হয়ে আসছে। সেদিন ছিল এরকমই এক পুনর্মিলন উৎসবের দিন। ইউজির শেষ বছর। ও বসেছিল নাম রেজিস্ট্রেসন কাউন্টারে। ঋতম ছিল পাশের চেয়ারে। তখন সকাল সাড়ে দশটা। ধীরে ধীরে একজন দুজন করে হাজির হচ্ছে। হাসাহাসি আর গল্পে জমে উঠছে চত্বর। জয়শ্রী দেখল রিক্সা থেকে একটা সাধারণ দেখতে ছেলে নেমে এল। পরণে মেরুণ পাঞ্জাবি আর হাল্কা নীল জিন্স। এসব কিছুই অবশ্য জয়শ্রীর চোখে পড়ত না, যদি না ছেলেটির একটা হাতে প্লাস্টার করা থাকত। তালিকা থেকে কেবল ওর নামটা কেমন মনে গেঁথে গেল। ওই প্লাস্টারই ইন্দ্রনীল রায়কে আলাদা করে দিল সেদিন।

সেদিন সারাদিনে নানান কাজ বা আড্ডার ফাঁকে কেবল ইন্দ্রনীল রায়কেই দেখল জয়শ্রী। আর শুনল ওর গান। ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’, ‘ও চাঁদ সামলে রাখ জোছনাকে’, ‘আমি তার ঠিকানা রাখি নি’, ইত্যাদি। লাঞ্চের পর মাঠে বসে মান্না দে’র পাগল করা প্রেমের গানগুলো একটা একটা করে গাইছিল ইন্দ্রনীল আর জয়শ্রী একটু একটু করে ডুবছিল। ইন্দ্রনীল কি ওকে খেয়াল করেছিল? জয়শ্রী জানে না। ও শুধু জানে ওর ধ্যানধারণা কেমন ভেসে চলে যাচ্ছে ওর থেকে অনেক দূরে। একটা ছেলেকে দেখে ওর ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে।

তিনবছর আগের সেই দিনটার কথা ভাবলে এখনও কেমন যেন ঘোর লাগে জয়শ্রীর। নাম ছাড়া আর কিছুই জানত না সেদিন। আলাদা করে একটাও কথাও হয় নি ওর সঙ্গে। শুধু সারাদিন একটা নেশার মধ্যে কাটিয়ে একবুক ভালো লাগা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন।

পরের দিন ক্লাসে গিয়ে ঘুরিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছিল। জানতে পেরেছিল ইন্দ্রনীল একজন খুবই সাধারণ ছাত্র তবে অসাধারণ লেখক আর অসামান্য গায়ক। ওর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মাতিয়ে রাখত ও। জয়শ্রীর থেকে তিন বছরের বড়। জয়শ্রী যেবার ঢোকে, ইন্দ্রনীল সেবারেই বেরিয়ে গিয়েছে। এখন দিল্লিতে একটা পত্রিকায় কাজ করে। জয়শ্রী ফেসবুকে খুঁজে খুঁজে বের করেছিল ইন্দ্রনীল রায়কে। সাহস করে নিজের পরিচয় দিয়ে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল। তারপর একটু একটু করে একে অপরকে জানা।

তারপর থেকে প্রতিবছর এই একটা দিনেই ওদের দেখা হত। জয়শ্রী অনেকবার ইঙ্গিত দিয়েছে, কিন্তু নিজে মুখে বলতে পারে নি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকার পর থেকে ইন্দ্রর সঙ্গে চ্যাটে কথা বলার পরিমাণ বেড়েছে। নানা রকম কাজের কথা বলতে বলতে হাজারটা অকাজের কথাও হয়। অকাজের কথাতেই যেন দুজনের আনন্দ বেশি। জয়শ্রীর মনে হয়, ইন্দ্র কিছু বলতে চায়। কিন্তু ওই মনে হওয়াই। কিছুই তো বলে না স্পষ্ট করে। জয়শ্রী অপেক্ষা করে। জানে না কবে আসবে সেই দিন!

অত সাধের স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাওয়ায় একটু দুঃখ হল ওর। তারপর হঠাৎ মনে হল, ‘অনেক দিন তো হল স্বপ্ন দেখছি। আজ বরং নিজেই স্বপ্নটা সত্যি করে ফেলি। ও কিছু না বললে, আমিই বলে দেব।’

‘গুডমর্নিং, তাড়াতাড়ি এস। আমি আসছি…’ মেসেজটা লিখে ইন্দ্রকে পাঠিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে একটা হাই তুলল জয়শ্রী। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে নেমে চঞ্চল পায়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। দুধসাদা মাইসোর সিল্ক আর লম্বাহাতা ময়ূরকন্ঠী রঙের ব্লাউজটা বের করল। শাড়ির ভাঁজেই রাখা ছিল মাইসোর থেকে আনা চন্দন সাবানটা। সেটা ওর পায়ের সামনে পড়ে গেল শব্দ করে। প্যাকেটা খুলে লম্বা শ্বাস নিল। তারপর ঢুকে গেল স্নান ঘরে। স্নানঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে গুঞ্জরিত হচ্ছে,

‘বহু মনরথে সাজু অভিসারে, পেহেলু সুনীল বেশ
কাজর নয়ানে সলাজ বয়ানে কুসুমে সাজানু কেশ…’

-সমাপ্ত-
(গানের পঙক্তিঃ ঋতুপর্ণ ঘোষ)

বাংলা আমার আশা

সুশান্ত কুমার দাস

প্রায় সারাজীবন কেটেছে আমার
বাংলার বাইরে। শুধু পড়াশুনার
কয়েকটি বছর ছিলাম সেখানে।
কিন্তু বুঝি না কেন যে প্রতিদিন আমার
মনকে মুগ্ধ করে রাখে বাংলার কথা
আর গানে।
কতবার মনে হয়েছে “ছায়া সুনিবীড়
শান্তির নীড়” বাংলার কোন গ্রামে
বেশ কিছুদিন কাটাই।
আর খুঁজে বেড়াই সেই “ময়না পাড়ার
মাঠ” যদি সেখানে আজকের
কোন “কৃষ্ণকলির” সন্ধান পাই।
কতবারই তো বিদেশে সাগরের
সবুজতীরে দেখেছি তুলনাহীনারে
আর মনে হয়েছে হয়তো রবীন্দ্রনাথই
অশেষ বন্ধনে বাংলার সাথে বেঁধেছে
আমারে।
আজও বাংলা থেকে এতদূরে এই দক্ষিণে
ঘরের বারান্দায় বসে যখন কোন চিল দেখি
নীল আকাশে,
তখনি কেন আমার বাংলার কারো
“বেতের ফলের মত ম্লান চোখ”
মনে আসে?
আগে মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণে বিদিশায়
গিয়ে মনে পড়ল “বনলতা সেন”
নামের জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা।
“আমি প্রেমের আশায় পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে
থাকি” কবিকে মনে হয় যেন হায় কালো মেঘে ঢাকা
পূর্বাহ্ণের সবিতা।
এখানেও যখন অতিদূরে
পল্লীগ্রামে যাই
মুগ্ধ হয়ে বাংলার সেই চিত্রটি
দেখতে পাই –
“সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে
পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা”।
সবাইকে এই কথাটি বলে যেতে চাই
বাংলা আমার আশা – বাংলা আমার ভালোবাসা,
বাংলায় একটি সুন্দর কবিতা লিখে
যাবো জীবনের কাছে
আমার আছে শুধু এইটুকু প্রত্যাশা।

অনু গল্পমালা

শ্যাম সুন্দর মুখোপাধ্যায়

কোলের ছেলে
আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা । সে সময় পরিবারে তিন চার জন বা তারও বেশি ভাইবোন থাকাটা খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল । বড়, মেজ, সেজ, ন, ছোট এইভাবে সন্তানদের ক্রমাঙ্কন করা হত । কোলকাতা ও তার উপকণ্ঠের ভাষায় অনেক সময় সর্বকণিষ্ঠ ছেলেটিকে কোলের ছেলে বলা হত ।
ভাইবোনদের মধ্য সবচেয়ে ছোট হওয়ার জন্য অনেক সময় মা আমার পরিচয় দিতে গেলে বলতেন – এ হল কোলের ছেলে । আর যখনই একথা বলতেন তখনই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন , অবশ্য তখন আমি অনেক ছোট ।
এরপর অনেক বছর কেটে গিয়েছে , কলেজ পাশ করে চাকরি জীবনের দু বছর পার করেছি । বেশ কিছুদিন হল মা কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী । অফিস থেকে ফিরে মায়ের ঘরে গেলাম । ছোট মাসী এসেছেন মাকে দেখতে , অনেক বছর পর । মায়ের বিছানায় মাথার কাছে বসলাম । শয্যাশায়ী মায়ের হাত মাথা অবধি গেল না, পিঠে হাত রেখেই মাসীকে বললেন – এই হল কোলের ছেলে ।
কতদিন পরে কথাটা শুনলাম । চোখে জল এসে গেল ।
**********
ঈশ্বর ও বাস্তব
এই বুড়ো বয়সে পরেশবাবুর আবার আগের মতো টোনাটুনির সংসার । অবসর জীবন চলছে তা প্রায় বছর ছয়েক হল । দুই ছেলে , তারা তাদের রাস্তা যে যার মত দেখে নিয়েছে । বছর গেলে একবার বিজয়ার পেন্নাম ঠুকতে আসে ।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর , মুখটুখ ধুয়ে পরেশবাবু নারায়ণ প্রণাম করেন । দেওয়ালে টাঙানো বহু পুরাণো চতুর্ভূজ নারায়ণের ছবি । ছবির কয়েক জায়গায় পোকায় খেয়েছে । হাত জোড় করে স্তব করেন , প্রণাম মন্ত্র বলেন । শেষে বলেন – নারায়ণ কৃপা কর ।
এরপর তিনি চা খাওয়ার জোগাড়-যন্ত্র শুরু করেন ।
পরেশবাবুর স্ত্রী বেলাদেবী এই সময় বিছানায় জেগে ঘুমান । ওনার তীব্র শ্রবণ শক্তি । শুয়ে শুয়েই শব্দ শুনে শুনে স্বামীর সকল গতিবিধি খেয়াল রাখেন । কখনও বলেন – বেসিনের কলটা কমিয়ে দাও জল ছিটছে । কখনও বা – আজ বিস্কুট নেই , মুড়ি খাও ।
চা বানানো , চা পান ইত্যাদি সারতে সারতেই সাতটা বেজে যায় । এই সময় পরেশবাবুকে আর একটা কাজ করতে হয় ।
ফ্ল্যাটের বেরোবার দরজা খুলে তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামেন । তাঁর ঠিক নীচের ফ্ল্যাটের দরজার পাপোষের দিকে তাকান । উনি খোঁজেন একজোড়া চেনা চটি । ওনাদের কাজের মেয়েটি এই ফ্ল্যাটেও কাজ করে এবং আগে এখানে আসে । চটি দেখতে পেলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন গিন্নিকে সু-সংবাদ দিতে ।
চটি না থাকলে দুর্যোগের আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে তাঁর ।
কী দুর্যোগ ?
সে আরেক কাহিনী । অনুগল্পে অত কথা লেখা যায় না ।
******
পটি
শব্দটি আমি প্রথম শুনি ২০০৫ সালে যখন আমার বয়স ৫০ বছর । আমাদের পুরণো রহড়ার বাড়িতে দেখা হল ভাইঝির সঙ্গে , ওর ছেলে তখন কিন্ডারগার্ডনে পড়ে । নাতির খোঁজ করতেই ভাইঝি বলল – ও পটি করছে ।
– কী করছে ?
– পটি করছে , পটি ।
– মানে ?
– আরে বাবা , পায়খানা করছে । হাগু হাগু, বুঝেছ এবার ।
– হাগু আবার পটি হ’ল কবে ? তোরা তো ছোট বেলায় হাগু ই বলতিস ।তুই শিখলি কোথা থেকে ?
– ইস্কুলের আন্টিরা বলে , বাচ্ছার মায়েরাও বলে ।বনিকেও আমরা সেটাই শিখিয়েছি । ও হাগু পায়খানা এ সব জানে না ।
আমি বললাম – গু হ’ল শুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ , দেবভাষা । গু মানে অন্ধকার ও আবর্জনা , গুরু শব্দ গু থেকে এসেছে । গুরু মানে যিনি মনের অন্ধকার দূর করেন । অজ্ঞানতিমিরন্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া ……. ।
– ও সব জ্ঞানের কথা জানি না । ভদ্রসমাজে এখন গু হাগু এসব কেউ বলে না ।তুমি আবার বনিকে এসব শিখিও না ।তোমার তো বাচ্ছাদের অসভ্য কথা শেখানোর ঝোঁক আছে ।
– না রে না । বনিকে বলতে যাব কেন এসব ।
সম্যক জ্ঞান লাভ করলাম ভাইঝির কাছথেকে – জায়গা বুঝে হাগু , অন্যথায় পটি ।
*******

যাদবপুরের গল্প

তখন আমার ইঞ্জিনিয়ারিং – এ থার্ড ইয়ার চলছে । আর দু বছর পর অর্থাৎ সাতাত্তর সালে পাশ করে বেরোব ।
মেট্রোলজির একটা সেশনাল জমা দেওয়ার ছিল , বেমালুম ভুলে গেছি ।যাদবপুরে মাঠের আড্ডায় জানা গেল লাষ্ট ডেট চলে গেছে ।কি আর করা যায় । অর্ধেক ক্লাস করে বিকালের মধ্যে বাড়ী ফিরে পাতা লেখা, ছবি আঁকা, কভার পেজ করে সেশনাল শেষ হয় মাঝ রাতে । পরদিন সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙে । তাড়াহুড়ো করে স্নান করা , ভাত খাওয়া , কাগজ পত্র ঝোলাব্যাগে পুরে চটি পায়ে গলিয়ে দৌড় ট্র্রেন ধরার জন্য । খড়দা স্টেশন থেকে আটটা বাহান্নর নৈহাটি লোকাল যার কানেক্টিং ট্রেন শিয়ালদা সাউথ থেকে নটা বিয়াল্লিশে । সেশনালটা ব্যাগে পোরার আগে একবার দেখে নিতে গিয়েই চক্ষু চড়ক গাছে । রিপোর্টের সামনের গোটা পাঁচেক পাতায় ডট পেনে ওপর থেকে নীচে লম্বা টানা দাগ । আমার আড়াই বছর বয়সের ভাইপোর কীর্তি । পাতাগুলো হয়তো হারুদার ষ্টোর থেকে কিনে লিখে নেওয়া যাবে । কিন্তু ছবি আঁকতে তো ঘন্টা চারেক লাগবে ।
সেশনাল জমা দিতে হ’বে মধুবাবুর কাছে । মধুসূদন সেনগুপ্ত , আমাদের ক্লাসের অনির্বাণের বাবা । কপাল ঠুকে রিপোর্ট হাতে নিয়ে ওনার চেম্বারের দরজায় ।
– আসব স্যার ।
ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করলেন ।
– মেট্রোলজির সেশনাল জমা দেব ।
ওনার টেবিলের পাশে একটা টেবিল, তার উপর ডাঁই করা আমাদের ব্যাচের রিপোর্ট । উনি সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন ।
– না স্যার , আপনাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে ।
কিছু বলছেন না । জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ।
আগ বাড়িয়ে রিপোর্ট খুলে ওনাকে দেখালাম । উনি পাতা উল্টে উল্টে দেখছেন আর আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন ।
আমি মনে মনে আর্জিটা গুছিয়ে রাখছি , আরও দু দিন সময় চাইব ।
রিপোর্ট দেখে বললেন – কে করেছে ?
– আমার ভাইপো স্যার ।
– বয়স কত ।
– আড়াই বছর ।
– তাহলে ঠিক আছে । ওই খানে রাখ ।
ধড়ে প্রাণ এল । রিপোর্ট জায়গায় রেখে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি । বেরোতে গিয়ে দরজা অবধি গেছি , গম্ভীর গলা শুনলাম ।
– শোন ।
আবার কি বিপদ রে বাবা ।
– বলুন স্যার ।
– জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাক ।
– হ্যাঁ স্যার ।
– আচ্ছা আস ।
এই রকম পিতৃপ্রতিম ব্যাবহার ছিল আমাদের যাদবপুরের শিক্ষকদের ।

মাসিমা

শমিতা চক্রবর্তী

সেদিন ছিল সরস্বতী পুজো
নতুন শাড়ী, অঞ্জলী,ধূপ, মন্ত্র –
সবে মিলি হৈ হৈ পুজোমন্ডপে।
বসে ছিলাম সবার পিছনে,
দূর থেকে দেখছি সকলকে,
উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত আমিও সবার সাথে।

খাবার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে
চোখে পড়ে তাঁরে –
বসে ছিলেন সামনে চেয়ারে একা
শান্ত চেহারা, জড়ানো খোঁপা চুলে
মুখখানা অচেনা, অজানা –
আগে তো দেখিনি তাঁরে !

আবার দেখি তাঁরে, নাটকের সভাঘরে
অনুরাধা ডেকে বলে-“মা আমার
এসেছেন এখানে”।
মনে পড়ে সেই মুখ, সেই সৌম্য মুখখানি,
অচেনা, অজানা – সত্যি কি ?
দেখিনি কি তাঁরে ?

আবার দেখা এক সন্ধ্যাবেলা অনুরাধার বাড়িতে
প্রণাম করে বলি প্রথম কথা তাঁর সাথে,
মনে হল কত চেনা, কত জানা !
মাতৃত্বের পরশ প্রতি শব্দে
অনন্ত ভালোবাসার ছোঁয়ায়
হারিয়ে যায় মন আমার অন্য পৃথিবীতে।

তারপর ফিরে ফিরে দেখা – অল্প কিছু কথা
স্বল্পভাষিণী অন্তহীন স্নেহের ভান্ডার
সর্বদা মিষ্টি হেসে কুশল প্রশ্ন তাঁর।
অল্প সময়ের ব্যবধানে
বেঁধেছেন সবারে স্নেহের বন্ধনে।

যতবার দেখি তাঁরে,
মন আমার খুঁজে ফেরে
সেই হাসি, সেই অপত্য স্নেহের পসার
বার বার মনে জাগে
কোথায় দেখেছি তাঁকে?
স্মৃতির খনি থেকে উঁকি মারে
ছাব্বিশ বছর আগে হারিয়েছি যারে।

পিতা-পুত্র

মনীষা রায়

বিধান চৌধুরী সারা জীবন পরিশ্রম করে টাকা পয়সা অনেক করেছেন। এমন কী জামসেদপুরের স্টিল কোম্পানির চিফ কেমিস্টের পদ থেকে বিশ্রাম নেবার পরও আবার নানা জায়গায় কন্সাল্টিং-এর কাজ করেছেন। স্ত্রী সুজাতার আপত্তি সত্বেও ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে সল্টলেকে একটা ছোট দোতলা বাড়ি কিনে উঠে এলেন তাঁর সত্তর হবার আগেই। আত্মীয় পরিজন চিরকাল বিধান চৌধুরীকে যথেষ্ট প্রগ্রেসিভ এবং আধুনিক বলে জানেন। নতুন বাড়িতে তাঁর পছন্দ মতো আধুনিক ডিজাইনের ফার্নিচার এল। সুজাতা এত বছরের আসবাব পত্র, পুরোনো ছবি, লেপ-তোষক, জামা-কাপড়, এমনকি শাশুড়ির আমলের হাতের কাজ করা বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকনা এসব বিলিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। পুরোনো রংচটা লোহার ট্রাঙ্কটা ভর্তি করে যখন বাড়ির ঝি সব নিয়ে গেল তখন বুকের ভেতরে একটা ঠান্ডা কষ্ট চেপে ধরেছিল।তাঁদের একমাত্র সন্তান কৌশিক যখন আমেরিকা গিয়েছিল তখনও কিন্তু সুজাতা এভাবে কষ্ট পাননি; জানতেন ঐ বিচ্ছেদটা স্বাভাবিক এবং হয়তো সাময়িক।
সুজাতা জানতেন স্বামীকে এসব কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেবেন, নয়ত ব্যঙ্গ করে কিছু একটা বলবেন। তাতে কষ্ট আরও বাড়বে। এভাবে এত বছরের সংসার ভেঙ্গে সমস্ত ইতিহাস উপড়ে চলে আসাটা অলক্ষুণে বলে মনে হয়ছিল। চল্লিশ বছর আগে যখন চৌধুরী পরিবারে নতুন বৌ হয়ে এসেছিলেন, তখন শাশুড়ি বলেছিলেন, “ তুমিই এখন এবাড়ির কর্ত্রী, আমরা চলে গেলে এ সংসারের পুরোপুরি দায়িত্ব তোমার”। একমাত্র ছেলের বৌ হয়ে সুজাতা সে দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করেছেন।কিন্তু আজ এই বার্ধক্যের সূচনায় সেই প্রতিশ্রুতি ভাংতে হল। হয়ত এই বিরাট পরিবর্তন তাঁর বিবাহিত জীবনান্তের ঘোষণা। কথাটা মাথায় আসা মাত্র সুজাতা সেটা মনের অতলে ঠেলে দিয়েছিলেন। যদিও এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে স্বামীর হৃদয়ের আনাচে-কানাচে কতটা প্রবেশাধিকার পেয়েছেন সেটা এখন জানেন না।
একদিন বিকেলে পুরোনো বাড়ির শোবার ঘরে বসে চা খেতে খেতে স্ত্রীর মুখ ভার দেখে বিধান চৌধুরী হেসে বলেছিলেন, “দ্যাখো, বয়স তোমার আমার কারোরই কমছে না।এই সময় যদি একটু আরাম করে থাকতে না পারি তাহলে এত পয়সা কড়ি রোজগার করে কী লাভ। ঠাকুরদাদার তৈরি বাড়ি যতই শক্তপোক্ত হোক, অ্যামিনিটিস এক্কেবারে নিল। চেষ্টা করলেও সেসব নতুন করে বানানো সম্ভব নয়। তুমিই না বলেছিলে ছেলে-বৌ দেশে বেড়াতে এলে ওদের খুব অসুবিধে হয়। বাথটাব না হলেও একটা আলাদা শাওয়ার স্টল থাকলে বাথরুমগুলো শুকনো রাখা সম্ভব। ফ্লাশটা বছরে ন’মাস কাজ করে না। জয়েসের কাছে রীতিমত অপ্রস্তুত হতে হয়”।
“তা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এতদিনের পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে দেবে? এই বাড়ির ইট কাঠে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কত স্মৃতি জমে আছে। তোমার মনে কষ্ট হয় না? তাছাড়া কৌশিক আর জয়েস আসে তো সেই দু বছরে তিন বছরে একবার।ছেলেপুলে হলে আসা আরও কমে যাবে, দেখো”। “আঃ হা, এর ভেতর আবার সেন্টিমেন্টাল হবার কী দরকার ! তোমার ঐ এক দোষ, হুট করে মন টন টেনে এনে একটা জট পাকিয়ে তোল। চেঞ্জ, — বুঝলে, চেঞ্জ ছাড়া জীবনে নতুন কিছু ঘটতে পারে না। সেই মান্ধাতার আমলে পড়ে থাকলে পৃথিবী এগোবে কী করে ?” তারপর আরও কত কী বলে গিয়েছিলেন বিধান চৌধুরী, যার অনেক কথাই সুজাতার বোধগম্য হয়নি; হয়তো বোঝার চেষ্টাও তেমন করেন নি। সুজাতা কাজ আর অনুভূতি দিয়ে পৃথিবীটা দেখার ও বোঝার চেষ্টা করতেন। বিশ্লেষণ করা তাঁর স্বভাব নয়। তাই পুরোনো জীবন ছেড়ে আসার শোক ভুলতে চেষ্টা করলেন নতুন বাড়ির হাজার কাজে। হয়তো অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলেই এক মাসের মধ্যে বিছানায় পড়লেন। প্রথমে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, তারপ্র নানা উপসর্গ। সলটলেকের হাস্পাতালের বড় বড় ডাক্তাররা অনেক চিকিতসা করেও কিছু করতে পারলেন না।নতুন বাড়িতে উঠে আসার আড়াই মাসের গোড়াতেই মাত্র চৌষট্টি বছর বয়সে সুজাতা তাঁর স্বামীর শখের কেনা নতুন বাড়ি থেকে শুধু নয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিধান চৌধুরী শোকে ভেঙ্গে পড়লেন।
খবর পেয়ে আমেরিকা থেকে ছেলে ছুটে এল। শ্রাদ্ধের পর বাবাকে অনেক পীড়াপীড়ি করল ওর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে ক’মাস থাকতে। জায়গা বদল, হাওয়া বদলে মনটা শান্ত হবে। উত্তরে বিধান চৌধুরী কেবল বললেন, “এখন নয়। তোর মার খুব শখ ছিল হরিদ্বারে যাবেন তীর্থ করতে। ভাবছি সেখানে কিছুদিন কাটাব। তারপর দেখা যাবে। কৌশিক চলে যাবার পর দিন বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেলেন হরিদ্বার। সেখানে এক মঠে কাটালেন ন’মাস। ফিরে এসে আবার যথারীতি পুরোনো জীবনে ফিরে গেলেন – শনিবার গলফ, রবিবার ক্যালকাটা ক্লাবে দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে স্কচ সহযোগে তাস খেলা এবং বাকি সপ্তাহ নিজের বাড়িতে বসে বই, কাগজ-পত্র ঘাঁটা। সপ্তাহে একদিন ছেলের সঙ্গে ই-মেল মারফৎ চিঠির আদান-প্রদান হয়, মাঝে মাঝে ছেলের বৌয়ের নামটাও জুড়ে দেন সম্বোধনে। মাস ছয়েক পর একদিন জয়েসের একটা ই-মেল এল শ্বশুরকে আমন্ত্রন জানিয়ে।‘আপনি আগে আসতে চাননি, এখনতো হল প্রায় দু’বছর, এবার আসবেন কি ? এলে কৌশিক ও আমি খুব খুশি হবো।ই-মেলটা পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন এবারে যাবেন।
একটা সুটকেসে চাকুরি জীবনে কেনা দামি তিনখানা স্যুটের সঙ্গে সুজাতার কয়েকটি গয়না ভরে নিলেন। জয়েসকে তার মৃত শাশুড়ির উপহার হিসেবে দেবেন; ব্যবহার করাটা ওদের ইচ্ছের অপর। সুজাতা এক মাত্র ছেলের বৌয়ের জন্যেই গয়নাগুলো রেখে গেছে।বাড়ির কাজের মহিলাকে দু-মাসের মাইনে সহ তিন মাসের ছুটি দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে প্রতিবেশীদের বললেন, তিন মাস পশ্চিম গোলার্ধে কাটাতে যাচ্ছেন।‘দেখে আসি আমেরিকার মাহাত্ম্য’। বলে হাসলেন। বন্ধুবান্ধবরা খুশি হল যে স্ত্রী-বিয়োগের পর বিধান চৌধুরী আবার তার নিজস্ব ফর্মে ফিরে এসেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির সান হোসে শহরে কৌশিক আর তার বৌ জয়েসের কাছে এক মাস বিশ্রামে কেটে গেল বিধান চৌধুরীর।ইতিমধ্যে উইকেন্ডে ছেলে-বৌ গাড়ি করে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান দেখিয়েছে। গোল্ডেন গেট, নাপা ভ্যালির ওয়াইন কান্ট্রি, ম্যুর এবং রেডউড ফরেস্ট, ইত্যাদি। কোনও কোনও শনিবার কৌশিক আর জয়েসের বন্ধুবান্ধবরা আসে ককটেল বা ডিনারে। এরা সব কম বয়সি ছেলেমেয়ে; বেশিক্ষণ আড্ডা দিতে গেলেই মতভেদ দেখা দেয়। ভদ্রতার খাতিরে বিধান চৌধুরী তখন চুপ করে যান। সারাটা দিন একা কাটে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নানারকম সাপ্তাহিক কাগজ পত্র ঘেঁটে, টেলিভিশন দেখে সময় কাটতে চায় না।ঠিক করলেন ছেলেকে বলবেন যদি কোনও গলফ ক্লাবে যোগ দেওয়া যায়।নয়তো টিকিট বদলে আর এক মাসের ভেতর ফিরে যাবার কথা ভাববেন।
এক সকালে ব্রেকফাস্টের পর রোজকার রুটিন শেষ করে, বেলা এগারোটা নাগাদ দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস আদ্যোপ্রান্ত পড়া হয়ে গেলে বিধান চৌধুরী রান্নাঘরে গেলেন চা বানাতে।এদেশে আসার পর দিনই জয়েস শ্বশুরকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে চা কফি বানাতে হয়। কখনও ভাবেননি এই বয়সে নিজের হাতে চা করে খেতে হবে।
জলের কেটলিটা ইলেক্ট্রিক স্টোভে বসাবার সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজার বেল বেজে উঠল।একটু চমকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখেন এক আমেরিকান মহিলা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন – হাতে একটা প্লেটে চকলেট-কেক। মহিলা বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বল্লেন, ‘আমি মার্গারেট উইলসন, পাশের বাড়িতে থাকি। আপনি যখন এলেন তখন আমি ছুটিতে ছিলাম, তাই দেখা হয়নি। জয়েসকে আমি কথা দিয়েছিলাম মাঝে মধ্যে এসে আপনাকে দেখব। হিয়ার আ য়্যাম’। মার্গারেট উইলসন বিধান চৌধুরীর পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন এবং কাউন্টারের ওপর কেকটা রেখে আবার বললেন, ‘আশা করি আপনি চকোলেট-কেক পছন্দ করেন। আমি নিজে তৈরি করেছি’। যেন কোন এক স্বপ্ন বলে কোথা থেকে এক সোনালি চুলের সুন্দরী তাঁর সামনে আবির্ভূত। মধ্যবয়স্কা হলেও মারগারেটের অবয়বে যুবতির প্রাণোচ্ছ্বলতা। ভর দুপুরে একা একজন সুন্দরী বিদেশী মহিলার সঙ্গে গল্প করার অভিজ্ঞতা নেই বিধান চৌধুরীর। এতক্ষণে তাঁর সম্বিত ফিরে এল। তাড়াতাড়ি নিজের পরিচয় দিয়ে মহিলার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং খাবার টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসতে দিলেন। ইতিমধ্যে কেটলির জল ফুটে একটা তীক্ষ্ণ হুইসেলের আওয়াজ শুরু হল। মার্গারেট তৎক্ষণাৎ স্টোভের সুইচটা অফ করে চায়ের সরঞ্জাম বার করে দুজনের জন্য চা বানাল এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক কথাও বলল।
পনের বছর আগে মার্গারেট তার স্বামীকে হারিয়েছে একটা এক্সিডেন্টে। তারপর থেকে অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। পঞ্চাশ বছর বয়সে তাকে আবার চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। এক কোম্পানিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কাজ করেছে এবং মাত্র তিন বছর হল রিটায়ার করেছে। একটি মাত্র সন্তান লেখা পড়া শেষ করে মিনিয়াপোলিসে গেছে এক হাইস্কুলে পড়াতে। ছেলেকে নিয়ে মায়ের খুব গর্ব, কারণ সে আদর্শবাদী – মাইনে সামান্য হওয়া সত্ত্বেও সে স্কুলের শিক্ষক হয়েছে। প্রায় দু-ঘন্টা অনেক গল্প করল মার্গারেট । এত অল্প সময়ের আলাপে যে একজন মহিলা একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে এতটা স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারে, বিধান চৌধুরী ভাবতেই পারেন না।
বেলা দেড়টা নাগাদ যখন মার্গারেট উঠল তখন তাঁর কেবল মনে হচ্ছিল যদি কোনও অজুহাতে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখা যেত মহিলাকে। তখন লাঞ্চের সময়, খাবার নেমন্তন্ন না করে কাউকে আটকে রাখা অভদ্রতা। তাছাড়া এই কয়েক ঘন্টার আলাপের পর একজন মহিলাকে খেতে বলাটা এখানকার সমাজেও হয়তো ঠিক নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ওকে খাওয়াবেনই বা কী। ওঁর নিজের জন্য ফ্রিজে মাত্র একটা স্যান্ডুইচ তৈরি করা আছে। কৌশিক রোজ সকালে সেটা বানিয়ে রেখে যায়।
অজুহাতের দরকার হল না। সেদিনের পর থেকে মার্গারেট প্রায় প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে দরজায় টোকা দিতে লাগল। কোনও দিন দুজনে হাঁটতে যান একটু দূরে একটা পার্ক অব্দি, কখনও বা ও ড্রাইভ করে নিয়ে যায় শহরের অন্য প্রান্তে পাবলিক লাইব্রেরিতে। ফেরার পথে স্টারবাক্সে কফি খেয়ে বাড়ি ফেরেন। কখনও বা বিধান চৌধুরী মার্গারেট আমন্ত্রণ জানান ওর সঙ্গে বসে স্কচ খাবার জন্য। পেছনের ডেকে বসে দুজন স্কচের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কথা বলেন। বিধান চৌধুরীর কোনও ধারণা ছিল না যে তাঁর এত কথা বলার ছিল। আরও অবাক হন এই ভেবে যে এদেশে প্রতিবেশীরা কেউ মাথা ঘামায় না কে কার সঙ্গে মিশছে, এই নিয়ে। এই স্বাধীনতার মাদকতা যে তাঁকে এক মহিলার সঙ্গে স্কচ পান করার বাইরে আরও কিছু বলা বা করার সাহস জোগাতে পারে সেটা বুঝতে পেরে এই প্রবীন মানুষটি একটু ভয়ও পেলেন। অবশ্য ছেলে-বৌকে মার্গারেটের সঙ্গে তাঁর আউটিং সম্বন্ধে ডিটেল কিছু বলেন না।
এক রবিবার সবাই যখন ব্রেকফাস্ট করছে তখন বিধান চৌধুরী জয়েসকে ও বললেন,’চল না সবাই মিলে আজ বাইরে কোথাও খেতে যাই। আমি খাওয়াবো’। তারপর চায়ের কাপে কয়েকবার চুমুক দিয়ে যোগ করলেন, ‘আচ্ছা তোমার নেবার মার্গারেটকেও ইনক্লুড করলে কেমন হয়। সেদিন আমার নাম করে এত ভাল একটা কেক এনেছিলেন। মানুষটা মনে হয় বেশ ভাল। মাঝে মধ্যে বিকেলবেলা আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসেন – মানে আমি যখন বাগানে জল টল দিতে যাই তখন বেরিয়ে এসে গল্প করেন’।
‘নিশ্চই। লেটস ডু দ্যাট। আই শ্যাল কল হার রাইট নাও।গুড আইডিয়া’। জয়েস সেই রাত্রে বিছানায় কৌশিককে বলেছিল যে তাঁর বাবা আসলে সত্যি কথাটা চেপে গেছেন। কারণ মার্গারেট জয়ে্সকে ইতিমধ্যে বলেছে যে ওর শ্বশুর এবং সে প্রায় প্রতিদিন দেখা করে। কৌশিক এই খবরে খুব একটা খুশি হতে পারল না, যদিও জয়েস হেসে ওকে ঠাট্টা করল, ‘হোয়াট আর ইউ ওয়ারিড অ্যাবাউট ? এটা তো খুব ভাল কথা। লেট দ্য ওল্ড ম্যান হ্যাভ সাম ফান। দে আর বোথ ফ্রি টু ডু সো’।
‘ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড’- বলে কৌশিক অন্য পাশে ফিরে শুয়েছিল। অবশ্য জয়েসের কথাটা তাঁর মাথায় রয়ে গেল।লক্ষ্য করল বাবা যেন আগের তুলনায় একটু বেশি উৎফুল্ল। কথায় কথায় অ্যামেরিকার প্রশংসা, যা আগে করতেন না।
দেখতে দেখতে দু-মাস কেটে গেল। বিধান চৌধুরীর ভিসা যদিও ছ’মাসের জন্য, কিন্তু উনি প্রথম থেকেই বলে রেখেছেন যে তিন মাসের ওপর একটা দিনও তাঁর থাকা সম্ভব নয়। একদিন খাবার টেবিলে কৌশিক বলল, ‘বাবা, তোমার তো দেশে ফেরার দিন প্রায় এসে গেল। আমি ভাবছি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে তোমাকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নটা দেখিয়ে আনবো। জয়েস এই মুহূর্তে ছুটি পাবে না। যাবে?’
‘আরে তাড়া কিসের?’ বিধান চৌধুরী ইংরেজিতে বললেন।‘আমার ভিসা তো রয়েছে ছ’মাসের জন্য। ভেবে দেখলাম একবার যখন এসেছি, নাহয় পুরো সময়টাই কাটিয়ে যাই। তোমরা এত করে বলছো, তাই আগের প্ল্যানটা বদলালাম। আর ইউ হ্যাপি নাও?’ বলে বিধান চৌধুরী হাসি মুখে জয়েসের দিকে তাকালেন।
‘অফকোর্স। উই আর অল ডিলাইটেড’। জয়েস তাড়াতাড়ি কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল। মনে মনে ভাবল, কারণটা সে ভাল করেই জানে। সে রাত্রে আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা হল।জয়েস সাজেস্ট করল মার্গারেটকে ওদের সঙ্গে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যাবার আমন্ত্রণ জানাতে। কৌশিক রেগে মেগে বলে উঠল, ‘আর ইউ আউট অব ইওর মাইন্ড? তুমি এখন তোমার শ্বশুরের বিয়ের ঘটকালি করবে মনে হচ্ছে!’ এই নিয়ে দুজনের বেশ কথা কাটাকাটি হল। জয়েস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কৌশিক কেন তাঁর বাবার সুখে সুখী নয়। তাঁর আপত্তির আসল কারণটা কৌশিক নিজেই জানে না, জয়েসকে কী করে বোঝাবে! তবু চেষ্টা করল।‘মা চলে গেছেন মাত্র দু’বছর হয়েছে।বাবা কী করে এত তাড়াতাড়ি মাকে ভুলে গেলেন?’ তাঁর যুক্তিটা যে একজন অ্যামেরিকানের কাছে অকাট্য নয় সেটা বুঝে আর কথা বাড়াল না।
চার মাস পর একদিন বিধান চৌধুরী ছেলেকে বললেন যে কোলকাতা থেকে তাঁর প্রতিবেশীর চিঠি এসেছে। ওঁর বাড়িতে নাকি চোর ঢোকার চেষ্টা করেছে কয়েকবার। তাই ওঁর দেশে ফেরা দরকার। সেই সঙ্গে আরেকটি কথা বললেন যা কৌশিক একেবারেই আশা করেনি।বললেন, ‘সেদিন কথায় কথায় তোদের নেবার মার্গারেট বলছিল ওর বহুদিনের ইচ্ছে ইন্ডিয়া দেখার। আমাকে এই নিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছে, ও যদি আমার সঙ্গে যায় তাহলে আমি হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারি। প্রথমবার যাচ্ছে কিনা। ওর ছেলেও আমাকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছে। তাই মার্গারেটকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। মাস খানেক থেকে ফিরে আসবে। আমি জানি তুমি আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ চিন্তিত। তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই’। এই বলে তিনি নিজের শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
দু’সপ্তাহ পর কৌশিক ও জয়েস, বিধান চৌধুরী এবং মারগারেটকে সানফ্রান্সিস্কো এয়ারপোর্টে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে তুলে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন কৌশিক স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল,’হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক? আর দে ইন লাভ?’
‘হাও ডু আই নো? হি ইজ ইওর ফাদার’।