আমার আপন গান

শান্তনু দাশগুপ্ত

তখন আমি খুব ছোট, ক্লাস ফোর কি ফাইভ। গরমের ছুটির কোন এক সন্ধ্যা, মা, বাবা আর সোনাকাকা (বাবার পিসতুতো ভাই) রবীন্দ্র সদনে কি একটা অনুষ্ঠান দেখতে গেছেন। আমি দাদু-ঠাকুমার সাথে বাড়িতে, নটার একটু আগেই তিনজন ফিরে এলেন। মার মুখটা বিরক্তিতে ভরা, বেশ অবাক করার মত ব্যাপার। কারণ গানের অনুষ্ঠান শুনে ফেরার পর মা-কে সাধারনত বেশ ফুরফুরে মেজাজেই পাওয়া যেত এবং এখনও যায়। সেদিনের সন্ধ্যাটা নিঃসন্দেহে এক অর্থে ব্যতিক্রমী ছিল। সমানে গজগজ করে যাচ্ছিল মা, “ছি ছি, একজন মানী শিল্পীকে এই ভাবে অসন্মান করা!!! এই সব দর্শক রবি ঠাকুরের গান শোনার উপযুক্তই নয়। কি লজ্জা লাগছিল…” মা মেজাজ হারালে বাবা বেশীর ভাগ সময়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতেন (কোন স্বামীই বা না করেন?)। এ ক্ষেত্রে কিন্তু মনে পড়ে বাবু মায়ের তালে তাল মিলিয়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলছিলেন। ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। যতটুকু কানে এল তাতে করে এটুকু জানলাম যে সুবিনয় রায় নামে কোন এক গায়ককে নাকি অধিকাংশ শ্রোতারা তিন-চারটে গানের পর হাততালি দিয়ে তুলে দিয়েছেন। প্রথমবার কথাটা শুনে বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। হাততালি দিয়ে তুলে দেওয়া!!! ততদিন অবধি জানতাম যে হাততালি দেওয়ার মানে হল প্রশংসা করা, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা, হাততালি দিয়ে কি করে কাউকে অসন্মান করা যায় বা আসর থেকে তুলে দেওয়া যায়? তখনকার ছোট্ট মাথায় একেবারেই ঢুকতে চাইছিল না। পরে মায়ের কাছে বিস্তারিত ভাবে শুনেছিলাম সেই আসরের ইতিবৃত্ত। আসলে সেই সন্ধ্যায় সুবিনয় রায়ের পরের শিল্পী ছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। সেটা সত্তর দশকের মাঝামাঝি, চিন্ময়বাবুর জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া বললেও বোধহয় কম বলা হবে। আর উনি মূলত যে ধরণের গানের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন, সুবিনয়বাবু ঠিক তার বিপরীত আঙ্গিকের গান ধরেছিলেন। স্বল্পশ্রুত রবীন্দ্র সঙ্গীত। প্রথম গানটি অবিশ্যি পরিচিত ছিল, ‘বসে আছি হে, কবে শুনিব তোমার বানী’। তাই প্রথম গানের সময়ে শ্রোতারা শান্তই ছিলেন। কিন্তু এর পর উনি গাইলেন আড়া চৌতালে নিবদ্ধ, ইমন কল্যান রাগাশ্রিত ‘সংসারে কোন ভয় নাহি’। ব্যস, শ্রোতারা উশখুশ করা শুরু করে দিলেন। এর পরে যখন ধরলেন ‘তারো তারো হরি দীনজনে’, তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তারা আর নিতে পারলেন না, সত্যি-ই তো!!! তাদের আর দোষ কি? তখন থেকে হা পিত্যেশ করে বসে আছেন কখন চিন্ময়বাবু এসে, ‘মায়াবনবিহারীনি’, ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিও পাশে’ কিংবা ‘সখী সে গেল কোথায়’ শোনাবেন, তা না, কোত্থেকে একটা প্রৌঢ়, টেকো, গাল তোবড়ানো গাইয়ে এসে ব্রহ্মসঙ্গীত শোনাতে লেগেছে। বেশ করেছিলেন তারা লোকটাকে স্টেজ থেকে তুলে দিয়ে।

কাট টু- ১৯৯২ সাল, ফেব্রুয়ারী মাসের কোন একটি রবিবারের সকাল। রবীন্দ্রসদনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন আমার মা আর বাবা। এদিন তাদের সাথে সোনাকাকার বদলে তাদের একমাত্র সন্তান। সিঁড়ি বেয়ে সদনের মূল গেটে পৌঁছোবার পথে কম পক্ষে ছ-সাত জন মানুষ পথ আটকেছিলেন, “দাদা এক্সট্রা আছে?” সেই আশায় ভরা উৎসাহী মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার অনিবার্য ভাবে মনে পড়ে যাচ্ছিল মায়ের কাছে শোনা সেই সঙ্গীত সন্ধ্যার বিবরণ। সেদিন সদন মঞ্চে যে বরেণ্য শিল্পীকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল, আজ সেই একই মঞ্চে, তাঁরই একক অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্রের জন্য হাহাকার। সেদিনের সেই প্রৌঢ় শিল্পী আজ বার্ধ্যক্যে উপনীত। কিন্তু তাঁর কন্ঠ আজ হাজার হাজার রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রেমীর মনে আলোড়ন তোলে, শ্রদ্ধাবনত করে হৃদয়, শেষমেষ বিশুদ্ধতার আবেদন উপেক্ষা করা যে একপ্রকার অসম্ভব, একনিষ্ঠতার প্রাপ্য মর্যাদা যে আমরা দিতে বাধ্য থাকবই, সেদিনের সেই ‘এক্সট্রা’ প্রার্থী মানুষেরা নিশ্চিতভাবে সেই সাক্ষ্যই বহন করছিলেন। কানায় কানায় পূর্ণ রবীন্দ্র সদনে সেদিন পর্দা ওঠার সাথে সাথে যখন বেজে উঠল সেই সুরঋদ্ধ কন্ঠে ‘সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মল প্রাণে’, তখন ১৫-১৬ বছর আগেকার সেই অসন্মানের সন্ধ্যাকে স্রেফ গল্পকথা বলে উড়িয়ে দিতে মন চাইছিল।

ছোটবেলা থেকে রবি ঠাকুরের গান কানে নিয়েই বড় হয়েছি। এমন কোন দিনের কথা স্মরণ করা মুস্কিল, যেদিন কোন না কোন রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার শ্রুতিগোচর হয়নি। যাদের গান শুনে বেড়ে উঠেছি, তাদের মধ্যে অবশ্যই শীর্ষে থাকবেন দেবব্রত বিশ্বাস ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর মহিলাদের মধ্যে, বলাই বাহুল্য, মোহরদি আর সুচিত্রা মিত্র। বাবার দৌলতে অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়ও শুনেছি ভরপুর। এ ছাড়াও মায়ের খুব প্রিয় ছিলেন ঋতু গুহ (পরে আমারও), পূর্বা দাম, নীলিমা সেন। এ ছাড়াও সাগর সেন এবং চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন পরিবারের সবারই পছন্দের তালিকায়। সেই সময়ে, সঙ্গত কারণেই আমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ বোধটা তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই বাড়ির সবার সাথে এরাই মূলত ছিলেন আমারও পছন্দের শিল্পী। সুবিনয় রায়ের নামোল্লেখ কখনও যে হয়নি, তা নয়, তবে সেটা নিতান্তই কথাচ্ছলে। আমার মা যে ওনার প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল, সেটা বুঝতে পারতাম। আমার নিজের সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হবার পরে, ধীরে ধীরে যখন নিজস্ব সাংগীতিক বোধ গড়ে উঠতে লাগল, তখনও উপরোক্ত শিল্পীরাই আমার মনোজগত দখল করে ছিলেন। মা যদিও মাঝে মাঝে বলতেন, “রাজা, তোমাকে একবার সুবিনয় রায়ের অনুষ্ঠান শোনাব, যা শুনেছ, তার থেকে একদম অন্য রকম”। কিন্তু সত্যি বলতে কি, তেমন উৎসাহ বোধ করিনি। আসলে যার গান শুনিইনি সেভাবে, তাঁর গান শোনার ব্যাপারে খুব একটা মাথা ব্যথা অনুভব করার মত ম্যাচিওরিটি তখন ছিল না।

খুব সম্ভবত আমি তখন একাদশ শ্রেনীর ছাত্র। কাকতালীয় ভাবেই একদিন কলকাতা দূরদর্শনের সান্ধ্যকালীন রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসরে, প্রথমবার ঠিকঠাক শুনলাম সুবিনয় রায়কে। তিনটি গান গেয়েছিলেন, আজো সেই নিবেদন ভুলতে পারিনি। ‘মধুর রূপে বিরাজ, হে বিশ্বরাজ’, ‘তব প্রেমসুধারসে’  আর ‘রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে’ শুনতে শুনতে সব কিছু উলটে-পালটে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে আজন্ম লালিত ধ্যানধারণা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, সব কিছু। মায়ের কথার যথার্থতা মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলাম। সত্যিই, এত দিন যা শুনে এসেছি, তার থেকে একদম আলাদা। এক সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিক, ভিন্নতর রসের সন্ধান পেয়ে মন ভাললাগায় ভরে উঠেছিল। সেই দিন, সেই মূহুর্ত থেকে আমার বোধের জগতে চিরকালীন ভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। মনে মনে বোধহয় সেই দিনই সুবিনয় রায়কে ‘দ্রোণাচার্য’ রূপে বরণ করে নিয়েছিলাম। একলব্য নিজের হাতে আক্ষরিক অর্থেই মূর্তি গড়ে নিয়েছিলেন। আমার মূর্তি রচিত হয়েছিল মনে। একলব্যের মত প্রতিভা বা সাধনার কানাকড়িও আমার মধ্যে ছিলনা, আজও নেই। তাই শিষ্য হিসেবে আমি সেই উৎকর্ষতার ধারে কাছেও কোনদিন পৌঁছতে পারিনি। কিন্তু সুবিনয় রায় আমার জন্য ‘দ্রোণাচার্য’ ছিলেন, আছেন আর থাকবেনও।

সেই যে ভাল লাগার জালে আবদ্ধ হলাম, তার থেকে আর মুক্তি পেলাম না। পেতে চাইও নি কখনো। এরপর থেকেই শুরু হল টিউশনি আর হাত খরচের টাকা জমিয়ে পরের পর ক্যাসেট সংগ্রহ করা, একের পর এক একক অনুষ্ঠানে হাজির থাকা। একটা সময়ে, টানা প্রায় পাঁচ বছর, কলকাতা শহরে সুবিনয় রায়ের এমন কোন একক অনুষ্ঠান হয়নি, যেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম না। এর মধ্যে ‘অবন মহলে’ অনুষ্ঠিত এককের স্মৃতি আজীবন বয়ে বেড়াব। সেদিনের প্রথম নিবেদনে ছিল ‘জাগে নাথ জোছনা রাতে’, বেহাগ আশ্রিত, ধামারে নিবদ্ধ এই গানখানি কেমন মন্ত্রোচ্চারণের মত সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে রণিত হয়েছিল। সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম ‘আমার আপন গান’, ‘কি রাগিণী বাজালে’ আর শুনেছিলাম, ‘না বলে যেও না চলে’, পরজের মায়াজাল পরতে পরতে আচ্ছন্ন করছিল সমস্ত সত্বা। পরিপূর্ণতার সকল সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন তিনি ওই দিন। কি যথার্থ ভাবেই না উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর কন্ঠে, “আমার আপন গান, আমার অগোচরে/ নিয়ে সে যায় ভাসায়ে, সকল সীমারই পারে”। ভাল গায়ক তো আছেন বেশ কিছু, কিন্তু এই ‘সকল সীমা’-র পারে নিয়ে যেতে পারেন হাতে গোনা গুটি কতক। সুবিনয় রায় নিঃসন্দেহে সেই বিরল পর্যায়ভুক্ত।

সৌভাগ্যক্রমে মায়ের পরে এমন দুজনকে সঙ্গীত-গুরু হিসেবে পেলাম, যারা কিনা একই ঘরানার ধারক ও বাহক। শ্রী আশিস ভট্টাচার্য ও শ্রীমতী এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়। সুবিনয়বাবুর মত এনারাও প্রবাদপ্রতিম আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের হাতে তৈরি। সুবিনয় রায়ের প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ জন্মেছিল, ওই অতুলনীয় গায়কীর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করবার, তাকে আয়ত্ত করবার যে অদম্য বাসনা মনকে তোলপাড় করছিল, সেসব যেন পরিপূর্ণতা পেল আশিসদার কাছে এসে। প্রথমবার আশিসদার কন্ঠে যে গানটি শুনেছিলাম, সেটা হল, ‘নাথ হে প্রেমপথে সব বাধা ভাঙিয়া দাও’। তখন আমি কলেজের প্রথম বর্ষে, শুনেই মনে হয়েছিল, এই তো আর এক জনকে পেয়েছি। সেই নিখুঁত স্বরক্ষেপন, সেই অনায়াস ভঙ্গীতে দুরূহ গান পরিবেশন করা, সেই একই আত্মমগ্নতা, একই পরিমিতি বোধ। এই পরিমিতি বোধের বড়ই অভাব আজকের দিনে। রবীন্দ্রনাথ, যিনি কিনা পরিমিতি বোধের শেষ কথা, যাঁর প্রতিটি আচরণ, অভিব্যক্তি এমনকি প্রতিবাদ বা বিরক্তি প্রকাশের মধ্যেও জারিত হয়ে থাকত এক অসামান্য পরিমিতি বোধ, তাঁর সৃষ্টিকে রূপদানের ক্ষেত্রে আমরা কি করে অপরিমিত, অনিয়ন্ত্রিত হতে পারি? এই প্রশ্নের সদুত্তর আমি আজ অবধি পাইনি। এর কোন সদুত্তর আসলে হয়ই না।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুবিনয় রায়ের অবদান ঠিক কতটা? কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন তিনি? আমার মত সামান্য গাইয়ের পক্ষে এর যথাযত মূল্যায়ন করার প্রচেষ্টা এক প্রকার ধৃষ্টতারই সামিল। তবে এটুকু খুব জোর দিয়ে বলতে পারি যে রবীন্দ্রসংগীত-কে ১৫০-২০০ গানের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে ওনাকে পথিকৃৎ মানতে আমরা বাধ্য। উনি না থাকলে আরো কতদিন যে ‘তোমার খোলা হাওয়া’, ‘আমার হিয়ার মাঝে’, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, এই জাতীয় জনপ্রিয় গানের চর্বিত চর্বনেই আবদ্ধ থাকত রবি ঠাকুরের গান, তা কে জানে? উনি না থাকলে সাধারন শ্রোতা কি জানতে পারতেন যে রবীন্দ্রনাথ ৫-৫ ছন্দের (১০ মাত্রা) একটি তাল সৃষ্টি করেছিলেন, এবং সেই তালে একটি অসামান্য গান রচনা করেছিলেন? (‘ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল’), এরকম অজস্র গানের উদাহরণ দেওয়া যায়, যেগুলি সুবিনয় রায়ের জন্যই সাধারন শ্রোতার গোচরে এসেছে। তবে আর দীর্ঘায়িত না করে, একটা ঘটনার উল্লেখ করেই এই লেখার ইতি টানব।

২০১০ সালের দুর্গাষ্টমী, বালিগঞ্জ পোস্ট অফিসের গা দিয়ে যে রাস্তাটা বেরিয়েছে, সেই আয়রন সাইড রোডের শেষ প্রান্তে একটি আবাসনের পুজোর সান্ধ্য জলসায় আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আমন্ত্রিত। সেখানকার আবসিকদের সাথে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারছিলাম যে বেশ মনোজ্ঞ শ্রোতৃবৃন্দের সামনে গান শোনাতে চলেছি। খান তিনেক গান গাইবার পরই কয়েকটি চিরকুটে গানের অনুরোধ আসতে শুরু করল। প্রথম চিরকুটে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম! “তোমারি মধুর রূপে ভরেছ ভুবন” এই সব গান মানুষ অনুরোধ করছেন?!!!!  সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল আমার দ্রোনাচার্যকে। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর জন্যই। একদিন এই জাতীয় গান নির্বাচনের জন্য তাঁকে মঞ্চ থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। উনি কিন্তু কক্ষচ্যুত হন নি, সস্তা জনপ্রিয়তার স্রোতে গা ভাসান নি। কারণ উনি জানতেন খাঁটি জিনিসের কদর একদিন না একদিন হবেই। সেই প্রত্যয়ের বীজ খুব গভীরে প্রোথিত ছিল বলেই বাজারের দাবী মেনে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ‘বাজারি’ করে তোলেন নি কখনও। তোলেন নি বলেই ২০১০ সালের শ্রোতা আমার মত অখ্যাত জনের কাছেও ধ্রুপদাঙ্গের গান শোনার আর্জি জানাতে পারেন। ওনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোন অন্ত নেই। যারা জনপ্রিয়তার প্রবাহ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিশুদ্ধতার আমেজ পোহাতে চান, তাদের জন্য সুবিনয় রায় এক চিরকালীন অনুপ্রেরণা হয়ে রয়ে যাবেন।

 

সময় আর মাধবীলতা

পার্থ প্রতিম মল্লিক

সময়টা অল্প পাল্টেছে;

বাকী সব প্রায় এক।

না হলে কেন মাঝবয়সে প্রেমে পড়বে

মাধবীলতা?

দারুচিনি রঙের কনকচাঁপার…

আকাশের বুকে মেঘের টুকরো, পূর্ণিমার রাতে –

কেউ কি দেখেনি?

তাহলে জীবনের নাভিদেশে নতুন কোনো তিলে

কেন আশ্চর্য্য হয় মাধবীলতা!

 

সময়টা পাল্টেছে।

তাই আন্দোলনে আজ আর ফেস্টুন বোমা নয়।

শুধু চুম্বন আর প্রেম!

ওদের কথায়, প্রেম নামুক শহরজুড়ে –

বিক্ষোভ আর আন্দোলনে।

 

মাঝবয়সে মাধবীলতা

নেহাত তরুণ কনকচাঁপা।

 

প্রেম নেমেছে, প্রেম নেমেছে।

গলার স্বর ঈষৎ কাঁপা…

মুর্শিদ ধন হে

সুদর্শনা ধর

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে নিয়ে লিখতে বসে মনে হল আমি নিতান্তই ওঁর গুনমগ্ধ শ্রোতা বই তো কিছু নই, আমার আর ওঁর যোগসূত্র ওইটুকুই। তবে তাই নাহয় হল। কালিকা রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে“ উদ্ধৃত করতে শুনেছি। তাই শিল্পীর সৃষ্টির ওপর শ্রোতার অধিকার দাবি করেই আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ লিখতে বসেছি।

মনে করতে পারিনা শেষ কবে এক গায়ক,বাদক,শিল্পী,লেখক,চিত্রকর এর অকাল প্রয়ানে জনমানসে এই রকম জোয়ার উঠেছিলো। আশ্চর্য এক বেদনা,যেন এক আপনজনকে হারালাম। এ আমার একার কথা নয়,বহু মানুষ বললেন,”ও যে এত আপন ছিল আগে তো এ ভাবে বুঝিনি”? সবার চোখের কোণে জল। না,কেউ আত্মীয়,পরিজন,বন্ধু-বান্ধব এর কথা বলছে না,অচেনা শ্রোতার দল কদিন ধরে আপন মনের গভীর ক্ষত নিয়ে কি করবে বুঝে পেলনা। কত লেখা,কত ছবি,কত গান,শোক মিছিল, শোকসভা হল,কিন্তু কিছুতেই তাকে আর ফিরে পাওয়া হলনা।

২০০০ সালের কোন একটা সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ক্যাসেটের দোকানে পেলাম একটা মজার মনোগ্রাহী প্রচ্ছদে বাংলা গানের দল দোহার এর গানের ক্যাসেট। গানের সারিতে দেখি, ছাতপেটার গান,সারি গান,মুর্শিদি,ভাটিয়ালি,কারবালার গান,চা বাগানের গান। দেখে শুনে মনে কৌতূহল হল। এ কি রকম দল?এ কি রকম গান?ক্যাসেটের ভেতর সুন্দর বাংলায় মুখবন্ধ লেখা। এই দল বরাক উপত্যকা থেকে গান খুঁজে এনেছে আর সেই গানেরই দোহার দিচ্ছে।

পড়ে ভারি মজা লাগল যে এরা বলছেনা এরা নিজেরা গান রচনা করেছে বা সুর দিয়েছে,বরং পরিষ্কার ভাষায় বলছে অন্যের গান খুঁজে পেতে এনে গাইছি। সেই সময়টা এমনি ছিল যখন আশেপাশে প্রচুর ব্যান্ড নিজের গান গাইছে আর একক গায়কেরা নিজের গান গলায় গিটার ঝুলিয়ে গাইছেন। তখন সেটাই রীতি। এরা বলছে আমরা অন্যের গান গাইছি,গরিবের গান,শ্রমিকের গান,প্রান্তিকবর্গের গান। অতি উৎসাহে বাড়ি এনে চালালাম গান।

প্রথম গানটা ছিল,কালিকাপ্রসাদ এর লেখা ভনিতা,দোহারের বন্দনা। চমৎকৃত হয়ে গেছিলাম বললে বাড়িয়ে বলা হয়না। পথের পাঁচালির মিঠে বাঁশি দিয়ে শুরু আর তারপর অসাধারণ কথায় বাঁধা একটি গানরূপি ভনিতা। সেখানে শুনলাম দোহার বন্দনা করছে,কি ভাবে,কাকে?

“দোহারে বন্দে সবারে বন্দে

আসর বন্দে,শ্রোতা বন্দে,বন্দে গানের দেশ

খুঁজে প্রানের দেশ আহা মরি বেশ”

“বন্দে মহাজন আর বন্দে বন্ধু সুজন”

আর

“বন্দে ফতিমা, বন্দে সরস্বতী মা”।

এই সব গাইছে আর প্রায় যেন কীর্তন এর হরধ্বনির মত রব তুলেছে।

কি কাণ্ড! এমন কথা আর এমন গান তো বাপের জন্মে শুনিনি! এরা কারা?

পরিষ্কার,পরিশীলিত পরিবেশনা। যন্ত্র সবই দেশী,গান সবই যেমনই মেঠো তেমনই মিঠে। কোথাও অযথা যন্ত্র বা বাদ্যের ব্যবহার নেই। এএক্কেবারে যাকে বলে নিটোল পরিবেশনা। শুনলে মনে হয় আহা কি শুনলাম!মনে হল পেলে জিজ্ঞেস করি,কোথায়ে ছিলে গো তোমরা?

লোকসঙ্গীতের সব থেকে বড় গুণ তার সহজ পরিবেশন। গান আর বাজনার সহজ মিলমিশ তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে। গানের সুরে বিশেষ বৈচিত্র্য না থাকলেও সহজবোধ্য সুর আর অনাবিল ছন্দ না থাকলেই নয়। মাটির গান যেখান থেকে উঠে এসেছে সেখানে আর যাই থাকুক রকমারি দামি বাদ্যযন্ত্রের আড়ম্বর থাকা অসম্ভব বললেই চলে। পেটে নেই ভাত,তা না হয় আজ মরমী দু কলি গান বেঁধেই পেট ভরাই!

সেই গান কি যে সে গান? তার কথার ভাব শহরের মানুষের মনেও দোলা দেয়। সহজ সুর,গভীর কথা  আর শরীরের সমস্ত শক্তি ও আবেগ নিংড়ে নেওয়া গায়কী। এই লোকগানের টান অতি আন্তরিক।

শহরে বেশিদিন নাগরিক জীবন যাপনের এক বিষম বেদনা হল জটিলতা। তার বিভিন্ন রূপ দৈনন্দিন কাজে-অকাজে ব্যক্ত হয়। গানই বা বাদ যাবে কেন?যে যত ভাল গান জানে,যার গানের জ্ঞান যত বেশী,সে ক্রমেই গান কে আরও জটিল করে তুলবে,এ আর আশ্চর্য কি?যারা ট্রেনে বাসে গান গেয়ে ভিক্ষে করে,তাদের গান চড়া সুর হলেও,মিঠে লাগে। কিন্তু সে গান শহুরে মানুষের ছোট ড্রয়িং রুম বা মাইক ফিটিং গলার মাপে বেমানান লাগে। কেতা কায়দায়ে ঢ্যারা। পড়াশোনা শিখে অমন চাষা ভুষোদের মত গাইলে চলেনা। তাই না?

এই রকমে একটা জায়গায়ে কালিকা দিলেন আঘাত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যর ছাত্র,ভালো ঘরের ছেলে কোথায় রবীন্দ্রগান বা মার্গ সঙ্গীত এর পথ ধরবে,তা নয়,গেরামের গান ধরল। যেখানে বুদ্ধিজীবির কথার ধারই মাপকাঠি,সেখানে কিনা অন্যের মেঠো গান? হাতের কাছে ইলেক্ট্রনিক বাজনার কোন অভাব নেই,পরতের পর পরত মিলিয়ে মিশিয়ে গান তৈরির সব সরঞ্জাম মজুত,সেখানে সরল রেখার মত গান?

আর শুধু কি গান? কালিকার গানের সঙ্গে থাকতো  গানের ইতিহাস ও সামাজিক ব্যাখ্যা। এইখানে কাজে লাগত ওঁর তথাকথিত পড়াশোনা। যে কোনও গান গাইবার আগে সেই গানের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিস্তারিত ভাবে শ্রোতাকে ব্যাখ্যা করা, এতটা ক’জন করে আর ক’জনই বা করতে পারে? গভীর জিজ্ঞাসা মনে নিয়ে এই শিল্পী-গবেষক অনুসধন্ধান করতেন। গানের কথা, সুর, এবং আঞ্চলিক সঠিক উচ্চারণ কে সম্পূর্ণ সম্মান জনক ভাবে তুলে ধরার মধ্যে মনন, চিন্তা ও মুনশিয়ানা প্রচুর। কালিকার প্রতিটি কাজ ও কথা যেন লোকগান কে উদ্যেশ্য করেই বার বার বলত “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।“

সোহাগ চাঁদ বদনি ধনি গানটি কলকাতায় সোহাগ বলেই উচ্চারণ করা হত। এমনকি নির্মলেন্দু চৌধুরীও পরিষ্কার সোহাগ বলেই উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কালিকা সেই জায়গাটুকুও ত্যাগ করতে রাজি না। “সুহাগ” চাঁদ বদনি ধনি শুনলাম পরিষ্কার তাঁর কাছেই। নির্দ্বিধায়,সহজ ভাবে আঞ্চলিক উচ্চারণ যে কতটা মুক্তির,কতটা আনন্দদায়ী, এটা শুধু মাত্র অনুভবের,ব্যাখার নয়।

একই রকম ভাবে “দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সুনা”বলে তাঁর দলের রাজিবকে অ্যালবাম রেকর্ড করতে শুনেছে বহু লোক। আমার শুনে ভারি মজা লেগেছিল। আমরা যারা অসম থেকে কলকাতায় এসে প্রাণপণ আঞ্চলিক ভাষার আভাস ভোলানোর চেষ্টা করছি,সেখানে ওরা এসে দিব্যি আঞ্চলিক উচ্চারণে দাপটের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে!মনে জোর পেলাম,লজ্জা কাটিয়ে উঠলাম। আমিও তখন ছোট খাটো অনুষ্ঠানে ওদের গান গুলো ওদের মত করেই গাইতে লাগলাম। কালিকার সঙ্গে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হত। শুনে খুশি হয়েছিলেন যে আমি ওদের গান গেয়ে বেড়াই।

এই বার আসি দোহারের কথায়। দোহার ছিল গানের দল। ব্যান্ড নয়। ব্যান্ড কথাটার একটা পরিধি বা সীমা আছে,কিন্তু দল মাত্রেই বড় আকার এবং ক্রমবর্ধমান। কালিকা কোনোদিন তাঁর কাকার বিশাল ভান্ডার কে নিজের নামে বেঁধে রাখেনি। গান গেয়ে,গাইয়ে,শুনিয়ে,বুঝিয়ে,শিখিয়ে দেওয়ার নামই হল দোহার। অ্যালবাম থেকে,শো থেকে,লেখালেখি থেকে ক্রমে সারেগামাপা এবং সিনেমাতে সঙ্গীত পরিচালক হওয়া,সব কিছুই দোহারের লোকগানের মূল আদর্শকে ধরে রেখে কাজ করে যাওয়া। এক সময় এমন আকার ধরল,যেন একটা গানের আন্দোলন শুরু হল!লোকগান কে “কুল” বা “হেপ” করে তোলা। ট্যাটু গায়ে,জিন্‌স পরা ছেলে মেয়ে লোকগান শুনছেও,গাইছেও!এক অভূতপূর্ব সময় এসে পড়েছিল গানের জগতে। সবাই দোহার কে চেনে। ঘরে ঘরে ওদের গান,ওদের চর্চা। কালিকার গানের ব্যাখ্যা,অজানা তথ্য সবাই হাঁ করে শুনছে।

বাউল গান বা লোকগানের অভাব ছিলনা। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল এমনটাও ঠিক বলা যায়না। কেন্দুলির মেলাতে বাউলরা এখনো আসেন। গ্রামে গঞ্জে,ট্রেনে বাসে,গ্রামের বিয়ে বাড়িতে,চা বাগানের কুলিদের সান্ধ্য জমায়েতে,সাঁওতালদের আড্ডায় গান জমে ওঠে। এখনো।

কিন্তু সে মরমী গান শুনতে গেলে তাঁদের কাছে যেতে হয়,ভাব জমাতে হয়,থাকতে হয়। সেই যেমন সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক ছবিতে উৎপল দত্তকে দেখা গেছিল। খানিক না মিশলে ওরা ওদের তত্ত্বকথা মন খুলে বলবে কেন?

এই এত পথ হেঁটে গিয়ে গান শোনাটাই সহজ করলেন কালিকা।  নিজে যোগাড় করে সাজিয়ে গুছিয়ে শহরে নিয়ে এলেন এই অজানা,অল্প চেনা গান। নিয়ে এল গানের তথ্য যা জানার ইচ্ছে থাকলেও শহুরে মানুষের জানা হয়ে ওঠেনি। লেখালেখিও বিশেষ হয়নি। হলেও বা সেটা এতটাই শুষ্ক যে সেটা মরমে গিয়ে পৌছয়নি। গানের সম্পর্কে যতই লেখা হোক,আসল নথিতো গান নিজেই।

এই লোকগানকে আজকের মত করে বুঝে,সমসাময়িক আলোচ্য বিষয়কে ঘিরে গান চয়ন করা এবং চড়া সুর ও নরম সুরের সুন্দর মিশ্রন পরিবেশনা করার জন্যে লাগে তুখোড় মেধা আর গান শোনানোর চরম আকাঙ্খা!এই এত কিছু কার ঝুলি তে আছে?কার ঝুলি তে ছিল?

একটা গানের কথা বলি। গৌরি এল, দেখে যা লো…। এই গানে একটা মিষ্টি কথা বারবার আছে “কি ঠাকুর দেখলাম চাচা!কি দুগগি দেখলাম চাচি!” বেশি ভাবার ও দরকার নেই। সবাই জানে,চাচা চাচি কোন সম্প্রদায়ের লোকের সম্বোধন। তারা দুর্গা ঠাকুর দেখতে এসেছে,আর আদর করে দুর্গা কে দুগগি বলছে!যেন বাড়ির আদরের ছোট্ট মেয়ে। কি সুন্দর একটা দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠল!আজকের এই মৌলবাদী আবহাওয়ায় এই গান কি সুন্দর ভাবে গ্রামের একটা সজীব দৃশ্য তুলে ধরে!কে আজ সাহস করে এই গান গাইবে?কে গাইবে ওদের সেই অসাধারণ কারবালার গান?

সবাই কেন কাঁদছে ওর জন্যে?ও যে শুধু গান গাইত না গো,ও যে অনেক প্রান্তিক বর্গের মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। ও যে নিরঞ্জনদার সারিন্দাকে দেশ বিদেশের সম্মান এনে দিয়েছিল। তুলিকা গঙ্গাধরের গান যে ও পৃথিবীকে শুনিয়েছিল। আদিতির কীর্তনে সকলকে কাঁদিয়েছিল!

যাক,কাজ অসম্পূর্ণ রেখে গেল। মানুষের মনে দোলা দিয়ে টুক করে কেটে পড়া মোটে ভালো কাজ না। ওরই গাওয়া বাউল আব্দুল করিমের গান ধরে কালিকার উদ্দ্যেশে বলি “ভক্তের অধীন হও চিরদিন, থাকো ভক্তের অন্তরে..”।

হায়দ্রাবাদ নট আউট

বেদদ্যুতি চক্রবর্তী

কতদিন আগের কথা ! ১৩৭০ কোটি বছর !! হায়দ্রাবাদ – কোলকাতা- মগরা- ভিয়েতনাম- রোম- প্যারিস- ইউরেনাস- নেপচুন- সিরিয়াস- বেটেলগিউস- সপ্তর্ষিমন্ডল- কালপুরুষ- অ্যান্ড্রোমিডা- ব্ল্যাকহোল- ব্রহ্মান্ড — সব একাকার হয়ে ছিল একটা ডিমের মধ্যে। কসমিক এগ। মহাডিম্ব। সেটাই ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল। আজ থেকে ১৩৭০ কোটি বছর আগে। সৃষ্টির আপন নিয়মে তৈরি হল সৌরজগৎ। তারমধ্যে পুটকি পৃথিবী। পৃথিবীর মধ্যে বিন্দুবৎ হায়দ্রাবাদ।
হায়দ্রাবাদের ঐ পাথরগুলোর বয়স ২৫০ কোটি বছর ! ঐ যে পর পর পাথরগুলো, ইয়াব্বড়-বড় পাথরের চাঁই আরেকটা পাথরের ওপর কোনরকমে সংক্ষিপ্ত সংযোগে দাঁড়িয়ে আছে ! মনে হবে এই পড়ে গেল বুঝি ! অথচ না। দিব্যি ওরা আছে, কোটি কোটি বছর ধরে। কত প্রাণ-প্রজাতির আসা-যাওয়া। ডাইনোসরের হম্বি-তম্বি। ঝড়-জল-বৃষ্টি, রাত-দিন-বারোমাস।  নীরব সাক্ষী সবকিছুর।
হায়দ্রাবাদ, হায়দ্রাবাদ হল তো হালে ! মোটে ৪২৫ বছর আগে। ছোট-বড়ো অবলা পাথরগুলোর আড়ালে কখন যে ভাগমতী আর কুলি কুতুব শাহের মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল তা আজও ঐ পাথরেই জীবন্ত। রাজা কুলি ভাগমতীকে বিয়ে করে, ভাগমতীর গ্রামের নাম রেখে দিলেন ভাগ্যনগর। বিশ্বস্ত সহচর মমিন আলিকে জানালেন প্রাণের কথা। ভাগ্যনগরে গড়ে উঠবে মস্ত শহর। প্রাসাদ- মিনার- বাগানবাড়ি। স্বপ্ন মূর্ত হল। ভাগমতীকে কুলি ডেকে নিলেন প্রাসাদে। একান্তে। চারমিনারের ওপর তখন টুকরো চাঁদের ভালোবাসা। ভাগমতি তখন “হায়দার মহল”।

‘হায়দার মহল’, সে তো কুলিরই দেওয়া নাম।
এ ভাবে ভাগ্যনগর যে কখন হায়দার মহলের নামে ‘হায়দ্রাবাদ’ হয়ে গেল তাও ঐ পাথরগুলো জানে। শাহ্ জাহানের মুমতাজ মহল তো অনেক পরে। পাথুরে শহর হায়দ্রাবাদে প্রেমের পরশ লেগেছিল তারও অনেক আগে।

প্রেম, অথচ প্রেম নয়। হায়দ্রাফাদের শেষ রাজা (শেষ নিজাম) মীর ওসমান আলির বৌ-এর সংখ্যা ৪৩ বা ৭২। দুই কৌতুহলীর দুই হিসেব। তাদের ঘরে ছেলে-পুলে, নাতি-নাতনি। নিজামের সাম্রাজ্য। একশো বছর আগে (১৯১৭-১৮), হায়দ্রাবাদেই নিজাম গড়ে তুলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের নামেই তার নাম — ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি। পঠন-পাঠন শুরু হল উর্দুতে। কেন বাবা ! তামিল-তেলেগু-কন্নর কী দোষ করল ? এই কারনেই কয়ক শো ছাত্রের বিদ্রোহে উত্তপ্ত হল বিদ্যাক্ষেত্র। অবশেষে তাদের বহিষ্কার। ব্যাপারটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেনি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। অসীম ভরসায় নাগপুর ইউনিভার্সিটির উপাচার্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কৃত ছাত্রদের অ্যাডমিশন দিলেন। এও যেমন সত্যি, এটাও সত্যি যে ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতেই ‘গীতা’-র প্রথম আরবি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। এখানকার বিজ্ঞান গবেষণার হাত ধরে জগৎ চিনল ঐ ছোট্ট জীবানুটাকে। নাম “স্ট্রেপ্টোমাইসেস ওসমানিয়াসিস”। এই জীবানুকেই এখনকার বিজ্ঞানীরা ধানগাছে ছত্রাকের আক্রমণ রুখতে ব্যবহার করতে চাইছেন।

বিড়লা মন্দিরের পাথরে আরও কত ঘটনার অদৃশ্য খোদাই। এখনকার ঐ মন্দিরস্থল আগেকার নওবত পাহাড়। এখান থেকেই নহবৎ বাজিয়ে নিজামের ‘ফরমান’ (আদেশনামা) পথচলতি নাগরিককে জানান দেওয়া হত।
পাশেই হুসেন সাগর। পাথুরে জায়গাটায় যে জলের বড়ই দরকার। দক্ষ স্থপতি হুসেন শাহের তত্ত্বাবধানে হায়দ্রাবাদ শহর পত্তনের আগেই যে বিরাট জলাধার তৈরি হল, গোলকুন্ডার রাজা ইব্রাহিম তার নাম রাখেন হুসেন সাগর। গুগল ম্যাপে দেখলে তাকে মনে হবে হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তার পাশে ট্যাঙ্ক বান্ড। তার ধার ঘেঁষে চৌত্রিশ মনীষির প্রস্থরমূর্ত্তি সুরক্ষিত, সুশোভিত। ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার পিঙ্গালী ভেঙ্কাইয়াও এখানে উপস্থিত। উল্টোদিকে উড়ছে বিরাট একটা তেরাঙ্গা। কাছাকাছি রইল সালার জং মিউজিয়াম। জীবনে বিয়েই করলেন না একসময়ের নিজামের ঐ প্রধানমন্ত্রী। বছর দুয়েক ওসমান আলির প্রধানমন্ত্রিত্ব করলেও নিজামের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেন নি। প্রধানমন্ত্রীর পদ খুইয়ে বিষাদরোগে আক্রান্ত হলেন। বিদেশী চিকিৎসকের পরামর্শে জীবনের স্বাদ খুঁজে পেতে চাইলেন অ্যান্টিক সংগ্রহে। এক জীবনে ৪৩,০০০ অ্যান্টিকের সংগ্রাহক (বইয়ের হিসেব বাদ), বিশ্বে বিরল।

প্রধানমন্ত্রী – পাইগা – জায়গীরদার – নিজাম। সবারই অঢেল ধনরত্ন। ১৯৩৭ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তির মর্যাদা পেয়েছিলেন নিজাম। এখন যে শিরোপা বিল গেটসের মাথায়। ২০ গ্রামের (প্রায়) ‘জ্যাকব ডায়মন্ড’-এর মালিকও ছিলেন এই নিজাম। এখন সেই হীরে নিজামের ১০,০০০ কোটি টাকার রত্নসম্পদের সাথে দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অন্ধকার ঘরে।
ধনরত্ন, অর্থকরী বাড়ানোর নানান উপায় ফেঁদেছিলেন এই নিজামেরা। মীর ওসমান আলিকে প্রজারা দর্শন করতে এলে স্বর্ণমুদ্রা দিতে হত “নজরান” হিসেবে। আর, নিজামের যদি কোনও জিনিস পছন্দ হত, প্রজারা তাকে তা দিয়ে ধন্য হত। মানে, নিজাম তাদের ধন্য হওয়াতেন। এইভাবেই ফলনামা প্যালেস পাইগাদের কাছ থেকে নিজামের আয়ত্তে এল। নিজাম এসমান আলি সেই প্রাসাদকে ব্যবহার করতেন গেস্ট হাউস হিসেবে। এমনই কিপটে ছিলেন, অতিথিদের চায়ের সাথে একটার বদলে দু’টো বিস্কুট দিতেন কুন্ঠাভরে। তালাচাবি মারা আলমারি থেকে বিস্কুটের কৌটো বার করে। আর খেতেন চারমিনার সিগারেট। চারমিনার নামটার ব্যবহার করার অনুমতি দেবার জন্যে, ঐ সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে মোটা টাকাও পেতেন নিজাম।

সেই চারমিনার ! হায়দ্রাবাদের সাথে অচ্ছেদ্য, অভিন্ন।
প্লেগ মহামারির আকার নিয়েছিল একবার। বহুলোক মরল। প্রকৃতির নিয়মে প্লেগ যখন বিদায় নিল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নগরবাসী। মহানন্দে কুলি কুতুব শাহ গড়ে তুললেন চারমিনার। সাত কিলোমিটার দূরের গোলকুন্ডার শীর্ষের সাথে তিনিই নাকি সুড়ঙ্গ কাটিয়েছিলেন। এখনও গোলকুন্ডার ওপরে উঠলে, পাথর দিয়ে বন্ধ করা সেই সুড়ঙ্গর মুখ দেখা যায়। কিন্তু পাথর দিয়ে কি ইতিহাসকে বন্ধ করা যায় ?
তারামতি , প্রেমমতি, তানা শা, আওরঙ্গজেব, হায়াত বক্সী, ইব্রাহিম, জাহাঙ্গীর, ভাগিরথীকে নিয়ে গোলকুন্ডার পাথরগুলোর যে এখনও অনেক গল্প বলা বাকি !
হায়দ্রাবাদ শহরটার নামকরণের ৪২৫ ফছর পেরিয়ে গেল। এখনও সেটা ভীষনভাবেই হায়দ্রাবাদ। ইতিহাসের গায়ে বর্তমানের চাদর মুড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলেছে শহরটা। চলতে থাকুক। নিজেকে আরও সুন্দর করে। এস, আমরাও বাড়াই হাত।

উত্তরাধিকার এবং ভিখারি

অমিতাভ পাড়ুই

ভগবান বুদ্ধকে স্বামীজী যে কি চোখে দেখতেন তা বলে বোঝানো যাবে না। বুদ্ধর নাম উচ্চারণ করা মাত্রই তিনি যেন কেমন হয়ে যেতেন। বোঝা যেত হৃদয়ের গভীরে এক প্রকাণ্ড তরঙ্গ উঠেছে। ভীষণ অন্তরঙ্গভাবে তিনি বুদ্ধের জীবনী শ্রোতাদের সামনে মেলে ধরতেন। স্বামীজীর বলা এমনই একটি ঘটনা– যা তিনি তাঁর লেকচারে  শ্রোতাদের শোনাতেন।

বোধিলাভের পর বুদ্ধ পিতৃরাজ্যে একবার ফিরে এসেছিলেন। বৃদ্ধ পিতার আনন্দ আর ধরে না! রাজপুত্র ফিরছেন শোনামাত্রই তিনি রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন – রাজধানীকে পত্রে, পুস্পে, তোরণে, বর্ণের বিচিত্র বাহারে সুসজ্জিত কর। সকলের মধ্যেই উচ্ছাস আর আগ্রহ, প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশা – কতদিন পর রাজকুমার দেশে ফিরছেন!

স্বামীজীর বলা এই ঘটনাটিকে অনুসরণ করে নীচের কবিতাটি রচিত…

 

উত্তরাধিকার

 

সাজো সাজো রব রাজার প্রাসাদে

আজি বহুকাল পর

মহা-আনন্দে মাতিয়াছে সব

কুমার ফিরিছে ঘর।

প্রাসাদ অলিন্দে অস্থির যশোধরা

সন্তান সাথে প্রিয় প্রতিক্ষারতা।

কতকাল পর ফিরিছে কুমার

বুঝি অবসান দীর্ঘ আশার।

 

আবেগ না মানে বাঁধন যে হায়

হেরিয়া স্বামীরে যশোধরা কয় –

হে পুত্র মোর ‘ঐ আসে পিতা, যাও ছুটে যাও,

প্রাপ্য তোমার লও মেগে লও।‘

অপার বিস্ময়ে বালক কহিল –

‘কে আমার পিতা, বলো মোরে বলো,

আমি শুধু দেখি প্রাসাদ পানে চলে

সহায় সম্বলহীন ভিখারি দলে দলে।‘

যশোধরা কয় – ‘ওরে বাছা মোর,

ভাল করে দেখ – পুরভাগে ওর

উজ্জ্বল জ্যোতি মৃগেন্দ্র সম

পিতা তোমারই, দেবতা মম।

রাজপুত্র তিনি কি বিচিত্র সাজ!

ভিখারির বেশে এ যে মহারাজ!’

 

শুনিয়া সে কথা পুত্র রাহুল

সেই দিক পানে ধায়

নতজানু হয়ে দুহাত বাড়ায়ে

পিতা মুখপানে চায়।

সম্মুখে তাঁর শিশুপুত্র সেই!

ত্যাজিয়া যাহারে, ছাড়িয়া রাজপ্রাসাদ

এ খোলা আকাশ হইয়াছে

তাঁর আপন গৃহের ছাদ।

 

রাজার প্রাসাদে রাখিয়া প্রমাণ

পুত্রের হাতে বুদ্ধ ভগবান

নিজ ঝোলা হতে টানি

করিলেন দান গৈরিক বস্ত্রখানি।

 

অঞ্জলিপুটে হল অর্পণ

যা তাঁহার বড় আপনার ধন

“সব ধর্ম মাঝে ত্যাগ ধর্ম সার”

পিতৃ সম্পদে পুত্রের অধিকার।

 

কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী, ইংরেজি ৯ই নভেম্বর, ১৮৮৪ সাল। শীতের প্রারম্ভ। ঠাকুরের জামার প্রয়োজন হইয়াছিল, মাস্টারকে আনিতে বলিয়াছিলেন। তিনি লংক্লথের জামা ছাড়া একটি জিনের জামা আনিয়াছিলেন; কিন্তু ঠাকুর জিনের জামা আনিতে বলেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – তুমি বরং একটা নিয়ে যাও। তুমি পরবে। তাতে দোষ নাই। আচ্ছা, তোমায় কি রকম জামার কথা বলেছিলাম?

মাস্টার – আজ্ঞা, আপনি সাদাসিধে জামার কথা বলেছিলেন, জিনের জামা আনিতে বলেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তবে জিনেরটাই ফিরিয়ে নিয়ে যাও।

বিজয় – আজ্ঞা, তা বই কি! যা দরকার কাজেই নিতে হয়। একজনের ত দিতেই হবে। মানুষ ছাড়া আর কে দেবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেবার সেই ইশ্বর !

এই বলে ঠাকুর নীচের গল্পটি বলেছিলেন  —

“একজন ফকির আকবর শাহর কাছে কিছু টাকা আনতে গিছলো।   বাদশাহ তখন নামাজ পড়ছে আর বলছে, হে খোদা! আমায় ধন দাও, দৌলত দাও। ফকির তখন চলে যাবার উপক্রম করলে। …“

ঠাকুরের এই গল্পটি অনুসরণ করে নীচের কবিতাটি রচিত…

 

ভিখারি

বাদশাহ বীর – উন্নত শীর সম্রাট আকবর

পড়িছেন নামাজ একদা প্রভাতে বসি।

জীর্ণ শরীর – বৃদ্ধ ফকির

ভিক্ষার তরে জোড় হাত করে

নীরবে দাঁড়াল আসি।

 

কহে সম্রাট আল্লার প্রতি –

দয়া কর মোরে, করি এ মিনতি

মোর পানে প্রভু চাও

ধন দৌলত আরও বেশী করে মোরে দাও।

 

শুনিয়া সেকথা বৃদ্ধ ফকির

সহসা করিল স্থির

সে স্থান হতে – দ্রুত রাজপথে

তখনই হইল বাহির।

অবাক তাহাতে বাদশাহ বীর

ফকিরে ডাকিয়া কয়

ভিক্ষা না লও – কেন চলে যাও!

জানো মোর পরিচয়?

 

নত করি শীর – কহিল ফকির

মাগিব ভিক্ষা – ভিখারির কাছে!

তাই কি কখনও হয়?

বাঙলা নাটক

ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

একজন বিশ্ববন্দিত নাট্যকার আর একজন পৃথিবী বিখ্যাত রাজনীতিবিদ।

দুজনেরই জিহ্বাগ্রে সরস্বতী এবং দুজনেই নোবেল ল’রিয়েট। একজন তো আবার ওয়ান অ্যান্ড দ্য ওনলি ওয়ান যাঁর ঝুলিতে নোবেল আর অস্কার দু-দুটো শিরোপাই আছে।

তবে নাট্যকার ব্যক্তিটি ছিলেন রাজনীতিবিদটির চরম সমালোচক। তবে নিজের নতুন নাটকের প্রিমিয়ারে নাট্যকার টেলিগ্রাম করে নিমন্ত্রন করেছিলেন সেই রাজনীতিবিদকে।

১৯১৩ সালে বার্নাড শ’ তাঁর “পিগম্যালিয়ন” নাটকের প্রথম শো’র আগে টেলিগ্রাম করলেন চার্চিলকে :

“Reserving two tickets for you for my premier. Come and bring a friend….if you have one!”

Pat came the reply from Churchill, ”Impossible to be present for first performance. Will attend the second……if there is one!”

 

JU Alumni-র “মেঘপিওন” সাহিত্য পত্রিকার জন্য সুশান্তর নির্দেশে বাংলা নাটক সম্পর্কে লিখতে বসে মনে হচ্ছে কলার ভেলায় চড়ে সমুদ্রপাড়ি দিতে চলেছি। এই গুরুগম্ভীর বিষয়ের ওপর লেখার জন্য আমার মতো একজন ম্যাঙ্গো-ম্যান পটলবাবুর ওপর কেন দায়িত্ব দেওয়া হলো তার সঠিক কারন খুঁজতে গিয়ে আমার পরিবারসহ নিকট আপনজন এবং বন্ধুবান্ধব সকলেই দেখছি বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের ধারনা আমি যে বিষয়ে যত কম জানি সেই বিষয়ে আমি তত বেশী অগ্রগামী।

অবশ্য ওনাদের এই ধারনার যে একবারেই কোন ভিত্তি নেই একথাটা মোটেই বলা যাবে না। কারন আমার স্কুল জীবনের একটা ঐতিহাসিক নাটুকে ঘটনার কথা কি করে যেন আমার বাল্যবন্ধুরা আমার স্ত্রীর কানে তুলে দিয়েছিল। আর তারপর থেকেই ঘটনাটা এত ব্যাপক প্রচার পায় যে শুধু মাতৃভূমিতেই নয় হিমালয় পবর্ত আর সাত সাগর পেরিয়ে এই বিশ্বায়নের যুগে সবর্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

ঘটনাটা একটু ছোট করে এখানে বলে নেওয়া যাক।

ক্লাস সিক্সে একবার আমাদের স্কুলের বাৎসরিক উৎসবের ঐতিহাসিক নাটকে এক দূতের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম। নাটক যখন জমে দই তখন একটি দৃশ্যে মহারাজ মঞ্চে উপস্থিত, সঙ্গে মন্ত্রী। রাজ্যের সীমানায় যুদ্ধ চলছে তাই মহারাজ ভীষণ উদ্বিগ্ন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেনাপতি সেই রাত্রে সংবাদ বাহকের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিস্থিতি বিস্তারিত জানিয়ে মহারাজকে একটি পত্র প্রেরণ করবেন। সেই সংবাদের আশায় মহারাজ আর মন্ত্রী দুজনেই উৎসুক।

এমন সময়ে দৌবারিক এসে মহারাজকে সংবাদ দেয় যে রাজসেনাপতির সংবাদ বাহক মহারাজের দর্শণ প্রার্থী। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মঞ্চে প্রবেশ।

স্টেজে ঢুকেই সামনে অত লোক দেখে আমার হঠাৎ সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল।

ইতিমধ্যে মহারাজ বার দুয়েক প্রশ্ন করে ফেলেছেন,”যুদ্ধের কি বারতা আনিয়াছ তুমি?”

আমার মুখ থেকে কোন উত্তর নেই। হাতে একটা গোটানো কাগজ ছিল সেটা মহারাজকে দিয়ে শুধু বলতে হবে,”মহারাজ, সেনাপতি এই পত্রখানি প্রেরণ করিয়াছেন।“ এটা বলেই দু পা পিছিয়ে এসে একবার মহারাজকে আর একবার মহামন্ত্রীকে কুর্ণিশ করে চলে যাবার কথা।

কিন্তু তখন সব গুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে। পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। সবাই আমার দিকে উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে। বেশ বুঝতে পারছি উইংসের পাশ থেকে আমাদের নাটকের পরিচালক ইতিহাস স্যর আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু আমার কানে তখন কিছুই ঢুকছে না।

একসময়ে হঠাৎ যেন নিজের ভিতর থেকে একটা তাড়না অনুভব করলাম। তারপর বলতে শুরু করলাম,”যুদ্ধের বারতা আমি আপনাকে শোনাই মহারাজ। যুদ্ধক্ষেত্রে সে কি ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। সে এক ভয়াভহ যুদ্ধ! মানুষে-মানুষে যুদ্ধ, হাতিতে-হাতিতে যুদ্ধ, ঘোড়ায়-ঘোড়ায় যুদ্ধ, তলোয়ারে-তলোয়ারে যুদ্ধের টং-টং আওয়াজ সারা যুদ্ধক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে। হাতি আর ঘোড়ার পায়ের ধুলোয় চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। তারপর…।“

তারপর ইতিহাস স্যর আমাকে আর এগোতে দেন নি।

আলো নিভিয়ে দিয়ে আমার ঘেঁটি ধরে এক ঝটকায় উইংসের ভেতরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

এরপরের ইতিহাস এতই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে আমি আর তা মনে করতে চাই না। এই হলো আমার জীবনে বাঙলা নাটকের প্রথম আবির্ভাব।

(২)

 

তা এইরকম এক অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন আমাকে বাংলা নাটকের ওপর লেখার অনুরোধ সামলাতে হয় তখন কি পরিমাণ দুঃসাহসিকতার পরিচয় আমাকে দিতে হবে সেটা নিশ্চয় সুধী পাঠকবৃন্দের অনুমান করে নিতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

 

যাইহোক লিখতে যখন হবেই তখন বাংলা নাটকের আদিপর্বের ইতিহাসের কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখা যাক। সেই কবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়েছি তার ওপরে তো  শুধু ভরসা করলে চলবে না, হাতের কাছে গুগুল জেঠূ  যখন আছেন যখন চিন্তা কি!

তবে বছর দুয়েক আগে কলকাতার বহুরূপী নাট্যদলের আয়োজিত নাট্যমেলাতে “মুখোশের মুখ” নাটকটি দেখতে গিয়ে সেই নাট্যউৎসব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি নাটকবিষয়ক স্মারক পত্রিকা আমার হাতে আসে। সেটাতে দেখছি শম্ভু মিত্র মহাশয়ের একটি দামী লেখা আছে এবং তাতে বাংলা নাটকের ইতিহাসের ওপর বেশ কয়েকটা কথা আছে। সেগুলোই প্রথমে পাঠকদের সাথে, ঐ কি যেন বলে, হ্যাঁ শেয়ার করে নেওয়া যাক।

 

১৭৭৪ সালে কলকাতা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী হবার ঠিক একুশ বছর পর ১৭৯৫ সালের নভেম্বর মাসে গেরাসিম লেবেডফ নামে এক রাশিয়ান ভদ্রলোক কলকাতায় এক মঞ্চ নির্মান করেন। এরপর  সেই ভদ্রলোক একটি বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। নাটকটির নাম ছিল “কাল্পনিক সংবদল” – এটি একটি “দি ডিসগাইজ” নামক এক ইংরেজি নাটকের বাংলা তর্জমা।

সবচেয়ে বড় কথাটা হচ্ছে লেবেডফের এই নাটকে স্ত্রী চরিত্রে মেয়েরাই অভিনয় করেছিলেন এবং টিকিটের মূল্য ছিল চার টাকা আর আট টাকা।

প্রথমবারের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে লেবেডফ পরের বছরের মার্চ মাসে আবার এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। নাটক অভিনয়ের আগে লেবেডফ ক্যালকাটা গেজেট কাগজে একটি বিজ্ঞাপন দেন; বিজ্ঞাপনটি নিম্নরূপ ছিলঃ

“দর্শকদের সুবিধার জন্য বসিবার আসন দুইশত করা হইয়াছে যাহা শীঘ্র পুর্ণ হইয়া যাইবে। দর্শণপ্রার্থীদের এক স্বর্ণমোহর সহযোগে আবেদন করিতে হইবে। পেক্ষাগৃহ পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আবেদন পত্র গৃহীত হইবে।“

একটি টিকিটের জন্য এক স্বর্ণমোহর এই সময়েও আমাদের সবাইকে চমকে দেবে! তবে লেবেডফ সাহেব অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। অভিনয়ের পরের দিন তিনি আবার ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে দর্শকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য অকুন্ঠ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

এরপর লেবেডফ সাহেব ইংল্যান্ডে চলে গেলে বাংলা থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর আবার উনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে নতুন করে বাংলা থিয়েটারের কথা শোনা যায় – হিন্দু থিয়েটার স্থাপন এবং নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে রঙ্গমঞ্চ তৈরী হয়।

এই সময়কার থিয়েটার বলতে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য যবনিকাপট সমেত প্রসিনিয়াম মঞ্চের কথাই ধরেছেন।

 

শম্ভু মিত্র অবশ্য তাঁর এই লেখাটাতেই বলেছেন যে পরর্বর্তী কালে অনেক নাট্য বিশেষজ্ঞ লেবেডফের এই বাংলা নাটকের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে সেটা আমাদের মতো ম্যাঙ্গো-ম্যানদের কাছে বড় কথা নয়। একজন বিদেশী বাংলা আর বাঙালির সাথে কতখানি একাত্মতা অনুভব করলে তবে এমন একটা বিশাল ঐতিহাসিক কর্মকান্ডের সৃষ্টি করতে পারেন তা ভাবতে গেলেই শিহরিত হতে হয়।

এরপর থেকেই কিন্তু বাংলা নাটক তার স্থিতিজাঢ্যতা ত্যাগ করে জঙ্গম অবস্থা প্রাপ্ত হয়।

 

বাংলা নাট্য জগতে যে নাটকটি সর্বপ্রথম মৌলিক নাটক হিসবে মান্যতা পেয়েছে সেটা হচ্ছে পণ্ডিত রামরত্ন তর্করত্ন রচিত “কুলীনকুল সর্বস্ব।” ১৮৫৪ সালে লিখিত এবং অভিনীত প্রথম সামাজিক নাটক।

তারপর ১৮৫৯ সালে বাংলা নাট্যমঞ্চে মধ্যাহ্ন সুর্য্যের মতো মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত আর বিশেষ কোনো নাম বা নাট্য প্রযোজনা নজরে কাড়ে না বললেই চলে। ১৮৫৮ সালে তৎকালীন কলকাতার উত্তরাঞ্চলে এক রাজবাড়িতে “রত্নাবলী” নাটকের অভিনয় দেখে মাইকেল তাঁর পরিচিত মহলে অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেন,”রাজারা এই তুচ্ছ নাটকের জন্য কি বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন।“

 

 

 

(৩)

 

এরপরই মাইকেলের বন্ধুরা সবাই মাইকেলকে অনুরোধ করেন বাংলা নাটক লিখবার জন্য। এই সময়ে মাইকেলের সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা স্মরণ করতে পারি,

”অলীক কুনাট্য রঙ্গে,

মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে,

নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।“

 

এরপর আমরা মাইকেলের হাত থেকে পাই তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক “শর্মিষ্ঠা”। এই নাটকটি পড়ে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজা প্রতাপচন্দ্র এবং আরও জ্ঞানীগুণীজন নাটকটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

এইখানে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলায় নাটক রচনার মধ্যে দিয়েই কিন্তু আমরা প্রথম বাঙালি লেখক মাইকেলকে পাই। আর শুধু তাই নয়, অমিত্রাক্ষর ছন্দ মাইকেল প্রথম প্রয়োগ করেন তাঁর পদ্মাবতী নাটকে, পরীক্ষামূলক ভাবে বলা যেতে পারে।

এরপর থেকেই বাংলা নাট্য জগতের তৎকালীন মরা গাঙে বাণ এলো মনে হয়।

মাইকেলের হাত থেকে যখন একেরপর এক নাটক, প্রহসন যখন বেরচ্ছে তখন ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র’র “নীলদর্পণ” ভীষণ ভাবে বাংলা নাট্য জগতে এবং বৃটিশ শাসক মহলে আলোড়ন তুলে দিল।

এরপরের ইতিহাস পাদ্রি লংসাহেবের নাম দিয়ে মাইকেলের নীলদর্পণ ইংরেজিতে অনুবাদ তো আমাদের সবারই জানা। অনেকদিন ধরে এই নীলদর্পণ নাটকটি বৃটিশদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। সেই সময়ে সারা বাংলা জুড়ে নীলদর্পণের অভিনয় চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ১৮৭২ সালে কলকাতার সাধারন রঙ্গশালার উদ্বোধন হয় নীলদর্পণ নাটকটি মঞ্চস্থ করে। এর ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে বৃটিশ শাসকদল ১৮৭৬ সালে নাট্য অভিনয় বিল পাস করে থিয়েটারের কন্ঠরোধ করে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক পর্যন্ত নাকি ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই আইনটি বলবত ছিল। সুখের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে এই আইনটি আর চালু নেই। তবে আজকের আইনি চিত্রটি আইন বিশেষজ্ঞরা হয়ত সঠিক বলতে পারবেন।

 

এরপর ১৮৭৩ সালে বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা পাবার পর থেকে আমরা বাংলা নাট্য জগতে পাই গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বোস, রাজকৃষ্ণ রায়, অমরেন্দ্র দত্তের মতো আরও অনেক প্রতিভাশালী নাট্য ব্যক্তিত্ব। গিরিশ ঘোষ সে সময়ে নাটক পাগল বাঙালিকে নাটকে মজিয়ে দিয়েছিলেন বলা যায়। এই সময়েই বোধহয় বাংলা থিয়েটার জগতে সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত প্রবাদ বাক্যটি তৈরি হয়েছিল,

“যাত্রা দেখে ফাতরা লোকে / থিয়েটার দেখে ভদ্রলোকে”

এই গিরিশ ঘোষের কিন্তু নাট্যমঞ্চে প্রথম প্রকাশ ১৮৬৮ সালে দুর্গা পুজোর সময়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে দীনবন্ধু মিত্রের “সধবার একাদশী” নাটকের মঞ্চায়নের মাধ্যমে। নাটকের প্রধান চরিত্র নিমচাঁদের ভূমিকায় গিরিশ ঘোষ দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন। ঐ ধরনের ট্র্যাজিক অভিনয় দর্শক বাংলা নাটকে আগে কখনও দেখে নি। যদিও গিরিশচন্দ্রের কোনও রকম প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু তিনি নিজের চেষ্টায় শিক্ষালাভ ক’রে দেশী-বিদেশী সাহিত্য ও রঙ্গমঞ্চ বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর থেকে গিরিশ ঘোষকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। সেই সময়ে গিরিশ ঘোষকে বাঙলা মঞ্চের জনক বলা হত। তবে একটা শুন্যতা সেইকালে বাংলা নাট্য জগতে দেখা গিয়েছিল যার কারনে নাট্যমোদি মহলে একটি কথা প্রচলিত ছিল যে বাঙলা রঙ্গমঞ্চের জনক আছে ঠিকই, কিন্তু কোনো কাকা বা জ্যাঠা নেই। গিরিশচন্দ্র মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যে’র নাট্যরূপও দিয়েছিলেন এবং এটি সাফল্যের সঙ্গে অভিনীতও হয়। এই সময়েই বিনোদিনী দাসী নামে এক অতি অল্প বয়সী অভিনেত্রী দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তী যুগে তিনি বাঙলা রঙ্গমঞ্চের একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী রূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব গিরিশ ঘোষের নাটক দেখে একাধারে নাট্যকার আর নটসম্রাট গিরিশ ঘোষকে আর্শীবাদ করেছিলেন লোকশিক্ষার কান্ডারি হিসেবে আর চৈতন্যলীলায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে তাঁকে “চৈতন্য হও” বলে আশীর্বাদ করেছিলেন।

(৪)

গিরিশ ঘোষকে আমরা মূলত জানি পৌরাণিক আর সামাজিক কাহিনী অবলম্বনে নাটক রচনাকার হিসেবে। তবে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে লেখেন সিরাজদোউল্লা, মির কাশেম আর ছত্রপতি শিবাজীর মতো দেশাত্মমূলক নাটক। এছাড়া উনি নিজে শেক্সপিয়ার অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করেছিলেন কিন্তু বাণিজ্যিক সাফল্য পান নি। আমার মনে হয় সাধারন বাঙালি দর্শক বোধহয় তখনও শেক্সপিয়ারকে হজম করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি কেননা পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি বাঙলার দর্শক ভীষণ ভাবে শেক্সপিয়ার প্রেমী হয়ে উঠেছিল যা আজ পর্যন্ত চলে আসছে। তবে গিরিশ ঘোষের বেশ কিছু নাটক আজও বাঙালী দর্শককে প্রভূত আনন্দ দিয়ে চলেছে।

বহুবর্ণে রঙিন ছিল গিরিশ ঘোষের বর্ণময় জীবন। এক সময় উনি লিখেছিলেন,

“তিরস্কার পুরস্কার কলঙ্ক কন্ঠের হার

তথাপি এ পথে পদ করেছি অর্পন

হৃদে সাধ রাশি রাশি, রঙ্গভূমি ভালোবাসি

আশার নেশায় করি জীবন যাপন”।

 

গিরিশ ঘোষের শেষ জীবনের কিছু নাটক দেখেছিলেন আর এক মহান নাট্যব্যক্তিত্ব শিশিরকুমার ভাদুড়ি। তখন তাঁর বয়স বড়জোর বাইশ। সেই মুগ্ধ অভিজ্ঞতার কথা তিনি তাঁর বাহান্ন বছর বয়সে শুনিয়ে ছিলেন আর এক তরুণ শম্ভু মিত্রকে যিনি পরর্বর্তী কালে এক মহান নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।

আমার মনেহয় এটাই বোধহয় বাংলা নাটকের মহান লিগ্যাসি। এক মহান নাট্যব্যক্তিত্বের প্রতিভার ছটা আর এক মহান নাট্যব্যক্তিত্ব বর্ণণা করছেন ভাবিকালের আর এক মহান নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে যিনি তখন সবে বিকশিত হতে শুরু করেছেন।

১৯১২ সালে গিরিশ্চন্দ্রের মৃত্যু হয়। গিরিশচন্দ্রের পর বাঙলা রঙ্গমঞ্চের উল্লেখযোগ্য নতুন পর্বের সুচনা হল শিশিরকুমার ভাদুড়ির আর্বিভাবে। শিশিরবাবু  কলেজ জীবনে বেশ নামকরা অভিনেতা ছিলেন এবং ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে তাঁর নাট্যপ্রযোজনা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পরে তিনি কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে পুরোপুরি নাটক জগতেই আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি যোগেশ চৌধুরীর সীতা নাটক নিয়ে নিজস্ব নাট্যসম্প্রদায় গড়ে তুললেন। এইভাবে ‘নাট্যমন্দির’-এর সূচনা হলো এবং সেটি শ্রেষ্ঠ থিয়েটার রূপে গৃহীত হলো। তারপর থেকে শিশিরকুমারকে যুগান্তকারী শিল্পপ্রতিভা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমান কালের বহু নাট্য সমালোচক আক্ষরিক অর্থে শিশির ভাদুড়িকেই বাংলা নাটকের প্রথম নির্দেশক হিসেবে মান্যতা দেন। নাট্য-অভিনয়কে একটি সামগ্রিক শিল্পকর্ম হিসেবে তিনিই প্রথম বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। নাট্যমন্দিরে তাঁর প্রযোজনাতে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর সূক্ষ্ম শিল্পবোধের পরিচয়। তাঁর মঞ্চসজ্জা, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, আগের কালের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই বাংলা নাট্য জগতে তাঁর স্থান “নাট্যাচার্য” শিশিরকুমার হিসেবে চিরকাল অমলিন থাকবে।

অনুষ্টুপ প্রকাশনা সংস্থা থেকে অনিল মুখোপাধ্যায় রচিত “বাংলা থিয়েটার ও নাট্যাচার্য শিশিরকুমার” বইটির রিভিউতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,”শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখতে শুরু করি আমি ১৯৫১ সাল থেকে। সেই অভিনয় দেখার অভিঘাত আমায় এতই আন্দোলিত করে যে তার দু-তিন বছরের মধ্যেই আমি মনস্থির করে ফেলি যে আমি একজন পেশাদার অভিনেতা হয়েই জীবনযাপন করব।“

যোগেশ চৌধুরীর “সীতা” নাটকটি নিয়ে তিনি আমেরিকা পাড়ি দিয়ে তিনি বাংলা নাটকের জগতের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেন। আমার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে উপলব্ধ “সীতা” নাটকটির পোষ্ট আমেরিকা সফর সংস্করণের ভূমিকায় দেখছি যোগেশ চৌধুরী লিখেছেন যে প্রথমে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া না গেলেও আমেরিকায় পরর্বর্তী শো গুলোতে সীতা নাটকটি সাফল্যের মুখ দেখে। আবার শিশির ভাদুড়ির বায়োপিক লেখক সুনীল গাঙ্গুলির লেখা “নিসঙ্গ সম্রাট”-এ দেখছি আমেরিকায় “সীতা” অসফল হওয়ায় শিশির ভাদুড়ি আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। হায়দ্রাবাদে সুনীল গাঙ্গুলি এসেছিলেন JU Alumni-র ডাকে। ইচ্ছে ছিল “সীতা”র আমেরিকা সফরের ব্যবসায়িক সাফল্য-অসাফল্যর দিকটার ঐতিহাসিক সত্যটা যাচাই করে নেবার। দুর্ভাগ্যবশত উঞ্ছবৃত্তির চাপে হায়দ্রাবাদে সে সময়ে না থাকতে পারায় আমার আর এই তথ্যটা যাচাই করা হলো না।

নিজের জীবন সম্পর্কে বলেছেন শিশির ভাদুড়ি বলেছেন,”থিয়েটারের শিশির ভাদুড়ির জীবনটা – বাংলা থিয়েটার নিয়ে আমার স্বপ্ন, আমার দোষগুণ, এমনকী থিয়েটার চালানোর জন্য হুন্ডি কেটে টাকা ধার করা – সব জানতেন মহর্ষি। আমার জীবনটা খোলা পাতার মতো ছিল তাঁর কাছে। একমাত্র তিনিই পারতেন (আমার জীবনী) লিখতে।“

(অভিনেতা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে তিনি স্নেহবশত “মহর্ষি” বলে ডাকতেন। সীতা নাটকে তিনি মহর্ষি বাল্মীকির পার্ট করেছিলেন।)

(৫)

অনেকরকম বিরুদ্ধতার সঙ্গেই শিশির ভাদুড়িকে লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৩৩ সালে ২৫শে জুলাই শিশির ভাদুড়ি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পাওনাদারদের টাকা না-দিতে পারার অপরাধে এবং অবশেষে তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হন। ১৯৫৬ সালের ২৪ শে জানুয়ারি  শ্রীরঙ্গমে অভিনয় করে শিশির ভাদুড়ি শেষবারের মতো মঞ্চহারা হন। এরপর বছর তিনেক তিনি কয়েকটি আমন্ত্রিত অভিনয় করতেন যাকে তিনি নিজেই নিজেকে ভাড়াটে কেষ্ট বলতেন।  ১৯৫৯ সালের ৩০ শে জুন তাঁর মৃত্যু হয়……মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “I want to die. I had enough of life.”

প্রাক-শিশির যুগে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে ঠাকুরবাড়ির ঘেরাটোপে, পরিচিত মহলে আমন্ত্রিত দর্শকমণ্ডলীর সামনে, ঠাকুর বাড়ির সদস্য-সদস্যারা নিয়মিত ভাবে তাঁদের নাটক অভিনয় করে চলেছেন।

এই সময়ে ১৮৭৩ সালে মাত্র বারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যোতিদাদার “সৌদামিনী” নাটকের জন্য গান লিখে দিয়েছেন। প্রথমে কথা ছিল যে “সৌদামিনী” নাটকের প্রারম্ভে জ্যোতিদাদার একটা পাঠ থাকবে। মহলার সময়ে তিনি সেটা সবাইকে শোনাচ্ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরে ছিলেন এবং মহলা কক্ষে এসে জ্যোতিদাদাকে বলেন যে এই পাঠটার বদলে যদি একটা গান দিয়ে নাটকটি শুরু করা যায়, তবে নাটকটা আরও বেশী আকর্ষণীয় হবে। প্রথমে জ্যোতিদাদা নিমরাজি ছিলেন কেননা নতুন করে গান লিখে সুর দিয়ে নাটকটিতে সংযোজন করে মঞ্চায়ন করা বেশ সময় সাপেক্ষ। আর তাছাড়া সাত-তাড়াতাড়ি এখন কে-ই বা গান লিখবে!

সেই শুনে কিশোর রবি পাশের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই এই গানটি “সৌদামিনী” নাটকটির জন্য লিখে আনেনঃ

“জ্বল জ্বল চিতা, দ্বিগুন দ্বিগুন

পরান সঁপিবে বিধবা বালা।

জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন,

জুড়াবে এখনই প্রানের জ্বালা।।“

 

আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যে সেইসময়ে প্রচলিত নাটকের সমস্তরকম ফর্ম ভেঙে রবীন্দ্রনাথ যে শুধু মঞ্চে নাট্য প্রয়োগের গতানুগতিক চিন্তাধারাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন তাই নয়, বাংলা নাট্য জগতে এমন একটা বৈপ্লবিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিলেন যা চিরকালীন।

 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর “ডাকঘর” নাটকটি লেখেন ১৯১২ সালে আর “রক্তকরবী” লেখেন ১৯২৬সালে শিলং-এ থাকাকালীন। এই দুটি নাটকই সময়ের বেড়া ভেঙে মানুষের কাছে চিরকালীন আবেদন রেখে গেছে। তাই আজ প্রায় ন’দশক পরেও রবীন্দ্রনাথের “রক্তকরবী” ফুলটি আজকের দর্শকের কাছে একই রকম তাজা।

আমরা আজও রক্তকরবীকে নিয়ে মঞ্চে যে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা দেখতে পাই সেটা আধুনিক দর্শকদের কাছেও সমান আকর্ষনীও। মফস্বল থেকে শুরু করে কলকাতা শহরের যে কোন ছোটবড় নাট্যদলের কাছে রক্তকরবী’র আবেদন অলঙ্ঘনীয়। আমার মনে হয় সব ধরনের নাট্যদলেরই মনের গোপন কোনায় একবার অন্তত রক্তকরবী মঞ্চস্থ করবার ইচ্ছেটা সদাই জাগ্রত থাকে……একদিন না হয় একদিন……।

তাই এই হায়দ্রাবাদে বসেই এখানকার রবীন্দ্রভারতীতেই আমরা পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত নাট্যদলের “রক্তকরবী” প্রযোজনা দেখতে পাই। নাটকের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধতা থাকলে একটি অখ্যাত নাট্যদল সুদূর পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত মফস্বল শহর থেকে রক্তকরবী নাটকটি মঞ্চস্থ করার সাহস নিয়ে হায়দ্রাবাদে আসতে পারে ভাবলেই আমি আশ্চর্যান্বিত হই। আরও আশ্চর্য হই যখন দেখি তারা রবীন্দ্রনাথের ওপর কলম চালিয়ে রক্তকরবীর রাজাকে তাঁরা Expose করে মঞ্চে দর্শকের সামনে উপস্থিত করেন। পরিচালকের তরফ থেকে এ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। নাটক শেষে পরিচালককে প্রশ্ন করি যে তিনি কি কোন বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা চিন্তা করে রাজাকে প্রকাশিত করেছিলেন নাকি তাঁর আর কোন চিন্তাভাবনা এর পেছনে কাজ করেছিল?

সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বলেছিলেন যুগের সাথে সাথে দর্শকের মানসিক স্থিতি বদলাতে থাকে। রাজাকে প্রচ্ছন্ন রেখে নাটকের আবেদন গত নব্বই বছর ধরে দর্শকের মনকে ক্রমাগত নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে রাজাকে প্রকাশিত করে দর্শকের দরবারে হাজির করলে নাটকটির আবেদন আরও বাড়ে না কমে।

 

(৬)

 

আমি রক্তকরবীর অনেক প্রযোজনাই দেখেছি। ছোটবড় সব দলেরই। বর্তমানে কলকাতায় একটি বড় প্রযোজনা চলছে যেখানে “নন্দিনী”র ভূমিকায় শক্তিশালী অভিনেত্রী চৈতি ঘোষাল অভিনয় করছেন। সঙ্গীত পরিচালনায় আছেন রসিদ খান। আর আছে আমজাদ আলী সাহেব আর তাঁর সুযোগ্য পুত্র আমান আলীর যন্ত্রসঙ্গীতের সুর। অত্যন্ত ভারি প্রযোজনা এবং এই প্রযোজনাতেও দেখলাম রাজা প্রকাশিত।

ভাবলে আশ্চর্য হই এই ভেবে যে আজ থেকে প্রায় দশ-বার বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্বলী নাট্যদল রক্তকরবীর রাজাকে প্রকাশিত করে যে সাহস দেখিয়েছিল আজ তার প্রভাব কলকাতার বড় দলের ওপরও এসে পড়েছে।

ছোট-বড় মিলিয়ে আজ পর্যন্ত যে কটা রক্তকরবীর প্রযোজনা দেখেছি তার প্রত্যেকটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটা বোধহয় রক্তকরবী নাটকটির একটি সামগ্রিক আবেদন। বক্তব্য, বৈপ্লবিক চিন্তাধারা, সংলাপ, মানুষের দাসত্বহীন স্বাধীন জীবন যাপনের জন্মগত অধিকার এবং অতি অবশ্যই মঞ্চ উপযোগী নাট্যসাহিত্য…এই সমস্ত কিছুর সঠিক সংমিশ্রণেই রক্তকরবীর মঞ্চায়ন চিরকালীন বলেই আমার মনে হয়।

তৃপ্তি মিত্র সম্পর্কে চৈতি দেবীর মাসি হন। চৈতি দেবীর ছোটবেলার স্মৃতিতে বহুরূপীর রক্তকরবী নাটকের মহলা আর মঞ্চায়ন ভীষণ ভাবে উপস্থিত এবং এর ফলে নাটকের নন্দিনী চরিত্রে তিনি অত্যন্ত সাবলীল।

 

অনিল মুখোপাধ্যায়ের “বাংলা থিয়েটার ও নাট্যাচার্য শিশিরকুমার” বইটার “রক্তকরবী ও শিশিকুমার” অধ্যায়টাতে দেখছি “রক্তকরবী” অভিনয় করার ভার রবীন্দ্রনাথ শিশির ভাদুড়িকে দিয়েছিলেন। যে-সব কারণে শিশিরবাবু নাটকটি মঞ্চস্থ করতে পারেননি, তার মধ্যে প্রধান ছিল তখনকার শিশির-সম্প্রদায়ে নন্দিনী করার মতো কোনও অভিনেত্রীকে নাট্যাচার্যের পছন্দ ছিল না। “রক্তকরবী” না করার দুঃখ তাঁর আজীবন ছিল।

এখানে একটা বিতর্কিত বিষয় আছে, শিশিরবাবু নাকি “রক্তকরবী” নাটকটিকে একটি “হাফ ফিলজফি-হাফ থিওলজি-হাফ পলিটিক্স” রচনা বলে মনে করতেন এবং সেই কারনেই নাকি শম্ভু মিত্রকে এই নাটকটি করতে বারণ করেছিলেন। “বহুরূপী” নাট্যসংস্থার কোন একটি ক্রোড় পত্রে এই বিতর্কিত বিষয়টির দেখা মেলে। সত্যি-মিথ্যে যাই হোক, তবে ভাগ্যিস শম্ভু মিত্র শিশির ভাদুড়ীর উপদেশ শোনেন নি!

রক্তকরবীর আর একটি প্রযোজনার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

স্বাধীনতা উত্তর-পূর্ব কালে দু-দুবার জর্জ বিশ্বাস মানে দেবব্রত বিশ্বাস রক্তকরবী অভিনয় করেছিলেন। সে সময়ে কালিকা সিনেমা হলে “রক্তকরবী” মঞ্চস্থ হয়েছিল। পরিচালনা জর্জের আর সেই সঙ্গে বিশুপাগলের চরিত্রে অভিনয় করলেন জর্জ। ১৯৪৭-এর শেষের দিকে শ্রীরঙ্গমেও অভিনয় হলো রক্তকরবী শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় এবং সেখানেও জর্জ বিশু। নেপথ্যে থেকে শম্ভু মিত্র রাজার ভুমিকাটি পড়লেন। শ্রীরঙ্গমে নন্দিণীর ভূমিকায় কণিকা মজুমদার ছিলেন। তৃপ্তি মিত্র অভিনয় করেছিলেন চন্দ্রা’র ভূমিকায় আর সর্দার-এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রতি দায়বদ্ধতা হিসেবে রাজা কিন্তু মঞ্চে অপ্রকাশিতই থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কপি রাইটের সমাপ্তি ঘটে ২০০১ সাল নাগাদ। আর তারপর থেকেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ওপরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পান পরিচালকেরা।

এরপরেও বহুরূপী যখন “ছেঁড়াতার” করেছে, জর্জ তখন মহিমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। অভিনয় করতে করতে উদাত্ত কন্ঠে গান গাইতেন জর্জ। রবীন্দ্রনাথের গান জর্জের গলায় হয়ে উঠত গণসঙ্গীত। দেবব্রত বিশ্বাসের এই দিকটি আমার কাছে অপরিচিত ছিল। JU Alumni-কে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ সুশান্তকে। ওদের জন্যই কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এই সব তথ্যের সন্ধান পাই।

 

যাইহোক আবার বাংলা নাটকের পট পরিবর্তনে ফিরে আসা যাক।

আস্তে আস্তে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পোস্ট রবীন্দ্রযুগে আমরা নাট্য জগতে দেখলাম এক রেনেসাঁ। ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (IPTA) তৈরি হবার পরে দেশের নাটকের চরিত্রেরই বদল ঘটে গেল। সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। এরপর আমরা দেখতে পেলাম সমগ্র পৃথিবীর উচ্চতম পর্যায়ের নাটকের অনুবাদ আমাদের দেশে সফল ভাবে মঞ্চে পরিবেশিত হতে থাকল। বাঙালি দর্শক ব্রেখট, কামু, কাফকা, আর্থার মিলার, গোর্কি, পিরানদেল্লো, পিটার টার্সন এবং অতি অবশ্যই শেক্সপিয়ারসহ বহু বড় বড় নাট্যকারের সৃষ্টির স্বাদ পেতে লাগল। এছাড়া আরও অনেক নামও আছে। স্থানাভাবে উহ্য রাখতে হচ্ছে।

 

(৭)

 

এইসব নাটককে ঠিক অনুবাদ না বলে রূপান্তরিত বলা বোধহয় ঠিক। কেননা এইসব নাটকের সব গল্প আর চরিত্রই আমাদের দেশে হাজির আছে শুধু তাকে আমরা দেখি বিলিতি আয়নার মাধ্যমে।

এই প্রসঙ্গে ব্রেখটের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে।

“নাটক হলো স্বচ্ছ্ব আয়নার মতো যাতে নীল আকাশের সাথে সমাজের খানাখন্দও চোখে পড়ে। এখন আপনি আকাশ, ফুল দেখবেন, না খানাখন্দ দেখবেন কিম্বা দেখে চোখ সরিয়ে অন্য পথে যাবেন বা খানাখন্দের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতৃপক্ষকে দোষ দেবেন অথবা আয়নাকেই গালাগাল দেবেন, সেটা আপনার রুচি। আয়না কিন্তু সত্যের প্রতিবিম্বই দেখাবে”।

আমাদের বাংলা নাট্য জগতেও এই চিন্তাধারার আঁচ এসে লাগলো।

 

এরপর IPTA ভেঙে গেলে আমরা পশ্চিমবঙ্গের নাট্যজগতে এক নতুন জোয়ার দেখতে পেলাম। গ্রুপ থিয়েটার নামে স্বাধীনতার পরর্বর্তী পর্যায়ে অপেশাদারি নাট্যদল তৈরির একটা চিন্তাধারা নাট্য প্রযোজনার জগতের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল বলা যায় এক অদৃষ্টপূর্ব নাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে।

স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব আমরা এই নাট্যআন্দোলনের দেখতে শুরু করলাম। সামাজিক সচেতনাতা বাড়াবার জন্য Have and Have-Nots-দের শ্রেণীভাগ মুছে দেবার মন্ত্রে দীক্ষা নেবার আহ্বানকে জোরদার করতে এই নতুন নাট্যকর্মীরা একের পর এক সাড়া জাগানো নাটক মঞ্চস্থ করতে লাগলেন। এনাদের মধ্যে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, অহীন্দ্র চৌধুরী, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, কুমার রায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস ভট্টাচার্য এবং ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর আমরা পাই অরুণ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, ঊষা গাংগুলি, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, মনোজ মিত্র, অশোক মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু, কৌশিক সেন, শাঁওলি মিত্র, কেয়া চক্রবর্তী, মণীষ মিত্র, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পৌলমী সেনগুপ্ত, গৌতম হালদার, দেবশঙ্কর হালদার এবং আরও অনেকে (নাট্য জগতের সমস্ত মহান ব্যক্তিত্বদের নাম একত্রে স্মরণ করতে না পারার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত।) নিজ-নিজ গ্রুপ থিয়েটার দল প্রতিষ্ঠা করে অথবা এইসব গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করে বাংলা নাটকে শুধু যে তাঁদের প্রভূত অবদান রেখে গিয়েছেন তাই নয়, এখনও রেখে চলেছেন। বাংলা নাটক বর্তমানে তার বিশাল ঐতিহ্য স্মরণ করে যে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

 

১৯৪৩ সালে বিজন ভট্টাচার্যের লেখা “নবান্ন” অভিনীত হয় শম্ভু মিত্রের পরিচালনায়। সেই শুরু। সেই নাটক দিয়েই গ্রুপ থিয়েটারের জয়যাত্রা শুরু হয় বলা যেতে পারে।

১৯৪৭ সালে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, কুমার রায়, অহীন্দ্র চৌধুরীসহ আরও কয়েকজনের দল “বহুরূপী’ প্রতিষ্ঠীত হয়।

রবীন্দ্রনাথের অনেক সৃষ্টিকে যেমন রক্তকরবী, চার অধ্যায়, বিসর্জন, ঘরে বাইরে, ডাকঘর – এঁরা নাট্যরূপে মঞ্চে এনেছেন। এছাড়া গালিলিও, পুতুল খেলা, রাজা অয়দিপাউস, রাজদর্শন, কিনু কাহারের থিয়েটার অত্যন্ত সুখ্যাত। এমনকি বহুরূপীর হালের “নালন্দা” প্রযোজনাটিও উচ্চ প্রশংসিত।

 

এরপর ১৯৪৯ সালে আমরা পাই উৎপল দত্তকে। বাংলা নাট্যমঞ্চে উৎপল দত্ত একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে নট, নাট্যকার, পরিচালক, সংগঠক এবং এক প্রতিবাদী চরিত্র। তাঁর “লিটল থিয়েটার গ্রুপ” একের পর এক বৈপ্লবিক নাটক মঞ্চস্থ করতে থাকে। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ইংরেজি পড়াতেন তিনি আর ছিল নাটক অন্ত প্রাণ। ১৯৪৭ সালে শেক্সপিয়ারিয়ানস নামক দল গঠন করে তিনি রিচার্ড – থ্রীতে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁর সেই অভিনয় দেখে জিওফ্রে কেন্ডেল আর লরা কেন্ডেল (আমাদের পরিচিত শশী কাপুরের স্বর্গতা স্ত্রী জেনিফার কেন্ডলের বাবা-মা) এত মুগ্ধ হন যে ওনাদের “শেক্সপিয়ারিনা” নাটকের দলে উৎপল দত্তকে সঙ্গে নিয়ে দু-বছর ধরে সারা ভারত-পাকিস্তান জুড়ে অভিনয় করে বেড়ান। এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে উনি ব্রেখট সোসাইটি তৈরি করেন আর তার সভাপতি ছিলেন সত্যজিৎ রায়।

উৎপল দত্ত সম্পর্কে আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তবে পাঠকদের কাছে কয়েকটি কথা শেয়ার করে নেওয়া যেতে পারে। IPTA-এর একজন Founder Member ছিলেন তিনি। আবার গণনাট্য সঙ্ঘেরও একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এককথায় বলা যায় বাংলার গ্রুপ থিয়েটার মুভমেন্টের প্রাণপুরুষ ছিলেন উৎপল দত্ত।

 

 

 

(৮)

 

উৎপল দত্তের “লিটল থিয়েটার গ্রুপ”(LTG) হচ্ছে প্রথম একটি গ্রুপ থিয়েটার দল যারা প্রথম একটি নাট্যমঞ্চ লিজ নিয়ে সেখানে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। উৎপল দত্তের “অঙ্গার” নাটকটি দিয়ে মিনার্ভা থিয়েটার হলে ১৯৫৯ সালে “লিটল থিয়েটার গ্রুপ” দলটির নিয়মিত অভিনয় যাত্রা শুরু হয়। গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাসে এটা একটা বড় কৃতিত্ব। এরপর ১৯৬৫ সালে উৎপল দত্তের “কল্লোল” নাটক মঞ্চস্থ হয় বিখ্যাত ভারতীয় নৌসেনা বিদ্রোহের ওপর।

তারপর ১৯৬৮ সালে “লিটল থিয়েটার গ্রুপ” ভেঙে তৈরি হয় “পিপলস লিটল থিয়েটার” (PLT) দল। এই সময়ে উৎপল দত্ত তাঁর “জনতার আফিম” নাটকে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলার মুলে কষাঘাত করেছিলেন। ভাবলে আশ্চর্য লাগে আজকের দিনেও ধর্ম নিয়ে রাজনীতির সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।

উৎপল দত্তই হচ্ছেন একমাত্র অভিনেতা যিনি প্যারালাল থিয়েটার ও আর্ট সিনেমা এবং কমার্র্শিয়াল হিন্দি-বাংলা সিনেমা জগতে একত্রে সফলতার স্বাদ পেয়েছেন। এটা ওনার একটা বিরাট কৃতিত্ব। প্যারালাল থিয়েটার আর আর্ট সিনেমা জগতের মানুষ মানেই যে কমার্র্শিয়াল জগতকে হীন দৃষ্টিতে দেখতে হবে সেটা তিনি ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন।

 

তারপর ১৯৬০ সালে নান্দীকার জন্ম নেয়। নান্দীকার মানে হলো গিয়ে “শুভ প্রারম্ভ”। অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ, কেয়া চক্রবর্তী, বিভাস চক্রবর্তী, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে এই দলটির Founder members. এই দলটির লোগোটি তৈরি করেন সত্যজিৎ রায়। “নান্দীকার” আর “নন্দন” এই দুই লোগোতেই সত্যজিতের নিজস্বতা লক্ষণীয়।

১৯৭০ সালে অজিতেশ এবং অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় নান্দীকার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও নান্দীকারের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। নান্দীকারের ঝুলিতে বহু বিদেশী নাটকের রূপান্তরিত সংস্করণ মঞ্চস্থ করার সুখ্যাতি আছে। তার মধ্যে “নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র” (মূল নাটক – পিরানদেল্লো), ফুটবল (মুল নাটক-পিটার টার্সন), শেষ সাক্ষাৎকার (মুল নাটক – ভ্লাদলেন দোজরতসেভ), ফেরিওয়ালার মৃত্যু ও গোত্রহীন (মূল নাটক-আর্থার মিলার) অত্যন্ত নামী-দামী প্রযোজনা।

বিভিন্ন সময়ের দর্শকদের চাহিদা পুরনের জন্য “ফুটবল” নাটকটি নান্দীকার তিন-তিনবার উপস্থাপিত করে। প্রথম ১৯৭৭ সালে মঞ্চস্থ হবার পর আশির দশকের মধ্যভাগে আর একবার এবং ২০০১ সালে তৃতীয়বারের জন্য “ফুটবল” আবার মঞ্চস্থ হয়। “পাঞ্চজন্য” নান্দীকারের বর্তমান কালের নতুন নাটক। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলার মাঝে দাঁড়িয়ে গান্ধারী অভিযোগের আঙুল তুলেছেন কৃষ্ণের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের দিকে।

প্রথমদিকের নাটকগুলোর মধ্যে নান্দীকারের “তিন পয়সার পালা” দর্শকদের মনে চিরকালের জন্য ছাপ রেখে দিয়েছে। “তিন পয়সার পালা” নাটকটির মূল রচনাটি নিয়ে একটা ধারনা নাট্যমোদী দর্শকদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে জার্মান নাট্যকার ব্রেখট সাহেব নাকি এই নাটকটি রচনা করেছিলেন। আসলে এটি ১৭২৮ সালে জন গে নামক এক নাট্যকার এটি রচনা করেন এবং নাটকটি “দ্য বেগারস’ অপেরা” নামে প্রচলিত ছিল। ব্রেখটের সেক্রেটারি কোত্থেকে জানি এই নাটকটাকে পেয়ে সেটাকে জার্মানিতে অনুবাদ করে ফেলেন।

যে নাটক ছিল আভিজাত্যতার বিরুদ্ধে, ব্রেখট সেটাকে রাজনীতির অন্ধকার দিকগুলোর দিকে নিশানা বদল করে দেন। জার্মানিতে ১৯২৮ সালে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পাবার পর হিটলার সেটাকে বন্ধ করে দেন। বছরখানেক কি বছর দেড়েক আগে অঞ্জন দত্ত “তিন পেনি অপেরা’ নাম দিয়ে এই নাটকটি আবার কলকাতার দর্শকদের কাছে হাজির করেন।নান্দীকারের “তিন পয়সার পালা” আর অঞ্জনের “তিন পেনি অপেরা”র  মধ্যে পার্থক্যটা হলো গিয়ে মূল নাটকটার   না-দেশীয়করন। নান্দীকার মুল নাটকটির ভাবান্তর করে দেশজকরন করেছিল সেখানে অঞ্জন এক্কেবারে বিলিতি ঢঙে নাটকটিকে লন্ডনের প্রেক্ষাপটে হুবহু বাঙলাতে অনুবাদ করে দিয়েছেন। এটাই ছিল অঞ্জন দত্তের “তিন পেনি অপেরা’র বৈশিষ্ট।

 

বর্তমান বাংলা নাটক জগতে প্রচুর ভালো ভালো প্রযোজনা নাটকপ্রেমী বাঙালি দর্শককে যেমন আনন্দ দিয়ে চলেছে তেমনি ভাবাচ্ছেও। এরই সঙ্গে পুরোনো প্রযোজনা নতুন আঙ্গিকে দেখা হচ্ছে।

সময়ের সাথে সাথে নাটকের বিষয়, উপস্থাপনা এবং অভিনয়েরও চরিত্র বদল হয়েছে প্রচুর। এই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্য সম্পন্ন নাটকের পরিবর্তে নাট্যমঞ্চে এখন একটা অন্য ধরনের জোয়ার এসেছে বলেই আমার যেন মনে হয়। পৃথিবীব্যাপী উপভোক্তা সর্বস্ব অর্থনিতীর প্রভাব যেন নাট্য জগতেও এসে পড়েছে। দর্শকদের কাছে ভ্যালু ফর দেয়ার মানি জাতীয় বিনোদনের মূল্য এখন সর্বোচ্চ।

 

(৯)

 

তবে এখনও বেশ কিছু ছোট, বড় এবং মাঝারি দল তাদের বলিষ্ঠ সামাজিক বক্তব্য নিয়ে এখনও নাট্য প্রযোজনা করে চলেছেন স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কাটার সমস্ত পরিশ্রম নিয়ে।

তাই এখন বাংলা নাটক জগৎ এখন আর শুধু কলকাতার নামী দামী গ্রুপ থিয়েটার-এর দলগুলোর দ্বারা প্রভাবিত নয়। বাঙলার নাট্যমোদী দর্শকদের কাছে কলকাতার ছোট আর মাঝারি দল যেমন আগ্রহ সৃষ্টি করে তেমনই মফস্বল আর গ্রাম বাঙলার থিয়েটার গ্রুপগুলোও সমান ভাবে বাঙলার নাটকপ্রেমী দর্শকদের আনন্দ দিয়ে চলেছে। কিন্তু আর্থিক অনিশ্চয়তা এইসব ছোট আর মাঝারি দলগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে কেননা পেটের তাগিদে দলের সদস্যদের অনেকেরই আনুগত্যের অভাব ঘটে বড়দল, সিনেমা আর টিভি সিরিয়ালের হাতছানির কাছে।

 

এই প্রসঙ্গে সায়ক নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার মেঘনাদ ভট্টাচার্য মাহাশয়ের কয়েকটি কথা স্মরণ করতে পারি।

“There is a tremendous inequality among groups. Some get hyped by media while some donot. Many actors & technicians work as freelancers working for several plays at the same time which dilute the quality of their work that impacts on the final performance. Some have become stars & have strong audience pull.

Big groups also enjoy media hype & spend on marketing & promotion. As a consequence, small & very good theatre groups are destroyed just when they are beginning.”

 

How very true it is!!!!

 

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শোনাই।

বছর কয়েক আগে একটি ছোট দলের প্রযোজনা “হেলমেট” নামক একটি নাটক দেখতে গেছিলাম কোন একটা ছোট হলে। বেশ ভাল লেগেছিল নাটকটি। দর্শক সংখ্যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শ’আড়াই হবে হয়তো।

নাটক শেষে নাটকের কর্ণধার এই দলের পরবর্তি শো অ্যাকাডেমি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বলে উপস্থিত দর্শকদের জানান। অনুষ্ঠানের তারিখও জানালেন সকলকে। তারপর হাতজোর করে উপস্থিত সমস্ত দর্শককে অনুরোধ করলেন যে তাঁরা যেন তাঁদের সকল বন্ধুবান্ধবদের এই নাটকের পরবর্তি শো-এর কথা জানিয়ে দেন। ছোট দল বলে ওনাদের পক্ষে বিজ্ঞাপনের খরচ বহন করা দুঃসাধ্য। অনেক তদ্বির-তদারক করে এবার অ্যাকাডেমি মঞ্চটি জোগাড় করতে পেরেছেন। তাই অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে এই অন্যায় অনুরোধটি সবার কাছে করছেন।

চোখে জল এনে দেবার মতো একটি ঘটনা। নাটকের জন্য কতটা ভালবাসা থাকলে এই ভাবে একটি নাট্যদলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ভাবলেই আশ্চর্য হতে হয়।

 

১৯৭৩ সালে বাংলা নাট্যজগতে “সায়ক” নাট্যদলের আত্মপ্রকাশ। অভিধানে দেখছি সায়ক কথাটির অর্থ “বাণ”, “খড়্গ”, “ব্জ্র”। “সায়ক” নাট্টগোষ্ঠীর কর্ণধার মেঘনাদ ভট্টাচার্য আমাদের বহু ভালো নাটক উপহার দিয়েছেন। সামাজিক বহু অনিয়মের বিরুদ্ধে সায়কের খড়্গ ঝলসে উঠেছে বারে বারে তাদের প্রযোজিত নাটকের মাধ্যমে।

এই হায়দ্রাবাদেই বেশ কয়েকবার অভিনয় করে গেছেন তিনি। আমি যে বছর হায়দ্রাবাদে আসি সেই ২০০১ সালেই সায়ক তার সিগনেচার নাটক “দায়বদ্ধ” আর “কর্ণাবতী” নাটক মঞ্চস্থ করে গেছে। এরপর সায়ক আবার এসেছে হায়দ্রাবাদে তাদের “পিঙ্কি বুলি” নাটক মঞ্চস্থ করতে। ২০০৪ সালে বাংলা নাট্য জগতের খ্যাতনাম অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত সায়ক-এর “সাঁজবেলা” নাটকে শ্রীময়ী’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মেঘনাদ-স্বাতীলেখা’র মনকাড়া দ্বৈত অভিনয় বহু নাট্যমোদীর স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল।

মেঘনাদের একটা লেখাতে একটা দামি বিষয় নজরে এলো।

পপকর্ণ মুভি কালচারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা নাটক পরিবেশনায় অনেক বিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নাটক প্রযোজনার খরচ এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ-খরচা এবং হল ভাড়া খরচ ধরে বর্তমানে যে অঙ্কটি দাঁড়ায় সেটা উদ্ধার করতে গেলে যে হারে প্রবেশ মূল্য ধার্য করতে হয় সেটা বেশীরভাগ সময়েই সাধারন নাট্যমোদী দর্শকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এর ফলে বাংলা নাটকের যেটা প্রধান ভিত সেই সাধারন ইন্টেলেকচুয়াল আমজনতা, তাদের বাংলা নাটক দেখার সাধ থাকলেও সেই সাধ অনেক সময়েই তাদের সাধ্যের বাইরে চলে যায়।

এর ফলে বাংলা নাটক বিতর্কিত মননশীল বিষয় থেকে দূরে সরে গিয়ে পপকর্ণ মুভি গোয়ার’সদের টেনে আনার জন্য তাদের প্রিয় বিষয় বেশিরভাগ নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

এটা কিন্তু বাংলা নাটক জগতের পক্ষে একটা অশনি সংকেত।

 

 

(১০)

 

এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথাটা লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে।

হায়দ্রাবাদে একবার গৌতম হালদারের “মেঘনাদবধ কাব্য” এসেছিল। একটা নাটক দলকে কলকাতা থেকে নিয়ে এসে তাদের থাকা-খাওয়ার সমস্ত খরচ-খরচা বহন করে, হল এবং আনুষঙ্গিক লাইট, মাইক, ষ্টেজ ক্রাফট ইত্যাদি সব খরচ ধরে এবং তারপর আয়োজিত ক্লাবের তরফ থেকে ভর্তুকি বহন করেও নাটকের প্রবেশ মূল্য বেশ যথেষ্ট বলেই সাধারন নাট্যমোদীদের মনে হয়ে থাকে।

একদা প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে “মেঘনাদবধ কাব্য”-র পোষ্টার গাড়িতে লাগিয়ে ঘোরার সময় আমি মাধাপুরে একজন  সাধারন “নাটক ভালবাসি” দৈনিক শ্রমিক মানুষের সংস্পর্শে আসি যাঁর বাংলা নাটক জ্ঞান দেখে আমি স্তম্ভিত হই।

২০১০ সালে গৌতম হালদার নান্দীকার ছেড়ে “৯-এ নাটুয়া” নামে নিজস্ব নাট্যদল তৈরি করেছেন। সেই দলের পক্ষ থেকে গৌতম হায়দ্রাবাদ এসেছিলেন “মেঘনাদবধ কাব্য” মঞ্চস্থ করতে।

মাধাপুরের একটি সাইটের দৈনিক শ্রমিক মেদিনীপুর নিবাসী প্রকাশ গড়াই মহাশয় আমার গাড়িতে বাংলা নাটকের পোষ্টার দেখে নিজে থেকে এগিয়ে এসে আমার সাথে আলাপ করেছিলেন নাটকটির ব্যাপারে। উনি নাটকটি ১৯৯৫ সালে কলকাতায় দেখেছিলেন যখন গৌতম নান্দীকারে অভিনয় করতেন।

ওনার সাথে নাটক নিয়ে কথা বলার সময় বুঝতে পারলাম কি অসাধারন নাটকপ্রেমী এই প্রকাশ গড়াই।

দুঃখের বিষয় ব্যক্তিগত কারণে ওনার পক্ষে আর হায়দ্রাবাদে “মেঘনাদ বধ কাব্য” আর দেখা হয়ে ওঠেনি। প্রকাশ গড়াইয়ের অনুপস্থিতির জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলাম।

 

মেঘনাদবাবু বাংলা নাটকের এই মননশীল নাট্যমোদী দর্শকদের কথাই বলতে চেয়েছেন। বর্তমানে বাংলা নাটকের দর্শণী অত্যধিক বৃদ্ধি হবার ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত নাট্যমোদী দর্শক যদি নাটক দেখা থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন তবে  আখেরে কিন্তু বাংলা নাটক জগতেরই ক্ষতি। শুধুমাত্র বিনোদনের সন্ধানে বাংলা নাটকের প্রেক্ষাগৃহ উচ্চবিত্ত বাঙালি দর্শকে ভরে উঠতে থাকবে সেটা যেমন কোনো ভাবেই বাঙালি বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের কাছে কাম্য নয় তেমনি সেটা কোনো নাট্যদলই মেনে নিতে পারবে না।

এই অর্থনৈতিক চাপের প্রভাবে যে সকল বাংলা নাটক মানুষকে ভাবায়, কাঁদায়, সমাজের সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার ইন্ধন যোগায়, আস্তে আস্তে সেই সকল নাটকের উত্তাপ কমতে শুরু করবে। আর যাঁরা গাঁটের কড়ি খরচ করে উচ্চ মূল্যের দর্শণী দিয়ে শুধুমাত্র আমোদিত হতে চান, তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী আর তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য বাংলা নাটক যদি শুধুমাত্র বিনোদনের অঙ্গ হয়ে উঠতে চায় তবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলা নাটক  তার নিজস্ব গতিময়তা হারিয়ে ফেলবে। এই অশনি সঙ্কেতের কথাই মেঘনাদবাবু আমাদের আকারে ইঙ্গিতে আমাদের শুনিয়েছেন।

 

এই স্বল্প পরিসরে সমস্ত নাট্য ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। তাই বাংলা নাটক নিয়ে অনেক আলোচনার বিষয় থাকলেও এই রচনাটির কলেবর বৃদ্ধির প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকাই ভাল।

তবু আরও কয়েকটি কথা, ঘটনা না লিখলেই নয়। পাঠককূলের ধৈর্যচ্যুতি’র জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

 

বাদল সরকারকে নিয়ে একটা ঘটনা পাঠকদের সাথে শেয়ার করা যাক।

গল্পটা বলেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল মশাই। বাদল সরকার আর নারায়ন সান্যাল এই দু-জন বিখ্যাত মানুষই আমাদের কলেজের প্রাক্তন ছাত্র।

কলেজে ছাত্রাবস্থায় নারায়ণ সান্যাল সাহিত্য চর্চার সাথে সাথে নাট্যচর্চাও করতেন। একবার কলেজে কোনো এক উৎসবে নিজেই নাটক লিখে উৎসাহী বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে মহলা দেওয়া শুরু করে দেন। নাটকের দিন এগিয়ে আসছে। মহলা জোরদার চলছে। এমন সময়ে সাধারন দেখতে এক জুনিয়র ছাত্র এসে নারায়ণ সান্যাল মশাইকে ধরে বসল যে সে তাঁর নাটকে অভিনয় করবে।

যাইহোক ছেলেটির উৎসাহ দেখে শেষমেশ নারায়ণ সান্যাল রাজী হয়ে ওকে একদিন মহলায় আসতে বলেন। ছেলেটি উপস্থিত হলে তিনি তাকে নাটকের এক চরিত্রের একটি ছোট্ট পার্ট অভিনয় করে দেখাতে বলেন। ছেলেটির অভিনয় ক্ষমতা দেখে নারায়ণ সান্যাল যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলে বসেন যে তার দ্বারা আর যাইহোক অভিনয় হবে না।

 

 

(১১)

 

এরপর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে।

নারায়ণ সান্যাল জীবনে নামী সাহিত্যক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এরকম এক সময়ে কলকাতার এক মঞ্চে নাটক দেখে খুশী হয়ে নাটক শেষে অভিনেতার প্রশংসা করতে গিয়ে জানতে পারলেন যে অভিনেতার নাম বাদল সরকার আর এই সেই অভিনেতা যাঁর অভিনয় ক্ষমতা সম্পর্কে একদা তিনি সন্দিহান ছিলেন!

বাদল সরকার তখন বাংলা নাট্য জগতে এক উজ্জ্বল জোতিষ্ক। তাঁর রচিত নাটক “বল্লভপুরের রূপকথা”, “সারারাত্রি”, “পাগলা ঘোড়া”, “এবং ইন্দ্রজিৎ” ইত্যাদি সব কালজয়ী নাটক তখন বাংলা নাট্যমঞ্চ কাঁপাচ্ছে।

নারায়ন সান্যাল মশাইয়ের তখন “ধরনী দ্বিধা হও” অবস্থা।

 

বর্তমান বাংলা নাট্যজগতের আর কয়েকজনের কথা না আলোচনা করলে এই রচনাটা সম্পূর্ণ হবে না বলেই আমার মনে হয়।

এঁরা দু-জনেই স্বনামে বিখ্যাত – দেবশঙ্কর হালদার আর গৌতম হালদার। দুজনেরই মঞ্চজীবন শুরু নান্দীকার থেকে।

এই মুহুর্তে বাংলা নাট্যমঞ্চে সবচেয়ে ব্যস্ত নাম হলো দেবশঙ্কর। এক সময়ে দেবশঙ্কর অভিনীত দশটিরও বেশী নাটক এবং সিনেমা একত্রে কলকাতায় নাট্যমঞ্চে ও প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের দরবারে হাজির ছিল।

আমার নিজের চোখে দেখা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র কন্যা পৌলমী’র সাথে “ফেরা” নাটকে দুপুরের শো’য়ে অ্যাকাডেমিতে অভিনয় করে দেবশঙ্কর ছুটলেন উত্তর কলকাতার গিরীশ মঞ্চে সন্ধ্যার শো’য়ে ব্রাত্য বসুর “বোমা” নাটকে ঋষি অরবিন্দের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য।

যাবার আগে দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন নাটকের পরবর্তী পর্যায়ের দর্শকদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত না থাকতে পারার জন্য।

হায়দ্রাবাদের নাট্যপ্রেমী দর্শক দেবশঙ্কর অভিনীত যে কটি নাটকের স্বাদ পেয়েছেন তার মধ্যে “নাচনী’, “রূদ্ধ সঙ্গীত”,  “শেষ সাক্ষাৎকার” অন্যতম।

 

এরপর আসি গৌতম হালদারের কথায়।

“মেঘনাদবধ কাব্য” নাটকটি গৌতমের সিগনেচার আইটেম। এই নাটকটি একসময়ে বাংলা নাট্য জগতে ঝড় তুলে দিয়েছিল। কি অসাধারন একক অভিনয়! গৌতম বাঙালি দর্শকদের কাছে অভিনয় ক্ষমতার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে দেন। কি পরিমাণ প্যাশন থাকলে যে এই ধরনের উচ্চ মার্গের অভিনয় করা যায় সেটা গৌতম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

আমরা হায়দ্রাবাদে নান্দীকারের “শেষ সাক্ষাৎকার” নাটকে গৌতম আর দেবশঙ্করের একত্রিত অভিনয় দেখেছি। নান্দীকারের “সোজনবাদিয়ার ঘাট” নাটকেও অসাধারন অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন গৌতম।

পরবর্তী পর্যায়ে “নান্দীকার” ছেড়ে নিজের নাটকের দল “৯-এ নাটুয়া” তৈরি করেন গৌতম। এই দলের “বুদ্ধু ভুতুম” নাটকটি অসাধারন। শিশু ও কিশোরদের জন্য নাটক বড় দলের খুব কমই আছে। তারা সদাই একটা ব্যবসায়িক অ-সাফল্যতার অনিশ্চতায় ভোগে। গৌতম এই মিথটির গোড়ায় কুড়ুল মেরেছেন। পরবর্তীকালে তিনি আবার “ঠাকুরমার ঝুলি” নাটকটিও মঞ্চস্থ করেন।

গৌতমের সবচেয়ে বিতর্কিত নাটকটি হলো “হাওয়াই”।

মঞ্চনির্মান, উপস্থাপনায় নাটকটিকে “জারা হটকে” নাটকের পর্যায়ে ফেলা যায়। মুল নাটকটি বিদেশী – স্লোভানীয়ার।  Evald Flisar এর The Eleventh Planet এর রূপান্তর এই নাটক। আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে এই নাটক। সঠিক মনে করতে পারছি না তবে নাটকের এক কুশীলবের একটি ডায়ালগ দর্শককে চিরকাল ভাবাবে বলেই আমার মনে হয়। একটি রাষ্ট্র যখন তার রণকৌশলে জয়ী হয়ে অপর রাষ্ট্রের সম্পদ অধিকার করে তখন তাকে যখন হরণ করা বলা হয় না, বলা হয় “অধিকৃত”। কিন্তু একজন সাধারন তস্কর যখন তার চৌর্য শিল্পের দ্বারা কোনো সম্পদ অধিকার করে তবে তা অধিকৃত হিসেবে বিবেচিত হবে না কেন!

এইসব কারনেই এই নাটকটিকে “জারা হটকে” নাটকের গোত্রে ফেলা যায়।

 

১২/-

 

 

 

 

(১২)

 

এবার দেবশঙ্করের নিজের জবানিতে একটা গল্প শোনা যাক।

 

”তখন আমি২১, নান্দীকার-এ গেছি অডিশন দিতে। বিজ্ঞাপন দেখে পাঁচশ ছেলেমেয়ে লাইন দিয়েছে। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমি তো অভিনয়ের কিছুই জানি না। চান্স পাব না। শেষমেশ ইন্টারভিউ দিলাম। রুদ্রপ্রসাদ আর স্বাতীলেখা অনেক প্রশ্ন করলেন,আমি কিছুই জানি না,শুধু বললাম খেলাধুলা জানি আর লিটল ম্যাগাজিন করেছি। গান গাইতে বললেন। খুব বাজে গাইলাম। কোন ভীরুকে ভয় দেখাবি,আঁধার সবই মিছে। খুব রাগ হচ্ছিল ওনাদের ওপর। রেজাল্ট বেরলো। কেন দেখতে গেলাম জানি না। আশ্চর্য, আমার নাম দেখলাম লিষ্টের তলার দিকে আছে।

বেরিয়ে আসছি একজনের সঙ্গে আলাপ হল। আমারই বয়সি। শুকনো মুখ।

বললো,”আপনার হয়েছে না?

“হ্যাঁ…আপনার?“

“না হয় নি।“

“কি নাম আপনার?”

“গৌতম হালদার।“

“ভালো করে দেখেছেন?”

“না হয় নি……আমি জানি।“

“চলুন না। আর একবার দেখি…আমি দেখেছি দুজন হালদার আছে।“

‘আরে না না…জানি আমার হয় নি।“

জোর করে টেনে নিয়ে গেলাম। দেখি লিষ্টের এক নম্বর নামটা গৌতম হালদার।“”

 

Awesome বলা যায় কি?! নিঃসন্দেহে “হ্যাঁ” বলা যায়……তাই নয় কি?

 

বর্তমান নাট্য জগতের আর একজন ব্যক্তিত্বের নাম না নিলে বোধহয় বিরাট অন্যায় হয়ে যাবে। তবে উনি নাট্যমঞ্চের এবং রুপোলী পর্দার দু-দুটো তলোয়ার দুহাতে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে এখনও ঘুরিয়ে চলেছেন – তিনি হলেন আমাদের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

ওনার কবিতা, আবৃত্তি, ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তা ইত্যাদি সমস্ত কর্মকান্ডের ব্যাপ্তি ছেড়ে দিয়েও ওনার শুধু অভিনয় কুশলতাই বাঙালিকে চিরকাল বিস্মিত করে আসবে।

মঞ্চ এবং রুপোলী পর্দা – এই দুই অভিনয় জগতে সৌমিত্রবাবু নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন আর এক উচ্চতায় স্থাপন করে চলেছেন যে ভবিষ্যতে আর কোনও অভিনেতার পক্ষে বোধহয় এই দুই জগতের এই দুই উচ্চতায় একত্রে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।

এই বয়সেও সুপুরুষ সৌমিত্রবাবু যদি “রাজা লিয়র” মঞ্চস্থ করেন, তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে বাংলার নাটক পাগল দর্শক আজও রাত জেগে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়াতে প্রস্তুত।

 

সৌমিত্রবাবুর প্রথম নাটক আমি দেখি “নামজীবন”…মানিকতলার কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে। হলের Acoustic অত্যন্ত খারাপ ছিল। পেছনের দর্শক সংলাপ শুনতে পাচ্ছেন না, বিরক্ত হচ্ছে্ন। শেষমেশ মাইক বন্ধ করেই নাটক শেষ করলেন তিনি। দর্শক আর গোলমাল করেনি।

এরপর ওনার অভিনীত “নীলকণ্ঠ”, “হোমাপাখি”, তৃতীয় অঙ্ক অতএব” এবং হালের “ফেরা” নাটক দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।  এই বয়সেও উনি নিজেকে সিরিয়াস নাটকের সাথে এত গভীর ভাবে কি করে জড়িত রেখেছেন এটা ভাবলেই আশ্চর্য লাগে।

সত্যি বাংলা এবং বাঙালির গর্ব হচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

 

 

 

(১৩)

 

বাংলা নাটক জগৎ বলা যেতে পারে সতত জঙ্গম। প্রতিনিয়ত এখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। স্বদেশী, বিদেশী, মাইথলজি, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি সবরকম বিষয়বস্তু নিয়েই কোন না কোনও দল তাদের নিত্য নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে বাঙালি দর্শকদের কাছে হাজির করে চলেছেন তাঁদের নতুন নতুন নাটক।

এই রকমই একটি নাটকের নাম “উরুভঙ্গম”। মণীশ মিত্রের সারারাত্রি ব্যাপি ছ’ঘন্টার নাটক নিয়ে বাঙলার নাট্য জগতে এক নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল। মঞ্চে বিদ্যমান সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে বিশাল একটি নাট্য দলের যথেষ্ট পরিশ্রমী উপস্থাপনা। মোট চারটে ব্রেক আছে এই নাটকে এবং এই সময়ে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে দর্শকদের মধ্যে কথকথার মাধ্যমে সঙ্গীত শিল্পীসহ নাটকটি পরিবেশিত হয়। এটি একটি ব্যতিক্রমী পরিবেশনা বলা যেতে পারে।

 

এতক্ষণ ধরে বাংলা নাটকের পরিচিত বড় বড় নামি-দামী দলের আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম। এবার একটু কলকাতা সংলগ্ন এবং কলকাতার বাইরের কিছু ছোট ছোট দলের নাটকের কথা শোনা যাক। নামে এবং ওজনে এইসব দল হয়ত বড় ব্ড় দলের সাথে এক পংক্তিতে বসতে পারে না বটে কিন্তু চিন্তায় ভাবনায় পরিবেশনায় এই দলগুলি কিন্তু বড় বড় দলগুলির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে।

এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যে দলটির কথা আমার মনে আসছে সেটা হল “গোবরডাঙার নকশা”। এই দলটির “স্বপ্ন স্বদেশ” নাটকটির বক্তব্যে দেশের স্বাধীনতা বিষয়ক মূল উপলব্ধির গোড়ায় আঘাত করে।

সেইরকমই কল্যাণীর একটি দলের প্রযোজনা “খোয়াবনামা”। মঞ্চ পরিকল্পনায় যে কোন বড় দলকে এরা লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।

নিজেদের সীমিত ক্ষমতার উর্ধে উঠে এইসব দল শুধুমাত্র নাটকের প্রতি ভালবাসার দায়বদ্ধতার জন্য একের পর এক মনকাড়া নাটক নিয়ে দর্শকদের ভাবনা চিন্তাকে নাড়িয়ে দিতে হাজির হয়।

এইরকম বেশ কিছু দল আছে যারা তাদের নাটকের মাধ্যমে নাটকপ্রিয় মননশীল  দর্শককে ভাবায়, কাঁদায়, চিন্তা করতে শেখায় এবং অবশ্যই “থোড়-বড়ি-খাড়া / খাড়া-বড়ি-থোড়” ক্লিশে জীবন যাত্রার বাইরেও যে একটা সুস্থ্য সুন্দর জীবন আছে সেটা দেখতে বুঝতে সাহায্য করে।

এইরকমই কয়েকটি মফস্বলী দল হল “কৃষ্ণনগর সিঞ্চন”, “সমতট সংস্কৃতি – উত্তরপাড়া”, “রঙ্গপীঠ-শান্তিপুর”, “সপ্তর্ষি-বহরমপুর”।

এদের মধ্যে “সপ্তর্ষি-বহরমপুর” বছর কয়েক আগে হায়দ্রাবাদে সিরাজদৌল্লার জীবন নিয়ে তাদের নিজেদের রচনা এবং প্রযোজনা “মতিঝিলের কান্না” পরিবেশন করে গেছেন। বহরমপুরের সৈদাবাদে এই নাট্যদলটির আঁতুড় ঘরে আমি গিয়ে মুদ্ধ হয়েছি। দেখেছি কি ভীষণ পরিমাণে উৎসর্গীত প্রাণ না হলে এই ধরনের নাট্যদলকে বাঁচিয়ে রাখা কতখানি দুরূহ। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় অসম্ভব।

এইসব নাট্যদলের নিরলস নাট্যচর্চা আছে বলেই বাংলা নাটক জগত আজও এত সমৃদ্ধ।

 

সবশেষে আমাদের হায়দ্রাবাদের একটা নাট্যদলের কথা বলে এই রচনাটিতে দাঁড়ি টানতে চাই।

সুদূর প্রবাসে হায়দ্রাবাদের বাঙালিকে সিরিয়াস নাটক-রসের স্বাদ আস্বাদন করানোর প্রচেষ্টায় “শূদ্রক-হায়দ্রাবাদ” নাট্যদল নিয়মিত কিছু বলিষ্ঠ নাটক পরিবেশন করে চলেছে। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও এই দলের কর্ণধার স্বপন আর পুলকের নিরলস প্রচেষ্টা অতি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।

এই দলটির বাংলা নাটক  “এক স্বৈরাচারী রাজার কথা”, “আজীর” এবং “সারারাত্রি” সমালোচকদের বিস্মিত করেছে। এছাড়া আরও অনেক অন্যভাষী নাটক ভারতবর্ষের দর্শকদের মনের কোনায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

এই দলটির সাথে একবার শান্তিপুরে তিনদিন ব্যাপী নাট্যউৎসবে দুদিন হাজির থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এই দেখে যে শান্তিপুরের মত একটি ছোট শহরে এত বিরাট একটা নাট্যউৎসব আয়োজন করা কি করে সম্ভব!

সারা ভারতবর্ষ থেকে কত নামীদামী নাট্যসংস্থা শান্তিপুরের এই বাৎসরিক নাট্যউৎসবে যোগ দিতে উদগ্রীব হয়ে থাকে।

সুদূর পাঞ্জাব, আহমেদাবাদ, ত্রিপুরা, NSD Reparatory-দিল্লী, কর্ণাটক, বাংলাদেশ, আসাম, উড়িষ্যা, পন্ডিচেরি থেকে শান্তিপুরের ২০১৬ সালের এই নাট্য উৎসবে হাজির হয়েছিল।

এছাড়াও ঊষা গাঙ্গুলি (অন্তর্যাত্রা), সুমন মুখোপাধ্যায় (ম্যান অফ দ্য হার্ট) এবং অশোক মুখোপাধ্যায় (কুশীলব) এর মত কলকাতার নামীদামী নাট্যব্যক্তিত্ব শান্তিপুরের এই নাট্যউৎসবে নিজেদের নাটক নিয়ে হাজির ছিলেন।

 

 

 

(১৪)

 

 

সবচেয়ে যেটা ভালো লাগল সেটা হচ্ছে ছোট্ট শহর শান্তিপুরের এই নাট্যউৎসব ঘিরে সে কি উন্মাদনা। ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-বউ সবাই যেন কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শান্তিপুরের এই নাট্যউৎসবকে সফল করার জন্য। এই নাট্যউৎসবের প্রাণপুরুষ বিশ্বজিৎবাবু ও তাঁর নাট্যদল রঙ্গপীঠ-এর আন্তরিক প্রচেষ্ঠা অতি অবশ্যই প্রশংসনীয়।

সবশেষে মনে হয় রঙ্গপীঠের মত বেশকিছু নাট্য সংস্থা আজ আমাদের পশ্চিমবাংলায় আছে বলেই বাংলা নাটক আজও তার ট্র্যাডিশন বজায় রাখতে পেরেছে।

দু হাত জোড় করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি সারা পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বজিৎবাবুরা এবং তাঁদের নাট্যদলগুলি আগামী দিনে আরও বড় হয়ে উঠুক আর বাংলা নাটকের ইতিহাস ওনাদের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক।

 

 

পরিশিষ্টঃ এই রচনায় বাংলা নাট্য জগতের একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরার অসফল প্রচেষ্টা আছে মাত্র। স্বাধীনতার পরবর্তী কালে মুলত গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন এবং সমসাময়িক বাংলা নাটকের কথা বলতে গিয়ে এই রচনাটিতে শুধুমাত্র প্যারালাল থিয়েটারের কথাই এসে গেছে। কিন্তু বাংলা নাট্য জগতে এটাই শেষ কথা নয়। এই প্যারালাল থিয়েটারের সাথে সাথে বাণিজ্যিক বহু থিয়েটারও বাংলা নাট্য জগতের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কলকাতার বাণিজ্যিক মঞ্চ ভাড়া করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে বাংলা বাণিজ্যিক নাটক দর্শকদের মনোরঞ্জন করে এসেছে। সারকারিনা, তপন থিয়েটার, ষ্টার থিয়েটার, মিনার্ভা থিয়েটারে বারবধু, নহবত, বিবর, লাগলে বলবেন, কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম  ইত্যাদি বহু নাটকের বলিষ্ঠ প্রযোজনা আমরা দেখেছি। সুপ্রিয়া / সাবিত্রী / তরুণ কুমার / ভানু / জহর / বিকাশ রায় / উত্তম কুমার / অনুপ কুমার / রবি ঘোষ / চিন্ময় রায়   এবং বাঙালী চলচিত্র জগতের আরও অনেক নামীদামী অভিনেতা-অভিনেত্রী বাংলা বাণিজ্যিক নাটক জগতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে সময় সুযোগ হলে মিস শেফালি, মিস জে সহ সকল নৃত্যশিল্পীদের অগ্নিময় উপস্থিতি এবং বাণিজ্যিক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় নিয়ে আরও কিছু লেখার।

 

বাকি থেকে গেল বাংলা থিয়েটারের গান। এটা বলা যেতে পারে বাংলা সাঙিস্কৃতিক জগতে একটা আনমোল রতন। এটা আমার সামর্থের বাইরে। বাংলা নাটকের এই দিকটা নিয়ে যদি কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তি কলম ধরেন তো হায়দ্রাবাদের সকল বাঙালিই উপকৃত হবেন।  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের গলায় তাঁর “নীলকন্ঠ” নাটকে গান গেয়েছিলেন বছর ত্রিশ(+) আগে। সেই নাটক দেখার সৌভাগ্য এই অধমের হয়েছিল।

খুনী

নির্মাল্য সেনগুপ্ত

আমার প্রাক্তণ প্রেমিকার মা আমাকে দেখলেই রেগে যেতেন। বলতেন, এই ছেলেটার মধ্যে একটা ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল ছাপ আছে। চোয়াল দেখেই বোঝা যায় অপরাধী। প্রাক্তণ প্রেমিকার বাবা বলতেন, ও চাইলেই খুন করে ফেলতে পারে কাউকে।

তাঁরা ভুল বলতেননা। আমি সেই জন্মানোর কিছুদিন পর থেকেই পরিবারের দুজন সদস্যকে খুন করার কথা ভেবে চলেছি। একজন আমার বাবা, অন্যজন দাদু।

 

বোধ হওয়ার পর থেকেই ওই শশ্রুগুম্ফধারী ভদ্রলোককে আমার মোটেই পোষায়নি। হাতে পায়ে প্রচণ্ড শক্ত, মায়ের সাথে ঝগড়া করে, প্রচণ্ড জোরে চেঁচায়, একগাদা ভাত খায় আর ঘুমের সময় নাক ডাকে। মাঝে মাঝে আমাকে কাঁধের উপর তুলে রাস্তায় ঘুরতে বেরোলে মন্দ লাগতনা যদিও, কিন্তু সেই একমাত্র ভাললাগার বিষয়টাতেও প্রায়ই ফাঁকি দিত লোকটা। এই লোকটি কেন আমার বাড়িতে থাকছে এবং কেন আমার আর আমার মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে আমি বুঝতামইনা। কিন্তু প্রতিবাদ করার মত ক্ষমতা তখনও আসেনি গলায়, অগত্যা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা।
এরপর যেই আমার বয়স আরেকটু বাড়ল, আমি বুঝতে পারলাম আই ওয়াজ ড্যাম রাইট। লোকটা প্রচণ্ড খারাপ। আমার উপর অত্যাচার প্রথম শুরু হল সেটা সন ১৯৯৩। ভোর ছটায় ঘুম থেকে তুলে একটা বাড়িতে নিয়ে গেল যেখানে আমার মতই আরও প্রচুর ভিক্টিম এবং এই লোকটার মতনই অনেকগুলো খারাপ লোক অত্যাচার করছে। সেকি কষ্টকর! গাদাগাদা বই এনে পড়াচ্ছে, না পারলে মারধোর করছে। কয়েকটা মায়ের মতন নরম জিনিস ছিল, ভেবেছিলাম এরা আমার ক্যাম্পের হবে। ও হরি, এগুলোও সঙ্গদোষে নষ্ট হয়েছে দেখি! এরাও একই কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এতেই শেষ নেই! সেখান থেকে বিকেলবেলা ফেরার পর রাত হতেই ওই ভদ্রলোক আবার একপ্রস্থ অত্যাচার শুরু করে দিল। ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমি আবার কাঁদি টাদিনা। ভ্রূকুঞ্চিত করে সহ্য করি সব। দেখি কত নীচে নামতে পারে।
আমি প্রথমে যেই বাড়িতে থাকতাম, তার পিছনে ছিল একটা খাল। নোংরা জলে ভর্তি, অজস্র পোকা মাকড়। এই লোকটা আমাকে প্রচুরবার তখন থ্রেট দিয়েছে পড়াশুনা না করলে আর যা যা করতে বারণ করা হয়েছে সেগুলো করলে ওই খালে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আমি পাত্তা দিইনি। এরপর যখন নতুন আরেকটা বাড়িতে আসলাম, দেখি ঘরের পিছনদিকেই একটা মরে যাওয়া পুকুর। প্রচুর গাছপালা আর জঙ্গলে ভরা। বিভিন্ন রঙের পাখি এসে বসে থাকে গাছের ডালে।অজস্র বিষধর সাপ কিলবিল করে ঘুরে বেড়ায়, কচুরীপানার উপর মেঘের ছায়া পড়ে, আর একদম মধ্যিখানে কিছুটা জল এখনও থেকে গেছে। সন্ধ্যের সময় লাল রঙের সূর্য্যের অবয়ব সেই জলে প্রতিফলিত হলে অবিকল ডিমের পোচের মত দেখায়।

 

এই সব প্রাকৃতিক সৌর্ন্দর্য্যে মজে গিয়ে যেই আমি বড় হয়ে কবি টবি হওয়া যায় কিনা ভাবছি, অমনি ওই ভদ্রলোক এলেন এবং ফতোয়া জারি করলেন যে খালটা ক্যানসেল হয়েছিল বেশ কিছুটা দূর বলে। পুকুরটা ঘরের পিছনেই। একটা দরজা খোলার অপেক্ষা। কিছু করেছি কী সেখানে ফেলে দেবে আমায় এবং এবার তিনি পুরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যেন জীবনে আর কিছু কাজ নেই, আমাকে পুকুর, খাল ইত্যাদিতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া।

 

এত দূর অবধি ঠিক ছিল, বাড়াবাড়িটা হল সেদিন।
আমি দোতলার একটা ছেলেকে কোনও এক লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিতে মারধোর করেছি। অতি সামান্য ব্যাপার, ইগনোর করাই যেত। কিন্তু তিনি মানলেননা। দরজাটা খুলে আমাকে হাফ বাইরে ছুঁড়ে শেষ মূহুর্তে টেনে নিয়ে এসে বললেন, “এবারের মতন ছেড়ে দিলাম। আর যদি কখনও দেখেছি…” আমার ততক্ষণে আত্মারাম রণতুঙ্গা হয়ে গেছে।
কিন্তু আরও দু তিন বার সেম জিনিস করার পর আমি বুঝলাম, নাহ্‌, এ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। কিছু একটা স্টেপ নিতেই হবে।

তখনই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক করে ফেললাম, আর দেরী নয়, লোকটাকে আমায় খুন করতে হবে, যেমন করেই হোক। নইলে আমার প্রাণ সংশয় হতে পারে। কোনদিন হাত থেকে স্লিপ করে গেলেই তো আমার হয়ে গেল। বরং একই পদ্ধতি আমি অ্যাপ্লাই করি। বাবাকেই ফেলে দিই ওখানে।

 

সেদিন শনিবার। ভদ্রলোক কোত্থেকে যেন চড়ে এসে ফিরেছে। আমি পাথরের মত মুখ করে গেলাম সামনে। বললাম, “একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, ওইখানে। দেখবে চল।”
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? পুকুরে? কেন গেছিলি ওখানে? দেব ফেলে হ্যাঁ? দেব?”
আমি হাত দেখিয়ে বললাম, “না, আগে দেখ জিনিসটা। তারপর ডিসিশন নিও।”
আমার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর ওকে ভাবাল। বলল, “চল দেখি…”
আমি দরজার কাছে গেলাম। বুক দুরুদুরু করছে। ঠাকুর, আমি পারব তো? আমায় সফল কোরো ঠাকুর। না পারলে যে আমি শেষ। প্রতিশোধ নিতে ওই ষণ্ডা ভদ্রলোক এক মূহুর্তও অপেক্ষা করবেনা।

 

দরজাটা খুলে মাঝের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, “ওই দ্যাখো? দেখতে পারছ?”

 

সে উঁকি মেরে প্রাণপণ দেখার চেষ্টা করছে কোথায় কী? আমি আস্তে করে পিছিয়ে এলাম। তার গায়ে যত জোর আছে তা দিয়ে দিলাম এক ধাক্কা।
সেদিনই বুঝে গেছিলাম ভগবান নেই। লোকটা এক চুলও নড়লনা। বরং ঘুরে বলল “এই কোথায় কী? আর তুই আমার পিছনে কী করছিস হ্যাঁ?”
কিছুক্ষণ পরই তার টনক নড়ল। ছবির মত বুঝে গেল কী হতে চলেছে। “ওহ তুই আমাকে ফেলে দিতে চাইছিলি? কী সর্বনাশ!” বলে আমায় কোলে তুলে নিল।
আমি জানি আমি নেই আর। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। আমার জীবনের ভ্যালিডিটি এইটুকুই ছিল। এবার বিদায় নেওয়ার পালা।
কিন্তু লোকটা আমায় ফেললনা। অবাক করে সেই প্রথমবার আমার গালে দুটো চুমু খেয়ে আদর করে মাকে ডাকতে শুরু করল, “এই দ্যাখো তোমার ছেলে আমায় ফেলে দিতে চাইছে পুকুরে…” এই বলে খুব হাসতে থাকল আর আদর করতে থাকল। সে হাসছে। মা হাসছে। আমার চোয়াল শক্ত হওয়া শুরু সেদিন থেকেই। এর থেকে ফেলে দিলে বোধহয় ভাল ছিল। এই অপমান জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।
তবে লোকটাকে আমার অল্প অল্প ভাল লাগতে শুরু করেছিল তার পর থেকেই। এরকমই হয় বোধহয়। খুনের ভিক্টিম কোনওভাবে বেঁচে গেলে তাঁর প্রতি একটা মায়া পড়ে যায়। কিছুদিন পর একদিন আমার কোনও একটা ‘করতে নেই’ এমন কাজে লোকটা রেগে গেল আবার। কিন্তু সেদিন আমাকে পুকুরে ফেলতে চাইলনা। বলল, “তুই এমন করিস তো, যা আমিই চলে যাচ্ছি পুকুরে। আর আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই।” এই বলে দরজার দিকে এগোল। সেই প্রথম আমার দৃঢ়, ঠাণ্ডা মুখ, শক্ত চোয়াল, পাথরের মত দৃষ্টি এবং কুঞ্চিত ভ্রু হঠাৎ বদলে গেল এক নিমেষে।
আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার পেটে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বললাম, “না তুমি যাবেনা… অ্যাঁআঁআঁআআ…বাবাআআআ… আমি আর করবনা এরকম… যাবেনাআআআআ…”
আমার খুনেপণা বন্ধ হয়ে গেছিল সেই সময়। কিন্তু কথায় আছে না? যে যার জন্য জন্মায় তাকে তাই করতে হয়? আমার দ্বিতীয় ভিক্টিমের আগমন তখনই ঘটল। আমার দাদু বা ঠাকুর্দা!


প্রথম প্রথম এই পক্ককেশধারীকে আমার বেশ ভাল লাগত। এ যে অমন জল্লাদের বাপ ধারণাই হয়নি। বরং এর যে আরেকখানা ছেলে আছে সেটা পুরো মাই ডিয়ার লোক। দেখলেই কিছু না কিছু কিনে দিচ্ছে বা খাওয়াচ্ছে, গল্প শোনাচ্ছে, ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে, সিনেমা দেখাচ্ছে, পুরো ফাটাফাটি।

কিন্তু যেই আমি আরেকটু বড় হলাম, এই বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের রঙ দেখানো শুরু করল। বাবা তাঁকে বলল, “আমার দ্বারা এমন বিচ্ছু সামলানো সম্ভব হচ্ছেনা। একফোঁটা পড়াশুনা করেনা, একটাও কথা শোনেনা, তুমি দ্যাখো যদি পারো, নয়ত এ উচ্ছন্নে যাবে।”
ব্যাস বুঝলাম তারপর, এ শালা রক্তের দোষ। আর এ আরও বেশি অত্যাচারী। কংস, শকুনি, অশ্বথামা তাবড় তাবড় ভিলেইনকে এ এক থাপ্পড়ে সোজা করে দিতে পারে। কে বলবে এত বয়স হয়েছে। রোজ আসছে, গাদা অঙ্ক করাচ্ছে, ধপাধপ মেরে শুইয়ে দিচ্ছে। শেষে এক টাকা হাতে দিয়ে ‘লজেন্স খেও’ বলে চলে যাচ্ছে। প্রথমে রাগে ভেবেছিলাম টাকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিই। তারপর ভাবলাম নাহ্‌, এতটা লস ধর্মে আটকাবে। লজেন্সটা খেয়েই নিলাম।
সে যাই হোক, এমন চলতেই থাকছে। আর বাড়ির ভদ্রলোক তো আর বদলে যায়নি পুরো। সে না হয় আমি ক্ষমাঘেন্না করে দিয়েছি মায়ায় পড়ে, পুকুরে আর ফ্যালে ট্যালেনা, কিন্তু সেও হাতের সুখ করে নেয় মাঝে মাঝেই। আর দিন কে দিন মা’টাও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে এদের সাথে মিশে। সবাই মিলে এমন আমার পিছনে পড়েছে কেন বুঝতেই পারছিনা। প্রাণ অতিষ্ট করে তুলেছে! তখনই ঠিক করলাম এদের একটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তবে বাকি দুটো ভয় পেয়ে থামবে।
মনে মনে বললাম, “দাদু, দিন গোনা শুরু কর। তোমার মৃত্যু আমার হাতেই হবে…”
প্রথমেই আমার ‘হাতের পাঁচ’ পুকুর দিয়ে ট্রাই করলাম। একই পদ্ধতি। বাবা না হয় শক্তিশালী, দাদু তো নয়। লাঠি নিয়ে হাঁটে। মাঝে মাঝেই ‘গেছি গেছি’ করে কঁকিয়ে ওঠে। আর আমিও বড় হয়েছি। ব্যস, শুধু নিয়ে যাও দরজায়। তারপর এক ধাক্কা…
কিন্তু যতটা সোজা হবে ভেবেছিলাম, হলনা। লোকটা প্রচণ্ড ধূর্ত। অমন কঠিন কঠিন অঙ্ক কষে ফেলা দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল। সে প্রথমেই নাকচ করে দিল, পুকুরে কিছু দেখার থেকে। বলল “না, না, আমি যেতে পারবনা, ওসব বাদ দাও, এখানে বস, ঐকিক নিয়মটা শেখাই।”
এরপর আমি অন্য পথ ভাবলাম। মা বলত, ‘উকুনের ওষুধ খুব বিষাক্ত। পেটে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। আমি ঠিক করলাম দাদুকে সেটা জলে গুলে খাইয়ে দেব। এবার তো আর বাঁচতে পারবেনা…”

লোকটা বোধহয় আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছিল। যা ধূর্ত লোক! বুঝতেই পারে। সে চালু করল ঘুষ দেওয়া। আমার সাথে পরিচয় করালো গল্পের বই এর।

 

অবাক হয়ে গেলাম আমি! ছাপার অক্ষরে কঠিন কঠিন অঙ্ক, ইতিহাস ছাড়া যে এমন মজার জিনিস থাকতে পারে কল্পনাই করতে পারিনি! সেখানে প্রচুর খুনী, গোয়েন্দা, চোর, ডাকাত, পুলিশ সব কিলবিল করছে। পুরো মজে গেলাম সেই নেশায়। আর ঠিক করলাম, নাহ্‌, এ বাঁচুক, প্রচুর দিন বাঁচুক, যেন কোনওদিন না মরে। আর দিয়ে যাক আমাকে এমন সমস্ত সম্পদ। আমি অঙ্ক করব, মা বাবার কথা শুনব, কাউকে পিটাবোনা, শুধু এই রস থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত করা না হয়…
তারপর? তারপর আর কী… আমার আর কাউকে খুন করা হলনা। এখন খুন করার মত লোক প্রচুর। কিন্তু তাঁদের দেখে আমার চোয়াল শক্ত হলেই আমি বই এর তাক থেকে পেড়ে আনি একটা গল্পের বই। ব্যস, সব ঠিক হয়ে যায়।
আমার কথা কিন্তু খণ্ডায়নি। আমার ম্যাজিক বুড়ো গত বছর আমার হাতেই মারা গেছে। অনেকবার বললাম, “দাদু যেওনা, কে দেবে আমায় গল্পের বই বল? যেওনা প্লিজ। কে করাবে আমাকে অঙ্ক?” শুনলইনা কথা।
সবাইকে চলে যেতে হয়। আমার বাড়ির ওই অত্যাচারী, শশ্রুগুম্ফধারী, ষণ্ডা ভদ্রলোকও আস্তে আস্তে নরম হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। চুল পাকছে, টেনশন করা শুরু করেছে, প্রেশার হচ্ছে। আমি অপেক্ষায় আছি সেদিনের, যেদিন আরেকটা প্রজন্ম চোয়াল শক্ত করে প্ল্যান করবে তাকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার, আর মাহেন্দ্রক্ষণে নিজেই দরজায় দাঁড়িয়ে তার পেটে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বলবে “নাআআআআ যাবেনাআআআআআআআ…”

Illustration by Debjyoti Mahapatra

 

নববর্ষ

মন্দিরা বসু

নববর্ষ মানে কি কেবল নতুন জামা পড়া,
আর লুচি মাংস খাওয়া ?
নববর্ষ মানে কি কেবল গনেশ পুজো আর
হালখাতায় যাওয়া ?
নতুন বছর মানে নতুন ভোর, নতুন পথ,
নতুন আশা
– তোমার আমার চলার নেশা।
কি পাইনি আর কি পেলাম?
কি দিইনি আর কি দিলাম ?
হিসাব কিতাব নাই বা নিলাম
– নতুন দিশায় পা বাড়ালাম।

ইশকিয়া

সোমা ঘোষ (চক্রবর্তী)

ইটালির কথা ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভাবছি। ঐতিহাসিক শহর রোমের বর্ণনা দিয়ে নাকি রোমান্টিক বর্ণালী জল-শহর ভেনিসের গন্ডোলা রাইডের অভিজ্ঞতা দিয়ে। নাকি রেস্তোঁরার সেই মিষ্টি হাসির মেয়ে অ্যান-এর আখ্যান শোনাব, যে রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে আলাপ করে অতি যত্ন সহকারে নিজের রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে বীফ লাজানিয়া খাইয়েছিল। তারপর থেকে দুবেলা আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত অপেক্ষায়, কখন পার করব ওর পথ? সেই যে গ্রীক গডের মত সুন্দর সুঠাম এবং ততটাই সুন্দর মনের মানুষ ড্রাইভার রোনালদিনো’? তার কথা বলব? যার কাছে ইংরাজি ‘ডিফিকাল্ট’ শব্দের প্রতিশব্দ স্ট্রং? নাকি বলব, দীর্ঘ দেড় হাজার বছর ছাইএর নীচে চাপা পড়ে থাকা তিন হাজার বছরের পুরনো শহর পম্পেই এর মৃত্যু মূহুর্তে থমকে থাকার ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার কথা! ক্যাপ্রি নামের সেই গভীর নীল দ্বীপটা? যার সীমানা জুড়ে অদ্ভুত সাদাটে পাথুরে পাহাড়ের সারি, যার পায়ের কাছে গিয়েই হঠাতকরে সমুদ্রটা আরও স্বচ্ছ আরও অভাবনীয় অবাস্তব সবজে নীল হয়ে উঠল! একেবারে হলিউডি রূপকথা ছায়াছবির সমুদ্রের মত মায়াবীসুন্দর!  আমাদের বোট একের পর এক প্রাকৃতিক আর্ক ফুঁড়ে ফুঁড়ে সবাইকে যেন অন্য গ্রহের এক স্বপ্নজগতে নিয়ে চলেছিল!

ম্যাঞ্চেষ্টার এয়ারপোর্ট আমাদের বাড়ির লাগোয়া বললে অত্যুক্তি হয়না। তবু উড়ানের দুঘন্টা আগে পৌঁছে গেছিলাম। কস্টা’য় কফিসহ ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে যথাসময়ে প্লেনে চাপলাম দুই পুত্র এবং বরকে বগলদাবা করে।

আমাদের সেদিনের যাত্রার অন্তিম গন্তব্য ছিল নেপলস। দক্ষিণ ইটালির ছোট্ট একটা শহর। জেনেছিলাম নেপেলস শহর রোম থেকে তীব্রগতি (৩০০কিমি/ঘন্টা) ট্রেনে মাত্র দেড় ঘন্টার পথ। এই শহর কে কেন্দ্র করে আমরা বাকি শহরগুল ঘুরব এমনি প্ল্যান। পাঁচদিন পর নেপলস ছেড়ে শেষ দুটো দিন ভেনিসে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। আমরা ইন্টাররেল পাস কিনে নিয়েছিলাম দ্রুতগতিতে ইটালির শহরগুলয় যাতায়াতের জন্যে। ইন্টাররেল পাস যথেষ্ট দামি হলেও অনেকগুলো শহর কভার করতে গেলে আলাদা করে টিকিট কেনা অনেক বেশী খরচসাপেক্ষ হয়ে যায়, তাই আখেরে সাশ্রয়। যাইহোক,আমাদের মনে হয়েছিল আমরা বিকেল ৪ টের দিকে হোটেল ঢুকে যেতে পারলে পাঁচটার দিকে পম্পেই রওনা দেব। তাহলে পরদিন এ্যামালফি কোস্ট, সরেন্টো, পোসিটানিও এই কোস্টাল পয়েন্টগুল দেখা যাবে। কিন্তু বিধি বাম। আজ সেই গপ্পটাই নাহয় করা যাক।

প্লেনে উইন্ডোসাইড সীটটা ছোটোজন দখল করল,কারণ এই আড়াই ঘন্টার যাত্রাপথে সিনেমার ব্যাবস্থা নেই। ওর সাথে কিছুটা বায়নাক্কা করে যখন দেখলাম লাভ হলনা উপরন্তু লোকজন কিঞ্চিত বিস্মিত দৃষ্টি দিচ্ছে এই আধ-দামড়া মহিলার হাব ভাব দেখে,অগত্যা মাঝের সীটে বসলাম। বেশ রোদ ঝলমলে আকাশে ফুরফুরে মুডে চলেছি,পার হয়েছে ঘন্টা দেড়েক,এমন সময় পাইলট এনাউন্স করল- ‘আমরা এখন আল্পসের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পরে ডান দিকে মাউন্ট ব্ল্যাঙ্ক (মঁ ব্লঁ,আল্পস এর উচ্চতম শৃঙ্গ) দেখা যাবে। পারলে তখন ছেলেকে মেরে ধরেই সরাই। তবু লোকসমক্ষে,‘বেবি, প্লীজ সুইচ আওয়ার সীটস’। বিশ্বওঁচা বেবি বললে,‘নো আই উইল সী দ মাউন্টেইন’। দাঁত কিড়মিড়ানি চেপে মুখে হাসি বজায় রেখেই বললাম,‘বাট আই হ্যাভ টু টেক সাম পিকচার্স ফর ইওর ‘শো এন্ড টেল’এট স্কুল,বেবি!’তার উত্তর,‘মা, হু টেইক ইওর পিকচারস  অফটেন, হুহ? গিভ মি দা ক্যামেরা।‘জনান্তিকে বলে রাখি,আমার ফোটোশুট এর একমাত্র সহায় সম্বল এই ছোটো পুত্র। বড় পুত্র বা বরকে একটার বেশী দুটো ছবি তুলতে বললে,পারে তো দা কাটারি নিয়ে তেড়ে আসে। অগত্যা চেপে বসে গেলাম মুখ ব্যাজার করে।

কিন্তু ছেলে যখন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে বল্ল, ‘মা, লুক আউটসাইড’… আমি তার গায়ের ওপর দিয়েই হুমড়ি খেয়ে জানলার দিকে চেয়ে দেখি-  যতদুর চোখ যায় তুষার ঢাকা শৃঙ্গের সারি।  জানিনা প্লেনের উচ্চতা ৪০০০ ফুট থেকে কিছু নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল কিনা, কিন্তু তুষারাবৃত চড়াই আর ঘন আঁধার উতরাই ঢেউএর বিস্তার নিয়ে ভারি স্পষ্ট ভাবে পাহারগুল ঝিমঝিমে নীল আকাশের গায়ে মিলিয়ে যাচ্ছে,দেখছিলাম। অন্তত বিশ পঁচিশ মিনিট জানালায় ওই উৎকট ভঙ্গিমায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বড় ছেলে পেছনের জানলা থেকে বেশ অস্বস্তিমাখা স্বরে বলল,‘এবার তো বস।‘তখনও কালো পাহাড়ের পেছনে রূপোলী পাহাড়েরা সরে সরে যাচ্ছে অতি ধীরে। আশাতিরিক্ত প্রাপ্তিতে মন ভরপুর হয়ে গেল!

বাক্সপ্যাঁট্রা পেয়ে যাবার পর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে রোম এয়ারপোর্ট ছাড়তে ছাড়তে বেজে গেল আড়াইটে প্রায়। রোমা টার্মিনি,রোমের মেইন রেলওয়ে স্টেশনে এসে ইন্টাররেল পাস কেনার পালা। ভেবেছিলাম সে কাজ হবে- ‘টাকা দাও আর হাতে নাও’টাইপ। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম,দেশের ন্যাশলাইজড ব্যাঙ্কগুলোর মত হাতে ধরিয়ে দিল নাম্বার লেখা একটা স্লিপ। যেখানে কিউতে ত্রিশ জনের পরে ডাক। আর এক একজনের মিনিট দশেক করে সময় লাগছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম,ওদিন পম্পেই দেখার প্ল্যান তো মায়ের ভোগে গেল! যাকগে যাক, নেপলস শহরটাই ঘুরে দেখা যাবে। তবে হোটেলে পৌঁছতে হবে সাতটার মধ্যে। থুড়ি হোটেল নয়,রিসর্ট। যেখানে সন্ধ্যে সাতটার পর রিসেপশন বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের চাবি দেবার আর কেউ থাকবেনা দেরী হলে।

তা যাইহোক,টিকিট কিনেটিনে ট্রেনে চেপে বসে তো দিল একেবারে ঝিঙ্কাচিকা। যেমনি ট্রেনের রংরূপ (একেবারে ফুলটু ঝক্কাস),তেমনি দুপাশের ঘন সবুজ পাহাড় রূপের পসরা নিয়ে তীব্র বেগে পেছনে ছুটে যেতে যেতে কখনও দূরে যাচ্ছে কখনও কাছে সরে আসছে। কোথাও চোখে পড়ছিল সবুজ পাহাড়ের পেছনে বরফ ঢাকা পাহাড়ের ঝিলমিলে রেখা। তার ফাঁকে ফাঁকে আঙুরের অর্চারড অথবা হলুদ ক্ষেত কিংবা জলপাই বাগান কে যেন গুঁজে দিয়ে গেছে।

তাপমাত্রা ১৭/১৯ ডিগ্রীর মধ্যে বলে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা হল ক্লান্তি এসে জুড়ে বসতে অবসর পায়না। ভাবছি সাড়ে ছ’টার মধ্যে নেপেলস পৌঁছে যাব,তাহলে হোটেলে সাতটার মধ্যে অবশ্যই ঢুকে যাব। কারণ বলা হয়েছিল ঘন্টা দেড়েকে রোম পৌঁছোন যাবে হোটেল থেকে। তাই চিন্তা না করে ট্রেন যাত্রাটা আপাতত উপভোগ করা যাক।

সব ভালর শেষ আছে। আমাদের যাত্রাপথের একটা ঘন্টা উবে গেল কোথা দিয়ে। মনে এই আনন্দ নিয়ে নাবলাম যে আগামী চারটে দিন এই পথে যাতায়াত জারি থাকবে।

দেখে মনে হল না নেপেলস ছোটো শহর,বিশাল স্টেশন,স্টেশনস্ত দোকানপাট সব ধোপদুরস্ত- এলাহি ব্যাপার। আবার বাক্সপ্যাঁট্রা বর ছেলেপুলে সমেত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। লাইনে দাঁড়াতে বেশ জলদিই আমাদের টার্ন এল। ড্রাইভারকে দেখানো হল আমাদের আবাসের ঠিকানা। ড্রাইভার বলল ২০ মিনিট ড্রাইভের পর ফেরী। আমরা বললাম,ফেরী চাইনা আমরা পুরো পথটাই ট্যাক্সিতে যাব। উত্তরে ড্রাইভার বললে, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ উইংস!’ উত্তর শুনে আমি আর বর চোখ চাওয়াচাওই করলাম। বলে কি …  ব্যাটারা মোটেই ইংরিজি বোঝেনা ভুল ভাল বকছে। ওকে ফেলে এগিয়ে চল্লাম অন্য ট্যাক্সির উদ্যেশ্যে। সেই ড্রাইভার তুলনামুলক ভাল,কিছুটা ভরসাযোগ্য ইংরিজি বলে। বলল, ‘দ্যাট উদ বি ভেরি স্ত্রং’। আগেই বলেছি এঁর কাছে স্ট্রং মানে ডিফিকাল্ট। পরবর্তীতে আমাদের সারথীর ভুমিকা যথার্থ ভাবে পালন করেছে এই হ্যান্ডসাম ইতালীয় যুবক।

ওর কথাবার্তা শুনে যা বোঝা গেল,এই রিসর্টটি একটি দ্বীপে অবস্থিত। যেখানে হাই স্পীড ফেরীতে পৌঁছতে লাগবে দেড় ঘন্টা। তাও নির্ভর করবে সমুদ্রের আবহাওয়ার ওপর।

এবং লাস্ট ফেরী ছাড়বে ৭টায়,ফেরী ঘাট পৌঁছতে লাগবে ২০ মিনিট। তারপর টিকিট কাটার কিছুটা সময়,শেষ ফেরী পাওয়া প্রায় অসম্ভব। চমক ভাঙ্গার আগেই গাড়িতে বসে লাগাও তাড়া,‘হারি আপ প্লীজ। ফেরী ঘাটে নেমে বর ছুটল টিকিট কিনতে- আমরা লাগেজ নিয়ে ল্যাজে গোবোরে হয়ে অসহায় ভাবে ছুটোছুটি করে বোঝার চেষ্টা করছি গোটা সাতেক জেটির মধ্যে ঠিক কোনটাতে আমাদের ফেরী বাঁধা।

যাইহোক অবশেষে ফেরীতেও বসা হল এবং যথা সময়ে ভেঁপু বাজিয়ে যাত্রাও শুরু হল। লাগেজ টাগেজ রেখে প্রায় ফাঁকা ফেরীতে গুছিয়ে বসলাম। বাইরে তখন দিব্য দিবালোক। মেঘলা আকাশ,সমুদ্র কিছুই আর শিহরণ জাগাচ্ছেনা,এতটাই অবসন্ন বোধ করছি। ইতিমধ্যে ৭টা দশ বেজেছে,তড়িঘড়ি ফোন করা হল রিসর্টে আমাদের বিলম্বের খবর জানাতে। গোটা আষ্টেক কলের পরেও অন্যতরফ নিরুত্তর। ফোন বেজে গেল। সুতরাং রিসর্টে খবর দেওয়া গেলনা।

অজানা নির্জন দ্বীপে,রিসর্ট বন্ধ হয়ে গেলে রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মিলবে কোথায় সেই দুশ্চিন্তায় দিশাহারা লাগছিল। এরমধ্যে লোকজনের সাথে কথা বলে আরও কিছু আশঙ্কাজনক তথ্য পেলাম-  ইশকিয়া নামের রিমোট এই নির্জন দ্বীপে খুব অল্প লোকের বাস। তিন ঘন্টা পর পর নেপেলস থেকে আসা যাওয়ার ফেরী। সুতরাং ওখানে পৌঁছনোর অর্থ বাকী দুনিয়া ভুলে ইশাকিয়ার ইশকেই মজে থাকা।

হিলটন হলিডে টাইমশেয়ার কেনা আমাদের। ওরাই নেপলসে আমাদের হোটেল বুক করেছে। তা যে আদৌ নেপলস এ নয়, একটা নির্জন দ্বীপে সেই তথ্য আমাদের একেবারেই আজানা। উপরন্তু ওদের ইনফর্মেশন অনুযায়ী আমাদের হোটেল থেকে রোমের দূরত্ব মাত্র দেড় ঘন্টা।

তবে? কি হবে আমাদের বাকি প্ল্যানের? এই যে এত টাকা দিয়ে কাটা হল আট দিনের ইন্টার রেল পাস? তার সাথে রোম শহরের বেশ কিছু মিউজিয়াম, কলোসিয়াম ইত্যাদি দেখার জন্যে কেনা হল অমনিয়া পাস? এত এত প্ল্যান সব স-অ-ব জলে গেল? বেড়াতে আসার সবটুকু মজাই কেমন ব্লটিং পেপারে তরলের মত কেউ কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ শুষে নিয়েছে মনে হল।

মন খারাপ নিয়ে চারটে প্রাণী তখন ভাবছি কোনোমনে থাকার একটা ঘর যেন জুটে যায়। কারণ রাতে নেপলস ফেরার কোনও সুযোগ আর নেই। কিন্তু কপালের লিখন আরও খারাপ।

আধ ঘন্টা পার হতেই হঠাত সমুদ্র উঠল ফুঁসে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল সামনের জলরাশি। বোটটা খ্যাপা ষাঁড়ের মত উথাল পাতাল দুলতে লাগল। আমরা মোটেই ডিঙি নৌকো টাইপের ছোট খাটো কিছুতে যাচ্ছিলামনা। দুটো ফ্লোর মিলে তিনশো সীট আছে এতোটাই বড় এই নৌকো। এবং সজ্জায় রীতিমত আধুনিক।

এই উঠে যায় কত্ব উঁচুতে আবার ধপাস করে পড়ে। গোটা শরীরে কি অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত এক দুলুনি, মনে হচ্ছিল পেটের ভেতর থেকে সব পাকিয়ে নিয়ে বের করে আনবে। আমি আর ছোটো ছানা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নিত্য যাত্রীরা অব্দি বেশ শঙ্কিত বোঝা যাচ্ছিল। আর আমি তো ভীতুর ডিম। ভাবলাম,এই ছিল কপালে? এভাবে সলিল সমাধি?

যাইহোক সব ভালোর যেমন শেষ আছে,খারাপেরও আছে। এই ভয়ংকর দুলে দুলে ওঠা-পড়াও এক সময় শেষ হল। আমাদের বোট তীরে এসে ভিড়ল। সেই জেটিতে আমাদের বোটের গুটিকয় যাত্রী ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না। বেড়িয়ে দেখলাম দুসীটের ছোটো ছোটো কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে,যারা যাত্রী নিয়ে ফেরীঘাট বেবাক খালি করে কেবল আমাদের রেখে চলে গেল। আমরা বাদে বাকি যাত্রীরা কুলিয়ে গেল এমনি মাপে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। অনুমান করলাম এই গাড়িদের ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়েছে।

দু একজন ড্রাইভারকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা দেখাতে কিছুই না বলে নিজেদের যাত্রী নিয়ে চলে গেল। একজন ড্রাইভার শুধু বললে,‘আই উইল সেন্ড আ ট্যাক্সি ফর ইউ’। একটু ভাবুন কি অসহায় ভাবে একটা নির্জন দ্বীপে আমরা চারজন। প্রাণে বাঁচলাম বটে কিন্তু চুড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা একটা সেকেন্ড অপেক্ষা করে চলেছি ট্যাক্সির আশায়। অদূরে গোটা তিনেক ঝাঁপ বন্ধকরা দোকান। বৃষ্টি থেমে গেছে বটে,তবে ঠান্ডাটা জমিয়ে পড়েছে। সামার জ্যাকেট আর কাজ করছেনা।

কিন্তু ট্যাক্সি এল অবশেষে। এবং ড্রাইভার ঠিকানা দেখে বলল পাহাড়ি রাস্তায় চল্লিশ মিনিটের পথ। আর তখন কিছুই ভাবছিনা,আমাদের একটা ছাদ চাই শুধু। আরও একটু অপেক্ষা নাহয় করলাম। ছোটোটা ট্যাক্সিতে আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পাকদন্ডী বেয়ে আমরা উঠে যেতে থাকলাম আমাদের হোটেলের দিকে। বিরক্তির সাথে ভাবছি,কারো মাথায় আসে কিকরে এমন জায়গায় হোটেল বানাবার কথা!!

রাস্তাঘাট যদিও একেবারে টিপটপ,যেমন ইউরোপের যেকোনো জায়গায় হয়। বেশ কিছু বাড়িঘর দোকানপাট,পথে লোকজন,ছোট্ট ক্যাফে চোখে পড়তে মনে হল, যাক একেবারে গোবিন্দপুর নয়। ঘর পেলে একটু খাবারও জুটে যেতে পারে। ততক্ষণে খিদেটা চাগাড় দিতে শুরু করেছে।

এতক্ষণে আমরা গল্পের ক্লাইম্যাক্সে এসে পৌঁছেছি।  রিসর্টের সামনে নামলাম। একটা খাড়া ঢালু রাস্তা বেয়ে গাড়িটা দাঁড়াল একটা আধো অন্ধকার হট সুইমিং পুলের পাশে।  রিসেপশন লেখা জায়গায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দরজা লকড। তিনটে খাড়া পায়ে চলার পথ ওপরে উঠে গেছে,সেদিকেই বিল্ডিং মনে হচ্ছে। আলো এত কম যে পুরো জায়গাটাকেই আন্দাজে ধরে নেওয়ার চেষ্টা। এসব দেশে আলো নেভানোর রীতি নেই। বড় বড় দোকান কাঁচের দরজার ভিতরে আলোকিত হয়ে রাত কাটায়। আথচ এই বেয়াক্কেলে রিসর্টের রিসেপশন অন্ধকার।  বর বেচারা ফোনের পর ফোন করছে আর রিং টোন ওই অন্ধকার রিসেপশন থেকে আমাদের কানেই ফিরত আসছে। এ কেমন আধো অন্ধকার ভুতুড়ে এক জায়গায় এসে উঠলাম আমরা! জনমনিষ্যির নামনিশান নেই। ভয়ে শীতে গা ছম ছম করছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যখন গাড়ি ঘোরাচ্ছে ছুটে গিয়ে জানতে চাইলাম,কি করব? সে ইটালিয়ান ভাষায় কিছু একটা বলে চলে গেল। ইচ্ছে করছিলাম ডাক ছেড়ে ভ্যাঁ করে কাঁদি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় একেই বলে! আমরা স্থাণু হয়ে ওখানে আটকে গেছি। পরে কি হবে কিছুই জানিনা। কিছু সময় এভাবে কেটে গেল!

হঠাত শোনা গেল নারী পুরুষের কন্ঠস্বর ওপর থেকে নেমে আসছে। প্রায় ‘ইউরেকা’ বলে বর দৌড়ে গিয়ে পাকরাও করলে কন্ঠস্বরের মালিক মালকিন দের। তিন আমেরিকান বৃদ্ধ বৃদ্ধা রেস্টোরান্টে খেয়ে ফেরত আসছে। বললে, ‘ ম্যানেজার চলে গেছে সাতটায়, নো সার্ভিস আফটার সেভেন, তবে রেস্টোরান্টে স্টাফ আছে হয়তো তোমাদের সাহায্য করতে পারে।’

এই বলে তারা নিজেদের রুমের দিকে চলে গেল। বড়পুত্র সবে  দিকে হাঁটা দিয়েছে রেস্টোর‍্যান্ট- পানে,দেখা গেল ওপর থেকে হুডপরা একজন নেমে আসছে।

যাক,কাজের শেষে এর কাছে চাবি দিয়ে গেছে আমাদের ম্যানেজার। ট্যাক্সির আওয়াজ পেয়ে খবর নিতে এসেছে আমরা এসেছি কিনা।

অবশেষে আমরা রুমে পৌঁছলাম।  তখন রাত প্রায় দশটা। কিছুক্ষণের মধ্যে বড়পুত্র আর বর মিলে গরম গরম অমৃতসমান পিত্জা নিয়ে এল। পিত্জার ডো মাখা থেকে শুরু করে সবটাই ওদের চোখের সামনে। পিত্জা তৈরী হবার ফাঁকে বর এক্সপিডিয়াকে ফোন করে পরদিন থেকে চার রাতের জন্যে নেপেলসে হোটেল বুক করে ফেলল। ইশকিয়া গোল্লায় যাও এমন একটা ভাব।

এরকম ফ্রেশ পিত্জা আগে পরে আর কোনওদিন খাইনি। কি যে সুবাস! ইটালিয়ান রেড ওয়াইন সহযোগে তাকে গলঃধকরণ করে একটা দুধসাদা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম! আঃ শান্তি।

পরদিন ঘুম ভেঙে পর্দা সরিয়ে দেখি অদ্ভুত সুন্দর কালচে সবুজ পাহাড় খুব কাছেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার পায়ের কাছে জলপাই বন। ছুটে ব্যালকনি গেলাম- সদ্য ঘুমভাঙা অপূর্ব শান্ত নীল সমুদ্র নীল আকাশের সাথে আদুরে দুষ্টুমি করার ফাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল,আমায় ছেড়ে চলে যাবি? ভোর সকালের ঢুলু ঢুলু সুন্দর এরকম একটা রিসর্ট কে রাতে এমন ভুতুড়ে লাগছিল কেন কে জানে? রাতে যতক্ষণ না ঘুম এসেছে হিল্টনের তো আয়িসি কি ত্যাইসি করে গেছি স্বামী স্ত্রীতে। আর এখন? ইশকিয়া ছেড়ে যেতেই মন কেমন করছে! এক নজরেই হামলিয়ে ইশক হয়ে গেল ইশকিয়ার সাথে।

৫০টি বছর পার করে খুঁজে পেলাম তারে

দেবাশীষ বসু

  যাকে খুঁজে পেলাম সে শিলং এর লাবানে, পাহাড়ের কোলে ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ী। বাড়ীর একধারে বেশ কিছু সিঁড়ি নেমে, বয়ে যাওয়া জলধারার ওপরে একটা ছোট্ট সাঁকো। সেই সাঁকো পেরিয়ে বড় রাস্তা। আর রাস্তার ওপারে পাহাড়ের ওপর পাইন গাছের সারি। বাড়ীর অন্য ধার দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হরিসভা মন্দিরের পাশ দিয়ে লাবান বাজার যাবার পথ।
এই কথাগুলো আজকের নয়। তখনকার কথা যখন আমার বয়স ছিল ১২ কি ১৩। অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর আগে। আমি পড়তাম দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে, আর আমার বাবা মা থাকতেন শিলং-এর এই সুন্দর বাড়ীটার এক অংশে। সেখানে আমি যেতাম প্রতি বছর গরমের আর শীতের ছুটিতে। এই বাড়ীটার স্মৃতি কেন যে আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল জানিনা। মনে পড়ত পাইন গাছের সারি আর তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলের স্রোতের আওয়াজ। আর ভাবতাম কবে আবার যাবো শিলং-এর বাড়ীতে।
দেওঘরে থাকাকালীন হঠাৎ এক দিন জানতে পারলাম যে বাবা চাকরিসূত্রে শিলং ছেড়ে কোলকাতা চলে যাবেন। তাই স্কুলের ছুটিতে আমার আর শিলং যাওয়া হবে না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বাড়ীর ছবিটা মনে রয়ে গেল স্বপ্নের মত। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল,কিন্তু একবারের জন্যেও আমার আর শিলং যাওয়া হলনা। এত বছর পরেও বাড়ীটা কি এখনও আছে? কে জানে?

অবশেষে শিলং যাবার পরিকল্পনা হল আমাদের। স্ত্রী মন্দিরা, বড়ছেলে শতজিত এবং ওর স্ত্রী মীনাক্ষীকে নিয়ে। যেদিন যাবার পরিকল্পনা হল, সেদিন আমার মনে হল যদি সেই বাড়ীটা আজও অটুট থাকে,আমি সেটা খুঁজে বার করবই আর সেই থেকে মনে একটা উত্তেজনাও সৃষ্টি হল।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, শিলং-এর কাছে বড়াপানি বিমান-বন্দর হয়ে পৌঁছলাম শিলং-এ। শিলং-এ পৌঁছেই বয়সটাকে কমিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম ১৯৬৬/৬৭ সালে। চোখটা বন্ধ করতে মনে হল, ছোট ছেলেটা সিঁড়ি ভেঙ্গে ওই সুন্দর বাড়ীটার দিকে যাচ্ছে। তাই চোখ খুলে ঠিক করে ফেললাম আগামীকাল শিলং-এ বেড়াতে বেড়িয়ে প্রথম কাজ হবে ওই বাড়ীটা খুঁজে বার করা।

হরিসভা মন্দির

পরদিন হোটেল থেকে রওনা হয়ে গাড়ীর ড্রাইভারকে বললাম আমাদের লাবানে নিয়ে যেতে। লাবানের কোথায় যাব জানতে চাইলে বললাম হরিসভা মন্দিরের কাছে। ড্রাইভার এই মন্দিরের নাম শোনেনি। লাবানের একটা জমজমাট রাস্তার কাছে নিয়ে গাড়ী দাঁড় করাল। আমরা গাড়ী থেকে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম হরিসভা মন্দির। এক দোকানের মালিক আমার প্রশ্ন শুনে হরিসভা মন্দির যাবার হাঁটা পথ দেখিয়ে দিল। আমরা সেই রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম হরিসভার মন্দির।

 

ভীষণ ভাল লাগল মন্দিরের সামনে দাড়িয়ে। যদিও মন্দিরের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত হলাম যে এটাই সেই মন্দির যেটা আমি শেষবার দেখেছি ৫০ বছর আগে। এবার বাড়ী খুঁজে

বার করার পালা। মন্দিরের ভেতরে কয়েকজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। বাড়ীর যিনি মালিক তাঁর নাম করে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীটার হদিস দিতে পারেন কিনা। বাড়ীটার বর্ণনা দিলাম। বাড়ীতে পৌঁছতে যে সিঁড়ি ভাঙতেই হয় তাও বললাম। কিন্তু কেউই সঠিক হদিস দিতে পারলেন না। আমি এই বাড়ীতে ৫০ বছর আগে থেকেছি শুনে একজন ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি বাড়ীটা কেন খুঁজছি। সঠিক উত্তর দিতে পারলাম না। ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে মন্দিরের সামনের রাস্তায় চলে এলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। পাব কি খুঁজে সেই বাড়ী?

সিঁড়ি ভেঙ্গে নামলে বাড়ীসিঁড়ি ভেঙ্গে উঠলে বাড়ী

মন্দিরের মুখোমুখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখটা বন্ধ করে একমনে ভাববার চেষ্টা করলাম সেই রাস্তাটা যেটা ধরে ৫০ বছর আগে ছোট ছেলেটা অনায়াসে মন্দির থেকে বাড়ী পৌঁছে যেত। হঠাৎ মনে পড়ল বাড়ী থেকে মন্দিরের পাশ দিয়ে গেলে মন্দিরটা হাতের বাঁ দিকে পড়ত। তাহলে কি আমরা ঠিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আর আমাদের যেতে হবে বাঁ দিকে? চলতে শুরু করলাম আর মনে হতে লাগল সরু পাহাড়ী রাস্তাগুলো ভীষণ চেনা লাগছে। আরও মনে হল যেন আমরা আর বাড়ী থেকে বেশি দূরে নেই।

ঠিক এই সময় রাস্তার পাশের বাড়ীতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম সেই একই কথা যা করেছিলাম মন্দিরের ভদ্রলোকদের।

ভদ্রলোক কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। নামটা শুনে বললেন যে তিনি আমার বাবাকে মনে করতে পেরেছেন। ভীষণ আবাক লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীটা কি এখনও আছে? উনি আমাকে আর একটু কাছে ডেকে নিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে আঙুল দেখিয়ে বললেন “দেখতে পাচ্ছেন ওই সিঁড়িগুলো? সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেই ওই বাড়ীতে পৌছে যাবেন”। হেঁটে গিয়ে দাড়ালাম সিঁড়িগুলোর সামনে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে খুঁজে পেলাম বাড়ীটাকে। মনে

একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। বাড়ীটা ঠিক সেই রকমই আছে যেমনটা ছিল আমার স্মৃতিতে। এমনটা যে দেখব সত্যি ভাবিনি। বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মনে পড়তে লাগল সেই ছোটবেলার দিনগুলো। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে কত যে আনন্দ হয়…..

 

মন্দিরা পাশে দাড়িয়ে বোধহয় আমার মনের অস্থিরতার আঁচ পেয়েছিল, বলল “যাবেনা বাড়ীটাতে”?

শুকতারা পড়ার জায়গা

বেল বাজাতে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, তাকে একটু অস্বস্তির সঙ্গে বললাম “এই বাড়ীতে অনেক বছর আগে আমরা ভাড়া থাকতাম। অনেক স্মৃতি আছে এই বাড়ীটাকে ঘিরে, তাই বাড়ীটা আবার দেখতে এসেছি”। ভারী অবাক হলেন তিনি। ভেতরে আসতে বললেন। অনেক কথা হল। বুঝলাম উনি

সেই পরিবারেরই লোক। তথনকার দিনে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে দাদু ,দিদা আর নেই।আর যারা আমার পরিচিত ছিলেন তারা কেউ আর এই বাড়ীতে থাকেন না। বাড়ীর ভিতরটা ঘুরে দেখলাম। যে দিকটায় আমরা থাকতাম সেই দিকটাতেও গেলাম। হুবহু একই রকম আছে। দেখতে দেখতে ঘরের সামনের উঠোনে এসে দাড়ালাম। এই উঠোনে পিঠে রোদ লাগিয়ে বসে শীতকালে শুকতারা পড়তাম। সেখানে আমার একটা ছবি তুলতে বললাম মন্দিরাকে।

প্রায় কিছুই বদলায়নি এই বাড়ীটাতে ৫০ বছরে। এত মনে পড়ছিল ছোটবেলাটা যে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম যে আমি আজ চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে। সার্থক হল এই বাড়ীটা খুঁজে বার করার চেষ্টা।

বাড়ীর বাইরে এসে দেখলাম বাড়ীর চারপাশে আর কিছুই আগের মত নেই। নেই সেই পাইন গাছের সারি, না আছে বয়ে যাওয়া জলের ধারা। আছে উঁচু উঁচু বাড়ী, দোকান আর মানুষ এবং গাড়ীঘোড়ার ভীড়।

ফেরার সময়ে মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল, কারণ বাড়ীটা ঠিক সেইরকমই সুন্দর আছে আর

একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় বুঝতে পেরেছিল একদিন আমি ওকে খুঁজতে আসব আর আমাকে

দেখে ওরও নিশ্চয়ই খুব ভাল লেগেছে যে ছেলেটা এর মধ্যে কত বড় হয়ে গেছে।

 

হারিয়ে গেছে ছোট্ট ঝরণাখানি

হারিয়ে গেছে পাইন গাছের সারি

তবুও স্মৃতি জড়িয়ে নিয়ে গায়ে

জেগে আছে আমার বসতবাড়ি

এই সেই বাড়ী